পৌলোমী সেনগুপ্ত
খগা সরকার আর ভগা সরকারকে চিনত না এমন লোক টেনাগড়ে কেউ ছিল না। পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট শহর এই টেনাগড়। এখানে সকলেই সকলকে চেনে।
খগাদার বয়স হয়েছে ষাট-টাট। শৌখিন লোক। যৌবনে বেহালা বাজাতেন, শিকার করতেন, ওকালতিও। পিতৃপুরুষের বহু সম্পত্তি ছিল বিহারের নানা জায়গায়। তাই ‘খেটে খেয়ে’ তিনি জনগণের সামিল হতে চাননি। কিন্তু প্রয়োজন না থাকলেও খাটতে তিনি ভালবাসতেন এবং পরিশ্রমে বিশ্বাস করতেন।
খগাদার ভাই ভগাদার বয়স তিরিশ-টিরিশ হবে। টেনাগড়ে তিনি প্রায়ই নানা ধরনের খবরের সৃষ্টি করে থাকেন। লোকটি ভাল।
খগাদা এখন রিটায়ার্ড। ইদানীং চটের উপরে গুনছুঁচে রঙিন সুতো পরিয়ে ‘সদা সত্য কথা বলিবে,’ ‘ভগবান ভরসা’, ‘যারে রাখো সেই রাখে’ ইত্যাদি লিখে-লিখে বস্তির লোকেদের সেগুলো দান করেন। মাঝে-মাঝে কাহার-বস্তির অনিচ্ছুক শুয়োরগুলোকে ধরে এনে কুয়োতলায় তাদের জবরদস্তি সাবান মাখান। সন্ধেবেলায় ওঁর বাড়িতে ভজন গান হয়। সকালে দাতব্য হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা করেন। খগাদার ডিসপেনসারিতে লোম-ওঠা পথের কুকুর, কুঁজে-ঘা-হওয়া বলদ এবং হাড্ডিসার মানুষ— সকলেই চিকিৎসার জন্যে আসে এবং, আশ্চর্য, কেউ কেউ ভালও হয়ে যায়।
ছেলেমেয়েও নেই। খগাদা মৃতদার। ভগাদা বিয়েই করেনি। দুই ভাইয়ের সুন-সান্নাটা সংসার। থাকবার মধ্যে একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর, তার নাম মোহিনী। চাকর-বাকর আছে, গাই-বয়েল, খেতি-খামার খিদ্মদ্গার। আর আছে বারান্দায় দাঁড়ে-বসা একটা কুৎসিত কাকাতুয়া। ভগাদার আদরের পাখি। কুকুরটাও আদরের। কাকাতুয়াটাকে ভগাদা আদর করে ডাকত ‘কাকু’ বলে। আমরা বলতাম, ‘কাড়িয়া পিরেত’। ওদের বাড়ি ঢুকলেই কাকাতুয়াটা বলে উঠত, “ভাগো হিঁয়াসে, ভাগো হিঁয়াসে।”
খগাদা আধুনিক কবিতা, পশুপালন, বাজরা-মকাই, তাইচুং ও আই-আর-এইট ধান, ভগাদার ভবিষ্যৎ ইত্যাদি তাবৎ বিষয় নিয়েই আমাদের সঙ্গে জোর আলোচনা করতেন এবং গলার জোর বাড়ানোর জন্যে তেজপাতা-আদা-এলাচ দেওয়া গোরখপুরী কায়দায় বানানো চা ও ভৈষালোটনের জঙ্গল থেকে আনানো খাঁটি ঘিয়ে ভাজা সেওই খাওয়াতেন।
সেদিন সকালে খগাদার বসবার ঘরে ঢুকতেই দেখি খগাদার মুখ গম্ভীর, থমথমে।
গুনছুঁচ ঢুকে গেছে বুড়ো আঙুলে?
বীরু নিজের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, “খুব লেগেছে?”
খগাদা বললেন, “লেগেছে, তবে আঙুলে নয়, হৃদয়ে।”
ঢোক গিলে বললাম, “স্ট্রোক! মাইল্ট অ্যাটাক?”
খগাদা বললেন, “তার চেয়েও মারাত্মক।”
আমরা বসে পড়ে সমস্বরে বললাম, “কী, তবে কী?”
খগাদা বললেন, “চুরি।”
কোথায়, কোথায়? চোর কোথায়? কী চুরি? বলে আমরা প্রায় চিৎকার করে উঠলাম।
এমন সময় ভগাদাকে দেখা গেল একটা লাল রঙের শর্টস পরে কাবুলি জুতো পায়ে, খালি গায়ে কাকাতুয়াটাকে খাওয়াচ্ছেন নিজে হাতে বারান্দায় এসে।
খগাদা আঙুল দেখিয়ে বললেন, “ওই যে কালপ্রিট, ওই দাঁড়িয়ে আছে সশরীরে। সহোদর আমার। সাক্ষাৎ লক্ষ্মণ!”
আমাদের খারাপ লাগল, বিশ্বাসও হল না। আপন ভাই কখনও চুরি করতে পারে?
খগাদা কী বলছে বুঝতে না পেরে ভগাদা সাঁ করে বারান্দা ছেড়ে সরে গেল ভিতরে। ধরে থাকা খাঁচাটা হঠাৎ ছেড়ে দেওয়ায় কাকাতুয়ার খাঁচাটা জোরে নড়ে উঠল। কাকাতুয়াটা বলল, “কাঁচকলা খা! কাঁচকলা খা!” ভগাদাকেই বলল বোধহয়।
খগাদা আস্তে আস্তে বললেন, “গত শনিবার রাতে এ বাড়িতে যত কাঁসার ও রুপোর বাসন ছিল, সব চুরি করে নিয়ে গেছে চোরে, শুনেছ তোমরা?”
বীরু বলল, “সে কী? বাড়িতে বন্দুক ছিল না?”
আমি বললাম, “অত বড় অ্যালসেশিয়ান কুকুর ছিল!”
“ছেল।” খগাদা বললেন, “ছেল সবই। কিন্তু বন্দুক রাখা ছেল গ্রিজ মাখানো অবস্থায় বেহালার বাক্সে। আর কুকুর মজাসে ঘুমোচ্ছিল।”
আমরা বোকার মতো বললাম, “কুকুর ঘুমোচ্ছিল মানে?”
“তা হলে আর বললুম কী?” খগাদা সখেদে বললেন। তারপর বললেন, “যে বাড়িতে কুকুর ঘুমোয়, সে-বাড়িতে চুরি হবে না?”
এরপর গড়গড়ায় গয়ার তামাকে দুটো টান দিয়ে বললেন, “বুঝলে ভায়ারা, রোজ রাতে পড়াশুনো করি, আর শুনতে পাই বারান্দায় মোহিনীর পায়ের পায়জোড়ের আওয়াজ। মোহিনীকে ভগা রুপোর পায়জোড়বানিয়ে দিয়েছিল। পা ফেললেই ঝুমুর ঝুমুর করে বাজে। আওয়াজ শুনতে পাই। কিন্তু এগারোটা বাজলেই দেখি আওয়াজ থেমে যায়। একদিন মনে সন্দ হওয়াতে পা টিপে টিপে ভগার ঘরের সামনে গিয়ে দেখি ভগা মশারির মধ্যে অঘোরে ঘুমোচ্ছে, আর মেঝেতে শুয়ে মোহিনীও দিব্যি নাক ডাকাচ্ছে। আমি ডাকলুম, ‘ভগা’। তাতে ‘কে রে’ বলেই ভগা উঠে বসে জানালার ধারে আমায় দেখতে পেয়েই ঘুমন্ত মোহিনীর পেটে মারলে ক্যাঁক করে এক লাথি। ঘুমঘোরে লাথি খেয়ে মোহিনী তো মারলে বডি থ্রো।”—
বীরু বলল, “আর ভগাদা?”
“ভগাদা?” বলে, খগাদা বিদ্রুপের হাসি হাসলেন। বললেন, “ভগা আবার তক্ষুনি শুয়ে পড়ল।”
তারপর বললেন, “তোমরাই বলো, এ-বাড়িতে চুরি হবে না তো কোন বাড়িতে হবে?”
আমরা সত্যিই বড় চিন্তায় পড়লাম খগাদার জন্যে। সরি, ভগাদার জন্যে। আসলে ভগাদা মাঝে মাঝেই আমাদের এবং খগাদাকে ঝামেলায় ফেলতেন।
একদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরেই শুনলাম খগাদা আমাদের জরুরি তলব দিয়েছেন।
আমরা দৌড়ে গেলাম। দেখি, খগাদার অবস্থা খুব খারাপ। কোলে বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘কনকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস’ বইখানা আধ-খোলা পড়ে আছে, আর খগাদার চোখের কোণে জল চিক চিক করছে।
বীরু বলল, “খগাদা, কী? দুঃখ কীসের?”
খগাদা বললেন, “আর কী, একমাত্র ভাইটাকে বুঝি হারালাম এবার।”
“কী হয়েছে কী?” আমি উত্তেজিত হয়ে শুধোলাম।
খগাদা বললেন, “ভগা আর ওর বন্ধু গিদাইয়া পদ্মার রাজার বিলে হাঁস মারতে গেছে সেই ভোর চারটেয়— বাড়িতে মশলা বাটতে বলে গেছে। হাঁসের শিককাবাব বানাবে বলে শিক ঘষামাজা করে রাখতে বলেছে, টক দই, পেঁপে, গরমমশলা, ভাঙা পিরিচ সবকিছুর জোগাড় রেখে গেছে। আর দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল, এখনও তাদের দেখা নেই। নির্ঘাত কোনও অঘটন ঘটেছে। আমার পায়ের গেঁটে বাতটা বেড়েছে কয়েকদিন হল। আজ আবার অমাবস্যা। রোজ রসুন খাই, তবু ব্যথা যায় না। আমি তো চলচ্ছক্তিরহিত। তোমরা বাবা যাও একটু। আমার জিপগাড়িখানা নিয়ে যাও। ভগা গিদাইয়াকে নিয়ে মোটর সাইকেলে করে গেছে।”
বীরু বলল, “নো-প্রবলেম। আপনি চিন্তা করবেন না খগাদা। আমরা বন্দোবস্ত করছি। তার আগে আমি চট করে পোস্ট অফিস থেকে পদ্মার রাজবাড়ির ম্যানেজারকে একটা ফোন করে খবর নিয়ে নিই। তাঁকে আমি চিনি, আমার কাকার বন্ধু।”
খগাদা বললেন, “ব্যস, ব্যস, তা হলে তো কথাই নেই। এই নাও, টাকা নিয়ে যাও।” বলেই, কোমরের গেঁজ থেকে একটা লাল রঙের নাইলনের মোজা বের করে তার থেকে একটা দশটাকার নোট দিলেন বীরুকে।
বীরু বলল, “তুই থাক। খগাদা নিডস কম্পানি।”
খগাদা বললেন, “বুঝলে ভায়া, আজ কত কথাই মনে পড়ছে। ভগা যখন হাসপাতাল থেকে মায়ের সঙ্গে বাড়ি এল, তখন ওকে দেখতে একেবারে বাচ্চা একটা খরগোশের মতো ছিল। কী গাবলু গুবলু। তার উপর আবার খিল খিল করে হাসত। আমার চেয়ে কত ছোট। কিন্তু পড়াশোনা করল না, কিছুই করল না, জীবনটাকে নষ্ট করল পাখি আর কুকুর নিয়ে। আমিই এখন ওর মা, ওর বাবা, ওর দাদা, সব। কী বিপদ হল কে জানে। বিলে কি ডুবে মরল, না কি সাপে কামড়াল?”
একটু পর ক্রিং ক্রিং করে সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে চাকায় কির-র-র শব্দ তুলে বীরু ফিরল।
খগাদা একবার দাঁড়াবার চেষ্টা করেই মুখ বিকৃতি করে ‘উঃ মাগো’ বলে পায়ের ব্যথায় বসে পড়লেন।
বসেই বীরুর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “খবর পেলে?”
বীরু অধোবদনে দাড়িয়ে গম্ভীর মুখে বলল, “হুঁ।”
“কী?” খগাদা চিৎকার করে উঠলেন। তারপর বললেন, “বলে ফেলো সোজাসুজি। আছে, না নেই?” তারপরই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ভগা রে। আমার ভগাবাবু!”
বীরু বলল, “ভগাদা আছে। কিন্তু রাজার কয়েদখানায়।”
“হোয়াট?” বলে খগাদা আবার উঠে দাঁড়াতে গিয়েই ‘গেছি গেছি গেছি’ বলে বসে পড়লেন।
তারপর হাতের ‘কনকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস’টাকে মাটিতে ছুড়ে বললেন, “হোয়াই? হাউ কাম?”
বীরু বলল, “বিলের ধারে রাজার পোষা হাতি চরছিল, ভগাদা তাকে গুলি করেছে।”
“হাতিকে? গুলি? পাখি-মারা ছররা দিয়ে? ইমপসিবল্! নিশ্চয়ই অ্যাকসিডেন্ট। তা বলে কয়েদখানায়? খগা সরকারের ভাই কয়েদখানায়?”
বীরু, বীরর কাকাও আমি যখন খগাদার জিপ নিয়ে গিয়ে পদ্মার রাজার কয়েদখানা থেকে পঁচিশ টাকা জরিমানা দিয়ে ভগাদা, গিদাইয়া আর মোটর সাইকেলটাকে ছাড়িয়ে আনলাম, তখন রাত হয়ে গেছে।
আসবার পথে বীরু বলল, “ভগাদা, কী করে এমন হল? হাতি কি তোমাকে তেড়ে এসেছিল?”
ভগাদা বললেন, “আরে না না। এই গিদাইয়া ইডিয়টটার জন্যেই তো।”
গিদাইয়া মাথা ঘুরিয়ে টিকি নেড়ে মহা প্রতিবাদ জানাল।
ভগাদা বললেন, “বুঝলি, বিলে এক ঝাঁক পিনটেইল হাঁস ছিল। একটা পুটুস ঝোপের পাশে শুয়ে এইম করছিলাম। ভাবছিলাম লাইনে পেলেই একেবারে গদাম করে ঝেড়ে দেব, গোটা ছয়েক উলটে যাবে। এমন সময়…”
আমি বললাম, “এমন সময় কী?”
ভগাদা বললেন, “এমন সময় গিদাইয়া কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ভগা! ওয়াইল্ড এলিফ্যান্ট। তাকিয়ে দেখি, আমাদের পাশেই একটা হাতি দাঁড়িয়ে ভোঁস ভোঁস করে শুঁড় ঘুরিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে আর কান নাড়াচ্ছে। আমার মন বলল, নিশ্চয়ই পোষা হাতি; রাজার। কিন্তু গিদাইয়া বলল, এক-একটা দাঁত— পাঁচ-পাঁচ হাজার টাকা। অত হাজার টাকার কথা শুনেই আমার মাথা ঘুরে গেল। দিলাম দেগে এক নম্বর ছররা।”
আমি রুদ্ধশ্বাসে শুধোলাম, “তারপরে কী হল?”
“তারপর আর কী! হাতি বলল, প্যাঁ— অ্যা-অ্যা-অ্যা-অ্যা। আর আমি ও গিদাইয়াও একসঙ্গে ভ্যাঁ— অ্যা-অ-অ্যা-অ্যা।”
বীরু অবাক হয়ে বলল, “কেঁদে ফেললে? এ মা, এত বড় লোক হয়ে কেঁদে ফেললে?”
ভগাদা বলল, “হুঁ হুঁ বাবা, কান্না পেলেও না যদি কাঁদো তবে সঙ্গে সঙ্গে ইসকিমিয়া, মায়াকার্ডিয়াক অ্যাটাক! হার্ট এক্কেরে কিমা। জানিস না তোরা কিছুই।”
বীরু বলল, “তারপর?”
“তারপর আর কী? হাতি এসে ঘাড়ে পড়ার আগেই মাহুত আর রাজার পেয়াদা এসে ঘাড়ে পড়ল। বন্দুক কেড়ে নিল। আর কী রদ্দা, কী রদ্দা!”
“হাতিটাকে কোথায় মেরেছিলে?” আমি শুধোলাম।
ভগাদা বলল, “এইম করেছিলাম কানের পাশেই নিয়মমাফিক।”
গিদাইয়া এতক্ষণ পর কথা বলল। বলল, “কিন্তু কুল্লে চার দানা ছররা গিয়ে লেগেছিল হাতির সামনের পায়ের গোড়ালিতে।”
ভগাদা চটে উঠে বলল, “য়্যু শাট আপ। দোস্ত তো নয়, সাক্ষাৎ দুশমন।”
এই ঘটনার কিছুদিন পরই খগাদা আমাদের নেমন্তন্ন করে খুব একচোট খাওয়ালেন। ভগাদা চাকরিতে জয়েন করেছে। অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যাবসা। নিজেই চেষ্টা-চরিত্র করে জোগাড় করেছে। এতদিনে ভাইয়ের একটা গতি হল। সকলেই খুশি, আমরাও। ভগাদা রোজ সময়মতো প্যান্ট আর হাওয়াইন শার্ট পরে অফিস যায়।
দিন পনেরো বাদে খগাদা আবার আমাদের জরুরি তলব দিলেন। গেলাম। বুঝলাম, আবার কেস গড়বড়।
খগাদা বললেন, “আবার একটা উপকার করতে হবে।”
আমরা বললাম, “বলুন কী করতে পারি। ভগাদা কি আবার কোনও ঝামেলা…”
খগাদা বললেন, “শোনো আগে! চাকরি করছিল ভগা, খুশি ছিলাম কত। কিন্তু গত কয়েকদিন অফিস যাচ্ছিল না। প্রথমে বলছিল পেটে ব্যথা। নাক্স-ভমিকা থার্টি দিলাম। তারপর বলতে লাগল গায়ে ব্যথা। আর্নিকা দিলাম। তারপর বলল, রাতে ঘুম হয় না। কালি-ফস্ দিলাম। তাতে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোবার কথা, কিন্তু সমানে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে ভায়া আমার শুয়ে থাকে। কথাও বলে না, খায়ও না। তারপর ওয়ারস্ট অব অল, কাল থেকে পলাতক। কোথায় যে চলে গেল না বলে-কয়ে!”
বীরু হঠাৎ বলল, “চাকরির ব্যাপারটা একটু খোঁজ করলে হত না? সেখানে কোনও গোলমাল?”
খগাদার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, “ব্রিলিয়ান্ট। সাধে বলি, তোমাদের মতো ছেলে হয় না।”
বীরু আমাকে বলল, “চল, এক্ষুনি ব্যাপারটা জেনে আসা যাক।”
খগাদার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বীরু বেরিয়ে পড়ল সাইকেলে আমাকে ডাবল-ক্যারি করে।
সবজিমণ্ডির পাশে মসজিদ, মসজিদের থেকে খানিকটা দূরে কালু মিয়ার কাবাবের দোকান, তার পাশে একটা ছোট্ট দোকানঘর— সবুজের উপর সাদায় লেখা সাইনবোর্ড ঝুলছে, ইন্টারন্যাশনাল সাপ্লায়ার্স। কিন্তু সেই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কেরোসিন তেলের টিন দিয়ে তৈরি দরজাটাতে একটা মস্ত বড় তালা ঝুলছে।
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম সাইকেল থেকে নেমে।
ইন্টারন্যাশনাল সাপ্লায়ার্সের উলটোদিকে একটা দর্জির দোকান। খয়েরি আর সাদা খোপ খোপ লুঙ্গি আর বেগনে কামিজ পরে মাথায় সাদা টুপি চড়ানো কালো চাপ-দাড়িওয়ালা দরজি আপনমনে ঝটপট করে পা-মেশিনে রজাইয়ের ওয়াড় সেলাই করে যাচ্ছিল।
আমরা গিয়ে একটু কেশে দাঁড়ালাম।
দরজি মুখ তুলে নিকেলের ফ্রেমের চশমার কাচের ফাঁক দিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল, “ফরমাইয়ে।”
বীরু বলল, “খাস কাম কুছ নেহি। এই যে উলটোদিকের অফিসটা, সেটা বন্ধ কেন? তালা ঝুলছে কেন?”
দরজি বলল, “দফতর বন্ধ হ্যায়। উঠ গ্যয়া।”
“উঠে গেছে মানে?” আমরা শুধোলাম।
দরজি বলল, “জি হাঁ।” তারপর ডান হাতের তিনখানা আঙুল বীরুর নাকের সামনে নেড়ে বলল, “আপিস তো ছিল দু’জনের— হেডবাবু গিরধারী পান্ডে আর অ্যাসিস্ট্যান্ট ভগা সরকার। সেদিন কী নিয়ে কথা কাটাকাটি হতে অ্যাসিস্ট্যান্ট গিয়ে হেডবাবুর মাথায় হঠাৎ কাঠের রুলার দিয়ে মারল এক বাড়ি। সাথে সাথ মাথা ফট। হেডবাবু হাসপাতালে আর অ্যাসিস্ট্যান্ট ফেরার। আপিস আর চালাবে কে? কিওয়ারি বন্ধ।”
আমরা ফিরলাম। খগাদা উদগ্রীব হয়ে বসেছিলেন। বললেন, “কী খবর?”
বীরু গম্ভীরমুখে বলল, “আপিস উঠে গেছে। হেডবাবু হসপিটালে, অ্যাসিস্ট্যান্ট এবসকন্ডিং।”
খগাদা প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে “মার্ডারার, মার্ডারার, কোথায় গেলি, কোথায় গেলি,” বলেই দৌড়ে বারান্দার দিকে গেলেন, যেন ভগাদা বারান্দাতেই বসে আছেন।
খগাদা বারান্দাতে গিয়ে পৌঁছতেই ভগাদার ঠোঁটকাটা কাকাতুয়াটা খ্যানখেনে গলায় বলে উঠল, “হাইপারটেনশান! হাইপারটেনশান!”
অগস্ট ১৯৭৭
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন