১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ

সতীশচন্দ্র মিত্র

একাদশ পরিচ্ছেদ – সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ

ভ্রমণের পক্ষে সুন্দরবনের মত অনুপযুক্ত স্থান আর নাই। সুবিস্তৃত এবং তরঙ্গসঙ্কুল অসংখ্য নদী, নিবিড় দুর্ভেদ্য জঙ্গল, ভীষণ হিংস্র জন্তুসমূহের অত্যাচার, প্রতিনিয়ত জলপ্লাবনে অত্যন্ত কদমাক্ত ভূপৃষ্ঠ, আবাস, আশ্রয় বা ভ্রমণচিহ্নিত পথের অভাব এবং আরও শত প্রকার উৎপাত সুন্দরবনকে মনুষ্যের পক্ষে অগম্য করিয়া রাখিয়াছে। বিশেষতঃ সুন্দরবনের স্থানীয় অবস্থাদির বিবরণ বা শিকারের গল্প কাহারও জানিবার বিশেষ উপায় নাই। ইয়োরোপীয় শিকারী ভারতবর্ষের অন্যান্য নানা স্থানে শিকারোপলক্ষে তথাকার স্থানীয় অবস্থা ও জীবজন্তু প্রভৃতির বর্ণনা করিয়াছেন বটে, কিন্তু সুন্দরবন সম্বন্ধে তাঁহারা একপ্রকার নির্ব্বাক্। হিমালয় বা মধ্যভারতীয় পার্ব্বত্য প্রদেশের শিকার সম্বন্ধে বহু পুস্তক লিখিত হইয়াছে, কিন্তু সুন্দরবন সম্বন্ধে তাহার শতাংশের একাংশও নহে। প্রকৃত কথা এই, শিকার একটা আমোদজনক ব্যাপার; সুন্দরবনে শিকার করিতে গেলে আমোদ উপভোগের কোন সম্ভাবনা নাই। এখানে হিংস্রজন্তুর এত উৎপাত যে প্রাণ হাতে করিয়া বাহির হইতে হয়, জঙ্গলের নিবিড়তা ও পথের অগম্যতা লক্ষ্য সন্ধানের কোন বাহাদুরীর পরিচয় দিতে দেয় না; আবার খোলা বাতাস নাই, লোণাজল আছে; আশ্রয় নাই কিন্তু অকূল সমুদ্রোপম নদীপথে পথভ্রান্তির যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে; সাধারণ স্বাস্থ্য যেমন খারাপ, চিকিৎসকের সাহায্যের প্রত্যাশা সুদূরপরাহত। এই জন্য পাশ্চাত্য শিকারিগণ এ প্রদেশে আসেন না, আসিলেও ষ্টীমার হইতে ভূপৃষ্টে অবতরণ করেন না; সুতরাং সাধারণতঃ কেহ এ বিষয়ে লেখনী চালনা করেন না, যদি কেহ কোন সামান্য বিবরণ সংগ্রহ করিয়া থাকেন, তাহা অনুমান ও কল্পনা বলে পুষ্ট করিয়া প্রকৃত তথ্য হইতে দূরস্থ করিয়া ফেলেন। সরকারী রিপোর্টে সুন্দরবনের আয়ব্যয় বা বিলিবন্দোবস্ত সম্বন্ধে যাহা কিছু বিবরণ থাকে, ইহার ঐতিহাসিকতা, প্রাচীনতা, বা সাধারণ অবস্থাদি সম্বন্ধে তাহাতে উল্লেখযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য তথ্য থাকে না। দূরে বসিয়া বাওয়ালী ও কাঠুরিয়াদিগের মুখে কিছু কিছু গল্প শুনা যায় বটে, কিন্তু সে সকল গল্পের মূল কথা বন হইতে জনস্থানে পৌঁছিতে পৌঁছিতে এত অতিরঞ্জিত হইয়া যায় যে, তাহার উপর আস্থা স্থাপন করা কঠিন। এই সকল কথা বুঝিয়া, আমরা স্বচক্ষে সুন্দরবনের অবস্থা পর্যবেক্ষণপূর্ব্বক বিবরণ সংগ্রহ করিবার জন্য কয়েকবার একপ্রকার প্রাণ হাতে করিয়া দুর্গম জঙ্গলে প্রবেশ করিয়াছিলাম, এ প্রদেশের স্বাস্থ্যে অনভ্যস্ত বিদেশীয়গণের পক্ষে সেরূপ ভ্রমণ করা বোধ হয় সম্ভবপরই নহে। আমাদের ভ্রমণ- প্রণালীর সামান্য বর্ণনা হইতে বনভাগের অবস্থা সম্বন্ধেও কিছু বিবরণ পাওয়া যাইতে পারে।

প্রত্যেকবারেই রাডুলিনিবাসী রায়সাহেব নলিনীকান্ত রায়চৌধুরী মহাশয় আমাদের অভিভাবক ও পথ প্রদর্শক হইতেন। তিনি বম্বে মেডিক্যাল কলেজে ৬ বৎসর অধ্যয়নের পর ডাক্তার হইয়া বাড়ী আসেন, তদবধি জীবনের শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩০ বৎসর যাবৎ অবিরত সুন্দরবনে ভ্রমণ ও শিকার করিতে করিতে তৎসম্বন্ধীয় এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিলেন। বিস্তীর্ণ বনবিভাগের খাল-নালা, পথ-ঘাট, ভাবভাষা, প্রত্নকীর্তি সকলই তাঁহার নখদর্পণে ছিল। সাহস করিয়া বলিতে পারি, সমগ্র বঙ্গদেশে এ বিষয়ে এরূপ অভিজ্ঞতা আর কাহারও নাই। শুধু তাহাই নহে, তিনি যেমন অদম্য সাহসী, তেমনই স্থির লক্ষ্য শিকারী; যেমন অভিজ্ঞ, তেমন তত্ত্বানুসন্ধিৎসু; যেমন উদ্যম ও উৎসাহশীল তেমনই সবল ও কষ্টসহিষ্ণু। তিনি যেমন শিশুর মত সরল, তেমনই বৃদ্ধোপযোগী জ্ঞানগম্ভীর; তিনি যেমন স্বজাতিবৎসল, তেমনি রাজভক্ত; বনবিভাগীয় আইন ও নিয়মাবলী তাঁহার এরূপ জানা ছিল এবং ভ্রমণকালে এমনভাবে ঐ সমস্ত অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলিতেন যে, তাঁহার সে প্রকৃতি এমন কি ফরেষ্ট বিভাগীয় কর্মচারিগণেরও অনুকরণীয় হইতে পারে।

এতগুলি গুণের সহিত তাঁহার সার্ব্বজনীন সামাজিকতা এবং দেবপ্রকৃতিক সহৃদয়তা তাঁহাকে লোকমাত্রেরই বরণীয় ও ভালবাসার বস্তু করিয়া রাখিয়াছিল। সদাশয় গবর্ণমেন্টও তাঁহার গুণের সমাদর করিতে বিস্মৃত হন নাই। তাঁহার ৫টি বন্দুকের, ১টা Rifle বন্দুকের, একটি রিভলভারের পাশ ছিল; তিনি গবর্ণমেন্টের রক্ষিত বনে শিকারের জন্য নির্দিষ্ট কয়েক মাসে (নভেম্বর হইতে এপ্রিল) প্রতি সপ্তাহে ২টি করিয়া হরিণ শিকার করিবার অনুমতি পাইয়াছিলেন। রাজাধিরাজ পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষ্যে গবর্ণমেণ্ট হইতে তিনি ‘রায়সাহেব’ খেতাব এবং একখানি বহুমূল্য তরবারি খেলাত পান। উপাধি লাভের পরে তিনি অস্ত্র-আইন হইতে বিমুক্ত হইয়াছিলেন। তিনি স্বনামধন্য দানবীর আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অগ্রজ এবং বঙ্গবরণীয় প্রসিদ্ধ কায়স্থকূলের মুখোজ্জ্বলকারী। এরূপ এক কৃতী পুরুষের পক্ষপুটাশ্রয়ে ভীষণ জঙ্গলে গিয়া, ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করিবার সুযোগ পাইয়া আমরা ধন্য হইয়াছিলাম।

প্রত্যেকবারই আমাদের সঙ্গে একখানি বড় নৌকা ও একখানি ছোট ডিঙ্গি থাকিত। আমরা ৮/৯ জন যাইতাম, তদ্ব্যতীত মাঝিমাল্লা ৪/৫ জন ছিল। বড় নৌকায় আমরা থাকিতাম, রাঁধিতাম ও খাইতাম; ছোট ডিঙ্গিতে বসিয়া স্নানাদি করিতাম এবং ছোট খালে প্রবেশ করিতাম। সুন্দরবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে বনদেবতা বা বনবিবি বলে। অজ্ঞানান্ধকার বিলুপ্ত করিয়া যাহারা কাঠুরিয়াদিগকে সেই বনদেবীর রাজ্যমধ্যে নিরাপদে পথপ্রদর্শন করে, তাহারা বাওয়ালী নামে খ্যাত। এই বাওয়ালিগণ সুন্দরবনের অনেক তথ্য জানে; আমরা ইহাদের নিকট অনেক সকল্পন গল্পমিশ্রিত সংবাদ পাইতাম এবং নলিনীবাবুও বিংশাধিক বর্ষের অভিজ্ঞতার ফলে অনেক প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষী ছিলেন। তদনুসারে তথ্য সংগ্রহ ও কীর্তিচিহ্নের ফটো লইবার জন্য আমরা বনে প্রবেশ করিতাম। প্রথমতঃ নদী হইতে উভয় নৌকা লইয়া বড় খালে যাইতাম, শেষে যেখানে পাশখালিতে বড় নৌকা যাইত না, সেখানে ছোট ডিঙ্গিতে অগ্রসর হইতাম। যেখানে ছোট ডিঙ্গিও যাইত না, সেখানে তীরে নামিয়া পদব্ৰজে কদমাক্ত ও কণ্টকিত ভয়ঙ্কর বনপথে নিঃশব্দে উদ্দিষ্ট ভগ্নাবশেষের সন্ধানে বহির্গত হইতাম। আমার সঙ্গে খাতা, পেনসিল, ম্যাপ, কম্পাস, ঘড়ি, মাপের ফিতা, বাঁশী (Whistle), ছোট দা এবং একখানি লাঠি থাকিত, আমার একজন সহকারী ফটো তুলিবার জন্য ক্যামেরা ও তাহার সরঞ্জামাদি লইত এবং অন্য চারি পাঁচজন বন্দুক লইয়া অগ্রপশ্চাতে আমাদের শরীররক্ষী ও পথপ্রদর্শক হইত। সময় সময় কিছু পয়সা দিয়া জনৈক বাওয়ালীকেও সঙ্গে লইবার ব্যবস্থা করা যাইত। বয়সাধিক্যবশতঃ রায়সাহেবের তখন আর এরূপ কদমাক্ত ভীষণ পথে আমাদের সঙ্গে ভ্রমণের সামর্থ্য ছিল না, তিনি উপযুক্ত সন্ধান ও উপদেশ দিয়া আমাদের খাদ্যাদির সুব্যবস্থার ভার লইয়া বড় নৌকাতেই থাকিতেন। আমরা বনের মধ্যে ‘সরিতাম’— কারণ ‘যাইতাম’ একথা বনের মধ্যে বলা একেবারে নিষিদ্ধ। এই সরিবার ব্যাপার বড় গুরুতর, মানুষের দু’টি চক্ষে কুলায় না। দূরে ও কম্পাসে লক্ষ্য রাখিয়া অন্ধকারময় জঙ্গলের মধ্যে পথের দিনির্ণয় করিতে হয়; ডাইনে বায়ে কোথায় হ’দো, হেন্তাল বা বলার ঝোপে বড় মিঞা (ব্যাঘ্র) ছোঁ পাতিয়া আছেন, তাহা দেখিতে হয়; নিম্নদিকে চাহিয়া, কৰ্দ্দমে অর্দ্ধমগ্ন শৃ’লোর মধ্যে দেখিয়া দেখিয়া পা ফেলিতে হয়। কত সাবধান থাকিতাম, কিন্তু তাহাও যথেষ্ট হইত না। কাঁটায় কাপড় ছিঁড়িত, গা কাটিত, শূলোর ঘায়ে পায়ে রক্ত বহিত, কদমে হাঁটু পর্য্যন্ত ডুবিয়া যাইত, কখনও জল ঝাপাইয়া, কখনও গোলের শীষ দিয়া পুল বাঁধিয়া খাল পার হইতে হইত, কিন্তু আমাদের গতি থামিত না।

আমরা সকল ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম; আমাদের সরঞ্জাম ঠিক ছিল। বাঘের জন্য ৪/৫টি বন্দুক ও তাহার মাল মসল্যা ছিল, শিকারী ছিলেন নলিনী বাবু স্বয়ং এবং তাঁহার অনুগত শিষ্য নান্টু,[১] (শ্রীসুরেন্দ্রনাথ দে) এবং আরও ৩/৪ জন; নলিনীবাবুর জ্যেষ্ঠপুত্র যামিনীবাবু ছিলেন সাপের ওঝা, তিনি বনের মধ্যে, জলের উপরে সুকৌশলে কালসম বন্যসর্প ধরিতে পারিতেন, নান্টু এবং কালু সেখ প্রভৃতি এ বিষয়ে তাঁহার শিষ্য ছিলেন। আমরা প্রত্যেকবারই দুই একটি করিয়া ভীষণ গোক্ষুরা বা পাতরাজ সাপ ধরিয়া আনিয়াছিলাম। এজন্য নৌকার মধ্যে ঝাপি থাকিত। পথের মাঝে সময়ে সময়ে সাপকে দাঁত ভাঙ্গিয়া গামছায় বাঁধিয়া পুটুলি করিয়া লইয়া আসিতে হইত। কত শিকারীই শিকার করিতে যাইয়া থাকেন, কিন্তু সাপ-শিকারী সহকারী আমাদের যেমন ছিল, তেমন বোধ হয় বঙ্গভূমে কোথাও পাওয়া যায় না।[২] মৎস্য ধরিবার জন্য জাল ছিল। কীৰ্ত্তিস্থানের ফটো লইবার জন্য ক্যামেরা ছিল, আর বিবরণ লিখিয়া লইবার জন্য আমি ছিলাম।

সুন্দরবনে পথ হারাইবার মত সোজা কাজ আর নাই। আমরাও পথ হারাইতাম; কদমাক্ত পথে পদচিহ্নে অনেক সময় পথের পরিচয় রাখিত; কিন্তু ফিরিবার বেলায় কখনও আমরা একটু সোজা পথ ধরিতে গিয়া একেবারে পথহারা হইতাম। তখন আমাদিগকে বাঁশীর সিটি দিয়া নৌকাস্থিত বাঁশীর উত্তর আদায় করিতে হইত। যখন বাঁশীর সুর নৌকায় পৌঁছাইত না বা উত্তর পাওয়া যাইত না, তখন দীর্ঘ বৃক্ষে চড়িয়া পথের অনুমান করিতে হইত। এমনও দুই এক দিন হইয়াছে যে, অনেক বেলা কাজের জন্য ঘুরিয়া চলিতেছে, অন্য দিকে সেইরূপ রাত্রিবাসের জন্য বড় গাছের সন্ধান করিয়া লওয়া হইয়াছে। একদিন এমন বিপদ হইল যে, বড়গাছ পাইতে হইলে আমাদিগকে একটি প্রকাণ্ড খাল সাঁতারিয়া পার হইতে হয়; তখন পথের সন্ধানের শেষ ফলের আশায় কেহ কেহ ভরা বন্দুকের সাহসে গোলের শীষ দ্বারা বেঞ্চ করিয়া খালের কূলে বসিয়া তমসাময়ী রজনীর অবস্থা চিন্তা করিতে লাগিলাম। তখন সন্ধ্যালোকে দূর হইতে আমাদের বৃক্ষারোহী সঙ্গী ডিঙ্গিখানি দেখিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল। একজন গাছে থাকিয়া নির্দ্দেশ করিতে লাগিল এবং অন্য ২/১ জন বন্দুক হস্তে ডিঙ্গির সন্ধানে ছুটিল। অবশেষে ডিঙ্গি পাওয়া গেল, কিন্তু দেখা গেল আমাদের পরিত্যক্ত কাপড় চোপড়ের উপর বানরে অনেক অনধিকার অত্যাচার করিয়া গিয়াছে; কিন্তু তখন সে তদন্তের সময় ছিল না, ডিঙ্গি যে আছে, ইহাই যথেষ্ট। আমরা আনন্দে ঘন ঘন বংশীরবে দিগন্ত মুখরিত করিতে করিতে অন্ধকারে সাবধানে নদীর দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। সে দিনান্তব্যাপী পরিশ্রম এবং সঙ্কটময় অভিযানের পর আমাদের সম্মিলিত হাস্যোচ্ছ্বাসময় গল্পলহরী সেই দীপময়ী তরণীর কক্ষকে কিরূপ আনন্দময় করিয়া তুলিয়াছিল, তাহা উপভোগের বিষয় ছিল, কতকটা অনুভবের বিষয়ও হইতে পারে, কিন্তু বর্ণার বিষয় হইতে পারে না।

সুন্দরবনে ভ্রমণকারীকে সৈনিকের মত জীবন অবলম্বন করিতে হয়। একদিন আমরা সকালে বাহির হইয়াছিলাম; কয়েকস্থানে ভগ্নাবশেষ পর্যবেক্ষণ করিয়া পরিশ্রান্ত হইয়া বেলা ১২টার সময় নৌকায় ফিরিয়া আসিলাম। নৌকায় উঠিবার পূর্ব্বেই গল্প শুনিলাম যে এক বাওয়ালী নলিনীবাবুকে সংবাদ দিয়াছে যে, তাহারা প্রাতে কামার পুকুরে মাছ ধরিতে গিয়া দুইটি বাঘ দেখিয়া- আসিয়াছে—উহার একটি কালো এবং একটি হলদে। কত গল্প শুনিয়াছি, কিন্তু বাঘ যে কালো হয়, এ গল্প আমরা কখনও শুনি নাই। বাঘের কৃষ্ণত্বে বিশ্বাস না করিলেও অস্তিত্বে বিশ্বাস না করিয়া পারিলাম না। সুতরাং তখনই তাহার সন্ধানে আমাদের ডিঙ্গি ভাসাইয়া চলিলাম; অভিভাবকের সুব্যবস্থায় আমাদের দগ্ধ পাকস্থলীর জন্য একটি ঝুনা নারিকেল ও কিছু গুড় তাড়াতাড়ি করিয়া ডিঙ্গিতে নিক্ষিপ্ত হইল। তাড়াতাড়ি করিলেও আমরা জাল এবং মাছ রাখিবার খালুই লইতে ভুলি নাই। সেখের খাল যেখানে শিবসানদীতে মিশিয়াছে, সেই স্থানে ডিঙ্গিখানি গোলের শিকড়ে বাঁধিয়া আমরা তীরে উঠিলাম এবং সজ্জিত বন্দুকের ভরসায় ও বাঘ দেখিবার আশায় চুপে চুপে পা টিপিয়া চলিতে লাগিলাম। অবশেষে এক দ্বিতল বাটীর ভগ্নাবশিষ্ট প্রকাণ্ড ইষ্টকস্তূপের সমীপবর্ত্তী হইলাম এবং তাহারই পার্শ্বে দেখিলাম একটি পোস্তবাঁধা পুকুরের গাত্র-লগ্ন ইষ্টকপ্রাচীর ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। একটি ক্ষুদ্র খাল আসিয়া পুকুরকে নদীর সহিত মিশাইয়া দিয়াছে। গল্পকারী বাওয়ালী ভায়াকে স্থান নির্দেশের জন্য সঙ্গে আনিয়াছিলাম, কিন্তু তিনি বড়মিঞাদিগকে দেখাইয়া দিতে পারিলেন না। অগত্যা আমরা চারিধার ঘুরিয়া একটি ফটো লইয়া ক্ষ্যান্ত হইলাম। তখন নান্টু ভায়া বন্দুক রাখিয়া জাল লইয়া পুকুরের জলে পড়িলেন, কিন্তু নদীর মৎস্য এত অধিক পরিমাণে এখানে আশ্রয় লইয়াছিল যে, মৎস্যের ভারে জাল টানিয়া উঠান কষ্টকর হইতে লাগিল। অল্পকালমধ্যেই যথেষ্ট মৎস্য শিকার করিয়া আমরা নৌকায় পৌঁছিলাম। আসিয়া দেখি অন্ন প্রস্তুত।

আমাদের ভ্রমণের একটা বিশেষত্ব ছিল। ঐতিহাসিক অনুসন্ধানই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য, শিকারের সন্ধান আনুষঙ্গিক। সুতরাং শিকারের জন্য পথে কোথায়ও সময় নষ্ট করা হইত না। উদ্দেশ্য বুঝিয়া সকলেরই একটা কর্ত্তব্যবুদ্ধি ছিল, তাহাও আবার সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ছিল নলিনীবাবুর, যিনি আমাদের নেতা এবং অভিভাবক। আমরা সকলেই সূক্ষ্মভাবে তাঁহার আদেশের অনুবর্ত্তী হইয়া চলিতাম। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, তিনি উপরে উঠিতে পারিতেন না। তিনি নৌকায় থাকিতেন, আমরা উপরে উঠিতাম। আমরা পরিশ্রান্ত হইয়া ফিরিয়া আসিলে দেখিতাম, তিনি অন্য একজনের সহায়তায় নৌকায় সমস্ত আহারাদির বন্দোবস্ত স্থির করিয়া রাখিয়াছেন। তিনি মাঝে মাঝে নৌকায় বসিয়া নদীবাহনে শিকারে বাহির হইতেন, আমরাও অবসরমত তাঁহার সঙ্গে যাইতাম, আসিবার সময় মৎস্য শিকার বা জ্বালানি কাষ্ঠ সংগ্রহ করিয়া আনা হইত। আমাদেরও আবার কখনও কখনও অতিথি জুটিত; সুন্দরবনে পানসী নৌকা দেখিলেই লোকে মনে করে উহা মেজো বাবু বা পুটুবাবুর নৌকা (নলিনীবাবু এই চলিত নামেই অধিক পরিচিত); সুতরাং পানসী দেখিলে কেহ পরামর্শের জন্য, কেহ রোগ চিকিৎসার জন্য এবং কেহ বা হরিণের মাংসের লোভে নৌকার নিকটবর্ত্তী হইত। দৈবযোগে বিপদে পড়িয়াও কেহ কেহ আমাদের নৌকায় আশ্রয় লইত। একদিন দেখি কতকগুলি লোকে প্রকাণ্ড এক নৌকাডুবি হওয়ায় আমাদের নৌকায় আসিয়াছে। আমরা আমাদের সামান্য ভোজ্য দ্বারা অতিথি সৎকার করিলাম। দিন ভরিয়া নানা ভ্রমণ বা অনুসন্ধানের পর আমরা সন্ধ্যাকালে সকলে মিলিয়া নৌকায় বসিয়া, স্বীয় স্বীয় অভিজ্ঞতার ফল আলোচনা করিতাম। নলিনীবাবু অসঙ্কোচে তাহাতে যোগদান করিয়া আমাদের অনেক সন্দেহের নিরসন করিতেন। পূজনীয় পরিচালকের অধীনে বাস করিয়া এবং কাজ করিয়া যে সুখ, তাহা আমরা সর্ব্বদা প্রাণে প্রাণে অনুভব করিতাম।[৩]

সুন্দরবনে শিকার চারি প্রকার : (১) ‘মাঠাল’ অর্থাৎ তীরে উঠিয়া জঙ্গলের ভিতর চলিতে চলিতে শিকার; (২) ‘বাওন’ বা নদীবাহনে শিকার অর্থাৎ ছোট নৌকায় নদী বা খালের কূলে কূলে নিঃশব্দে চলিতে চলিতে তীরের উপর লক্ষ্য করিয়া শিকার; (৩) ‘গাছাল’ অর্থাৎ কোন কোন বিশেষ স্থানে কেওড়া বা অন্য গাছে উঠিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া শিকার; (৪) ‘টোপ’ অর্থাৎ নদী-সৈকতে, সাগরের বেলা-ভূমিতে বা অন্য কোন উন্মুক্ত স্থানে গর্ত্ত কাটিয়া উহার মধ্যে বসিয়া মাথার উপর পত্রাদি চাপা দিয়া শিকার। ইহার মধ্যে গাছাল এবং বাওনেই অনেক শিকার হয়। টোপের সুবিধা প্রায়ই হয় না, কারণ খোলা স্থান পাওয়া অতীব দুষ্কর। আবার শিকারের চেষ্টায় বন চুঁড়িয়া বেড়ান অনেকে পছন্দ করে না, কারণ উহা যেমন বিপজ্জনক তেমনি কষ্টকর। সুতরাং মাঠালও বড় কম হয়। আমাদের বেলায় কিন্তু এই মাঠালই অধিক, তবে সে মাঠালের উদ্দেশ্য স্বতন্ত্র; হরিণের খোঁজে বা ব্যাঘ্রের পদচিহ্ন লক্ষ্য করিয়া আমরা যে কখনও কখনও অগ্রসর না হইয়াছি, তাহা নহে; তবে আমাদের মূল লক্ষ্য প্রত্নতত্ত্বের উদ্ধার, আমাদের গল্পে কাজে বা ভ্রমণে সৰ্ব্বদা তাহাই আলোচ্য বিষয়।

সুন্দরবনে ভ্রমণ বা শিকার করিতে হইলে, তৎপ্রদেশীয় ভাষার সহিত পরিচিত হওয়া উচিত। বঙ্গদেশে প্রধানতঃ বাঙ্গলা ভাষা প্রচলিত থাকিলেও, তাহার বিভিন্ন জেলায় সে ভাষার প্রাদেশিক বিশেষত্ব রহিয়াছে। সকল জেলার ন্যায় সুন্দরবনের ভাষারও একটা প্রাদেশিকতা আছে। এই প্রাদেশিকতার সহিত নিকটবর্ত্তী কয়েকটি জেলারও ভাষাগত সম্বন্ধ রহিয়াছে। সুন্দরবনের এই মিশ্রিত ভাষাকে আমরা ‘জঙ্গলা’ ভাষা বলিতে পারি। সুন্দরবনের কাঠুরিয়া, গোলের ব্যাপারী, নৌকার মাঝি, আবাদকারী কৃষক এবং দেশীয় শিকারী, বাওয়ালী ও ফকিরগণ এই ভাষায় কথা কহে। এই সকল লোকের সহিত যশোহর-খুলনার সর্ব্বস্থানের লোকের কথাবার্তার প্রয়োজন হয়, সুতরাং এই জঙ্গলা ভাষা জেলাগত বাঙ্গলা ভাষার সহিত মিশিয়া যায় ও তাহার শব্দ-ভাণ্ডার বৃদ্ধি করে। জঙ্গলা ভাষা না জানিলে দক্ষিণদেশীয় ব্যাপারীদিগের কথোপকথনের এক বর্ণও বুঝা যায় না। সুতরাং ফরেষ্ট বা পুলিশ বিভাগের কর্মচারিগণের এ ভাষার সহিত পরিচিত হওয়া একান্ত আবশ্যক হইয়া পড়ে। সুন্দরবন অনেকবার উঠিয়া পড়িয়াছে, আবার পড়িয়া উঠিবে। এখনও পূৰ্ব্বতন বাসচিহ্ন লুপ্ত হয় নাই, অনেক বনভূমি ধান্যক্ষেত্রে পরিণত হইতেছে এবং নিকটে নিকটে মানুষের বসতি হইতেছে। নানা স্থানে কীৰ্ত্তিচিহ্ন আবিষ্কৃত হইতেছে, বঙ্গদেশেও প্রত্নতত্ত্বের পিপাসা জাগিয়াছে। এ পুস্তকেও উহার কতকটা নিদর্শন থাকিবে। তজ্জন্য লোকসমাজে সে সব কীর্তিকথা প্রচারিত হইলে, এ অঞ্চলে ঐতিহাসিকের শুভাগমন সম্ভাবিত হইবে। সুন্দরবনের স্বাভাবিক অবস্থার পরিচয় বিজ্ঞাপিত হইলে, সাধারণ দর্শক বা শিকারীরও অভাব হইবে না। সাধারনের কতক সুবিধা এবং অন্ততঃ দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমরা সাধ্যমত জঙ্গলা ভাষার কতকগুলি শব্দার্থ সংগ্রহ করিলাম।

পাদটীকা :

১. পিতৃহীন নিরাশ্রয় নান্টু নলিনীবাবুর নিকট পিতৃস্নেহ পাইয়া প্রতিপালিত হইয়াছিলেন এবং মোটামুটি বাঙ্গালা ও ইংরাজীতে বেশ শিক্ষালাভ করিয়াছেন। কিন্তু সুন্দরবন ভ্রমণে ও শিকারে তাঁহার যে শিক্ষা ও দক্ষতা জন্মিয়াছে, তাহার তুলনা নাই। সুন্দরবনের ভৌগোলিক অভিজ্ঞতা তাঁহার যথেষ্ট, কারণ তিনি নলিনীবাবুর সহচর ত ছিলেনই, তাহা ছাড়া অনেকবার সাহেবদিগের সঙ্গে সঙ্গে বনের মধ্যেও ঘুরিয়াছেন। এই ক্ষীণকায় যুবকের যে বিপদকালে অটল সাহস, শিকারে এক প্রকার অব্যর্থ লক্ষ্য, গৃহকার্য্যে দক্ষতা, রন্ধনে নিপুণতা, পরসেবায় তুষ্টি এবং সর্ব্বোপরি তাঁহার যে পরচিত্তহারী মধুর স্বভাবের পরিচয় পাইয়াছি, তাহা একত্র অন্যত্র অতীব সুদুর্লভ। যাহারা সুন্দরবনে ভ্রমণ বা শিকারার্থ বাহির হইতে চান, শ্রীমান্ সুরেন্দ্রনাথের মত সঙ্গী তাঁহারা আর পাইবেন না। শ্রীমান্ সুরেন্দ্রনাথ এক্ষণে রাড়লি কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কের উচ্চ কর্ম্মচারী।

২. যামিনীভূষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ করা যুবক না হইলেও বেশ সুশিক্ষিত এবং বংশানুরূপ সদাশয় ও উন্নতচরিত্র লোক ছিলেন। আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্রের প্রকৃতি বংশমধ্যে সংক্রামিত আছে। যামিনীভূষণও অকৃতদার ছিলেন; তাঁহার মত অমায়িক স্বভাব ও নিস্পৃহ সরল বিলাসশূন্য ভাব এবং বড় ঘরের ছেলের ফকিরের বেশ কদাচিৎ দেখা যায়। সর্পবিদ্যায় এবং সর্পদংশনের মন্ত্রচিকিৎসায় সুনিপুণ ও কৃতকার্য্য, তাঁহার মত কোন ব্যক্তির সন্ধান আমি পাই নাই। যামিনীবাবু অযাচিত ও সম্পূর্ণ স্বার্থ সম্পর্ক বৰ্জ্জিতভাবে কত লোককে যে চিকিৎসা করিয়া বাঁচাইয়াছেন, তাহা বলিবার নহে। এমন কি মৃত বলিয়া পরিত্যক্ত সর্পদষ্ট রোগীর দেহে ২৪ ঘণ্টার পরও যে তিনি জীবন সঞ্চার করিয়াছিলেন, তেমন ২/১টি জীবনপ্রাপ্ত লোকের সাক্ষ্য আমিই দিতে পারি। আমি তাঁহাকে উগ্রবীর্য্য বিষধর সর্প বনের মধ্যে স্বহস্তে ধরিতে দেখিয়াছি। সর্পের শ্রেণী বিভাগ সম্বন্ধীয় অনেক তথ্য তিনিই আমাকে সংগ্রহ করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু শ্রীভগবানের কি বিধান, একদিন ঐরূপ একটি ভীষণ সর্প ধরিয়া আনিবার কালে একটু অসতর্কতার জন্য সেই সর্প-দংশনে ১৩২৭, ৩১শে আষাঢ় তারিখে তাঁহার অকালমৃত্যু হয়।

৩. খুলনা জেলারই দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই আদর্শচরিত্র প্রবীণ পুরুষ কয়েক বৎসর হইতে হৃদরোগে কষ্ট পাইয়া গত ১৩৩০ সালের ৪ঠা ফাল্গুন (১৮/১২/২৪) তারিখে দেহত্যাগ করিয়াছেন।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. ২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. ৩. নদী-সংস্থান
৪. ৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. ৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. ৬. সুন্দরবন
৭. ৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. ৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. ৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. ১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. ১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. ১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
১৩. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
১৪. ২. দ্বীপের প্রকৃতি
১৫. ৩. আদি হিন্দু-যুগ
১৬. ৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
১৭. ৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
১৮. ৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
১৯. ৭. মাৎস্য-ন্যায়
২০. ৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
২১. ৯. সেন-রাজত্ব
২২. ১০. সেন-রাজত্বের শেষ
২৩. ১১. আভিজাত্য
২৪. ১. তামস যুগ
২৫. ২. বসতি ও সমাজ
২৬. ৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
২৭. ৪. খাঁ জাহান আলি
২৮. ৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
২৯. ৬. পয়োগ্রাম কসবা
৩০. ৭. খালিফাতাবাদ
৩১. ৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৩২. ৯. হুসেন শাহ
৩৩. ১০. রূপ-সনাতন
৩৪. ১১. লোকনাথ
৩৫. ১২. হরিদাস
৩৬. ১৩. রামচন্দ্র খাঁ
৩৭. ১৪. গাজীর আবির্ভাব
৩৮. ১৫. মুকুট রায়
৩৯. ১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
৪০. ১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
৪১. পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
৪২. পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
৪৩. পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
৪৪. পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন