পৌলোমী সেনগুপ্ত
আমাদের গজেনকাকার সামনে মুখ ফসকে কিছু বলার উপায় ছিল না। অন্তত বাবা কিছু বলতে পারতেন না, মা তো নয়ই।
সেবার খুব বৃষ্টি-বাদল যাচ্ছিল। একটানা তিন-চার দিন বৃষ্টির পর ধানবাদ শহরের মাঠঘাট, কবরখানার আশপাশ, গোশালা সব ডুবে গেল। রেল-লাইনের পাশে যে মস্ত ঝিল-মতন ছিল—যাকে আমরা লোকো ট্যাঙ্ক বলতাম, তার জল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। রেল-লাইনই না ডুবে যায়!
লোকো ট্যাঙ্কে অনেকেই মাছ ধরত তখন, বছরের বারো মাসই। কেউ শখ করে, কারওর বা নেশা ছিল মাছ ধরার। তা সেবারের ওই টানা বৃষ্টির পর ট্যাঙ্কের জল যখন ছাপিয়ে মাঠেঘাটে ছড়িয়ে গিয়েছে তখন মাছ-ধরার ধুম পড়ে গেল।
আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতেন চাটুজ্যেকাকা। মাছ ধরা ছিল তাঁর নেশা। তিনি ছিলেন রেলের গার্ডসাহেব। যেদিন বাড়িতে থাকতেন, কিংবা সুযোগ পেতেন, সেদিনই ছিপ হাতে বেরিয়ে পড়তেন মাছ ধরতে। এই চাটুজ্যেকাকা ওই সময় এক বড়সড় মাছ ধরেছিলেন ট্যাঙ্ক থেকে। সেই মাছ তিনি বাড়িতে ভাগাভাগি করে দু’-তিন বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের বাড়িতে এক ভাগ এসেছিল।
আমার মায়ের হাতের রান্না ছিল ভাল। আরও যত্ন করে মাছটা রাঁধলেন। বাবা যে খাইয়ে লোক ছিলেন—তাও নয়, তবে বাবার জিভের খুব তার ছিল। খেতে ভাল লাগলে খেতেন অল্প, তবে বলতেন বেশি।
মাছটা বাবার ভাল লেগেছিল। বললেন, “খুব স্বাদ মাছটার। চমৎকার স্বাদ। এমন মাছ জীবনে কমই খেয়েছি।”
কথাটা মুখ ফসকেই বলা। সকলেই এরকম বলে। গজেনকাকা বাবার মুখোমুখি বসে খাচ্ছিলেন, কথাটা শুনলেন। বললেন না কিছুই।
পরের দিন বিকেলে দেখি গজেনকাকা একটা ছিপ হাতে বাড়ি ঢুকছেন। আমরা অবাক। আমাদের বাড়িতে কোনওদিন কারওর হাতে ছিপ দেখিনি। বললাম, “ছিপ নিয়ে কী করবে, কাকা?”
“মাছ ধরব।”
“মা-ছ! কোথায়? লোকো ট্যাঙ্কে?”
“হ্যাঁ।”
“ছিপ কিনলে?”
“না, চেয়ে এনেছি দাসবাবুর কাছ থেকে। দেখব একবার। ছিপটা ভাল মনে হচ্ছে না।”
“কবে যাবে?”
“দেখি। মাছ ধরা কিছুই নয়। তবে তেমন একটা মাছ ধরায় অনেক হিম্মত লাগে। ভাল ছিপ দরকার।”
“তুমি যেদিন মাছ ধরতে যাবে—আমাদের নিয়ে যাবে তো?”
“বৃষ্টি না হলে নিয়ে যাব।”
খুবই খুশি হলাম গজনকাকার কথায়। লোকে ছিপ ফেলে মাছ ধরছে দেখেছি দূর থেকে, নিজেরা কখনও মাছ ধরতে যাইনি, ট্যাঙ্কের পাশে বসেও থাকিনি। যাক, এবার অন্তত গজেনকাকার শাগরেদ হয়ে মাছ ধরতে যাব।
দিন তিনেক কাটতে-না-কাটতেই একটা হইহই পড়ে গেল। পড়বারই কথা। গজেনকাকা ছিপ আনছেন তো আনছেনই। সারা ধানবাদ শহর ঘুরে এর-ওর কাছ থেকে কোনওটা সরু, কোনওটা লিকলিকে, কোনওটা মাঝারি, কোনওটা বা বড় মাপের ছিপ এনে জড়ো করতে শুরু করলেন। সবই চেয়েচিন্তে আনা। ঘরে বসে কয়েক দফা সেই ছিপ পরীক্ষা করতেন গজেনকাকা, তারপর যা করতেন সেটা আরও অদ্ভুত।
আমাদের নীচের দালানে একটা বড় চৌবাচ্চা ছিল। জলও ভরা থাকত। গজেনকাকা আমাদের বলতেন ভারী ভারী জিনিস এনে চৌবাচ্চায় ডুবিয়ে সেটা ছিপের ডগায় বেঁধে দিতে। আমরা মায়ের রান্নার বাসনকোশন, শিলের নোড়া, হামানদিস্তের মুগুর—যেখানে যা পেতাম এনে কখনও দড়ি দিয়ে বেঁধে দিতাম ছিপের ডগায়। গজেনকাকা ছিপ ধরে টান মারতেন। বলতেন, ছিপের ‘জান’ পরীক্ষা করছেন। আসলে কাকা কম-সে-কম একটা সাত-আট সেরি মাছ তো ধরবেনই। কাজেই কষ্ট করে মাছ ধরার পর যদি সেটা ওঠাতে গিয়ে ছিপ ভেঙে যায় তবে কী হবে?
কথাটা ঠিকই। আমরা ভাইবোনরা গজেনকাকার বুদ্ধির তারিফ করতাম।
এইসব কাজকর্ম একটু লুকিয়ে-চুরিয়ে হত, যেন মায়ের চোখে না পড়ে যায়। রান্নাঘরের বাসনপত্র শিলনোড়ার এই দুর্গতি মা সহ্য করবেন না।
ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। মা ধরে ফেললেন একদিন।
গজেনকাকা মাথা চুলকে বললেন, “দাদার সেদিন মাছটা খেতে খুব ভাল লেগেছিল। ওটা ছিল বড় কাতলা। পাকা রুই আরও ভাল লাগবে। আমি একদিন সের আষ্টেকের একটা মাছ ধরব ভাবছিলাম, বউদি।”
মা বিলক্ষণ চেনেন গজেনকাকাকে। বললেন, “মাছ পুকুরে থাকে, চৌবাচ্চায় নয়। তুমি পুকুরের পাড়ে গিয়ে বসে থাকো গে।”
গজেনকাকা বোধহয় দুঃখই পেলেন, কিন্তু হাল ছাড়লেন না।
বোধহয় পরের দিনই গজেনকাকা সটান ট্রেনে চেপে চলে গেলেন আসানসোল। সেখান থেকে সন্ধেবেলার গাড়িতে ফিরে এলেন মস্ত এক ছিপ নিয়ে। চকচকে হুইল। ছিপটা দেখে আমরা বেজায় খুশি। কাকা বললেন, আসানসোলের আঢ্যি কোম্পানিতে এর চেয়ে ভাল ছিপ আর ছিল না। কাগজে মোড়া আধ ডজন বঁড়শিও দেখালেন গজেনকাকা। ছোট-বড় বঁড়শি। আর সেই সঙ্গে লাল কাগজের মলাট দেওয়া, অনেকটা ধারাপাতের মতন দেখতে একটা বাংলা চটি বই, তাতে নানানরকম চার আর টোপ দেবার ফিরিস্তি লেখা আছে।।
এরপর দিন-দুই গেল চার তৈরি করতে। গজেনকাকা বইয়ের লেখা থেকে অর্ধেক নিলেন, অর্ধেক বার করলেন মাথা খাটিয়ে। বললেন, “দেখ, মাছ তো আর ছাগল নয় যে, যা পাবে খাবে, তাদের পছন্দ আছে। ওসব আজে-বাজে জিনিস দিয়ে চার আমি মাখব না। খেতে ভাল, গন্ধ আছে—এমন জিনিস দিয়ে চার তৈরি করব।”
গজেনকাকা কী কী জিনিস দিয়ে চার তৈরি করেছিলেন আজ আর তা মনে নেই—তবে এইটুকু মনে আছে, বেড়াল পচলেও তার চেয়ে খারাপ গন্ধ বেরোয় না। মায়ের ভয়ে গজেনকাকা বাগানে হাঁড়ি চাপা দিয়ে চার রেখে এসেছিলেন।
বাবার চোখে এত তোড়জোড় ধরা পড়ল নাকি মা কিছু বলে দিয়েছিলেন কে জানে—বাবা বললেন, “গজেন, তুমি কি ছিপের দোকান খুলবে?”
গজেনকাকা বিনয় করে জবাব দিলেন, “আজ্ঞে না।”
“তবে?”
“একদিন মাছ ধরতে যাব।”
“আচ্ছা! তা তোমার কি মাছ ধরার অভ্যেস আছে?”
“মোকামার গঙ্গায় ধরেছি।”
বাবা কৌতুক বোধ করছিলেন। “বাঃ, তবে তো তোমার হাতযশ আছে। চেষ্টা করে দেখো। তা মাছ ধরতে কোথায় যাবে ভাবছ?”
“আজ্ঞে লোকো ট্যাঙ্কে।”
“সে কী, তার জল তো শুকিয়ে গেল! মাছও শুনছি সব শেষ!”
এবার গজেনকাকা বিজ্ঞের মতন একটু হেসে বললেন, “শেষ কেমন করে হবে, দাদা! বাড়তি জলে যেসব মাছ ভেসে উঠেছিল সেগুলো হল হালকা মাছ। হালকা জিনিস জলে আগে ভেসে ওঠে, ভারী জিনিস থাকে তলায়। আমি কম করেও সাত-আট সেরি মাছ ধরব।”
গজেনকাকার কথায় বাবা হেসে বললেন, “তা ঠিক। দেখি ক’সেরি মাছ ধরতে পারো!”
পরের দিন গজেনকাকার শাগরেদ হয়ে আমরা দুই ভাই চললাম লোকো ট্যাঙ্কে মাছ ধরতে। অর্থাৎ গজেনকাকার মাছ ধরা দেখতে। মেয়েদের মাছ ধরতে যেতে নেই বলে তুলতুলিকে আমরা সঙ্গে নিলাম না। সে ভীষণ চটে গেল। মা বারবার বললেন, “জলে নামবে না তোমরা।”
বর্ষার দিন। মেঘলা অল্পস্বল্প হবেই। দু’-এক পশলা বৃষ্টিও হতে পারে। গজেনকাকা বড় একটা ছাতা নিলেন, আমরা দুই ভাই নিলাম ছোট ছোট ছাতা। গজেনকাকা ছিপটাকে ঘাড়ে চাপিয়ে ছাতার বাঁটে অমন বিদঘুটে গন্ধঅলা চারের কৌটো কাপড়ের পুঁটলিতে ঝুলিয়ে মাছ ধরতে চললেন। পিছু পিছু আমরা। দেখলে মনে হবে গজেনকাকা আমাদের সঙ্গিনধারী সেপাই।
লোকো ট্যাঙ্কের জল তখন সত্যিই কমে গিয়েছে। চারদিকে কাদাকাদা ভাব, বড় বড় ঘাস, নানারকম লতাপাতা, শ্যাওলা, শাপলা। ট্যাঙ্কের একদিকে রেললাইন অন্যদিকে মাঠ।
তখন দুপুর। ভাত খেয়ে আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। মাইল খানেকের বেশি হাঁটা হয়েছে। মেঘলা মেঘলা ভাব থাকলেও দরদর করে ঘামছি।
মাছ ধরার ভিড় নেই ট্যাঙ্কে। নেহাত মাছ-ধরার নেশা যাদের, তেমন পাঁচ-সাত জন বসে আছে ছাতা মাথায়।
অন্যদের অনেক দূরে রেখে গজেনকাকা একটা জায়গা বেছে নিলেন। জল-বরাবর সরুমতন একটা তক্তা পাতা, চারদিকে শ্যাওলা আর শাপলা। গজনকাকা তক্তার ওপর বসে বেশ কিছুক্ষণ সব নজর করলেন, তারপর চারের কৌটো খুলে সেই অদ্ভুত পদার্থ পাঁকের সঙ্গে মেখে নিয়ে তাল পাকিয়ে জলে ছুড়তে লাগলেন। গন্ধে বমি আসছিল আমাদের। কয়েকটা ব্যাং লাফিয়ে তক্তায় উঠল। আমরা তক্তার ত্রি-সীমানাতেও থাকলাম না।
গজেনকাকা হাত ধুয়ে একটা মহাদেব-মার্কা বিড়ি ধরালেন; বোধহয় গন্ধ কাটাতে।
বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর গজেনকাকা ছিপ, বঁড়শি সব ঠিকঠাক করে নিয়ে ছিপ ফেললেন। বললেন, “চারটে বঁড়শি দিলাম রে। বড় মাছ তো। কালোজাম আর রুটির টোপ দিয়েছি। বাবুরা নেচেনেচে ছুটে আসবে।” আমরা দুই ভাই সামান্য তফাতে বসে পড়লাম।
গজেনকাকা ছিপ ফেলে জলের দিকে তাকিয়ে তাকলেন। মাঝে মাঝে কথা বলছিলেন আমাদের সঙ্গে। মাছ ধরার গল্প বলছিলেন। মোকামার গঙ্গায় কাকা রুই, কাতলা, মৃগেল, গলদা কত কী ধরেছে। মাছ ধরা হল বুদ্ধির খেলা। মাছের সঙ্গে বুদ্ধি খেলিয়ে লড়তে হয়।
দেখতে দেখতে এক ঘণ্টা কাটল। বিকেল চারটের গাড়িও চলে গেল। মাঝে মাঝেই মালগাড়ি যাচ্ছে লাইন দিয়ে। মাটি যেন সামান্য কেঁপে উঠছিল গাড়ি যাবার সময়। যতবার গাড়ি যাচ্ছে, ততবার গজেনকাকা বিরক্ত হচ্ছেন, যেন মাছরা শব্দ শুনতে পাচ্ছে গাড়ির।
দু’ঘণ্টা কাটল। তিন ঘণ্টা। বিকেল শেষ। আকাশে একটু কালচে মেঘও উঠেছে। আমাদের ভয় করছিল, আর খানিকটা পরে বিকেল মরে সন্ধে হয়ে আসবে, বৃষ্টিও আসতে পারে। অন্ধকার হয়ে গেলে এখানে বসে থাকব কেমন করে!
গজেনকাকার কোনও হুঁশ নেই। ফাতনা দেখছেন একদৃষ্টে। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ সইয়ে নিচ্ছেন।
আমরা অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম। আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়! খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছিল। মাছরা একটুও নেচে নেচে আসছে না।
“কাকা?”
“উঁ!’’
“মাছ আর আসবে না। বাড়ি চলো।”
“আসবে।”
“আর কখন আসবে! এত দেরি হচ্ছে!”
“বড় বড় মাছ অনেক তলায় থাকে। তলা থেকে আসতে দেরি হয়। এইবার আসবে।”
আরও খানিকটা সময় গেল। অন্ধকার-মতন হয়ে আসছিল। বাদলা-হাওয়া আসতে লাগল। বৃষ্টি বোধহয় এসেই গেল।
হঠাৎ দেখি গজেনকাকা উঠে দাঁড়িয়েছেন। ছিপের হুইলে হাত। বললেন, “টোপ গিলেছে। এইবার বাছাধনকে…”
গজেনকাকা সুতো ছাড়তে লাগলেন।
আমরা হাঁ করে তাকিয়ে। সন্তু বলল, “কাকা, কী করছ?”
“মাছ খেলাচ্ছি।”
মাছ বোধহয় খেলতেই লাগল।
গজেনকাকার সব সুতো যখন ফুরিয়ে গেল, তখন কাকা আচমকা লাফ মেরে পেছন দিকে সরে এসে ছিপ হাতে দৌড়তে লাগলেন।
আমরা কিছুই না বুঝে ভয় পেয়ে কাকার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়তে লাগলাম।
শেষ পর্যন্ত কাকা মাঠের কাদার মধ্যে পা পিছলে একেবারে চিত হয়ে পড়লেন। হাতে ছিপ।
আমরা কাকার কাছাকাছি এসে হাঁফাতে লাগলাম।
কাকা বললেন, “বেজায় ভারী মাছ। দশ-বারো সের হবে। দেখ তো ডাঙায় উঠল কি না?”
দশ সেরের মাছ শুনে আবার আমরা ট্যাঙ্কের দিকে ছুটলাম।
গিয়ে দেখি, মাছের কোনও চিহ্ন কোথাও নেই। ভাঙাচোরা ফুটোফাটা শ্যাওলা মাখা একটা ছোট বালতি পড়ে আছে।
সন্তু চেঁচিয়ে বলল, “কাকা, মাছ নেই।”
কাদামাখা গজেনকাকা উঠে দাঁড়িয়েছেন। হাতে ছিপ।
কাছে এসে কাকা সব দেখলেন। তারপর বললেন, “মাছটা বড় চালাক, বালতি মাথায় দিয়ে টোপ খেয়েছে। কাল এসে বেটাকে ধরব।”
আমরা অবশ্য আর গজেনকাকার সঙ্গে মাছ ধরতে যাইনি।
২৭ অগস্ট ১৯৮০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন