সতীশচন্দ্র মিত্র
আমরা দেখিয়াছি, সুন্দরবন পূর্ব্বেও ছিল, এখনও আছে। তবে ইহার সীমা পরিবর্তিত হইতেছে। ইহার উত্তর ও দক্ষিণ সীমা ক্রমশঃ দক্ষিণে সরিয়া যাইতেছে। ব্লকম্যান সাহেব টোডরমল্লের রাজস্ব-তালিকা হইতে দেখাইয়াছেন যে, গত ৩/৪ শত বৎসরের মধ্যে সুন্দরবনের উত্তর সীমার পরিবর্ত্তন হয় নাই।[১] কারণ রাজস্বের পরিমাণ একরূপই ছিল। কিন্তু ১৫৮২ খৃঃ অব্দে এই রাজস্ব হিসাব প্রস্তুত হইবার পর, প্রতাপাদিত্যের দুর্জয় প্রতিভা বর্দ্ধিত হয় এবং নব নব রাজ্যাংশ তাঁহার করায়ত্ত হইয়া পড়ে। যেখানে জঙ্গল কাটিয়া বিক্রমাদিত্যের যশোর রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রতাপাদিত্য তাহার বহুদূর দক্ষিণে গিয়া ধূমঘাট পত্তনে নূতন রাজধানী স্থাপন করেন। তজ্জন্য উত্তরে বসন্তপুর হইতে দক্ষিণে ধূমঘাট পর্যন্ত ২২/২৩ মাইল দীর্ঘ এবং আড়পাঙ্গাসিয়া হইতে যমুনা পৰ্য্যন্ত ১৫/১৬ মাইল প্রশস্ত বিস্তৃত প্রদেশ সম্পূর্ণ জনাকীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। পূৰ্ব্বদিকে চকশ্রী প্রভৃতি দ্বীপ নৌবাহিনীর আড্ডা হওয়ায় লোকালয়ে পরিণত হইয়াছিল। বেদকাশীতে তখন লোকের বসতি থাকায় প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে সেখানে বসন্তরায় কর্তৃক মন্দিরাদি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সুতরাং টোডরমল্লের হিসাব প্রস্তুত হওয়ার পর সুন্দরবনের উত্তর সীমা যে অনেক দূর দক্ষিণে সরিয়া গিয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই।
আবার প্রতাপাদিত্যের পতনের পর হঠাৎ জমি নিম্ন হইয়া জলপ্লাবনে প্রতাপের রাজধানী প্রভৃতি জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া পড়িতে থাকে; ক্রমে ক্রমে অধিবাসীরা সরিয়া সরিয়া উত্তরদিকে যাইতেছিল; এমন কি হঠাৎ দৈশিক অবস্থার পরিবর্তনে তাহাদিগকে টোডরমল্লের সময়ের সুন্দরবনের উত্তর সীমা হইতে আরও উত্তর দিকে যাইতে হইয়াছিল। এতৎসঙ্গে আরও একটি কথা বিবেচ্য। রাজস্বের পরিমাণ ঠিক থাকিলেই, দেশের পরিমাণ ঠিক থাকে না। বিক্রমাদিত্য যে রাজ্যের জন্য নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব দিবেন স্থির হইয়াছিল, তাঁহার রাজ্য বৃদ্ধি হইলেও সে রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় নাই। প্রতাপাদিত্যের সময় রাজস্ব বন্ধ হইয়াছিল, কিন্তু রাজ্যের সীমা নানা দিকে বিস্তৃত হইয়াছিল। সুতরাং দেখা যাইতেছে, সুন্দরবনের উত্তর সীমা অনবরত উত্তরে দক্ষিণে সরিতেছে। বর্তমান সময়ে আবার দেখিতেছি উক্ত উত্তর সীমার গতি দক্ষিণ দিকেই চলিয়াছে, অর্থাৎ জমি ক্রমশঃ জঙ্গলশূন্য ও শস্যোপযোগী হওয়ায় আবাদের সঙ্গে সঙ্গে লোকের বসতিও দক্ষিণদিকে বিস্তৃত হইয়া পড়িতেছে। সুন্দরবনের উত্থান, পতন বা সীমা পরিবর্তন মানুষের কোন ইচ্ছার অধীন নহে।
পূৰ্ব্বে বলা হইয়াছে যে, ভাগীরথীর মুখে ভূমি গঠনকাৰ্য্য বহু প্রাচীন যুগ হইতে চলিয়া আসিতেছিল। সুতরাং সুন্দরবনের সেই পশ্চিমাংশ পূৰ্ব্বাংশ অপেক্ষা অনেক দক্ষিণদিকে অগ্রবর্ত্তী ছিল। সাগরদ্বীপ অতি পুরাতন স্থান। এখন পূৰ্ব্বাংশে ভূমিসঞ্চয়কাৰ্য্য চলিতেছে। পশ্চিমাংশের দক্ষিণ সীমা গত কয়েকশত বৎসরের মধ্যে অধিক দূর অগ্রসর হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। হয়ত তাহার একটি প্রধান কারণ এই যে, ঐ দিকে দক্ষিণোপকূল হইতে অতলস্পর্শ অধিক দূরবর্তী নহে। পূর্ব্বদিকে কিন্তু এই দক্ষিণ সীমা অনেক অগ্রবর্ত্তী হইয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রকূলবর্তী অনেক স্থান ভিতরে পড়িয়া গিয়াছে। এক্ষণে পূর্ব্বে ও পশ্চিমে উভয়াংশে সুন্দরবনের দক্ষিণ সীমা প্রায় একই রেখায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে; এ রেখা সম্ভবতঃ অতলস্পর্শের জন্য আর অগ্রসর হইতে পারিতেছে না।
এই অতলস্পর্শ বর্তমান থাকিলে সুন্দরবনের দক্ষিণ সীমা স্থির থাকিতে পারে বটে, কিন্তু অতলস্পর্শের প্রকোপে দেশে পুনরায় অবনমন সম্ভাবিত হইতে পারে। তাহা হইলে উত্তর সীমা আবার উত্তরদিকে সরিবে এবং অনেক স্থান হইতে মনুষ্যাবাস আবার উঠিবে। কিন্তু যদি কোন আকস্মিক কারণে অতলস্পর্শই পলিরাশিতে পূরিয়া উঠে বা সরিয়া যায়, তাহা হইলে সুন্দরবনও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হইতে পারে এবং সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিক হইতে লোকের বসতি আরও দ্রুতবেগে দক্ষিণবর্ত্তী হইয়া সুন্দরবনকে সঙ্কীর্ণ করিয়া দিতে পারে। তখন এই গঙ্গোপদ্বীপের এক অপূর্ব্ব গৌরবের দিন আসিবে। হয়ত আবার সমুদ্রকূলে প্রসিদ্ধ নগরী ও বাণিজ্য বন্দর প্রতিষ্ঠিত হইবে।
অতলস্পর্শের বয়স চারি পাঁচশত বৎসরের অধিক বলিয়া বোধ হয় না। এই সময় মধ্যে সুন্দরবন সমুদ্রদিকে অধিক দূর অগ্রসর হয় নাই। পূর্ব্বে সুন্দরবন ক্রমশঃ দক্ষিণদিকে বিস্তৃত হইয়াছিল; চর যত দক্ষিণদিকে রহিয়াছে, বনও তত সরিয়া গিয়াছে এবং উত্তরাংশে ক্রমশঃ উন্নত হইয়াছে। এই উন্নত ভূভাগে শস্যের ক্ষেত্র ও লোকের বসতি স্থাপিত হইয়াছে। এইরূপে সুন্দরবনের অগ্রবর্ত্তিতার সঙ্গে সঙ্গে লোকের বসতিও তত সরিয়া গিয়াছে। আজ যেখানে বসতি, পূর্ব্বে তথায় সুন্দরবন ছিল; আজ যেখানে সুন্দরবন, ক্রমে সেখানে বসতি হইবারই সম্ভাবনা। সুন্দরবন একস্থানেও কোন দিন থাকে নাই, সুন্দরবনের অবস্থাও চিরদিন একরূপ ছিল না। যশোহর-খুলনার নিম্নস্থিত ভূপঞ্জরের অবস্থা হইতে আমরা পূর্ব্বে ইহা প্রতিপন্ন করিয়াছি। সুতরাং সুন্দরবনে যে পূর্ব্বে বসতি ছিল না, এরূপ কল্পনা করা সমীচীন নহে।
সুন্দরবনে মনুষ্যের বসতি ছিল কি না, তৎসম্বন্ধে দুটি মত আছে। প্রথম মত, দেশীয়দিগের মত। তদনুসারে সুন্দরবনে পূর্ব্বে বসতি ছিল, সুন্দর নগরীসমূহ ছিল, বহুকারণে ঐ সকল নষ্ট হইয়াছে। আমরা এই মতের পরিপোষক এবং তাহার অনেকগুলি কারণের বিষয় পূৰ্ব্বাধ্যায়ে আলোচিত হইয়াছে। দ্বিতীয় মত, বৈদেশিক মত। তদনুসারে সুন্দরবন কখনও সুন্দর বাসভূমি ছিল না। কখনও কখনও দুঃসাহসিক লোকে ইহার আবাদ করিতে বা বসতি পত্তন করিতে অনর্থক চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু কখনও ইহার ভাল অবস্থা ছিল না।[২] বিভারিজ, ব্লকম্যান প্রভৃতি প্রসিদ্ধ পণ্ডিতবর্গ এই মতাবলম্বী। বিভারিজ সাহেব এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করিয়াছেন।[৩] তিনি স্বীয় মতের পরিপোষণ জন্য যে সকল কারণ উত্থাপিত করিয়াছেন, আমরা প্রথমতঃ সেইগুলির সমালোচনা করিয়া পরে আমাদের মত স্থাপন জন্য বিবিধ চাক্ষুষ প্রমাণ উপস্থাপিত করিতেছি।
প্রথমতঃ, সুন্দরবনের পূর্ব্বাংশে বাখরগঞ্জ ও নোয়াখালি জেলার মধ্যে সন্দ্বীপ ও আরও কয়েকটি দ্বীপ আছে। এই সকল দ্বীপে প্রাচীন কালে বহুল পরিমাণ লবণ উৎপন্ন হইত। ডু জারিকের বিবরণীতে দেখা যায়, এই দ্বীপ সমগ্র বঙ্গে লবণ সরবরাহ করিতে পারিত।[৪] লবণের উৎপাদন জন্য যথেষ্ট কাষ্ঠের প্রয়োজন। সুতরাং সন্দ্বীপে যথেষ্ট জঙ্গল ছিল।
সন্দ্বীপে জঙ্গল থাকিতে পারে। জনাকীর্ণ সন্দ্বীপে এখনও স্থানে স্থানে জঙ্গল আছে। কিন্তু তদ্বারা সপ্রমাণ হয় না যে, সন্দ্বীপে বসতি নাই। বসতি না থাকিলেই বা লবণ প্রস্তুত করিত কে? ডু জারিকই বলিতেছেন যে, সন্দ্বীপে যে লবণ প্রস্তুত হইত তাহা বঙ্গে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িত, এবং পর্তুগীজ আধিপত্যের সময়েও তথা হইতে দুই শতের অধিক জাহাজ লবণ বোঝাই হইয়া বিদেশে প্রেরিত হইত। যাহারা উৎকৃষ্ট লবণ প্রস্তুত করিয়া স্বকীয় জাহাজে বিদেশে প্রেরণ করিত, তাহারা অসভ্য নহে। সন্দ্বীপ বা স্বর্ণদ্বীপ অতি প্রাচীন স্থান। প্রবাদ এই, বঙ্গেশ্বর আদিশূরের নবম পুত্ৰ বিশ্বম্ভরশূর চন্দ্রনাথ তীর্থ হইতে প্রত্যাগমনকালে এখানে বারাহী দেবীর মন্দির নির্মাণ করেন। তাঁহারই অধস্তন বংশধর লক্ষ্মণ মাণিক্য নোয়াখালীর অন্তর্গত ভুলুয়ায় রাজ্যস্থাপন করিয়া বারভূঞার অন্যতম হইয়াছিলেন। সন্দ্বীপের অধিকার লইয়া মগ, পর্তুগীজ ও ভুঞারাজগণের সহিত বহু যুগ ধরিয়া সংঘর্ষ চলিয়াছিল। সন্দ্বীপে দুর্গ ছিল, উহার কয়েকটির ভগ্নাবশেষ আমরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছি। সন্দ্বীপের সাগরবেলা অন্ততঃ ১৫/১৬ বার বিখ্যাত জলযুদ্ধসমূহের ক্রীড়াক্ষেত্র হইয়া রক্তরঞ্জিত হইয়াছে। সে দীর্ঘ কাহিনী এখানে বক্তব্য নহে।[৫]
১৫৬৯ খৃষ্টাব্দে সীজর ফ্রেডারিক নামক একজন ভিনীসীয় ভ্রমণকারী ভীষণ ঝটিকায় সন্দ্বীপের কূলে নিক্ষিপ্ত হন। তাঁহার বর্ণনা হইতে জানা যায় যে, সন্দ্বীপ পৃথিবীর মধ্যে একটি সাতিশয় উর্ব্বর স্থান। ইহা শস্যক্ষেত্রে পূর্ণ এবং ঘনসন্নিবেশে লোকাকীর্ণ। এখান হইতে প্রতিবৎসর দুই শত জাহাজ লবণ বোঝাই হইয়া বিদেশে যায়। এতদ্দেশে জাহাজ নির্মাণের উপাদান এত অধিক যে, তুর্ক-সুলতান আলেকজেন্দ্রিয়া অপেক্ষা এখান হইতে জাহাজ নিৰ্ম্মাণ করিয়া লওয়া সুলভ মনে করিয়াছিলেন।[৬] যে স্থানের এইরূপ প্রতিপত্তি সুদূর ইউরোপেও ব্যাপ্ত হইয়াছিল, তাহা যে সুন্দরবনের অসভ্য জাতির আবাসস্থান, এরূপ বলা যায় না।
দ্বিতীয়তঃ, মিশনরী র্যালফ্ ফিচ্ (Ralph Fitch) যখন ১৫৮৬ খৃষ্টাব্দে বাঙ্গলা পরিদর্শন করেন, তখন এ দেশকে উৎকৃষ্ট ও সমৃদ্ধ দেখিয়াছিলেন। কিন্তু বিভারিজ সাহেব তাঁহার কথা বিশ্বাস করেন নাই; কারণ তিনি পূর্ব্ববর্ত্তী বৎসরে বরিশালে যে ঝটিকা ও প্লাবন হইয়াছিল, তাহার বর্ণনা দিতে ভুলিয়াছিলেন।
১৫৮৫ খৃষ্টাব্দে বালা অঞ্চলে ভীষণ ঝটিকা হইয়াছিল, এবং ২/১ বৎসরে তাহার চিহ্ন বিলুপ্ত হয় নাই, ইহা সত্য। কিন্তু ভ্রান্তি বশতঃ তাহার প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয় নাই বলিয়াই বৃদ্ধ ধর্মপ্রচারকের বর্ণনায় অপ্রত্যয় করা সঙ্গত হয় নাই। কিন্তু এস্থলে অবিশ্বাস করিলেও মিশনরী যেখানে এ দেশের লোক প্রায় উলঙ্গ এবং তাহারা কেবলমাত্র কটীতে সামান্য একটু কাপড় পরিধান করে, এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন, সেখানে কিন্তু মিশনরীর কথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিয়া মহামতি বিভারিজ এদেশীয় লোককে অসভ্য প্রতিপন্ন করিয়াছেন। শীতপ্রধান পাশ্চাত্য দেশীয় লোকে আমাদের মত গ্রীষ্মপ্রধান দেশের লোকের বস্ত্র-ব্যবহার দেখিয়া, এখনও এদেশীয় লোককে উলঙ্গ বলিয়া থাকেন। প্রত্যেকেই নিজের অবস্থাকে আদর্শ করিয়া লয়। কিন্তু সব দেশে সব আদর্শ খাটে না। আমরা লাপল্যাণ্ডের লোকের চর্মসাজ দেখিয়া যেরূপ বিস্মিত হই, তাহারাও আমাদের দেশের বস্ত্রাল্পতা দেখিযা সমভাবে বিস্মিত হয়। আবার বিভারিজ বালাকে সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত ধরেন নাই। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় দনুজমৰ্দ্দন নবোখিত সমুদ্রকূলসঞ্জাত দ্বীপে রাজ্য সংস্থাপন করিয়াছিলেন এবং সে রাজ্য সভ্যতামণ্ডিত ছিল।[৭] সুতরাং সুন্দরবনের পূর্ব্বাংশ যে এক সময়ে সভ্যতাস্পর্দ্ধী জাতির ক্রীড়া-ক্ষেত্র ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই।
তৃতীয়তঃ, বাখরগঞ্জের অন্তর্গত ইদিলপুরের তাম্র-শাসনে এক ‘চণ্ডভণ্ড’ নামক অসভ্য জাতির উল্লেখ দেখা যায়।[৮] উহাতে এতদঞ্চলে যে সভ্যতা ছিল, এমন প্রমাণ হয় না। এ কথার উত্তরে ইহা বলা যাইতে পারে যে, বিস্তৃত সুন্দরবনের কোন কোণে অসভ্য জাতির বাস থাকিলেই এরূপ ধারণা করা উচিত নহে যে, এতদঞ্চলে কোন সভ্যজাতির বাস ছিল না। ইদিলপুরে যখন অসভ্যজাতির বসতি ছিল, তখনই যে কপোতাক্ষ-কূলে, বিস্তীর্ণ যশোর রাজ্যে, সমৃদ্ধ অবস্থার বিকাশ থাকিতে পারে না, এমন নহে। প্রতাপচন্দ্র ঘোষ মহাশয় এই চণ্ডভণ্ড জাতিকে লবণ প্রস্তুতকারী মোলঙ্গীদিগের সহিত তুলনা করিয়াছেন। সমুদ্রকূলে লবণ হয়, উহা প্রস্তুত করিবার ভার অপেক্ষাকৃত অসভ্য শ্রমজীবীর উপর থাকা অসম্ভব নহে। তদ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, নিকটে সভ্যতর জাতি ছিল না।
চতুর্থতঃ, ১৫৯৯ ও ১৬০০ খৃষ্টাব্দে জেসুইট মিশনরীগণ বালা হইতে প্রতাপাদিত্যের রাজ্যে যাইবার পথের যে বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে উহা জঙ্গলাকীর্ণ সুন্দরবনের পথ বলিয়াই মনে হয়। সুতরাং এ প্রদেশ জঙ্গলাকীর্ণ ছিল এবং তথায় কোন লোকের বসতি ছিল না। এ কথারও উত্তরে বলা যাইতে পারে যে, সুন্দরবনের সব স্থানে একই সময়ে সমৃদ্ধ পল্লী বা বিস্তৃত বসতি কোনকালে ছিল না; থাকিতেও পারে না এবং সে কথা লইয়া কেহ বাদানুবাদও করে না। কিন্তু তাই বলিয়া সুন্দরবনে লোকের বসতি ছিল না, এরূপ একটা সাধারণ মন্তব্য প্রকাশ করা সঙ্গত নহে। মিশনরী সাহেবরা কোন্ পথে আসিয়াছিলেন, তাহা জানা যায় নাই। সম্ভবতঃ তাঁহারা একেবারে বাহিরের নদীপথে আসিতে পারেন। সে পথে তখনও বসতি স্থাপিত হয় নাই। যে পথে তখন সাধারণতঃ পূর্ব্ববঙ্গের নৌকা আসিত, সে পথে আসিলে মিশনরীগণ পথে আর কোনও স্থান না দেখুন, খলিফাতাবাদ, পাণিঘাট, চকশ্রী, কুড়লতলা প্রভৃতি স্থান দেখিয়া আসিতে পারিতেন।
সুন্দরবনে চিরদিন বসতি হইতে পারে নাই। এক সময় হয়ত সুন্দরবন উঠিয়াছে, দুই-তিন শত বৎসর পর্য্যন্ত উহার আবাদ ও বসতি স্থাপন কাৰ্য্য চলিয়াছে; পরে হঠাৎ পুনরায় উহা বসিয়া গিয়াছে, আবার জঙ্গল জন্মিয়াছে। এই অবস্থার পরিবর্তন হইতে আবার অনেক দিন লাগিয়াছে। কেহ অনুমান করিতে পারেন যে, মিশনরীগণ এইরূপ কোন পতনের যুগে আসিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা বিশ্বাস হয় না; কারণ তাঁহাদের আগমনের অব্যবহিত পূর্ব্বে সমস্ত দক্ষিণ বনে যেখানে সেখানে নদীর মোহানায় প্রতাপাদিত্যের কীর্ত্তিহর্ম্ম-সমূহ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সাগরদ্বীপে, ধূমঘাটে, বেদকাশী বা চকশীতে এবং আর কত স্থানে প্রতাপাদিত্যের যে দুর্গ ছিল, তাহার বিশেষ বিবরণ পরে প্রদত্ত হইবে। সে সকল দুর্গ ব্যতীত অন্য নানাবিধ কীৰ্ত্তিচিহ্নও সুন্দরবনের নানা স্থানে নানা ভাবে বর্ত্তমান রহিয়াছে। কোথায়ও ভগ্ন অট্টালিকা, প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ, ইষ্টকস্তূপ, পুকুর বা রাস্তার অংশবিশেষ, পুকুরের বাঁধা ঘাট, পরিচিত গ্রাম্য বৃক্ষ, মাটীর ঢিপি বা ভিট্টা, মনুষ্য ব্যবহৃত মৃন্ময় পাত্রাদি বা তাহার ভগ্নাংশ প্রভৃতি নানা স্থানে ভীষণ অরণ্যানীর মধ্যে দর্শকমাত্রকে চমকিত করে। ইষ্টকগৃহ পাইলে ব্যাঘ্রে আশ্রয় লয়, পুকুরের পার্শ্বে শূকর থাকে, উচ্চ ভিট্টার উপর গাব বা জাম গাছের ছায়ায় হরিণে বিশ্রাম ‘লাভ করে ও তাহাদের লোভে ব্যাঘ্র আসে এবং ইষ্টকস্তূপে বনের কাল সর্পে বাসা করে। সুতরাং সাধারণতঃ জলমগ্ন অরণ্যভাগ অপেক্ষা উচ্চ কীর্ত্তিস্থানসমূহ অধিকতর বিপজ্জনক।
সুন্দরবনের সমস্ত স্থান দেখা এক জীবনের কাজ নহে। বিশেষতঃ দক্ষিণাংশে এমন অনেক স্থান আছে, যাহা মানুষের অগম্য এবং বনবিভাগীয় শাসনের বহির্ভূত। সে সব স্থানে জমি এত নিম্ন, বন এত নিবিড় এবং পার্শ্ববর্তী নদীসমূহ এত বহুবিস্তৃত ও তরঙ্গ-সঙ্কুল যে, সে সকল স্থানের পথও অজানিত বলিয়া শিকারীরাও সে দিকে যায় না। সমুদ্রের দিক হইতে এ সব স্থান নিকটবর্ত্তী বলা যায়, কিন্তু সে দিক্ হইতে ষ্টীমার লইয়া নয়ন চরিতার্থ করিবার অভিলাষে এই বনে ভ্ৰমণ করিবার প্রবৃত্তি বা সুযোগ অতি অল্প লোকেরই হইতে পারে। সাধারণতঃ সেখানে শিকারী যায় না, কাঠুরিয়া যায় না, সুতরাং সে প্রদেশের সংবাদ সংগ্রহ করা অতীব কঠিন। সুন্দরবনের এই অজানিত প্রদেশ পার হইতে পারিলে সমুদ্রের কূলে যাওয়া যায়; তখন সেই তরঙ্গাহত বেলাভূমির অপূর্ব্ব দৃশ্যে মানবমাত্রের চিত্ত পুলকিত করে এবং সঙ্গে সঙ্গে নানা স্থানে বিভিন্ন দেশীয় মৎস্য- ব্যবসায়িগণের অসংখ্য আবাস-শ্রেণী দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়।
পরের মুখের কথা শুনিয়া কোনও স্থানেরই বিশেষ বিবরণ দেওয়া যায় না, বিশেষতঃ সুন্দরবনের। সেখানে যাহারা সর্ব্বদা যাতায়াত করে, তাহারা নিরক্ষর কাঠুরিয়া। তাহারা কোন স্থানই চক্ষু লইয়া দেখে না। যাহা দেখে, তাহাও এত অতিরঞ্জিত করিয়া, অসম্ভব কথায় ও অপদেবতার গল্পে পূর্ণ করিয়া বলে যে, তাহাদের কথা বিশ্বাস করা অতীব কঠিন। সুন্দরবন এক মন্ত্র-তন্ত্রময় রাজ্য। কাষ্ঠদেবতা, বনদেবতা, বনবিবি এ দেশের রাজ্যেশ্বরী; গাজী কালুর কথা, চম্পাবতীর কথা, পাঁচপীরের কথা, এমন কত উপকথায় যে এ অঞ্চলের ইতিকথা বিষমভাবে বিজড়িত, তাহা বলিবার নহে। সহিষ্ণুতা রক্ষা করিয়া এ সম্বন্ধে নানা অবান্তর ও অবাস্তব কথায় অবিরত ‘হুঁ’ দিতে না পারিলে, সত্য মিথ্যা কোন গল্পই শুনিতে পারা যায় না। সংযত শ্রোতাকে বহু কথা শুনিয়া অবশেষে তুষরাশির মধ্য হইতে তণ্ডুলকণা সংগ্রহের মত, বহুকষ্টে কিছু কিছু সার-সংগ্রহ করিতে হয়। অনেকস্থলে আমাদিগকেও তাহাই করিতে হইয়াছে। তবে সে-ভাবে যে তথ্য পাইয়াছি, স্বচক্ষে পরীক্ষা না করিয়া তাহা লিপিবদ্ধ করি নাই। আমরা যে সকল তথ্য প্রকাশ করিব, তাহার অধিকাংশই স্বচক্ষে দেখিবার ফল, অবশিষ্ট বিশেষ সতর্কতার সহিত বিশ্বস্ত শিক্ষিত লোকের নিকট হইতে সংগ্রহীত। প্রকাশিত বিবরণী পর্য্যাপ্ত নহে সত্য, কিন্তু তাহার সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার কোন কারণ নাই।
পূর্ব্বে বলিয়াছি আমাদের বিশ্বাস এই যে, সুন্দরবনে দীর্ঘকালব্যাপী বসতি ছিল। সে বসতির চিহ্ন এখনও আছে। সুন্দরবনের এক গৌরবের দিন ছিল, তাহার নিদর্শন এখনও বিলুপ্ত হয় নাই। তবে সমগ্রবনে বা তাহার প্রান্তভাগে কোথায় কোন্ কীৰ্ত্তি আছে, তাহা সমস্ত বিবৃত করা একপ্রকার দুঃসাধ্য। যতদূর সম্ভব, আমরা পশ্চিমদিক্ হইতে আরম্ভ করিয়া কতকগুলি কীৰ্ত্তিচিহ্নের সংবাদ প্রদান করিতেছি। সাগরদ্বীপে ২/১টি প্রাচীন মন্দির বর্ত্তমান আছে। উত্তরে হাতিয়াগড় অতি পুরাতন স্থান। বৌদ্ধযুগে হাতিয়াগড়ে একটি প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ বিহার ছিল। সমতটে চীনদেশীয় ভ্রমণকারী যে সকল বিহার দেখিয়াছিলেন, সম্ভবতঃ ইহা তাহাদের অন্যতম। এখানকার অম্বুলিঙ্গ শিব ইহার প্রাচীনত্বের পরিচয় দিতেছেন। ধনপতি সদাগর ‘হাতে ঘরে’ অম্বুলিঙ্গ ও নীলমাধবের পূজা করিয়াছিলেন।[৯] হাতিয়াগড়ের পূর্ব্বে মণিনদী, পশ্চিমে (২৬নং লাটে) রায়দীঘি ও কঙ্কণদীঘি নামে দুইটি উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ প্রকাণ্ড জলাশয় এখনও বৰ্ত্তমান আছে।[১০] উহাদের পূর্ব্ব পার্শ্বে (১১৬ নং লাটে) প্রসিদ্ধ জটার দেউল। ইহা একটি উত্তুঙ্গ মন্দির; ৪০/৫০ হাত উচ্চ হইবে, বহুদূরে নদী হইতে দেখা যায়। ইহা কোন্ সময়ে কাহার দ্বারা নির্ম্মিত হইয়াছিল, জানা যায় না। ইহা প্রতাপাদিত্যের আমলের কোন জয়স্তম্ভ কিনা, তদ্বিষয়ে সন্দেহ হয়।[১১] ইহা হইতে পূর্ব্বোত্তর কোণে কিছু দূরে পরাণ-বসুর খাল। এই খাল মাতলা নদী হইতে বিদ্যা নদীতে মিশিয়াছে। এই খালের দক্ষিণে ১২৭নং লাট। তন্মধ্যে খালের ধারে ‘বিরিঞ্চির মন্দির’ নামে এক বৃহৎ ইষ্টক স্তূপ আছে। খালের উত্তরপারে ১২৮নং লাটের মধ্যে একটি স্থানকে ‘ভরতগড়’ বলে। সেই গড় বা দুৰ্গ পরিখাবেষ্টিত ছিল, স্থানে স্থানে তাহার ইষ্টকপ্রাচীরের ভগ্নাবশেষ আছে। খাল হইতে ৭/৮ শত হস্ত দূরে একটি প্রকাণ্ড ইষ্টকস্তূপ এখনও ভরতরাজার মন্দির বলিয়া কথিত হয়। পুরাকালে সুন্দরবন প্রদেশে ভরত নামে একজন বিখ্যাত রাজা ছিলেন, নানাস্থানে তাঁহার পরিচয় পাওয়া যায়। খুলনা জেলার দৌলতপুর হইতে ১২/১৩ মাইল দক্ষিণে ভদ্র নদের কূলে যে প্রকাণ্ড ইষ্টকস্তূপ এখনও ‘ভরতরাজার দেউল’ বলিয়া কথিত হয়, যে স্থানের নাম এখনও ভরতভায়না এবং নিকটবর্ত্তী গৌরীঘোনা গ্রামে একটি ইষ্টকময় স্থানকে এখনও যে ভরতরাজার বাটী বলিয়া গল্প আছে, সে ভরতরাজার সহিত এই ভরতরাজার কোন সম্বন্ধ ছিল নিা, তাহা কে বলিবে?
মাতলা বা ক্যানিং সহর হইতে দক্ষিণদিকে গিয়া মাতলা নদীর পূর্ব্বাংশে ১২৯ নং লাটে, হাড়ভাঙ্গা আবাদে ২০/২২ বিঘা পরিমিত এক প্রকাণ্ড দীঘি আছে। উহার পূর্ব্বদিকে ১৩০নং লাটে একটা ছোট পোস্তবাঁধা পুকুর আছে, উহাকে ‘গলায় দড়িয়ার’ পুকুর বলে।১২ ১৮৫০ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে রেভারেণ্ড লং সাহেব মাতলার অনতিদূরে টার্ডা (Tarda) নামক একটি বড় পর্তুগীজ বন্দর দেখিয়াছিলেন। কলিকাতার পূর্ব্বে উহাই তাহাদের প্রধান বন্দর ছিল। এখন উহার কোন ভগ্নাবশেষ নাই।[১৩]
মাতলা হইতে সোজা উত্তরে গেলে বালাণ্ডা পরগণায় প্রাচীন বালাণ্ডা নগরের একটু উত্তরে হাড়োয়া নামক স্থানে পীর গোরাচাঁদ বা গোরাই গাজির সমাধি-মন্দির দেখিতে পাওয়া যায়। হাড়োয়ার বাৎসরিক মেলা বিখ্যাত। বালাণ্ডা অতি পুরাতন স্থান। এখানে বঙ্গের পঞ্চবিভাগের অন্যতম বাড়ী বা বালবল্লভীর প্রধান নগরী ছিল বলিয়া বোধ হয়।[১৪]
কালীগঞ্জের সন্নিকটবর্ত্তী গড় মুকুন্দপুরের অপর পারে অর্থাৎ কালিন্দী নদীর পশ্চিম পারে, ১০১ নং লাটে বাঁকুড়া নামক স্থানে মৃত্তিকার নিম্নে শিবলিঙ্গ ও মন্দিরের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গিয়াছে। ইহার উত্তরে যশোহরের প্রথম জজ্ম্যাজিষ্ট্রেট হেঙ্কেল সাহেব স্বীয় নামে হেঙ্কেলগঞ্জ (হিঙ্গুলগঞ্জ) নাম দিয়া, সুন্দরবন আবাদের জন্য একটি প্রধান নগর স্থাপন করেন। তাহার উত্তরাংশে বাঙ্গালপাড়া নামক স্থানে যে এক সময়ে বহুলোকের বাস ছিল, তাহার প্রকৃষ্ট পরিচয় রহিয়াছে। বাঁকুড়ার পূর্ব্বপারে ডামরেলীর বিখ্যাত নবরত্ন মন্দির দণ্ডায়মান আছে এবং পার্শ্বে দ্বাদশ শিবমন্দিরের ভগ্নাবশেষ আছে।[১৫]
যমুনা ও ইচ্ছামতীর মধ্যস্থলে ১৬৫নং লাটে ধূমঘাট। ইহাতে ১০/১৫ মাইল ব্যাপিয়া সর্ব্বত্র নানাবিধ কীর্তিকলাপের চিহ্ন আছে। ইহার উত্তর প্রান্তে যশোহর নগর, দুর্গ ও যশোরেশ্বরীর মন্দির এবং দক্ষিণ প্রান্তে ধূমঘাট দুর্গ ছিল। মধ্যবর্ত্তী সমস্ত ভূভাগে এক বিপুল নগরীর ভগ্নাবশেষ বিদ্যমান রহিয়াছে। এই রাজধানীর উপনগর পূর্ব্বদিকে বর্তমান তেরকাঠির জঙ্গল পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
খোলপেটুয়া ও কদমতলীর মধ্যবর্তী ১৬৯ নং লাটে তেরকাঠি বা তেজকাঠি অতি ভীষণ জঙ্গল। উহার পূর্ব্বসীমাবর্ত্তী খোলপেটুয়া ও চূণার গাঙ্গ হইতে তেরকাঠির খাল, নৈহাটির খাল, নৈহাটির দোয়ানিয়া,[১৬] মোড়লখালি ও পোদখালি প্রভৃতি কতকগুলি খাল ইহার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। এই সব খাল দিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলে যে বহু বসতিচিহ্ন দৃষ্টিগোচর হয়, তাহা আমরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছি। সম্ভবতঃ তিওর ও পোদ জাতীয় নিম্নশ্রেণীর লোকেরা প্রথমতঃ এস্থান আবাদ করিয়া বসতি করিয়াছিলেন, তাহা হইতে তেরকাঠি বা তিওরকাঠি এবং পোদখালি প্রভৃতি নাম হইয়াছে। জঙ্গলের ভিতর বহু সংখ্যক উচ্চ ভিট্টা, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, এবং বটগাছ, পিত্তরাজ (রয়না) গাছ, সোণাইল গাছ, সাড়া, বনলেবু, ক্ষুদেজাম, আমজুম, সঁটি বা আমআদা, দাঁতন (আশ সেওড়া), পিঠানী, ছালানী (পেত্নীচিড়ে), নিম, কুঁচ, দয়ারগুড়া লতা, খড়বন, স্থানে স্থানে পরিষ্কার দূর্ব্বাবন, দুই একটি বকুল এবং লক্ষ লক্ষ গাবগাছ দেখা যায়! এ বন সৰ্ব্বত্রই খুব উচ্চ, জোয়ারের জল উঠিতে পারে না, সুন্দরী বৃক্ষ কম, কিন্তু জঙ্গল বড় নিবিড় ও অত্যন্ত দুর্গম। দুই একখানি ইষ্টকখণ্ড নানাস্থানে দেখা যায়, এবং ২/১ স্থানে ক্ষুদ্র ইষ্টকস্তূপও দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল। পোদখালির পশ্চিমে দীঘি ও দালান আছে। পশ্চিম দিক্ হইতে রাস্তার পরিষ্কার চিহ্ন পাওয়া যায় এবং সেদিকে একটি গুম্বজওয়ালা মসজিদের ভগ্নাবশেষ আছে।
ইচ্ছামতী বা কদমতলী দক্ষিণে গিয়া আড়াইবাকীর মোহানা পার হইয়া, মালঞ্চ নাম ধারণ করিয়াছে। মালঞ্চ ও আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর মাঝে হরিখালি নামক একটি সুদীর্ঘ খাল উভয়কে সংযুক্ত করিয়াছে। এই হরিখালির দক্ষিণতীরে একস্থানে ১৭৯ নং লাটে নদীর গায়ে ভগ্ন বাটীর প্রাচীর আছে। সম্ভবতঃ তথায় লবণের কারখানা ছিল। ইরিখালি হইতে দক্ষিণ দিকে একটি পাশখালির পার্শ্বে একটু দূরে এক প্রকাণ্ড ভগ্ন বাটীর প্রাচীরাদি দণ্ডায়মান রহিয়াছে। ৪/৫ বৎসর পূর্ব্বে গুরুচরণ দাস নামক এক সন্ন্যাসী এই ভগ্ন বাটীতে আসিয়া আশ্রয় লইয়া সাধন ভজন করিতেন। ইনি পূর্ব্বে কিছুদিন তেরকাটির জঙ্গলে ছিলেন। সেখানে একটি খালের কূলে যেস্থানে তিনি বৃক্ষতলে আশ্রম নিৰ্দ্দেশ করিয়াছিলেন, তাহাও আমরা দেখিয়াছি। তিনি অনেকদিন ব্যাঘ্রসঙ্কুল হরিখালির জঙ্গলে ছিলেন এবং জানি না কি কৌশলে বা সাধনবলে ব্যাঘ্রের করাল গ্রাস হইতে আত্মরক্ষা করিয়াছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে শেষ রক্ষা করিতে পারেন নাই। আমরা হরিখালির জঙ্গলে যাইবার কিছুদিন পূর্ব্বে তাঁহাকে এক ভীষণ ব্যাঘ্রের উদরসাৎ হইতে হইয়াছিল। মালঞ্চ নদী যেখানে সমুদ্রে পড়িয়াছে, তাঁহার পশ্চিম ধারে রায়মঙ্গল মোহানার সন্নিকটে ১৮৭ নং লাটে ইষ্টকগৃহের ভগ্নাবশেষ আছে। মালঞ্চের পূর্ব্ব পার্শ্বে টিপ্নের মাদিয়া (দ্বীপ)। তাহার পূর্ব্বে সেজিখালি নদী। এই সেজিখালির পূর্বতীরে ১৮৮ নং লাটে কাশীয়াডাঙ্গা নামক স্থানে বড় জামগাছ ও পুঞ্জীকৃত ইষ্টক পড়িয়া রহিয়াছে।
মালঞ্চ হইতে আড়াইবাঁকী নামক এক সুবৃহৎ দোয়ানিয়া আড়পাঙ্গাসিয়ায় মিশিয়াছে। এই আড়াইবাঁকীর উত্তরাংশে প্রতাপাদিত্যের ধূমঘাট দুর্গ ছিল। তাহারই সন্নিকটে ১৭৩ নং লাটে নৌসেনাপতির বাস-গৃহাদি ছিল। উহার বিলুপ্ত ভগ্নচিহ্ন এখনও বিদ্যমান। আড়পাঙ্গাসিয়া দিয়া উত্তর দিকে আসিলে খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষের সঙ্গমস্থলে পতিত হওয়া যায়। এই খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষের মধ্যবর্তী স্থানে প্রতাপনগর ও গড় কমলপুর। কমলপুরে প্রতাপাদিত্যের একটি প্রধান দুর্গ ছিল। উহার উত্তরে এখনও এক প্রকাণ্ড মৃত্তিকার গড় আছে, তাহার পার্শ্বে খোলপেটুয়া নদীর ধারে একটি পুরাতন পুষ্করিণী। এ পুষ্করিণীর জল অতি মিষ্ট। এখন সুন্দরবনের কোন কোন স্থানে শাসনকেন্দ্র (coupe) স্থাপন করিয়া, সেখানে আফিস ও কর্মচারিগণের বাসস্থান স্থির করিতে গিয়া, পানীয় জলের জন্য পুষ্করিণী খনন করিবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোথাও পুষ্করিণীতে ভাল জল হয় না। অথচ উপরোক্ত পুষ্করিণীতে উৎকৃষ্ট জল পাওয়া যাইতেছে; বহুদূর হইতে লোক আসিয়া এ পুকুর হইতে জল লয়। গ্রীষ্মকালে লোকে নৌকায় করিয়া জল লইয়া যায়। এইরূপে চাঁদখালির হেঙ্কেল পুষ্করিণী, বেদকাশীর দীঘি, আমাদির কালিকা দীঘি প্রভৃতি প্রাচীন জলাশয়গুলির জল সুমিষ্ট। ইহা হইতে দুইটি অনুমান হয়; সম্ভবতঃ (১) সুন্দরবনের মৃত্তিকারই সাধারণ অবস্থার পরিবর্ত্তন হইয়াছে, (২) অথবা তখন লোকে পরীক্ষা করিয়া স্থান দেখিয়া পুষ্করিণী খনন করিত। এই দ্বিতীয় অনুমান ঠিক নহে; কারণ বহুস্থানে লোকের বসতিচিহ্ন পাওয়া যাইতেছে; পানীয় জলের ব্যবস্থা না হইলে বসতি হয় না। প্রকৃতপক্ষে যেখানে লোকের বসতি ছিল, সেখানেই পুষ্করিণীর অস্তিত্বের প্রমাণ আছে, সুতরাং সুন্দরবনের সাধারণ অবস্থা- বৈপরীত্য ব্যতীত আর কিছু বলা যায় না।
প্রতাপনগর হইতে উত্তরে ভালুকা পরগণার মধ্যে বিছট নামক গ্রাম। এখানে খোলপেটুয়া নদীর উপরেই একটি প্রকাণ্ড ডক (Dock) বা জাহাজনির্মাণস্থান রহিয়াছে। এই জাহাজঘাটা কোকালে কাহার দ্বারা খনিত হইয়াছিল, তাহা জানিবার উপায় নাই। দুইপার্শ্বে দুইটি ১০/১২ হাত উচ্চ সুবিস্তৃত মাটীর ঢিপি এবং মধ্যস্থলে নদীর সহিত সম্মিলিত খাত রহিয়াছে। মাটীর ঢিপি দুইটির দৈর্ঘ্য এখনও প্রায় ১২৫০ ফুট আছে। এই ডকের ভিতর উত্তর-পশ্চিমপ্রান্ত হইতে একটি ৩০ হাত প্রশস্ত রাস্তা প্রায় একমাইল দূরবর্তী ‘বাণিয়াপুকুর’ নামক ৯ বিঘা জলাশয়যুক্ত দীঘির কূল পৰ্য্যন্ত গিয়াছে। সম্ভবতঃ এখানে বণিক বা সওদাগর জাতীয় ব্যবসায়িগণের নিবাস ছিল এবং ডকে তাহাদের জাহাজ নির্ম্মাণ হইত। পুকুরের সন্নিকটে কয়েক স্থানে ইষ্টকের চিহ্ন পাওয়া যায়। ডকের ভিতর হইতে যে খাল বাহিত হইয়া গিয়াছে, সম্ভবতঃ তাহার মধ্যে এককালে নানাজাতীয় তরণী সজ্জীভূত থাকিত। এই খালের নাম কুমারখালি। পার্শ্বে ডকের উত্তরপূর্ব্ব পাহাড়ের নিম্নে বহুদূর পর্য্যন্ত রাশীকৃত চাড়া বা মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশদ্বারা কুম্ভকারদিগের বাড়ীর পরিচয় আছে। এই বিছট অতি পুরাতন স্থান; ইহারই সন্নিকটে বাসুদেবপুরে দনুজমৰ্দ্দনের মুদ্রা পাইয়াছিলাম। প্রতাপনগর হইতে পূর্ব্বদিকে কপোতাক্ষ পার হইলে বর্তমান ২১২ নং লাটের ভিতর গাদিগুমা ও দমদমা ছিল। প্রতাপাদিত্যের কপোতাক্ষ দুর্গের প্রসঙ্গে উহার বিষয় আলোচনা করা যাইবে (২য় খণ্ড, মোগল আমল, ১৬শ ও ১৯শ পরিচ্ছেদ)।
উক্ত দমদমা প্রভৃতি স্থান হইতে দক্ষিণ মুখে গিয়া কাশীখাল পার হইলে বৰ্ত্তমান ২১১ নং লাটে পড়িতে হয়; ঐস্থানে কপোতাক্ষের পূর্ব্বপারে সুবিদিত বেদকাশী আবাদ। ইহা অতি পুরাতন স্থান। এখানে একটি সুবিস্তৃত দীঘি আছে। দীঘিটি পূৰ্ব্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ; দৈর্ঘ্য ৭০০ হাত এবং প্রস্থ ৪০0 হাতের অধিক হইবে। দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি ইটে গাঁথা মঞ্চে কালীর স্থান আছে এবং তাহার পার্শ্বে খালাস খাঁ পীরের আস্তানা। এজন্য জলাশয়টির নাম হইয়াছে, ‘কালী-খালাস খাঁ’ দীঘি। সম্ভবতঃ পাঠান আমলে খালাস খাঁ নামক জনৈক মুসলমান সাধু বা পীর এখানে আসিয়া ধর্মপ্রচার করেন এবং দীঘি তিনি খনন করেন। মোগল আমলে বা প্রতাপাদিত্যের সময়ে এখানে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিবে। দীঘিটির জল খুব ভাল, ইহার উপরে এমন দামদল জন্মিয়াছে যে, শীতকালে মানুষে স্বচ্ছন্দে উহার উপর দিয়া চলিয়া বেড়াইতে পারে। দীঘির উত্তর-পূর্ব্ব কোণে কিছুদূরে একটি প্রকাণ্ড বাটীর ভগ্নাবশেষ রহিয়াছে। এখনও উহার বেষ্টন-প্রাচীরের কতকাংশ এবং ৭০/৮০ বিঘা জমি বেষ্টন করিয়া এক গড়খাই বৰ্ত্তমান আছে। ইহা খালাস খাঁর দুর্গ কিংবা প্রতাপাদিত্যের দুর্গ, তাহা স্থির করিবার উপায় নাই। পাঠান আমলে মজিদের যেরূপ প্রাচুর্য্য দেখা যায়, দুর্গের তেমন নিদর্শন নাই। তবে প্রতাপাদিত্যের সময় নিশ্চয়ই এ স্থানে সমৃদ্ধ পল্লী ছিল; নতুবা মহারাজ বসন্তরায় এখানে উৎকলেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করিতেন না। রাজধানী যশোহরপুরীকে কাশী বলা হইত; সে রাজধানীর বিস্তৃতি উপনগর সমেত পূৰ্ব্বদিকে কপোতাক্ষ পর্য্যন্ত ধরা যাইতে পারে; বারাণসীর অপর পারস্থ বেদকাশীর অনুকরণে কপোতাক্ষের অপর পারস্থ স্থানকে দেবকাশী বলা হইয়াছিল। বসন্তরায়ের যে কবি-প্রতিভা যশোরকে যশোহর করিয়াছিল, তাহাই বেদকাশী নামেরও উৎপত্তির কারণ। এই বেদকাশীতেও শিবমন্দির হইয়াছিল, তাহাতে শিলালিপি ছিল। সে মন্দির এক্ষণে নাই, আছে কেবল তাহার ৬/৭টি সুন্দর প্রস্তরস্তম্ভ। উহা দেখিবার জিনিষ, খুলনা জেলার একটি পরম গৌরবের সামগ্রী; কিন্তু স্তম্ভসমূহ কোন্ যুগে কোথা হইতে কে আনিয়াছিল, তাহা জানিবার উপায় নাই (২য় খণ্ড, মোগল আমল, ২৪শ পরিচ্ছেদ)।
বেদকাশীর পূর্ব্ব-দক্ষিণ কোণে যেখানে শিবসা নদীর দ্বিধাবিভক্ত প্রবাহদ্বয় একত্র মিলিত হইয়া মজ্জাল নাম ধারণপূর্ব্বক সমুদ্রমুখী হইয়াছে, সেই ত্রিমোহানার পূর্ব্বধারে প্রায় আধ মাইল পরিমিত স্থানে শিবসা নদীর কূল দিয়া খাতের মধ্যে অসংখ্য ইষ্টক দেখিতে পাওয়া যায়। হয়ত কোন নদীকূলবর্তী প্রাচীন অট্টালিকা ভাঙ্গিয়া পড়িয়া স্রোতোবেগে ইষ্টকরাশি বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, অথবা তীর হইতে দূরে এককালে যে সমস্ত বসতিস্থান ছিল, তথাকার ভগ্ন অট্টালিকাসমূহের ইট কেহ নৌকায় বোঝাই করিয়া লইয়া যাইবার সময় নদীতীরে ইট ফেলিয়া গিয়াছে। সেই ইটগুলি খুব ভাল; বহুদিন ধরিয়া লোণা জল বা বাতাসে তাহার ধ্বংসসাধন করিতে পারে নাই। বাস্তবিকই এইস্থানে উপরে বহুদূর ধরিয়া নানা বসতিচিহ্ন আছে। তন্মধ্যে একটি বাড়ী বেশ জাঁকজমকশালী ছিল বলিয়া বোধ হয়। উহাকে কাঠুরিয়াগণ ‘কামার বাড়ী’ বলে, কারণ কোনকালে নাকি সেখানে কামারদিগের লোহা পিটান একটি ‘নেহাই’ পাওয়া গিয়াছিল। কিন্তু ইহা প্রবাদ মাত্র; দ্বিতল একটি বাড়ীর ভগ্নাবশেষ দেখিলে তাহা কোন বিশেষ প্রতিপত্তিশালী ধনীর বাড়ী বলিয়া মনে হয়। একটি বিস্তৃত দ্বিতল গৃহের অত্যুচ্চ ইষ্টকস্তূপের সহিত সংলগ্নভাবে স্থানে স্থানে মৃত্তিকার ঢিপি ও অন্য ইষ্টকস্তূপ বাটীর অন্যান্য গৃহাদির পরিচয় দেয়। এই সকল স্তূপ এক্ষণে প্রকাণ্ড বিষধর সর্পগণের আবাসস্থান হইয়াছে। বাড়ীর পার্শ্বেই একটি পোস্তবাঁধা পুকুর; উহারও চতুঃপার্শ্ব এক সময়ে ইষ্টকপ্রাচীরে বেষ্টিত ছিল। এখনও স্থানে স্থানে সে প্রাচীরের অংশবিশেষ দণ্ডায়মান আছে। বিস্তৃত বাড়ীর এক ধারে নদী ও তিন ধারে গড়খাই ছিল; ঐ গড়খাই একদিকে পুকুরে আসিয়া মিশিয়াছে বলিয়া নদীর মৎস্য আসিয়া পুকুরে রাশীকৃত হইয়াছে।
এইস্থান ত্যাগ করিয়া দক্ষিণ-পশ্চিম মুখে একটু অগ্রসর হইলেই বামে সেখের খাল। উহার কূলে গোল গাছ খুব ভাল হয়; তজ্জন্য বহু নৌকা গোল কাটিতে এই খালের মধ্যে আসে। মর্জ্জাল নদী হইতে একটি খাল পূৰ্ব্বমুখে জঙ্গলে প্রবেশ করিয়াছে, উহার নাম কালীর খাল। এই সেখের খাল ও কালীর খালের মধ্যবর্তী অপেক্ষাকৃত উচ্চভূমিবিশিষ্ট নিবিড় জঙ্গলকে সেখের টেক বলে। উহা ২৩৩ নং লাটের অন্তর্গত। এখানে সুন্দরী গাছ যথেষ্ট, হরিণের সংখ্যা অত্যন্ত অধিক এবং ব্যাঘ্রাদি হিংস্র জন্তুর আমদানীও বেশী। সুতরাং আমাদিগকে একপ্রকার প্রাণ হাতে করিয়া এ বনে ভ্রমণ করিতে হইয়াছিল। সেখের খালের মধ্যে প্রবেশ করিয়া ডানদিকে চতুর্থ পাশখালির পার্শ্বে এক স্থলে ইষ্টক-গৃহের ভগ্নাবশেষ ও কয়েকটি গাবগাছ দেখা যায়। তথা হইতে উঠিয়া বনের মধ্যে প্রায় একমাইল গেলে, একটি দুর্গ দেখিতে পাওয়া যায়। সাধারণতঃ বাওয়ালীরা ইহাকে ‘বড় বাড়ী’ বলে। সম্ভবতঃ ইহাই মহারাজ প্রতাপাদিত্যের শিবসা দুর্গ। দুর্গের অনেক স্থানে উচ্চ প্রাচীর এখনও বর্ত্তমান। অন্যত্র ইহার বিশেষ বিবরণ দেওয়া যাইবে।১৭ এই দুর্গের উত্তর-পূর্ব্ব বা ঈশানকোণে একটি শিবমন্দিরের ভগ্নাবশেষ আছে। সেখানে হইতে দক্ষিণ-পূৰ্ব্ব মুখে অগ্রসর হইলে, যেখানে- সেখানে পুকুর ও পরে ২/৩টি ইষ্টকবাড়ী ও অসংখ্য বসতিভিট্টা পাওয়া যায়। বাড়ীগুলির মাটীর ঢিপি শত শত গাবগাছে ঢাকা রহিয়াছে। তাহা হইতে বাহির হইলে, একটু অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গায় একটি সুন্দর মন্দির দৃষ্টিপথবর্ত্তী হয়। সুন্দরবনের ভীষণ অরণ্যানীর মধ্যে বিবিধ কারুকার্য্য- খচিত এবং অভগ্ন অবস্থায় দণ্ডায়মান এমন মন্দির আর দেখি নাই।
ইহার খিলানগুলি গোল নহে, পরন্তু মুসলমান-স্থাপত্যানুগত খিলানের মত ত্রিকোণ। হিন্দুরাও ত্রিকোণ খিলান ব্যবহার করিতেন, তাহার প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। ১৮ মন্দিরের অন্যান্য প্রকৃতি দেখিয়ে ইহা যে মোগল আমলে কোন হিন্দুকর্তৃক নির্ম্মিত হইয়াছিল, তাহা অনুমান করা সহজ হয়। যদিও মন্দিরের গুম্বজ ছাদ আছে, কিন্তু চূড়া নাই, কারণ শীর্ষদেশ জঙ্গলসমাকীর্ণ হইয়াছে, তবুও ইহা মুসলমানের মসজিদ নহে, ইহা স্থির। মন্দিরের দক্ষিণ ও পশ্চিমদিকে দরজা আছে, পূর্ব্বে ও উত্তরে কোন দরজা নাই। মুসলমানের কোন মসজিদে পশ্চিমদিকে কোন খোলা দ্বার থাকে না এবং উহা সাধারণতঃ পূর্ব্বদ্বারী হইয়া থাকে। মন্দিরের দক্ষিণদিকে জঙ্গল খুব নিকটবর্ত্তী হইয়া আসিয়াছে, কিন্তু পশ্চিম ও উত্তর দিকে এখনও প্রশস্ত পরিষ্কৃত জমি আছে এবং তাহা বেশ উচ্চ। মন্দিরে কোন দেববিগ্রহ নাই; তবুও অনুমান করা যায় যে, প্রতাপাদিত্য তাঁহার দুর্গের সন্নিকটে এই কালিকা দেবীর মন্দির নির্মাণ করেন। তজ্জন্য মন্দিরের নিকট দিয়া প্ৰবাহিত খালটি ‘কালীর খাল’ নামে অভিহিত হইয়াছে। সরকারী ম্যাপেও এখনও কালীর খাল নাম বিলুপ্ত হয় নাই। যশোরেশ্বরীর মন্দিরের মত ইহারও পশ্চিম দিকে সদর বলিয়া বোধ হয়। আমাদের সঙ্গে যে এক বাবু খাঁ বাওয়ালী ছিলেন, তিনি ২৫/৩০ বৎসর সুন্দরবনে আসিতেছেন; তিনি বলিলেন, ১২/১৪ বৎসর পূর্ব্বে কোন একদল বিশিষ্ট ভদ্রলোক স্বপ্নাদিষ্ট হইয়া আসিয়া, মহাসমারোহে এই মন্দিরে কালীপূজা দিয়া গিয়াছিলেন। বাবু খাঁ সে সময়ে এই জঙ্গলে আসিয়াছিলেন। মন্দিরের পশ্চিম দিকে ঐ পূজায় বলি হয়। ঠিক যে স্থানে সে বলি হইয়াছিল, বাবু খাঁ সে স্থানটি আমাদিগকে প্রদর্শন করিলেন। কিন্তু এমন জীবন্ত দর্শক সাক্ষী পাইয়াও আমরা তাঁহার বর্ণনায় সম্পূর্ণ আস্থা স্থাপন করিতে সম্মত নহি; কারণ নিরক্ষর গল্পরসিক বৃদ্ধ বাওয়ালী গল্পের খাতিরে মিথ্যা কথা বলিতে যে কিছু মাত্র দ্বিধাবোধ করেন না, তাহা দেখিয়াছি।
এই মন্দিরটি সুন্দরবনের একটি প্রধান স্থাপত্য-নিদর্শন। ইহার ভিতরের মাপ ১০’-৬’’-×১০’-৬’’ এবং বাহিরে ২১’-৩’’ ×২১’-৩’’; ভিত্তি ৫’-৩’’। ভিতরের উচ্চতা ২৫’-৬’’। মন্দিরে পশ্চিমে ও দক্ষিণে দরজা আছে; পশ্চিম দ্বার ৫’-৪’’ ×২’-৬’’, উপরে খিলানের উচ্চতা ১’-৮’’; দক্ষিণ দ্বার ৫’-৬’’ x২’-৬’’, খিলানের উচ্চতা ১’-৯’’; উত্তরের দিকে ভিতরের ৪ ফুট উচ্চস্থানে একটি কুলুঙ্গ বা সংবদ্ধ জানালা আছে, উহার মাপ ৩’x২’’ এবং খিলানের উচ্চতা ১’-৬’’। পূর্ব্বদিকে এরূপ কোন কুলুঙ্গ বা জানালার খাত নাই। মন্দিরের বাহিরের ইষ্টকে, দেওয়ালের কার্ণিসে নানা কারুকার্য্য আছে। উত্তর দিকে দেওয়ালে ইষ্টক দ্বারা একপ্রকার জাল বা ঝাপ্পী প্রস্তুত করা আছে। দক্ষিণ পার্শ্বে জমি অনেক বসিয়া গিয়াছে, সেজন্য জঙ্গল হইয়াছে এবং জোয়ারের জল মন্দিরের মূল পর্য্যন্ত আসে। সুতরাং সে দিকে মন্দিরের গায়ে একটু লোণা ধরিয়াছে। অন্য সবদিকে জমি উচ্চ আছে, জল উঠে না; এজন্য লোণা ধরে নাই। মন্দিরের শিরোভাগে কতকগুলি গাছ জন্মিয়াছে, কালে উহাতেই এই অপূৰ্ব্ব স্থাপত্য নিদর্শন বিলুপ্ত করিবে। এজন্য আমি এই মন্দিরের রক্ষণার্থ ইহার প্রতি গবর্ণমেণ্টের প্রত্নতত্ত্ব-বিভাগীয় ব্যক্তিবর্গের কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। মন্দিরের পশ্চিম দিক্ হইতে উহার ফটো লওয়া হইয়াছিল। মন্দিরের নিকটবর্ত্তী স্থানে জঙ্গল এত ভীষণ যে ফটোগ্রাফারের প্রাণরক্ষার্থে চারিদিকে সতর্ক বন্দুকধারী দণ্ডায়মান রাখিতে হইয়াছিল।[১৯]
সেখের টেক হইতে মৰ্জ্জাল নদী দিয়া দক্ষিণ দিকে গেলে, ডানদিকে আল্কী নদী মৰ্জ্জাল হইতে বাহির হইয়া, পুনরায় কিছু দক্ষিণে সে-নদীতেই পড়িয়াছে; সেই মোহানায়, আল্কী নদী ও মজ্জালের মধ্যস্থলে, ১৯৮ নং লাটে, আল্কীর কূলে ইষ্টকস্তূপ দেখিতে পাওয়া যায়; ঐ স্থানে পূর্ব্বে নেমক খালাড়ী বা লবণ প্রস্তুত করিবার কারখানা ছিল বলিয়া বোধ হয়। আরও দক্ষিণে গেলে মজ্জালের নাম মার্জাটা হইয়াছে, পশর আসিয়া দুইবার তাহাতে মিশিয়াছে, আবার পূৰ্ব্বদিকে পশরের এক শাখা বাঙ্গড়া নামে সমুদ্রে পড়িয়াছে। বাঙ্গড়ার মোহানার বহু পূর্ব্বদিকে মধুমতী বা বলেশ্বরের মোহানা, ইহাকেই বিখ্যাত হরিণঘাটা মোহানা বলে। ঐ মোহানার উত্তরাংশে সুপতি ফরেষ্ট ষ্টেশন। সুপতির মত এত দক্ষিণে, এত সমুদ্রসান্নিধ্যে, কোন ফরেষ্ট আফিস নাই। সুপতি এত দক্ষিণে গেল কেন, তাহার একটা কারণ আছে।
পূৰ্ব্বে বলা হইয়াছে বলেশ্বর দিয়া পার্ব্বত্য জল বহে এবং বলেশ্বর স্বকীয় জলের বলে এত বলী যে, সমুদ্রসঙ্গম পর্যন্ত সে স্বীয় প্রকৃতি রক্ষণ করিয়াছে। সুপতির সন্নিকটে বলেশ্বরের জল বৎসরের অধিকাংশ সময় মিষ্ট থাকে; পৌষমাস পর্য্যন্ত তথাকার জল লবণাক্ত হয় না। এখান হইতে মর্জ্জালের মোহানা পর্য্যন্ত অনেক স্থানে সমুদ্রকূলের সন্নিকটে মিষ্ট জলাশয় আছে। মর্জ্জালের মোহানা হইতে সমুদ্রকূল বাহিয়া পূর্ব্বদিকে অগ্রসর হইলে, ফুলজুরী জঙ্গলের নিকটে এক মিষ্ট জলের পুকুর আছে; নাবিকেরা ইহার সন্ধান রাখে এবং এদিকে আসিলেই এই পুকুর হইতে পানীয় সংগ্রহ করে। এই স্থান হইতে পূর্ব্বদিকে গেলে বালুকার চড়ায় যেখানে খনন করা যায়, সেখানেই মিষ্টি জল পাওয়া যায়। এজন্য এখানে লোকের বসতি ও ব্যবসায় করিবার সুবিধা হইয়াছে। উক্ত মিষ্ট পুকুরের পূর্ব্বদিকে ফুলজুরী বা মেহেরালির খাল। আধুনিক সময়ে মেহের আলি নামক এক সারঙ্গের নামে উহার নাম মেহের-আলি হইয়াছে। এই খালের আরও পূৰ্ব্বদিকে মাণিকদিয়া বা মাণিকখালি নদী। এই নদী পশর হইতে উঠিয়া সাগরে পড়িয়াছে। এই মাণিকদিয়া নদীর মধ্যে চট্টগ্রামের মৎস্যজীবীগণ এক সুন্দর উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছেন। নদীর দুইধারে জালিয়াদিগের বাড়ী, তাহারা রাশি রাশি মৎস্য ধরেন এবং উহা শুকাইয়া বিদেশে চালান দেন। সে স্থানে জালিয়াদিগের এমন বিস্তৃত উপনিবেশ বসিয়াছে যে, তাহাদের অভাব-পূরণ জন্য নানা স্থান হইতে ব্যবসায়িগণ আসিয়া তথায় বাজার বসাইয়াছেন। শুনা মৎস্যের দুর্গন্ধে নদীর মধ্যে প্রবেশ করা দুষ্কর, কিন্তু ব্যবসায়ের লোভে সেই নদীর মধ্যে বহুসংখ্যক ব্যবসায়ী নৌকার মধ্যেই স্থায়ী দোকান খুলিয়া বাজার বসাইয়াছেন। যশোহর জেলারও কত দোকানদার এখানে ব্যবসায় করিয়া অর্থ সঞ্চয় করিতেছেন।[২০] মিষ্ট জল পান বলিয়া এসব লোক তথায় স্বচ্ছন্দে জীবিকানির্ব্বাহ করিতেছেন। সেই কারণে এ অঞ্চলে অনেক স্থলে পূর্ব্বে নেমক খালাড়ী ছিল। পশর হইতে একটি খাল পশ্চিমমুখে আসিয়া মাৰ্জ্জাটায় মিশিয়াছে; এই খালের নাম ভেদাখালি ইহার উত্তর কূলে এবং নিকটবর্ত্তী দুবলা ভারানীর খালের উত্তরাংশে বহুসংখ্যক নেমক খালাড়ীর ভগ্নাবশেষ আছে। বাঙ্গড়া নদীর মোহানার উত্তরাংশে একটি খাল আসিয়া দক্ষিণমুখে সমুদ্রে পড়িয়াছে; এই খালের মোহানার একস্থানে লাল ও কালো পাথর প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। কিরূপে কখন্ এখানে পাথর আসিয়াছিল, তাহা নির্ণয় করিবার কোন উপায় নাই। তবে এসব নিদর্শন যে মানুষের প্রাচীন বসতি প্রভৃতির প্রমাণ দেয়, তাহাতে সন্দেহ নাই। শুধু মাণিকদিয়া নদীর মধ্যে নহে, বাঙ্গড়ার মোহানা হইতে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত মোরাদিয়া খালের মধ্যেও জালিয়াগণের একটা প্রধান আড্ডা হইয়াছে।
এসব ত আধুনিক যুগের কথা। অপেক্ষাকৃত প্রাচীনযুগেও এ অঞ্চলে মনুষ্যাবাস ছিল। এ অতি সুন্দর স্থান, বহুদেশের মধ্যে, বহুনদীর সঙ্গমে, সাগরকূলে এস্থানের অতি সুন্দর অবস্থান; এস্থানে দাঁড়াইলে মনে হয়, বঙ্গ যেন বাহুবিস্তার করিয়া একদিকে রাঢ় ও কলিঙ্গ এবং অন্য দিকে চট্টল ও আরাকাণকে আকর্ষণ করিত এবং এই সকল দেশের পণ্যভার বঙ্গসাগরের এই শীর্ষভাগে আসিয়া নানা নদীপথে শত জনপদের অভাব মোচন করিতে যাইত। বিশেষতঃ যখন পশরে ও বলেশ্বরে পার্বত্য স্রোত প্রবাহিত হইত, তখন এ স্থানের অবস্থা আরও উন্নত ছিল বলিয়া অনুমান করা যায়। যে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য ডিঙ্গা দেশে বিদেশে ব্যবসায় চালাইত, তাহা এখানেও আসিয়াছিল। হরিণঘাটার মোহানা হইতে ‘চাঁদের আড়া’ নদী পশ্চিমমুখে আসিয়াছে; উহার পার্শ্বে এখনও পুকুর, কলাগাছ, রাস্তার ভগ্নাবশেষ এবং ইষ্টকস্তূপসমূহ আছে। এই চাঁদের আড়ায় চাঁদ সওদাগরের পোতাশ্রয় ছিল। আর একটু পশ্চিমে আসিয়া ‘কালীদহের খাল’ তাহার আরও সাক্ষ্য দিতেছে। হরিণঘাটার পশ্চিম কোণে একস্থানকে Tiger Point বা বাঘের কোণা বলে। তাহার সন্নিকটে যে ইষ্টকস্তূপাদি আছে, তাহা কোন প্রাচীন বন্দরের অস্তিত্ব সপ্রমাণ করে। পর্তুগীজ ঐতিহাসিকেরা সুন্দরবনের যে পাঁচটি বিনষ্ট নগরীর কথা বলিয়া গিয়াছেন এখানে তাহার একটির অবস্থান ছিল বলিয়া মনে হয়।[২১] কবিকঙ্কণকৃত চণ্ডীকাব্যে যে সকল বাঙ্গাল মাঝি লইয়া ধনপতি প্রভৃতি সওদাগরগণের সিংহল গিয়া বাণিজ্য করিবার বর্ণনা আছে, তাহাদিগকে সম্ভবতঃ এই অঞ্চল হইতে সংগ্রহ করা হইত।[২২]
পশর নদী দিয়া উত্তরমুখে আসিলে দেখা যায়, ‘নন্দবালা’ ও ‘কুমুদবালা’ নামক দুইটি খাল পশর হইতে উঠিয়া সেলা নদীতে পড়িয়াছে। ঐ নন্দবালার উত্তরপারে ২৪৮ নং লাটে এক জঙ্গলের মধ্যে বকুলবৃক্ষ-বেষ্টিত পুকুর রহিয়াছে। আরও উত্তর মুখে আসিলে একস্থানে ভদ্র ও পশরের মধ্যস্থানে ২২৬ নং লাটে করমজলীর খাস জঙ্গলে পশরের পশ্চিম পারে, রাস্তার চিহ্ন, পুকুর, বাড়ীর ভগ্নাবশেষ এবং ভগ্ন দেওয়াল প্রভৃতি পাওয়া গিয়াছে। করমজলীর উত্তরে ২২৫ নং লাটে লাউডোব আবাদ। এখানে জমি বন্দোবস্ত ও রীতিমত বসতি হইতেছে। পশর হইতে ‘লাউডোবের খাল’ পশ্চিমমুখে গিয়াছে; ঐ খাল হইতে যে আর একটি খাল উত্তরবাহী হইয়াছে, তাহার নাম ‘কালিকাবাড়ীর খাল।’ এই কালিকাবাড়ীর খালের পার্শ্বে বর্ত্তমান সময় শ্রীহরিচরণ দে নামক এক প্রজার জমির উত্তরে প্রকাণ্ড ইষ্টকস্তূপ পাওয়া গিয়াছে। এখানে কোন কালীবাড়ী ছিল বলিয়া বোধ হয়; তদনুসারে সম্ভবতঃ খালের নাম হইয়াছে। কালীবাড়ী এ অঞ্চলে আরও অনেক আছে; তন্মধ্যে ডাক্রার কালীবাড়ী প্রসিদ্ধ। ইহা রামপালের দক্ষিণ-পূর্ব্ব কোণে কুমারখালি নদীর উপর অবস্থিত। এখনও বহু দূরবর্তী স্থান হইতে লোকে এই সুন্দরবনের কালীবাড়ীতে পূজা দিতে আসে এবং এখানকার মাহাত্ম্য সম্বন্ধে অনেক গল্পকথা প্রচলিত আছে। কতকাল পূর্ব্বে কাহার দ্বারা এই পূজার স্থান ও মন্দিরাদি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহা জানা যায় না। পশ্চিমদিকে কপোতাক্ষের কূলে কপিলমুনি নামক স্থানে অনেক প্রাচীন নিদর্শন আছে। এখানে একটি পুকুর কাটিতে যে কয়েকটি প্রস্তরময়ী মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল তন্মধ্যে দুইটি এক্ষণে নিকটবর্ত্তী প্রতাপকাটি গ্রামে রসিকলাল হালদার মহাশয়ের বাটীতে পূজিত হইতেছেন। এ দুইটি বৌদ্ধমূর্তি, কিন্তু এক্ষণে বিষ্ণু ও ব্ৰহ্মা বলিয়া পূজিত হন। আরও দক্ষিণে কপোতাক্ষের কূলে প্রসিদ্ধ আমাদি গ্রাম। এখানে এক ‘পরীমালা’ দেবী আছেন। আমাদির দক্ষিণেই সুন্দরবন। কয়ড়ানদীর অপর পারে নারায়ণপুর নামক স্থানে বহুকাল পূর্ব্বে মৃত্তিকার নিম্নে এক প্রস্তরময়ী দেবীমূর্ত্তি পাওয়া যায়। এটি চতুর্ভূজা চামুণ্ডামূৰ্ত্তি। এখনও ইহার নিত্য পূজা হয়। আমাদিগ্রামে ‘কালিকা দীঘি’ নামে প্রকাণ্ড জলাশয় আছে। ইহার পরিমাণ ৮০০ হাত ×৭০০ হাত হইবে। দীঘিটি উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ; উহার উপর এরূপ ভাবে দামদল হইয়াছে যে, তাহার উপর দিয়া মানুষ ও গরু স্বচ্ছন্দে হাঁটিয়া যাইতে পারে। তথাপি পুকুরের জল অতি মিষ্ট এবং উহা এখনও তৎপ্রদেশের বহুলোকের জলকষ্ট নিবারণ করিতেছে। খুলনার পূর্ব্বভাগে রামপালের সন্নিকটে হুড়কা নামক স্থানে এইরূপ আর একটি সুপেয় সলিলপূর্ণ জলাশয় আছে। ইহাকে ‘ঝলম’লে দীঘি’ বলে। এ দীঘি কতকাল পূর্ব্বে কবে কাহার দ্বারা খনিত হইয়াছিল, তাহা জানা যায় না। ইহার জল কখনও শুকায় না এবং ইহাতে বিশেষ দামদল নাই। রামপালেও এক প্রকাণ্ড পুরাতন ‘রামপাল দীঘি’ আছে, উহা এক্ষণে খুলনা ডিষ্ট্রীক্ট বোর্ড কর্তৃক সংস্কৃত হইয়াছে। রামপাল ও আমাদি প্রভৃতি স্থান বহুদিন সুন্দরবনের গ্রাস হইতে জাগে নাই।
স্মরণখোলা ফরেষ্ট ষ্টেশনের সম্মুখে পশ্চিমদিকে মরা ভোলা নদীর উপর প্রাচীরবেষ্টিত একটি বাড়ী আছে; উহার ভগ্ন প্রাচীর এখনও দ্রষ্টব্য। চাঁদপাই ফরেষ্ট ষ্টেশনের দেড় মাইল দক্ষিণ-পূৰ্ব্বে সেলা নদী হইতে বহির্গত সোণামুখী খালের পার্শ্বে জঙ্গলের মধ্যে এখনও একটি সুস্পষ্ট ইটের পাঁজা বর্তমান রহিয়াছে। খুলনা জেলার পশ্চিমভাগে আশাশুনি পুলিশ ষ্টেশন। উহার পশ্চিমদিকে গুতিয়াখালি নদী, তাহার পশ্চিমপারে সাঁইহাটি গ্রাম। এস্থান পূর্ব্বে ভীষণ জঙ্গলাক্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিল, সম্প্রতি আবাদ হইয়াছে। জঙ্গলের পূর্ব্ব হইতে এখানে অনেকগুলি মন্দির ছিল; তন্মধ্যে তিনটি মন্দিরের ভগ্নাবশেষ এখনও আছে। ইহার মধ্যে পূর্ব্ব-প্রান্তে যেটি, তাহাই দণ্ডায়মান আছে। উহা নানা কারুকার্যখচিত সুন্দরমন্দির। সাঁইহাটি গ্রামের মধ্যে এক অংশের নাম উজিরপুর। সেখানে এখনও একটি প্রকাণ্ড ইষ্টকস্তূপ উজিরের বাড়ী বলিয়া খ্যাত।
এতক্ষণে আমি সুন্দরবনের প্রাচীন বসতিচিহ্নের সংক্ষিপ্ত বিবরণী শেষ করিলাম। ইহার অধিকাংশ স্বচক্ষে দেখিয়া লিখিয়াছি এবং কতকগুলি বিশ্বস্ত ও শিক্ষিত দর্শকের নিজের মুখের বিবরণী হইতে লিপিবদ্ধ করিয়াছি; অনেকস্থলে তাহাদিগকে উদ্যোগী করিয়া এসব বিষয় স্থিরভাবে দেখিবার জন্য প্রবর্তিত করিয়াছি। তত্ত্বানুসন্ধিৎসু পাঠক স্বচক্ষে দেখিলে ইহার সত্যতা উপলব্ধি করিতে পারিবেন। এই সকল বিবরণের সাক্ষ্য হইতে বোধ হয় স্বচ্ছন্দে অনুমান করিতে পারি যে, সুন্দরবন এক সময়ে মনুষ্যাবাসের উপযুক্ত ছিল; ইহার ভূমি তখন শস্যভারে হাস্যময়ী হইত; ইহার নগরীসমূহ হর্ম্যমন্দিরে সমৃদ্ধ এবং জনকোলাহলময় ছিল। অনেকবার সুন্দরবনের উত্থান পতন হইয়াছে; ইহা বৌদ্ধযুগের শেষভাগে পড়িয়াছিল এবং হিন্দুরাজত্বে পুনরায় জাগিয়াছিল; সেই হিন্দুর সময়ে পড়িয়াছিল, আবার পাঠানযুগে জাগিয়াছিল। পরে মোগলের মধ্যযুগে পড়িয়াছে, আর উঠে নাই। মোগল আমলের প্রথমভাগে পাশ্চাত্য যে সকল জাতি বাণিজ্যের জন্য এদেশে আসিয়াছিলেন, তাহারা সুন্দরবনকে এমন পতিত, অগম্য, হিংস্ৰসেবিত এবং অরণ্যাবৃত দেখেন নাই। তাঁহারা যাহা দেখিয়াছিলেন, এখন তাহার চিহ্নমাত্রও নাই। এমন আশ্চর্য্য পতন সুন্দরবনে ভিন্ন অন্য কোথাও হয় না।
১৮৬৮ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কলিকাতায় এসিয়াটিক সোসাইটির এক অধিবেশন হয়। উহাতে খুলনার রেণীসাহেবের মধ্যম পুত্র (H. J. Rainey) সুন্দরবন ও প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। তদনন্তর সভাপতি ঐ প্রবন্ধ সম্বন্ধে সকলের মতামত জিজ্ঞাসা করিলে, রেভারেণ্ড লং (Rev. J. Long) সাহেব বলিয়াছিলেন যে, ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দে তিনি যখন প্যারিস সহরে গিয়াছিলেন, তখন তথাকার বিখ্যাত রাজকীয় অনুসন্ধান-পরিষদের এক প্রধান পণ্ডিত ২৩ তাঁহাকে ভারতবর্ষের একখানি পর্তুগীজ মানচিত্র প্রদর্শন করেন। উহা তখন হইতে ২০০ বর্ষ পূর্ব্বে অর্থাৎ মোগল রাজত্বের মধ্যযুগে প্রস্তুত। ঐ মানচিত্রে সুন্দরবন সমুব্বর দেশ ও তাহাতে পাঁচটি নগরী প্রদর্শিত হইয়াছে। ব্যারোস (De Barros) প্রণীত এসিয়ার ইতিবৃত্তে সংলগ্ন ম্যাপ এবং ভ্যানডেন ব্রুকের ম্যাপ হইতেও তাহাই প্রতিপন্ন হয়। এই সকল ম্যাপ হইতে জানা যায় যে, সুন্দরবনের সমুদ্রকূলে প্যাকাকুলি (Pacaculi), কুইপিটাভাজ (Cuipitavaz), নলদী (Noldy), ডাপারা (Dapara) এবং টিপারিয়া (Tiparia) নামক পাঁচটি প্রসিদ্ধ বন্দর ছিল, তাহা এক্ষণে নাই। যদিও ব্লকম্যান সাহেব, এই সকল ম্যাপে কিছুই প্রতিপন্ন করে না বলিয়া উড়াইয়া দিয়াছেন,[২৪] তবুও আমার তাঁহার পন্থানুসরণ করিতে সম্মত নাহি। যাঁহারা মানচিত্র প্রস্তুত করেন, তাঁহারা কোন স্থানের নামের প্রকৃত উচ্চারণ ভুল করিতে পারেন, কিন্তু তাঁহারা কাল্পনিক কতকগুলি স্থান বসাইয়া দিতে পারেন, এরূপ বিশ্বাস করিতে পারি না। আমরা অনুমান করি সুন্দরবনে এমন অনেক সহর ছিল, তন্মধ্যে পর্তুগীজ আমলে যে পাঁচটি সমধিক খ্যাতিলাভ করিয়াছিল, ঐ সকল ম্যাপে তাহারই উল্লেখ আছে।[২৫]
ব্লকম্যান সাহেবের উক্তির প্রতিবাদ করিতে হইলে, দেখান উচিত যে এই কয়েকটি সহ কোথায় ছিল এবং ইহাদের প্রকৃত নাম কি। গ্রীক ও পর্তুগীজ প্রভৃতি বৈদেশিকগণ এদেশীয় স্থানের নামকে এত বিকৃত করিয়াছেন যে, তাঁহাদের বর্ণনা দেখিয়া সহজে কোন প্রকৃত স্থান নির্দ্দেশ করা দুষ্কর হইয়া পড়ে। প্যাকাকুলি বা পেঁচাকুলি একই কথা; পেঁচাকুলি চব্বিশ পরগণা জেলার চব্বিশটি পরগণার মধ্যে অন্যতম।
১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে এই পরগণাগুলি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি নবাব মীরজাফর খাঁর নিকট হইতে জমিদারীস্বরূপ প্রাপ্ত হন। মীরজাফরের প্রদত্ত সনন্দের অনুবাদের পেঁচকুলি ইংরাজীতে বিকৃত হইয়া Patcha kolla হইয়াছে।[২৬] পেঁচকুলি পরগণা প্রথমতঃ সেলিমাবাদ সরকারের অন্তর্গত ছিল। মীরজাফরের প্রদত্ত পরগণার পরোয়াণা একবৎসর পরে বাদশাহের সনন্দে পরিণত হয়; তদনুসারে কোম্পানি যে সাতাইশ মহল পাইয়াছিলেন, তাহাতে পেঁচকুলির উল্লেখ আছে।[২৭] বর্তমানে এই পেঁচকুলি ডায়মণ্ডহারবার সাব্ডিভিসনের অধীন। ইহার মধ্যে প্রধান প্রধান স্থান চাঁদপাল, রাজারামপুর, ফলতা প্রভৃতি,[২৮]; ফলতা ভাগীরথীর উপর, ইহা ইংরাজ আমলেও একটি প্রধান স্থান হইয়াছিল। ইহাই সম্ভবতঃ পূৰ্ব্বকালে পেঁচাকুলি ছিল।
কুইপিটা-ভাজ যে খলিফাতাবাদ তাহাতে সন্দেহ নাই।[২৯] খলিফাত হইতে কুইপিট এবং আবাদ হইতে ‘আভাজ’ হইয়াছে। ভ্যানডেন ব্রুকের[৩০] কুইপিটাভাজ, পাঠান আমলের খালিফাতাবাদ ও বর্তমান বাগেরহাট একই স্থান বুঝাইতেছে। সমুদ্র হইতে উঠিয়া গেলে জনপদের সীমান্তে এই স্থান এক কালে পাঠানদিগের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। খাঁ জাহান আলির ইতিহাসে খলিফাতাবাদের বিশেষ বিবরণ প্রদত্ত হইবে।
মেঘনার মোহানায় দক্ষিণ সাহাবাজপুর এক্ষণে যেরূপ দক্ষিণে ও পশ্চিমে বহুদূর বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছে, পূর্ব্বে এরূপ ছিল না। রেণেল, মার্টিন ও রিচার্ডস্ সাহেবদিগের জরিপে ১৭৬৪ হইতে ১৭৭২ খৃষ্টাব্দের মধ্যে যে ম্যাপ হইয়াছিল,[৩১] তাহাতে দক্ষিণ সাহবাজপুর একটি দ্বীপ মাত্র ও উহার পশ্চিম দিকেও মেঘনা নদী প্রবাহিত ছিল। মেঘনা হইতে একটি ক্ষুদ্র শাখা পশ্চিমোত্তর মুখে বহিয়া পুনরায় মেঘনায় পড়িয়াছিল। মেঘনার এই অংশ পরে তেতুলিয়া নদী নাম ধারণ করিয়াছে এবং উক্ত শাখা কালুয়া নদী হইয়াছে। মেঘনা ও হরিণঘাটা মোহানার মধ্যে রাবণাবাদ বা গলাচিপা নামক একটি নদী সমুদ্রে পড়িয়াছে; এই রাবণাবাদ ও মেঘনার মধ্যবর্তী অংশ রাবণাবাদ নামে খ্যাত; ইহা চতুৰ্দ্দিকে নদী বেষ্টিত একটি দ্বীপ। রেণেলের ম্যাপে রাবণাবাদের ও হরিণঘাটার মধ্যবর্ত্তী সমস্ত প্রদেশ ‘মগদিগের দ্বারা উৎসন্ন’ বলিয়া লিখিত আছে। এই রাবণাবাদে দুইটি মৃন্ময় দুর্গ ও নানা ভগ্নাবশেষ ছিল। উহার চিহ্ন এখন নাই।[৩২] ঐ রাবণাবাদের উত্তর সীমায় কালুয়া নদীর দক্ষিণ কূলে দাসপাড়া (Duspara) নামক একটি সহর ছিল। উপরোক্ত ম্যাপে উহার বিশেষ উল্লেখ আছে। ইহাই পৰ্টুগীজ ডাপাড়া (Dapara) সহর। ইহা দাসপাড়া বা দেবপাড়া এইরূপ কোন নামের অপভ্রংশ হইবে।
অপর দুইটি নগরী সম্বন্ধে অনুমান ভিন্ন অন্যোপায় নাই। নলদী সম্ভবতঃ বৰ্ত্তমান নলুয়া বা নলদিয়া হইতে পারে। ইহা উত্তর হাতিয়াগড়ে মথুরাপুরের সন্নিকটে নলুয়া নদীর উপর। এখনও কলিকাতা হইতে দক্ষিণদেশীয় আবাদে যাইতে হইলে, মগরাহাট ষ্টেশন হইতে জয়নগর দিয়া নলুয়ায় পৌঁছিতে হয়, তথা হইতে নৌকাযোগে নানাদিকে যাওয়া যায়। নলুয়ার সন্নিকটে মণির টাট ও নলগড়া আবাদ; এইস্থানে এক প্রাচীন দুর্গের কিছু কিছু ভগ্নাবশেষ পাওয়া যায়; এই দুর্গের দক্ষিণ প্রান্তেই বিখ্যাত জটার দেউল।৩৩ তদ্বিষয় পূৰ্ব্বে বলা হইয়াছে। এ প্রদেশে ঠাকুরাণী নদীর সন্নিকটে প্রাচীনকালে কোন বিখ্যাত স্থান ছিল, তাহা সহজে অনুমান করা যায়। টিপুরিয়া সহর ত্রিপুরার বিকৃত নাম বলিয়া বোধ হয়। সুন্দরবন পদ্মা-মেঘনা পার হইয়া চট্টগ্রাম পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
পাদটীকা
১. Blochmann, H. Geography and History of Bengal, J. A. S. B. 1873, P. 231.
২. ‘I do not believe that the gloomy Sundarbans or the seaface of Jessore and Bakarganj were ever well peopled or the sites of cities.’ — History of Bakarganj, pp. 169-80 [J. A. S. B. vol. XLV pt. 1, 1876, P. 76–শি মি]
৩. ‘Were the Sunderbans inhabited in ancient times? ‘ – An article by H. Beveridge originally pub- lished in J. A. S. B. vol. XLV (Pt. 1, PP. 71-76–শি মি] 1876, and afterwards incorporated in his History of Bakarganj, pp. 169-80.
৪. Histoire Des Indes orientales, by Peirre Du Jarric, 1610. এই পুস্তকের ৩২তম অধ্যায়ে সন্দ্বীপের বিবরণ আছে। উহার অনুবাদের জন্য নিখিলনাথ রায়ের ‘প্রতাপাদিত্য’, ৪৪৯ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
৫. যদুনাথ সরকার, ‘শোণদ্বীপের বিবরণ’- ‘নবনুর’ পত্রিকা, মাঘ, ১৩১২।
৬. Noakhali District Gazetteer.
৭. ‘গৌড়দেশং পরিত্যজ্য জ্গাম সমুদ্রকূলং
তস্থাবত্র নবোত্থিতং সমুদ্রকূলসঞ্জাতং
দ্বীপমেকং সুবিস্তৃতং নানাবৃক্ষোপশোভিতম্।’—বটুভট্টকৃত অপ্রকাশিত ‘দেব-বংশ’ পুঁথি।
৮. J. A. S. B.,1868.
৯. কবিকঙ্কণ চণ্ডী, ২০২ পৃ (এলাহাবাদ সংস্করণ)।
১০. সুন্দরবন জরিপ করিয়া ইংরাজ আমলে যে ম্যাপ প্রস্তুত করা হয়, তাহাতে উহাকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করিয়া, এক একটি অংশে এক একটি নম্বর দেওয়া হইয়াছে। এই অংশকে Lot বা লাট বলে। সুন্দরবনের ম্যাপে এই লাট নম্বর আছে।
১১. ২য় খণ্ড, মোগল আমল, ১৯শ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
১২. যে পুকুরের খাতের চতুঃপার্শ্ব ইষ্টকপ্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত, তাহাকে পোস্তবাঁধা পুকুর বলে।
১৩. Proceedings of the Asiatic Society of Bengal for December, 1868.
১৪. Introduction to Sandhyakara Nandi’s Ramcarita, by Hara Prasad Sastri-Memoir of the Asiatic Society, vol. III. no 1, P. 14. [এই প্রসঙ্গে পরিশিষ্ট (গ) দ্রষ্টব্য- শি মি
১৫. ডামরেলীর মন্দির এবং কালীগঞ্জ হইতে ধূমঘাট দুর্গ পর্য্যন্ত প্রতাপাদিত্যের যে অসংখ্য কীৰ্ত্তিচিহ্ন এখনও বর্ত্তমান আছে, তাহার বিশেষ বিবরণ প্রতাপাদিত্য প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য (২য় খণ্ড, মোগল আমল, ৯ম পরিচ্ছেদ)।
১৬. যে খালের দুইদিক্ হইতে জোয়ার-ভাটা হয়, তাহাকে দোয়ানিয়া খাল বলে।
১৭. ২য় খণ্ড, মোগল আমল, ১৯শ পরিচ্ছেদ
১৮. Havell’s Indian Architecture, pp. 52 56 : ‘The Bengali builders being brick-layers rather than stone-masons, had learnt to use the radiating arch whenever useful for constructive purposes, long before the Mahomedans came there.’
১৯. এ মন্দিরের ফটো এই প্রথম প্রকাশিত হইতেছে। আমাদের মন্দির দর্শনের সংবাদ পাওয়ার পর খুলনার তদানীন্তন প্রত্নতত্ত্ববিৎ ম্যাজিষ্ট্রেট ব্রাডলীবার্ট মহোদয় এই মন্দির দেখিতে যান। কিন্তু তিনি যে ফটো লইয়াছিলেন, তাহা ব্যর্থ হয়। অবশেষে তিনি আমার নিকট হইতে একখানি ফটো লইয়াছিলেন। এ পর্যন্ত তিনি তাহার কোন সদ্ব্যবহার করিয়াছেন কি না, জানি না।
২০. একজন বড় দোকানদারের নাম শ্রীনিকুঞ্জবিহারী সাহা, সাং কোলা দিগলিয়া, যশোহর। এই নদীর মধ্যে ও কূলে নৌকা ও গৃহগুলি চট্টগ্রাম সন্দ্বীপ প্রভৃতির প্রথাক্রমে বাঁশের খোলার ছাওয়া। সেগুলি দেখিতে অতি সুন্দর।
২১. Five ‘lost towns’ on the maps of De Barros [Jao de Barros-ff] in his Da Asia-Blaeve and Van den Broucke.
২২. ‘কান্দেরে বাঙ্গাল সব বাফোই বাফোই’—কবিকঙ্কণ চণ্ডী।
২৩. ‘Monsieur Jomard, the head of the Geographical Department of the Bibliotheque Royale.’
২৪. ‘The old portuguese and Dutch maps prove nothing’-Geography and History of Bengal, J. A. S. B. vol. XLII, 1873, P. 231.
২৫.. N. Sauson কৃত ১৬৫২ অব্দের ম্যাপে এই পাঁচটি সহরের ২/১টির উল্লেখ আছে। সে ম্যাপের প্রতিলিপির জন্য পুস্তকের শেষে পরিশিষ্টি (ক) দ্রষ্টব্য।
২৬. Collecion of Treaties &c. (1812)
২৭. Fifth Report from the Select Committee of the House of Commons.
২৮. ঐতিহাসিক চিত্র, চৈত্র, ১৩৩১ সাল, ৩৫২ পৃ।
২৯. Khulna Gazetteer, P. 29.
৩০. Van Den Broucke’s Map of 1660.
৩১. ‘Map of the provinces of Krishenagar, Jesore, Boosnah and Mahmudshahi with part of Dacca and Raujeshy surveyed by Rennel, Martin and Richards between the years 1764 and 1772’ attached to colonel Gastrell’s Geographical and Statistical Report of Jessore, Fureedpore and Backerganj.
৩২. ‘The mud forts entered on Rennel’s map on the banks of the Rabanabad or Gallachipa River do not exist now-a-days; nor would we glean any information regarding them.’-Colonel Gastrell’s Report, P. 265.
৩৩. ২য় খণ্ড, মোগল আমল, ১৯শ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন