রাঘব বোয়াল – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

পৌলোমী সেনগুপ্ত

রাঘব বোয়াল – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

রাঘববাবু একজন নামকরা লেখক। বিশেষ করে ভূতের গল্প লেখায় তাঁর জুড়ি নেই। এমন অনেক লেখক আছেন যাঁরা ভূতের গল্প লেখেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখিয়ে দেন ভূত বলে কিছু নেই, মানুষ উদ্ভট কিছু দেখে ভয় পায় এবং ভূতের অস্তিত্ব কল্পনা করে নেয়। রাঘববাবু কিন্তু এই লেখকদের দলে নন। তাঁর গল্পে ভূত আছে এবং থাকবে। তাঁর যুক্তি হল ভূতের গল্প যারা পড়তে ভালবাসে তারাই তো ভূতের বই কিনবে! তা ভূতের গল্পে যদি ভূত না থাকে তা হলে সেই গল্প লিখে নিজের নামটি ছাপিয়ে নেওয়ার দরকারটা কী? রুচিতে বাধে, অন্য গল্প লেখো। আপত্তি করছে কে?

যাই হোক, রাঘববাবু বনগাঁ থেকে আসেন। ওখানকার কোনও একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তাঁর বেশ কয়েকটি বই খুবই জনপ্রিয়। তা কলকাতায়, মানে বইপাড়ায় এলে প্রথমেই তিনি তাঁর প্রকাশকের দোকান ‘সৎ সাহিত্য’-এ ঢোকেন আড্ডা দিতে। তার কারণ এঁদের দোকানের পরিবেশ খুব ভাল। তাই আড্ডা দিতে ভালও লাগে। বই প্রকাশ এবং টাকা-পয়সার লেনদেনের ব্যাপারেও এঁদের সঙ্গে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাঁর।

সেদিন বিকেলে দোকানে বসে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন, এমন সময় চায়ের ভাঁড় ও কেটলি নিয়ে আনন্দদা এল। তাকে দেখেই তো আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠলেন রাঘববাবু। হবেন না-ই বা কেন? বইপাড়ায় এলে আনন্দদার চা খেতে পাওয়া একটা ভাগ্যের ব্যাপার। তার কারণ সুদীর্ঘ দিন ধরে চায়ের একই রকম স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে চলেছেন আনন্দদা। সবচেয়ে বড় কথা, আনন্দদা অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। এই বিশাল বইপাড়ার দোকানে দোকানে চা-সাপ্লাই দেওয়া কি মুখের কথা? কেউ চাইলেই পায়, কেউ চেয়েও পায় না।

তা আনন্দদার চা পেলে কে না খুশি হন? সদাহাস্যময় আনন্দদা সব সময়ই আনন্দময়। আজ কিন্তু আনন্দদার মুখ একটু গম্ভীর। অথচ এমনটি হওয়ার কথা নয়। চেহারার দিক থেকে আনন্দদাকে সবাই বলে উনি নাকি জরাব্যাধিকে পর্যন্ত জয় করেছেন। কিন্তু সেই আনন্দদা আজ এত ম্লান কেন?

রাঘববাবু বললেন, “কী হল আনন্দদা তোমার মুখে হাসি নেই কেন?”

আনন্দদা সে কথার উত্তর না দিয়ে ভাঁড় মেপে সবাইকে চা দিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেল, “কাল বিকেলে শিয়ালদহ স্টেশনে আমাকে দেখে অমন না চেনার ভান না করলেই পারতেন।”

রাঘববাবু অবাক। বললেন, “আমি!”

“মনে করেই দেখুন না।”

এর পরে আর কথা চলে না। পরিচিত লোককে দেখেও না দেখলে অথবা চিনতে না পারলে দুঃখ হওয়াই স্বাভাবিক।

প্রকাশক বললেন, “এমন তো হওয়ার কথা নয়, আপনি কি অন্যমনস্ক ছিলেন কাল?”

রাঘববাবু বললেন, “কাল বাগুইআটিতে আমি একটি স্কুলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে প্রধান অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম। গাড়িতে গেছি গাড়িতেই এসেছি। অতএব শিয়ালদা স্টেশনে ওর সঙ্গে তো দেখা হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।”

তাই তো! সত্যিই তো! রাঘববাবু যে কাল বাগুইআটিতে গিয়েছিলেন তার প্রমাণ আছে। কেননা ওই প্রকাশকেরই এক আত্মীয় ওঁর অটোগ্রাফ এনে দেখিয়েছিল তাঁকে। তবে কি আনন্দদারই ভুল। তাই বা কী করে হয়? রাঘববাবু তো একদিনের নয়, বিশ বছরের চেনা।

ধান্দাবাজ সুবিমল সেন একটি ভুয়া চিট ফান্ডের ফাঁদে ফেলে মধ্যবিত্ত গৃহস্থদের সর্বস্বান্ত করে থাকেন। সেদিন গড়িয়াহাটার মোড়ে দাঁড়িয়ে সবে একটি সিগারেটে টান দিয়েছেন এমন সময় এক সুবেশা তরুণী এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেল তাঁকে।

সুবিমল সেন ছিটকে সরে গেলেন, “এ কী! এ কী! কে আপনি? পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন কেন?”

তরুণী বলল, “আমি আপনাকে অনেকদিন ধরে খুঁজছি। আজ যখন পেয়েছি তখন আর ছাড়ছি না আপনাকে।”

সুবিমল সেন ধরা পড়ার ভয়ে সভয়ে তাকালেন তরুণীর দিকে। তারপর সিগারেটটা ফেলে দিয়ে এক লাফে একটি চলন্ত ডবলডেকারের হাতল ধরে ঝুলে পড়লেন।

তরুণী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেইদিকে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল ওর।

পরদিন বিকেলে অশোকনগরে ওর এক মাসির বাড়িতে গিয়েছিল তরুণী। সেখানে তখন কোনও এক পাঠাগারের সংগীত ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির পদ অলংকৃত করছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক রাঘবচন্দ্র ভট্টাচার্য।

তরুণীও ওর মাসির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সেই অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিল। কেননা ওর মাসির ছেলেই তো প্রথম পুরস্কারটি নেবে রাঘববাবুর হাত থেকে।

নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ফুঁসে উঠল তরুণী। কাউকে কিছু না বলেই সে চুপিসারে উঠে গেল মঞ্চের দিকে। তরুণীকে দেখে কেউ বাধা দিল না বা আপত্তি করল না। তরুণী গিয়ে উদ্যোক্তাদের একজনকে বলল, “আমি আপনাদের রাঘববাবুর একজন ভক্ত পাঠিকা। শুধু তাই নয়, ওঁর লেখা একটি ছবিতে আমি সহ-নায়িকার ভূমিকায় অভিনয়ও করছি। তাই ওঁর সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই।”

উদ্যোক্তারা বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিছুদিন আগে ছোট পরদাতেও আপনি একটি সিরিয়ালে অভিনয় করেছেন। আপনার নাম তো অনামিকা রায়?”

“হ্যাঁ।”

“আসুন, আসুন। মঞ্চে আসুন। আমাদের কী সৌভাগ্য যে এমন একজন অভিনেত্রীকে আমরা পেয়ে গেলাম।—” বলেই ঘোষণা। “উপস্থিত দর্শক ও সুধীবৃন্দ, এইমাত্র দূরদর্শন, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের পরদা থেকে জনপ্রিয় অভিনেত্রী অনামিকা রায় উঠে এসেছেন আমাদের ডাকে আমাদের এই ছোট্ট অনুষ্ঠানটিকে সাফল্যমণ্ডিত করতে। বাংলা তথা মুম্বইয়ের টলিউড বনাম বলিউডের এই সম্ভাবনাময় অভিনেত্রী তাঁর অজস্র ছবির কাজ ফেলে উঠে এসেছেন। রামধাক্কা, গুলতাপ্পি, শ্রীমতী চারশো বিশ, মার থাপ্পড় প্রভৃতি আগামী দিনের বহু ছবির নায়িকা উনি—।”

তরুণী বাধা দিয়ে বলল, “না, না, এসব বলে আপনারা লজ্জা দেবেন না আমাকে। এত ছবিতে কাজ আমি করছি না।”

উদ্যোক্তারা চাপা গলায় বলল, “না করলেই বা। এটা হচ্ছে পাবলিসিটির যুগ। টেনে টেনে গুল মারতে হয় এ-যুগে।” বলেই বলল, “প্রচারবিমুখ আমাদের এই নব নায়িকা অনামিকা ওঁর সম্বন্ধে বেশি কিছু বলতে বারণ করছেন। তবে আমাদের কাছে খবর আছে রাজ কপুর তাঁর আগামী ছবির ব্যাপারে কথা বলতে শিগগিরই আসছেন ওঁর কাছে।”

দর্শকদের মধ্য থেকে গুঞ্জন উঠল এবার, “সে কী! রাজ কপুর তো মারা গেছেন কয়েক বছর আগে!”

ঘোষক বলল, “সরি! ভুল বলার জন্য দুঃখিত। রাজ কপুর নয়, দেবানন্দ। ছবির নাম—। নামটা অবশ্য এখনও ঠিক হয়নি। যাক, উনি সাহিত্যিক রাঘববাবুর সম্বন্ধে দু’-চার কথা আপনাদের বলতে চান।”

তরুণী এবার মাইকের সামনে এগিয়ে এল। এসে বলল, “হে সুধীগণ, আজ আপনাদের কাছে আমি এমন দু’-একটি কথা শোনাব এই রাঘববাবুর সম্বন্ধে, যাতে আপনারা চমকে উঠবেন। এই বেড়ালতপস্বী সাহিত্যিক হিসেবে খুবই পরিচিত। জনপ্রিয়ও। কিন্তু এই মহান ব্যক্তিটির এমন একটি ছদ্মবেশ আছে যা আপনারা জানেন না। এই যে দেখছেন বক ধার্মিকটি ফুলের মালা গলায় দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন ইনি কিন্তু এর বাইরে অত্যন্ত মারাত্মক। এলাকার বাইরে গেলেই ইনি প্যান্ট শার্ট পরে অন্যমূর্তি ধরেন। কাগজে কত মিথ্যে লেখা হয় এঁর সম্বন্ধে। ইনি নাকি নেশা করেন না, ধূমপান করেন না। সব মিথ্যে, কাল আমি নিজের চোখে ওঁকে ধূমপান করতে দেখেছি।”

রাঘববাবু দারুণ রেগে উঠে দাঁড়ালেন এবার। বললেন, “মিথ্যে কথা। সব মিথ্যে। আমার পেছনে একটা ঘোর ষড়যন্ত্র চলছে। কেউ পরিকল্পনা করেই পাঠিয়েছে এই অভিনেত্রীকে। ঠিক আছে আমার বদলে মঞ্চে উনিই থাকুন। আমি বিদায় নিচ্ছি।”

উদ্যোক্তাদের একজন বলল, “সেই ভাল। আপনি বরং বিদায়ই নিন। আপনাকে ডাকলেই পাব। কিন্তু এমন লাস্যময়ী একজন অভিনেত্রীকে তো পাব না। আসলে ফিল্‌ম স্টারদের পাই না বলেই আমরা আপনাদের মতো ঘাটের মড়াদের দ্বারস্থ হই। না হলে কে যেত বলুন আপনাদের কাছে?”

রাঘববাবু বললেন, “তা ঠিক। তা ঠিক।” বলে বিদায় নিলেন।

আর তাঁর অবর্তমানে সভা পরিচালনা এবং মাঝে মাঝে রাঘববাবুর শ্রাদ্ধ করতে লাগল তরুণী।

রাঘববাবু তো রীতিমতো অপমানিত হয়েই বাড়ি ফিরলেন সে-রাতে। বারবার তাঁর আনন্দদার কথা মনে হল। কোথায় যেন একটা গোলমাল আচমকাই হয়ে যাচ্ছে। কী এর রহস্য?

মনের দুঃখে রাঘববাবু ভাল করে খেতেও পারলেন না সে-রাতে।

পরদিন সকালে বাজারে গেছেন। কী লজ্জা, কী লজ্জা! দেখলেন, সবাই কেমন এড়িয়ে যেতে লাগল তাঁকে। কেউ কেউ দূর থেকে আঙুল তুলে দেখাতে লাগল।

যে মাছওয়ালার কাছে প্রতিদিন মাছ নেন তার কাছে গিয়ে মাছের দাম জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, “এ মাছ বিক্রি নেই।” বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিল। অথচ পাশের বাড়ির দোলনবাবু একশো গ্রাম পেটির মাছ দশ টুকরো করে দিতে বলতেই মাছওয়ালা বিরক্ত না হয়ে তাই দিল এবং ওজন করে দামও নিল।

হঠাৎ কানে এল কে যেন বলছে, “রাঘব ভট্‌চায নয়তো, রাঘব বোয়াল। এমন একজন গুণী লোক অথচ কী তার কীর্তি।”

মানী লোকের অপমান মৃত্যুতুল্য। রাঘববাবু আর থাকতে পারলেন না। বললেন, “কী ব্যাপার বলুন তো মশাই আপনাদের? আমি কি চোর না ডাকাত? আমাকে আপনারা এমন করে দেখছেনই বা কেন, আর এতসব আজেবাজে কথাই বা বলাবলি করছেন কেন?”

এলাকার অত্যন্ত বদমেজাজি অঘোরবাবু এগিয়ে এলেন এবার। বললেন, “তা বাবা রাঘব বোয়াল, হাজত থেকে ছাড়া পেলে কখন?”

রাঘববাবুর মাথা গরম হয়ে উঠল। একে তিনি এই লোকটিকে সহ্য করতে পারেন না তার ওপর তাঁর এই চিপটেন কাটা কথা। বললেন, “হাজত থেকে ছাড়া পেলাম! আমি? এবার বুঝেছি এসব কার কাজ। এখনই আমি থানায় যাচ্ছি, উকিলবাড়ি যাচ্ছি। তোমার দফা আমি খেয়ে দিচ্ছি দাঁড়াও।”

অঘোরবাবু হেসে বললেন, “তবে যাই বলো বাপু, কাগজে তোমার ছবিটি কিন্তু ভাল ছেপেছে। নতুন নামও দিয়েছে রাঘব বোয়াল। ডুবে ডুবে অনেকদিন ধরেই জল খাচ্ছ তা হলে, কী বলো?”

ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল রাঘববাবুর। বাজারের ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, “কই, কোথায়? কোন কাগজে বেরিয়েছে আমার ছবি? নিয়ে আয় দেখি, তারপরে তোর ব্যবস্থা করছি। ছুঁচো কোথাকার।”

অমনই একটি ফোচকে ছোকরা পাশের চা-দোকান থেকে সেদিনের খবরের কাগজখানা এগিয়ে দিল তাঁর দিকে। দিয়ে বলল, “এই যে গুরু, দ্যাখো কী সুন্দর ছবি বেরিয়েছে তোমার।”

রাঘববাবু জ্বলে উঠলেন। কথায় আছে কপাল ফাঁসলে ব্যাঙেও লাথি মারে। ফচকে একটা ছেলে, তিনি ওর বাপের বয়সি, তাঁকে কিনা ‘তুমি’ বলা? অথচ বছরখানেক আগে ওই ছেলেটির ডাকেই ওদের বিশ্ববখাটে সঙ্ঘের সভাপতি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

যাই হোক, ছেলেটির হাত থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে খবরের ওপর চোখ বুলিয়েই লাফিয়ে উঠলেন রাঘববাবু।

আশপাশের লোকজন তখন মজা দেখে হাসছে।

অঘোর শয়তানটা গলায় আওয়াজ করে হাসচে, “হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ।”

রাঘববাবুর চোখ কপালে উঠে গেল। কাগজের প্রথম পাতাতেই তাঁর ছবি। আর বেশ বড় বড় অক্ষরেই ছাপা আছে ‘রাঘব বোয়াল ধৃত’। সংবাদ এইরকম— প্রখ্যাত সাহিত্যিক রাঘব ভট্টাচার্য ওরফে সুবিমল সেন প্রতারণার অভিযোগে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এখন জেল হাজতে। শিয়ালদহর কাছে একটি হোটেলে এক ব্যবসায়ীকে দু’লাখ টাকা প্রতারণা করতে গিয়ে…।

আর পড়তে পারলেন না তিনি। রাগে কান গরম হয়ে গেল তাঁর। লজ্জায় অপমানে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে এলেন। পেছন থেকে অঘোর শয়তানটা চেঁচাতে লাগল, “গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাঘব বোয়াল চোর হ্যায়।”

এদিকে পাড়াতেও তখন হুলুস্থুলু। রাঘববাবুর স্ত্রী ছেলেমেয়ে প্রতিবেশীদের গঞ্জনায় ঘর থেকে বেরোতে পারছেন না। সবারই লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।

রাঘববাবুর বন্ধু দেড়কড়ি ভড় একজন নামকরা উকিল। রাঘববাবুকে তিনি ভালই চেনেন। সেই লোক এই কাজ করবে তা তিনি বিশ্বাসই করেন না। তাই কাগজ দেখেই ছুটে এলেন রাঘববাবুর কাছে। বললেন, “কী ব্যাপার রে রাঘব! এসব কী?”

রাঘববাবু বললেন, “সেটা তো আমিও ভেবে পাচ্ছি না। দিব্যি জলজ্যান্ত মানুষটা আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি অথচ সংবাদে প্রকাশ আমি নাকি জেল হাজতে।”

উকিলবাবু একবার শুধু বললেন, “হুঁ।” তারপর বললেন, “আমার নাম কিন্তু দেড়কড়ি ভড়।” বলেই পাড়ার অতি উৎসাহী কয়েকজন লোককে নিয়ে থানায় গেলেন। রাঘববাবুও গেলেন সঙ্গে।

থানার দারোগাবাবু অবশ্য ভাল ব্যবহার করলেন সকলের সঙ্গে।

দেড়কড়ি ভড় বললেন, “আমার মক্কেল এই রাঘববাবুকে আপনি চেনেন?”

“বিলক্ষণ চিনি।”

“আজকের কাগজ দেখেছেন?”

“দেখেই আঁতকে উঠেছি। এবং সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় ফোন করে জেনেছি উনি এখন কঠোরভাবে গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে আছেন। এমনকী, ওঁকে কোনও জামিনও দেওয়া হবে না। তা এখন তো দেখছি…।”

“কী দেখছেন?”

“উনি সশরীরেই উপস্থিত।”

“তা হলেই বুঝুন ব্যাপারটা কীরকম গোলমেলে।”

“মোটেই গোলমেলে নয়। আসলে উনি ভূতের গল্প লেখেন তো, তাই ভূতেরাই ওঁকে ভালবেসে এই ভৌতিক কাণ্ড ঘটিয়েছে।”

“এখন তা হলে।”

“চলো কলকাতা।”

চলো তো চলো। সবাই চলল কলকাতায়। গিয়ে দেখা গেল রাঘববাবুর ডুপ্লিকেট খাঁচাঘরে বন্দি হয়ে আছেন। প্যান্টশার্ট-পরা হুবহু একই চেহারা। রাঘববাবু ধুতি পরেন। পোশাকটুকু বাদ দিলে দু’জনেই এক। এই প্রতারকের নাম সুবিমল সেন। কিন্তু রাঘববাবুর নামের সঙ্গে ওঁর নামটা জড়াল কেন? তারও কারণ আছে। প্রথমত, চেহারার হুবহু মিল। তার ওপর ধৃতের অ্যাটাচি থেকে রাঘববাবুর লেখা কয়েকটি বইও পাওয়া গেছে। প্রতারক অবশ্য বরাবরই বলেছে উনি রাঘববাবু নন, বা ওঁর সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্কও নেই। তবুও পুলিশের ধারণা, লজ্জা ঢাকতেই বুঝি…

পরদিন কাগজে আসল সত্য প্রকাশ হওয়ায় রাঘববাবু তাঁর হৃত মর্যাদা ফিরে পেলেন। বইপাড়ায় প্রকাশকের দোকানে আড্ডা দিতে এসে আনন্দদার তৈরি চা বেশ তৃপ্তি করেই খেলেন। আনন্দদাও তাঁর ভুলটা বুঝতে পারল। আসলে সেদিন ওই প্রতারককে দেখেই…। যাই হোক, আর কোনও খেদ নেই রাঘববাবুর। নব ভ্রান্তিবিলাসের প্রভাবে লজ্জিতা সেই তরুণীও এসে ক্ষমা চেয়ে গেল একদিন। কিন্তু এত সত্ত্বেও রাঘববাবুর নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ওই রাঘব বোয়াল নামটি কিন্তু মুছল না। রাঘববাবু সবার কাছে রাঘব বোয়ালই হয়ে গেলেন।

১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯

সকল অধ্যায়

১. বিষে বিষক্ষয় – আশাপূর্ণা দেবী
২. আটচল্লিশ – অরবিন্দ গুহ
৩. ডোডো তাতাই পালা কাহিনি – তারাপদ রায়
৪. কৈলাসে চা পান – আশাপূর্ণা দেবী
৫. চোরে ডাকাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের নতুন কাজ – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ইলশেঘাই – লীলা মজুমদার
৮. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ! – শিবরাম চক্রবর্তী
৯. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
১১. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
১২. কে ফার্স্ট? – আশাপূর্ণা দেবী
১৩. ফ্ল্যাট রেস – জরাসন্ধ
১৪. চিত্তশুদ্ধি আশ্রম – বিমল কর
১৫. টেনাগড়ে টেনশান – বুদ্ধদেব গুহ
১৬. হাতি-চোর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৭. ছোটমাসির মেয়েরা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৮. মোটরবাইক, ষাঁড় ও লাকি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৯. ব্যাঙাচিদের লেজ – তারাপদ রায়
২০. বাজারদর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২১. তেঁতুলমামার জগৎ – হিমানীশ গোস্বামী
২২. রাজার মন ভাল নেই – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৩. গজেনকাকার মাছ-ধরা – বিমল কর
২৪. দাদুর ইঁদুর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৫. সাত নম্বর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৬. মেজদার সার্কাস – চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত
২৭. চোর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৮. কুস্তির প্যাঁচ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
৩০. পিলকিন’স ইলেভেন – বিমল কর
৩১. রাত যখন বারোটা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩২. ভুনিকাকার চৌরশতম – বিমল কর
৩৩. গ্রামের নাম জাঁকপুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩৪. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩৫. বাঘের দুধ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৬. গগনবাবুর গাড়ি – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৭. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৮. কুরুক্ষেত্র – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৯. কাক্কাবোক্কার ভুতুড়ে কাণ্ড – শৈলেন ঘোষ
৪০. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪১. বড়দার বেড়াল – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪২. মহাকর্ম – সমরেশ মজুমদার
৪৩. পায়রাডাঙায় রাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৪. মামার বিশ্বকাপ দর্শন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৫. গটমটে সাহেব বটে – শৈলেন ঘোষ
৪৬. রাঘব বোয়াল – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪৭. স্কন্ধকুমার এবং অর্ধচন্দ্র – তারাপদ রায়
৪৮. পাগল হইবার সহজপাঠ – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৯. বিপিনবিহারীর বিপদ – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. সাদা রঙের পাঞ্জাবি – অনির্বাণ বসু
৫১. জগু যাবে বেড়াতে – বাণী বসু
৫২. কুঞ্জবাবুর পিঁপড়ে বাতিক – অমিতাভ গঙ্গোপাধ্যায়
৫৩. ভুলে যাওয়া – সিদ্ধার্থ ঘোষ
৫৪. ঝগড়ুটে ফাইভ – প্রচেত গুপ্ত
৫৫. বিপদভঞ্জনের সর্পদোষ – উল্লাস মল্লিক
৫৬. মাসির বাড়ি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৫৭. জাগ্রত অসুরের গল্প – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৫৮. কাকাতুয়া ডট কম – প্রচেত গুপ্ত
৫৯. নতুন নাটকও ভন্ডুল – উল্লাস মল্লিক
৬০. রামখেলাওনের কেরামতি – সৌরভ মুখোপাধ্যায়
৬১. কলহগড়ের নিস্তব্ধতা – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
৬২. পটলার থিমপুজো – শক্তিপদ রাজগুরু
৬৩. সংকটমোচন কমিটি – প্রচেত গুপ্ত
৬৪. নতুন বন্ধু চিনু – জয়দীপ চক্রবর্তী
৬৫. বুঁচকির মেয়ের বিয়ে – নবনীতা দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন