পৌলোমী সেনগুপ্ত
চাকরি থেকে রিটায়ার করলে মানুষ কেমন হাঁসফাঁস করে প্রথম দিকটায়। কারও শরীর ভেঙে যায়, কারও ব্লাডপ্রেসার চাগায়, কেউ বা সারাদিন বড় বড় ঢেঁকুর তোলে, কাউকে আবার দেখেছি রাত্রে শোবার আগে কবিরাজি তেল মেখে ঘুমের সাধ্যসাধনা করে। প্রথম ধাক্কাটা সামলানো খুবই মুশকিল, সব কেমন ওলট পালট হয়ে যায় বলেই বোধহয়। এক-একজন এই বিশ্রী অবস্থাটা কাটাবার জন্যে বেরিয়ে পড়ে কাশী-হরিদ্বার-বৃন্দাবন ঘুরতে; কেউ বা মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে, কারও বা নেশা ধরে তাস-পাশায়। গাছপালা-বাগান-কুকুর-বেড়াল, এসব নিয়েও কেউ কেউ মেতে ওঠে। গোড়ার ধাক্কাটা একবার সামলে নিতে পারলেই হল, তারপর ধীরে ধীরে সব সয়ে যায়।
আমাদের মহাদেব জ্যাঠামশাইকেই প্রথম দেখলাম, যেদিন চাকরি থেকে মুক্তি পেলেন, তার পরের দিন থেকেই আহ্লাদে আটখানা। ধানবাদে আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি। বাবার বন্ধুর মতন। বয়েসে সামান্য বড় বলে বাবা তাঁকে দাদা বলতেন। আমরা বলতুম জ্যাঠামশাই। বেঁটেখাটো মানুষ, গোলগাল চেহারা, গায়ের রং ফরসা। মাথার মাঝমধ্যিখানে সিঁথি করে চুল আঁচড়াতেন। সাবেকি গোঁফ ছিল তাঁর। মাথার চুল, গোঁফ দশ আনাই সাদা হয়ে গিয়েছিল জ্যাঠামশাইয়ের।
আমরা থাকতাম ভাড়া-বাড়িতে। জ্যাঠামশাইদের বাড়িটা ছিল নিজেদের। পুরনো বাড়ি। দোতলা। সংসারে মানুষ বলতে ছিলেন জ্যাঠামশাই, জ্যাঠাইমা, আর ঠাকুমা। মাঝে-মাঝে দুমকা থেকে রাধাদি আসত বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে।
জ্যাঠামশাই আমাদের খুব ভালবাসতেন। আমাকে একটু বেশি। আমার বাবাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতন মনে করতেন।
এই জ্যাঠামশাইকে দেখলাম, চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর তুড়ি মেরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। না গেলেন তীর্থধর্ম করতে, না বসলেন তাস-পাশার আড্ডায়। তাঁর শরীর ভাঙল না, রোগটোগ কাছে ঘেঁষল না, যেমন কে তেমন চেহারা নিয়ে জ্যাঠামশাই ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
বাবা বললেন, “মহাদেবদার ধাতই আলাদা। ও মানুষ কি সহজে ভাঙেন!”
জ্যাঠামশাই যে ভাঙার পাত্র নন, সেটা আমরাও জানতাম।
একদিন কিন্তু একটা ঘটনা ঘটল।
জ্যাঠামশাই আমাদের বাড়িতে এসে বাবার সঙ্গে গল্পটল্প করে চলে যাবার পর বাবা হাঁক দিয়ে মাকে বললেন, “শুনেছ, মহাদেবদা আশ্রম খুলবেন।”
আশ্রমের কথা শুনে মা যেন খুশিই হলেন। বললেন, “ভালই হল। আমাদের এদিকে আশ্রমটাশ্রম নেই, ওই এক শিবমন্দির। আশ্রম খুললে তবু দু’দণ্ড গিয়ে বসতে পারব। ঠাকুরের গানটান হবে।”
বাবা বললেন, “সে গুড়ে বালি। মহাদেবদা চিত্তশুদ্ধি আশ্রম খুলবেন।”
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “সেটা কী? চিত্তশুদ্ধি আশ্রমটা আবার কেমন জিনিস?”
“বুঝলাম না,” বাবা মাথা নেড়ে বললেন, “ভেঙে কিছু বললেন না; তবে তোমার ঠাকুরদেবতার জায়গা বোধহয় ওই আশ্রমে হবে না। দেখো কী হয়।”
আমরা ছেলেমানুষ। বড়দের কথায় কথা বলতে নেই। কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। বলাইদের পাড়ায় একটা আশ্ৰম আছে; সেখানে মাঝে মাঝে উৎসব হয়। উৎসবের দিন আশ্রমে গেলেই ভিজে ছোলা, গুড়, বাতাসা, কলা, দু’-এক টুকরো বাতাবি লেবু, চিনির মন্ডা পাওয়া যায়। জ্যাঠামশাই ওই রকম একটা আশ্রম খুললে মন্দ হত না। মাঝে মাঝে কিছু পাওয়া যেত।
জ্যাঠামশাইয়ের আশ্রম সম্পর্কে তেমন কোনও কৌতূহল আমাদের তখন আর জাগল না।
এর কয়েকদিন পরে দেখলাম, জ্যাঠামশাইদের বাড়ির নীচের তলা সাফসুফ হচ্ছে। তারপর এল বালি, সুরকি, দু’-চার গাড়ি ইট। মিস্ত্রি মজুর খাটতে লাগল। নীচেরতলার ব্যবস্থা বেশ পালটে ফেললেন জ্যাঠামশাই। গোটা দুই ঘর হল; উঠোনে জলকলের ব্যবস্থা করলেন; ভেতর বাড়ি আর বাইরের বাড়ির মধ্যে একটা পাঁচিল গাঁথা হল। চুনকাম-টুনকামও হয়ে গেল একদিন।
এরপর দেখি দড়ির খাটিয়া এল গোটা ছয়েক। ধুনুরি ডেকে পাতলা পাতলা তোশক-বালিশ বানানো হল। শেষে একটা ছোট সাইনবোর্ডও লাগানো হল বাড়ির বাইরের দিকে। তাতে লেখা থাকল: চিত্তশুদ্ধি আশ্রম।
বাবা বললেন, “মহাদেবদার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শুনছি উনি নাকি যত চোর-বাটপাড়-পাগল এনে ওই আশ্রমে রাখবেন। বাড়ির মধ্যে একী কাণ্ড! বউদি চেঁচামেচি করছেন, মাসিমা কাঁদছেন। কী পাগলামি বলো তো!”
আমরা ছেলেমানুষ হলেও বুঝতে পারলাম, একটা অদ্ভুত কিছু হতে যাচ্ছে। জ্যাঠামশাই যেমন-তেমন মানুষ নন, নিশ্চয় অনেক ভেবেচিন্তে কাজে নেমেছেন। লোকে তাঁকে পাগল বলুক আর যাই বলুক, তিনি যা ঠিক করেছেন তা থেকে নড়বেন না।
চিত্তশুদ্ধি আশ্রম সম্পর্কে আমাদের রীতিমতো কৌতূহল জাগল। পাড়ার লোকজনও দেখলাম জ্যাঠামশাইদের বাড়ির সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করছে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সাইনবোর্ডটা, হাসাহাসি করছে। কেউ বলছে, দত্তমশাই উন্মাদ হয়ে গেছেন, কেউ বা রসিকতা করে বলছে, দত্তবাবু নিশ্চয় হোটেল খুলবেন।
যার যা খুশি বলুক, আমরা তিন ভাইবোন কিন্তু জ্যাঠামশাইদের বাড়িতে দু’বেলা আসা-যাওয়া করতে লাগলুম। জ্যাঠাইমার মুখ গম্ভীর; ঠাকুমা চুপচাপ। জ্যাঠামশাই আগের মতনই হাসিখুশি। নীচের ঘরে তিনি একটা টেবিল পেতেছেন, টেবিলের ওপর রুলটানা খাতা, দোয়াত, কলম, লাল নীল পেনসিল, একটা মোটাসোটা রুল আর দু’-একটা বই রেখে অফিস-ঘর সাজিয়েছেন।
আমরা রোজই ঘুরঘুর করি ও-বাড়িতে। একদিন জ্যাঠামশাই আমাদের ডাকলেন। ডেকে নীচে অফিসঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। আমি, কালু আর লতু বেঞ্চিতে বসলাম।
জ্যাঠামশাই বললেন, “তোরা নীচের ঘরটর সব দেখেছিস ভাল করে?”
তিনজনেই মাথা নাড়লাম। দেখেছি।
জ্যাঠামশাই বললেন, “কাল দুপুর থেকে আমার আশ্রমে লোক আসতে শুরু করবে। বগলাকে চিনিস?”
আমাদের এদিকে তিনজন বগলা আছে। একজন বাড়ি বাড়ি কলের জল দেয় খাবার জন্যে; একজন পোস্টাফিসের পিয়ন; আর একজন থাকে বাজারে। আমি বললাম, “কোন বগলা?”
জ্যাঠামশাই বললেন, “বাজারের বগলা।”
বাজারের বগলার বড় দুর্নাম। সে ফলমূল বেচে। তার দোকান নেই। রাস্তায় বসে শসা, কলা, শুকনো কমলালেবু, শাঁক-আলু এইসব বিক্রি করে। গরিব লোক। অল্পস্বল্প যা জোগাড় করতে পারে তাই বেচে দিন চালায়। লোকটা ভীষণ মানুষ ঠকায়। ছেলেমানুষ দেখলে তো কথাই নেই, ফিরতি পয়সাও কম দেবে। অচল পয়সাও চালিয়ে দেয়।
বগলার নাম শুনে আমি আঁতকে উঠে বললাম, “বগলা তো চোর, জ্যাঠামশাই।”
জ্যাঠামশাই বললেন, “চোর নয়, লোভী। দু’পয়সার জিনিস বেচে পাঁচ পয়সা পকেটে ভরতে চায়। আমি ওকে শুধরে দেব। ওর চিত্তশুদ্ধি দরকার।”
কালু বলল, “বাজারে গণেশ আছে; সে আরও চোর।”
জ্যাঠামশাই বললেন, “আমি সব লিস্ট করে ফেলেছি। ঘুরে ঘুরে, দেখে দেখে দশজনের লিস্টি করেছি। বগলাকেই প্রথম আনব। বগলার পরে আনব পঞ্চাকে।”
পঞ্চার নামে লতু সিঁটিয়ে গেল। বলল, “ও জ্যাঠামণি, পঞ্চা ভীষণ পাজি। ওর একটা পোষা নেউল আছে। আমাদের স্কুল যাবার সময় ভয় দেখায়।”
জ্যাঠামশাই বললেন, “পঞ্চার মাথায় ছিট আছে খানিকটা। একসময়ে স্টেশনে মুসাফিরখানায় পড়ে থাকত। মালপত্তরও সরাত। পুলিশের হাতে শিক্ষা পেয়ে শুধরেছে অনেকটা। তবু পুরনো অভ্যেস পুরোপুরি যায়নি। ওরও চিত্তশুদ্ধি দরকার।”
আমরা তিন ভাইবোনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে উঠে এলাম। কিছু তো আর বলতে পারি না জ্যাঠামশাইকে।
বাইরে এসে কালু বলল, “চিত্তশুদ্ধি কেমন করে হয়?”
আমরা কিছুই জানতাম না। চুপ করে থাকলাম।
পরের দিন থেকে জ্যাঠামশাইয়ের চিত্তশুদ্ধি আশ্রম চালু হয়ে গেল। সত্যি সত্যি বগলা এসে আশ্রমে ঢুকল। একাট ছেঁড়া গামছা, মাথায় ফলের ছোট ঝুড়ি, ডান হাতে এক পুঁটলি— বগলা বেশ হাসতে হাসতে আশ্রমের দরজায় এসে দাঁড়াল।
বিকেলে একবার তাকে দেখতে গেলাম। গরম কাল। কার্বোলিক সাবান মাখিয়ে জ্যাঠামশাই তাকে স্নান করিয়েছেন, নতুন একটা ধুতি আর গেঞ্জি দিয়েছেন পরতে। বগলা স্নান করে, ধুতি-গেঞ্জি পরে বিড়ি টানছিল। আমাদের দেখে মিটিমিটি হাসতে লাগল।
জ্যাঠামশাইয়ের চিত্তশুদ্ধি আশ্রমে জনা চারেক লোক সপ্তাহ খানেকের মধ্যে জুটে গেল। বগলা, হাবুল, গিরিধারী আর কেষ্ট। একজন ঠগ, অন্যরা ছিঁচকে চোর, পাগল। পঞ্চাকে জ্যাঠামশাই ধরতে পারেননি তখনও।
আমাদের বাড়িতে, পাড়ায়, ততদিনে একটা হইহই পড়ে গেছে। চোর, ছ্যাঁচড়, পাগল এনে এনে জ্যাঠামশাই বাড়িতে পুরছেন, তারা দিব্যি বিনি পয়সায় দু’বেলা ডাল-ভাত-তরকারি খাচ্ছে, দড়ির খাটিয়ায় তোশক পেতে ঘুম মারছে, এরপর তো এরাই পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে চুরি-চামারি করতে বেরুবে।
কেউ বলছে, পাড়ার মধ্যে এসব চলতে দেওয়া যায় না; কারও কারও মত হল, থানায় গিয়ে একটা খবর দিয়ে এলে ভাল হয়। বুড়োর দলই বেশি হইহই করতে লাগল— চুরি-চামারির ভয় ছাড়াও পাড়ার একটা ইজ্জত রয়েছে, জ্যাঠামশাই সেই ইজ্জত নষ্ট করে ছাড়লেন।
দু’-পাঁচজন জ্যাঠামশাইকে গিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, নিষেধও করলেন। জ্যাঠামশাই কোনও পাত্তাই দিলেন না। বললেন, “তোমরা আমার চরকায় তেল দিতে এসো না। আমার বাড়িতে আমি যা খুশি করব, কারও কিছু বলার এক্তিয়ার নেই।”
পাড়ার লোক জ্যাঠামশাইয়ের ওপর চটতে লাগল। বাড়িতে জ্যাঠাইমাও রাগে গরগর করতেন। ঠাকুমা অবশ্য হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমাদের বাড়িতেও দেখতাম, বাবা বেশ অসন্তুষ্ট। বলতেন, “মহাদেবদার মাথা খারাপ হয়েছে। গাঁটের পয়সা খরচ করে কতকগুলো রাস্তার চোর-জোচ্চোরকে পুষছেন। পাগল ছাড়া এমন কাজ কেউ করে না।”
চিত্তশুদ্ধি আশ্রম মাসখানেকের মধ্যেই বেশ জমে উঠল। চারের জায়গায় ছয় হয়ে গেল আশ্রমের সদস্য। নতুন দু’জন এল স্টেশনের ওপার থেকে। একজনের নাম ঝন্টু, অন্যজনের নাম মিশির। আরও দু’-একজন নাকি খাতায় নাম লিখিয়ে গেল, পরে আসবে।
আমি আর কালু জ্যাঠামশাইয়ের আশ্রমের ব্যাপারস্যাপারগুলো দেখতে যেতাম। সকালে বগলারা ঘুম থেকে উঠে দাঁতন করত, মুখ ধুয়ে উঠোনে গিয়ে বসত আসন করে, জ্যাঠামশাই নীচে নেমে আসতেন। জ্যাঠামশাইয়ের সামনে হাতজোড় করে বসে ওরা একটা বিদঘুটে শ্লোক আওড়াত। জ্যাঠামশাই শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ওদের মুখের কথা কিছু বোঝা যেত না। গলার স্বরও অদ্ভুত।
এরপর থাকত বগলাদের ছোলা-মুড়ি-গুড়ের ব্যবস্থা। খেয়ে নিয়ে ওরা জ্যাঠামশাইয়ের কাছে অফিসঘরে এসে দাঁড়াত। বগলাকে জ্যাঠামশাই টাকা দিতেন, কোনওদিন পাঁচ, কোনওদিন সাত। বগলা চলে যেত বাজারে। ফল কিনে বেচাকেনা করে আবার বেলায় ফিরে আসবে। চুরিচামারি করবে না। লোক ঠকাবে না। ফিরে এসে হিসেব দিতে হবে জ্যাঠামশাইকে। বগলার পর টাকা নিত গিরিধারী। সে যাবে তিলকুট, রেওড়ি, তিলের নাড়ু বেচতে। বগলার মতন তাকেও ফিরে এসে হিসেবপত্র দিতে হবে। হাবুল আর কেষ্টর মধ্যে পালা করে একজন যেত জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে বাজারে, অন্যজন আশ্রমের ঘরদোর পরিষ্কার করত, পাঁড়ে ঠাকুর রান্না করতে এলে জলটল তুলে দিত। আশ্রমের রান্না হত নীচেই।
সন্ধের দিকে জ্যাঠামশাই তাঁর আশ্রমের লোকদের ধর্মকথা শোনাতেন, সৎ শিক্ষা দিতেন, মন্দ কাজ করলে মানুষের কী হয় তার ফিরিস্তি শোনাতেন।
মোটামুটি এইভাবেই চিত্তশুদ্ধি আশ্রম চলছিল। আশ্রমের লোকেরা খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে মাসখানেকের মধ্যেই চেহারা পালটে ফেলতে লাগল। সাজপোশাক সকলের একরকম ছিল না। কেউ কেউ ধুতি পেয়েছিল, গেঞ্জি পেয়েছিল; কাউকে কাউকে জ্যাঠামশাই খাকি হাফ প্যান্ট আর ফতুয়া দিয়েছিলেন। আমরা অবশ্য আশ্রমে গেলেই কার্বোলিক সাবানের গন্ধ পেতুম, কখনও দেখেছি— পাঁচড়ার মলম, নিমতেলের গন্ধ ছাড়ছে বাতাসে। কেষ্ট পাগলা মাঝে মাঝে পালিয়ে যেত আশ্রম ছেড়ে, জ্যাঠামশাই তাকে ধরে আনতে সারা শহর ঘুরে বেড়াতেন। আনতেনও ধরে।
কার কতটা চিত্তশুদ্ধি হচ্ছে জানবার আগেই একদিন শুনলাম বগলা পালিয়েছে। শহর ছেড়েই উধাও। হাবুল বলল, “বাবুর কাছে পাঁচ টাকা নিলে ও চার টাকার ফল কিনত, এক টাকা আগেই মারত। চার টাকার ফল বেচে বাবুর কাছে সাড়ে পাঁচ টাকার হিসেব দিত। আট আনা তার নামে জমত লাভ বাবদ।”
জ্যাঠামশাই কোনও কথা বললেন না। গম্ভীর হয়ে থাকলেন। বগলার জায়গায় এল অনাদি। বয়েস কম, চালাক চতুর। সুশীল কাকাদের বাড়িতে কাজ করত। নিজেই এসে জ্যাঠামশাইয়ের পা জড়িয়ে ধরল। তার বড় হাতটানের অভ্যেস। লোভ দমন করতে পারে না। তার চিত্তশুদ্ধি দরকার।
আশ্রমে অনাদির জায়গা হয়ে গেল।
বগলা পালাবার সপ্তাহখানেক পরে গিরিধারীও পালাল। অবশ্য শহর ছেড়ে চলে গেল না। ঘাপটি মেরে থাকল। আশ্রম তার পোষাচ্ছে না।
পাগলা কেষ্ট একদিন খেপে গিয়ে হাবুলের সঙ্গে এমন মারপিট করল যে, কেষ্টর কনুইয়ের জোড়টাই গেল ভেঙে। তাকে রেলের হাসপাতালে রেখে আসতে হল জ্যাঠামশাইকে, তার চিৎকার আর সহ্য হচ্ছিল না জ্যাঠাইমার।
আশ্রমে আসবে বলে যারা নাম দিয়েছিল, আগেই জ্যাঠামশাই তাদের খুঁজতে লাগলেন। কেউ আর এখন আসতে চায় না। খাওয়া-দাওয়া, শোওয়া সব ফ্রি। তবু কেন যে ওরা আসতে চাইছে না, জ্যাঠামশাই বুঝতে পারলেন না।
আমাকে বললেন, “হ্যাঁরে, কী হল বল তো? ব্যাটারা নিজেরাই বলেছিল আসব, এখন আমায় দেখলেই পালায়।”
আমি বললাম, “ভয়ে।”
“ভয়ে? কীসের ভয়ে?”
“তা জানি না। এখানে এলেই নাকি দাগী হয়ে যেতে হয়।”
“দাগী?”
“তাই তো বলছিল একদিন গিরিধারী। বলছিল, জেলখানা থেকে বেরিয়ে এলে যেমন দাগী চোর হয়ে যেতে হয়, এখানে থাকলেও সেই রকম হয়।”
জ্যাঠামশাই একটু ভেবেচিন্তে বললেন, “বুঝেছি। আমার পেছনে এনিমি লেগেছে।”
এর দিন দশেক পরে একদিন সকালবেলায় জ্যাঠামশাই হন্তদন্ত হয়ে বাবার কাছে এসে বললেন, “সত্য, আমার গালে ওই ছোঁড়াটা চড় মেরে পালিয়েছে।”
বাবা বললেন, “সে কী! কোন ছোঁড়া চড় মারল?”
জ্যাঠামশাই বললেন, “ওই যে অনাদি। সুশীল মিত্তিরদের বাড়ি থেকে এসেছিল। ছোঁড়াটা নিজেই এসেছিল। তার কথাবার্তা হাবভাব আমার ভাল লেগেছিল। দিন কয়েক দেখেশুনে তাকে আমি বাড়ির কাজে লাগিয়েছিলাম। তোমার বউদিও দেখতাম ছোঁড়াকে পছন্দ করছে। তখন কী জানতাম ছোঁড়ার পেটে পেটে এত শয়তানি বুদ্ধি।”
“কী করেছে ছোঁড়াটা?” বাবা আসল কথাটা জানতে চাইলেন।
জ্যাঠামশাই বললেন, “আজ সকালে উঠে বাজারে যাব; দেখি আমার পকেট- ঘড়িটা নেই। ও কি আজকের ঘড়ি? আমার বাবামশাই দিল্লি দরবারের সময় কিনেছিলেন। সোনা রয়েছে ওতে। দামের কথা বাদ দাও, ওটা আমার বাবার স্মৃতি। ছোঁড়াটাকে আমি এত বিশ্বাস করলাম, আর ও কিনা আমার ঘড়ি চুরি করে পালাল।”
বাবা বললেন, “থানায় গিয়ে খবর দিন। আর তো কিছু করার নেই।”
জ্যাঠামশাই হায়-হায় করতে করতে চলে গেলেন।
এর দিন তিনেক পরে আবার যে ঘটনাটি ঘটল সেটা আরও অদ্ভুত।
জ্যাঠামশাই রাত্রের দিকে আমাদের বাড়িতে এসে বাবাকে তাঁর চুরি-যাওয়া ঘড়িটা দেখালেন। ঘড়ি ফেরত পেয়ে জ্যাঠামশাইয়ের যতটা খুশি হওয়া উচিত ছিল, ততটা খুশি তাঁকে দেখাচ্ছিল না।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, “কেমন করে পেলেন ঘড়িটা?”
জ্যাঠামশাই পকেট থেকে একটা চিরকুট বার করে বাবার হাতে দিলেন। বললেন, “সুশীল আমায় খুব একটা শিক্ষা দিয়েছে।”
চিরকুটটা পড়ে বাবা হা-হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, “সুশীলবাবুই তা হলে তাঁর বাড়ির চাকর অনাদিকে আপনার আশ্রমে পাঠিয়েছিলেন ঘড়ি চুরি করতে।”
জ্যাঠামশাই চুপ করে থাকলেন।
বাবার হাত থেকে চিরকুটটা নিয়ে জ্যাঠামশাই দলা পাকিয়ে ছুড়ে দিলেন বাইরে। তুলে দেখি, সুশীলকাকা বড় বড় করে লিখেছেন: “ঘড়িটা ফেরত নেবেন। আমাকে ক্ষমা করবেন। অনাদি চোর নয়। আমার কথায় চুরি করেছিল। আপনার চিত্তশুদ্ধি আশ্রমটি রাখবেন না তুলে দেবেন ভেবে দেখবেন।”
জ্যাঠামশাই শেষ পর্যন্ত তাঁর সাধের চিত্তশুদ্ধি আশ্রমটি তুলেই দিলেন।
এপ্রিল ১৯৭৭
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন