পৌলোমী সেনগুপ্ত
পিলকিনসাহেবকে আমরা বলতুম পিলপিলসাহেব। কেন বলতুম জানি না। বোধহয় সাহেবের চেহারার জন্যে। মাথায় বেশ লম্বা, চেহারায় রোগী। ঢ্যাঙা চেহারার মানুষকে এমনিতেই দেখতে রোগা রোগা লাগে; তার ওপর যদি সে সত্যিই রোগাটে হয়— তাকে কেমন লাগবে দেখতে? তালগাছ, না, সুপুরিগাছ? তা যেমনই লাগুক পিলকিনসাহেবের পিলপিল নামটাই চালু হয়ে গিয়েছিল।
আমাদের কোলিয়ারিটা ছিল বড়। সাহেব কোম্পানির কোলিয়ারি। সাহেবসুবোদের ম্যানেজার করে পাঠানোই রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল মালিকদের। পিলকিনসাহেব যখন এলেন তখন তাঁর বয়েস চল্লিশ হয়ে গিয়েছে। মানুষটি কাজের ছিলেন, ভাল ছিলেন। মজার ছিলেন। তাঁর যথেষ্ট নামডাক হয়েছিল কোলিয়ারি মহলে।
পিলপিলসাহেবের শখ বলতে ছিল তিনটে জিনিস। গাড়ি, বাগান আর ফুটবল। সাহেবের একটা টু-সিটার হিলম্যান গাড়ি ছিল। রং ছিল টকটকে লাল। সেই গাড়িতে একটা আঁচড় পড়লে সাহেবের সর্দি ধরে যেত মনের দুঃখে। আর ম্যানেজার পিলকিনের বিশাল বাংলো বাড়িতে গাছের অভাব ছিল না। মস্ত বাগানে দু’-দুটো মালি সারাদিন কাজ করত। নানা জাতের নানা বাহারের ফুল ফুটত বাগানে। বাঙালিবাবুরা বলতেন, পিলপিলের নন্দনকানন।
গাড়ি আর বাগান নিয়ে পিলপিলসাহেবের যতই মায়া-মমতা থাক— তাঁর প্রাণ বলতে ছিল ‘পিলকিন’স ইলেভেন’। পিলকিন’স ইলেভেন মানে সাহেবের কোলিয়ারির ফুটবল টিম।
ছোট সাহেবদের মধ্যে পিলকিন’স ইলেভেন নিয়ে হাসিঠাট্টা হত। কেউ বলতেন, পিলকিনের এগারোটি বাঁদর; কেউ বলতেন, এগারোটা ধেড়ে বজ্জাত; কেউ বা বলতেন, সাহেবের পোষ্যপুত্র সব।
ইঞ্জিনিয়ার সেনগুপ্তকাকা বলতেন, “মেমসাহেব মারা গিয়েছেন, মেয়ে দেরাদুনে থেকে পড়াশোনা করে, সাহেব কী নিয়ে আর থাকবেন! তাই ওই পিলকিন’স ইলেভেন। খ্যাপা মানুষ। তা ছাড়া পিলকিন নিজে একসময় খেলাধুলো করতেন তো। তাই এত সব।”
আমাদের কোলিয়ারিতে ফুটবল খেলার রেওয়াজ তেমন ছিল না। বাচ্চাকাচ্চারা খেলতুম। বড়রা আর খেলবে কখন? সারাদিন কোলিয়ারির কাজকর্ম সেরে সময় কোথায় খেলার! তবু গরমে আর বর্ষায় হাটের পাশে ন্যাড়া মাঠে গদাইদা, রাখহরিদা, রামভরত, সাহানাবাবু—মাঝে মাঝে ফুটবল নিয়ে নেমে পড়ত। সে ছিল মজার খেলা। হাট-বাজার করতে এসে খানিকটা বল পেটাপেটি।
পিলকিনসাহেব কোলিয়ারিতে আসার পর নিজে উদ্যোগী হয়ে একটা দল করলেন। হাটের মাঠে ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি করালেন জনা-বিশেক জোয়ান ছেলেকে—তার মধ্যে গদাইদারা থাকল। শেষমেশ আনাড়িদের বাদ দিয়ে সাহেবের দল গড়া হল। নাম হল, পিলকিন’স ইলেভেন।
পিলকিন’স ইলেভেনের সবাই কোলিয়ারিতে কাজ করত। কেউ ইলেকট্রিশিয়ান, কেউ ফিটার, কেউ ওয়ার্কশপের মিস্ত্রি, কেউ অফিসের কেরানি, কেউ বা হাসপাতালের কম্পাউন্ডার। দত্তসাহেব বলতেন, ‘দামড়া ইলেভেন’।
পিলকিন’স ইলেভেন প্রথম খেলা খেলতে গেল বার্নপুরের মাঠে। ফ্রেন্ডলি ম্যাচ, সাত গোল খেয়ে ফিরে এল। সে-খেলা আমরা দেখিনি, শুনেছি বার্নপুর কারখানার দল শুয়ে বসে হেসে হেসে খেলে মাত্র সাত গোল দিয়ে ভদ্রতা করে ছেড়ে দিয়েছিল পিলকিন’স ইলেভেনকে।
পিলপিলসাহেব বড়ই দুঃখ পেয়েছিলেন সেদিন। সাত দিন আর জলস্পর্শ করেননি। তবে দমে যাননি মোটেই, টিমের ছেলেদের বলেছেন, ‘নেভার মাইন্ড, আচ্ছাসে খেলো।’
সেবারের মরশুমে পিলকিন’স ইলেভেন যাদের সঙ্গেই খেলেছে, সে যেমন খেলাই হোক পাঁচ-সাত-দশ গোলে হেরেছে।
পরের বছর পিলকিন’স সাহেব নিজের কোলিয়ারিতে চাকরি দিয়ে দু’-একজন নতুন খেলোয়াড় আনালেন। তার মধ্যে ফণিদা আর গণপতি ভাল খেলোয়াড়। দেখা গেল, উন্নতি হয়েছে। ধানবাদের রেল-মাঠে ভাওড়া কোলিয়ারির সঙ্গে খেলায় পিলকিন’স ইলেভেন পাঁচ গোলে হারল। তা খারাপ কী? ভাওড়া কোলিয়ারি নামকরা দল। শিল্ড চ্যাম্পিয়ন।
তার পরের বছর পিলপিলসাহেব নিজের কোলিয়ারিতেই এক টুর্নামেন্ট লাগিয়ে দিলেন। কোলিয়ারির সেটা পঁচিশ বছর। সিলভার জুবিলি। টুর্নামেন্টের নাম দেওয়া হল, জুবিলি কাপ। শুধু কোলিয়ারি দলরাই সেই টুর্নামেন্টে খেলতে পারবে।
সাহেবের প্রতিপত্তি কম ছিল না। নিজেই এখানে-ওখানে চিঠি লিখলেন, গাড়ি হাঁকিয়ে দেখা করতে গেলেন, অন্য কোলিয়ারির ম্যানেজারদের সঙ্গে। বারো-চোদ্দোটা দল রাজি হয়ে গেল খেলতে।
এরপর হইহই করে মাঠ পরিষ্কারের কাজ হতে লাগল। পিলপিলসাহেব নিজে তদারক করতে লাগলেন। মাঠ পরিষ্কার হল, গোলপোস্ট পোঁতা হল, মাঠের পাশে একধারে টিনের শেড তৈরি হল ছোট করে, গণ্যমান্যরা বসবেন। খেলোয়াড়দের প্যান্টজামা বদলাবার জন্যে তাঁবু বসানো হল।
আমাদের কোলিয়ারিতে হইচই করার মতন কাণ্ডকারখানা দু’-চারটে হত। কালীপুজো, যাত্রা, বেবি শো— এইসব আর কী! কিন্তু ফুটবল খেলার হইচই ছিল না। আমরা, বাচ্চাকাচ্চার দল তো মহা খুশি। রোজ বিকেল বেলায় দল বেঁধে গিয়ে মাঠ পরিষ্কার, তাঁবু খাটানো দেখতাম।
শেষ পর্যন্ত একদিন ধুমধাম করে জুবিলি কাপের খেলা শুরু হল। আসানসোল থেকে ইব্রাহিমের ব্যান্ড-পার্টি এল বাজনা বাজাতে, কলকাতা থেকে বাজি এল দু’-চার ঝুড়ি, দমাদ্দম বাজি ফাটল, তুবড়ি পুড়ল, হাওয়াই ছুটল।
আমাদেরই হল মজা। জুবিলি কাপের খেলা থাকত রোজই প্রায়। আমরাও বিকেল হল কী, মাঠের দিকে ছুটতাম। রোজই ভিড় হত মাঠে।
পিলকিন’স ইলেভেনকে সাহেব ততদিনে পাকা করে ফেলেছেন। টপাটপ বেড়া ডিঙিয়ে সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত চলে গেল তাঁর দল। লোদনা কোলিয়ারি, শ্রীপুর, ভিক্টোরিয়া— তিন তিনটে কোলিয়ারিকে হারিয়ে একেবারে সেমি-ফাইনাল। আমরা বগল বাজাতে লাগলাম। মন্দ লোকে অবশ্য বলত, রেফারিগুলো চোট্টামি করছে। সে-কথায় কে কান দেয়। আমরাও দিতাম না।
সেমি-ফাইনালে খেলা পড়ল সেই ভাওড়া কোলিয়ারির সঙ্গে। বড় শক্ত টিম। পাকা টিম। তা ছাড়া ওদের দলে জন বলে একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান প্লেয়ার আছে। বুট পরে খেলে। জবরদস্ত খেলোয়াড়। তার সঙ্গে আছে বানোয়ারিলাল, সে একেবারে পেছল শোলমাছ, সুড়ুত করে পিছলে একেবারে গোলের কাছে চলে যায় একটু ফাঁকফোকর পেলেই। তার সবই ভাল, শুধু একটা দোষ আছে। কোনও প্লেয়ার যদি তার গায়ে গায়ে এসে পড়ে ব্যস হয়ে গেল। বানোয়ারির কাতুকুতু লেগে যায়। বল ছেড়ে দিয়ে সে হাসতে শুরু করে।
খেলার দিন, সকাল থেকেই বৃষ্টি নেমেছিল। ভাদ্র মাস। ঘণ্টা-দুয়েক জোর বৃষ্টির পর মেঘ কাটল। আমাদের মনের মেঘ কিন্তু কাটল না। আজ পিলকিন’স ইলেভেনের হয়ে গেল। অবধারিত হার। কমপক্ষে তিনটে গোল হজম করতে হবে। কোলিয়ারিতে একটাও জাগ্রত ঠাকুর-দেবতা নেই যে আমরা মানত করে আসব। সন্তু দামড়া গাঁয়ের ধর্মরাজ ঠাকুরকেই মানত করে এল।
বিকেলে মাঠে গিয়ে দেখি পিলপিলসাহেব তখনও তাঁর দলবল নিয়ে আসেননি। কোলিয়ারির অর্ধেক লোক এসে মাঠের তিন পাশ দখল করে বসে পড়েছে। আমরা তাঁবুর দিকটায় জায়গা করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বেশ একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব লাগছিল।
মাঠের অবস্থা মন্দ নয়। জলে কাদায় ভরতি হয়নি মাঠ; তবে জায়গায় জায়গায় জল জমে আছে, কোথাও কোথাও সামান্য কাদা।
খেলা শুরুর খানিকটা আগে পিলপিলসাহেব তাঁর দল নিয়ে মাঠে এলেন। কোলিয়ারির ট্রাকে করে এসেছেন। প্লেয়াররা একেবারে তৈরি। আমরা হইহই করে উঠলাম।
ভাওড়া কোলিয়ারি দল আগেই মাঠে নামল। হলুদ রঙের গেঞ্জি তাদের জার্সি। আমাদের হল নীল শার্ট।
ভাওড়ার দল মাঠে নামতেই আমাদের কোলিয়ারির লোকরা নানারকম শব্দ করতে লাগল মুখে। কেউ কুকুর ডাক ডাকল, কেউ ছাগল ডাক ডাকল। শেয়ালের ডাকও ডাকতে লাগল। ভাওড়ার দল গ্রাহ্য করল না। তারা এমন ভাব করতে লাগল যেন ওরা সব হুলো বেড়াল; এগারোটা নেংটি ইঁদুর তাদের কাছে কিছুই নয়।
পিলকিন’স ইলেভেন মাঠে নামার আগে পিলপিলসাহেব তাঁর দলকে কী যেন মন্তর দিয়ে দিলেন কানে কানে। আমরা দেখলুম সাহেব আমাদের হাফ ব্যাক বদুদাকে আলাদাভাবে একপাশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কিছু বলছেন।
বদুদা— মানে বদ্যিনাথ চট্টরাজকে লোকে জ্যান্ত মহিষাসুর বলত। বিশাল চেহারা, কুচকুচ করছে গায়ের রং, মাথার চুলগুলো ঝাঁকড়া। বদুদা নাকি একটা পুরো খাসির মাংস সাবাড় করতে পারে। কোলিয়ারির যাত্রা-পার্টিতে বদুদাকে কখনও যমরাজ, কখনও কুম্ভকর্ণ, কখনও অসুর জলন্ধরের সেনাপতির পার্ট দেওয়া হয়। কথাবার্তায় পুরো মানভূমি টান। সেই টানেই পার্ট বলে যায়।
যাই হোক, খেলা শুরু হল। শুরুতেই সেই বানোয়ারিলাল আমাদের চমকে দিয়েছিল। একটা গোল হতে হতে হল না। কেমনভাবে যেন বলটা বাইরে বেরিয়ে গেল। নয়তো হয়ে যেত।
প্রথমটায় আমাদের পিলকিন’স ইলেভেন শুধুই নাচতে লাগল। আমাদের তখন বুক ধসে যাচ্ছে! তবু সারা মাঠ চেঁচাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে। ধরে ফেল, মেরে দে, পেনো ছোট, বাঁ দিকে পাস দে মির্জা…নানান ধরনের চিৎকার।
বেশ খানিকক্ষণ পিলকিন’স ইলেভেন নেংটি নাচা নেচে শেষে নিজেদের সামলে নিল। তারপর শুরু হল বদুদার খেলা। এমন খেলা কেউ দেখেছে কি না জানি না। ভাওড়ার কোনও প্লেয়ার বল নিয়ে এগুতে গেলেই বদুদা তেড়ে যাচ্ছে চেঁচাতে চেঁচাতে, কী বলছে শোনা যাচ্ছে না, কখনও যাত্রার পার্ট মুখস্থ বলছে, কখনও হুংকার ছাড়ছে, কখনও খেপিয়ে দিচ্ছে। এরপর শুরু করল বদুদার মার। সিংগল কাঁচি, জোড়া কাঁচি, ছররা, ল্যাঙ, কনুইবাজি, হাঁটু-চোট, গরদানা— কত রকম কী মার আছে বদুদার, চোরা মার, সোজা মার, সবই মারতে লাগল। ধন্য রেফারি। অত মার, তবু চক্ষু দুটি বুজে রইল।
কতক্ষণ আর সহ্য করে মানুষ। শেষে ভাওড়া কোলিয়ারির জন বদুদাকে এমন এক গুপ্তি মারল যে মহিষাসুর বদুদা ছিলে-কাটা ধনুকের মতন ছিটকে গিয়ে সাইড লাইনে পড়ল। পড়ে আর উঠতে পারল না। কাঁধের কাছে হাড় সরে গেছে। বদুদা ছটফট করতে লাগল। রেফারি জনকে মাঠ থেকে তাড়িয়ে দিল।
হাফ-টাইমের পর আবার যখন খেলা শুরু হল তখন পিলকিন’স ইলেভেন মরিবাঁচি করে লেগে পড়ল। ভাওড়াও কম যায় না। তারাও বারবার আছড়ে পড়তে লাগল পিলকিন’স ইলেভেনের গোলের ওপর।
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আমাদের গলা বসে গেল, বিশ-পঁচিশটা ভাঙা ছাতা হাটের দিকে উড়তে লাগল, আকাশে আবার কালো করে মেঘ জমে উঠল। তবু কিছু হল না। দু’-পক্ষই লড়ে যেতে লাগল। ম্যাচ ড্র হল।
পরের দিন আবার খেলতে হবে। তাই নিয়ম ছিল।
পরের দিন যে আমরা হেরে যাব এ যেন সবাই বুঝে নিয়েছিল। শোনা গেল, ভাওড়া কোলিয়ারি বলে দিয়েছে, আসানসোলের বার্জ ছাড়া অন্য কোনও রেফারি মাঠে নামলে তারা খেলবে না, দল নিয়ে চলে যাবে।
পিলকিনসাহেব বললেন, “ঠিক আছে। বার্জকেই আনাব। তবে সে ফাইনালের খেলা খেলাবার জন্যে তৈরি ছিল। ঠিক আছে।”
পরের দিন অদ্ভুত এক কাণ্ড করলেন পিলকিনসাহেব। মাঠে টিম নামাবার সময় গোলকিপার হিসেবে নামিয়ে দিলেন অখিল সাহানাকে। অখিলদাকে দেখতে কোলাব্যাঙের মতে। বেঁটে, মোটা, গোল। মাথায় চুল নেই। মাসখানেক আগে তার বাবার শ্রাদ্ধ গিয়েছে।
অখিলদাকে নিয়ে কোলিয়ারসুদ্ধু সবাই মজা করত। নিজেও ভীষণ মজার মানুষ। হরদম মজা করে। ওই ব্যাঙের মতো চেহারা নিয়ে ডিগবাজি খায়, কখনও কখনও জোড়া ডিগবাজি। অদ্ভুত এক মুখভঙ্গি করে ভেঙচায়, থপ থপ করে জোড়া পায়ে লাফায়। আর অনবরত খিলখিল খকখক করে হাসতে পারে। তার হাসির কোনও মাথামুন্ডু নেই।
অখিলদাকে জোকার বলা যায়, কিন্তু সে তো ফুটবল প্লেয়ার নয়। মাঠে এসে মজা করে এই যা। সেই অখিলদাকে গোলকিপার হিসেবে খেলতে নামালেন কেন পিলকিনসাহেব? মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে নাকি! নাকি সাহেব ধরেই নিয়েছেন, হারতে যখন হবেই তখন বৃথা লড়ালড়ি না করে মাঠে একটু তামাশাই করা যাক! কী জানি কী মনে ছিল ওঁর।
খেলা শুরুর আগে দেখি, কোলিয়ারির জন্য-পাঁচেক যণ্ডা গোছের লোক ঢাক, ভেঁপু, কাঁসর-ঘণ্টা নিয়ে মাঠে এসে হাজির। সঙ্গে আরও চার-পাঁচজন অতি বজ্জাত দামড়া গাঁয়ের লোক। ওদেরই শাকরেদ।
এবার পিলকিন’স ইলেভেনই মাঠে নামল প্রথমে। অখিলদার গায়ে লাল গেঞ্জি, মাথায় এক বাঁদুরে টুপি। নামল ডিগবাজি খেতে খেতে, জোকারদের মতন হাত-পা ছুড়ল, গড়াগড়ি দিল মাটিতে, আবার ডিগবাজি খেল। একে ওই ব্যাঙের মতো চেহারা, তার ওপর অমন বেশভূষা, আমরা তো হেসেই মরি। মাঠসুদ্ধু লোকের মজা লেগে গেল। হাসির ধুম।
তারপর দেখি, পিলকিন’স ইলেভেন যে দিকের গোল আগলাতে গেল, সেদিকে মাঠের ঠিক বাইরে গোল লাইন ঘেঁষে সেই ষণ্ডা গোছের লোকগুলো তাদের শাকরেদদের নিয়ে সার বেঁধে দাড়িয়ে পড়ল। তাদের হাতে ভেঁপু, কাঁধে ঝোলানো ঢাক, হাতে কাসর-ঘণ্টা। অখিলদা বার-দুই ডিগবাজি খেল, সঙ্গে সঙ্গে ঢাক আর ভেঁপু বেজে উঠল। যেন নাচ প্র্যাকটিস হল বাজনার সঙ্গে।
ব্যাপারটা তখনও ভাল বুঝলাম না। মনে হল, একটা কিছু মতলব নিয়ে লোকগুলো এসেছে। কিন্তু কী যে মতলব বুঝতে পারলাম না।
খেলা শুরু হল।
ভাওড়া কোলিয়ারি যেন ঠিক করে নিয়েছিল আজ তারা প্রথম দিকে একটু গা আলগা করে খেলবে, খেলে পিলকিন’স ইলেভেনকে ধোঁকা দেবে, তারপর আচমকা লাফ মেরে টুঁটি চেপে ধরবে পিলকিনদের।
সেই ভাবেই খেলা শুরু হল। আমাদের কোলিয়ারি সাপের ফণা তোলার মতন করে ছুটে গেল ওদের পেনাল্টি এরিয়া পর্যন্ত। কিন্তু ছোবল বসাতে পারল না। হেলেসাপের মতো নেতিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ এইভাবে কাটল। হঠাৎ দেখি সেই বানোয়ারিলাল বল নিয়ে পনপন করে ছুটে আসছে। কে তাকে আটকায়। দেখতে দেখতে আমাদের গোলের কাছে। এই বুঝি একটা দিল ঢুকিয়ে।
কিন্তু ও কী! আমাদের গোলকিপার অখিলদার কাণ্ড দেখেছ? বল নিয়ে বানোয়ারি ঝড়ের বেগে তেড়ে আসছে আর অখিলদা গোল লাইনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সার্কাসের ক্লাউনদের মতো ডিগবাজি খাচ্ছে। থপ্ থপ্ করে নাচছে। মুখের নানা রকম ভঙ্গি করছে। এ আবার কী!
বানোয়ারি গোলের কাছে শট নিতে যাচ্ছে। আর সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত শব্দ করে ভেঁপু বেজে উঠল।
কেমন থমকে গেল বানোয়ারি, পায়ের বল পায়ের কাছেই পড়ে থাকল। সে চোখ তুলে অখিলদার ডিগবাজি খাওয়া আর নাচ দেখল। দেখে হেসে ফেলল। প্রথমে দমকা হাসি, তারপর হো-হো হাসি, শেষে পেট চেপে অট্টহাসি। আর একেবারে শেষে হাসতে হাসতে মাঠে গড়াগড়ি দিতে লাগল।
যণ্ডার দল যেন তাক খুঁজছিল। তারা ভেঁপু, ঢাক, কাসর-ঘণ্টা বাজাতে লাগল প্রাণপণে। সেই সঙ্গে নাচতে লাগল।
মাঠসুদ্ধু লোক খেলা দেখবে কী, তামাশা দেখে যেন হেসেই মরতে লাগল। হইহই কাণ্ড লেগে গেল মাঠে।
রেফারি বার্জ খেলা বন্ধ করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এসব কী? এটা খেলা না সার্কাস?”
পিলকিন বললেন, “আমার টিমের গোলকিপার যদি ডিগবাজি খায় তাতে হয়েছে কী? কোন আইনে আছে গোলি মাঠের মধ্যে ডিগবাজি খেতে পারবে না?’’
বার্জ বললেন, “তোমার কোলিয়ারির লোকরা ওই সব বাজনা বাজাচ্ছে কেন? অন্য টিমের প্লেয়াররা গোলে শট নিতে পারছে না, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছে!”
পিলকিন বললেন, “মাঠের বাইরের লোক আমার টিম নয়। তারা পাবলিক। তারা বাজনা বাজাতে পারবে না, এমন কোনও আইন আছে?”
রেফারি বার্জের কাছে কোনও আইনের বই ছিল না। তা ছাড়া সেকালে কোলিয়ারির ম্যাচ খেলাতে কে আর আইনের বই দেখে রেফারি হয়েছে।
বার্জ বললেন, “হয় তোমাদের বাঁদরামি বন্ধ করো, না-হয় আমি খেলা বন্ধ রেখে চলে যাচ্ছি।”
পিলকিন খানিকটা ভেবে বললেন, “ঠিক আছে। আমার টিম ফেয়ার গেম খেলবে। খেলা শুরু করো।”
আবার খেলা শুরু হল।
তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না, পিলকিন’স ইলেভেন হঠাৎ কেমন ভদ্রলোক হয়ে গেল। আর গোনা-গুনতি বারোটা গোল খেয়ে মাঠের মধ্যেই শুয়ে পড়ল। লেমনেড পর্যন্ত খেল না।
২৬ জুন ১৯৮৫
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন