পৌলোমী সেনগুপ্ত
ভুল করে পানের বদলে একশো টাকার নোটখানা চিবিয়ে খেয়ে মেরে দিয়েছেন, এটা টের পেলেন দোলগোবিন্দ দফাদার ‘মঙ্গলের হাটে’ এসে ভুসির দাম দেবার সময়।
হাটে গোলদার হারান দাসের কাছ থেকে হাজার কথা কয়ে দরাদরি করে আটানব্বই টাকা পঁচাশি পয়সায় পাঁচ বস্তা ভুসি সওদা করে বিনোদ গাড়োয়ানের গোরুর গাড়িতে বস্তাগুলো তোলাতে থাকেন দোলগোবিন্দ বেজার বেজার মুখে। কী বাজারই হয়েছে! একটা পয়সা কমাতে চায় না কেউ, পাঁচ বস্তা ভুসির দাম কিনা আটানব্বই টাকা পঁচাশি পয়সা!
আর আগে? কী সস্তাই ছিল। পাঁচসিকের বস্তা। ভাবছেন, হঠাৎ চমকে উঠলেন হারানের ডাকে, “মাল তো তোলাচ্ছেন কত্তা, আমার পাওনা টাকাটা মিটিয়ে দ্যান?”
শুনে দোলগোবিন্দর পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। কড়া গলায় বলেন, “তোর পাওনা টাকা নিয়ে কি আমি ভেগে পড়ছি হারান? ধারকর্জ রাখিনে আমি, এই নে—”
বলে ট্যাঁকের মোচড়পাক খুলে দামটা হারানের সামনে ফেলে দিলেন। দিতেই হারান ‘হাঁ’ হয়ে গিয়ে বলল, “কী এ?”
কী এ!
তাই তো! ব্যাপারটা কী! ‘হাঁ’ হয়ে গেলেন দফাদারও। মানে ব্যাপার দেখে দফাটা তাঁর রফাই হয়ে গেল। দেখলেন হারানের সামনে যেটা ফেলে দিয়েছেন তিনি, সেটা হচ্ছে কান-মোচড়ানো চামড়া-কোঁচকানো একখিলি সাজা পান। না, আট ভাঁজ করা একখানা একশো টাকার নোট নয়, ওই শুকনো পানের খিলিটাই!
ট্যাঁকের কষির মোচড়পাকের খাঁজে যেখানে একশো টাকার নোটখানার শুয়ে থাকার কথা, সেখানে ওই শুকনো শুকনো পানের খিলিটা শুতে এল কখন সেটা বুঝতে না পেরে দফাদার থতমত খেয়ে বললেন, “তাই তো! কী এ?”
হারান দাস ডোম্বল গলায় বলল, “গরিবের সঙ্গে আপনার আবার এ কী মশকরা কত্তামশাই?”
দফাদার রেগে আগুন হয়ে বললেন, “তোর সঙ্গে আমি মশকরা করছি হারান? বুঝে সমঝে কথা কইতে শিখিসনি?”
হারান বলে, “শিখব না কেন কত্তা? যা ফ্যাক্টো সেটাও তো দেখতে হবে। আমি শুধোচ্ছি মানেটা কী এর?”
ততক্ষণে বিনোদ গাড়োয়ান তার খ্যাঁদা নাকটি বাড়িয়ে ‘মানে’র গন্ধ শুঁকতে এসেছে, আর তার সঙ্গে হাটের এ-খাঁজ ও-খাঁজ থেকে নাক চলে আসছে কোনও একটি গোলমেলে গন্ধের আশায়।
দোলগোবিন্দ বিহ্বল গলায় বলেন, “মানে তো আমিই শুধোচ্ছি তোমায় হারান! বলি ট্যাঁক থেকে নোটটাই বা গেল কোথায়, আর পানের খিলিটাই বা এল কোথা থেকে?”
হারান বেজারস্য বেজার মুখে বলে, “এতকাল গোলদারি ব্যাবসা করছি কত্তা, এই মঙ্গলের হাটে এসে বেচাকেনাও করছি, ভুসিমালের কারবারও করে আসছি জ্ঞান অবধি, কিন্তু পানের খিলি দিয়ে দাম শুধতে তো দেখিনি কাউকে।”
দফাদার অগ্নিশর্মা হয়ে বলেন, “পানের খিলি দিয়ে তোর ভুসির দাম শুধতে এসেছি আমি? নোটখানা কোথায় হাওয়া হয়ে গেল আর পানটা কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল, সেটাই চিন্তা করছি।”
হারান দাস বলে, “তা আজ্ঞে করুন চিন্তে, বিনোদ তুই ততক্ষণ বস্তাগুলো গুনতি করে নামিয়ে ফের আমার চালার তলায় বসিয়ে দে ঠিক যেমনটি ছেলো।”
হারানের ওই চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনে দোলগোবিন্দর মুখখানা বনবিড়ালের মতো, আ মেজাজটা নিমপাতার মতন হয়ে গেল। কিন্তু— বলতে তো পারেন না, ‘খবরদার বিনোদ, বস্তা নামাবি না, নামালে তোর হাড়মাস আলাদা করে ছাড়ব।’
হ্যাঁ, মেজাজটা দোলগোবিন্দর ওই রকমই। কথায় কথায় তিনি লোকের হাড়মাস আলাদা করেন, মাথা গুঁড়িয়ে ছাতু করেন, পিঠের চামড়া ছাড়িয়ে নেন, নাক কান কেটে টিকটিকিকে দিয়ে খাওয়ান, ঠেঙিয়ে ‘বিন্দাবন’ দেখিয়ে দেন, ছুঁচোবাজি হেন চরকিপাক খাইয়ে ছাড়েন। কিন্তু এখনকার কথা আলাদা।
এখন হারান দাস সেই কান-মোচড়ানো গাল-তোবড়ানো পানের খিলিটাকে হাতের তালুতে রেখে সেই হাতটাকে টর্চবাতি ঘোরানোর মতন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাটসুদ্ধু লোককে দেখাচ্ছে, “দেখুন ভাই সবাই, দফাদারমশাই আমায় পাঁচ বস্তা ভুসির দাম দেছেন। একশত টাকার লোট।”
বলছে, আর দাঁত বার করে হাসছে।
শুনতে শুনতে দোলগোবিন্দর মুখটা বনবেড়ালের মতন থেকে ক্রমশ মেছো কুমিরের মতন হয়ে উঠছে। ঠিক এই সময় আলুওলা গগন গড়াই নাকের সঙ্গে মুখটাও এগিয়ে এনে বলে, “আচ্ছা দফাদারমশাই, নোটখান নিয্যস এনেছিলেন তো? না কি ঘরেই ফেলে এসেছিলেন, ভাবুন তো জম্পেস করে।”
দফাদার আগুন গলায় বলেন, “এর আবার জম্পেস করে ভাববার কী আছে হে গড়াই? মাল সওদা করতে হাটে আসব আর টাকা আনব না? একশো টাকার নোটখানা ক্যাশবাক্স থেকে বার করে— মা কালীর ছবির চরণে ছুঁইয়ে কপালে ঠেকিয়ে ট্যাঁকে নিলাম, তখন ভজ পিছু ডাকল। ওই পিছু ডাকই সর্বনাশের গোড়া। তা তখন ভজ পিছু ডেকে বলল, ‘বাবা, মা বলল, সাত সকালে একধামা গুড়মুড়ি গিলে পাঁচ-সাত মাইল হাঁটতে বেরোচ্ছ, এই নুন-জোয়ান দেওয়া পানটা খেয়ে নাও, নচেৎ অম্বল উঠবে।’ ওই নুন-জোয়ানের পান আমার দু’চক্ষের বিষ, তবু দেরির ভয়ে তক্কাতক্কি না করে, পানটা গালে ফেলে কোমরের কষি শক্ত করে বেরিয়ে এলাম চটপট।”
“বেরিয়ে এলেন চটপট?”
গগন গড়াইয়ের মুখে একটি অলৌকিক হাসি ফুটে ওঠে, তবু সেটা চেপে টিপে টিপে বলে, “লোটটা ট্যাঁকে রাখলেন, পানটা মুখে ফেললেন, বেরিয়ে এলেন চটপট, কেমন?”
দোলগোবিন্দ বেশ বোঝেন, সুবিধে পেয়ে এরা তাঁকে নিয়ে মজা দেখছে। রাগে তোতলা হয়ে ওঠেন দোলগোবিন্দ, বলেন, “তা— তা— তাইতো। এ নিয়ে অ্যা— অ্যা— অ্যাতো জে— জেরার কী আছে শু— শুনি?”
“আহাহা জেরা কীসের? আপনি একটা মান্যমান ব্যক্তি, আপনাকে জেরা করবে গগন গড়াই? শুধু শুধোচ্ছি পানটা তা হলে ঠিক ওই যাত্রাকালেই গালে ফেলেছিলেন?”
দোলগোবিন্দ তাকিয়ে দেখেন, হাটসুদ্ধু লোক তাঁর দিকেই তাকিয়ে, আর বিনোদ গাড়োয়ান ভুসির বস্তাগুলো নামিয়ে নামিয়ে হারানের চালায় ঢোকাচ্ছে। এই অপমান আজ বরদাস্ত করতে হল দোলগোবিন্দকে শুধু একটা ভুতুড়ে কাণ্ডয়।
ইচ্ছে হচ্ছে হাটসুদ্ধু সবাইকে নাকে নস্যি দিয়ে হাঁচান, চোখে লঙ্কা দিয়ে কাঁদান, সিদ্ধির শরবত খাইয়ে হাসান। আর ওই হারানটাকে?
ইচ্ছে করছে— ইচ্ছে করছে, কী ইচ্ছে করছে ভাববার আগেই গগন গড়াই নিরীহ গলায় বলে, “তা পানটা আজ্ঞে ভালই খেয়েছিলেন তো? বেশ মিঠে মিঠে, নুন ঝাল? যেমনটি রোজ খান?”
এ কথার মানে? পানটা যে দোলগোবিন্দর বিচ্ছিরি লেগেছিল, একথা ও জানল কী করে?
তবু চড়াগলায় বললেন, “সেই অবধি পান পান করে মাথা ঘামাচ্ছ কেন হে গগন? বলি পানটা আমার পানের মতন লেগেছিল কি কাঠ-খড়-কাগজ-শালপাতার মতন লেগেছিল, তাতে তোমার কী আসছে যাচ্ছে?”
গগন গড়াই অমায়িক গলায় বলে, “আমার কিছুই আসছে না দফাদারমশাই, আপনার যাচ্ছে এই একশো টাকার লোটখানা। ধরুন তাড়াতাড়িতে আপনি, মানে ভুলক্রমে আরকী! সেবার যেমন লাঠিগাছটাকে বিছানায় শুইয়ে নিজে সারারাত ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থেকেছিলেন।”
“অ্যাঁ!”
হঠাৎ যেন একটা বিদ্যুতের শলা দফাদারের মগজটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে যায়।
সর্বনাশ!
এই কাণ্ড করে বসেছেন তিনি?
ঠিক ঠিক। করেই বসেছেন। তাই পানটা মুখে ফেলা পর্যন্ত মেজাজটা বোদা হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল পান খাচ্ছি না, কাগজ খাচ্ছি।
তার মানে কাগজই খাচ্ছিলেন।
সেই আট-ভাঁজ-করা ময়লা কাগজখানা। চিবোচ্ছেন আর চিবোচ্ছেন, রস আর বার করতে পারছেন না।
হায়! হায়!
আর তিনি কিনা তখন মনে মনে ভজর মা’র মুন্ডুটাকেও চিবোচ্ছিলেন, একটা বাসী পান গছিয়েছে বলে।
দোলগোবিন্দ প্যাঁচার মতো মুখে, গলা নামিয়ে বলেন, “চেপে যা গগন!”
গগন গড়াই বলে, “তা আর বলতে।”
কিন্তু রহস্যটা তো সকলের কাছে ভেদ হয়নি। তাই সবাই নাক বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে, “ব্যাপারটা কী হল গড়াইমশাই? ব্যাপারটা কী হল?”
গগন গড়াই একটা চোখ টিপে বড় গলায় বলে, “কিচ্ছু না কিচ্ছু না। সামান্য এদিক-ওদিকের ব্যাপার। যান দফাদারমশাই, ঘরে যান। সামনের হাটে মাল তুলবেন।… যাও যাও ভাই, তোমরা নিজ নিজ কাজে যাও!”
দোলগোবিন্দ তাঁর ঐতিহাসিক ছাতাটি বগলে চেপে সাঁ করে উলটো মুখে মুখ ঘুরিয়ে গটগট করে এগিয়ে গেলেন মনে মনে নিজের গালে-মুখে চড়াতে চড়াতে।
উঃ! এই অপকর্মটি যদি বোঁচা করে বসত? নির্ঘাত তাঁর এই নতুন ছাতাটি তার পিঠে ভাঙতেন। ‘পাগলে কী না কয়, আর ছাগলে কী না খায়’ বলে ছেড়ে দিতেন না।
ছাতাটা অবশ্য দোলগোবিন্দর বাবা রাসগোবিন্দর দরুন, কিন্তু দু’-দু’বার ওর বাঁট বদলানো হয়েছে, আড়াইবার শিক, আর বার তিনেক কাপড় পালটানো হয়েছে। এতেও যদি ‘নতুন’ বলা না হয় তো কীসে হবে? তবু ওটাই বোঁচার পিঠে ভাঙতেন দোলগোবিন্দ, যদি বোঁচা এই অকর্মটি করে বসত।
সেবার যখন ক্যালেন্ডারের রাধাকৃষ্ণর ছবিখানা চিবিয়ে মেরে দিয়েছিল বোঁচা, ভাঙেননি দোলগোবিন্দ তার পিঠে আস্ত ছাতাটা?
দ্বিতীয়বার বাঁট বদলের কারণটাই তো তাই।
দোলগোবিন্দর ইচ্ছে হল নিজেকে বোঁচার জায়গায় দাঁড় করিয়ে ছাতাটা উঁচিয়ে ধাঁই ধাঁই পিটোতে থাকেন, যতক্ষণ না ভাঙে। ধাঁই পটাপট ধাঁই পটাপট!
কিন্তু সত্যি কি আর নিজেকে ছাতা পেটানো যায়? যায় না, তাই ছাতাটাকে বগলে চেপে বাড়িই ফিরতে গেলেন।
গেলেন, তবে যাওয়া হল না। খানিকটা গিয়ে মনটা হঠাৎ ঘুরে গেল। দূর ছাই কী হবে এক্ষুনি বাড়ি ফিরে? ঘোড়েল গগন গড়াই তখন ভালমানুষটি সাজলেও দোলগোবিন্দর এই লোকহাসানো কীর্তির কথা নিয়ে ঢাক পেটাতে বাকি রেখেছে নাকি? দু’চাকার গাড়িতে চড়ে রাজ্যি জয় করে বেড়ায়, কখন পৌঁছে গেছে।
একবার বুক ফুলিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলেন, বলেছে তো বলেছে, এত ভয়টা কী? নিজের নোট খেয়েচি বই তো অপরের খেতে যাইনি। কিন্তু ভাবতে জোর পেলেন না। সব থেকে ভয় ওই গিন্নিটিকে। ভজগোবিন্দর উপযুক্ত জননী।
শুনতে যা দেরি, এ কুলের ও কুলের তিনকুলের সক্কলকে ডেকে ডেকে বলবে আরও রংচং মিশিয়ে।… বলি ভুল তো মানুষেরই হয়। পশুপক্ষী তো ভুল করতে যায় না? তা সে-কথা বুঝবে না, তিলকে তাল করে তুলবে।
এই তো কবে যেন একদিন দোলগোবিন্দ কুলুঙ্গির ভেতরে পড়ে-থাকা টেঁপির কানফুল জোড়াটাকে সুপুরির ভুসো ভেবে গালে ফেলে চিবিয়ে ফেলেছিলেন। এই সামান্যকে নিয়ে কী কাণ্ডই না করে বেড়াল!
মেয়ের দোষটি কেউ দেখল না।
যত দোষ নন্দ ঘোষ দোলগোবিন্দর।
কেন, মেয়ে কেন সেইখানেই ফুলজোড়াটি রাখতে গেছল, বাবা যেখানে সুপুরির কৌটো রাখে?
পৃথিবীতে আর জায়গা ছিল না?
ঘুঁটের মাচা নেই?
কয়লার বস্তা নেই?
গোয়াল নেই?
ঢেঁকিঘর নেই?
বাবার জায়গাটিতেই দরকার?
দোলগোবিন্দ গোছানো মানুষ, অতশতর কী জানেন? ভেবেছেন, কৌটোয় রাখতে ধারেপাশে ছড়িয়ে পড়ে যাওয়া এই সুপুরি-কুচো, এগুলোই আগে শেষ করি।
হায়, কে জানত, তারাই শেষ করবে দোলগোবিন্দকে। কানফুলের সেই খোঁচা কোণ মাড়িতে ফুটে গিয়ে দোলগোবিন্দর গাল ফুলে কুমড়ো! বড় ডাক্তারের চিমটেয় সেই সোনার খোঁচা বেরোল।
তবু লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে কিনা বেদরদে পাড়াসুদ্ধু সবাইকে বলে বেড়িয়েছে, “বাবা না… হি হি… সুপুরি ভেবে… হি হি… আমার কানের ফুল দুটোকে মুখে ফেলে… হিহিহিহি হিহি হিহি… চিবিয়ে চিবিয়ে না… হিহি… গাল ফুলিয়ে হিহি—”
আর তারপরও কিনা নতুন একজোড়া কানফুল আদায় করে ছেড়েছে। এই পৃথিবী!
আর সেবার টেঁপির মা’র মোটা গোট হারটাকে কুকুর বাঁধা পেতলের চেন ভেবে বোঁচাকে বাঁধতে গিয়ে?
নাঃ, সে-কথা আর মনে না আনাই ভাল। তুমি সোনার হার ছড়াটাকে আলনায় দুলিয়ে রেখে চান করতে গেছ, এ-কথা কে বুঝবে?
দুর, দুনিয়ায় কেউ কারও নয়। এ সংসার ত্যাগ করাই উচিত।
কিন্তু উচিত বললেই তো হল না?
ত্যাগ করার উপায় কোথায়?
আসছে মঙ্গলবারে আবার ওই শেয়ালমুখো হারান দাসের কাছ থেকে পাঁচ বস্তা ভুসি কিনতে হবে না? বর্ষার আগে গোয়ালের চাল ছাইতে হবে না? টেঁপির বিয়ের জন্যে পাত্তর দেখতে হবে না তোড়জোড় করে? কাজের কি শেষ আছে? এসব সমাধা করে তুলে, তবে না সংসার ত্যাগ? তার চেয়ে বরং একবার বটু ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলে দেখলে হয়, “ডাক্তার, তোমাদের শাস্তরে এই ভ্রান্তিরোগের কোনও দাওয়াই আছে? বড়ি, গুলি, জলগোলা, যা হোক—”
ডাক্তারের বাড়ির পথে মোচড় খেয়েছেন, আর দেখেন প্রাণের বন্ধু পতিতপাবন আসছে হনহনিয়ে। পতিতপাবনের তিব্বতি লামার মতো লতানে গোঁফজোড়াটি কাঠবেড়ালির ল্যাজের মতো খোঁচা হয়ে উঠেছে, আর গায়ের লোমগুলো আলপিনের আগার মতো।
দোলগোবিন্দকে দেখেই পতিত চিৎকার করে ওঠে, “এই যে দোলু, তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম। বলি, আমার ছাগল যদি আমি ল্যাজে কাটি, তাতে কার কী?”
দোলগোবিন্দ এই রণমূর্তি দেখে তাড়াতাড়ি বলেন, “কারওর কিচ্ছু না।”
“আমি যদি ছাগলের দামে গোরু বেচি, কার কী?”
দোলগোবিন্দ আবার বলে ওঠেন, “কিচ্ছু না।”
পতিতপাবন ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, “তবে? তবে গিন্নি কেন বলছে, আমি নাকি গাঁজা ধরেছি! বলছে দোলগোবিন্দ দফাদারের সঙ্গে মিশেমিশেই আমার এই দফাগয়া দশা হয়েছে।”
নিজের নাম শুনে দোলগোবিন্দ রেগে উঠে বলেন, “আমার কথা উঠছে কেন? আমার কথা উঠছে কেন?”
“ওই তো, বলে কে। একটু এদিক-ওদিক হলেই নানান কথা তুলবে।”
দোলগোবিন্দ একটু গুম হয়ে গিয়ে বলেন, “তা বর্তমানে কোন এদিক-ওদিকটা হল?”
পতিতপাবন উড়িয়ে দিয়ে বলে, “কিস্যুই না। গেল শনিবারের হাটে বশির শেখের সঙ্গে কথা হয়েছিল আমার একটা ছাগল ওকে বেচব। দেড়কুড়ি টাকা দরও দিয়েছিল। আর বলেছিল ছাগলটা যেন বেশ পুরুষ্ট হয়। সেই কথামতো নিয়ে গেছি একটাকে বেছেগুছে—” পতিতপাবন এখন একটু মাথা চুলকে বলে, “খেয়াল করিনি সেটা আমার কালো গাইটা।”
“অ্যাঁ।”
দোলগোবিন্দ তাঁর বিরাট বপুখানি নিয়েও প্রায় আধহাত লাফিয়ে উঠে বলেন, “বলো কী হে পতিতপাবন? অ্যাঁ? ছাগল বলে তুমি কালো গাইটাকে!!! হা হা হা। তুমি যে আমাকেও হারালে।… তা বলি, বশির কিছু বলল না?”
পতিতপাবন আরও মাথা চুলকোয়। পতিতের গোঁফজোড়াটা আবার তিব্বতি লামার মতন লতিয়ে যায়, পতিতপাবন কাঁচুমাচু মুখে বলে, “মিথ্যে বলব না ভাই, বলেছিল। দেখেই বলেছিল, ‘এটা কী আনলেন ঘোষমশাই?’… আমিই রেগেমেগে বললাম, ‘দেখতে পাচ্ছিস না কী আনলাম? চোখ নেই? কানা? যেমন বলেছিলি পুরুষ্ট দেখে আনতে, তেমনি সবসেরা ছাগলটাই নিয়ে এসেছি।’… তা ও ব্যাটা আমার সঙ্গে চালাকি খেলল। কোথায় বলবে, ‘ঘোষমশাই ছাগল কোথা? এটা যে গোরু।’ তা হলে আমার খেয়ালে আসে। তা নয়, মিটিমিটি হেসে বলল কিনা, ‘কী খাইয়ে এতখানিটি করে তুলেছেন ঘোমশাই?’ আমারও রাগ উঠে গেল, বললাম, ‘তোর মতন নই রে বশির যে, পোষা প্রাণীকে শুধু মাঠে ছেড়ে দিয়েই কর্তব্যে খালাস হব। দস্তুরমতো খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছি। শুনে-না ফ্যাকফ্যাক করে হেসে, সেলাম ঠুকে চলে গেল। তারপর ভাই বাড়ি ফিরে যা হবার তাই। দেখি গিন্নি উঠোনে গড়াগড়ি দিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ছে। বুক চাপড়াচ্ছে। আমায় দেখে মাথা ঠুকতে বসল, ‘ছাগলের বদলে তুমি বুধিকে হাটে বেচে দিয়ে এলে। দিনে তিন চার সের করে দুধ দিচ্ছিল বুধি।’”
“ইস!”
দোলগোবিন্দ বলেন, “তা তুমি গিয়ে বললে না বশিরকে?”
পতিতপাবন বলে, “বলিনি আবার? সেই শনি থেকে এই মঙ্গল— এই তিন-চারদিন ধরে হাঁটাহাঁটি করে জুতোর তলা খয়ে গেল। তা মানতে চায় না ব্যাটা। হেসে হেসে বলে, “আপনি বেচলেন ছাগল, আমি কিনলাম ছাগল, এর মধ্যে গোরু আসে কোথা থেকে ঘোষমশাই?’… তা রেগে টেগে ভাবলাম, চুলোয় যাক। ভুলটা যখন আমারই, লোকসানটা আমারই হবে। কিন্তু এদিকে গিন্নি থেকে, ছেলেরা থেকে, পড়শিরা পর্যন্ত গঞ্জনা দিয়ে দিয়ে আমায় তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না ভাই। তাই এখন আমিও মেজাজ ধরেছি, বলি, আমার গোরু আমি ছাগলের দামে ছাড়ব, তাতে লোকের কী?”
দোলগোবিন্দ উদাস ভাবে বলেন, “সেই তো মজা। সংসারের নিয়মই এই! লোকের কিচ্ছু না, তবু লোকে— তা নইলে আর আমি পান বলে ভুল করে একশো টাকার নোটখানা খেয়ে ফেলে, বাড়িপানে না গিয়ে ডাক্তার-বাড়ির পানে ছুটছি কেন?”
“অ্যাঁ, কী বললে?” পতিতপাবন স্থির চক্ষে কিছুক্ষণ বন্ধুকে— যাকে বলে— অবলোকন করে, হঠাৎ হাসতে শুরু করে। হা হা হা! হাসি আর থামেই না।
তারপর অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে, “চলো চলো, তোমায় আমার গিন্নির কাছে নিয়ে যাই। দেখি কাকে ফাস্টো করে—”
দোলগোবিন্দ বলেন, “তার আগে তোমাকে আমার গিন্নির কাছে—”
“উঁহু আগে তোমায় আমি—”
“উঁহু আগে তোমায় আমি—”
“না না, আগে তোমার—”
“আরে না না, আগে তোমায়—”
“বলছি আগে তোমায়—”
“বলছি আগে তোমায়—”
দুইবন্ধুতে দু’জনার হাত ধরে টাগ অব ওয়ার চালাতে থাকে। কেউ কাউকে একচুল নড়াতে পারে না। কারণ দু’জনেই সমান বলশালী।… দোলগোবিন্দ যেমন একধামা মুড়ি-গুড়ে ব্রেকফাস্ট সারেন, পতিতপাবন তেমনি সারেন এক গামলা নুন পান্তোয়।
সারাদিন ওই রেটেই আহারাদি চলে, কাজেই কে যে কাকে আগে গিন্নির কাছে ধরে নিয়ে যেতে পারবে, বলা শক্ত। অতএব কে ফার্স্ট হবে তাও এখন বলা যাবে না। পারো যদি তোমরাই বলো।
চৈত্র ১৩৮২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন