সংকটমোচন কমিটি – প্রচেত গুপ্ত

পৌলোমী সেনগুপ্ত

সংকটমোচন কমিটি – প্রচেত গুপ্ত

ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ জরুরি মিটিং ডেকেছে। ভূতলোকে আগে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ বলে কিছু ছিল না। ইদানীং হয়েছে। বাংলায় তারা এর নাম দিয়েছে ‘সংকটমোচন কমিটি’। কমিটি তৈরি না করে কোনও উপায় ছিল না। শুধু হেসে-খেলে, ভয় দেখিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরেফিরে বেড়ানোর দিন আর নেই। আজকাল প্রায়ই তাদের কোনও না-কোনও সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। তার মধ্যে কোনও কোনও সমস্যা তো খুবই জটিল। এইসব সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই কমিটিকে মাঝেমধ্যে আলোচনায় বসতে হয়। তবে বেশিরভাগ সময়েই ঝগড়া লেগে যায় এবং মাঝপথে মিটিং ভেস্তে যায়। তবে এবার শোনা যাচ্ছে, সমস্যা শুধু জটিল নয়, মারাত্মক রকম জটিল। শ্রীনিবাস, কালিপদ আর ঝন্টু মিটিংয়ে সেই সমস্যার কথা সকলকে জানাবে।

সমস্যাটা কী?

একটা সময় ছিল যখন ভূতেরা হুটহাট মিটিং ডাকত না। তিথি, পঞ্জিকা ঘেঁটে, অমাবস্যা দেখে তবে দিনক্ষণ স্থির হত। তারপর বাছা হত জায়গা, মিটিংয়ের ভেনু যাকে বলে। জায়গার অবশ্য কোনও অভাব ছিল না। কলকাতা শহর আর তার আশপাশে পোড়ো বাড়ি, বনবাদাড় ছিল প্রচুর। বেহালা, টালিগঞ্জ বা লেকটাউন অঞ্চলে একটু খোঁজ নিলেই চমৎকার চমৎকার সব বাঁশবন পাওয়া যেত। সেখানে দিনের বেলাতেও ঝুমমারা অন্ধকার। ভবানীপুর, হাতিবাগানের দিকে সহজে পোড়ো বাড়িও মিলত। দরজা-জানলা ভাঙা, দেওয়ালে বটগাছ, ঘরের মধ্যে মাকড়সার জাল আর চামচিকের বাসা। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য একেবারে আদর্শ পরিবেশ। ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঝিঁঝি ডাকছে, হাওয়া বইছে শিরশির করে, দূর থেকে ভেসে আসছে শিয়ালের ডাক। সব মিলিয়ে গা ছমছমে একটা ভাব। গা ছমছমে ভাব থাকলে ভূতেদের বুদ্ধি খোলে।

আজকাল এসব পাট উঠে গিয়েছে। বাঁশবনই বা কোথায়? পোড়ো বাড়িই বা কে দেবে? চারপাশে উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি, চওড়া চওড়া রাস্তা, লম্বা লম্বা ফ্লাইওভার। সর্বনাশের কথা হল, শহরে পূর্ণিমা-অমাবস্যা বলে আর কিছু নেই। সন্ধে হলেই ঝলমল করছে আলো। রাস্তায় আলো, শপিংমলে আলো, বাড়িতে আলো। এমনকী, বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংগুলো পর্যন্ত আকাশে আলো জ্বেলে বসে আছে সারারাত। পূর্ণিমার চাঁদ থেকেও নেই। অমাবস্যার অন্ধকার তো একেবারে ভ্যানিশ। শহুরে ভূতের দল ঠান্ডা মাথায় খানিকক্ষণ বসে যে নিজেদের মধ্যে দুটো কথা সেরে নেবে, সে উপায় নেই। কিন্তু তা বলে তো আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। মিটিং তো করতেই হবে। বিশেষ করে সমস্যা যখন মারাত্মক, তখন সংকটমোচন কমিটিকে বসতেই হবে।

তাই ঝপ করে লোডশেডিং হতেই এমার্জেন্সি মিটিং ডাকা হয়েছে। অমাবস্যার বদলে লোডশেডিংই এখন ভরসা। গতবার সংকটমোচন কমিটির মিটিং ডাকা হয়েছিল মেট্রোরেলের টানেলে। কালীঘাট থেকে এসপ্ল্যানেডের মাঝখানের সুড়ঙ্গের ভিতরে খানিকটা জায়গায় আলো নেই। বেশ একটা স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার। গভীর রাতে মিটিং শুরু হল। সেবারও আলোচনার বিষয় ছিল খুবই জরুরি। জরুরি এবং উদ্বেগজনক। কলকাতায় ভূতেদের থাকবার জায়গা হু হু করে কমে যাচ্ছে। বনবাদাড়, পানাপুকুর, ডোবা, পোড়ো বাড়ি নেই। এদিক-সেদিক দু’-চারটে ঝোপঝাড় যা পড়ে আছে, সেখানে আস্তানা গাড়তে গেলে ভাড়া গুনতে হচ্ছে ডবল। পুরনো বাড়ি খুঁজে ফ্যামিলি নিয়ে ঢুকতে গেলে মোটা সেলামি লাগছে। ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদের কোনায় যে গা ঢাকা দিয়ে থাকবে, সে-পথ বন্ধ। সারারাত বড় বড় আলো জ্বলছে। লোকের বাড়ির খাটের তলায়, আলমারির পিছনে যে ঘাপটি মেরে দিনটুকু কাটবে, তাও সম্ভব নয়। আজকাল আলমারিগুলো সব দেওয়ালের সঙ্গে সাঁটা। পিছনে লুকিয়ে থাকবার জায়গা কোথায়? বেডরুমের খাটগুলো এতই নিচু যে, মেঝের সঙ্গে যেন লেগেই থাকে। ঘণ্টাখানেক নীচে গুড়ি মেরে থাকলে ঘাড়ে-পিঠে এমন ব্যথা হয় যে, গরম তেল মালিশেও সে ব্যথা যায় না। শপিংমল, মাল্টিপ্লেক্সের মতো ঝাঁ চকচকে যেসব জায়গা হয়েছে, সেখানেও বাসা বাঁধার চেষ্টা হয়েছে, লাভ হয়নি। ওসব জায়গায় সিকিউরিটির বড্ড কড়াকড়ি। টুপি পরা পাহারাদার হাতে লাঠি নিয়ে সর্বক্ষণ ঘোরাফেরা করে। তার উপর আজকাল আর-এক নতুন ফ্যাচাং হয়েছে। মাঝেমধ্যেই বোমা, গুলি লুকনো আছে কি না খুঁজে দেখতে বাঘের মতো বড়-বড় কুকুর নিয়ে পুলিশ ঘুরে বেড়ায়। তারা ফোঁস ফোঁস করে। অন্ধকার আনাচে কানাচে যখন তখন নাক ঢুকিয়ে দেয়।

এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই গতবার মিটিং হয়েছিল। মিটিং চলছিলও গড়গড়িয়ে। নানা ধরনের প্রস্তাব উঠছিল। কেউ বলছিল, ভূতেদের জন্য আলাদা হাউজিং কমপ্লেক্স চাই। সেখানে দোকান-বাজার থাকবে, অডিটোরিয়াম থাকবে, সুইমিংপুল থাকবে। ছেলেপুলেরা সাঁতার শিখবে। কারও বক্তব্য হল, আগে বাড়িওলা-ভূতেদের অত্যাচারের হাত থেকে ভাড়াটে-ভূতেদের রক্ষা করতে হবে। সামান্য কয়েকটা পুরনো বাড়ির দখল নিয়ে তারা যে জোরজুলুম শুরু করেছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। কারও মতে, এবার একটা জম্পেশ ধরনের বন্‌ধ না ডাকলেই নয়। প্রতিবাদ দেখানোর সময় এসেছে।

কমিটির আলোচনা সিরিয়াস দিকেই এগোচ্ছিল। কিন্তু যথারীতি মাঝখানে গোলমাল বেধে গেল। গোলমালের বিষয় মিটিংয়ের ভেনু। বৃদ্ধ ক্ষিতীশ পাকড়াশি হঠাৎ বিরাট হম্বিতম্বি শুরু করলেন, “এই যে কমিটির মাথারা, তোমরা ভেবেছটা কী? অ্যাঁ, কী ভেবেছ? জানোও না রাতে মেট্রো স্টেশনগুলোতে এসকালেটর বন্ধ থাকে? নাকি জেনেও রসিকতা করছ? এখন কী হবে? ফেরবার সময় অত সিঁড়ি ভেঙে আমি উঠব কী করে? আমার কোমরে ব্যথা, হাঁটুতে বাত। তোমাদের কি বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেল হে? আমাকে কি বেঘোরে মারতে চাও?”

সেদিন মিটিংয়ের সভাপতি ছিলেন শশিভূষণ চাকলাদার। শশিভূষণবাবু অল্পেই মাথা গরম করে ফেলেন। অভিযোগ শুনে তিনি হাত-পা ছুড়ে বললেন, “ভূত আবার বেঘোরে মরবে কী? ভূত কখনও মরে? এতদিন তো জানতাম মরেই ভূত হয়। তা ছাড়া বাতের ব্যথায় আপনার হাঁটার দরকার কী ক্ষিতীশবাবু? হাওয়ায় ভেসে চলে যাবেন। ভূত যখন হয়েছেন, ভাসতে তো অসুবিধে কিছু নেই। মানুষ হলে একটা কথা ছিল।”

ক্ষিতীশ পাকড়াশি হাতের লাঠি বাগিয়ে, চোখ পাকিয়ে বললেন, “খবরদার শশী, মানুষ বলে গালাগালি দেবে না বলে দিলাম। কমিটির সভাপতি হয়েছ বলে মাথা কিনে নাওনি। আমি হেঁটে যাব না হামাগুড়ি দিয়ে যাব, তোমাকে শেখাতে হবে না।”

খুবই ছেলেমানুষি ধরনের ঝগড়া। কিন্তু দ্রুত ঝগড়া এমন জায়গায় গড়িয়েছিল যে, আলোচনা শিকেয় উঠেছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতাহাতি শুরু হতেই মিটিং ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল। এবার তাই ভেবেচিন্তে মিটিংয়ের জায়গা ঠিক হয়েছে গড়িয়ার ফ্লাইওভারে। এই ফ্লাইওভার এখনও তৈরি হয়নি। কাজ চলছে। সেখানে মানুষের হট্টগোল নেই, গাড়ির চোখধাঁধানো হেডলাইটও জ্বলে না। কমিটির কেউ বসেছে রেলিংয়ের উপর অন্ধকারে মিশে, কেউ বসেছে পিলারের আড়ালে ছায়া হয়ে, কেউ আছে ইটের পাঁজার ফাঁকফোকরে ঢুকে। মাথাটুকু শুধু বের করে রেখেছে। অল্পবয়সিরা অনেকেই ফ্লাইওভারের নীচে রড ধারে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে।

সংকটমোচন কমিটি আজ জ্ঞানদাশঙ্কর ভট্টাচার্য মহাশয়কে মিটিং চালানোর দায়িত্ব দিয়েছে। প্রবীণ জ্ঞানদাশঙ্কর একসময় ছিলেন ঠান্ডা মাথার বুদ্ধিমান মানুষ। ভূতজীবনে প্রবেশের পরও একই রকম আছেন। কমিটির আশা, উনি ঝগড়া ছাড়াই মিটিং পরিচালনা করতে পারবেন এবং সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও না-কোনও পথ বলে দিতে পারবেন। দায়িত্ব পেয়ে আজ জ্ঞানদাশঙ্করবাবু খুশি। তিনি পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এসেছেন। মিটিং শুরুর আগে সংকটমোচন কমিটির পক্ষ থেকে গলায় গাঁদাফুলের মালা পরিয়ে তাঁকে বরণ করা হল। জ্ঞানদাশঙ্করবাবু লজ্জিত মুখে বসলেন খানিকটা উঁচুতে, একটা ক্রেনের মাথায়। তারপর দু’বার গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, “ভাইসব, আপনারা শান্ত হোন। হাতে বেশি সময় নেই। যে-কোনও সময় ইলেকট্রিসিটি চলে আসবে। সুতরাং আমাদের আলোচনা দ্রুত শেষ করতে হবে। মনে রাখবেন, ভূতসমাজ এই মুহূর্তে যে-বিপদের মুখোমুখি হয়েছে, তা অতি মারাত্মক। এই সংকট থেকে যদি আমরা নিজেদের রক্ষা না করতে পারি, তা হলে আমাদের অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি পড়ে যাবে। মানুষের অত্যাচার আমাদের কম সহ্য করতে হয় না। কিন্তু এবারের ঘটনা সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে।”

শ্রোতারা ঝটপট হাততালি দিল। জ্ঞানদাশঙ্করবাবু উৎসাহ পেলেন। বললেন, “ভাইসব, আপনারা আগে আমাদের তিন সঙ্গী শ্রীনিবাস, কালিপদ আর ঝন্টুর মুখ থেকে তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনুন। তারপর আমরা ঠিক করব, কীভাবে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।”

এবার হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সকলেই কাছে এসে কথা শুনতে চায়। এ ওকে ঠেলা দিল, সে লম্বা হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল তার গলা। দু’-একজন গুড়ি মেরে এগিয়ে অন্যদের পা ধরে হেঁচকা টান দিল। বেচারি হুড়মুড়িয়ে পড়ল রেলিং থেকে। জ্ঞানদাশঙ্করবাবু তাড়াতাড়ি হাওয়ায় ডিগবাজি খেয়ে ক্রেনের আংটা ধরে ঝুলে পড়লেন। তাঁর সাধের পাটভাঙা ধুতির কোঁচা ছিঁড়ল, মালা থেকে গাঁদাফুল খসে পড়ল। তিনি হাত তুলে বললেন, “শান্ত হোন ভাইসব, শান্ত হোন। আজ নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করলে বিপদ আরও বাড়বে।”

বিপদের কথায় সবাই চুপ করল। আর ঝন্টু, কালিপদ, শ্রীনিবাসের কথা শুনে চমকে চমকে উঠতে লাগল। যা ঘটেছে তাতে চমকে ওঠারই কথা। যে মানুষ একসময় ভূতের ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপত, দাঁতকপাটি লেগে যেত, চোখ কপালে তুলে মূৰ্ছা যেত, সেই মানুষ এখন আর ভূতে ভয় পাচ্ছে না পাত্তাই দিচ্ছে না মোটে। ভূতের দিকে মন দেওয়ার সময়ই নেই তাদের। ভয় দেখানোর যাবতীয় কসরত ফেল করছে। শ্রীনিবাস নিজে এই ঘটনার সাক্ষী। গত সপ্তাহে বালিগঞ্জের এক ফ্ল্যাটবাড়ির এগারোতলা পর্যন্ত উঠেছিল সে। হাসি দিয়ে মানুষ ঘাবড়ানোয় শ্রীনিবাস একসময় ছিল বিরাট ওস্তাদ। ভূতসমাজে তাকে ‘হাসিভূত’ বলে ডাকা হত। সেই শ্রীনিবাস এগারোতলার জানলার পাশে ফ্যাঁসাফ্যাঁস করে বেশ খানিকটা হাসি দিল। রাতবিরেতে এই হাসিতে বুক হিম হয়ে যাওয়ার কথা। অনেকেরই গিয়েছে। অথচ সেদিন ঘটল অন্যরকম। খানিকক্ষণের মধ্যেই জানলা খুলে গোলগাল চেহারার এক মহিলা বাজখাঁই গলায় ধমক দিল, “অ্যাই কে রে? মাঝরাতে ফাজলামি করে!’’

ভূতের হাসি শুনে ধমক! কেউ কখনও শুনেছে? শুধু হাসি নয়, ভৌতিক আওয়াজগুলো পর্যন্ত সব অকেজো হয়ে যাচ্ছে। দরজার ক্যাঁচকোঁচ, বাথরুমের কল থেকে মিথ্যে জল পড়ার টুপটাপ, ছাদে পায়ের ধুপধাপ, খাটের তলায় খচমচ, বারান্দার ফিসফাসে কেউ আর গা করছে না। গত কয়েক মাসে কালিপদ সবক’টায় ব্যর্থ হয়েছে। মানুষ এইসব ভৌতিক আওয়াজে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে মনের আনন্দে টিভি চালিয়ে দিয়েছে, নয় মিউজিক সিস্টেমে গান বাজিয়েছে গাঁকগাঁক করে। অপমানের একশেষ যাকে বলে! ভয় দেখানোর ভারী সহজ উপায় ছিল আলো-আঁধারি সিঁড়ি বেয়ে সরসর করে উঠে যাওয়া। বাঁকের মুখে শার্টের একটা কোণ, শাড়ির একটুখানি আঁচল দেখা যাবে মাত্র। বাকি সবটাই মিশে থাকবে বাতাসে। এই টেকনিকের নাম হল, ‘আছে কিন্তু নেই’ টেকনিক। এই টেকনিকে একসময় বহু মানুষ মূৰ্ছা যেত। সেদিন ঝন্টু এই টেকনিক ব্যবহার করতে গিয়ে ভারী অপমানিত হয়েছে। সিঁড়িতে পিছন পিছন আসা মানুষটা সমানে কানে মোবাইল ফোন চেপে ধরে বকর বকর চালিয়ে গিয়েছে। এতই ব্যস্ত যে ভূতের শার্ট, পেতনির শাড়ির আঁচল তো কোন ছার, সামনে দিয়ে আস্ত ভূত সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেও তার ঘুরে তাকানোর সময় নেই। কে জানে হয়তো মাথা নাড়িয়ে বলে বসবে ‘গুড ইভনিং’। ঝন্টুর এক সময় ইচ্ছে করল, মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়ে মানুষটার গালে চড় কষায়। ‘আছে কিন্তু নেই’ টেকনিকে চড় মারার কোনও নিয়ম নেই। মনের দুঃখে সে ফিরে এল।

তিনজনের কথা শেষ হওয়ার পরও সবাই চুপ করে রইল। বিপদ সত্যি মারাত্মক। ভয় দেখাতে না পারলে ভূতের আর রইল কী? বাড়িঘর দিয়েই বা কী হবে? ভালমন্দ খাবারদাবার দিয়েই বা কী হবে? ভূতের আসল পরিচয় তো আর বাড়িঘরে নয়, পরিচয় ভয়ে। জ্ঞানদাশঙ্করবাবু বেশ খানিকক্ষণ মাথা চুলকে ভাবলেন। তারপর বললেন, “দেখুন ভাইসব, এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে হবে না। এমন তো হতে পারে, আমরা যাদের ভয় দেখাতে গিয়েছিলাম তারা সব সাহসী মানুষ। আমরা তাই ব্যর্থ হয়েছি। হতে পারে না?”

শ্রোতারা আশার কথা শুনে খুশি হল। সমস্বরে হইহই করে বলল, “হতে পারে, খুব হতে পারে। শ্রীনিবাস, কালিপদ আর ঝন্টুটা খুব বোকা!”

তিনজনেই উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে গেল। লাভ হল না কোনও। বাকিরা চড়থাপ্পড় আর কানমলা দিয়ে তাদের বসিয়ে দিল। জ্ঞানদাশঙ্করবাবু বললেন, “আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। এবার ক’দিন আমরা বড়দের বাদ দিয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখি? ভূতের ভয়ের ব্যাপারে প্রাচীনকাল থেকে তাদের প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে। তাদেরও আমাদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। বড়দের মতো তারা আমাদের সহজে ফেলতে পারবে না। আপনারা কী বলেন?”

কেউ কিছু বলার আগেই ভেউ ভেউ করে কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। ভূতেদের মধ্যে কান্নাকাটি একটা বিরাট লজ্জার ব্যাপার। তার উপর একেবারে প্রকাশ্য সভায়। ছি ছি, কে কাঁদে? সবাই মুখ ফেরাল।

কাঁদছে জগদীশ সাঁতরা। এতক্ষণ সিমেন্টবালির বস্তার মধ্যে চ্যাপটা হয়ে গা ঢাকা দিয়ে বসে ছিল। এবার বেরিয়ে এসে কান্না জুড়ে দিয়েছে। জ্ঞানদাশঙ্করবাবু অবাক হয়ে বললেন, “এ কী! তোমার আবার কী হল জগদীশ?”

জগদীশ উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত জোড় করে বলল, “আমাকে ছেড়ে দিন স্যার। ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমাকে ডাকবেন না। আমি মরে যাব স্যার।”

“মরে যাবে। কেন?”

চোখের জল মুছতে মুছতে জগদীশ বলল, “বড়দের মধ্যে এখনও এক-আধজন ভিতু পাওয়া গেলেও যেতে পারে স্যার। ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনও চান্স নেই, আমি হলফ করে বলতে পারি। স্কুলে-পড়া ছেলেমেয়েগুলো আজকাল এক-একটা বিচ্ছু। আস্ত পাজি। দিনরাত কম্পিউটার ঘেঁটে, গল্পের বই গিলে আর হরর সিনেমা দেখে সাপের পাঁচ-পা দেখেছে স্যার। আগে একটু আওয়াজ পেল কী পেল না, বিছানায় উঠে চাদর মুড়ি দিত। আমাদের কোনও খাটাখাটনিই ছিল না। এখন মোবাইল ফোনের আলো জ্বেলে খোঁজ লাগায়। ভয়ের কোনও ধার ধারে না।’

জ্ঞানদাশঙ্করবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, “টেবিলের তলায় বসে দেখেছ? ওতে তো ভয় পাওয়ার কথা!”

জগদীশ ফুঁপিয়ে উঠে বলল, “দেখিনি স্যার, খুব দেখেছি। সেই ঘটনা মনে পড়তেই তো চোখে জল চলে এল। গত শনিবার কী যে প্যাঁচে ফেলেছিল। ক্লাস টেন-এ পড়া একটা পাকা ছেলের টেবিলের তলায় ঘাপটি মেরে আছি। রাত তখন একটা তো হবেই। বেশিও হতে পারে। বাড়িসুদ্ধ সবাই ঘুমিয়ে কাদা। চারপাশ নিস্তব্ধ। ভয় দেখানোর জন্য আইডিয়াল সময় যাকে বলে। আমি তো স্যার তক্কেতক্কে আছি। ছেলেটি নীচের দিকে তাকালেই বড় ধরনের একটা দাঁতখিঁচুনি দেব।”

জগদীশ চুপ করল। শ্রোতাদের মধ্যে থেকে চিৎকার উঠল, “তারপর, তারপর কী হল?” জগদীশ বলল, “তারপর আর কী, ছেলে তো কিছুতেই টেবিলের নীচে তাকায় না। একমনে খাতায় খসখস করে কী যেন করে। এদিকে বসে থাকতে থাকতে আমার পায়ে ধরেছে ঝিঁঝি। যেই একটু নড়াচড়া করেছি অমনি সেই ছেলে বলে কি না…।”

জ্ঞানদাশঙ্করবাবু বললেন, “কী বলে? তাড়াতাড়ি বলো?”

জগদীশ বলল, “সেই ছেলে গম্ভীর গলায় বলে উঠল, ‘টেবিলের তলায় কেউ নেই জানি, তবু যদি থাকো, উঠে এসে দেখি বাছাধন। উঠে এসে এই জিয়োমেট্রিগুলো সলভ করে দাও।’ একবার ভাবুন স্যার, কত বড় পাজি ছেলে! ভূতকে কিনা জিয়োমেট্রি করতে বলছে। ভয় দেখাব কী, আমি তো নিজেই ভয়ে কাঁটা হয়ে গিয়েছি। লেখাপড়া কবে ছেড়েছুড়ে দিয়েছি। তার উপর জ্যামিতিতে আমি চিরকালই কাঁচা ছিলাম। এতই ভয় পেয়েছি যে, স্যার, হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার কায়দাটা পর্যন্ত মনে পড়ল না। পালাতেই পারলাম না। লজ্জার কথা কী বলব স্যার, সেই ছেলে আমাকে টেবিলের তলা থেকে বের করে সত্যি সত্যি খাতা-বই ধরিয়ে দিল। দাঁত বের করে বলল, “অঙ্কগুলো না কষলে তোমার ছাড় নেই। সে তুমি যতই ভূত হও আর প্রেতই হও। আমি এখন কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনব। আর তোমায় পাহারা দেব। সেদিন গুনে গুনে বিয়াল্লিশটা জ্যামিতি করেছি স্যার। সম্পাদ্য, উপপাদ্য, একস্ট্রা, কী নয়? এখনও হাত টনটন করছে। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আর ওদের কাছে যাচ্ছি না।”

এরপরই আলো ফিরে এল। মিটিং ভেস্তে দিয়ে সকলেই দ্রুত এদিক-ওদিক গা ঢাকা দিল। জগদীশের ঘটনা শোনার পর থেকে সকলেই যেন পালানোর জন্য অপেক্ষা করছিল। ভূত হয়েও অঙ্ক কষতে হবে? বাপ রে! জ্ঞানদাশঙ্করবাবুও গলার মালা খুলে ভুস করে মিলিয়ে গেলেন।

পরদিন মিস্তিরি-শ্রমিকরা কাজে এসে অবাক হল। ফ্লাইওভারের উপর শুকনো ফুলের মালা ফেলল কে?

২০ ডিসেম্বর ২০০৮

সকল অধ্যায়

১. বিষে বিষক্ষয় – আশাপূর্ণা দেবী
২. আটচল্লিশ – অরবিন্দ গুহ
৩. ডোডো তাতাই পালা কাহিনি – তারাপদ রায়
৪. কৈলাসে চা পান – আশাপূর্ণা দেবী
৫. চোরে ডাকাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের নতুন কাজ – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ইলশেঘাই – লীলা মজুমদার
৮. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ! – শিবরাম চক্রবর্তী
৯. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
১১. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
১২. কে ফার্স্ট? – আশাপূর্ণা দেবী
১৩. ফ্ল্যাট রেস – জরাসন্ধ
১৪. চিত্তশুদ্ধি আশ্রম – বিমল কর
১৫. টেনাগড়ে টেনশান – বুদ্ধদেব গুহ
১৬. হাতি-চোর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৭. ছোটমাসির মেয়েরা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৮. মোটরবাইক, ষাঁড় ও লাকি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৯. ব্যাঙাচিদের লেজ – তারাপদ রায়
২০. বাজারদর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২১. তেঁতুলমামার জগৎ – হিমানীশ গোস্বামী
২২. রাজার মন ভাল নেই – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৩. গজেনকাকার মাছ-ধরা – বিমল কর
২৪. দাদুর ইঁদুর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৫. সাত নম্বর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৬. মেজদার সার্কাস – চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত
২৭. চোর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৮. কুস্তির প্যাঁচ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
৩০. পিলকিন’স ইলেভেন – বিমল কর
৩১. রাত যখন বারোটা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩২. ভুনিকাকার চৌরশতম – বিমল কর
৩৩. গ্রামের নাম জাঁকপুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩৪. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩৫. বাঘের দুধ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৬. গগনবাবুর গাড়ি – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৭. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৮. কুরুক্ষেত্র – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৯. কাক্কাবোক্কার ভুতুড়ে কাণ্ড – শৈলেন ঘোষ
৪০. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪১. বড়দার বেড়াল – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪২. মহাকর্ম – সমরেশ মজুমদার
৪৩. পায়রাডাঙায় রাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৪. মামার বিশ্বকাপ দর্শন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৫. গটমটে সাহেব বটে – শৈলেন ঘোষ
৪৬. রাঘব বোয়াল – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪৭. স্কন্ধকুমার এবং অর্ধচন্দ্র – তারাপদ রায়
৪৮. পাগল হইবার সহজপাঠ – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৯. বিপিনবিহারীর বিপদ – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. সাদা রঙের পাঞ্জাবি – অনির্বাণ বসু
৫১. জগু যাবে বেড়াতে – বাণী বসু
৫২. কুঞ্জবাবুর পিঁপড়ে বাতিক – অমিতাভ গঙ্গোপাধ্যায়
৫৩. ভুলে যাওয়া – সিদ্ধার্থ ঘোষ
৫৪. ঝগড়ুটে ফাইভ – প্রচেত গুপ্ত
৫৫. বিপদভঞ্জনের সর্পদোষ – উল্লাস মল্লিক
৫৬. মাসির বাড়ি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৫৭. জাগ্রত অসুরের গল্প – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৫৮. কাকাতুয়া ডট কম – প্রচেত গুপ্ত
৫৯. নতুন নাটকও ভন্ডুল – উল্লাস মল্লিক
৬০. রামখেলাওনের কেরামতি – সৌরভ মুখোপাধ্যায়
৬১. কলহগড়ের নিস্তব্ধতা – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
৬২. পটলার থিমপুজো – শক্তিপদ রাজগুরু
৬৩. সংকটমোচন কমিটি – প্রচেত গুপ্ত
৬৪. নতুন বন্ধু চিনু – জয়দীপ চক্রবর্তী
৬৫. বুঁচকির মেয়ের বিয়ে – নবনীতা দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন