সতীশচন্দ্র মিত্র
উপবঙ্গ যে সকল দ্বীপ লইয়া গঠিত হইয়াছিল, উহারা লোকের বসতিহেতু ক্রমে নানা গ্রামে বিভিক্ত হইয়া পড়ে। ঐ সকল নামের সহিত দেশের সাধারণ প্রকৃতির একটা ইতিহাস প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করিলে আমরা দেখিতে পাই, এই যশোহর ও খুলনার গ্রামসমূহের নামের পূর্ব্বে বা পরে কতকগুলি পরিচয়াত্মক শব্দ আছে। উহাদের মধ্যে বিশিষ্টগুলিকে আমরা এইভাবে সাজাইয়া রাখিতে পারি, যথা : দোহা, ঘোনা, মোহানা, খালি, ডাঙ্গা, কূল, দাঁড়ী, ঘাটা, দিয়া, দহ, চর, চক, বুনিয়া, কাটি, আবাদ, পোল, কোল, মারা, খোলা, খাদা, গাতি, মহল, তলা, তলী, গাছা, গাছি, গ্রাম, পুর, নগর, ঘর, বাড়ী, বাড়িয়া, পাড়া, পাশা, ভোগ, কুণ্ড, হাট, হাটি, খানা, কসবা, গঞ্জ। বোধ হয়, এই দুই জেলার চৌদ্দ আনা গ্রামের শেষে ইহাদের কোন না কোন শব্দ আছে। তাহা হইতে ঐ সকল স্থানের পূর্ব্বাবস্থার আভাস পাইবার সুবিধা হয়।
এতদঞ্চল প্রথমতঃ জলে মগ্ন ছিল; পরে ভূমি গঠন হইতে থাকে; নবোথিত ভূমিভাগ চিহ্নিত করিতে কোন দোহা বা আবর্ত্ত, ঘোনা বা নদীর বাঁক এবং মোহানার নিদর্শনে স্থানের নাম হইতে থাকে। সারদোহা, গৌরীঘোনা, মাগুরাঘোনা, ত্রিমোহন প্রভৃতি নামের ইহাই উৎপত্তির কারণ হইতে পারে। যখন দ্বীপ জাগিয়া উঠিতে লাগিল, তখন সেই চর সকল মধ্যবর্তী জলভাগ অর্থাৎ গাঙ্গ বা খালের নামে পরিচিত হইল; যেমন দ্বিগঙ্গা, গাঙ্গনী, চাঁদখালি, গদখালি, খালিসাখালি প্রভৃতি। যখন নদীর কূলে উচ্চজমি বা ডাঙ্গা জমিল, তখন ‘ডাঙ্গা’ দিয়া অসংখ্য গ্রামের নাম হইতে লাগিল; যেমন নলডাঙ্গা, গোবরডাঙ্গা, ব্রাহ্মণডাঙ্গা। যখন দ্বীপ পরিষ্কার হইয়া উঠিল, তখন ‘দিয়া’ ও ‘দহ’ দ্বারা নাম চলিল; যথা, রাঙ্গদিয়া, ধানদিয়া, ঝিনাইদহ, বাঁশদহ। যেখানে দুই দিকে জলের ভিতর চরের উপর লোকের বাড়ী হইল, তখন সে স্থানের নাম হইল দিয়াড়া। এ দুই জেলায় অনেকগুলি দিয়াড়া আছে। চরসকল বিভিন্ন চক বা অংশে বিভক্ত হইয়া, লোকের করায়ত্ত হইতে লাগিল, তখন ‘চর’ ও ‘চক’ গ্রামের নামে গ্রন্থিত হইয়া রহিল; যেমন, চরকাটি, বকচর, চাকদহ, চকশ্রী (চাকসিরি)। ক্রমে স্থানে স্থানে জমিতে জঙ্গল জমিয়া ‘বুনিয়া’ হইতে লাগিল; যথা, বুজবুনিয়া, তালবুনিয়া। এই জঙ্গল কাটিয়া লোকে যখন আবাদ করিতে লাগিল; তখন ‘কাটি’ ও ‘আবাদের’ ছড়াছড়ি হইল; মামুদকাটি, কাটিপাড়া, চূড়ামণকাটি। খুলনা ছাড়াইলে বরিশাল জেলায় প্রধান প্রধান স্থানের নাম অধিকাংশই কাটি সংযুক্ত। রায়েরকাটি, ঝালকাটি, সিদ্ধকাটি, কাটির আর অবধি নাই। যাহারা কোনস্থানে প্রথমে ‘কাটির আবাদ’ করিয়া অর্থাৎ জঙ্গল কাটিয়া বসতি পত্তন করিয়াছিল, তাহাদিগকে সাধারণ কথায় ‘কাটিকাটা বাসিন্দা’ বলে। এই সকল লোকের চেষ্টায় ইমাদাবাদ, আমীরাবাদ, নয়াবাদ, প্রভৃতি অসংখ্য বনভূমি আবাদ হইল এবং আবাদসকল বাঁধবন্দী হইয়া শস্যক্ষেত্রে পরিগণিত হইতে লাগিল। তখন বেণাপোল, আলতাপোল, শ্রীকোল, বালিখোলা প্রভৃতি কত স্থান হইল। শস্যক্ষেত্র সকল নানা জনের নানা নামে ‘গাতি’ ও ‘মহলে’ বিভক্ত হইয়া নানা প্রকারে তলা, তলী, গাছা, গাছি প্রভৃতিতে চিহ্নিত হইতে লাগিল। বুনাগাতি, আইচগাতি, সিংহগাতি, চন্দনীমহল, ফুলতলা, বাঁশতলী, চৌগাছা কলাগাছি প্রভৃতি। সঙ্গে সঙ্গে পল্লীনির্মাণের সাধারণ পদ্ধতি অনুযায়ী, পুর, নগর, গ্রাম, ঘর, বাড়ী, বাড়িয়া, পাড়া, পাশা প্রভৃতি যোগ হইয়া খুলনা-যশোহরের প্রায় অর্দ্ধেক গ্রাম বিজ্ঞাপিত হইল। সত্রাজিৎপুর, দৌলতপুর, মহেশপুর, বিষ্ণুপুর, জয়নগর, নুরনগর, বনগ্রাম, পয়গ্রাম, মূলঘর, তেঘরিয়া, কচুবাড়িয়া, সোণাবাড়িয়া, লক্ষ্মীপাশা, মহেশ্বরপাশা, চাঁদপাড়া, কাড়াপাড়া, নওয়াপাড়া প্রভৃতি বিখ্যাত গ্রামের আদিম উৎপত্তি এইভাবে। বসতির সহিত বিপণির প্রয়োজন; হিন্দুর হট্ট বা হাট, মুসলমানের ‘বাজার’ এবং বৈদেশিকের গঞ্জ ও আড়ংএ পরিণত হইল। বাগেরহাট, নহাটা, সেখহাটি, সেনহাটি, বারবাজার, সেনের বাজার, কালীগঞ্জ, মোরেলগঞ্জ, হেঙ্কেলগঞ্জ, আড়ংঘাটা ও আড়ংগাছা প্রভৃতি স্থান ইহারই পরিচয়স্বরূপ। এইরূপভাবে যশোহর ও খুলনার প্রায় গ্রামগুলির নাম লইয়া পৰ্য্যালোচনা করিলে, দেশের প্রকৃতির কতকটা জ্ঞান হইতে পারে। যে পর্যায়ে পর পর কতকগুলি গ্রামের দৃষ্টান্ত দেওয়া গেল, সেরূপভাবে একটির পর একটির উৎপত্তি না হইতেও পারে; তবে গ্রামের নামের মধ্যে দৈশিক অবস্থার যে একটা সজীব ইতিহাস প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে, এইরূপ আলোচনা হইতে তাহারই কতকটা আভাস পাওয়া যাইতে পারে। সুতরাং গ্রামগুলির এইরূপ সাধারণ আলোচনাকে আমরা দেশের প্রাকৃতিক অবস্থা নির্ণয়ের প্রথম পন্থা ধরিতে পারি।
দ্বিতীয়তঃ, যশোহর ও খুলনার গ্রামগুলির কতকটা তুলনা করিলে উহাদের পূৰ্ব্বতন অবস্থা সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য পাই। ‘ডাঙ্গা’ সংযুক্ত গ্রামের নাম যশোহরে ২২৬ খানি এবং খুলনায় ১২১ খানি হইবে। ইহা হইতে একটি অনুমান করা যায়। প্রথমে যখন জল হইতে জমি উঠিতেছিল, তখন বহুস্থান ‘ডাঙ্গা’ হইয়া গেল; প্রথমে উত্তরদিকে অর্থাৎ যশোহরে ‘ডাঙ্গা’ হইল, লোকে প্রথমতঃ যশোহরের দিকে বসতি আরম্ভ করিল। ক্রমে খুলনা অঞ্চলেও ডাঙ্গা হইল, কিন্তু বসতি তেমন হইল না সুতরাং সেদিকে ডাঙ্গা উঠিয়া বহুকাল পড়িয়া থাকিয়া অবশেষে জঙ্গলে পরিণত হইয়া গেল। যে সব স্থানে বসতি হইল না, সে সকল স্থানের ডাঙ্গা নাম থাকিল না। খুলনায় শেষে জঙ্গল কাটিয়া বাসভূমি প্রস্তুত হইল। এজন্য যশোর অপেক্ষা খুলনায় ‘কাটি’ যুক্ত গ্রাম অধিক। যশোহরে ২১ খানি ও খুলনায় ৬৯ খানি গ্রামে ‘কাটি’ আছে এবং ক্রমে যেমন সুন্দরবন আবাদ হইতেছে, ততই কাটির সংখ্যা আরও বাড়িবে। এইরূপে খুলনায় যত গ্রামে ‘বুনিয়া’ আছে, যশোহরে তত নাই। যশোহরে দিয়াড়া একটি আছে, খুলনায় অন্যূন ৫টি।
তৃতীয়তঃ, যে দেশ দ্বীপাকারে জল হইতে উত্থিত হয় এবং যে দেশের চতুর্দ্দিকে নদী, খাল পরিবেষ্টিত থাকে, সে দেশে যথেষ্ট পরিমাণ মৎস্য পাওয়া যায় এবং দেশের অধিবাসিগণেরও মৎস্য একটি প্রধান খাদ্যোপকরণ হয়। এই জন্য সে দেশে কালে মৎস্যের নামে বহুসংখ্যক গ্রামের নাম হয়। যশোহর-খুলনায়ও তাহাই হইয়াছে। যেমন যশোহর জেলায় ইলিশমারি, ইচাখাদা, ইচাখোলা, কইখালি, কাতলাকর, খলিসাখালি, চাঁদা, চেঙ্গা, চিংড়া, টাকিপুর, টেঙ্গরা, টেঙ্গরালি, পুঁটিমারি, পুঁটিয়া, বাকেমারি, বাট্ কেডাঙ্গা, বোয়ালিয়া ভেটকিয়া, মাগুরা, মাগুরাডাঙ্গা, মাগুরখালি, রুইজানি, শলুয়া, শৈলকূপা, শৈলমারি, সিঙ্গা, সিঙ্গি প্রভৃতি। এবং খুলনা জেলায় ইলিশপুর, কইখালি, কাইনমারি, কাতলা, খলিসাখালি, খলসী, গজালমারি, গজালিয়া, গাগড়ামারি, চাঁদা, চিতলমারি, চিংড়া, চিংড়াখালি, টাকি, টাকিপুর, টাকিমারি, টেঙ্গরা, টেঙ্গরাখালি, পুঁটি, পুঁটিখালি, পুঁটিমারি, বাইনতলা, বাটকেমারি, বোয়াইলমারি, বোয়ালিয়া, মাছখোলা, মাগুরা, মাগুরাডাঙ্গা, শৈলমারি, সিঙ্গা প্রভৃতি। ইহার অধিকাংশে এক নামে ২/৩টি বা ততোধিক গ্রাম আছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যাইতে পারে, খলিসাখালি যশোহরে ৭টি এবং খুলনায় ৪টি আছে, বোয়ালিয়া যশোহরে ৬টি ও খুলনায় ৪টি, মাগুরা, যশোহরে ৮টি ও খুলনায় ৪টি, টেঙ্গরা মাছের নামে যশোহরে ৫টি ও খুলনায় ৬টি, সিঙ্গা যশোহরে ১৫টি এবং খুলনায় ২টি আছে। যশোহরে এক নামে অধিকতর গ্রামের নাম আছে, খুলনায় অধিকতর জাতীয় মৎস্যের নামে গ্রামের নাম আছে। মোটের উপর এক এক জেলায় ৬০/৭০ খানি মৎস্যনামীয় গ্রাম আছে। যে সকল মৎস্য এই অঞ্চলে পাওয়া যায়, সেই সকল মৎস্যের মধ্যেই গ্রামের নাম আছে। কোন অপ্রাপ্য বা বৈদেশিক মৎস্যের নামে কোন গ্রামের নাম হয় নাই। যশোহর জেলার অধিকাংশ স্থলে মৎস্যের শুধু নাম মাত্র আছে, মৎস্যের পর্যাপ্ত আমদানী নাই। খুলনাই এক্ষণে উভয় জেলার মৎস্য সংস্থান করে বলিলে অত্যুক্তি হয় না। যশোহরে উচ্চ জমি বা ডাঙ্গা অধিক, খুলনায় খাল, বিল ও মৎস্য প্রচুর। কিন্তু রেলওয়ে ট্রেনের ব্যবস্থায় প্রচুর ও পৰ্য্যাপ্ত প্রভৃতি কথা দেশান্তরিত হইতেছে। গ্রামের নামের ইতিহাস অবিরত পরিবর্তিত হইতেছে, পুরাতন নাম উঠাইয়া কৃতী পুরুষ বা জমিদারের স্মৃতি গ্রামের গায়ে লিখিয়া রাখা হইতেছে। এইরূপ পরিবর্তনের ইতিহাস সঙ্কলন করা অতীব কঠিন ব্যাপার।
চতুর্থতঃ, জলমগ্ন দেশ যখন দ্বীপাকারে দেশে পরিণত হয়, তখন তাহার আর একটি প্রকৃতি এই যে, উহার সভ্যতা নদীপথেই বাহিত হয়। বিস্তৃত জলরাশির মধ্যে দ্বীপ উৎপন্ন হইলে, মধ্যে মধ্যে বড় বড় নদী খাল রহিয়া যায়। ক্রমে এই সকল নদীপথে পলি আসিয়া কূলভাগ উন্নত ও সমুর্ঝর করে এবং সেই সকল নদীর কূলে উচ্চ শুষ্ক উর্ব্বর জমি পাইয়া লোকে বসতি করিয়া গ্রাম প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল। এই দুই জেলার প্রাকৃতিক বিবরণে পূর্ব্বে তাহার আলোচনা করা হইয়াছে। মনোযোগ সহকারে দেখিলে আমরা দেখিতে পাই, পশ্চিমে যমুনা-ইচ্ছামতী, মধ্যস্থলে দক্ষিণমুখী কপোতাক্ষ পূৰ্ব্বমুখী ভৈরব, উত্তরভাগে নবগঙ্গা-চিত্রা এবং পূৰ্ব্বসীমায় মধুমতী—এই পাঁচটি নদীই এই উভয় জেলার সভ্যতা ও প্রতিভার বিকাশপথ। কি রাজনৈতিক প্রাধান্য, কি সামাজিক প্রতিপত্তি, কি ধর্ম্মভাবের উন্মেষ বা বিদ্যার গৌরব—যে ভাবেই ধরা যায়, এই পাঁচটি নদীই অতি প্রাচীন যুগ হইতে এদেশের যাহা কিছু উন্নতি বা সমৃদ্ধির প্রকৃত কারণ। প্রতাপাদিত্য, সীতারাম, খাজাহান আলি, সত্রাজিৎ বা মুকুটরায় সকলেই এই নদীর কূলেই ক্রীড়াক্ষেত্র করিয়াছিলেন; কুশদ্বীপ, যশোহর, কুমিরা, বাঘুটিয়া, জঙ্গলবাধাল, সেনহাটি বা সেখহাটি, লক্ষ্মীপাশা, সিঙ্গিয়া, বা সত্রাজিৎপুর, ইতিনা বা মল্লিকপুর— উচ্চজাতীয় ব্যক্তিবর্গের প্রধান প্রধান সমাজকেন্দ্ৰ, এই কয়েকটি নদীর কূলে অবস্থিত। এই কয়েকটি নদীর কূলেই পণ্ডিতের সমাজ, সাধকের লীলাক্ষেত্র, বিদ্বানের লীলাস্থল এবং কবির জন্মভূমি। নদীই এদেশের আদিম অধিবাসের চিহ্নস্বরূপ, নদীই এদেশের উন্নতির মূলীভূত এবং নদীর পতনই এদেশের অধঃপতনের কারণ।
পঞ্চমতঃ, নদীমাতৃক দেশের অধিবাসীর পূর্ণ প্রকৃতিই যশোহর-খুলনার লোকের চরিত্রে দেখা যায়, আচার ব্যবহার ও কর্মজীবনে প্রতিফলিত হয়। এ অঞ্চলের লোক একটু অধিক মৎস্যাশী, তাহারা মৎস্য ধরিতে, প্রত্যহ একাধিকবার স্নান করিতে, সন্তরণ করিতে সাধারণতঃ সুদক্ষ। নৌকাযানের মত যান নাই, ইহা এদেশে একটি সাধারণ প্রবাদবাক্য। অন্য দেশের লোকে ইহার মর্ম্ম তেমন বুঝে না; কিন্তু এখানে লোকে সুবিধা পাইলেই নৌকায় ভ্রমণ করিতে ভালবাসে। নানাবিধ নৌকা গঠনে, তরঙ্গসঙ্কুল নদীবক্ষে নৌকাচালনে, সাধারণ নাবিকতা ও নৌযুদ্ধে এদেশের লোকে বিশেষ পারদর্শী। পূৰ্ব্বকাল হইতে এতদ্দেশীয় বড় লোকেরা দুই একখানি সুন্দর নৌকা রাখিতে যত্নবান হন। এদেশে কতকগুলি যাযাবর জাতি আছে, তাহারা নৌকার মধ্যেই আপনাদের ঘরবাড়ীর ব্যবস্থা করিয়া নিত্য নূতন স্থানে যাতায়াত করে। এ অঞ্চলের লোকের ধারণা এই যে, যেখানে নদী নাই, সেখানে বাস করিতে নাই। লোকে সব ত্যাগ করিতে পারে, নদীর মায়া ত্যাগ করিতে পারে না। এই নদীমাতৃক দেশের অধিবাসীর নিকট নদী বড় প্রিয় বস্তু; দেশমাতৃকার স্তন্যধারারূপিণী নদী প্রবাসীর মনে কি আনন্দময়ী স্মৃতি জাগাইয়া তুলে, তাহা ‘যশোরে সাগরদাঁড়ী কপোতাক্ষ তীরে’ যাঁহার জন্মভূমি ছিল, সে বঙ্গকবিকুলশিরোমণি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ফ্রান্স হইত লিখিত পত্রে পরিচয় দেয় :
‘বহুদেশে দেখিয়াছি বহু নদদলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষা মিটে কার জলে?
দুগ্ধস্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে।’[১]
আমরা এতক্ষণে দেখিতে পাইলাম যে, যশোহর-খুলনা যে-ভূভাগের অন্তর্গত ইহাই গাঙ্গরাষ্ট্র বা গাঙ্গোপদ্বীপ। এদেশ গঙ্গাজলবাহিত হিমালয়ের গাত্রধৌত পলি হইতে উৎপন্ন। প্রথমে এস্থান সমুদ্রগর্ভস্থ ছিল; পরে গঙ্গার পলিতে যেমন দ্বীপ হইতে থাকে, সমুদ্রও তেমনি দক্ষিণে সরিয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গার সঙ্গমও দক্ষিণে সরিয়াছে। মধ্যবর্তী প্রদেশে প্রথমতঃ অসংখ্য দ্বীপের সমষ্টি ছিল, পরে উহার অনেকগুলি মিশিয়া, একত্র হইয়া, উন্নত হইয়া, এমন উব্বর হইয়াছিল যে জগতে তাহার তুলনা নাই।[২] এই সমুব্বর দেশে ক্রমে লোকের বসতি স্থাপিত হয়। প্রথমতঃ বাগদি প্রভৃতি নানা অনার্য্যজাতি এস্থানের অধিবাসী হয়।[৩] ক্রমে এদেশে আর্য্যজাতির আবির্ভাব হয়। সেই সময় হইতে আর্য্য সভ্যতার আরম্ভ হয়। সেই আর্য্য সভ্যতা এখনও চলিতেছে। গাঙ্গোপদ্বীপের এই দীর্ঘ জীবনকে সাতটি প্রধান যুগে বিভক্ত করা হয়। ১ম—মহাভারতীয় যুগ হইতে খৃঃ পূৰ্ব্ব তৃতীয় শতাব্দীতে অশোকের রাজত্বকাল পর্য্যন্ত আদি যুগ। ২য়—অশোকের সময় হইতে খৃষ্টীয় দশম শতাব্দী পর্যন্ত ১২/১৩ শত বৎসর জৈন-বৌদ্ধ যুগ। ৩য়—পরবর্ত্তী দুই শত বৎসর সেনরাজগণের হিন্দু যুগ। ৪র্থ—পরবর্ত্তী ৩০০ বৎসর পাঠান শাসন। ৫ম-৫০/60 বৎসরকাল বার ভূঞার আমল। ৬ষ্ঠ-পরবর্তী ১৫০ বৎসর মোগল রাজত্বকাল। ৭ম—বিগত দেড় শতাধিক বৎসর ইংরাজ শাসন। প্রথম যুগে আমাদের আলোচ্য যশোহর-খুলনা জেলা বকদ্বীপের অন্তর্গত ছিল; এই বকদ্বীপেরই নামান্তর উপবঙ্গ। বৌদ্ধযুগে তাহা সমতট আখ্যা পাইয়াছিল। ৩য় যুগে অর্থাৎ সেন-রাজত্বকালে উহাই বগড়ী নামে চিহ্নিত হয়।[৪] পাঠান যুগে যশোহর ও খুলনা মামুদাবাদ, ফতেহাবাদ ও খলিফাতাবাদ এই তিনটি সরকারের কতকাংশে লইয়া গঠিত ছিল। এই সময়ই দক্ষিণভাগে যশোর রাজ্য বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়। মোগল আমলে যশোর প্রথমতঃ একটি সামন্ত রাজ্য ও পরে স্বাধীন বলিয়া কীৰ্ত্তিত হয়। ইংরাজ- শাসনকালে এই যশোর রাজ্য ও উত্তরবর্ত্তী বিস্তৃত প্রদেশ লইয়া প্রথমতঃ যশোহর ডিভিসন ও পরে তাহা হইতে খণ্ডিত করিয়া যশোহর জেলা গঠিত হয়। আদি যুগে অতি অল্প স্থানেই লোকের বসতি স্থাপিত হয়। পরবর্ত্তী যুগের প্রথমার্দ্ধ পর্য্যন্ত এই অবস্থা চলে। খৃষ্টীয় প্রথম বা দ্বিতীয় শতাব্দীতে সুন্দরবন অঞ্চল দিয়া অবনমনাদি হইয়া দেশের ধ্বংস হইয়াছিল। পুনরায় ভূমি জাগিয়া সমতট হয় এবং উহাতে ৫/৬ শত বৎসর ধরিয়া যথেষ্ট বসতি ও দৈশিক প্রতিপত্তি স্থাপিত হয়। উহার পরেই সুন্দরবন অঞ্চলের একবার নিমজ্জন হয়, তাহাতে অনেক বৌদ্ধকীৰ্ত্তি বিলুপ্ত হয়। পুনরায় সেন-রাজত্বের প্রায় দুই শতাব্দী ধরিয়া আবার দেশের জাগ্রত অবস্থা হয়। এমন সময়ে পাঠান বিজয়ের পর হইতে নানাভাবে দেশের অবনতি সাধিত হইতে থাকে— তাহার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবন অঞ্চলের পুনরায় একটা অবনমন হয়। ইহাকে আমরা তৃতীয় অবনমন বলিতে পারি। চতুৰ্দ্দশ শতাব্দীর শেষভাগ হইতে পুনরায় দেশ উন্নত হইতে থাকে। এইবার উন্নত হইতে অনেক কাল লাগিয়াছিল। এই তৃতীয় অবনমনের পর খাঁজাহান আলি সুন্দরবন আবাদ করিয়াছিলেন। ক্রমে যখন দেশের একটা বিশিষ্ট উন্নত অবস্থা উপস্থিত হয়, তখনই বার-ভূঞার যুগ এবং প্রতাপাদিত্য প্রভৃতি বীরবৃন্দের অভ্যুদয়কাল। কিন্তু সেই অভ্যুদয়ের অব্যবহিত পরেই পুনরায় যশোররাজ্যের দক্ষিণাংশ বা সুন্দরবন ভাগ অবনমিত ও জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া পড়ে। উত্তর ভাগে এই উপদ্রব যায় নাই। পুনরায় অতি অল্প দিন হইতে সুন্দরবনের সেই দুরবস্থার পরিবর্তন হইতেছে। বর্তমান সময়ে উচ্চ রাজকর্মচারিগণ সুন্দরবন বিভাগ পরিমাপ ও পরীক্ষা করিয়া অনুমান করিতেছেন যে সগরদ্বীপ হইতে চট্টগ্রাম পৰ্য্যন্ত ব’দ্বীপের তীরভূমি সোজাভাবে ছিল। বরিশালের মধ্যভাগ হইতে পূৰ্ব্বদিকে তীরভূমি এক্ষণে যেরূপ ভাঙ্গা ভাঙ্গা দেখা যায়, উহা অপেক্ষাকৃত আধুনিক অবনমনের ফল। উক্ত অবনমনে উচ্চ ভূমি যেমন নিম্ন হইয়া গিয়াছিল, নিম্ন ভূমি খালে পরিণত হইয়াছিল। এই অবনমনের পর নানাস্থানে বিশেষতঃ ঢাকার দক্ষিণ ভাগে মধুপুর জঙ্গলে যে ভূমিগঠন হইয়াছিল তাহার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।[৫]
পাদটীকা :
১. রায় বাহাদুর দীননাথ সান্যাল মহাশয় এই চতুৰ্দ্দশপদী কবিতাটির সম্পূর্ণ অংশ প্রস্তরফলকে সুন্দরভাবে উৎকীর্ণ করাইয়া সাগরদাঁড়ীতে মাইকেলের বাটীর নিকট কপোতাক্ষকূলে প্রতিষ্ঠিত করিয়া বঙ্গবাসীর ধন্যবাদ- ভাজন হইয়াছে।
২. ‘The great chasm which divided the ancient Barendra and Rarh Divisions of Bengal, has thus grad- ually disappeared and in its place we have a rich alluvial tract which, as respects fertility, yields the palm to no other country on the face of the globe.’-Sen, Ram Snker. Agricultural Statistics of Jessore, P. 4.
৩. দ্বিমত থাকিলেও বহু নৃতত্ত্ববিদেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলেন যে, ভারতীয় জনসৌধের প্রথম স্তর নেগ্রিটো বা নিগ্রোবটুজন। তাহাদের অবশেষ প্রমাণসাপেক্ষ হইলেও একসময়ে বঙ্গদেশের স্থানে স্থানে সুবিস্তৃত ছিল। ‘রাজমহল পাহাড়ের বাগ্দীদের মধ্যে, সুন্দরবনের মৎস্যশিকারী নিম্নবর্ণের লোকদের মধ্যে, মৈমনসিংহ ও নিম্নবঙ্গের কোনও কোনও স্থানে ক্বচিৎ কখনও, বিশেষভাবে সমাজের নিম্নতম স্তরের লোকদের ভিতর, যশোর জেলার বাঁশফোড়দের মধ্যে মাঝে মাঝে যে কৃষ্ণাভ ঘনশ্যামবর্ণ, প্রায় উর্ণাবৎ কেশ, পুরু উল্টানো ঠোঁট, খৰ্ব্বকায়, অতি চ্যাপ্টা নাকের লোক দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা তো নিগ্রোবটু রক্তেরই ফল বলিয়া মনে হয়।’…পরবর্ত্তী স্তর হইল আদি-অস্ট্রেলীয় বা Proto-Australoid জনদের। নিম্নবর্ণের বাঙালীর ও বাংলার আদিম অধীবাসীদের ভিতর এই জনের (people) প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ‘বাংলাদেশের উচ্চবর্ণের ও উত্তম সংকরবর্ণের জনসাধারণের মধ্যে যে গোল ও মধ্যম মুণ্ডাকৃতি, তীক্ষ্ণ ও উন্নত এবং মধ্যম নাসাকৃতি ও মাধ্যমিক দেহদৈর্ঘ্যের লক্ষণ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা অনেকাংশে কিছু পরবর্ত্তীকালের অ্যালপাইন (Homo-Alpinus) নরগোষ্ঠীরই দান।’… ‘বস্তুত, বাংলাদেশের যে জন (people) ও সংস্কৃতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহার প্রায় সমগ্র মূল রূপায়ণই প্রধানত অ্যালপাইন ও আদিঅস্ট্রেলীয়, এই দুই জনের লোকদের কীর্তি। পরবর্ত্তীকালে আগত আর্য্যভাষাভাষী আদি-নাৰ্ডিক (Proto-Nordic) নরগোষ্ঠীর রক্তপ্রবাহ ও সংস্কৃতি তাহার উপরের স্তরের একটি ক্ষীণ প্রবাহ মাত্র।’—ডাঃ নীহাররঞ্জন রায়, “বাঙালীর ইতিহাস’ (১৩৫৬), ২৯-৫৫ পৃ।-শি মি
৪. মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, ৬৫-৫৬ পৃ।
৫. ‘There are indications that at one time the Delta face extended from somewhere near Saugor Island right across to the Chittagong coast, and that the break that occurs now from the middle of the Bakarganj District to that coast is caused by recent depression. The original surface has been depressed as time went on and many of the Khals that now exist were the lowest portions of the old land surface.’-Narrative Report Submitted to the Government of Bengal, by Major F. C. Hirst I. A., Director of Surveys, Bengal and Assam, under the Topographical Survey of the Khulna and 24-Parganas Sundarbans, 1905-08. See the Statesman, 23. 3. 1914.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন