পৌলোমী সেনগুপ্ত
গণেশবাবুর ভারী দয়ার শরীর। তিনি ভিখিরিকে ভিক্ষে দেন, অভাবী মানুষকে সাহায্য করেন, কন্যাদায়গ্রস্তকে উদ্ধার করেন, গরিব ছাত্রের স্কুলের বেতন বা পরীক্ষার ফি দিতে কাতর হন না, পাড়ার ক্লাবে পুজোর চাঁদা দেন মুক্ত হস্তে। শুধু তাই নয়, তিনি সকালে উঠে নিজের হাতে কাক-পক্ষীদের ডাকাডাকি করে আটার নাড়ু আর দানা খাওয়ান, রাস্তার কুকুরদের দেন মাছের কাঁটা মেশানো ভাত, বেড়ালকে ভুক্তাবশেষ দুধ। কত আর বলা যাবে, বললে শেষ হয় না।
সারাদিন গণেশবাবুর নানা কাজ থাকে। বিরাট তাঁর ব্যাবসা; মস্ত ফলাও কারবার। বেশ একটু রাত করেই ফেরেন তিনি। তারপর কিছুক্ষণ বুকডন বৈঠকি দিয়ে একটু ব্যায়াম করেন। তারপর পোষা বাঁদরকে কলা খাওয়ান, স্নান করেন, চাট্টি খান। রাত বারোটায় যখন শুতে যান, তখন তাঁর বুড়ি পিসির ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙার দোষও নেই। নব্বুই বছরের পিসি সেই সাঁঝবেলা থেকেই ঘুমোন। রাত বারোটায় তাঁর ঘুম হয়ে যায়। তখন ডাকাডাকি করতে থাকেন, “বলি ও গনশা, এয়েছিস?”
“এসেছি পিসি।”
“খাবি না?”
“খেয়েছি।”
“এবার তবে ঘুমো।”
“ঘুমোচ্ছি।”
“বলি ও গনশা, এয়েছিস?”
“এসেছি পিসি।”
“খাবি না?”
“খেয়েছি।”
“এবার তবে ঘুমো।”
“ঘুমোচ্ছি।”
“বলি ও গনশা, এয়েছিস?”
এরকম কিছুক্ষণ চলার পর বুড়ি দাসী দামুর মা উঠে ধমক দেয়, “বলি হচ্ছেটা কী গো দিদি, এক কথা ক’বার জিজ্ঞেস করতে হয়? বাবু এয়েছে, খেয়েছে, ঘুমিয়েছে। এবার তুমি ঘুমোও তো!”
“ঘুম কি আর আসে রে বাছা, যা শীত পড়েছে এবারে। হাড় কালি হয়ে গেল।”
“তোমার মাথাটাই গেছে দিদি। জষ্টির গরমে আমরা হাঁফাচ্ছি, আর ওঁর এখন শীত লাগতে লেগেছে।”
“গিরিষ্মি নাকি? তাই বল, জষ্টি মাস! আমি কি আর অতশত বুঝতে পারি বাছা? তা কথা তো একই। গিরিষ্মিতেও কষ্ট, শীতেও কষ্ট। তা যা হোক একটা দে। হয় লেপ, না হয় হাতপাখা। কীসের যে কষ্ট বুঝতে পারি না। তা সেবার বটঠাকুর গিরিষ্মিকালে যা একখানা কাঁটাল এনেছিল না ষষ্ঠীতলা থেকে…”
দামুর মা উঠে পান আর দোক্তা মুখে দিয়ে ঝাঁটাগাছ তুলে নিয়ে বলে, “ঘুমের তো দফা রফা করলে, তা আমিও তা হলে বেহানবেলার কাজ মাঝ-রাত্তিরেই সেরে রাখি। ঝাঁটপাট দিয়ে ফেলি এই বেলা।”
গণেশবাবুর ছেলে গোবিন্দ এমনিতে শান্তশিষ্ট, তবে তার মাথাটা বড্ড গবেট। ক্লাস নাইন থেকে টেন-এ উঠতে তার বছর-পাঁচেক লেগেছিল। তবে সে বড় ধৈর্যশীল ছেলে। দিনরাত পড়ে। সেই পড়ায় পাড়া মাত। দুঃখের বিষয়, পড়াটা তার মাথায় ঢুকতে চায় না, ঢুকলেও থাকতে চায় না।
রাতের পড়া শেষ করে গোবিন্দ ঘুমোচ্ছ। দামুর মা’র ঝাঁটার শব্দে সে তড়াক করে উঠে পড়ল। ঝাঁটার শব্দ মানেই ভোর। আর ভোর মানেই পড়া। গোবিন্দ গ্রামার খুলে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল।
এক্রাম আলির মুরগিরা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল। ঝাঁটার শব্দে তারা সচকিত হয়েছিল, গোবিন্দর পড়ার শব্দে তারা ভোর হয়েছে ভেবে কোঁকোর-কোঁ বলে সমস্বরে ডেকে উঠল।
এক্রাম আলির বাড়ির উলটো দিকে থাকেন ভদ্রেশ্বরবাবু। মুরগির শব্দে ঘুম ভাঙতেই ভদ্রেশ্বরবাবু তাড়াতাড়ি ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে ছড়িগাছ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন প্রার্তভ্রমণে। কানাইবাবুকেও সঙ্গে ডেকে নেন।
তা প্রায় রোজই এরকম হয়। গণেশবাবু ফেরেন। বুড়ি পিসির ঘুম ভাঙে। দামুর মা ঝাঁটপাট শুরু করে। গোবিন্দ পড়তে লাগে। এক্রাম আলির মুরগি ডাকে। ভদ্রেশ্বরবাবু আর কানাইবাবু প্রার্তভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন।
আর এসব কাণ্ড যখন ঘটতে থাকে, তখন চুপিচুপি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা লোক রোজই গণেশবাবুর বাড়ির পাছদুয়ার থেকে গুটিগুটি ফিরে যায়। লোকটা আর কেউ নয়, চারু চোর।
লোকে বলে চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই। মদন আর চারু হল তাই। দু’জনেই দু’জনের মাসতুতো ভাই, দু’জনেই চোর। দু’জনের ভাবও খুব। চারুর বিরস মুখ দেখে মদন রোজই জিজ্ঞেস করে, “আজও পারলি না?”
চারু মলিন মুখে মাথা নেড়ে বলে, “না।”
মদন চিন্তিত মুখে বলে, “তবে তো ভারী মুশকিল হল।”
মুশকিলই বটে। আসলে দু’জনেই ছিঁচকে চোর। চোরের মহলে তাদের কেউ বিশেষ পাত্তা দেয় না। তবে তল্লাটে কালু দাসের একটা চোর তৈরির ইস্কুল আছে। চোরের ইস্কুল বলতে ব্যাপারটা ফেলনা নয়। কালুর সেই ইস্কুল থেকে যারা পাশ-মার্ক পেয়ে যায়, তারা হিল্লি-দিল্লি গিয়ে নাম করে ফেলে। সেই ইস্কুলে ভরতি হওয়া ভারী শক্ত। বহু হবু চোর প্রতিবার অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসে। মদন আর চারু গত দু’বছর ধরে চেষ্টা করে পেরে ওঠেনি। এবারও কালুর হুকুম হয়েছে, মদনকে মল্লিকবাড়ি থেকে আর চারুকে গণেশবাবুর বাড়ি থেকে চুরি করে এলেম দেখাতে হবে, তবে ভরতি।
হাড়কিপটে গগন মল্লিকের বাড়িতে চুরি করাটাও শক্ত কাজ ছিল। তবে মদনের কপাল ভাল। গগন মল্লিকের সওয়া শো বছর বয়সি ঠাকুমা হঠাৎ পট করে মরে যাওয়ায় বাড়িতে তেমন পাহারা ছিল না। মদন সেই ডামাডোলে ঘরে ঢুকে চুরি করে পালায়।
কিন্তু ফেঁসে গেছে চারু।
মদন বলল, “উপায় তো একটা করতেই হচ্ছে। দু’ভাই একসঙ্গে কালুর ইস্কুলে চুরি শিখতে না পারলে আর মজাটা কী? ঠিক আছে, আজ রাতে আমিও তোর সঙ্গে থাকব। তবে কথাটা কালু জানতে পারলে দু’জনকেই বাদ দিয়ে দেবে।”
তো তাই ঠিক হল।
গণেশবাবু বাড়ি ফিরেছেন। ব্যায়াম করেছেন। বাঁদরকে কলা খাইয়েছেন, স্নান করেছেন। চাট্টি খেয়েছেন। পান মুখে দিয়ে হাই তুলেছেন।
ওদিকে পিসিরও ঘুম ভেঙেছে।
“বলি ও গনশা, এয়েছিস?”
“এসেছি।”
“খাবি না?”
“খেয়েছি।”
“এবার তবে ঘুমো।”
“ঘুমোচ্ছি।”
“বলি ও গনশা, এয়েছিস?”
“এসেছি।”
“খাবি না?”
“খেয়েছি।”
“এবার তাবে ঘুমো।”
“ঘুমোচ্ছি।”
বলি ও গনশা, এয়েছিস।”
এরকম চলতে চলতেই দামুর মা উঠে পড়ল।
শীত-গ্রীষ্ম নিয়ে কথা হল। তারপর দামুর মা রাগ করে ঝাঁটপট শুরু করে দিল। গোবিন্দ উঠে পড়তে বসে গেল। এক্রাম আলির মুরগি ডাকতে লাগল। ভদ্রেশ্বরবাবু বেরিয়ে কানাইবাবুকে ডাকাডাকি করতে লাগলেন, “বলি ও কানাইবাবু, আর দেরি করলে যে বেলা হয়ে যাবে, সুয্যি যে উঠে পড়ল বলে।”
গোটা পাড়াটাই বলতে গেলে মাঝরাত্তিরে জেগে উঠল।
এই অবস্থায় চুরি করা বা পালানো দুই-ই বিপজ্জনক। মদন এবং চারু শুনতে পেল, এ-বাড়ির লোক ও-বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা কইতে শুরু করেছে। গণেশবাবুর পিসির যে আক্কেল নেই, দামুর মা যে একটি উজবুক, গোবিন্দ যে একখানা পাঁঠা, এক্রামের মুরগিগুলো যে মানুষ নয়, ভদ্রেশ্বর আর কানাইয়ের যে কোনওকালে বুদ্ধি হবে না এসব আলোচনার পর তারা নিজেদের সুখ-দুঃখের নানা কথা বলাবলি করতে লাগল।
মদন আর চারু দু’জনেই জোড়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরস্পরের দিকে তাকাল।
চারু মাথা নেড়েবলল, “উপায় নেই মদনদা, এ-বছর তুমিই ভরতি হও কালুর ইস্কুলে।”
মদন চাপা গলায় ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর তো।”
ওদিকে গণেশবাবু পান চিবিয়ে পাশবালিশ আঁকড়ে সদ্য ঘুমের আবেশে চোখ বুজেছেন, এমন সময় জানলার বাইরে থেকে কে যেন মোলায়েম গলায় বলল, “গণেশবাবু, ঘুমোলেন নাকি?”
গণেশবাবু ভারী অমায়িক মানুষ। তাড়াতাড়ি উঠে বসে বললেন, “আজ্ঞে না, একটু ঘুমোব ঘুমোব ভাবছিলাম আর কী।”
“কিন্তু আপনার কি ঘুমোনটা উচিত হবে গণেশবাবু? সারা পাড়া জাগিয়ে রেখে আপনার ঘুমিয়ে পড়াটা কি ভাল কাজ?”
গণেশবাবু ব্যাপারটা বোঝেন। মাথা চুলকে লাজুক গলায় বললেন, “আজ্ঞে, তা অবশ্য ঠিক। আমার পিসি, আমাদের দাসী, আমার ছেলে, এক্রামের মুরগি, ভদ্রেশ্বর আর কানাই মিলে রোজ রাতে একটা ভজঘট পাকায় বটে, কিন্তু তার জন্য আমি কী করতে পারি বলুন। আপনার কোথা থেকে আসা হচ্ছে? এদিকে তো কখনও দেখিনি মশাইকে।”
মদন একটু কেঠো গলা সাফ করে নিয়ে বলল, “যদি অভয় দেন তো বলি, আমরা দু’জনেই চোর।”
“বটে! বটে!”
“গত সাতদিন ধরে আমার ভাই এই চারু এসে ঘুরে যাচ্ছে, একদিনও চুরি করতে পারেনি। না পারলে কালুর ইস্কুলে এবারেও ওকে নেবে না। ব্যাপারটা ভেবে দেখেছেন? আপনার দয়ার শরীর, কাক-কুকুর- ভিখিরি কাউকে ফেরান না, আমার এই ভাইটিকে কি আর ফেরাবেন?”
গণেশবাবু একটু হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু একটু ভাবতেই তাঁর মাথা পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি হেঁকে উঠলেন, “বটেই তো, আমার বাড়িতে একটু চুরি করবেন সে তো আমার সৌভাগ্য। দাঁড়ান, এখনই ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
বলে গণেশবাবু গর্জন করতে করতে গিয়ে গোবিন্দকে বিছানায় পাঠালেন। দামুর মাকে ধমকে গোয়ালে গিয়ে শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। পিসির ঘরে শিকল তুলে দিলেন। তারপর সদর খুলে একগাল হেসে বললেন, “আসুন, আসুন।”
এরপর আর চুরির কোনও বাধা রইল না।
তবে আমরা খবর পেয়েছি, চারু এবারেও কালুর ইস্কুলে ভরতি হয়নি। সে চুরি ছেড়ে পানের দোকান দিয়েছে।
১১ জুন ১৯৮৬
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন