সতীশচন্দ্র মিত্র
শিশুকাল হইতে আমরা গাজীর কথা শুনিয়া আসিতেছি। নিম্নবঙ্গে গাজীর কথা শুনেন নাই, এমন লোক পাওয়া যায় না। রামলক্ষ্মণের মত গাজীকালুর নামও এক সঙ্গে গ্রথিত। যশোহর-খুলনার নিম্নশ্রেণীর মধ্যে ‘মনসার ভাসান’ যেমন প্রচলিত, ‘গাজীর গীত’ও তেমনি। ইহাতে শুধু গীত নহে, ‘আলাপচারি’ ও আছে, অর্থাৎ গানের মাঝে মাঝে পাঁচালির মত গাজীকালুর জীবনকথা কথিত হয়। এক সময়ে এদেশে গাজীর গীত এত প্রচলিত ছিল, এবং উহার একই কথা লোকে শুনিতে শুনিতে এমন বিরক্ত হইয়া গিয়াছিল যে, ‘গাজীর গীতের আলাপ’ বলিলে, যে-কথা লোকে শুনিয়া শুনিয়া আর শুনিতে চাহে না, এমন কথা বুঝায়। গাজীর নামে এই দুই জেলায় কত গ্রামের নাম আছে, গাজীরহাট, গাজীরঘাট, গাজীপুরের অভাব নাই। লোকে কোনও কার্য্যে বল প্রয়োগ করিবার সময় গাজীর নাম স্মরণ করে। তবে গাজীর নাম সর্ব্বাপেক্ষা অধিক স্মরণ করে নৌকার দাঁড়িমাঝিরা। এই নদীমাতৃক দেশে গাজীসাহেব নাবিকদিগের আরাধ্য দেবতা হইয়া রহিয়াছেন। ঐ গাজীসাহেব কে? লোকে তাহার কথা যত শুনে, তেমন কি তাঁহাকে কেহ চিনে? দুস্তর নদীপথে নৌকা ছাড়িবার সময় যখন দাঁড়িমাঝি যথাস্থানে উপবিষ্ট হইয়া, দাঁড়ে ও হাইলে হস্তার্পণ করিয়া ভক্তিবিনত ধীর গভীরভাবে ‘গাজী বদর বদর’ বলিয়া প্রাণ খুলিয়া ডাকে তখন জানিতে ইচ্ছা হয়, এই ভাগ্যবান্ পুরুষেরা কে? আবার নদীতরঙ্গে নৃত্যের তালে তালে দাঁড় বাহিতে বাহিতে যখন দাঁড়ীরা গায় :
‘আমরা আজি পোলাপান, গাজী আছে নিখাবান।[১]
শিরে গঙ্গা দরিয়া, পাঁচপীর বদর বদর্॥’
তখন মনে হয়, শুধু গাজী এবং বদর নহে, নাবিকের আরাধ্য দেবতা আরও আছেন : গঙ্গাদেবী,—তিনি শুধু হিন্দুর সম্পত্তি নন, আর আছেন পাঁচপীর। এ পঞ্চদেবতা কে?
পূর্ব্ববঙ্গে যে গাজীর গীত প্রচলিত আছে, তাহার ভিতর পাঁচপীরের কথা পাই :
‘পোড়া রাজা গয়েস্দি, তা’র বেটা সমস্দি,
পুত্র তা’র সাই সেকেন্দর।
তার বেটা বরখান্ গাজী, খোদাবন্দ মুলুকের রাজী
কলিযুগে যা’র অবসর;
বাদসাই ছিঁড়িল বঙ্গে, কেবল ভাই কালুসঙ্গে
নিজ নামে হইল ফকির।’[২]
সুবর্ণগ্রামে এই পাঁচপীরের নামে একস্থানে পাঁচটি দরগা বা মন্দির আছে। শ্রীহট্ট সহরে উহাদের কবরস্থান ‘পাঁচপীরের মোকাম’ বলিয়া পরিচিত।[৩] আবার পাঁচপীর যে শুধু বঙ্গেই আছে, তাহা নহে। ভারতবর্ষের অনেকস্থানে পাঁচপীর আছে এবং স্বতন্ত্র লোক লইয়া সে সব স্থানে পাঁচপীর হইয়াছে। বঙ্গের পাঁচপীর—গায়উদ্দীন, সামসুদ্দীন, সেকেন্দর, গাজী ও কালু। কিন্তু গাজীর গীতে ইহাদের সহিত যে সম্বন্ধ দেখা যাইতেছে, তাহার সহিত ইতিহাস মিলে না। কেহ কেহ অনুমান করেন, গায়সুদ্দীন বলিতে দিল্লীর বাদশাহ্ গিয়াসুদ্দীন তোগ্লককে বুঝাইতেছে, কিন্তু তাঁহার সহিত সামসুদ্দীনের কোন সম্বন্ধ নাই। বাঙ্গালার এক বিখ্যাত গিয়াসুদ্দীন ছিলেন; কিন্তু তিনি সেকন্দর শাহের পুত্র। তাহা হইলে সেকেন্দরের পুত্র গাজী কে ছিলেন, বুঝা যায় না। মোটকথা, পাঁচজনের মধ্যে সামসুদ্দীন ও সেকেন্দরকে বিশেষরূপে চিনিতে পারা যায়। সামসুদ্দীন বঙ্গের প্রথম স্বাধীন পাঠান শাসনকর্তা, তাঁহার সময়েই শ্রীহট্টে শাহজালালের আগমন হইয়াছিল, তিনি তৎপুত্র সেকন্দরকে শ্রীহট্টে মুসলমান প্রতিপত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য প্রেরণ করেন। এইরূপ ভাবে স্বধর্ম্মগৌরব প্রতিষ্ঠিত করার মাহাত্ম্যে পিতাপুত্রে পীরশ্রেণীভুক্ত হন! পিতার মৃত্যুর পর সেকন্দর শাহ সিংহাসন লাভ করেন; তিনিও সুশাসক বলিয়া খ্যাতিসম্পন্ন ছিলেন। তাঁহারই সময় বাঙ্গালাদেশের জরিপ হয়; তিনি যে মাপের গজ ব্যবহার করিয়াছিলেন, উহাই সেকন্দরী গজ বলিয়া খ্যাত। এই সেকন্দরের ১৮ পুত্র; তন্মধ্যে গিয়াসুদ্দীন অন্য ১৭ জনকে নিহত করিয়া রাজা হন। সুতরাং সেকন্দরের পুত্র গাজী সাহেবের কোন বিবরণ পাওয়া দুষ্কর। বিশেষতঃ সেকান্দরের রাজত্ব কালে অর্থাৎ খৃষ্টীয় চতুৰ্দ্দশ শতাব্দীর শেষভাগে খাঁ জাহানের পূর্ব্বে কেহ মুসলমান ধর্ম্মপ্রচার জন্য যশোহরে আসিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না।
মুসলমানের ধর্ম্মশাস্ত্রে বলে, যিনিই বিধর্মীর সহিত যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া স্বধর্ম্ম প্রতিষ্ঠা করেন, তিনিই গাজী।[৪] শাহজালালের সময় হইতে ইসলাম ধৰ্ম্ম প্রচার করিতে বহুজন এদেশে আসিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে ২টি শ্রেণী আছে—আউলিয়া ও গাজী। আউলিয়া ও ফকিরগণ শান্তিপ্রিয়, তাঁহারা যুক্তিতর্কে বা কৌশলে হিন্দু বৌদ্ধকে নিজের ধর্ম্মে টানিয়া লইয়াছেন; গাজীদিগেরও উদ্দেশ্য এক, কিন্তু তাঁহারা বলপ্রয়োগ বা অত্যাচার করিতে কুণ্ঠিত নহেন। এই গাজীনামধারী রাজনৈতিক সন্ন্যাসিগণ প্রয়োজন মত রাজার সাহায্যে সৈন্যসামন্ত লইয়া রীতিমত যুদ্ধ এমন কি লুঠপাট করিতেন। আউলিয়াগণ প্ররোচনায়, সাধুজীবনের আদর্শে এবং জনহিতৈষিতার পরিচয়ে কার্য্যসিদ্ধি করিতেন; কিন্তু গাজীগণ ছলে বলে, কৌশলে, অবিচারে, অত্যাচারে দেশ উৎসন্ন করিয়াছিলেন। গাজীদিগের মধ্যে যে কেহ কেহ সাধু ছিলেন না তাহা নহে, তবে তাঁহাদের সংখ্যা অল্প। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে জাফর খাঁ গাজী ত্রিবেণীতে আসিয়াছিলেন। তিনি হিন্দুর মন্দির ভাঙ্গিয়া তাহার প্রস্তর দ্বারা এক প্রকাণ্ড মসজিদ নির্ম্মাণ করেন; সেখানে তিনি ও তাঁহার বংশীয়গণ সমাধিস্থ আছেন। জাফরগাজীর এক পুত্রের নাম বরখাগাজী; তিনি স্থানীয় হিন্দু রাজাকে পরাস্ত করিয়া তাঁহার কন্যাকে বিবাহ করেন। সেই বরখান্ গাজীও আমাদের প্রস্তাবিত ‘গাজীর গীতের’ বরখান্ গাজী এক ব্যক্তি বলিয়া মনে হয় না। কারণ, জাফর খাঁ মসজিদের পারসীক লিপিতে যে তারিখ আছে, তাহাতে ১২৯৪ খৃষ্টাব্দ হয়; কিন্তু সে সময়ে যশোহর জেলায় মুকুট রাজা প্রাদুর্ভূত হন নাই। সে যুগে যশোহর-খুলনার অনেক স্থান বসতির অনুপযুক্ত হইয়া পড়িয়াছিল। তবে উভয় বরখান্ গাজী যে জোর করিয়া রাজার কন্যা কাড়িয়া লইয়া বিবাহ করিয়াছিলেন, তাহা সত্য কথা। উক্ত জাফর খাঁর নিজেরই নাম বা তাঁহার কোন সহচরের নাম দরাফ খাঁ ছিল, তাহা জানা যায় না। দরাফ খাঁ যে শেষ জীবনে গঙ্গা-ভক্ত হইয়া অপূর্ব্ব গঙ্গাস্তোত্র রচনা করিয়াছিলেন, তাহা অনেকেই জানেন। সময়ে সময়ে গাজীদিগের মধ্যেও জাতিনির্বিশেষে অতিরিক্ত দয়ালু লোক দেখা যাইত, এজন্য আমাদের দেশে কোন অতিরিক্ত দয়ালু ব্যক্তিকে ‘দয়ার গাজী’ বলিয়া থাকে।
পূর্ব্বোক্ত পাঁচ পীরের অন্যতম গাজীর বিশেষ কোন নাম পাওয়া যায় না। তিনি সাধারণতঃ বরখান্ বা বড়গাজী এবং গাজী সাহেব বলিয়া পরিচিত। তাঁহার সম্বন্ধে একটি প্রচলিত গল্প আছে। তিনি রাজা মুকুট রায়কে পরাজিত করিয়া তাঁহার রাজ্য ও রাজধানী ছারখার করেন এবং তাঁহার কন্যা চম্পাবতীকে বিবাহ করেন। এই গল্পের ভিত্তি অবলম্বন করিয়া কয়েকজন মুসলমানী বাঙ্গালায় ‘গাজীকালু ও চম্পাবতী’ পুঁথি রচনা করিয়াছেন এবং ঢাকা ও কলিকাতা হইতে উহার কয়েকটি সংস্করণ বাহির হইয়াছে। যদিও এই সকল সুলভ অশুদ্ধ ‘বটতলার’ পুঁথি শিক্ষিত ব্যক্তির নিকট অনাদৃত, তবুও ইহা একশ্রেণীর লোকের যথেষ্ট চিত্ত-বিনোদন করিয়া থাকে। কর্ম্মবিরত নাবিকেরা রাত্রিকালে উন্মুক্তহস্তে প্রদীপে তৈল ঢালিয়া দিয়া সুরসংযোগে এই পুঁথি পাঠ করেন, তখন পার্শ্ববর্ত্তী তরণীমালা হইতে যথেষ্ট সাগ্ৰহ শ্রোতা উপস্থিত হয়। এই সকল পুস্তকের গ্রাম্য ভাষায় লিখিত তুষরাশির মধ্যে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য কিছু কিছু ঐতিহাসিক তথ্য লুক্কায়িত আছে। আমরা প্রথমতঃ এই পুঁথির স্কুলমর্শ দিয়া পরে ইহার ঐতিহাসিকতার বিচার করিব।
বিরাটনগরে সেকেন্দর শাহ রাজা ছিলেন, তাঁহার রাণী অজুপাসুন্দরী; তিনি বলিরাজার কন্যা, সুতরাং গঙ্গাদেবীর ভগিনীপুত্রী। ইঁহাদের প্রথম পুত্র জুলহাস, তিনি শিকারে গিয়া নিরুদ্দেশ হন। দ্বিতীয় পুত্র গাজী; ইহা ব্যতীত এক পালিত পুত্র ছিলেন, তাঁহার নাম কালু। রাজারাণী প্রাপ্তবয়স্ক গাজীকে রাজ্য দিতে চাহিলেন, কিন্তু তিনি কিছুতেই তাহা লইলেন না; রাজা হিরণ্যকশিপুর মত তাঁহার উপর কত অত্যাচার করিলেন, কিছুতেই ফল হইল না। গাজী গোপনে কালুকে সঙ্গে লইয়া পলায়ন করিলেন এবং বাঙ্গালাদেশে সুন্দরবনে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে বাঘ, কুমীর, সবই তাঁহার বশীভূত। কিন্তু নানাস্থান ভ্রমণ করাই ফকিরের রীতি বলিয়া গাজী ও কালু ছাপাইনগরে শ্রীরামরাজার দেশে পৌঁছিলেন; রাজবাটীতে অগ্নি লাগিল, রাণী অপহৃত হইলেন, অবশেষে যে দেশে একজনও মুসলমান ছিল না, সে দেশে সব মুসলমান হইয়া নিস্তার পাইল। ছাপাইনগরে একটি সুবর্ণমণ্ডিত মজিদ প্রস্তুত হইল। অবশেষে তাঁহারা সোণারপুরে ও পরে ব্রাহ্মণনগরে রাজা মুকুটরায়ের দেশে গেলেন। মুকুটরায়ের সাত পুত্র ও এক কন্যা, তাহার নাম চম্পাবতী। চম্পাবতীর মত সুন্দরী আর নাই; গাজী তাহাকে পাইবার জন্য পাগল হইলেন। মুকুটরায় যবনদ্বেষী ব্রাহ্মণ, তাঁহার দেশের সব ব্রাহ্মণ; তিনি আচারহীন বিধর্মীর মুখ দেখিলে ত্রিরাত্র অশৌচ প্রতিপালন করেন। মুকুটরায়ের কন্যার সহিত গাজীর বিবাহের প্রস্তাব করিতে কালু রাজদরবারে উপনীত হইলেন; রাজা মুসলমানের আস্পর্দ্ধা দেখিয়া কালুকে বন্দী করিলেন। তখন গাজীর সহিত প্রকাশ্য যুদ্ধ বাধিল। গাজী অসংখ্য ব্যাঘ্র সৈন্য লইয়া গোপনে নদী পার হইয়া মুকুটের রাজপুরী আক্রমণ করিলেন। মুকুটরায়ের এক দিগ্বিজয়ী বলশালী সেনাপতি ছিলেন, তাঁহার নাম দক্ষিণরায়। তিনি কুমীর লইয়া গাজীর সহিত যুদ্ধ করিতে আসিলেন, কিন্তু ডাঙ্গায় কুমীরে কি বাঘের সঙ্গে পারে? দক্ষিণরায় গদাহস্তে গর্জিয়া আসিয়া গাজীর ‘আসা’ ভাঙ্গিয়া দিলেন। কিন্তু দৈবশক্তিতে অবশেষে তাঁহাকে পরাজিত হইতে হইল। গাজী দক্ষিণায়ের কাণ কাটিয়া, ‘বার হাত লম্বা’ টিকি কাটিয়া তাহাতে বাঁধিয়া রাখিলেন। এবার ‘বারকোটী নয় শত সেনা’ ও ‘লক্ষ লক্ষ তোপতীর’ প্রভৃতি লইয়া মুকুটরায় স্বয়ং যুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন; দিনে দিনে যুদ্ধ চলিতে লাগিল, প্রত্যহ রাত্রিতে মুকুটরায় তাঁহার ‘মৃত্যুজীব কুপ’ হইতে জল ছিটাইয়া হাতী, ঘোড়া, লোকজন সব বাঁচাইয়া দিতেন। তখন গাজী গরু মারিয়া রক্ত দিয়া কূপের সে শক্তি নষ্ট করিয়া দিলেন। আর মুকুটরায়ের উদ্ধার নাই। গাজীর লোকেরা রাজবাটীতে যেখানে সেখানে প্রবেশ করিয়া অমানুষিক অত্যাচার করিতে লাগিল; অবশেষে সকলে গাজী কালুর পদানত হইল। রাজারাণী পাত্রমিত্র সকলে পৈতা ছিঁড়িয়া কলমা পড়িলেন এবং ‘ঝুটি কাটিয়া’ মুসলমান হইলেন। গাজীর সহিত চম্পাবতীর বিবাহ হইল এবং চম্পাকে গাজী লইয়া গেলেন। পথে একদিন গাজী দেখিলেন, এক নদীর কূলে তিনশত যোগী তপে নিযুক্ত আছেন: গাজী গঙ্গাকে ডাকিয়া যোগীদিগের অভীষ্ট কমলে-কামিনী দর্শন করাইলেন; যোগীরা মুসলমান ধর্ম্মের মত ধৰ্ম্ম নাই দেখিয়া ‘ঝুট কাটিয়া’ মুসলমান হইল। পরে পাতালপুরী হইতে জুলহাসকে লইয়া গাজী, কালু ও চম্পা সাগর পার হইয়া বিরাটনগরে গেলেন। ইহাই পুঁথির স্থূল কথা।
এখানে সর্ব্বপ্রথম বিরাটনগর, পরে ছাপাইনগর, সোণারপুর ও ব্রাহ্মণ নগর, এই চারিটি স্থানের নাম পাইতেছি। বিরাটনগর কোথায়? গাজী সেকেন্দরশাহের পুত্র হইলে এই অজানিত বিরাটনগরের রাজধানীর কথা উঠিবে কেন? সেকেন্দর শাহ গৌড়াধিপ ছিলেন। আরও দেখা যাইতেছে, সমুদ্র পার হইয়া গাজী সুন্দরবনে আসিলেন। তাহা হইলে পূৰ্ব্ববঙ্গ বা উড়িষ্যা হইতে আসাই সম্ভব। যখন পূর্ব্ববঙ্গে গাজী-কালুর সমাধিস্থান দেখিতে পাইতেছি, তখন পূৰ্ব্ববঙ্গই তাঁহাদের পূর্ব্ব নিবাস ছিল বলিয়া অনুমান করিতে পারি। বঙ্গের সুলতানের সহিত তাঁহাদের কোন সম্বন্ধ না থাকাই সম্ভব; হয়ত তিনি সেকেন্দরনামধারী অন্য কোন প্রাদেশিক রাজার পুত্র ছিলেন। তিনি সংসার ত্যাগ করিয়া কোন বণিকের জাহাজে বর্ত্তমান খুলনা জেলার দক্ষিণাংশে কোথায়ও অবতরণ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। আমরা পূর্ব্বে দেখাইয়াছি, যাঁহারা মুসলমান ধর্ম্ম প্রচার করিতে আসিয়াছিলেন, বৌদ্ধপ্রধান প্রাচীন স্থানের উপরই তাঁহাদের প্রথম লক্ষ্য হইত। বিশেষতঃ সে সময়ে গাঙ্গেয় উপদ্বীপের সব স্থানে বসতি হয় নাই, প্রাচীন বৌদ্ধস্থানগুলিই সকলের পরিজ্ঞাত ছিল। বারবাজার ও হাতিয়াগড় কিরূপে বৌদ্ধ আমলে প্রধান স্থান ছিল, তাহা আমরা দেখাইয়াছি। গাজীর প্রথম দৃষ্টি এই দিকে পড়াই সম্ভব এবং তাহাই পড়িয়াছিল। গাজীর ছাপাইনগর চাঁদসওদাগরের নাম-সংযুক্ত চাম্পাইনগরে নহে। অনেক অনুসন্ধানের ফলে দেখিয়াছি, ইহা বারবাজারেরই একাংশ।
বর্তমান বারবাজার রেলওয়ে ষ্টেশনের পূর্ব্বদিকে এক মাইল পথ অগ্রসর হইলে, একটি প্রকাণ্ড দীঘি দেখিতে পাওয়া যায়। উহাকে সাধারণ লোকে শ্রীরাম রাজার দীঘি বলে। ঐ দীঘির দক্ষিণ ও বাদরগাছার পশ্চিমাংশকে পূর্ব্বে ছাপাইনগর বলিত। স্থানীয় বৃদ্ধ মুসলমান অধিবাসীরা এখনও ছাপাই নগর জানেন। এখন ছাপাইনগর উক্ত বাদুরগাছা মৌজার অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে; কিন্তু সেখান হইতে শ্রীরাম রাজার গড়বেষ্টিত বাড়ী লুপ্ত হয় নাই। শ্রীরাম রাজার দীঘি অতি সুন্দর জলাশয়; উহা উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ; জলে শৈবালাদি নাই, পাহাড় অতি উচ্চ, জল নিৰ্ম্মল। পূৰ্ব্ব ও দক্ষিণ তীরে প্রকাণ্ড বাঁধা ঘাটের ভগ্নাবশেষ আছে। এই দীঘি হইতে একটু পূৰ্ব্বদিকে অগ্রসর হইলেই শ্রীরাম রাজার বাড়ী দেখা যায়। সে বাড়ীর চারি ধার নদীর মত বিস্তৃত গড়ের দ্বারা বেষ্টিত। সে গড়ে এখনও জল আছে, এবং রাশি রাশি প্রস্ফুটিত পদ্মে সমাচ্ছন্ন হইয়া অপূৰ্ব্ব নয়নাভিরাম শোভা বিস্তার করে। এই গড়খাই এত বিস্তৃত, গভীর এবং দুর্গম যে, উহা পার হইয়া ভগ্নবাটীতে যাওয়ার উপায় নাই। সে বাটী বাঁশের ঝোপ ও বন্য বৃক্ষে সমাচ্ছন্ন হইয়া শ্বাপদসমূহের আশ্রয়স্থান হইয়াছে। সেখানে বাঘ বোধ হয় সর্ব্বদা আছে এবং স্থানীয় লোকের বিশ্বাস ঐ পরিখাবেষ্টিত বাড়ীর দক্ষিণ তীরে এক বৃহস্পতিবারে গাজী সাহেব প্রথম জাহির বা প্রকাশ হন বলিয়া প্রতি বৃহস্পতিবারে রাত্রিতে সে স্থানে ব্যাঘ্র নিশ্চয় আসিয়া থাকে, কারণ গাজী ব্যাঘ্রের দেবতা। পথে আসিতে আসিতে গাজীর সহিত অনেক শিষ্য জুটিয়াছিল, তিনি দলবদ্ধ হইয়া শ্রীরাম রাজার বাড়ীর দক্ষিণে পরিখাপারে যেখানে প্রথম আস্তানা করিয়াছিলেন, তথায় একটি অতি প্রকাণ্ড বহুবর্ষজীবী বটবৃক্ষ সাক্ষীর মত এখনও দণ্ডায়মান আছে। যাহা হউক, গাজী- কালু এখানে শ্রীরাম রাজার উপর অমানুষিক অত্যাচার করিয়া দেশশুদ্ধ হিন্দু-বৌদ্ধকে মুসলমান করিয়া, মজিদ প্রতিষ্ঠা করিয়া চলিয়া যান। শ্রীরাম রাজা সপরিবারে নিহত হন। কথিত আছে, তাঁহার একটি মাত্র নাবালক পুত্র অজিতনারায়ণ কোন এক দাসীর কৌশলে রক্ষা পায়। তাঁহারই পুত্র রাজা কমলনারায়ণ রায় বোধখানায় বাস করেন এবং তিনি বোধখানার বিখ্যাত চৌধুরী বংশের আদি পুরুষ। বিশেষ বিবরণ পরবর্ত্তী খণ্ডে প্রদত্ত হইবে।৫ গাজীর এই অত্যাচারকাহিনী গাজী কালু ও চম্পাবতী’ পুঁথিতেও প্রকাশিত।
বারবাজারের একটু দক্ষিণে মাস্লে-হাসিলবাগ নামক গ্রামে এক হাট হইত, ঐ হাটের নাম াদরেরহাট। নৌকার মাঝিরা যে বদরের নাম না উচ্চারণ করিয়া নৌকা ছাড়েন না, সেই বদরের নামেও এ হাট হইতে পারে। এই বদর উদ্দীন একজন প্রসিদ্ধ পীর, চট্টগ্রাম সহরে পীর বদরের কবর আছে। হাসিলবাগে আসিয়া শ্রীরাম তাঁতির উপর গাজী সাহেব অনুগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তাহাকে ধনী করিয়া দেন। তিনি জামলাগোদা নামক এক ব্যক্তির গোদ আরোগ্য করিয়া দেন। পুঁথিতেও তাহার বিশেষ উল্লেখ আছে। স্থানীয় লোকে বলেন যে, তাহারা শুনিয়াছেন, গাজী এখান হইতে কুনিয়ানগরে গিয়া মটুক রাজার কন্যাকে বিবাহ করেন। পুঁথিতে কিন্তু কুনিয়ানগরের স্থলে ব্রাহ্মণনগর আছে। আমরা সে কথা পরে বলিব।
বারবাজার হইতে গাজী কালু সোণারপুর গিয়াছিলেন। এই সোণারপুর হাতিয়াগড়ের অন্তর্গত। চব্বিশ-পরগণা জেলায় কলিকাতা হইতে দক্ষিণ মুখে যাইবার রেলওয়ে পথে এখনও সোণারপুর একটি প্রসিদ্ধ জংসন ষ্টেশন। সোণারপুরে গাজী, কালু প্রভৃতি সকলে মসজিদে গিয়া পৌঁছিয়াছিলেন বলিয়া পুঁথিতে বিবৃত আছে। সম্ভবতঃ গাজী-কালুর পূর্ব্বে ত্রিবেণী হইতে বরখান্ গাজী এই অঞ্চলে স্থানে স্থানে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। সোণারপুর তখনও একটি সুন্দর সহর ছিল। এই স্থানে কিছুকাল অধিষ্ঠান করিয়া গাজী মুকুট রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। এই মুকুট রায় কে?
পাদটীকা :
১. পোলাপান-শশুগণ; নিখাবান-রক্ষাকর্তা।
২. যতীন্দ্রমোহন রায়, ‘ঢাকার ইতিহাস’, ১ম খণ্ড, ৪২৪ পৃ।
৩. ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’, দ্বিতীয়ভাগ, ২য় খণ্ড, ৪৭ পৃ।
৪. ‘Ghazi signifies a conqueror, one who makes war upon infidels’-Tabakat-i-Nasiri (Raverty), P. 70, note-2.
৫. পরবর্ত্তী খণ্ড, মোগল আমল, ‘বোধখানার চৌধুরীবংশ’ দ্রষ্টব্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন