পৌলোমী সেনগুপ্ত
চাকরিতে বদলি হওয়ার ব্যাপারে এবার বোধহয় রেকর্ড করে ফেলবেন চিত্তদারোগা। টমটমপুরে বেশ গুছিয়ে বসে ছিলেন। স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হচ্ছিল। কোমরের বেল্টের শেষ ঘর থেকে কাঁটা উঠে এসেছিল একঘর উপরে। হেড অফিস থেকে অর্ডার এল, যেতে হবে কলহগড়ে। কাজের প্রতি নিষ্ঠা চিত্তদারোগার সন্দেহাতীত। এক-দু’বার কাগজে নামও বেরিয়ে ছিল। তবু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তাঁকে বারবার বদলি হতে হয় দূর গ্রামে। চাকরি জীবনের প্রায় গোটাটাই কেটে গেল পরিবার ছাড়া। স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে রাখতে হয়েছে কলকাতায়। এসব গ্রামে এক সপ্তাহের বেশি থাকতে পারবে না তারা।
কলহগড়ে চিত্তদারোগার আজ দ্বিতীয় দিন। এলাকাটাকে জরিপ করে নেওয়ার জন্য সকালবেলা বেরিয়ে পড়েছেন সাইকেল নিয়ে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সাইক্লিং হয়ে গেল। চোখে পড়ছে অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা। এখানকার পশুপাখিরা মানুষের চেয়ে ঢের বেশি প্রাণচঞ্চল। কুকুর, বিড়াল দৌড়ে দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছে, গোরু হাঁটছে ঘোড়ার চলনে, মাথার উপর শাঁ শাঁ করে উড়ে যাচ্ছে পাখি, মোড়ে মোড়ে কাকের পথসভা! মানুষগুলোই যেন অতি বিনয়ী। তারা যে শুধু দারোগাবাবুকে দেখেই রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছে তা নয়, হাঁটতে হাঁটতে অনেক সময় এমনিই সরে দাঁড়াচ্ছে। যেন বাতাসকে যেতে দিল। আরও একটা বিষয় লক্ষ করছেন চিত্তদারোগা, এখানকার মানুষের বড্ড প্রণাম করার ধুম। পথের ধারে মন্দির, গাছতলায় দেবতা মূর্তিকে তো প্রণাম করছেই, হঠাৎ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে মাটিতে হাত ঠেকিয়ে কপালে ধুলো নিচ্ছে অনেকে। ব্যাপারস্যাপার কিছুই বুঝছেন না চিত্তদারোগা। মনে হচ্ছে বেশ রহস্যজনক জায়গায় এসে পড়েছেন।
ঘণ্টা দেড়েক সাইক্লিংয়ের পর এখন খিদে খিদে পাচ্ছে। মিষ্টির দোকানের সামনে সাইকেল থামালেন দারোগাবাবু। পরনের পোশাক দেখে দোকানের মালিক হন্তদন্ত হয়ে এল, “নমস্কার স্যার। কী সৌভাগ্য আমার, সেকেন্ড দিনেই আপনার পা পড়ল দোকানে।”
চিত্তদারোগা বুঝলেন, তিনি যে এখানে বদলি হয়ে এসেছেন, খবর হয়ে গিয়েছে এলাকায়। দোকানের মালিক ফের বলল, “বলুন স্যার, আপনার জন্য কী করতে পারি?”
আচমকা পুলিশের আগমনে লোকটি ঘাবড়ায়নি, খাতির করছে আন্তরিকভাবে। এর থেকে আঁচ করা যায় এলাকাটা অপরাধপ্রবণ নয়।
দোকানের কাজের ছেলেটি বেঞ্চ ঝেড়ে দিয়ে গেল। বসে পড়ে দারোগাবাবু বললেন, “দুটো শিঙাড়া আর আপনার দোকানের ভাল কোনও একটা মিষ্টি দেখি।”
“একটু অপেক্ষা করুন স্যার। শিঙাড়া ভাজা হচ্ছে, গরম গরম পাঠিয়ে দিচ্ছি।” বলে দোকানের মালিক ফিরে গেল কাউন্টারে।
দোকানের সামনে পাঁচ-ছ’টা কাক লাফচ্ছে, চেঁচাচ্ছে, কথা বলছে যেন। সামান্য দূরে পাকা রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে দূরপাল্লার বাস, ভ্যানরিকশা, গোরুর গাড়ি, হেটোমেঠো মানুষজন। ওদের মধ্যেই একজনকে দেখা গেল আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রণাম করতে। জায়গাটার নাম ‘প্রণামপুর’ হলেই মানাত বেশি।
একটা-দুটো খদ্দের দোকানে এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছে খাবার। একজন দারোগাবাবুর থেকে দু’হাত তফাত রেখে বেঞ্চে বসল। দূরত্বের কারণ সহজেই অনুমেয়, সকলেই পুলিশের গা বাঁচিয়ে চলে। এক্ষেত্রে কিন্তু দারোগাবাবুর ধারণাটা ভুল প্রমাণিত হল। লোকটি নিশ্চয়ই নিত্যদিনের খদ্দের। বসার সঙ্গে সঙ্গে কাজের ছেলেটি দুটো শালপাতার প্লেটে নিয়ে এল গরম জিলিপি। একটা প্লেট মাঝের ফাঁকা জায়গায় রেখে অন্য প্লেটের জিলিপি তুলে ফুঁ দিতে লাগল লোকটি। দারোগাবাবু ভাবছেন, লোকটির কোনও সঙ্গী বুঝি আসবে, যার জন্য নেওয়া হয়েছে, আর-একটি প্লেট। কিন্তু তার আগেই একটা কাক ছোঁ মেরে নিয়ে গেল জিলিপির থালা। চমকে উঠে দাঁড়ালেন চিত্তদারোগা। আপশোসের সুরে লোকটিকে বললেন, “গেল তো! পরে নিলেই পারতেন!”
লোকটির কোনও বিকার নেই। অমায়িক হেসে বলল, “যাক, আপনি ব্যস্ত হবেন না।”
চিত্তদারোগা ফের বসলেন বেঞ্চিতে। লোকটির এই আচরণের কোনও মানে বুঝলেন না। দুটো জিলিপি খেয়ে চারটের দাম দিয়ে চলে গেল লোকটি। চেনা কেউ এল না তার।
“কার জন্য নিয়েছিল আর-একটা প্লেট?” প্রশ্নটা চিত্তদারোগা করলেন, যখন দোকানের মালিক শিঙাড়া-সন্দেশ নিয়ে এল।
“ও কিছু নয়। ভদ্রলোকের দয়ার শরীর, রোজই পাখিদের খাওয়ান।” বলে এড়িয়ে যাচ্ছিল দোকানি।
চিত্তদারোগা বললেন, “কাকেদের দেওয়ার হলে উনি ছুড়েই দিতে পারতেন। আলাদা করে শালপাতার প্লেট নিলেন কেন?”
এবার উত্তর দিতে থমকাল দোকানদার। বলল, “এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে বেকার মাথা ঘামাচ্ছেন। কলহগড়ে এরকম অনেক কিছুই দেখতে পাবেন, যার আসল কোনও মানেই নেই। কারওর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তাতে।”
বিষয়টিকে জিলিপির প্যাচের চেয়েও জটিল করে দিয়ে গেল দোকানদার। চিত্তদারোগা নিজের খাবারটি খেয়ে চা নিলেন। কপাল কুঁচকে ভাবলেন অনেকক্ষণ। তারপর একসময় দোকানদারকে দাম মিটিয়ে উঠে পড়লেন সাইকেলে। আজ আর কোথাও গিয়ে কাজ নেই, আরও কত অদ্ভুত ব্যাপার দেখা যাবে, কে জানে! একদিনের পক্ষে বেশি হয়ে যাবে ডোজ। আপাতত ফেরা যাক।
থানায় এসে চিত্তদারোগা ডেকে পাঠালেন হাবিলদার কাশীনাথকে। ও ছাড়া অবশ্য থানায় কেউ ছিলও না। বাকি তিনজন কনস্টেবল, হাবিলদার চাষের তদারকিতে গিয়েছে। কাশীনাথ সেলাম ঠুকে দাড়ানোর পর দারোগাবাবু হাতের ইশারায় উলটো দিকের চেয়ারে বসতে বললেন। ইতস্তত করে বসল কাশীনাথ। চিত্তদারোগা এলাকা পরিক্রমা করে যা যা দেখেছেন, বললেন। জিজ্ঞেস করলেন, “এসবের মানে কী?”
কাশীনাথ মাথা নিচু করে বসে রইল, মুখে কোনও কথা নেই। চিত্তদারোগা তাড়া দিলেন, “কী হল, কিছু বলছ না কেন? তুমি তো এখানকার ছেলে। কলহগড়ের নাড়ি-নক্ষত্র জানো।”
মাথা তুলে বিষণ্ণ মুখে কাশীনাথ বলল, “সবটা বলতে পারব না স্যার। আমায় মাফ করবেন। এটুকু বলতে পারি, কলহগড় ছ’মাস আগেও এরকম ছিল না। সব সময় হইচই। এসবের মধ্যে আনন্দ-উৎসব যেমন ছিল, ঝগড়া, মারপিট চলত ভালই। থানাও গমগম করত সবসময়। কী যে হল, এখন সন্ধের আগেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। দিনেরবেলায়ও লোকজন আড়ষ্ট হয়ে চলাফেরা করে, কথা বলে গলা নামিয়ে। এখন যা অবস্থা, কলহগড় নামটাই পালটে দেওয়া উচিত। গলা সপ্তমে না চড়িয়ে এখানকার লোকজন এককালে কথাই বলতে পারত না। চেঁচিয়ে ফুটবল ম্যাচ জেতা আমাদের কাছে জলভাত ছিল।”
“কী কারণে হঠাৎ স্বভাব বদলে গেল সকলের?” জানতে চাইলেন দারোগাবাবু।
কাশীনাথ বলল, “পল্টুর জন্যই এমনটা হল।”
“কে পল্টু?”
“আমাদের গ্রামের একমাত্র ফোটো তুলিয়ে। বাড়িতেই স্টুডিয়ো করেছে। পল্টুর কাছে গেলে আপনি এসবের কারণ জানতে পারবেন।”
“তোমার বলতে অসুবিধে কোথায়?”
“তেনারা কুপিত হবেন।”
‘তেনারা’ কথাটা চেনা চেনা লাগছে। আর-একটু পরিষ্কার হওয়ার জন্য চিত্তদারোগা প্রশ্ন করলেন, “কারা এই তেনারা?”
কোনও উত্তর এল না। কাশীনাথ হাবিলদার এমন ভঙ্গিতে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন প্রস্তরযুগের গুহাচিত্র দেখছে। দারোগাবাবু বললেন, “ঠিক আছে, কাল আমাকে একবার পল্টুর স্টুডিয়োতে নিয়ে যেয়ো তো।”
॥ ২ ॥
কলহগড়ে দরকারি সমস্ত কিছু একটা করে আছে। অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার একজন। ওষুধের দোকান একটা। মোটরগাড়িও একটাই। থানায় অবশ্য একটা জিপ আছে, ফর শো। চারটে চাকাই দেবে গিয়েছে, স্টিয়ারিং-এ মাথা গলিয়েছে সন্ধ্যামালতী গাছ। একটা হাই স্কুল, ফোন বুথ একটা এবং স্টুডিয়ো তাই। কাশীনাথ দূর থেকে পল্টুর বাড়িটা দেখিয়ে ফিরে গেল। বলল, “স্টাফেদের বিশ্বাস নেই। থানা ফাঁকা রেখেই ওরা হয়তো নিজেদের কাজে বেরিয়ে যাবে।”
চিত্তদারোগা বুঝতেই পারলেন, এটা অজুহাত। কাশীনাথ আসলে এড়াতে চাইল স্টুডিয়োটা। মাটির দালানের বাঁ দিক ঘেঁষে ঘরটার মাথায় টিনের বোর্ডে যেমন-তেমন করে লেখা ‘ছায়াছবি ফোটো স্টুডিয়ো’। নীচে লেখা, ‘প্রো. পল্টু হালদার’।
দালানে উঠে ঘরটার সামনে গেলেন দারোগাবাবু। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। দোকানে কাউন্টার বলে কিছু নেই। চেয়ার, টেবিল আর একটা বেঞ্চ। মাটির দেওয়ালে অজস্র ফোটো টাঙানো। যার মধ্যে বেশিরভাগ সিনেমা আর্টিস্টের ফোটো। তাঁরা নিশ্চয়ই এখানে ফোটো তুলিয়ে যাননি। পল্টু হালদার কোথাও থেকে জোগাড় করেছে। চিত্তদারোগা হাঁক পাড়লেন, “কেউ আছেন? আছেন কেউ?”
স্টুডিয়োর ভিতর থেকে পরদা সরিয়ে বেরিয়ে এল বছর পঁচিশের এক যুবক। পরনে পাজামা, গেঞ্জি। এই প্রথম কলহগড়ের একজন পুলিশ দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হল। পল্টু ভয় পাওয়া গলায় জানতে চাইল, “কী ব্যাপার স্যার?”
“কিছুই না। এমনই দেখতে এলাম তোমার স্টুডিয়োটা।”
“ও আচ্ছা। বসুন, বসুন!” বলে পল্টু গলা তুলল ভিতরবাড়ির উদ্দেশে, “সন্ধ্যা, বাইরে চা দিয়ো।”
দারোগাবাবুকে নিজের চেয়ারটা ছেড়ে দিয়ে পল্টু বসেছে বেঞ্চিতে। চিত্তদারোগা জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন চলে দোকান?”
করুণ মুখে পল্টু বলল, “একেবারেই ভাল নয় স্যার। ভেবেছিলাম বাবা-কাকার মতো চাষবাস না করে ভদ্রস্থ গোছের একটা বিজ়নেস করব। কিন্তু কোথায় কী! এই গন্ডগ্রামে এ ধরনের ব্যাবসা চলেই না।”
দারোগাবাবুর ভ্রু দুটো কাছাকাছি চলে এল। তিনি বললেন, “তোমাকে কিন্তু সকলেই একডাকে চেনে। অনেকে বলে তুমি নাকি কলহগড়ে অনেক বদল এনেছ।”
পল্টু ঢোক গিলল। কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। জীবনে বোধহয় প্রথমবার পুলিশি জেরার সামনে পড়েছে। ওকে বাঁচিয়ে দিল ভিতরবাড়ি থেকে চা নিয়ে আসা ঘোমটা-পরা বউ। সম্ভবত পল্টুরই স্ত্রী। চা এনেছে তিন কাপ। পল্টু প্রায় মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, “একটা কাপ নিয়ে যাও।”
বউটি বলল, “কেন, উনি তো এ সময় একবার খান।”
“যাও বলছি।” বিরক্ত হয়ে বলল পল্টু।
কাপটা ফেরত নিয়ে গেল বউ। ব্যাপারটা যথেষ্ট গোলমেলে লাগল চিত্তদারোগার কাছে। এ বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করা সমীচীন হবে না, এটা একেবারেই ওদের পারিবারিক মামলা। কার জন্য চা এনেছিল পল্টুর বউ? ভাবতে ভাবতে চা খাচ্ছেন চিত্তদারোগা। কেন জানি মনের চোখে ভেসে উঠল মিষ্টির দোকানের দৃশ্য, জিলিপি খেতে আসা লোকটি অন্য কারওর জন্য যেন আর-এক প্লেট জিলিপি নিয়েছিল। যদিও সেটা কাকে খেয়েছে, তাতে অবশ্য লোকটির কোনও আপশোস হয়নি।
“কী রে পল্টু, রাত ক’টায় আসব?”
আগন্তুকের কণ্ঠ শুনে চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল চিত্তদারোগার। তিনি দেখলেন, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন সত্তরের কাছাকাছি এক বৃদ্ধ। পল্টুকে যথেষ্ট অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে। হয়তো আশা করেনি দারোগাবাবুর উপস্থিতিতে বৃদ্ধ চলে আসবেন। তাই সে দায়সারাভাবে উত্তর দিল, “আসুন না জ্যাঠা, আপনার সুবিধেমতো সময়ে।”
বৃদ্ধ চলে যেতে যেতে বললেন, “আমাকে বাবা একটু আগে ছেড়ে দিস। ঠিক রাত বারোটা নাগাদ চলে আসব।”
দালান থেকে বৃদ্ধ নেমে যাওয়ার পর দারোগাবাবু পল্টুকে জিজ্ঞেস করলেন, “রাত বারোটায় কী কাজে আসবেন উনি?”
“তেমন কিছু না। বাড়িতে লুকিয়ে দলিলের বয়ান লেখাতে আসবেন। ছেলে-বউয়ের সামনে সেসব করা যাবে না। কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে।”
ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হল না চিত্তদারোগার। এতদিনের পুলিশের চাকরির অভিজ্ঞতায় কথার মধ্যে মিথ্যের মিশেলটা ভালই ধরতে পারেন। মনে হচ্ছে যা কিছু গণ্ডগোল রাতবিরেতেই হয়। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে এটা-সেটা বলে পল্টুর স্টুডিয়ো থেকে উঠে পড়লেন দারোগাবাবু।
॥ ৩ ॥
রাত সাড়ে বারোটা। জমজম করছে পল্টুর স্টুডিয়ো। দালানের আলো জ্বালানো হয়েছে। স্টুডিয়োর বেঞ্চিতে বসে আছেন জনাছয়েক কাস্টমার। শেষ খদ্দেরটি হচ্ছেন ছদ্মবেশ নেওয়া চিত্তদারোগা। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, মাথার চুলে সাদা রং লাগিয়ে বৃদ্ধ সেজেছেন। চোখে আদ্যিকালের চশমা। পল্টু এখন ভীষণ ব্যস্ত। একজন করে কাস্টমারকে নিয়ে চলে যাচ্ছে পুকুরধারে খেজুর গাছতলায়। ফ্ল্যাশের আলোয় লোকটির ফোটো তুলে ফেরত আসছে দোকানে অ্যাডভান্স টাকা নিয়ে বিল কেটে দিচ্ছে। ফের পরেরজনকে নিয়ে চলে যাচ্ছে সেই স্পটে। চিত্তদারোগা এখনও বুঝে উঠতে পারেননি, রাতের আঁধারে খেজুর গাছতলা এবং পুকুরকে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে কেন এত পছন্দ করছে পল্টু? ফোটো তোলাতে খদ্দেররা রাতের টাইমটা বেছে নিয়েছে কেন? এ সমস্ত কিছুই আর কিছুক্ষণ পরই স্পষ্ট হয়ে যাবে। পল্টুকে আসতেই হবে দারোগাবাবুর কাছে। উনি যে লাইনেই আছেন। চিত্তদারোগা আর-একটা জিনিস লক্ষ করছেন, ফোটো তোলার পর কাস্টমাররা একটাই প্রশ্ন করছে পল্টুকে, “হ্যাঁ রে, পেলি দেখতে, আসবে ফোটোয়?”
পল্টু কখনও বলছে, ‘আসবে আসবে’। কখনও বা বলছে, ‘আমি কিছু পাইনি দেখতে, যা দেখার ফোটোয় দেখতে পাবেন’। এ ধরনের কথার কোনও থই খুঁজে পাচ্ছেন না চিত্তদারোগা। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে আছেন পল্টুর জন্য। আসতে তাকে হবেই।
শেষে এল। সকলেই চলে গিয়েছে। পল্টু বলল, “চলুন দাদু, আপনার ফোটোটা তুলে দিয়ে শুতে যাই।”
নকল চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন চিত্তদারোগা। দু’হাত মাথায় দিয়ে মুছতে লাগলেন চুলের রং। পল্টুর তো কম্পমান অবস্থা। ভীষণ নার্ভাস গলায় বলল, “স্যার আপনি।”
“হ্যাঁ, আমি। এবার বলো তো বাছা, তোমার এই রাতের ফোটোর ব্যাপারটা আসলে কী?”
পল্টু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “স্যার, আমি কিন্তু কাউকে ঠকাইনি। আমার কোনও দোষ…।”
কথা কেড়ে নিয়ে চিত্তদারোগা ধমক দিলেন, “ন্যায়-অন্যায় সরকার বিচার করবে। আগে বলো তো রাতের এই ফলাও কারবারের পিছনে রহস্যটা কী?”
পল্টু বলল, “আমারও এই কারবার করতে আর ভাল লাগছে না স্যার। কিন্তু গ্রামের মানুষ যে শুনছে না।”
“পয়েন্টে এসো।” গম্ভীর গলায় আদেশ দিলেন চিত্তদারোগা।
কী মনে হতে পল্টু বারান্দার আলোটা নিভিয়ে দিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে বসল দারোগাবাবুর মুখোমুখি। তারপর বলল, “ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল মাসছয়েক আগে। শ্মশানে ফোটো তুলতে নিয়ে গেল মাইতিবাড়ির লোক। মারা গিয়েছেন ওদের বাড়ির কর্তা নিত্যানন্দ মাইতি। বয়স বিরানব্বই। ডেডবডি মাঝে রেখে ছেলেপুলে, নাতি, পাড়ার লোক গ্রুপ ফোটো তুলল। প্রিন্ট অর্ডার দিল বড় সাইজের, আট বাই বারো ইঞ্চি। শহরে প্রিন্ট করতে পাঠালাম।”
“কেন! তুমি নিজে প্রিন্ট করো না?” মাঝে ফুট কাটলেন দারোগাবাবু।
পল্টু বলল, “কালার প্রিন্ট সব স্টুডিয়োই শহরের ল্যাব থেকে করিয়ে আনে। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট আজকাল চলে না। আমি জানিও না সেসব কাজ। প্রিন্টের ঝামেলা নেই দেখে স্টুডিয়োটা খুলেছিলাম। সাটার টেপা আর ফিল্ম লোড করা ছাড়া ফোটোগ্রাফির আমি কিছু বুঝিই না। অবশ্য এই বিদ্যে দিয়ে গ্রামে দিব্যি কারবার চালানো যায়।”
“শহর থেকে প্রিন্ট আসার পর কী হল?” পল্টুকে প্রসঙ্গ ফিরিয়ে দিলেন চিত্তদারোগা।
পল্টু বলল, “আমি খাম খুলে একপলক ফোটোটা দেখে রেখে দিয়েছিলাম। গড়বড়টা ধরা পড়ল ডেলিভারির সময়। নিত্যানন্দ মাইতির বড়ছেলে সুধন্যদা মন দিয়ে ফোটোটা দেখতে দেখতে বলল, ‘আরে এটা কী?’
“ ‘কোনটা?’ বলে ফোটোটা হাতে নিলাম।
“সুধন্যদা আঙুল দিয়ে দেখাল, গ্রুপ ফোটোর পিছনের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছায়ামূর্তি। বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। সুধন্যদা জানতে চাইল, ‘এ কার ফোটো তুললি তুই?’ আমি উত্তর দিতে পারলাম না। সুধন্যদার পাশে থাকা বন্ধুটি বলল, ‘মনে হচ্ছে তোর বাবার আত্মার ফোটোটা উঠে গিয়েছে। উনি তখন তোদের সঙ্গেই ছিলেন। মায়া কাটাতে পারেননি।’
“খেপে গেল সুধন্য মাইতি। আমাকে বলল, ‘আমি কি তোকে বাবার আত্মার ফোটো তুলতে বলেছি? এ ফোটো আমি নেব না।’ সুধন্যদা রেগেমেগে চলে গেল।
“ফোটোটা খামে পুরে রাখলাম। খবরটা রটে গেল বাইরে। দু’দিন পর স্টুডিয়োতে এল এলাকার গুন্ডা রবি কুণ্ডু। বলল, ‘কয়েক দিন ধরেই অন্ধকারে হাঁটলে কার যেন পায়ের শব্দ পাচ্ছি। একটা ফোটো তুলে দেখবি, কে আছে পাশে। ডবল পয়সা দেব।’
“টাকার লোভে ফোটোটা তুললাম। আবার সেই সাদা অবয়ব। ফোটো দেখে রবি কুণ্ডু বলল, ‘মনে হচ্ছে নিতাই। এখনও পিছু ছাড়ল না!’
“কলহগড়ের সকলেই জানে রবি কুণ্ডু খুন করেছে নিতাইকে। ফোটো তোলার পর থেকে রবি কুণ্ডু কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেল। তারপর এল প্রভাত মণ্ডল। ভীষণ পিতৃভক্ত মানুষ। তার বায়না, বাবা সঙ্গে সঙ্গে আছেন কিনা দেখবে। ফোটো তোলার পর দেখা গেল, আছেন।”
শুনতে শুনতে চিত্তদারোগার চোখ ক্রমশ বড় হচ্ছে। পল্টু আবার শুরু করল, “এরপর এলেন নগেনের বাবা। বললেন, ‘তোর কাকিমা থাকতে কোনও দিন পাশাপাশি ফোটো তোলা হয়নি। তুলে দিবি বাবা?’ তুললাম। ফোটোয় দেখা দিলেন কাকিমা।”
চিত্তদারোগা বিস্ময়ের কণ্ঠে বললেন, “তার মানে শুধু ভূত নয়, পেতনিরও ফোটো উঠছে!”
“বিশ্বাস না হয় দেখুন, বেশ কিছু ফোটোর দুটো করে প্রিন্ট করিয়ে একটা স্যাম্পেল হিসেবে রেখেছি।” বলে ফোটো বের করতে থাকল পল্টু। বলে চলল, “কত লোক যে এরপর থেকে ফোটো তুলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কাউকে নিরাশ করেননি তার মারা যাওয়া আত্মীয়। তেনারা সব এ গ্রামেই আছেন। আজকাল লোকে তাদের কখনও সখনও খালি চোখেও দেখতে পাচ্ছে, প্রণাম করছে, ছেড়ে দাঁড়াচ্ছে রাস্তা, আত্মার প্রিয় খাবারটা খেতে দিচ্ছে। যেমন, কাল সকালে দেখলেন না, বউ তিন কাপ চা নিয়ে এসেছিল। এক্সট্রা কাপটা বাবার। বড় ভালবাসতেন চা খেতে!”
ভূতটুতকে খুব একটা আমল দেন না চিত্তদারোগা। কিন্তু এত কিছু শোনার পর গা’টা একটু ছমছম করছে। পল্টু দশ-বারোটা ফোটো ধরিয়ে দিল দারোগাবাবুর হাতে। হ্যাঁ, সত্যিই একটা আবছা সাদা অবয়ব সব ফোটোয় দেখা যাচ্ছে। কখনও ছায়ামূর্তিকে মনে হচ্ছে মহিলা, কখনও বা পুরুষ। একটা ফোটোয় দেখা গেল শুধু ছায়ামূর্তির ফোটো তুলেছে পল্টু।
চিত্তদারোগা জানতে চাইলেন, “এটা কী ব্যাপার?”
পল্টু বলল, “একদিন এমনই অন্ধকারের দিকে তাক করে ফোটো তুললাম। দেখলাম, সেখানেও তেনারা ভেসে বেড়াচ্ছেন। খুঁটিয়ে দেখুন, আরও কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে।”
দারোগাবাবুর ঘাম দিতে শুরু করেছে। এখন আবার এতটা পথ উজিয়ে যেতে হবে থানায়। কোনও বিপদ না ঘটে পথে! মনের কথাটা যেন শুনতে পেয়ে পল্টু বলল, “এঁরা কিন্তু কারওর কোনও ক্ষতি করছেন না, জানেন। তবে এঁরা আছেন বলে মানুষ অকাজ-কুকাজ করার নাম করে না। শুধু তাদের মনে হয়, একজন সাক্ষী থেকে গেল।”
ভয় তাড়ানোর জন্য গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন চিত্তদারোগা। বললেন, “আমার একটা ফোটো তোলো তো, দেখি কে পাশে এসে দাঁড়ায়!”
পল্টু ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বলল, “আপনার বেলায় হয়তো না-ও দাঁড়াতে পারেন, যতই হোক দারোগাবাবু বলে কথা!”
॥ ৪ ॥
ভূত যে পুলিশকে গ্রাহ্য করে না, প্রমাণ হয়ে গেল দু’দিন পর। স্টুডিয়োয় নিজের ফোটো নিতে এলেন চিত্তদারোগা। পল্টু শুকনো মুখে ফোটো এগিয়ে দিল। হ্যাঁ, দারোগাবাবুর পাশে ঘোমটা পরা ছায়ামূর্তি। ভীষণ নার্ভাস হয়ে গেলেন চিত্তদারোগা। মা মারা গিয়েছেন দু’যুগ হয়ে গেল। তা হলে কে এসে দাঁড়ালেন পাশে?
থানায় ফিরে গিয়ে ফোন করলেন বাড়িতে। নাঃ, স্ত্রী, সন্তান সব ভালই আছে। পরের দু’দিন খুব পায়চারি করলেন চিত্তদারোগা। ফিতে দিয়ে মাপলে দশবারো মাইল হয়ে যাবে অবশ্যই। শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, পল্টুর ক্যামেরাটা নিয়ে একবার কলকাতায় যেতে হবে। বাড়িতেও কাটানো যাবে দু’দিন। ওই ক্যামেরা যদি আত্মার ফোটো তুলতে পারে, সে এক মহার্ঘ্য ব্যাপার। হইচই পড়ে যাবে ক্যামেরাটা নিয়ে। আবিষ্কারক হিসেবে কাগজে নাম উঠে যাবে চিত্তদারোগার। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট আবার গর্বিত বোধ করবে চিত্তদারোগার জন্য।
দারোগাবাবু পল্টুকে এত কিছু বললেন না। বোঝালেন এই বলে, “তোমার ওই অশৈলী ক্যামেরাটা দাও, কলকাতায় একবার দেখিয়ে নিয়ে আসি। এ ধরনের অদ্ভুতুড়ে জিনিস সম্বন্ধে ভাল করে না জেনে ব্যবহার করা ঠিক হচ্ছে না।”
পল্টু বলল, “আপনি এক্ষুনি নিয়ে যান। কাল রাতে কে যেন কড়া নাড়ল। দরজা খুলে দেখি, কেউ নেই। আমার মনে হচ্ছে, তেনারা এবার নিজেরাই ফোটো তোলাতে আসছেন।”
ক্যামেরা এবং কিছু স্যাম্পেল ফোটো দারোগাবাবুর হাতে দিয়ে পল্টু বলল, “চেষ্টা করবেন বিক্রি করে দিতে। সেই টাকায় নিয়ে আসবেন নতুন ক্যামেরা। এক্সটা কিছু লাগলে আমি দিয়ে দেব।”
॥ ৫ ॥
কলকাতা থেকে ফিরে এসেছেন চিত্তদারোগা। চেহারায় ঝরঝরে ভাব। গেলেন পল্টুর স্টুডিয়োয়। আগের ক্যামেরাটাই ফেরত দিয়ে বললেন, “এই নাও, আর এতে আত্মাটাত্মার ফোটো উঠবে না। সারিয়ে এনেছি।”
পল্টুর মুখে খুশি ঝকমক করে উঠল। বলল, “বাঁচালেন! ভূতেদের ফোটো তুলে তুলে নিজেকেও আর ঠিক মানুষ বলে মনে হত না। তবে কিনা আত্মার ফোটোর জন্য কলহগড় একদম ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল।”
দারোগাবাবু বললেন, “আমি জানি। তাই তুমি কাউকেই বলবে না ক্যামেরা সারানো হয়েছে। বলবে, আত্মার ফোটো তোলার যন্ত্রটা খুলে রেখেছ ক্যামেরা থেকে। কারণ, ভূতের সর্দার এসে ফোটো তুলতে বারণ করে গিয়েছেন তোমায়। বলেছেন, ‘ফ্ল্যাশের আলো চোখে পড়ার পর দিন কুড়ি ভূতেরা খুব ভুগছেন। সারাক্ষণ করকর করছে চোখ।”
“বাঃ, বেড়ে বলেছেন তো!” প্রশংসার কণ্ঠে বলে উঠল পল্টু।
দারোগাবাবু ফের বললেন, “যদি কখনও দেখি, কলহগড়ে অশান্তি ফিরে আসছে, আবার তোমার ক্যামেরায় আত্মার ফোটো তোলার বন্দোবস্ত করে দেব।”
“কী করে?”
পল্টুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দারোগাবাবু মুচকি হেসে দালানোর নীচে রাখা সাইকেলে গিয়ে উঠলেন।
থানায় ফিরছেন চিত্তদারোগা। ঠোঁটের হাসি এখনও মেলায়নি। কলহগড়কে জব্দ রাখার অস্ত্র তাঁর পকেটে, একটা দেশলাই বাক্সর মধ্যে। ধর্মতলায় ক্যামেরা সারানোর দোকানে যখন ফোটো এবং ক্যামেরা দেখালেন, টেকনিশিয়ান মুন্ডু মটকানোর মতো লেন্সটা ক্যামেরা থেকে খুলে নিয়ে দেখাল, ভিতরের দিকে একটা সুতো ঝুলছে। বলল, “এটাই এক্সপোজ হয়ে যাচ্ছে সব ফোটোয়। সাটার পড়ার সময় নানারকম শেপ নিচ্ছে সুতোটা। ফিল্ম লোড করার সময় হয়তো ঢুকে গিয়েছিল।”
সুতোটা ফেলে দিচ্ছিল টেকনিশয়ান। তাড়াতাড়ি সেটা নিয়ে নিলেন চিত্তদারোগা। এই সামান্য সুতোর কী ক্ষমতা! ইহলোক-পরলোক জুড়ে দিচ্ছে নিমেষে! এ জিনিস কি হাতছাড়া করা যায়! পুলিশ জীবনে অনেক বঞ্চনার মধ্যে এটা তার একটা বিরাট পুরস্কার!
২ অক্টোবর ২০০৭
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন