৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক

সতীশচন্দ্র মিত্র

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – সমতটে চীন-পৰ্য্যটক

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে ৪০০ খৃষ্টাব্দে ফা-হিয়ান নামক একজন চীনদেশীয় ভ্রমণকারী ভারতবর্ষে আগমন করেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ এবং মূর্ত্তি সংগ্রহই তাহার প্রধান সাধনা ছিল, সুতরাং তাহার বিবরণীতে দেশের কোন বিশেষ ইতিহাস নাই। তিনি সমতটে আসেন নাই, সাধারণভাবে ভারতবাসীর চরিত্র সম্বন্ধে দুই চারি কথা লিখিয়া গিয়াছেন।

মহারাজ হর্ষবর্দ্ধনের রাজত্বকালে সুবিখ্যাত ইউয়ান চোয়াং এদেশে আসেন। তিনি ৬২৯ হইতে ৬৪৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত কাল মধ্যে ভারতবর্ষের অধিকাংশ স্থান পরিদর্শন করেন। তাহার বিরাট বিবরণীতে ভারতের তাৎকালিন ইতিহাস সম্বন্ধে বহু প্রয়োজনীয় কথা আছে। তিনি ৬৩৯ খৃষ্টাব্দে সমতটে আসেন। তাঁহার বর্ণনা হইতে বুঝা যায় যে, সমুদ্রকূলবর্ত্তী সমস্ত উপবঙ্গ বা গাঙ্গেয় বদ্বীপ সমতটের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[১] তাঁহার বিবরণী হইতে জানা যায়, তিনি ‘কামরূপ হইতে দক্ষিণ মুখে ১২/১৩ শত লী ভ্রমণ করিয়া সমতট দেশে উপনীত হন। এই দেশ সমুদ্রকূলে অবস্থিত বলিয়া নিম্ন এবং আর্দ্র। ইহার পরিধি ৩০০০ লী এবং ইহার রাজধানীর পরিধি ২০ লী হইবে। এদেশে ৩০টির অধিক বৌদ্ধ সংঘারাম এবং স্থবির সম্প্রদায়ের ২০০০ এর অধিক শ্রমণ ছিলেন। শতাধিক দেবমন্দির ছিল এবং নানা মতাবলম্বী লোক যেখানে সেখানে মিলিয়া মিশিয়া বাস করিত। এদেশে দিগম্বর নির্গ্রন্থ জৈনদিগের সংখ্যাও যথেষ্ট। রাজধানীর সন্নিকটে একটি অশোকস্তূপ ছিল; এই স্থানে বুদ্ধদেব স্বয়ং ৭ দিন পর্যন্ত দেবমানব-সকাশে স্বীয় ধর্ম্মমত প্ৰকাশ করিয়াছিলেন। ইহা ব্যতীত চারিজন বুদ্ধের কর্ম্মক্ষেত্র ও আশ্রমের চিহ্নও বর্তমান ছিল। রাজধানীর সন্নিকটে একটি বৌদ্ধমঠে বুদ্ধদেবের আট ফুট উচ্চ একটি গাঢ় নীলবর্ণ সুন্দর মূর্ত্তি ছিল। ইহাতে বুদ্ধমূর্তির যাবতীয় বিশিষ্ট চিহ্ন প্রকটিত ছিল এবং মূর্ত্তি হইতে বিস্ময়করী শক্তি বিকীর্ণ হইত। পৰ্য্যটক অবশেষে ক্রমান্বয়ে সমতটের সন্নিকটবর্ত্তী ৬টি দেশের নামোল্লেখ করিয়াছিলেন। তিনি এ সকল দেশ স্বয়ং পরিদর্শন করেন নাই; তিনি উহাদের সম্বন্ধীয় বিবরণ সমতটের রাজধানীতে সংগ্রহ করিয়াছেন।’[২] ইউয়ান চোয়াং সমতট সম্বন্ধে আরও লিখিয়া গিয়াছেন যে, এই স্থানের ভূমি উর্ব্বরা, লোক সকল ক্ষুদ্রাকৃতি, কৃষ্ণকায় এবং তীক্ষ্ণবুদ্ধি। চৈনিক সাধু এদেশে বহু পণ্ডিতের সমাবেশ দেখিয়া অতিশয় বিস্মিত হইয়াছিলেন।[৩]

সমতট যে গাঙ্গেয় উপদ্বীপ, তাহাতে সন্দেহ নাই। তবে চীনপর্যটকের বিবরণ হইতে ইহার রাজধানীর অবস্থান নির্দ্দেশ করা কঠিন। ইউয়ান চোয়াং যে দূরত্ব নির্দ্ধারণ করিয়া দিয়াছেন, তাহা হইতে বুঝা যাইতেছে যে সমতটের রাজধানী গাঙ্গেয় উপদ্বীপের মধ্যস্থলে অবস্থিত; উহা তাম্রলিপ্তি হইতে ৯০০ লী পূৰ্ব্বে। পূৰ্ব্বে উক্ত হইয়াছে যে, পর্যটক কামরূপ হইতে ১২/১৩ শত লী দক্ষিণে আসিয়া সমতট রাজ্যে পড়েন। ৬ লী এক মাইলের সমান ধরিয়া লওয়া হইয়া থাকে। এই হিসাবে দূরত্ব মাপিয়া নানাজনে এই রাজধানী নানাস্থানে স্থাপিত করিয়াছেন! ফার্গুসন বলেন সমতটের রাজধানী সোণার গাঁও বা সুবর্ণগ্রাম ছিল; ওয়ার্টাস (Watters) সাহেব বহু গবেষণা করিয়া বলিতেছেন যে, ইহা ফরিদপুর জেলার দক্ষিণাংশে অবস্থিত, কোথায় তাহা দূরে বসিয়া ঠিক করিয়া বলেন নাই। কানিংহাম সাহেব তাঁহার বিখ্যাত ভারতীয় প্রাচীন ভূগোলে যেমন বহুস্থানের অবস্থান নির্দ্দেশ করিয়াছেন, তেমন ভাবে বহু বিবেচনা করিয়া এই প্রাচীন রাজধানী মুড়লী বা বৰ্ত্তমান যশোহর সহরের সন্নিকটে স্থির করিয়াছেন। আমরা তাঁহার গণনা প্রণালীর সম্পূর্ণ অনুমোদন করিয়া বলিতে চাই যে, রাজধানী মুড়লীর সন্নিকটেই ছিল। এই রাজধানী ঠিক মুড়লীতে থাকাও বিচিত্র নহে, কারণ ইহা অতি প্রাচীন স্থান। তবে বহু বিষয় পর্যালোচনা করিয়া আমরা একটি অনুমান করিতেছি যে, প্রাচীন সমতটের রাজধানী মুড়লীর কয়েক মাইল উত্তরে বারবাজার নামক স্থানে ছিল। বারবাজারের বর্তমান অবস্থা বিচার করিলে, এই অনুমানের কারণ বাহির হইবে।

বর্তমান যশোহর নগরী হইতে ঠিক উত্তর দিকে দশ মাইল দূরে বারবাজার অবস্থিত। যশোহর হইতে ঝিনেদহ পৰ্য্যন্ত যে নূতন ছোট রেলওয়ে লাইন খুলিয়াছে, বারবাজার উহার একটি প্রধান ষ্টেশন। পূৰ্ব্বকালেও মুড়লী হইতে বারবাজার ও নলডাঙ্গার দিকে খুব বড় রাস্তা ছিল। উহাই বৰ্ত্তমানে ডিষ্ট্রীক্ট বোর্ডের রাস্তা হইয়াছে এবং এই ডিষ্ট্রীক্ট বোর্ডের রাস্তা দিয়াই রেলওয়ে লাইন গিয়াছে। বারবাজার ভৈরব নদের উত্তর পারে অবস্থিত। ভৈরব যখন পূর্ণ বিক্রমে প্রবাহিত হইত, তখন বারবাজারের অবস্থান অতি সুন্দর ছিল।

বারবাজারের এই সুন্দর অবস্থানই তাহাকে সমতটের প্রাচীন রাজপাট বলিয়া নিৰ্দ্দেশ করিবার প্রধান ও প্রথম কারণ। গৌড়, পাটলীপুত্র বা কর্ণসুবর্ণ হইতে পূৰ্ব্বাঞ্চলে আসিতে হইলে ভৈরবতটবর্ত্তী এই স্থানই প্রথম লোকের চিত্তাকর্ষণ করিত। বহু কীৰ্ত্তিচিহ্নমণ্ডিত, বহু প্রাচীন, বহু বিস্তৃত এবং অধুনা অধঃপতিত এমন কোন স্থান এ প্রদেশে আর নাই।

দ্বিতীয়তঃ, প্রাচীন ইষ্টকালয় নষ্ট হয়, মঠ ভাঙ্গিয়া মন্দির হয়, মন্দির ভাঙ্গিয়া মসজিদ হয়, মজিদ কালে লোকের বসতি বাটীতে পরিবর্তিত হয়, কিন্তু প্রাচীন জলাশয়ের তেমন পরিবর্তন হয় না। জলাশয় প্রায় জলাশয়ই থাকিয়া যায়, অথবা তাহার শুষ্ক খাত প্রাচীন মনুষ্যবাসের সাক্ষ্য দেয়। বারবাজারে জলাশয় অসংখ্য, লোকের মুখে প্রবাদ এই, তথায় ৬ বুড়ি ৬টা পুকুর অর্থাৎ ১২৬টি পুকুর আছে। ইহার অধিকাংশই দীর্ঘিকা বা দীঘি। কোনটি হিন্দুর কীর্ত্তি উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ, কোনটি মুসলমানের কীর্ত্তি পূর্ব্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ। কোন কোন মুসলমান উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ পুষ্করিণী খনন করিয়াছেন, কিন্তু কোন হিন্দু পূৰ্ব্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ জলাশয় খনন করেন না বা তাহার জল খান না। বারবাজারের অনেক পুকুরে এখনও বারমাস জল থাকে; এখানে জলকষ্ট নাই। আমরা কতকগুলি দীঘির নাম করিতেছি : রাজমাতা দীঘি, সওদাগর দীঘি, পীর পুকুর, মীরের পুকুর, ঘোড়ামারি পুকুর, গোড়ার পুকুর, চেরাগদানি দীঘি, গলাকাটির দীঘি, ভাই-বোন পুকুর, মনোহর পুকুর, সেখের পুকুর, কচুয়া, লোহাশলা, উভগাড়া, মিঠাপুকুর, নূনগোলা, খোনকার দীঘি, কানাই দীঘি, সাতপুকুর—এইগুলি রাস্তার পশ্চিম পারে এবং রাস্তার পূর্ব্ব পারে বাদেডিহি অংশে পাঁচ পীরের দীঘি, ছাতারে দীঘি, আলো খাঁ দীঘি, হাঁস পুকুর, বিশ্বাসের দীঘি, শ্রীরামরাজার দীঘি (৫৫০′×৩৫০′; উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ, পূর্ব্ব ও দক্ষিণ পারে বাঁধা ঘাটের ভগ্নাবশেষ, বারমাস সুন্দর জল থাকে, অতি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, পাহাড় এখনও ১০/১২ ফুট উচ্চ) এবং বেড়দীঘি অর্থাৎ শ্রীরামরাজার বাড়ীর চতুঃপার্শ্ববর্ত্তী গড়খাই বহু বিস্তৃত এবং পদ্মমণ্ডিত হইয়া অপূর্ব্ব শোভা বিস্তার করিতেছে। ইহা ব্যতীত ফেন-ঢালা, চাউল-ধোয়া, পিঠে-গড়া, ডাইল-ঢালা, কোদাল-ধোয়া প্রভৃতি চিরপরিচিত নামযুক্ত ছোট বড় অসংখ্য পুকুরের অভাব নাই। খুব কাছে কাছে এত জলাশয় কোথাও দেখি নাই। এতগুলি দীঘি ও পুষ্করিণী যে প্রাচীনত্বের প্রধান সাক্ষী হইতে পারে, তদ্বিষয়ে দ্বিমত নাই।

তৃতীয়তঃ, বারবাজারের ৩/৪ মাইল বিস্তৃত স্থান ইষ্টকস্তূপে পরিপূর্ণ। পশ্চিমদিকে কতকগুলি ১০/১২ হইতে ১৫/১৬ ফুট উচ্চ প্রকাণ্ড ভগ্নস্তূপ রহিয়াছে, উহার কোনটি অশোকের স্তূপ হওয়া বিচিত্র নহে। লোহাশলা নামে একটি পুকুর আছে, উহার সন্নিকটে কোন লৌহস্তম্ভ থাকিতেও পারে। হয়ত স্তম্ভের চতুঃপার্শ্ব খনন করিয়া তাহাকে এই পুষ্করিণীতে বিসর্জ্জন দেওয়া হইয়াছিল। কোথায়ও উচ্চ ঢিবি, কোথায়ও অট্টালিকার ভগ্নচিহ্ন, প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ এবং প্রস্তর স্তম্ভাদি ও সর্ব্বত্র বিস্তৃত ইষ্টকখণ্ড বারবাজারকে হিন্দু-বৌদ্ধ ও মুসলমানের মহাশ্মশানে পরিণত করিয়া রাখিয়াছে। যেখানে খনন করা যায়, সেই স্থানেই প্রায় ইষ্টকের প্রাচীর বাহির হইতেছে। লোকে তুলিয়া লইয়া গৃহভিত্তি, প্রাচীর, ইদ্‌গা ও মজিদ্ প্রভৃতি নির্ম্মান করিতেছে। যে সকল উচ্চ ঢিবি স্থানে স্থানে জঙ্গলাবৃত হইয়া রহিয়াছে, সাধারণ লোকে নানাবিধ ভয়ে সেগুলি খনন করিতে যায় না। গবর্ণমেণ্ট বা জেলার ম্যাজিষ্ট্রেটের চেষ্টায় উহার কতকগুলি খনিত হইলে অনেক প্রাচীনতত্ত্ব বাহির হইতে পারে।

চতুর্থতঃ, বারবাজারে স্থানে স্থানে কতকগুলি পাথর পড়িয়া আছে, উহা বৌদ্ধ আমলের প্রস্তর বলিয়া বোধ হয়। উপরোক্ত গোড়ার-পুকুরের পশ্চিমদিকে যে অভগ্ন মজিদ এখনও দণ্ডায়মান আছে, তাহার প্রাচীরগাত্রে চারিখানি প্রস্তরস্তম্ভ গাঁথুনির ভিতর প্রবেশ করান রহিয়াছে। এই মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি বাঁশ বাগানের মধ্যে একটি প্রস্তরস্তম্ভ মাটীতে পোঁতা রহিয়াছে। ৩′-৮′ মাত্র বাহিরে আছে, অধিকাংশই মৃত্তিকার নিম্নে প্রোথিত বলিয়া বোধ হয়। এই স্থান হইতে আরও পশ্চিমদিকে যাইতে পথের কাছে একখানি ১′-৯′ ×১′-৯′ পরিমিত সুন্দর কালো পাথরের পাদপীঠ পড়িয়া রহিয়াছে। চেরাগদানি পুকুরের পশ্চিম পারে মসজিদের উপর একখানি এবং গলাকাটি দীঘির দক্ষিণ পারে মসজিদের উপর একখানি পাথর আছে। আরও কত জঙ্গলের মধ্যে আছে বা দূরবর্ত্তী স্থানে স্থানান্তরিত হইয়াছে, তাহা জানিবার উপায় নাই। দেখিলেই বোধ হয়, এই হিন্দু বৌদ্ধ আমলের মঠ-মন্দিরের পাথরগুলি মুসলমানগণ সকল স্থানে কাজে লাগাইতে পারেন নাই। এই সকল প্রস্তর কোথা হইতে আসিল, সে সম্বন্ধে আমাদিগকে পরে বিশেষ বিচার করিতে হইবে।

পঞ্চমতঃ, মগধ ও বঙ্গের ইতিহাস আলোচনা করিয়া দেখা গিয়াছে যে, যেখানে কোন হিন্দু বা বৌদ্ধ-প্রতিপত্তির প্রধান স্থান ছিল, পাঠান আমলে মুসলমান প্রচারকগণ সর্ব্বাগ্রে সেই স্থানেই দেখা দিয়াছিলেন এবং মঠ বা মন্দির ভগ্ন করিয়া, জাতিধর্ম্মের উপর হস্তক্ষেপ করিয়া মুসলমান ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। বিশেষতঃ যেখানে বৌদ্ধ সংঘারাম ছিল, সেইখানেই তাঁহাদের অধিক আক্রোশ পড়িত, কারণ অহিংসাধর্মী, নিরীহ বৌদ্ধশ্রমণগণ শত্রুর আক্রমণে বিশেষ বাধা দিতে সক্ষম ছিলেন না এবং একটি সংঘারাম অধিকার করিতে পারিলে এককালে বহুলোককে মুসলমানধর্মে দীক্ষিত করা যাইত। যাহারা তাহাতে বাধা দিত, তাহারা অনেকস্থলে অসিমুখে নিপাতিত হইত। এইভাবে মগধের রাজধানী ওদন্তপুরীতে অসংখ্য মুণ্ডিতশীর্ষ শ্রমণ কালগ্রাসে পতিত হন। মুসলমান ঐতিহাসিক মীনহাজ উদ্দীন তাঁহার তবকাত্-ই-নাসিরি নামক গ্রন্থে ইহার বিশেষ বিবরণ দিয়াছেন। যেখানেই প্রাচীন হিন্দু বা বৌদ্ধনগরী ছিল, তাহাই এক্ষণে মুসলমানপ্রধান স্থানে পরিণত হইয়াছে। এ সকল মুসলমানই অন্যদেশ হইতে আসেন নাই। এই দেশীয় নানাজাতীয় লোক মুসলমান হইয়া গিয়াছেন। জাতীয় শক্তি বা বংশগৌরব লুপ্ত থাকিবার জিনিস নহে। যেখানে বিদেশ হইতে আগত প্রকৃত উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানের বংশ রহিয়াছে, সেখানে তখন তাঁহাদের চেহারায়, বিদ্যাচর্চ্চায় ও তেজস্বিতায় তাঁহাদিগকে চিনিয়া লওয়া যায়; আর যেখানে নিম্নশ্রেণীর হিন্দু মুসলমানধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়া মুসলমান হইয়াছিলেন, সেখানেই নিষ্প্রভ নিরক্ষর সম্প্রদায় গঠন করিয়াছেন। রাজধানী বালাণ্ডা মুসলমানের স্থান হইয়াছে,[৫] জগন্নাথপুরে হিন্দুর নাম উল্টাইয়া সেখহাটি হইয়াছে, পয়োগ্রাম-কায় হিন্দু একেবারেই নাই। বাগেরহাটে মুসলমান বারো আনা। বারবাজারেও হিন্দু নাই বলিলে অত্যুক্তি হয় না।

ষষ্ঠতঃ, এ দেশে যখন মুসলমান আক্রমণ আরম্ভ হয়, তখন তাহাদের প্রধান আস্তানা ছিল বারবাজার। যে বার আউলিয়া বা ফকিরগণ সুন্দরবন অঞ্চলে ধর্ম ও শস্যের আবাদ করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহাদের প্রথম আড্ডা হইয়াছিল বারবাজার। এই বারজন ফকিরের আস্তানার জন্য স্থানটির নাম রাখা হইয়াছিল বারবাজার। এইখানে গোরাইগাজী প্রথম জামলা গোদার গোদ ভাল করিয়া দেন, শ্রীরামরাজাকে মুসলমান ধর্ম্মে দীক্ষিত করেন। এক্ষণে বারবাজারের চারিপাশে সাদেকপুর, ইনায়েৎপুর, হাবাতপুর, পিরাজপুর, মুরাদগড়, মোল্লাডাঙ্গা, রহমপুর, বাদেডিহি, দৌলতপুর প্রভৃতি বহু মুসলমানী গ্রাম রহিয়াছে। পূর্ব্বে এস্থানে মুসলমান ছিলেন না। তাহার প্রমাণ ‘কালুগাজি ও চাম্পাবতী’ নামক মুসলমানী কেতাবে আছে। বারবাজারের যে অংশে শ্রীরামরাজার বাড়ীর ভগ্নাবশেষ আছে, উহারই পূর্ব্বনাম ছিল ছাপাইনগর। এখনও স্থানীয় মুসলমানেরা ছাপাইনগর জানেন। উহা এক্ষণে বাদুরগাছা মৌজার অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। কালু ও গাজি দুই ভাই যখন এইস্থানে আসিলেন, তখন—

‘যত প্রজা ছিল তথা সবে হিন্দুয়ান।
সেখানেতে নাহি ছিল এক মছলমান।’[৬]

সপ্তমতঃ, বারবাজার একেবারে মুসলমান হইয়া গেলেও এখনও কিছু কিছু হিন্দু বৌদ্ধের চিহ্ন আছে। বাদুরগাছার মধ্যে এখনও একটি কালীস্থান আছে। মুরদগড়ের গাঙ্গুলী মহাশয়েরা সেখানে পূজাদি করেন। বহু হিন্দুতে পূজা ও বলি দিতে আসে। দেবীর মন্দির এক্ষণে নাই, একটি অতি প্রকাণ্ড বটবৃক্ষ দেবীস্থানকে আশ্রয় দিয়াছে। রাজমাতার পুকুর, কানাইপুকুর প্রভৃতি কিছু প্রছন্ন তথ্য উদ্ঘাটিত করিয়া দেয়। নিকটবর্ত্তী রহমৎপুর, সাকোমতপুর, ও দেবরাজপুরে যোগী জাতির বাস এবং সাঁকো, সাজিয়ালি ও পয়োগ্রামে বণিকের বসতি আছে। এই যোগী ও গন্ধবণিক্ জাতির সহিত বৌদ্ধ সংঘারামের কি সম্বন্ধ আছে, তাহা আমরা পরে দেখাইব।

তত্ত্বদর্শী মহাপ্রাজ্ঞ কানিংহাম সাহেবের গণনার সহিত এই সকল কারণের সমাবেশ করিয়া আমরা বলিতে চাই যে, এই বারবাজারই ছিল সমতটের রাজধানী। ইহার পূর্ব্বনাম কি ছিল, তাহা নির্ণয় করিবার উপায় নাই। প্রাচীন নগরীর একাংশ যে ছাপাইনগর বা চাম্পাইনগর ছিল, তাহা আমরা দেখাইয়াছি।

৬৪৫ খৃষ্টাব্দে ইউয়ান চোয়াং স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তৎপরে সেঙ্গচি নামক একজন পৰ্য্যটক চীনদেশ হইতে জলপথে সমতটে আগমন করেন। তিনিও সমতটের রাজধানীতে আসিয়াছিলেন। তিনি তখন রাজভট্ট নামক একজন নৃপতিকে তথায় রাজত্ব করিতে দেখিয়া গিয়াছিলেন।[৭] ৬৭১ খৃষ্টাব্দে ইচিং (I-tsing) ভারতবর্ষে আসেন। তাঁহার বিবরণী হইতে জানা যায় সমতটের রাজা হো-লো-শে-পো-তো বা হর্ষভট্ট স্বয়ং বৌদ্ধমতাবলম্বী এবং বৌদ্ধদিগের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁহার রাজধানীতে যে বৌদ্ধশ্রমণের সংখ্যা ইউয়ান চোয়াংএর সময়ে ২০০০ ছিল, তাহাই ইচিং এর সময়ে ৪০০০ হইয়াছিল। ইউয়ান চোয়াং যাহাদিগকে প্রাচীন স্থবির মতাবলম্বী দেখিয়া গিয়াছিলেন, ইচিং এর সময় তাহারা গোঁড়া মহাযানী হইয়াছিল।

এক্ষণে প্রশ্ন হইতেছে, দুইটি। ১ম, ইউয়ান চোয়াং এর বিবরণী ভুক্ত সে বৌদ্ধ বিহারমালা, সেই সত্যনিষ্ঠ চীনদেশীয় সাধুর উল্লিখিত সমতটের সে ৩০টি সংঘারাম কোথায়? ২য়, এত যে নিষ্ঠাবান, বৌদ্ধ অধিবাসীতে দেশ জনাকীর্ণ ছিল, তাহারা কোথায় গেল? আমরা ক্রমে ক্রমে ইহার উত্তর দিবার চেষ্টা করিব।

পাদটীকা

১. Cunningham, Ancient Geography, P. 593.

২. Watters, Thomas. On Yuan Chwang’s Travels in India, Vol, II, P. 187.

৩. Beal. Buddhist Records, PP. 119-200; Julien. Hioven Thsang, PP. III, 81.

৪. Cunningham. Ancient Geography, PP. 501-2.

৫. ১৩২০ সালের সাহিত্য-সম্মিলনে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের অভিভাষণ।

৬. ‘কালুগাজি ও চাম্পাবতী’, ১৫ পৃ।

৭. Beal, Life of Hiven Tsiang, p. xxx; Watters – Vol. II. P. 188.

৮. Memoire, tr, by E. Chavannes, P. 128 and note.

৯. Record of the Buddhist Religion, tr. by J. Takakasu; Watters. Yuan Chwang P. 188.

সকল অধ্যায়

১. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. ২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. ৩. নদী-সংস্থান
৪. ৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. ৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. ৬. সুন্দরবন
৭. ৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. ৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. ৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. ১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. ১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. ১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
১৩. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
১৪. ২. দ্বীপের প্রকৃতি
১৫. ৩. আদি হিন্দু-যুগ
১৬. ৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
১৭. ৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
১৮. ৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
১৯. ৭. মাৎস্য-ন্যায়
২০. ৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
২১. ৯. সেন-রাজত্ব
২২. ১০. সেন-রাজত্বের শেষ
২৩. ১১. আভিজাত্য
২৪. ১. তামস যুগ
২৫. ২. বসতি ও সমাজ
২৬. ৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
২৭. ৪. খাঁ জাহান আলি
২৮. ৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
২৯. ৬. পয়োগ্রাম কসবা
৩০. ৭. খালিফাতাবাদ
৩১. ৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৩২. ৯. হুসেন শাহ
৩৩. ১০. রূপ-সনাতন
৩৪. ১১. লোকনাথ
৩৫. ১২. হরিদাস
৩৬. ১৩. রামচন্দ্র খাঁ
৩৭. ১৪. গাজীর আবির্ভাব
৩৮. ১৫. মুকুট রায়
৩৯. ১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
৪০. ১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
৪১. পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
৪২. পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
৪৩. পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
৪৪. পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন