৬. পয়োগ্রাম কসবা

সতীশচন্দ্র মিত্র

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – পয়োগ্রাম কসবা

মুড়লী কসবা হইতে খাঁ জাহান আলি স্বয়ং সৈন্য ও অনুচর সহ ভৈরবকূল দিয়া ক্রমে পূৰ্ব্বমুখে অগ্রসর হইতে থাকেন। রাস্তা নির্মাণ, দীঘি খনন ও মজিদ গঠন তাঁহার কার্য্য ছিল। এই সকল কীর্তিদ্বারা তাঁহার যাত্রাপথ সুচিহ্নিত হইয়াছে। খাঁ জাহান আলির এই সকল কীর্ত্তিকে সংক্ষেপতঃ ‘খাঞ্জালি’ কীৰ্ত্তি বলে। খাঞ্জালি হইতে আরও সংক্ষেপ হইয়া ‘খাঞ্জাই’ বা ‘খাঞ্জে’ কথা হইয়াছে। যেমন খাঞ্জেদীঘি, খাঞ্জাই ইট প্রভৃতি। আমরা এই সকল সৰ্ব্বজনবিদিত কথাই ব্যবহার করিব। যশোহর-খুলনায় এমন লোক নাই, যে খাঞ্জালি কথা জানে না, কিন্তু উহা যে খাঁ জাহান আলি নামের অপভ্রংশ, তাহা অতি অল্প লোকেই জানে না, কিন্তু উহা যে খাঁ জাহান আলি নামের অপভ্রংশ, তাহা অতি অল্প লোকেই জানে। বারবাজার হইতে মুড়লী দিয়া বাগেরহাট পৰ্য্যন্ত প্রায় ৭০ মাইল দীর্ঘ একটি রাস্তা এখনও সর্ব্বলোকের নিকট খাঞ্জালি রাস্তা নামে পরিচিত আছে। এই রাস্তা তাঁহার গতিপথ নির্দ্দেশ করিতেছে। এই রাস্তার পার্শ্বে তাঁহার চারিটি সহর ছিল। ১ম, বারবাজার,—ইঁহা বহু প্রাচীন স্থান বলিয়া খাঁ জাহান আলি কর্তৃক কসবা বা শহর নামে অভিহিত হয় নাই; ২য়, মুড়লী কসবা,—ইহা প্রাচীন মুড়লীর পশ্চিমপার্শ্বে খাঁ জাহান আলির নব প্রতিষ্ঠিত সহর; এই সহরে গরিব শাহ ও বেহরাম শাহ অধিষ্ঠান করেন। ৩য়, পয়োগ্রাম কসবা, মুড়লী হইতে ২১/২২ মাইল পূৰ্ব্বভাগে অবস্থিত। ৪র্থ, হাবেলী কসবা বা খালিফাতাবাদ, – বৰ্ত্তমান বাগেরহাট, ইহা যশোহর হইতে অন্যূন ৫৬ মাইল পূর্ব্বে ভৈরবকূলে অবস্থিত। আমরা প্রথম দুইটির কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি; এক্ষণে অপর দুইটি অর্থাৎ পয়োগ্রাম ও বাগেরহাটের কথা বলিব।

খাঁ জাহান আলি একজন অদ্ভুতকর্ম্মা পুরুষ ছিলেন। লোকমুখে অনেক অদ্ভুত কার্য্য তাঁহার উপর আরোপিত হইয়াছে। প্রবাদের গালভরা ভাষায় অনেক কথা বলা হয়, তাহাতে গল্পও জমে বেশ; কিন্তু তাহার ষোলআনা বিশ্বাস করিয়া লওয়া যায় না। তবে ষোলআনা না ধরিলেও তাহাতে কতক সত্য থাকে, তাহার উপর আস্থা স্থাপন করাও দুৰ্ব্বদ্ধিতা নহে। লোকে বলে খাঁ জাহানের ষাট হাজার সৈন্য ছিল, উহাদের অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্রের মত একখানি বাজে অস্ত্র ছিল কোদাল। যুদ্ধবিগ্রহ সব সময়ে চলিত না, আবশ্যকও হইত না, লোকে পাঠানসৈন্য দেখিলে বশ্যতা স্বীকার করিত। বিশেষতঃ লোকে খাঁ জাহানের জনহিতৈষণায় মোহিত হইয়া তাঁহাকে ভক্তি করিত। সুতরাং সৈন্যদিগকে অনেক সময় নিষ্কর্ম্মা থাকিতে হইত; খাঁ জাহান তাহাদিগের হস্তে কোদাল দিয়া কৰ্ম্ম দিয়াছিলেন। আজকাল ইংরাজ গবর্ণমেণ্ট শান্তিময় রাজ্যে নিষ্কর্ম্মা সৈন্যদিগকে ফুটবল কিনিয়া দিয়া কৰ্ম্মঠ রাখিতেছেন, খাঁ জাহানের আমলে তাহা ছিল না। যুদ্ধ বাধিলে সৈন্যেরা যুদ্ধ করিত, নতুবা কোদাল কেহ কাড়িয়া লইত না, অবাধে রাস্তা নির্মাণ ও পুষ্করিণী খনন করিতে করিতে দেশময় পুণ্যকীর্ত্তি রাখিয়া সৈন্যদল অগ্রসর হইত। এই প্ৰণালী একটি শিক্ষার বিষয়; এমনভাবে দেশের ও দশের স্থায়ী উপকারের উপায় আর নাই। উত্তরকালে রাজা সীতারাম রায়ও এই প্রণালী অবলম্বন করিয়াছিলেন। এই উভয়ের জলদান-পুণ্যে যশোহর-খুলনার অনেক স্থানে জল-দুর্ভিক্ষ নাই। বহুসংখ্যক কোড়াদার, বেলদার বা খননকারী সৈন্য হস্তগত থাকায়, অনেক স্থানে অতি অল্প সময়ের মধ্যে রাস্তা বা পুষ্করিণী হইত। রাস্তা প্ৰস্তুত করিতে করিতে খাঁ জাহান আলি অগ্রসর হইতেন, আবার কোনস্থানে খাদ্যাদি সংগ্রহ বা অন্য কোন কারণে কিছুকাল বিশ্রাম করিতে হইলে, তাহার বেলদার সৈন্যগণ অল্প সময়ের মধ্যে প্রকাণ্ড দীর্ঘিকা খনন করিয়া ফেলিত। ইহাই লোকে সামান্য অতিরঞ্জিত করিয়া বলে, খাঁ জাহান আলি একরাত্রিতেই প্রকাণ্ড পুষ্করিণী খনন করিয়া ফেলিতেন এবং তিনি নাকি রাত্রিতেই এই সকল অদ্ভুত কর্ম্ম করিতেন। এমন কি রাত্রি ভরিয়া পুষ্করিণী খনন করিতে করিতে তাহা শেষ হইবার পূর্ব্বে সূর্য্যোদয় হইলে, তৎক্ষণাৎ কাৰ্য্য বন্ধ হইত এবং সে কার্য্য সেই অবস্থাতেই সেখানে অসম্পূর্ণ রহিয়া যাইত। শুধু পুষ্করিণী খনন নহে, রাত্রির মধ্যেই মসজিদ গঠনও হইত। কিন্তু ইমারত গঠনের জন্য ইট ও মালমসল্যা চাই, তাহা তিনি সঙ্গে লইয়া ঘুরিতেন না, ইহাও লোকে ভুলিয়া যায়, ইহাই আশ্চর্য্যের বিষয়। যাহা হউক, তিনি বহুলোকের অধিনায়ক বলিয়া এই সকল কাৰ্য্য যে স্বল্পায়াসে, অতি সামান্য সময়ে সম্পন্ন করিতেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

মুড়লী হইতে ৪ মাইল পূর্ব্ব-দক্ষিণ কোণে রামনগর গ্রামে খাঁ জাহান একটি বড় দীঘি খনন করেন। উহাকে এক্ষণে শাহাবাটীর দীঘি বলে। এখনও উহাতে বারমাস জল থাকে। ইহা উত্তর- দক্ষিণে দীর্ঘ। কেহ কেহ এইজন্যই ইহাকে হিন্দুদীঘি বলিতে চান। কিন্তু তাহা সত্য নহে। হিন্দুর দীঘি উত্তর-দক্ষিণে এবং মুসলমানের দীঘি পূর্ব্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ করিয়া খনন করিবার নিয়ম আছে। খাঁ জাহান সে রীতি মানেন নাই। তাহার কারণ ছিল; হিন্দুরা পূর্ব্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ পুষ্করিণীর জল কোন বৈধকাৰ্যে ব্যবহার করেন না, মুসলমানদিগের উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ পুষ্করিণীর জল ব্যবহার করিলে ধৰ্ম্মহানি হয় না। সুতরাং উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ হইলে উহার জল সর্ব্বজাতিতে সমভাবে লয়। জলদাতার ইহাই প্রধান লক্ষ্য বিষয়। খাঁ জাহান আলি এ বিষয়ে কোন নিয়ম না মানিয়া, উভয়প্রকারের অসংখ্য দীঘি খনন করিয়া গিয়াছেন। অনেক স্থানে তিনি হিন্দুর খনিত প্রাচীন জলাশয়ের সংস্কার করিয়াছিলেন, সে সকল স্থলে তাহার দীঘি উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ না হইয়া পারে নাই।

সিঙ্গিয়া, সেখহাটি প্রভৃতি স্থান ছাড়িয়া আসিয়া যেখানে ভৈরব ক্রমে ক্রমে অর্দ্ধচন্দ্রাকারে দক্ষিণবাহী হইতেছিল, সেইস্থানে পয়োগ্রামে খাঁ জাহান আর একটি কসবা নগরী স্থাপন করিলেন। তাঁহার রাস্তা সোজাভাবে গ্রামের মধ্য দিয়া চলিয়া গেল এবং উহা তাঁহার নূতন নগরীকে দুইভাগে বিভক্ত করিল। যে ভাগ রাস্তার দক্ষিণে থাকিল, তাহার নাম দক্ষিণডিহি এবং যে ভাগ রাস্তার উত্তরে খাকিল, তাহার নাম উত্তরডিহি। এই উত্তরডিহি নদীর তীরে; সেইভাগে খাঁ জাহানের আবাসস্থান ও মসজিদ প্রভৃতি নির্ম্মিত হইল। উত্তরডিহির যে অংশে তাঁহার আবাসবাটিকা ছিল, তাহার নাম খাঞ্জেপুর। খাঞ্জালির পূর্ব্বোক্ত প্রধান রাস্তা হইতে অন্য একটী ৫০ ফুট বিস্তৃত রাস্তা উত্তরমুখে উত্তরডিহির মধ্য দিয়া নদীর দিকে গিয়াছে। ইহাই খাঞ্জালির সহরের প্রধান রাস্তা। উহা হইতে বামে দক্ষিণে অপেক্ষাকৃত স্বল্পপরিসর বহু রাস্তা নির্গত হইয়া সহরটিকে চককাটা মত করিয়াছে। এই সকল রাস্তার দুইপার্শ্বে লোকের বসতি হইয়াছিল। এখনও অনেক বসতি আছে, কিন্তু জঙ্গলই অধিক। এই জঙ্গলের মধ্য দিয়া ঘুরিয়া দেখিলে সরলরেখার মত সোজা রাস্তাগুলিকে আধুনিক পাড়াগেঁয়ে রাস্তা বলিয়া বোধ হয় না; পরন্তু ইহারা যে কোন কৃতী পুরুষের উদ্দেশ্য ও কল্পনানুযায়ী নির্ম্মিত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। উক্ত উত্তরবাহিনী বড় রাস্তার দুই পার্শ্বে একস্থানে দুইটি পুষ্করিণী আছে, উহার একটিকে আঁধার পুকুর ও অন্যটিকে সানের পুকুর বলে। সানের পুকুরের দক্ষিণ পাহাড়ে মৃত্তিকা নিম্নে ইট পাওয়া গিয়াছে। সেখানে যে বান্ধা ঘাট ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। খাঁ জাহানের পর কোন বিপ্লববশতঃ এই সকল স্থানে কিছুকালের জন্য লোকের বাস ছিল না, তাহাতেই এই সকল পুকুর ও কীর্ত্তিচিহ্ন সম্বন্ধে বহু প্রবাদের সূত্র হারাইয়া গিয়াছে। অনুমানের উপর নির্ভর করা ভিন্ন উপায় নাই। উক্ত বিপ্লব সময়ের একটি বিরাট তেঁতুলগাছ এখনও বর্তমান রহিয়াছে। এরূপ দীর্ঘকালস্থায়ী তেঁতুলগাছ আর দেখি নাই। গাছটা বেড় ঠিক ২৫ ফুট, উহা এত উচ্চ যে প্রায় এক মাইল দূরে নদী হইতে দেখা যায়।

উক্ত বড় রাস্তা নদীর নিকটবর্ত্তী হইয়া যেখানে ঘুরিয়া পূৰ্ব্বমুখে পয়োগ্রামের দিকে চলিয়া গিয়াছে, সেইখানেই উহার বামভাগে নদীর খুব সন্নিকটে একটি প্রকাণ্ড উচ্চ ঢিপি কোন পূর্ব্বকীর্তির সাক্ষীর মত দাঁড়াইয়া আছে। ঢিপিটি ১০০ × ১০০ ফুট, উহা পার্শ্ববর্তী জমি হইতে ৮ ফুট উচ্চ। এখানে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজের মত কোন বৃহৎ নমাজের স্থান বা দরবার গৃহ ছিল। শুনিয়াছি নিকটবর্ত্তী মধ্যপুর গ্রামে শ্রীধরপুরের ঈশ্বরচন্দ্র বসু মহাশয় নীলের কুঠি করিবার জন্য এই বিরাট ভগ্নগৃহ ভাঙ্গিয়া চুরিয়া বিলুপ্ত করিয়াছিলেন। এই ঢিপির উপর ৩২ × ১৭ ফুট। স্থানে ১ ফুট উচ্চ করিয়া একটা পাকা বেদী করিয়া উহার পশ্চিম দিকে একটি আধুনিক ইদ্‌গা স্থানীয় লোকে নিৰ্ম্মাণ করিয়া লইয়াছে। নিকটবর্ত্তী বহুসংখ্যক লোকেরা প্রধান প্রধান জুম্মা নমাজের উৎসবে এইস্থানে উপাসনা করিয়া থাকেন। এই ইদ্‌গার নিকটে একখানি অতি সুন্দর কষ্টিপাথর (Slate) আছে; উহার পরিমাণ ৩’ × ১’-৮’’। ঢিপির নিম্নে আর একখানি রাজমহল বা চট্টগ্রামের পাথর আছে। এই পাথর ঠিক ষাটগুম্বুজের স্তম্ভের পাথরের মত। এ পাথরখানি ১’-৮” X ১’-৮’’ × ৯’’ ইঞ্চি। আরও কত পাথর ছিল এবং তাহা কোথা হইতে কি ভাবে সংগ্রহীত হইয়াছিল, তাহা কে জানে? নীলকরেরা অনেকস্থানে ভ্যাণ্ডালদিগের মত ভীষণ অত্যাচার করিয়া দেশের অনেক পুরাকীর্ত্তি নষ্ট করিয়াছেন। সেরূপ অত্যাচার যে করা যায়, বর্ত্তমান গবর্ণমেণ্ট তাহা অনুভবও করিতে পারিবেন না।

পয়োগ্রাম কসবা একসময়ে সমৃদ্ধিশালী নগরী ছিল। এখানে অনেক সম্ভ্রান্ত মুসলমান এখনও বাস করিতেছেন। বোধ হয় এতগুলি খাঁটি উচ্চবংশীয় উন্নতিশীল মুসলমান পরিবার একত্র হইয়া যশোহর-খুলনার অন্য কোন স্থানে নাই। ইঁহাদের অনেকে পশ্চিমদেশ হইতে আগত সম্ভ্রান্ত মুসলমান অধিবাসীর বংশধর এবং কতক, যে-সকল উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান ধর্ম্ম পরিগ্রহ করেন, তাঁহাদেরই অধস্তন পুরুষ। কথিত আছে, খাঁ জাহানের পয়োগ্রাম নিবাসকালে পীরালি সম্প্রদায়ের প্রথম উৎপত্তি হয়।

দক্ষিণডিহি প্রাচীন স্থান। ইহার দক্ষিণডিহি নামকরণ খাঁ জাহানের সময় হইতে হয়। পূৰ্ব্বে ইহা পয়োগ্রামই ছিল। বিপ্লবের অব্যবহিত পরে এখানে রায়চৌধুরী বংশীয়েরা বাস করেন। যখন খাঁ জাহান পয়োগ্রামে আসেন, তখন রায়চৌধুরীগণ তথাকার প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। ইঁহারা ব্রাহ্মণ, কনোজাগত দক্ষের বংশধর। দক্ষের জ্যেষ্ঠ পুত্র ধীর মুর্শিদাবাদের ৬ ক্রোশ পশ্চিমে গুড়গ্রাম প্রাপ্ত হইয়া তথায় বাস করেন।[১] তজ্জন্য এই বংশীয়গণ গুড়ী বা গুড়গ্রামী ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচিত। এই বংশীয় শরণ বল্লালসেনের চতুদশগ্রামী গৌণ কুলীনের অন্যতম। পরে দনৌজামাধবের সমীকরণে ও রাজা গণেশ দত্তখানের ব্যবস্থায় গুড়গ্রামিগণ সাধ্যশ্রোত্রিয় মধ্যে পরিগণিত হন।[২] শরণের প্রপৌত্র ভবদত্ত পশ্চিম বঙ্গের পাঠান শাসন কালে গুণগরিমায় খাঁ উপাধি পান। ব্রাহ্মণের খাঁ উপাধি হেতু লোকে তাঁহাকে ‘বামন খাঁ’ বলিত। ভবদত্তের পৌত্র রঘুপতি আচার্য্য শেষ বয়সে বানপ্রস্থ অবলম্বন করিয়া কাশীবাস কালে পাণ্ডিত্যের জন্য দণ্ডীদিগের নিকট হইতে একটি স্বর্ণদণ্ড উপহার প্রাপ্ত হন, এজন্য তাঁহার উপাধি হয় কনকদণ্ডী। তদবধি তাঁহার বংশীয়গণ কনকদণ্ডী গুড় বলিয়া খ্যাত।

বল্লালসেনের সময় সূৰ্য্যমাঝি নামক একজন ধীবর অদ্ভুত কার্য্যের পুরস্কার স্বরূপ সূর্য্যদ্বীপের রাজত্ব পাইয়াছিলেন, তাহা পূৰ্ব্বে বর্ণিত হইয়াছে। এই সূর্য্যমাঝির এক অধস্তন পুরুষ মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিয়া সুলতান মাঝি বলিয়া পরিচিত হন। প্রবাদ এই, পূর্ব্বোক্ত কনকদণ্ডীর পুত্র রমাপতি এই সুলতান মাঝিকে বিনষ্ট করিয়া সূর্য্যদ্বীপ অধিকার করিয়া লন। রমাপতি চারি পুত্র- সৰ্ব্বানন্দ, জ্ঞানানন্দ, প্রেমানন্দ ও অমৃতানন্দ। তন্মধ্যে অমৃতানন্দ সরস্বতী সন্ন্যাসধর্ম্ম গ্রহণপূর্ব্বক সিদ্ধিলাভ করেন। জ্ঞানানন্দের পুত্র জয়কৃষ্ণ; তৎপুত্র নাগরনাথ ও দক্ষিণানাথ। মুসলমান ধর্ম্মাশ্রিত সুলতান মাঝির উপর অত্যাচারের সময় হইতে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান শাসনকর্তাগণ রমাপতি ও তদ্বংশীয়দিগের উপর অত্যন্ত বিরূপ ছিলেন; কিন্তু গৌড়াঞ্চলে সিংহাসন লইয়া এরূপ গণ্ডগোল চলিতেছিল যে, এদিকে তাঁহারা বিশেষ মনোযোগ দিতে পারেন নাই। সম্ভবতঃ রাজা গণেশের সময় নাগর ও দক্ষিণানাথ উভয় ভ্রাতা হিন্দু নরপতির সহায্যাদি করিয়া সন্তোষ বিধান করেন এবং তাহার ফলে রায়চৌধুরী উপাধি লাভ করেন। ইঁহারা দুই ভ্রাতায় কালে চেঙ্গুটিয়া পরগণা দখল করিয়া লন এবং অপেক্ষাকৃত নিরাপদ প্রদেশে সদর্পে শাসনদণ্ড পরিচালন জন্য দক্ষিণডিহি অঞ্চলে আসিয়া বাসস্থান নির্দ্দেশ করেন। কেহ কেহ বলেন, এই দুই ভ্রাতার মধ্যে বিভাগসূত্রে উত্তরডিহি ও দক্ষিণডিহি নামকরণ হয়। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ভৈরবের কূলে উত্তরদিকে থাকেন, উহাই উত্তরডিহি, এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতা দক্ষিণানাথ দক্ষিণডিহি পাইয়াছিলেন। কেহ কেহ দক্ষিণডিহি নামের সহিত দক্ষিণানাথ নামেরও সম্বন্ধ স্থাপন করেন। নাগর রায় সাধারণের সুবিধার জন্য এই প্রদেশে এক হাট স্থাপন করেন, সেই ‘নাগরের হাট’ বর্ত্তমান বেজেরডাঙ্গা ষ্টেশনের সন্নিকটে ছিল। এখনও লোকে সে স্থান প্রদর্শন করিয়া থাকে। যাহা হউক রায়চৌধুরিগণই দক্ষিণডিহি ও উত্তরডিহি নামে স্থান ভাগ করেন বা খাঁ জাহান আসিয়া তাহার নব প্রতিষ্ঠিত সহরের ঐরূপ ভাগ করেন, তাহার নিশ্চয়তা নাই। তবে এইটুকু নিশ্চয়তা আছে যে, খাঁ জাহানের আগমনের পরও দক্ষিণডিহিতে রায়চৌধুরিগণ বিশেষ গৌরবান্বিত ছিলেন।

নাগরনাথ নিঃসন্তান। দক্ষিণানাথের চারি পুত্র ছিল—কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব। দক্ষিণানাথের মত তাঁহার পুত্রগণ প্রতাপান্বিত ছিলেন না, কারণ খাঁ জাহানের আগমনকালে তাঁহাকে কেহ বাধা দিয়াছিলেন বলিয়া জানা যায় নাই। বাধা দিলেও তাহা যে বিফল হইয়াছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। পরন্তু খাঁ জাহানের শাসন প্রতিষ্ঠার পর কামদেব ও জয়দেব, এই উভয় ভ্রাতায় নবাগত পাঠানবীরের প্রধান কৰ্ম্মাধ্যক্ষ হইয়া বসিয়া ছিলেন। খাঁ জাহানও এই ভাবে তাহাদিগকে রুদ্ধবীর্য্য সর্পের মত করায়ত্ত করিয়াছিলেন। শুধু করাত্ত রাখা নহে, কৌশলে তাহাদিগকে মুসলমান ধৰ্ম্ম পরিগ্রহ করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন। সেই ঘটনাই এদেশীয় পীরালি বংশের উৎপত্তির মূল।

প্রবাদ আছে, বারবাজার ত্যাগ করিয়া, যখন খাঁ জাহান ভৈরবের কূল দিয়া ক্রমশঃ অগ্রসর হইতেছিলেন, জনৈক সুচতুর ব্রাহ্মণ তাঁহার পথপ্রবর্তক ছিলেন। এমন কি, এরূপও কথিত হয় যে, এই ব্রাহ্মণই খাঁ জাহানকে বঙ্গদেশে আনিবার মূল। গ্রাম্যবিবাদ ঘটিত প্রতিহিংসাই ব্রাহ্মণকে এই কার্য্যে প্রবৃত্ত করাইয়াছিল। সম্ভবতঃ চেঙ্গুটিয়া পরগণার অধিকারী দক্ষিণডিহির রায়চৌধুরী মহাশয়গণের সহিতই উক্ত বিবাদ হয় এবং তাহাতেই বোধ হয় ব্রাহ্মণকে স্বীয় হস্তে স্বগৃহে অনল প্রদান করিতে প্রলুব্ধ করে; কারণ প্রতিহিংসার অসাধ্য কিছু নাই। ব্রাহ্মণ পরহিংসা করিতে গিয়া আত্মহিংসাই করিয়াছিলেন; কারণ তিনি ধর্ম্ম বা রাজ্যলোভে অথবা সংস্পর্শ দোষে নিজের জাতিধৰ্ম্ম বিসর্জ্জন দিয়া মুসলমান ধৰ্ম্মে দীক্ষিত হইয়াছিলেন। তাঁহার পূর্ব্বে কি নাম ছিল, জানি না, জানিয়াও বিশেষ কাজ নাই; এখন তাঁহার নাম হইল মহম্মদ তাহের। তীক্ষ্ণবুদ্ধি ব্ৰাহ্মণ ধর্ম্মত্যাগ করিয়া পাশবিক উন্নতির পথ পরিষ্কার করিয়া লইলেন। পয়োগ্রাম কসবার নবাব হইলেন খাঁ জাহান আলি এবং তাঁহার উজীর হইলেন মহম্মদ তাহের। আর রায়চৌধুরীদিগের মত বহু ভূপতি ভয়ে তাঁহাদের দ্বারস্থ হইলেন। শীঘ্রই খাঁ জাহান পয়োগ্রাম পরিত্যাগ করিয়া রাজ্য বিস্তার ও কৃষি পত্তনের উদ্দেশ্যে বাগেরহাট অভিমুখে যাত্রা করিলেন। পয়োগ্রামে তৎপ্রদেশীয় শাসনকর্তৃত্ব মহম্মদ তাহেরের উপরই রাখিয়া গেলেন।

যে জাত্যন্তর বা ধর্মান্তর গ্রহণ করে, তাহারই গোঁড়ামি অধিক বাড়িয়া থাকে। মহম্মদ তাহেরের তাহাই হইয়াছিল। তাঁহার গোঁড়ামির মাত্রা এত চড়িয়া গেল যে, তাঁহার ধর্ম্মরঙ্গ দেখিয়া স্থানীয় হিন্দু মুসলমান তাঁহাকে ‘পীর আলি’ করিয়া লইল। পীর আলি নব ধর্ম্মানুশাসনে নানাভাবে হিন্দু যৌত নানা জাতিকে মুসলমান ধর্ম্মে দীক্ষিত করিতে লাগিলেন। এই ভাবে যাহারা প্রকৃত ভাবে মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করিলেন, তাহারা ‘পীর আলি মুসলমান’ বলিয়া চিহ্নিত হইলেন এবং যাহারা ঐরূ মুসলমানের সহিত সংস্রব-দোষে মুসলমান না হইয়াও সমাজচ্যুত হইলেন, তাহারা কেহ পীর আলি ব্রাহ্মণ, পীর আলি কায়স্থ, পীর আলি নাপিত ইত্যাদি থাকিয়া গেলেন। এইরূপ পীর আলি বা পীরালি হিন্দু ও মুসলমান যশোহর-খুলনার বহুস্থানে বাস করিতেছেন। পীরালিগণের সহিত বৈবাহিক সূত্রে বহু ব্রাহ্মণ কায়স্থ সমাজে অপদস্থ হইয়া পীরালি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হইয়া রহিয়াছেন।

দক্ষিণডিহি নিবাসী পূর্ব্বোক্ত দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরীর চারি পুত্রের মধ্যে কামদেব ও জয়দেব মহম্মদ তাহেরের অধীনে উচ্চ কাৰ্য্যে নিযুক্ত হন। মুসলমানের অধীন হইয়া চাকরি করিলেও রায়চৌধুরীগণ অত্যন্ত সম্মানিত এবং পরাক্রান্ত ছিলেন। তাঁহারা নিষ্ঠাবান্ হিন্দু, এজন্য ইসলামধর্ম্মে দীক্ষিত ব্রাহ্মণতনয় মহম্মদ তাহেরকে মনে মনে অত্যন্ত ঘৃণা করিতেন, মুখ ফুটিয়া বিশেষ কিছু বলিতে পারিতেন না। ধর্ম্মান্তরিত মহম্মদ তাহেরও তাঁহাদের গোঁড়ামি সহ্য করিতে পারিতেন না; এবং তাঁহার প্রতি সেই নিম্নস্থ কর্মচারীদিগের অস্পষ্ট ঘৃণার ভাব যে তিনি বুঝিতে পারিতেন না, এমন নহে। ফলতঃ দুইদিকেই অন্তরাকাশে মেঘ সঞ্চয় হইতেছিল। নবদীক্ষিত পীর আলি গোঁড়া হিন্দুকে স্বীয় মতে আনিয়া প্রতিশোধ লইবার কল্পনা পোষণ করিতেছিলেন। একদিন রোজা বা উপবাসের দিনে মহম্মদ তাহের ও কামদেব, জয়দেব প্রভৃতি কর্ম্মচারিগণ বসিয়া আছেন, এমন সময়ে একব্যক্তি তাহার নিজের বাটী হইতে একটি সুগন্ধি কলম্বা লেবু আনিয়া উপহার দিল। পীর আলি উহার ঘ্রাণ লইতেছিলেন, এমন সময় কামদেব বলিলেন, ‘হুজুর, ঘ্রাণ লইলে যে অর্দ্ধেক ভোজন হয়, আপনি যে গন্ধ গ্রহণ করিয়া রোজা ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন?’ এবং সঙ্গে সঙ্গে ‘ঘ্রাণেন চার্দ্ধভোজনং’ বলিয়া সংস্কৃত শ্লোকেরও উল্লেখ করিলেন। পীর আলি বাহিরে একটু অপ্রতিভ হইলেন বটে, কিন্তু হাড়ে চটিয়া গেলেন এবং কামদেবের বিদ্রূপের বিকট প্রতিশোধ লইবার জন্য সঙ্কল্প করিলেন।

গোপনে পরামর্শ স্থির হইল। একদিন তিনি প্রধান প্রধান হিন্দু মুসলমান প্রজাবর্গকে দরবারে আহ্বান করিলেন। দরবার-গৃহের পার্শ্ববর্তী ঘরে পলাণ্ডু প্রভৃতি সংযোগে গো-মাংস রন্ধন করা হইতেছিল। প্রজারা সকলে আসিলেন, কামদেব জয়দেবও যথা সময়ে দরবারে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু দরবার-গৃহে পলাণ্ডু প্রভৃতি মসল্লার গন্ধে ভরপুর হইয়াছিল। কামদেব প্রভৃতি নাকে কাপড় দিয়া বসিয়াছিলেন। তখন কঠোর বিদ্রূপাত্মক স্বরে পীর আলি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি সংবাদ চৌধুরী, নাকে কাপড় কেন?’ কামদেব মাংস গন্ধের কথা উল্লেখ করিলেন। অমনি পীর আলি বলিলেন, “সেখানে গো-মাংস রন্ধন হইতেছে, তাহা হইলে তোমাদেরও অর্দ্ধেক ভোজন করা হইয়াছে; সুতরাং জাতি গিয়াছে।’ হিন্দুগণ শিহরিয়া উঠিলেন। কামদেব ও জয়দেবকে ধরিয়া জোর করিয়া তাহাদের মুখে সেই মাংস দেওয়া হইল, অনেকে সে দুর্গতি দেখিয়া ভয়ে পলায়ন করিল। দুই ভ্রাতা জাতিচ্যুত হইয়া মুসলমান ধর্ম্ম পরিগ্রহ করিতে বাধ্য হইলেন। মহম্মদ তাহের তাহাদিগকে কামাল উদ্দীন ও জামাল উদ্দীন খাঁ চৌধুরী উপাধি দিয়া স্বশ্রেণীভুক্ত করিয়া লইলেন। সংস্রব জন্য অন্য দুই ভ্রাতা রতিদেব ও শুকদেব পীর আলি ব্রাহ্মণ হইলেন। ইহাই ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে পীরালি থাকের উৎপত্তি।

খাঁজাহানের আগমন ও পীরালিদিগের উৎপত্তি সম্বন্ধে ঘটকদিগের পুঁথিতে এইরূপ আছে :

‘খান্ জাহান মহামান পাদশা নফর।
যশোরে সনন্দ ল’য়ে করিল সফর॥
তার মুখ্য মহাপাত্র মামুদ তাহির।
মারিতে বামুন বেটা হইল হাজির॥
পূৰ্ব্বেতে আছিল সেও কুলীনের নাতি।
মুসলমানী-রূপে মজে হারাইল জাতি॥
পীর আলি নাম ধরে পিরাল্যা গ্রামে বাস।[৩]
যে গাঁয়েতে নবদ্বীপের হ’ল সৰ্ব্বনাশ॥
সুবিধা পাইয়া তাহির হইল উজীর।
চেঙ্গুটিয়া পরগণায় ছাড়িল জিগীর॥[৪]
গুড়-বংশ অবতংস রায় রায়ে ভাতি।[৫]
অর্থলোভে কৰ্ম্মদোষে মিলিল সংহতি॥
ধনবলে কৈল ভ্ৰম হৈল উচ্চ মাথা।
নানা জনে রটাইল নানা কুৎসা কথা॥
আঙ্গিনায় ব’সে আছে উজীর তাহির
কত প্ৰজা ল’য়ে ভেট করিছে হাজির॥
রোজার সে দিন পীর উপবাসী ছিল।
হেনকালে একজন নেবু এনে দিল॥
গন্ধামোদে চারিদিকে ভরপুর হইল।
বাহবা বাহবা বলি নাকেতে ধরিল॥
কামদেব জয়দেব পাত্ৰ দুইজন।
ব’সে ছিল সেইখানে বুদ্ধে বিচক্ষণ॥
কি করেন কি করেন বলিলা তাহিরে।
ঘ্রাণেতে অর্দ্ধেক ভোজন শাস্ত্রের বিচারে॥
কথায় বিদ্রূপ ভাবি তাহির অস্থির।
গোঁড়ামি ভাঙ্গিতে দোঁহের মনে কৈল স্থির॥
দিন পরে মজলিস করিল তাহির।
জয়দেব, কামদেব হইল হাজির॥
দরবারের চারিদিকে ভোজের আয়োজন।
শত শত বরি আর গো-মাংস রন্ধন॥
পলাণ্ডু লশুন গন্ধে সভা ভর পুর।
সেই সভায় ছিল আরো ব্রাহ্মণ প্রচুর॥
নাকে বস্ত্র দিয়া সবে প্রমাদ গণিল।
ফাঁকি দিয়া ছলে কলে কত পলাইল॥
কামদেবে জয়দেবে করি সম্বোধন।
হাসিয়া কহিল ধূর্ত তাহির তখন॥
জারি জুরি চৌধুরী আর নাহি খাটে।
ঘ্রাণে অৰ্দ্ধেক ভোজন শাস্ত্রে আছে বটে॥
নাকে হাত দিলে আর ফাঁকি ত চলে না।
এখন ছেড়ে ঢং আমার সাথে কর খানাপিনা॥
উপায় না ভাবিয়া দোঁহে প্রমাদ গণিল।
হিতে বিপরীত দেখি মরমে মরিল॥
পাকড়াও পাকড়াও হাঁক দিল পীর।
থতমত হ’য়ে দোঁহে হইল অস্থির॥
দুইজনে ধরি পীর খাওয়াইল গোস্ত।
 পীরালি হইল তারা হইল জাতিভ্রষ্ট॥
কামাল জামাল নাম হইল দোঁহার।
ব্রাহ্মণ সমাজে প’ড়ে গেল হাহাকার॥
তখন ডাকিয়া দোঁহে আলি খাঁজাহান।
সিঙ্গির জায়গীর দিল করিতে বাখান॥[৬]
সেই গোলে গুড়বাসে বিধি বিড়ম্বনা।
শত্রুগণে জাতিনাশে করিল কল্পনা
পীরালি অখ্যাতি দিল ঘ্রাণ মাত্র দোষ।
সৰ্ব্বদেশে রাষ্ট্র হ’ল কুগ্রহের রোষ॥
সংসর্গে পড়িল যারা তাহারাও মজিল।
গুড় পীরালি দোষ বলি ঘটকে বুঝিল
কিছুকাল পরে তারা মার্জ্জিত হইল
ঘটকের করুণায় সুঘর মিলিল
ধনে মানে হ’য়ে হীন কুটুম্ব স্বঘর।
সমাজে রহিল ঠেলা সেই বরাবর
পীরালি রহিল পড়ি কুলাচাৰ্য্য ঘোষে।
রচিল পীরালি কথা নীলকান্ত শেষে’[৭]

কামাল উদ্দীন ও জামাল উদ্দীন জায়গীর পাইয়া নিকটবর্ত্তী সিঙ্গিয়া গ্রামে বাস করিতে লাগিলেন। তাঁহারা হঠাৎ মুসলমান হইলেও হিন্দু আচার-ব্যবহার পরিত্যাগ করিতে সে বংশে বহুপুরুষ লাগিয়াছিল। প্রথমতঃ তাঁহারা অন্য মুসলমানের সহিত বিবাহাদি কার্য্য করিতেন না, উভয়ের বংশে পরস্পর বিবাহ প্রথা চলিয়াছিল, ক্রমে যখন এইরূপ পীর আলি মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল, তখন ক্রমে তাঁহারা ঐ সকল মুসলমানের সহিত মিশিয়া গিয়াছিলেন। ইঁহারা বহুপুরুষ পর্য্যন্ত হিন্দুর মত নাম রাখিয়াছেন, শিবপূজা, শিবরাত্রিব্রত, ষষ্ঠীপূজা প্রভৃতির অনুষ্ঠান করিয়াছেন, গো-মাংস ভোজন করিতেন না, বাড়ীতে কুক্কুট পুষিতেন না, তুলসীসেবা, গাডু ব্যবহার, আলিম্পন (আলপনা) দেওয়া, বিবাহাদি উপলক্ষে পীড়ি চিত্রিত করা প্রভৃতি রীতি প্রচলিত ছিল। এমন কি পূৰ্ব্বসম্পর্কিত হিন্দু আত্মীয়ের বাটীতে অন্নপ্রাশনাদি উপলক্ষ্যে নিমন্ত্রিত হইয়া জমি বা অর্থ যৌতুক দান করিতেন। এখনও অনেক হিন্দু এইভাবে প্রাপ্ত জমি ভোগ করিতেছেন। সিঙ্গিয়া, জগন্নাথপুর প্রভৃতি স্থানে এখনও এমন লোক জীবিত আছেন শুনিয়াছি যে, তাঁহাদের পিতামহী পর্য্যন্ত শিবপূজা করিতেন। সিঙ্গিয়া অঞ্চলে যেমন অনেকগুলি গ্রামে পীরালি মুসলমানের বাস আছে, সাতক্ষীরা অঞ্চলে কুলিয়া প্রভৃতি গ্রামে, যশোহরের অন্তর্গত মহেশপুর থানায় ঐরূপ অনেক প্রতিপত্তিশালী মুসলমান পীরালি সংজ্ঞাযুক্ত। প্রেসিডেন্সী বিভাগের স্কুলসমূহের ভূতপূর্ব্ব ইনস্পেক্টর জনাব মকলুব আহম্মদ খাঁ চৌধুরী ও তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা জনাব লুৎফ আহম্মদ সাতক্ষীরার অন্তর্গত পীরালিবংশ উজ্জ্বল করিয়াছেন।

খাঁ জাহানের আমলে পীর আলি মহম্মদ তাহেরের প্ররোচনায় যাঁহারা মুসলমান হন, তাঁহারা পীরালি আখ্যা পান বটে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে এইভাবে যে-সকল প্রসিদ্ধ বংশ মুসলমান ধৰ্ম্মে দীক্ষিত হইয়াছেন, তাঁহারাই পীরালি। মোগল রাজত্বের প্রারম্ভে জনৈক হিন্দু, মুসলমান হইয়া চাঁদ খাঁ নামধারণ করেন এবং নবাবের অধীন হাবিলদার ও পরে মীরমুন্সী হন। প্রবাদ আছে, প্রতাপাদিত্যের পতনের অব্যবহিত পরে যখন চাঁদ খাঁ পীরালি হন, তখন ১৪০০ ব্ৰাহ্মণ মুসলমানধর্ম্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। চাঁদ খাঁ সাতক্ষীরার অন্তর্গত চাঁদপুরে বাস করেন। ক্রমে ক্রমে ঐ স্থানে শ্রীরামপুর, কুলিয়া, কোমরপুর, পলাশপোল, হেলাতলা, নগরতলা, গণপতিপুর, পাথরঘাটা, হাকিমপুর, রসুলপুর প্রভৃতি স্থানে ২/৩ শত ঘর পীরালি মুসলমানের বাস হইয়াছে। উক্ত চাঁদ খাঁ হইতে ৯ম ও ১০ম পুরুষ জীবিত আছেন।

পয়োগ্রামের সন্নিকটে খাঞ্জেপুর প্রভৃতি স্থানে পাঠান আমল হইতে বহুসংখ্যক উচ্চবংশীয় মুসলমানের বাস হইয়াছিল। উঁহারা পীরালি নহেন। উঁহাদের বংশধরগণ এতৎপ্রদেশে মুসলমান সমাজে বিশেষ সম্মানিত রহিয়াছেন। ইঁহাদের জাতিগৌরব বিদ্যা-গৌরবে প্রমাণিত ও সমুজ্জ্বল হইয়াছে। ইঁহাদের মধ্যে অনেক ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট, ডেপুটী সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট, পুলিশ ইনস্পেক্টর, সবরেজিষ্টার, উকীল, হেডমাষ্টার প্রভৃতি উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত আছেন। এত অধিক সংখ্যক উচ্চ-চাকুরিয়া মুসলমান একত্র বোধ হয় যশোহর-খুলনার অন্য কোন গ্রামে পাওয়া যায় না।

রায়চৌধুরীবংশীয় শুকদেবের বংশধরগণ সংস্রব-দোষে সমাজে নিন্দিত ও আত্মীয়স্বজন কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া একটি পৃথক্ সম্প্রদায়ভুক্ত হইয়া পড়িলেন। ইহাকেই ব্রাহ্মণদিগের পীরালি থাক বলে। শুকদেবের পুত্র গৌরীদাস ও কালাচাঁদ বিখ্যাত ছিলেন। কালাচাঁদই দক্ষিণডিহিতে কালাচাঁদ অর্থাৎ কৃষ্ণমূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠিত করিয়া, উহার জন্য এক সুন্দর মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দেন। খাঁ জাহানের সঙ্গে যে সকল পাঠানস্থপতি এদেশে আসিয়াছিলেন, সম্ভবতঃ উহাদেরই সাহায্যে এই মন্দির নির্মিত হয়। মন্দিরটি এক্ষণে এক প্রকার ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, কিন্তু তবুও উহার স্থাপত্যে, গুম্বুজে ও খিলানে, মুসলমানী ধরনের সজীব আভাস পাওয়া যায়। কালাচাঁদ বিগ্রহ এখনও আছেন; কিন্তু তাঁহার মন্দির অব্যবহার্য্য হওয়ায়, এক্ষণে নিকটবর্ত্তী একটি ইষ্টকগৃহে তাঁহার যথাবিধি পূজা চলিতেছে। নিকটবর্ত্তী সিকিরহাটে যে কালীবাড়ী আছে, তাহাও এই রায়চৌধুরী বংশীয়দিগের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।

গৌরীদাসের প্রপৌত্র হরিবল্লভ যশোহরের অন্তর্গত হল্দা-মহেশপুরে গিয়া বাস করেন এবং অপর প্রপৌত্র রমাবল্লভ ও কৃষ্ণবল্লভ দক্ষিণডিহি থাকিয়া যান। রমাবল্লভের পৌত্র মনোহর প্রসিদ্ধ যোদ্ধা ও সেনানায়ক ছিলেন; সম্ভবতঃ তিনি বঙ্গেশ্বর দায়ুদ খাঁর রাজত্বকালে কার্য্যগৌরবে ‘লঙ্কর খাঁ চৌধুরী’ উপাধি লাভ করেন। মনোহরের আর একটা বিশেষত্ব ছিল, তিনি অপরিমিত আহার করিতে পারিতেন। এমন কি প্রবাদ আছে তিনি একমণ ভোজ্য দ্রব্য উদরসাৎ করিতে পারিতেন; তজ্জন্যই তাঁহার নাম হইয়াছিল—‘মুকে মনোহর’। মনোহরের দুই পুত্র; উপানন্দ ও শুভেন্দ্র। তন্মধ্যে উপানন্দের বংশধরেরা দক্ষিণডিহি এবং শুভেন্দ্রের পুত্রগণ জগন্নাথপুর, মহাকাল, সেখহাটি, বুঞীকারা, নরেন্দ্রপুর, চেঙ্গুটিয়া, ঘোপেরঘাট প্রভৃতি গ্রামে বাস করেন। এই সকল স্থানে ইহাদের অধিকাংশ বংশধরগণ বিশেষ প্রতিপত্তির সহিত বাস করিতেছেন।[৮]

রায়চৌধুরীগণ সমাজে নিন্দিত হইবার পর পুত্রকন্যার বিবাহ জন্য মহাবিড়ম্বিত হইয়া পড়েন। তখন তাঁহারা অর্থবলে ও কার্য্যকৌশলে সমাজকে বাধ্য করিয়া স্বকীয় উদ্দেশ্য-সিদ্ধি করিতে লাগিলেন। এইভাবে আরও অনেক বংশ তাঁহাদের সহিত সংস্রবদোষে পতিত হইতে থাকে। ইহার মধ্যে কলিকাতার সুপ্রসিদ্ধ ঠাকুর-বংশ]৯] বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঠাকুর বাবুরা ভট্টনারায়ণের সন্তান, শাণ্ডিল্য গোত্রীয় সিদ্ধশ্রোত্রিয়। তাঁহারা কুশারি-গাঞি ভুক্ত। খুলনা জেলায় ভৈরবকূলবর্তী পিঠাভোগ ও ঘাটভোগ গ্রামে কুশারিদিগের বাস ছিল। পিঠাভোগের কুশারিগণ গোষ্ঠীপতির বংশ বলিয়া সম্মানিত। ঢাকা ও বাঁকুড়ায়ও কুশারিদিগের বাস আছে। পিঠাভোগের কুশারি-বংশীয় পুরুষোত্তম বিদ্যাবাগীশ উক্ত রায়চৌধুরী-বংশে বিবাহ করিয়া পীরালি হন।[১০] সম্ভবতঃ ইনি আদি পীরালি শুকদেবের কন্যা বা পৌত্রী বিবাহ করেন। পুরুষোত্তম হইতে ঠাকুরবংশে ১৫/১৬ পুরুষ হইয়ছে। ইহার মধ্যে উভয় বংশে বহু বিবাহ-সম্বন্ধ হইয়াছে।[১১] সমৃদ্ধ ঠাকুর বংশের সহিত এইরূপ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধহেতু রায়চৌধুরীদিগের অনেকে কলিকাতায় বাস করিয়াছেন। তজ্জন্য তাঁহাদের আদি নিবাস দক্ষিণডিহি প্রভৃতি স্থান জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া পড়িতেছে। সেই জঙ্গলের মধ্য কালাচাঁদ বিগ্রহের প্রাচীন মন্দির এখনও প্রাচীন কথা স্মরণ করাইয়া দেয়।

ঠাকুর-বংশ ব্যতীত অন্য যে সকল বংশ এইভাবে পীরালি হন, তন্মধ্যে চেঙ্গুটিয়ার মুস্তৌফি বংশ বিখ্যাত। ইঁহারা ফুলিয়ার মুখটীবংশ। ফুলিয়া গ্রামবাসী ১৬ পর্য্যায়ভুক্ত প্রসিদ্ধ নৃসিংহ মুখোপাধ্যায়ের ভ্রাতা রামের অধস্তন সন্তান মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায় দক্ষিণডিহির রায়চৌধুরী বংশে বিবাহ করিয়া পীরালি হন। নাট্য-রঙ্গমঞ্চে হাস্যরসের অপূর্ব্ব অভিনয় করিয়া যিনি অমর হইয়াছেন, সেই অর্দ্ধেন্দুশেখর মুস্তৌফি এই মঙ্গলানন্দের অধস্তন পুরুষ। তৎপুত্র ব্যোমকেশ মুস্তৌফি বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের সহকারী সম্পাদক ও অন্যতম বিশিষ্ট কার্য্যাকারকরূপে সাহিত্যক্ষেত্রে সুপরিচিত ছিলেন।[১২] ঠাকুর ও মুস্তৌফিবংশ ব্যতীত আর যে সকল ব্রাহ্মণ, অথবা কায়স্থ প্রভৃতি জাতি পীরালি হইয়াছেন, তাঁহাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ স্থানান্তর প্রদত্ত হইবে।

পাদটীকা :

১. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণ কাণ্ড, ১ম খণ্ড, ১২১ পৃ।

২. ঐ, রাজন্যকাণ্ড, ৩৬৮ পৃ। [কুলগ্রন্থে রাজা গণেশ ‘দত্তখান’ নামে কথিত— শিমি

৩. পাঠান বিজয়ের প্রারম্ভ হইতেই নবদ্বীপ অঞ্চলে হিন্দুসমাজের উপর মুসলমানদিগের অত্যাচার আরব্ধ হয়। ক্রমে ক্রমে অনেক ব্রাহ্মণ জাতিচ্যুত হন এবং তাঁহারা নবদ্বীপের সন্নিকটে পারোলিয়া বা পীরলিয়া গ্রামে বাস করেন। সে গ্রাম এখনও আছে। মহম্মদ তাহের পূর্ব্বে ব্রাহ্মণ ছিলেন, ঘটকেরা বলেন তিনি কোন মুসলমান স্ত্রীর প্রতি আসক্ত হইয়া স্বধৰ্ম্ম ত্যাগ করেন। স্বেচ্ছায় বা বলপ্রয়োগে যে কারণেই হউক তিনি মুসলমান হইয়া পীর আলি নামে অভিহিত হন এবং পীরলিয়া গ্রামে বাস করেন। পীরলিয়া গ্রামের নামে তিনি পীর আলি হন বা তিনি ‘পীরালি’ বলিয়া গ্রামের নাম পীরলিয়া বা পীরাল্যা হয়, তাহা নির্ণয় করিবার উপায় নাই। এই পীরাল্যা গ্রামের নবদীক্ষিত মুসলমানদিগের অত্যাচারবশতঃ এক সময় নবদ্বীপ উৎসন্ন হইবার উপক্রম হইয়াছিল। চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ভক্ত জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলে দেখিতে পাই :

‘পীরাল্যা গ্রামেতে বৈসে যতেক যবন।
উচ্ছন্ন করিল নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ॥
ব্রাহ্মণে যবনে বাদ যুগে যুগে আছে।
বিষম পারাল্যা গ্রাম নবদ্বীপের কাছে॥’

এরূপ কথিত হইয়াছে যে এই উৎপাতের জন্য;

“বিশারদ সুত সাৰ্ব্বভৌম ভট্টাচাৰ্য্য।
স্ববংশে উৎকল গেলা ছাড়ি গৌড়রাজ্য॥’

৪. জিগীর = উচ্চ চীৎকার, জয়োল্লাস।

৫. আদি পীরালিদিগের সহিত ‘রায় রাঁইয়া’ উপাধির একটি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ দেখিতে পাওয়া যায়। ঘটকরাজ নুলোপঞ্চানন যেখানে পীরালির উল্লেখ, সেখানেই ‘রায় রাঁয়ে’ উপাধি সংযুক্ত করিয়া দিয়াছেন। যেমন :

‘রায় রায়ে সুকৃপণে, পীরালী দ্বিজনন্দনে’

অন্যত্র :

“ভাল খেল্‌লে ঠাকুরালী, রায় রেঁয়ে পীর আলী,
ফুলের মুখে বসে ঠাকুর।

— বিশ্বকোষ, ১১ খণ্ড, ৪৮৫ পৃ।

গুড়বংশীয় রায়চৌধুরীগণের রায়রাইয়া উপাধি ছিল কি না বলা যায় না।

৬. এই সিঙ্গি বৰ্ত্তমান সিঙ্গিয়া রেলওয়ে ষ্টেশন ও তাহার সন্নিকটবর্ত্তী স্থান।

৭. কুশদহ, ১৩২১, শ্রাবণ, ১৬১-৩ পৃ।

৮. রায়চৌধুরীগণের বংশাবলী পরিশিষ্টে প্রদত্ত হইবে। এখনও গুড় চৌধুরীবংশীয় বহুব্যক্তি মহেশপুরে বাস করিতেছেন। তাঁহাদের অনেকের জমিদারী আছে। ইঁহারা পূর্ব্বে বেনাপোল, বনগ্রাম প্রভৃতি স্থানে বাস করেন; কিন্তু সে সব স্থানে বংশলোপ হইয়াছে। পরবর্ত্তী খণ্ডে ‘মুসলমান-সমাজ’ দ্রষ্টব্য।

৯. কথিত আছে, ঠাকুরবংশের এক পূর্ব্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারি খুলনা জেলার মিঠাভোগ গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া, কালীঘাটের সন্নিকটে গোবিন্দপুরে আসিয়া বাস করেন। সে সময়ে গোবিন্দপুরে জেলে, মালো, কৈবর্ত্ত প্রভৃতি জাতির বাস ছিল; তাঁহারা নবাগত ব্রাহ্মণকে ‘ঠাকুর’ বলিয়াই ডাকিতেন। তদবধি পঞ্চানন ও তাঁহার বংশীয়গণের ঠাকুর উপাধি সৰ্ব্বজনবিদিত হইয়া যায়। শুধু এ বংশের নহে, আরও অনেক বংশে এরূপ ঠাকুর উপাধি ছিল। ব্রাহ্মণকে অন্য জাতিতে সাধারণতঃ ঠাকুর বলিয়া সম্বোধন করেন। তবে কীর্তিগৌরবে কলিকাতার ঠাকুর-বংশের মত আর কেহ অনন্যোপাধিক হন নাই।

১০. বিশ্বকোষ, পীরালি প্রবন্ধ, ১১ খণ্ড, ৪৮৪ পৃ; Furrell, T. W. The tagore Family, P. ১৯; পুরুষোত্তম বড় পণ্ডিত এবং বহুগ্রন্থ- লেখক বলিয়া খ্যাত।

১১. জয়রাম আমীন ঠাকুর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালীকৃষ্ণ ঠাকুর, কবিচূড়ামণি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর, গুণেন্দ্রমোহন ঠাকুর, মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, প্রফুল্লনাথ ঠাকুর প্রভৃতি ঠাকুর-বংশীয় বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি উক্ত রায়চৌধুরী-বংশে বিবাহ করেন।

১২. ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাসে’র পীরালিকাণ্ড প্রধানতঃ এই অক্লান্ত সাহিত্যসেবী ব্যোমকেশের লেখনীপ্রসূত। তাঁহার অকালমৃত্যুতে পরিষদের প্রভূত ক্ষতি হইয়াছে।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. ২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. ৩. নদী-সংস্থান
৪. ৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. ৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. ৬. সুন্দরবন
৭. ৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. ৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. ৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. ১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. ১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. ১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
১৩. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
১৪. ২. দ্বীপের প্রকৃতি
১৫. ৩. আদি হিন্দু-যুগ
১৬. ৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
১৭. ৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
১৮. ৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
১৯. ৭. মাৎস্য-ন্যায়
২০. ৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
২১. ৯. সেন-রাজত্ব
২২. ১০. সেন-রাজত্বের শেষ
২৩. ১১. আভিজাত্য
২৪. ১. তামস যুগ
২৫. ২. বসতি ও সমাজ
২৬. ৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
২৭. ৪. খাঁ জাহান আলি
২৮. ৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
২৯. ৬. পয়োগ্রাম কসবা
৩০. ৭. খালিফাতাবাদ
৩১. ৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৩২. ৯. হুসেন শাহ
৩৩. ১০. রূপ-সনাতন
৩৪. ১১. লোকনাথ
৩৫. ১২. হরিদাস
৩৬. ১৩. রামচন্দ্র খাঁ
৩৭. ১৪. গাজীর আবির্ভাব
৩৮. ১৫. মুকুট রায়
৩৯. ১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
৪০. ১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
৪১. পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
৪২. পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
৪৩. পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
৪৪. পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন