৭. মাৎস্য-ন্যায়

সতীশচন্দ্র মিত্র

সপ্তম পরিচ্ছেদ – মাৎস্য-ন্যায়

হর্ষবর্দ্ধনের মৃত্যুর পর দেশ ভরিয়া বিষম বিপ্লব উপস্থিত হয়। এই সময়ে মহারাজ যশোবর্ম্মা কান্যকুব্জের সিংহাসন অধিকার করিয়া দিগ্বিজয়ে বহির্গত হন। কিন্তু গৌড় বঙ্গ বিজয় করিয়া প্রত্যাগত হইবার অব্যবহিত পরেই কাশ্মীরপতি ললিতাদিত্য আসিয়া তাঁহাকে কান্যকুব্জ হইতে বিতাড়িত করেন। গৌড়াধিপ তখন ললিতাদিত্যের অধীনতা স্বীকার করিয়া সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন। কিন্তু তিনি কাশ্মীরে গেলে ললিতাদিত্য তাঁহার হত্যাসাধন করিয়া বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দেন। এই ললিতাদিত্যের পৌত্র জয়াদিত্য বা জয়াপীড়। কহলণ-প্রণীত রাজ-তরঙ্গিনী হইতে জানিতে পারি, জয়াপীড় রাজ্যারোহণ করিয়া পৌণ্ড্রবর্দ্ধনে ভ্রমনার্থ আসিয়া, রাজা জয়ন্তের কন্যা কল্যাণীদেবীকে বিবাহ করেন এবং স্ববলে রাজ্যজয় করিয়া শ্বশুরকে পঞ্চগৌড়েশ্বর করিয়া যান।

এই জয়ন্তই আদিশূর কিনা, তদ্বিষয়ে নানা মতভেদ আছে।[১] ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ প্রণেতা নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় প্রমাণ করিয়াছেন যে, জয়ন্তই পঞ্চ গৌড়েশ্বর হইয়া আদিশূর উপাধি ধারণ করেন। অনেকে এই মতের পোষকতা করিয়াছেন।[২] যতদিন বিপক্ষে কোনও প্রকৃষ্ট প্রমাণ না পাওয়া যায়, ততদিন এই মতই সমীচীন বলিয়া মনে করি। সম্ভবতঃ আদিশূর পরে বিক্রমপুরের অন্তর্গত রামপালে রাজধানী স্থাপন করেন; এবং সেখানেই যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া কান্যকুব্জ হইতে পঞ্চ ব্রাহ্মণ ও পঞ্চ কায়স্থ আনয়ন করেন। তাঁহার জামাতা জয়াপীড়ের সাহায্যেই এ ব্যবস্থা হইয়াছিল।

জয়ন্ত পঞ্চগৌড়েশ্বর ছিলেন নামে মাত্র। এই সময়ে গৌড়রাজ্যের উপর গুর্জ্জর, রাষ্ট্রকূট প্রভৃতি নানাদিক হইতে আক্রমণ হইতেছিল। এবন্বিধ বহিঃশত্রুর আক্রমণ জন্য গৌড়রাজ্যে তখন মাৎস্য-ন্যায় বা অরাজকতা উপস্থিত হইয়াছিল। তখন জনসাধারণ দৈশিক শান্তির জন্য পালবংশীয় গোপালকে পাটলীপুত্রে রাজা করিয়া প্রজাশক্তির প্রাধান্য স্থাপন করিয়াছিল।[৩] পাল ও শূর বংশীয়েরা একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে রাজত্ব করিতেছিলেন। গোপাল সমুদ্র পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করিয়াছিলেন।[৪] সমতটও তাঁহার রাজ্যান্তর্গত হইয়াছিল। গোপালের পৌত্র দেবপাল সৰ্ব্বাপেক্ষা প্রতাপশালী ছিলেন। তাঁহার মুঙ্গেরলিপি হইতে জানা যায় যে, তিনি উত্তর-দক্ষিণে হিমালয় হইতে সেতুবন্ধ এবং পূর্ব্ব-পশ্চিমে সিন্ধু হইতে সিন্ধু পর্য্যন্ত সমগ্র ভারত নিঃসপত্নভাবে উপভোগ করিয়াছিলেন। তাঁহার সময়ে শূরবংশীয়েরা বঙ্গ হইতে দক্ষিণ রাঢ়ে বিতাড়িত হন। দেবপাল সুশাসক ছিলেন, সম্ভবতঃ তাঁহার শাসনের সুফল যশোর রাজ্যে পৌঁছিয়াছিল। কিন্তু এইখানেই তাহার শেষ। ইহার পরে রাজার শাসন কি, যশোর-খুলনা অঞ্চল তাহা বহুকাল জানে নাই।

দেবপালের রাজত্বের পর পালরাজ্য উন্নতিহীন অবস্থায় ছিল। উন্নতি হইতেছিল শুধু ধর্ম্মের। পালনৃপতিগণ সকলেই বৌদ্ধ ছিলেন, বৌদ্ধধৰ্ম্মও দেশময় বিস্তৃত হইয়া পড়িতেছিল। দেবপালের পর পাঁচজন নৃপতির পরে রাজা হইলেন মহীপাল। তিনি যুদ্ধবিগ্রহ এক প্রকার ত্যাগ করিয়া পরহিতকর এবং পারত্রিক মঙ্গলকর কার্য্যানুষ্ঠানে রত হইয়া ছিলেন। সুতরাং দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যাহা হইয়াছিল, তাহা সহজে অনুমেয়। তিব্বতীয় তারানাথের মতে তিনি ৫২ বৎসর রাজত্ব করেন এবং সারনাথে তাঁহার শিলালিপি হইতে জানা যায়, তিনি ১০২৬ খৃষ্টাব্দে জীবিত ছিলেন সমস্ত বঙ্গদেশ নানা খণ্ড-রাজ্যে বিভক্ত হইয়া পড়িল। পালরাজগণের সময়ে দক্ষিণ রাঢ়ে যেমন শূরবংশীয়েরা রাজত্ব করিতেছিলেন, উত্তর বঙ্গে রাজা ছিলেন ধাড়ি চন্দ্র, তাঁহার পুত্র সুবর্ণচন্দ্র, তাঁহার পুত্র মাণিকচন্দ্র।[৫] মাণিকচন্দ্রের পর তৎপুত্র, ‘পাটিকা নগরে রাজা গোবিন্দচন্দ্ৰ ভূপ’।[৬] গোবিন্দচন্দ্রের রাজত্ব বহুদূর বিস্তৃত ছিল।[৭] এই সময়ে মাণিকচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ধর্ম্মপাল রঙ্গুর অঞ্চলে এক রাজ্যস্থাপন করেন। যে ভবদেব বাল-বল্লভীভূজঙ্গ ভুবনেশ্বরে এক মন্দির নির্মাণ করিয়া দেববিগ্রহ স্থাপন করেন, তাঁহার উর্দ্ধতন সপ্তম পুরুষ প্রথম ভবদেব এই ধর্মপালের মন্ত্রী ছিলেন। এই ধর্মপালের সহিত পালবংশীয় ধর্মপালের কোন সম্বন্ধ নাই। এই সময়ে কর্ণাট ক্ষত্রিয়বংশীয় সামন্ত সেন রাঢ় দেশে এক রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন।

যখন মহীপাল সমস্ত গৌড়রাজ্যের রাজা, তখন রাঢ়ে সামন্ত সেন, দক্ষিণ রাঢ়ে রণশূর ও বঙ্গে গোবিন্দচন্দ্র রাজত্ব করিতেন। এই সময়ে সেনভূম প্রদেশে রাজা ছিলেন কর্ণসেন। প্রবাদানুসারে অজয় তটে ত্রিষষ্ঠী গড়ে তাঁহার রাজধানী ছিল। তাঁহাকে তাড়াইয়া ইছাই ঘোষ রাজা হন। রঙ্গপুরের ধর্মপালের সহিত কর্ণসেনের আত্মীয়তা ছিল। কিন্তু ধৰ্ম্মপাল ইছাই ঘোষের কিছু করিতে পারেন না। অনেক কাল পরে কর্ণসেনের পুত্র লাউসেন তাহার হত্যা সাধন করিয়া রাজ্যোদ্ধার করেন।[৮] মহীপালের রাজ্য পশ্চিমে কাশী পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই সময়ে পশ্চিম ভারতে মুসলমান আক্রমণকারিগণের আবির্ভাব হইতেছিল, তন্মধ্যে সৰ্ব্বপ্রধান গজনীপতি মামুদ। তিনি প্রবল বিক্রমে রাজ্যজয় ও দেশ ছারখার করিয়া হিন্দুর দেবদেবী ও মন্দিরাদির উপর অমানুষিক অত্যাচার করিয়া সমস্ত আর্য্যাবর্ত্ত বেপমান করিয়া তুলিয়াছিলেন।

‘নিগ্রহিয়া বিগ্রহের নিধি নিল হ’রে
হইল অলকা ভ্রান্তি গজনী নগরে।’

কিন্তু মামুদের সে দুর্দ্ধর্ষ অভিযান মহীপালের রাজ্যগণ্ডীতে প্রবেশ করিতে পারে নাই। মহীপাল যখন এই ভাবে পশ্চিম দিকে রাজ্য রক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময়ে কেশরিবংশীয় রাজেন্দ্রচোল দেব সমগ্র গৌড়রাজ্য আক্রমণ করেন। চোলরাজের তিরুমলয় পাহাড়ে উৎকীর্ণ প্রশস্তি হইতে জানা যায় যে, তিনি উড়িষ্যা (‘ওড্ডবিষয়’), দক্ষিণ রাঢ়ের (“তক্কণ লাড়ং’) অধিপতি রণশূর, বঙ্গ দেশের (‘বঙ্গাল’ দেশ) অধীশ্বর গোবিন্দচন্দ্র এবং মহাযোদ্ধা মহীপালকে পরাজিত করিয়া ছিলেন।[৯] কিন্তু তিনি যে যুদ্ধান্তে রাজ্যমধ্যে অগ্রসর হইয়া রাজ্যশাসন করিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, এমন কোন প্রমাণ নাই। স্থির জলাশয়ে লোষ্ট্রনিক্ষেপবৎ এইরূপ রাজ্যজয়ের ফল অধিক কাল স্থায়ী হইত না।

প্রকৃতপক্ষে যে মাৎস্য-ন্যায় দূরীভূত করিবার জন্য প্রজাগণ গোপালকে সিংহাসনে বসাইয়াছিল, সে মাৎস্য-ন্যায় যায় নাই। দেবপাল[১০] পৰ্য্যন্ত দেশে কতকটা শান্তি থাকিলেও তাঁহার পর হইতে শাসনের ফল আর অনুভূত হয় নাই। নানাস্থানে নানাবংশীয়েরা বিভিন্ন রাজ্য সংস্থাপন করায় প্রজাবর্গ সৰ্ব্বদা সুবিধামত পক্ষ অবলম্বন করিয়া কার্য্যতঃ এক প্রকার স্বাধীনভাবে বাস করিত। গৌড় বা মগধে ভূপাল মহীপাল যিনিই রাজা হন, তাহাতে তাহাদের কিছু আসিয়া যাইত না। তাহারা পাল বা সেন, ইছাই ঘোষ বা গোবিন্দচন্দ্র, সকলের রাজদণ্ড লাভে সম্মতি দিয়া স্বকীয় স্বার্থে কৃতপ্রযত্ন হইত। দেশের এই অবস্থা শোচনীয়।

সমতটের এবং তদন্তর্গত যশোর-খুলনার অবস্থা আরও ভীষণ। যদিও দক্ষিণাংশে অনেক স্থল তখনও জলমগ্ন ছিল, তবুও উত্তরাংশে ইহার বিস্তৃতি নিতান্ত কম ছিল না। নদনদীবেষ্টিত এই রাজ্যে রীতিমত রাজ্যশাসন না থাকায়, নানা দস্যুদুর্বৃত্তের অত্যাচার হইয়াছিল। নানাজনে নানাস্থানে রাজা বলিয়া পরিচয় দিয়া দশের উপর অত্যাচার করিয়া আত্মপোষণ করিত। দুই চারিখানি গ্রাম লইয়া এইরূপ এক এক রাজচক্রবর্ত্তী জাগিয়া উঠিত। রাজবাড়ী বা রাজপাটে দেশ ভরিয়া গিয়াছিল। যদি পরবর্ত্তী কালে বিপ্লবের পর বিপ্লবে এই সকল স্থান ধ্বসিয়া বসিয়া ধ্বংস প্রাপ্ত না হইত, তাহা হইলে ইতিবৃত্ত বিহীন কত ভগ্নাবশেষ যে তত্ত্বানুসন্ধিৎসুকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিত, তাহা বলা যায় না।

মহীপালের সময় তিব্বতদেশে নিষ্প্রভ বৌদ্ধধর্ম্মের পুনরুত্থান জন্য মহাপণ্ডিত ধর্মপালকে পাঠান হয়, কিন্তু মহীপালের পুত্র ন্যায়পালের রাজত্বকালে দীপঙ্কর অতীশ গিয়া সে কাৰ্য্য সুসম্পন্ন করেন। ন্যায়পালের পর আরও অন্যূন ৯ জন পালরাজা রাজত্ব করেন, কিন্তু সেন রাজগণের বর্দ্ধিত প্রভাবে তাঁহাদের রাজ্যসীমা ক্রমেই সঙ্কুচিত হইয়া আসিতেছিল। উক্ত ৯ জনের মধ্যে কুমারপালের নাম প্রসিদ্ধ।[১১] তাঁহার মন্ত্রী ছিলেন বৈদ্যদেব। এই সময়ে দক্ষিণবঙ্গে এক ভীষণ বিদ্রোহ উপস্থিত হয়। দক্ষিণবঙ্গ বলিতে তখন কতদূর বুঝাইত এবং যশোহর-খুলনার লোক এ বিদ্রোহে লিপ্ত ছিলেন কিনা, তাহা নির্ণয় করিবার উপায় নাই। বৈদ্যদেবের কমৌলি তাম্রশাসন হইতে জানা যায় যে, তিনি নদীবহুল দক্ষিণবঙ্গের বিদ্রোহিগণের সহিত জলযুদ্ধে বিজয়লাভ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার নৌবাহিনীর বিজয়োল্লাসরবে (‘নৌবাট হীহী রব’) দিসমূহ সন্ত্রস্ত হইয়াছিল।[১২] ইহা হইতে অনুমান করা যায়, সমতট তখনও কুমারপালের অধীন ছিল এবং তথাকার সামন্ত রাজগণ নৌযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করিতেন।

এ দিকে গোবিন্দ্রচন্দ্র বা গোপীচন্দ্র হারিপা নামক ডোমজাতীয় এক যোগীর নিকট ধর্ম্মদীক্ষা গ্রহণ করিয়া চিরজীবনের মত দেশত্যাগ করিলে, তাঁহার পুত্র ভবচন্দ্র রাজা হইলেন। ইহার এক মন্ত্রী ছিলেন, তাঁহার নাম গবচন্দ্র। উভয়েই সমান মূর্খ। ভবচন্দ্র রাজার গবচন্দ্র মন্ত্রী—এই উভয়ের নির্বুদ্ধিতার অসংখ্য গল্প বরেন্দ্রপ্রদেশে প্রচলিত আছে। তাঁহাদের সবই অদ্ভুত; রাজার আদেশে প্রজারা দিনে নিদ্রিত থাকিয়া রাত্রিতে রাজকর্ম্ম করিত, এরূপও শুনা যায়। রাজা ও মন্ত্রীর নিরেট মস্তিষ্কে যখন যে খেয়াল উঠিত, তাহাই পালন করিতে গেলে প্রজার দুর্দ্দশার সীমা থাকিত না। এমন রাজাকে প্রজারা কতকাল কিরূপভাবে মান্য করে, তাহা সহজবোধ্য। ভবচন্দ্র শুধু একজন নয়, বঙ্গদেশের নানাস্থানে তখন বহু ভবচন্দ্রের উদয় হইয়াছিল। ফল হইয়াছিল—দেশময় এক অরাজকতা; তাহার ঢেউ যে যশোর-খুলনা প্লাবিত করিয়া সমুদ্র-সীমান্ত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই।

এ অরাজকতার যুগে আমাদের প্রস্তাবিত যশোহর-খুলনার যেখানে সেখানে নানা ক্ষুদ্র রাজার আবির্ভাব হইয়াছিল। তাহার অধিকাংশ নিদর্শন কাল প্রভাবে বিলুপ্ত হইয়াছে। যশোহরের উত্তরে ও পশ্চিমে কয়েক স্থানে কৈবর্ত্তগণ রাজত্ব করিতেন। লোকে বলে যাদব রায় নামক এক কৈবর্তরাজ যাদবপুর স্থাপন করেন। কলারোয়া থানার মধ্যে ধানদিয়ার সন্নিকটে মানিঘরে এক তিয়র রাজা রাজত্ব করিতেন। তাঁহার দুর্গ, গড়খাই এবং অনেকগুলি দীঘির চিহ্ন এখনও বর্ত্তমান রহিয়াছে। এ সময়ে এ স্থানের অধিকাংশ জলপ্লাবিত ছিল। সেইজন্য তিয়র, কৈবর্ত জাতি এখানকার প্রধান অধিবাসী ছিল। বিদ্যানন্দকাটিতে অন্য এক রাজার গড়বেষ্টিত বাড়ী ছিল, তাহার নিদর্শন এখনও আছে। ডুমুরিয়ার কাছে ভরত ভায়না নামক স্থানে এক ভরত রাজা বাস করিতেন। নিকটবর্ত্তী অনেকগুলি গ্রামের উপর তাঁহার আধিপত্য ছিল। ইহার সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ পরবর্ত্তী পরিচ্ছেদে প্রদত্ত হইবে। সাতক্ষীরার সন্নিকটে যে গণরাজার কীর্ত্তিচিহ্ন বর্ত্তমান আছে, তিনিও এই যুগে প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন কি না বলা যায় না। যশোহর-জেলায় নবগঙ্গার তীরে সিঙ্গিয়ার সন্নিকটে নয়াবাড়ী গ্রামে এক পাতালভেদী রাজার দুর্গবাড়ীর ভগ্নাবশেষ আছে। ইনি পাতালভেদী-রাজা নামেই খ্যাত, ইহার বিশেষ কোন নাম জানা যায় না। কেহ কেহ বলেন সিঙ্গাশোলপুর প্রভৃতি স্থানে যে রায় উপাধিকারী শৌলোক-(সৌলুক) দিগের বাস আছে, পাতালভেদী রাজা সেই বংশীয়। নয়াবাড়ীতে উহার যে দুর্গবাড়ীর চিহ্ন আছে, তাহা ৮৩৩×৭৬২ ফুট পরিমিত, উহার চারিদিকে ৯০ ফুট বিস্তৃত একটি পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। এই পরিখায় এখনও জল থাকে। দুর্গের মধ্যে একটি পুকুর ও কতকগুলি ইষ্টকস্তূপ পূর্ব্বাবস্থার কিছু আভাস দেয়। লোকে বলে এই রাজা মৃত্তিকার নিম্নে গড় কাটিয়া তন্মধ্যে আবাসবাটী প্রস্তুত করিয়াছিলেন এবং দুর্গ হইতে নিকটবর্ত্তী নবগঙ্গা নদীতে যাইবার জন্য সুড়ঙ্গ ছিল।[১৩] নদীর কূলে এক স্থানে বহুদূর বিস্তৃত ইষ্টকখণ্ড দ্বারা সুড়ঙ্গের মুখ প্রমাণ করা হয়। বাস্তবিক এরূপ কোন সুড়ঙ্গ ছিল কি না, সন্দেহস্থল। তবে দুর্গ হইতে উত্তর মুখে নদী পর্য্যন্ত যে ৩৫ ফুট বিস্তৃত একটি সুন্দর রাস্তা ছিল, তাহা স্পষ্ট বুঝা যায়। এই দুর্গবাড়ী খনন করিলে কিছু প্রাচীন তথ্যের সন্ধান হইতে পারে। এজন্য এদিকে গবর্ণমেণ্টের পুরাতত্ত্ববিভাগ এবং স্থানীয় বিদ্যোৎসাহী নড়াইলের জমিদার বাবুদিগের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি।

পাদটীকা :

১. গৌড়রাজমালা ১৮-১৯ পৃ।

২. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণকাণ্ড, ১ম খণ্ড ১০৩-৪ পৃ; সাহিত্য, ১২শ ভাগ, ৭২৩ পৃ; বাঙ্গালার পুরাবৃত্ত, ১৯২ পৃ; Archaeological-Survey Report, vol. XV, P. 163

৩. ‘মাৎস্যন্যায়মপোহিতুং প্রকৃতিভিলক্ষ্ম্যাঃ করং গ্রাহিতঃ।’—ধর্মপালদেবের খালিমপুরের তাম্রশাসন, গৌড়লেখমালা, ১২ পৃ। ডাঃ নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালীর ইতিহাসে’ অনুমান করা হইয়াছে যে, তৎকালীন সামন্ত-নায়কেরা মিলিয়া এই নির্বাচন করেন। আ ৭৫০ খৃষ্টাব্দ—শি মি]

৪. বিজিত্য যেনাজলধের্ব্বসুন্ধরাং’—দেবপাল দেবের মূঙ্গের-লিপি, গৌড়লেখমালা, ৬ষ্ঠ পংক্তি, ৩৫ ও ৪১ পৃ।

৫. প্রাচীন কবি দুৰ্ল্লভ মল্লিক-কৃত ‘গোবিন্দচন্দ্রগীতে আছে :

‘সুবর্ণচন্দ্র মহারাজা ধাড়িচন্দ পিতা
তার পুত্র মাণিকচন্দ্র শুন তার কথা।’—শিবচন্দ্র শীল-সম্পাদিত ‘গোবিন্দচন্দ্রগীত’, ৬৩ পৃ।

৬. পাটিকা গ্রাম কোথায় তাহা নির্ণয় করা যায় না। এ সম্বন্ধে নানা তর্ক আছে। কোচবিহারের পশ্চিমে এক পাটগ্রাম আছে। কেহ কেহ তাহাকেই পাটিগ্রাম বলেন। (গোবিন্দচন্দ্রগীত, টীকা, ৪২ পৃ)। তারানাথের মতে চাটিগ্রামই পাটিগ্রাম, কিন্তু ইহা সম্ভবপর নহে। ফরিদপুর জেলায় সাতৈর পরগণায় পাটিকা আছে; এস্থান রাজধানী হওয়া সম্ভবপর। কেহ বলেন ত্রিপুরা জেলার পাটিকারাই এই পাটিকা। গৃহস্থ, ১৩২১, জ্যৈষ্ঠ দ্রষ্টব্য। [বিশ্বেশ্বর ভট্টচার্য্য (J. A. S. B.-N. S. VI PP. 131-34) রংপুরে ময়না মতীর কোটের সন্নিকটে এই পাটিকানগর হইবে বলিয়া অনুমান করেন।-শি মি]

৭. গোবিন্দচন্দ্র বলিতেছেন, ‘সোলো দত্তের রাজা আমি বঙ্গ অধিকারী’ (গো. চ. গী. ৬০ পৃ)। রায় বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন ‘দত্তের স্থলে ‘দণ্ডের’ ধরিয়া লইয়া এই বঙ্গাধিকারী বিস্তৃত রাজ্যকে কয়েকখানি গ্রামের সমষ্টিতে পরিণত করিয়াছেন (‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ ৭৫ পৃ)। কিন্তু এই ‘দত্ত’ শব্দও দুৰ্ব্বোধ্য। শিবচন্দ্র শীল এই ‘দত্ত’-কে নদীবোধক ‘গর্ত্ত’ করিতে চান (গো. চ. গী. ৬০ পৃ), অর্থাৎ ষোল নদী দ্বারা সিক্ত দেশেই গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্য বিস্তৃত ছিল। সে রাজ্য সমতট পর্য্যন্ত আসিয়াছিল কি না জানিবার উপায় নাই। তবে তাহা যে পশ্চিমে ভাগীরথী পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।

৮. এই ধৰ্ম্মপাল ও কর্ণসেনের কথা, ইচ্ছাই ঘোষ ও লাউসেনের কথা সহদেব চক্রবর্ত্তী, মাণিক গাঙ্গুলি ও ঘনরায় চক্রবর্ত্তী প্রণীত ধৰ্ম্মমঙ্গলে আছে। বাঙ্গালা ভাষায় ধৰ্ম্মমঙ্গল অনেকগুলি। ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ ৪৭২-৮৫ পৃ।

৯. Epigraphia Indica, vol. IX, PP. 232-3; গৌড়রাজমালা, ৩৯ পৃ।

১০. দেবপালের রাজত্বকাল আ ৮১০-৮৫০ খৃষ্টাব্দ History of Bengal, Dacca Univ. vol. 1. —শি মি।

১১. আ ১১২০ খৃঃ অঃ—শি মি

১২. গৌড়লেখমালা, ১৬শ পংক্তি, ১৩০, ১৪০ পৃ।

১৩. নয়াবাড়ী গ্রামে শ্রীরামচরণ গাজীর বাড়ীর উত্তর ধারে সুড়ঙ্গের মুখ প্রদর্শিত হয়। পাতালভেদী রাজার বাড়ী পরবর্তীকালে কোন বিপ্লবে বসিয়া যাওয়া বিচিত্র নহে।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. ২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. ৩. নদী-সংস্থান
৪. ৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. ৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. ৬. সুন্দরবন
৭. ৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. ৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. ৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. ১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. ১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. ১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
১৩. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
১৪. ২. দ্বীপের প্রকৃতি
১৫. ৩. আদি হিন্দু-যুগ
১৬. ৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
১৭. ৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
১৮. ৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
১৯. ৭. মাৎস্য-ন্যায়
২০. ৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
২১. ৯. সেন-রাজত্ব
২২. ১০. সেন-রাজত্বের শেষ
২৩. ১১. আভিজাত্য
২৪. ১. তামস যুগ
২৫. ২. বসতি ও সমাজ
২৬. ৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
২৭. ৪. খাঁ জাহান আলি
২৮. ৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
২৯. ৬. পয়োগ্রাম কসবা
৩০. ৭. খালিফাতাবাদ
৩১. ৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৩২. ৯. হুসেন শাহ
৩৩. ১০. রূপ-সনাতন
৩৪. ১১. লোকনাথ
৩৫. ১২. হরিদাস
৩৬. ১৩. রামচন্দ্র খাঁ
৩৭. ১৪. গাজীর আবির্ভাব
৩৮. ১৫. মুকুট রায়
৩৯. ১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
৪০. ১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
৪১. পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
৪২. পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
৪৩. পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
৪৪. পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন