সতীশচন্দ্র মিত্র
বৌদ্ধযুগে ব্রাহ্মণাচার ও বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ড এক প্রকার বিলুপ্ত হইয়াছিল বলিয়া মহারাজ আদিশূর কান্যকুব্জ হইতে পঞ্চ ব্রাহ্মণ আনয়ন করেন। তাঁহাদের দ্বারা চিরন্তন ব্রাহ্মণ্য রক্ষিত হইবে, এইরূপ বিশ্বাস ছিল কিন্তু ক্রমে দেশের প্রকৃতিতে এবং সংস্পর্শ-দোষে তৎপক্ষে নানা ব্যাঘাত জন্মে। ইহাই দেখিয়া গৌড়মণ্ডলে পুনরায় বিদ্যা-ব্রাহ্মণ্য লোপ না পায়, এজন্য মহারাজ বল্লালসেন কৌলীন্য সংস্থাপন ও কুলরক্ষার বিধি প্রণয়ন করেন। কালসহকারে পরীক্ষিত হইয়া তাঁহার বংশধরগণের সময়ে সেই সকল বিধি সংস্কৃত ও পরিবর্দ্ধিত হয় এবং বঙ্গব্যাপী এক প্রবল আভিজাত্যের সৃষ্টি করে। সেন-রাজত্বের ইহাই সর্ব্বপ্রধান এবং স্থায়ী কীর্তি। হিন্দু রাজত্ব গিয়াছে, কিন্তু আভিজাত্যের প্রতিপত্তি যায় নাই। এখনও ইহার ফলে, দেশীয় রাজা না থাকিলেও, সমাজের শাসন চলিতেছে; লোক রাজনীতি ভুলিয়াছে, কিন্তু সমাজনীতি ভুলে নাই। বিদ্যাবল, ধনবল, জনবল প্রভৃতি যে বলেই যিনি বলী হউন না, সকলকেই আভিজাত্যের চরণতলে মস্তক অবনত করিতে হয়।
বংশপরম্পরাগত প্রবাদ ও বিবিধ কুলগ্রন্থ হইতে আমরা এই কৌলীন্য সংস্থাপনের প্রমাণ পাই। সেনরাজগণের প্রায় সকলেরই তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। কিন্তু ইহা অবশ্য খুব আশ্চর্য্যের বিষয় যে, এই সকল তাম্রলিপিতে দেশের অনেক কথা থাকিলেও এই কৌলীন্য স্থাপনের কথাটা নাই। ইহা হইতে কেহ কেহ অনুমান করেন যে বল্লালের আভিজাত্য সংস্থাপন এক ‘রচা কথা’।[১] প্রথমতঃ, তাম্রশাসনাদি রাজাদের শাসনকালেই প্রস্তুত হয়; তাহাতে সেই সময়ে যে সকল ঘটনা খ্যাতি লাভ করে, তাহারই উল্লেখ থাকে। আজ বঙ্গদেশে কৌলীন্যের যে প্রভাব দৃষ্ট হইতেছে, বল্লাল প্রভৃতির সময়ে তাহা ছিল না। বাস্তবিক ঘটকগণের অসংখ্য কুলকারিকা রচনা ও সুপ্রসিদ্ধ দেবীবর ঘটকের মেলবন্ধনের পর, কৌলীন্য ব্যাপার লইয়া যেরূপ আন্দোলন চলিয়াছে, ইহা ওতপ্রোতভাবে সমাজ-দেহে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া তাহার মূলগ্রন্থি যেরূপভাবে বিলোড়িত করিতেছে, পূর্ব্বে এরূপ ছিল না। ব্রাহ্মণের সৎকার ও মর্য্যাদা রক্ষা করিয়া হিন্দু রাজা কখনও গৰ্ব্বিত হইয়া আত্মশ্লাঘা প্রকটিত করিতেন না।
দ্বিতীয়তঃ, কুলগ্রন্থে অনেক কথা অতিরঞ্জিত হইতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে পুঁথিলেখকদিগের দ্বারা উহাতে নানা অংশ প্রক্ষিপ্ত হইতে পারে, তাহা স্বীকার করি। কিন্তু তাই বলিয়া বল্লালী কুলপ্রথা বলিতে কোন জিনিস ছিল না, এরূপ বলা যায় না। দেশশুদ্ধ পণ্ডিত ঘটকেরা একেবারে বায়বীয় মন্দির গঠন করিয়াছেন, এরূপ কল্পনা করা অন্যায়। বিশেষতঃ এই কৌলীন্য সম্বন্ধীয় প্রবাদকথা এরূপ ভাবে বাঙ্গালীর অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করিয়াছে, এবং বাঙ্গালীর আবালবৃদ্ধবনিতা এই বল্লালী আভিজাত্যের সহিত এত পরিচিত যে, ইহাতে অবিশ্বাস করিতে পারা যায় না। প্রবাদ বাদ দিয়া বোধ হয় জগতের কোন দেশের ইতিহাস রচিত হয় নাই; প্রবাদে রঞ্জিত পল্লবিত কাহিনী থাকিলেও সকল ঐতিহাসিকের নিকট ইহার মূল্য স্বীকৃত হইয়াছে। বাঙ্গালাদেশে বল্লালের মত কোন পরিচিত হিন্দু রাজা নাই; বল্লালের ইতিহাস বাদ দিলে বঙ্গীয় হিন্দুর ইতিহাসের কিছু থাকে না, – আর সেই বল্লালী ইতিহাসের নির্য্যাস এই আভিাজত্য।
আমাদের আলোচ্য যশোহর-খুলনাকে সমস্ত বঙ্গে সংক্ষিপ্ত সার বলিলে বোধ হয় অত্যুক্তি হইবে না। অন্যভাবে না হইলেও ইহা সামাজিক হিসাবে এখনও বঙ্গদেশে এরূপ আদর্শ সংস্থাপন করিতেছে যে, এ প্রদেশকে বঙ্গসমাজের হৃৎপিণ্ড বলা যায়। ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থের সর্ব্বোচ্চ কুলীনগণ এখানে যেমন সমবেত, এখানে যেমন তাহাদের পৃথক্ প্রবল সমাজ আছে, অন্যত্র কুত্রাপি একস্থানে তাহা নাই। এজন্য যশোহর-খুলনার ইতিহাসের সহিত কৌলীন্যের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। সামাজিক ইতিহাসই এখানকার সর্ব্বপ্রধান ইতিহাস। আর সেই সামাজিক ইতিবৃত্তের কিছু আভাস পাইতে হইলে, কৌলীন্য বিধির সংক্ষিপ্ত মর্ম্ম জানা প্রয়োজনীয়। আমরা এজন্য এখানে সেনরাজগণের প্রতিষ্ঠিত আভিজাত্যের প্রধান কথাগুলি সংক্ষেপে সঙ্কলিত করিতেছি।[২]
আদিশূরের আনীত পঞ্চব্রাহ্মণ হইতে পরে রাঢ়ী ও বারেন্দ্র দুই শ্রেণী হয়; উত্তরকালে পাশ্চাত্য বৈদিকগণ এদেশে আসিয়াছিলেন; এতদ্ব্যতীত আদিশূরের পূর্ব্বে যে সকল ব্রাহ্মণ এদেশে ছিলেন, তাঁহারা সন্তশতী বা সাতশতী বলিয়া খ্যাত। এই চারি শ্রেণীর মধ্যে যশোহর-খুলনায় রাঢ়ীয়দিগেরই প্রধান বাস, তদ্ব্যতীত দুই চারি ঘর বৈদিক ও বহুসংখ্যক সাতশতী আছেন। আদিশূরের সময় হইতে বহু কায়স্থ এদেশে আসিয়া তাঁহারা দক্ষিণরাঢ়ী, উত্তররাঢ়ী, বারেন্দ্র ও বঙ্গজ, এই চারি শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়া পড়েন। তন্মধ্যে যশোহর-খুলনায় দক্ষিণরাঢ়ীয় কায়স্থই অধিক; প্রতাপাদিত্যের সময়ে বহুসংখ্যক বঙ্গজও আসিয়া এদেশে বাস করেন। অন্য দুই শ্রেণীর কায়স্থ খুব অল্পই আছেন। বল্লালসেনের সময় হইতেই বৈদ্যগণ রাঢ়ী ও বঙ্গজ এই দুই ভাগে বিভক্ত হন। তন্মধ্যে প্রধান বঙ্গজ বৈদ্যগণের বাসের জন্য যশোহর-খুলনা বিখ্যাত। সুতরাং রাঢ়ীর ব্রাহ্মণ, বঙ্গজ বৈদ্য ও দক্ষিণরাঢ়ীয় কায়স্থ, এই তিন শ্রেণীর কুল-কথাই আমাদের প্রধান আলোচ্য।
বল্লালসেন ব্রাহ্মণাদি জাতির আদর্শ চরিত্র অক্ষুন্ন রাখিবার উপায়স্বরূপ নয়টি কুল-লক্ষণ নির্ণয় করেন :
আচারো বিনয়ো বিদ্যা প্রতিষ্ঠা তীর্থদর্শনম্।
নিষ্ঠাবৃত্তিস্তপোদানং নবধা কুল-লক্ষণম্॥[৩]
আদিশূরের আনীত পঞ্চব্রাহ্মণের অধস্তন সন্তান-সন্ততি এই সময়ে ৫৬ ঘর হইয়াছিলেন। উহারা ছাপ্পান্ন (৫৬) খানি পৃথক্ পৃথক্ গ্রামে বাস করিতেছিলেন; উক্ত গ্রামসমূহের নামানুসারে তাঁহাদের গ্রামী বা গাঁই সংজ্ঞা হয়।
এইজন্য উত্তরকালে কথা প্রচলিত হইয়াছিল :
‘পঞ্চ গোত্র ছাপ্পান্ন গাঁই, তা ছাড়া বামন নাই।
যদি থাকে দু’এক ঘর, তা সে সাতশতী আর পরাশর।’
বল্লালসেন উক্ত ছাপ্পান্নগ্রামী ব্রাহ্মণদিগকে আহ্বান করিয়া তাঁহাদিগকে কুললক্ষণ অনুসারে বিচার করেন। উহাদিগের মধ্যে যাঁহারা বরেন্দ্রে বাস করিতেছিলেন, তাঁহারা মূলতঃ ৫৬ গাঁই ভুক্ত হইলেও, আপনাদিগকে পৃথক্ বলিয়া নির্দেশ করেন এবং তাঁহাদের গাঁই সংখ্যা ১০০ হয়। এই ভাবে পঞ্চব্রাহ্মণ হইতে রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র এই দুই শ্রেণী হয়। বল্লাল রাঢ়ীদিগের মধ্যে বন্দ্য, মুখুটি, চট্ট, পূতিতুণ্ড, গাঙ্গুলি, কাঞ্জিলাল, কুন্দ ও ঘোষাল এই অষ্টগ্রামী ব্রাহ্মণদিগকে সৰ্ব্বতোভাবে উক্ত নবলক্ষণাক্রান্ত দেখিতে পাইয়া, তাঁহাদিগকে মুখ্য কুলীন, অন্য ১৪ গ্রামী ব্রাহ্মণকে গৌণ-কুলীন এবং অবশিষ্ট ২৪ গাঁই ভুক্ত ব্রাহ্মণকে শ্রোত্রিয় আখ্যা প্রদান করিলেন। তিনি পুনরায় বিচার করিয়া উক্ত মুখ্য ৮ গাঁই ভুক্ত কুলীনদিগের মধ্যে ১৯ জনকে বিশেষভাবে সৎকৃত করেন। বল্লালের নিকট সম্মানিত কুলীনগণ কেহই প্রতিগ্রহ বা দান গ্রহণ করিতে পারিতেন না। রাজা তাঁহাদিগকে গুণানুসারে যথেষ্ট ভূমিদান করিয়াছিলেন।
সকল বর্ণের সামাজিক কার্যকলাপ ও চরিত্রের উপর লক্ষ্য রাখিবার জন্য বল্লালসেন যথেষ্ট বৃত্তির ব্যবস্থা করিয়া কতকগুলি লোককে ঘটক নির্বাচন করিয়াছিলেন, ইঁহারা রোমীয় শাসনের Censor তুল্য; বংশাবলী রক্ষণ, সামাজিকের দোষগুণ কীর্তন এবং কৌলীন্য সম্বন্ধীয় মর্য্যাদা নিরূপণ ইঁহাদের ব্যবসায় হইয়াছিল। বল্লাল তাঁহার প্রতিষ্ঠিত আভিজাত্য বংশানুক্রমিক করেন নাই। উহা লক্ষ্মণসেনের সময়ে হইয়াছিল। কুলীনগণের মধ্যে সামাজিক কুলমর্য্যাদা লইয়া নানা বিভ্রাট উপস্থিত হইলে, লক্ষ্মণসেন দুইবার কুলীনদিগের পরীক্ষা করিয়া সমীকরণ করেন; তাহাতে ২১ জন কুলীন সমতুল্য বলিয়া গণ্য হন। এই সময়ে নির্দ্ধারিত হয় যে, সপর্যায়ে কুলীনে দান গ্রহণই কৰ্ত্তব্য; উহার অন্যথা হইলে কৌলীন্যের হ্রাসবৃদ্ধি হইবে। দনুজমাধবের সময় কৌলীন্য লইয়া বিষম আন্দোলন হয়। উহার জন্য তাঁহাকে বিভিন্ন কালে ৪ বার সমীকরণ করিতে হইয়াছিল। এই সময়ে কুলীনের বংশজাত যাঁহারা ২/৩ পুরুষের মধ্যে যথারীতি আদান প্রদান করিতে পারেন নাই, তাঁহারা বংশজ বলিয়া পরিচিত হন। শ্রোত্রিয়গণও গুণের তারতম্যে নানা শাখায় বিভক্ত হন। পরবর্ত্তী যুগে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ কুলীনের মধ্যে মেলবন্ধন দ্বারা কৌলীন্য পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন হয় এবং উহা দ্বারা ব্রাহ্মণসমাজে তুমুল বিপ্লব উপস্থিত করে। আমরা যথাস্থানে তৎপ্রসঙ্গ উত্থাপন করিব।
বল্লালসেন ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্যজাতির মধ্যেও কুলপ্রথা প্রচলিত করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে বৈদ্য ও কায়স্থ জাতি প্রধান। বঙ্গীয় সেনরাজ বংশের আদিপুরুষ সামন্তসেন কর্ণাট দেশীয় ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভব ছিলেন এবং তদ্বংশীয়গণের সহিত আদিশূরের বংশের বৈবাহিক সম্পর্ক হইয়াছিল, তাহা পূৰ্ব্বে দেখান হইয়াছে। কারিকাদির মতে ‘আদিশুর রাজা বৈদ্য, বৈশ্য তার জাতি। একচ্ছত্রী রাজা ছিল, ক্ষত্রবৎ ভাতি।’ শুধু সেনরাজ বংশ নহে, কাশ্মীর-রাজ প্রভৃতি অন্য ক্ষত্রিয়ের সহিত আদিশূরের সম্বন্ধের পরিচয় আছে। আবার সেনরাজগণের সহিত, আদিশূরের বংশ ছাড়া অন্য বৈদ্য সম্বন্ধ ও হইয়াছিল; শুনা যায় সামন্তসেন এক বৈদ্যকন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন এবং তাহাতে তদ্বংশীয়েরা বৈদ্য হইয়া যান। বল্লালসেন ‘দানসাগরে’ আপনাকে স্পষ্টভাবে ক্ষত্রিয় না বলিয়া সেনবংশকে ‘ক্ষত্রচারিত্রযামচর্য্যাদাগোত্রশৈল’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। বল্লালের মত প্রবলপ্রতাপ নৃপতি বিবাহ সম্বন্ধে বিশেষ নিয়মানুগত ছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। স্পষ্টবক্তা নুলো পঞ্চানন লিখিয়া গিয়াছেন :
‘বিশেষতঃ রাজা হ’লে নাহি থাকে জ্ঞান।
রাজায় রাজায় বিভা, সবাই ক্ষত্ৰিয়।
পিতৃমাতৃ এক পক্ষ, রাজন্য গোত্রীয়।।’
এতদিনের আন্দোলনের ফলে আমরা ধরিয়া লইতে পারিয়াছিলাম যে, বৈদ্যের বৈশ্যত্ব ও কায়স্থের ক্ষত্রিয়ত্ব এক প্রকার নিঃসংশয়িত রূপে প্রতিপন্ন। বৈদ্য রাজগণ কায়স্থকে ক্ষত্রিয় বলিয়া জানিতেন এবং তাঁহাদিগকে রাজকীয় উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত করিতেন। কান্যকুব্জাগত পুরুষোত্তম দত্তের বংশোদ্ভব নারায়ণ দত্ত লক্ষ্মণসেনের মহাসান্ধিবিগ্রহিক, বটুদাস মহাসামন্ত ও শ্রীধরদাস মহামান্ডলিক ছিলেন। সে সময়ে কায়স্থে ও বৈদ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল এখনও পূর্ব্ববঙ্গে উচ্চশিক্ষিত কায়স্থ বৈদ্যে বিবাহও চলিতেছে। ত্রিংশ বর্ষ পূৰ্ব্বেও যশোহর-খুলনার বহুস্থলে উচ্চ শ্রেণীর কায়স্থে ও বৈদ্যে পরম সম্প্রীতিতে বাস করিতেন। কিন্তু উভয় জাতির মধ্যে অল্পদিন পূর্ব্বে এক অনর্থক জিগীষা জাগিয়া সে সম্প্রীতি নষ্ট করিয়াছিল। ইহা যশোহর-খুলনার এক মহা অনিষ্টের কারণ। বল্লালসেন বৈদ্য কি কায়স্থ ছিলেন, তাহা এখনও স্থির হয় নাই।[৪] তবে উপরিভাগে যাহা বলিয়াছি তাহা হইতে আমাদের বিশ্বাস যে, বল্লালের পূর্ব্বপুরুষ ক্ষত্রিয়বংশোদ্ভব হইলেও তিনি নিজে বৈদ্য বলিয়া পরিচিত ছিলেন। বল্লাল নীচজাতীয় স্ত্রীগ্রহণ করিলে, লক্ষ্মণসেন কুলরক্ষার জন্য ক্ষমতাবলম্বী বৈদ্যদিগকে উপবীত ত্যাগ করিতে এবং স্থানভ্রষ্ট হইয়া বাস করিতে পরামর্শ দিয়াছিলেন, ইহা অপ্রত্যয় করি না। এখনও এই জন্য বল্লালী বৈদ্য ও লক্ষ্মণসেনী বৈদ্য বলিয়া বৈদ্যদিগের দুই শ্রেণী আছে।
এই দুই শ্রেণী যথাক্রমে রাঢ়ী ও বঙ্গজ বলিয়া খ্যাত। রাঢ়ীদিগের আর একটি শাখা ছিল পঞ্চকোটী। রাঢ়ী ও পঞ্চকোটী বৈদ্যগণ চিরকালই উপবীতধারী ও সদাচারসম্পন্ন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা রাজবল্লভের সময় বঙ্গজ বৈদ্যগণের উপবীত গ্রহণের চেষ্টা আরব্ধ হয়। বঙ্গজ বৈদ্যগণের মধ্যে কুল ত্রিবিধ : সিদ্ধ বা মুখ্য, সাধ্য এবং কষ্ট। অনেকে বল্লালের অন্নদোষে দুষ্ট ও স্থানভ্রষ্ট হইয়া সাধ্য সংজ্ঞাভুক্ত হন। যাঁহারা সম্পূর্ণ আচারভ্রষ্ট হইয়া শ্রীহট্ট প্রভৃতি স্থানে বাস করিয়াছেন, তাঁহারাই কষ্ট। মুখ্য কুলীনদিগের মধ্যে আটজনে প্রথম কৌলীন্য পাইয়াছিলেন; শক্তি- গোত্রীয় দুহি ও শিয়াল, ধন্বন্তরি গোত্রীয় বিনায়ক ও গয়ি, মৌদ্গল্য-গোত্রীয় চায়ু ও পন্থ এবং কাশ্যপ গোত্রীয় ত্রিপুর ও কায়ু। ইহাদের মধ্যে দুহি, শিয়াল, বিনায়ক ও গয়ি ‘সেন’ উপাধিযুক্ত ছিলেন; চায়ু ও পন্থের উপাধি ছিল ‘দাস’; এবং ত্রিপুর ও কায়ুর উপাধি ছিল ‘গুপ্ত’। দুহির পৌত্র হিঙ্গু পয়োগ্রামে এবং বিনায়কের প্রপৌত্র হিঙ্গু সেনহাটিতে আসিয়া বাস করেন; ক্রমে সেন ও দাস উপাধিধারী সৰ্ব্বজাতীয় কুলীনেরা যশোহর-খুলনায় সেনহাটি, পয়োগ্রাম, মূলঘর, ভট্টপ্রতাপ, কালিয়া, বেন্দা প্রভৃতি স্থানে সগৌরবে বাস করিতেছেন। আদান প্রদানাদি দ্বারা ইঁহাদিগেরও কুলমর্যাদার তারতম্য হইয়া থাকে। যশোহর-খুলনার বৈদ্য-বংশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পরে দিব।[৫]
ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদিগের মত কায়স্থগণও কুলের নবলক্ষণ অনুসারে বিচারিত হন। বল্লালের প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়া কায়স্থের চারি শ্রেণীর মধ্যে উত্তররাঢ়ী ও বারেন্দ্রগণ তৎপ্রদত্ত কুলমর্য্যাদা গ্রহণ করেন নাই। কেবলমাত্র দক্ষিণরাঢ়ী ও বঙ্গজগণ বল্লালী আভিজাত্য গ্রহণ করেন এবং এই দুই শ্রেণীর কায়স্থই যশোহর-খুলনার অধিবাসী। তন্মধ্যে দক্ষিণরাঢ়ী কায়স্থই অধিক। যশোহর-খুলনার মত দক্ষিণরাঢ়ীয় কায়স্থের এমন সমাজ কুত্রাপি নাই। মহারাজ বিক্রমাদিত্য যখন বিখ্যাত ‘যশোহর- সমাজ’ সংস্থাপন করেন, তখন এদেশে বঙ্গজগণেরও যথেষ্ট প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। বল্লাল ও লক্ষ্মণের পর বহুবার দক্ষিণরাঢ়ীয় কায়স্থ সমাজের সমীকরণ বা একযাই হইয়াছে। যথাস্থানে যশোহর-খুলনার কায়স্থের বিবরণ দিব।[৬] ইহাদ্বারা কুলবিধি অনেক পরিবর্তিত হইয়াছে। কোন সময়ে কতটুকু পরিবর্তন হয়, তাহা নির্ণয় করা যায় না। বঙ্গজ সমাজে এত অধিক পরিবর্তন হয় নাই; কারণ সেখানে বহুদিন দেশাধ্যক্ষ পরাক্রান্ত নৃপতিগণই কুলপতি ছিলেন।
আদিশূরের সময়ে গৌতম-গোত্রীয় দশরথ বসু, সৌকালীন-গোত্রীয় মকরন্দ ঘোষ, বিশ্বামিত্র-গোত্রীয় কালিদাস মিত্র, পুরুষোত্তম দত্ত ও বিরাট গুহ পঞ্চ ব্রাহ্মণের সঙ্গে আসিয়াছিলেন, ইহার মধ্যে ঘোষ বসু মিত্র দক্ষিণরাঢ়ে কৌলীন্য পান, গুহ বঙ্গে কুলীন হইয়াছিলেন এবং দত্ত ব্রাহ্মণের ভৃত্যত্ব স্বীকার করেন নাই বলিয়া নিষ্কলীন হন। প্রবাদে আছে যে দত্ত (সম্ভবতঃ নারায়ণ দত্ত) সগৰ্ব্বে বলিয়াছিলেন :
দত্ত কা’রো ভৃত্য নয়, শুন মহাশয়।
সঙ্গে মাত্র আসিয়াছি এই পরিচয়।
এবং এই জন্যই :
ঘোষ বসু মিত্র কুলের অধিকারী।
অভিমানে বালির দত্ত যান গড়াগড়ি।
এই তিন ঘর ব্যতীত দক্ষিণরাঢ়ীয় কায়স্থগণের অবশিষ্ট মৌলিক। মৌলিকেরা সিদ্ধ ও সাধ্য, এই দুইভাগে বিভক্ত। দেব, দত্ত, কর, পালিত, সেন, সিংহ, গুহ, দাস— ইহারা সিদ্ধ মৌলিক বা ‘আটঘ’রে’ এবং চন্দ্র, সোম, আদিত্য, রাহা, বিষ্ণু, ব্রহ্ম প্রভৃতি ৭২ ঘর সাধ্য মৌলিক ‘বাহাত্তরে’ কায়স্থ। সেন-রাজত্বকালে কুলীনদিগের সহিত কেবল সিদ্ধ মৌলিক বা আটঘরের সহিত আদান প্রদান চলিত। সাধ্যের মধ্যে কয়েক ঘরের সহিতও এখনও চলিতেছে। কুলীনেরা এমন সদাচার- সম্পন্ন ছিলেন যে, ব্রাহ্মণের মত ঠাকুর উপাধি লাভ করিয়া তাঁহারাও ঘোষ ঠাকুর, বসু ঠাকুর ইত্যাদি বলিয়া অভিহিত হইতেন। সৰ্ব্বলক্ষণাক্রান্ত হইয়া বসুগণ সর্ব্বাধিকারী উপাধি পাইয়াছিলেন। এখনও সে উপাধি চলিতেছে। পূর্ব্ববঙ্গে ‘ঠাকুর’ বা ‘ঠাকুরতা’ অনেক কুলীনের উপাধিভুক্ত হইয়া গিয়াছে।
উপরোক্ত মকরন্দ ঘোষের ৬ষ্ঠ পর্যায়ে নিশাপতি ও প্রভাকর, দশরথ বসুর ৫ম পর্যায়ে শুক্তি ও মুক্তি এবং কালিদাস মিত্রের ৯ম পর্যায়ে ধুই ও গুই লক্ষ্মণসেনের সভায় বংশানুক্রমিক কৌলীন্য লাভ করেন। উক্ত ছয় জনের বাসস্থানের নামানুসারে যথাক্রমে বালী ও আক্না, বাগাণ্ডা ও মাহিনগর এবং বড়িষা ও টেকা, এই ছয়টি সমাজের সৃষ্টি হইয়াছিল। উক্ত ছয় জনই মুখ্য কুলীন ছিলেন। তাঁহাদের সন্তান-সন্ততি কুলীনগণ ৯ শ্রেণীতে বিভক্ত হন। ইহাকে নবরঙ্গ কুল বলে। ইহার মধ্যে ৫টি মূল ও ৪টি শাখা কুল। মুখ্য, কনিষ্ঠ, ষড়ভ্রাতৃক বা ছ’ভায়া, মধ্যাংশ ও তেওজ, এই ৫টি মূল এবং কনিষ্ঠ দ্বিতীয় পুত্র বা দ্বিতীয় পো, ছ’ভায়া দ্বিতীয় পো, মধ্যাংশ দ্বিতীয় পো ও তেওজ দ্বিতীয় পো, এই চারিটি শাখা কুল। মুখ্য কুলীনেরা আবার তিন উপরিভাগে বিভক্ত— প্রকৃত, সহজ ও কোমল। জন্মানুসারে যিনি যেরূপ কুলীন হন, উচ্চকুলে দান গ্রহণাদি দ্বারা তিনি নিজের মর্য্যাদাবৃদ্ধি করিতে বা বাড়িয়া যাইতে পারেন। যাঁহারা এইরূপ বাড়িতে পারেন, তাঁহাদের কুলকে বাড়িকুল বলে। যেমন কনিষ্ঠ দান গ্রহণের উৎকর্ষে মুখ্য হইতে পারেন, এজন্য তাঁহার নাম বাড়িমুখ্য, তেওজ দান গ্রহণের আধিক্যে কনিষ্ঠ হন বলিয়া তাঁহাকে বাড়িকনিষ্ঠ বলে, ইত্যাদি।
কুলীনদিগের কোন্ পুত্র কিরূপ কুলমর্য্যাদা লাভ করেন, একটি কুললতিকা দ্বারা তাহা প্রদর্শিত হইতেছে। উহাতে যে ২/৩ পুরুষ মাত্র দেখান হইল, তন্নিম্নে ঐ ভাবেই ক্রমান্বয়ে চলিবে এবং আশা করি উহা হইতে এই জটিল তত্ত্ব সহজে বুঝিয়া লইবার কতকটা সুবিধা হইবে। উহাতে মুখ্য কুলীনের ত্রিবিধ শ্রেণীবিভাগ একত্র দেখাইতে গেলে, বুঝিতে কষ্ট হইবে মনে করিয়া তাহা পৃথক্ প্রদত্ত হইল। সুতরাং প্রথম লতিকায় জন্মমুখ্যের দ্বিতীয় তৃতীয় পুত্রকে সহজ ও উহাদের তৃতীয় পুত্রকে কোমল মুখ্য বুঝিতে হইবে। এই হিসাবে প্রকৃত মুখ্যের ২য় ও ৩য় পুত্ৰ বাড়িলে মুখ্য হন বলিয়া তাহাদিগকে বাড়ি সহজ মুখ্য বলে। এই সকল ব্যতীত কুলীনগণের দান গ্রহণ প্রভৃতির বহুসংখ্যক সূক্ষ্ম নিয়মাদি আছে, উহার লঙ্ঘনে কৌলীন্যের অধোগতি হয়।[৭] এ দক্ষিণরাঢ়ীয়গণের পুত্রগত কুল এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র স্বপর্যায়ে কুলীন কন্যা গ্রহণ না করিলে সকল ভ্রাতার কুলক্ষয় হয়। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্রথম বিবাহের পর এবং অন্য ভ্রাতৃগণ মৌলিকের কন্যা বিবাহ করিতে পারেন। যিনি কুলরক্ষা করেন, তাঁহার শ্বশুরকুলে অর্থাৎ শ্যালকের কুল ভঙ্গ না হয়, তাহা দেখিতে হয়। যে কোন কারণে কাহারও কুলভঙ্গ হইলে তিনি বংশজ-আখ্যা প্রাপ্ত হন।
বঙ্গজ কায়স্থগণের মধ্যে বসু, ঘোষ ও গুহ, এই তিন জন কুলীন। অবশিষ্ট মৌলিক। তাঁহারা মধ্যল্য, মহাপাত্র, নিম্ন মহাপাত্র ও অচলা এই চারিভাগে মোট ৯৩ ঘর। ইহাদের মধ্যে কুল, পুত্ৰ কন্যা উভয়গত। কুল ভঙ্গ হইলে, তাহাকে কুলজ বা বংশজ বলে। উত্তরকালে প্রতাপাদিত্য যে সমাজ গঠন করিয়াছিলেন, তাহা বঙ্গজ-কুলীনপ্রধান। তিনি নিজে কুলীন গুহ-বংশোদ্ভব ছিলেন। যশোহর-খুলনায় বঙ্গজ মৌলিক খুব কম।
বল্লালসেন সৰ্ব্বজাতীয় লোকের উপর তাঁহার জাতিগঠন নীতি চালাইয়াছিলেন। ইহাতে নবশায়কেরা বাদ পড়েন নাই। যদিও উঁহাদের মধ্যে কেহ কুলীন আখ্যা পায় নাই, তবুও প্রামাণিক বা পরামাণিক প্রভৃতি নানা উপাধি তাহাদের মানের পরিচয় দিত। নবশায়ক যথা :
‘গোপো মালী তথা তৈলী তন্ত্রী মোদক বারুজী
কুলালঃ কর্মকারশ্চ নাপিতো নবশায়কাঃ।’
অবশেষে ইহাই সাধারণ ভাষায় দাঁড়াইয়াছিল :
‘তিলী মালী তাম্বুলী গোপ নাপিত গোছালী
কামার কুমার পুঁটুলী এই নবশাখাবলী।’
অর্থাৎ তিলী (কলুদিগের সহিত ইঁহাদের সম্পর্ক নাই), মালী বা মালাকর, পানব্যবসায়ী বারুজীবী (গোছালী) ও তাম্বুলী, গোয়ালা, নাপিত, কর্ম্মকার, কুম্ভকার এবং তন্তুবায় ও মোদক (বা কুরি) ইঁহারাই নবশাখা ভুক্ত। তন্তুবায় ও মোদকের নাম এই তালিকায় নাই, তবে পুঁটুলী বা বণিকের নাম আছে। কিন্তু বণিকেরা নবশাখার অন্তর্গত নহেন। যাহা হউক, এই নবশায়কেরা আচারনিষ্ঠ ও উঁহাদের জল আচরণীয়। ইঁহারা পূর্ব্বর্তন বৈশ্যজাতি হইতে অবতীর্ণ এবং এক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসায়াবলম্বী। ইঁহাদের মধ্যে অনেকে এক্ষণে বৈশ্যাচার গ্রহণে চেষ্টিত। এই সকল জাতিই সেন রাজত্বের সময় হইতে যশোহর-খুলনায় কোন কোন স্থানে বাস করিতেছেন। নবশায়কের মধ্যে এ প্রদেশে বৈশ্যবারুজীবীগণ সৰ্ব্বাপেক্ষা উন্নতিশীল। তাঁহারা বিদ্যাচর্চ্চায় এবং ধনসম্পদে এ অঞ্চলে এক অগ্রগণ্য জাতি। উঁহাদের বিশেষ বিবরণ পরে দিব। (পরবর্ত্তী খণ্ড, ইংরাজ আমল, দশম পরিচ্ছেদ) অন্যান্য বিশিষ্ট জাতির মধ্যে বণিকেরা সর্ব্বপ্রধান। তাঁহারা প্রকৃত বৈশ্য শ্রেণীভুক্ত এবং পঞ্চশ্রেণীতে বিভক্ত :
‘গান্ধিকঃ শাঙ্খিকশ্চৈব কাংসিকো মণিকারকঃ।
সুবর্ণবণিকশ্চৈব পঞ্চৈতে বণিজ স্মৃতাঃ।।
—ভার্গবরাম-কৃত ‘জাতিমালা’
অর্থাৎ গন্ধবণিক, শঙ্খবণিক। (শাঁখারি), কাংস্যবণিক (কাঁসারি), মণিকার ও সুবর্ণবণিক— এই পাঁচটি বণিক জাতি এখনও পৈতৃক ব্যবসায় অক্ষুণ্ন রাখিয়া লক্ষ্মীমন্ত ও ধনসমৃদ্ধ হইয়া রহিয়াছেন। ইঁহারা সকলেই পূর্ব্বে এক সময়ে বৌদ্ধ ছিলেন; বল্লালসেন যখন নিজে বৌদ্ধতান্ত্রিকতা পরিত্যাগ করিয়া হিন্দুতান্ত্রিক হন, তখনও ইঁহারা পূর্ব্বমত অক্ষুণ্ণ রাখিতে উদ্যোগী হন এবং ধর্মঠাকুরের সেবক ছিলেন। পূর্ব্বে সকলেরই বৈশ্যাচার ছিল, পরে হিন্দুতান্ত্রিকতার প্রকোপেই অনেকের বৈদিক যজ্ঞসূত্র বিলুপ্ত হয়। ‘বল্লালসেনের সময় যে বণিক সমাজ উপনয়ন বৰ্জ্জিত হন, তাহা ঐতিহাসিক সত্য।’[৯]
মণিকারসম্প্রদায় যশোহর-খুলনায় নাই বলিলেও চলে। অন্য চারিটি জাতি আছে। উঁহাদের মধ্যে গন্ধবণিকেরা অধিকাংশই মসল্যা বা বেণেতি দ্রব্যের ব্যবসা করেন। পূর্ব্বে বৌদ্ধধর্ম্মের পতনে যখন শৈব মতের প্রচার, তখন ইহারা শিবভক্ত হন এবং দেশ, সংঘ (অপভ্রংশে শঙ্খ), আবট (অপভ্রংশে আউট) ও সন্ত্রীশ (ছত্রিশ), এই চারি আশ্রমে বিভক্ত হইয়া পড়েন। সম্ভবতঃ যাঁহারা পূর্ব্ব হইতে বৌদ্ধসংঘে বা বিহারে দ্রব্যাদি বিক্রয় করিতেন, তাঁহারাই সংঘাশ্রম ভুক্ত।[১০] এই বণিকগণ এক সময়ে সমুদ্রপথে বহু দ্বীপোপদ্বীপে গিয়া সাধারণ পণ্যবিনিময়ে বিদেশীয় ধনরত্ন আনিয়া দেশকে সমৃদ্ধ করিতেন। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে এবং মনসা-মঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল প্রভৃতি গ্রন্থে ইঁহাদের বিবরণ আছে, ও ইঁহাদের বৈশ্যত্ব প্রতিপন্ন হইয়াছে। এখন গন্ধবণিকেরা অনেকে বৈষ্ণব হইলেও তাঁহারা যে পূৰ্ব্বে শৈব ও শাক্ত ছিলেন, তাহার পরিচয় আছে। ইঁহাদের ইষ্টদেবতা সিংহবাহনা গন্ধেশ্বরী দেবী, তাঁহার পূজা সকলেই করেন। গন্ধবণিকেরা সদাচারসম্পন্ন, অন্বর্থনামা ‘সাধু’ প্রভৃতি উপাধিধারী এবং ইঁহাদের জল আচরণীয়। যশোর-খুলনায় বহু গন্ধবণিকের বাস। যশোহরের অন্তর্গত বারবাজারের নিকটবর্ত্তী সঙ্কট বা সাঁকো গন্ধবণিকদিগের একটি সমৃদ্ধ অধিষ্ঠান ছিল। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে :
‘সাঁকো হইতে বেণে আইসে নাম শঙ্খ দত্ত।
রাত্রিদিবা বহে যার অষ্ট ঘোড়ার রথ।’
যশোহর হইতে যিনি চতুরশ্বযানে উজানিনগরে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিলেন, এবং বহুক্ষেত্রে সামাজিকদিগের মধ্যে আত্মপ্রাধান্য দেখাইয়াছিলেন, সে বণিকরাজ শঙ্খদত্তের সময় সাঁকোর কি সমৃদ্ধি ছিল, তাহা সহজে অনুমেয়
গন্ধবণিকের মত শাঁখারি ও কাঁসারিগণও আচরণীয় বৈশ্যজাতি। যশোহর-খুলনার বহু স্থানে ইঁহাদের বাস আছে, তবে সংখ্যা অধিক নহে। কেশবপুরের নিকট মূলগ্রাম কাঁসারিদিগের একটি প্রধান স্থান।
এই সকল ব্যবসায়ী জাতির মধ্যে সুবর্ণবণিকেরা প্রধান ছিলেন। কিন্তু বল্লালসেন যেমন কতকগুলি জাতিকে আভিজাত্যে সম্মানিত করেন, তেমনই অন্য কতকগুলি জাতিকে বিদ্বেষবশতঃ সমাজে অপদস্থ করিয়া রাখেন। ইঁহাদের মধ্যে সুবর্ণবণিক ও যোগী জাতির নাম উল্লেখযোগ্য।
সুবর্ণবণিকগণ পূর্ব্বে বৈশ্য ছিলেন এবং তাঁহাদের মধ্যে অনেকে বৌদ্ধধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়াছিলেন। ইঁহারা সুবর্ণ ও মণিমাণিক্যের ব্যবসায়ে ধনাঢ্য হন। এখনও অনেকের ‘আঢ্য’ উপাধি আছে। পালরাজগণের সময়ে তাঁহারা অযোধ্যা অঞ্চল হইতে প্রথমে মগধে ও পরে বঙ্গে আসেন। তথায় এই ধনশালী জাতি প্রথমতঃ সগৌরবে গৃহীত ও সুবর্ণবণিক বলিয়া পরিচিত হন। পূর্ব্ববঙ্গে যেখানে তাঁহাদের প্রধান বাসস্থান হয়, উহাই সুবর্ণগ্রাম নামে বঙ্গের একটি প্রধান বন্দর হইয়াছিল। ইঁহাদের সহিত মগধের বৌদ্ধ নৃপতিগণের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। বল্লালের সময় ইঁহারা ধনবলে এক প্রবল জাতি হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। তৎকালে বল্লভানন্দ শেঠ (শ্রেষ্ঠী) প্রভূত ধনসম্পত্তির অধিকারী হইয়াছিলেন। বল্লালসেন তাঁহার নিকট হইতে যথেষ্ট অর্থ ঋণস্বরূপ গ্রহণ করিয়া যুদ্ধাভিযানে ব্যয় করেন। সে সময়ে উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব ছিল, পরে অসৌহৃদ্য হয়। সেন-রাজগণ বৈশ্য এবং সুবর্ণবণিকেরাও বৈশ্য বলিয়া নাকি উভয়ের মধ্যে একটা জাতীয় বিদ্বেষ ছিল। বল্লালের যথেচ্ছ শাসনে দেশমধ্যে শক্তিশালী ব্যক্তিমাত্রই তাঁহার উপর বিরক্ত হইয়াছিলেন। বল্লভানন্দ অত্যাচারপীড়িত অনেক লোককে আশ্রয় দিতেন; শুনা যায়, পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ ও বারেন্দ্র কায়স্থগণ বল্লালের কুলমর্য্যাদা গ্রহণে অসম্মত হইলে, বল্লাল তাঁহাদের প্রতি কুপিত হন। কালে তাঁহারা শত্রু হইয়া দাঁড়ান। বল্লভানন্দ তাঁহাদের পক্ষাবলম্বন করেন। এই সময়ে বল্লাল পুনরায় অর্থ ঋণ চাহিলে, তাহাতে বল্লভানন্দ অস্বীকৃত হন। বস্তুতঃ তাঁহার নেতৃত্বে সুবর্ণ বণিকেরা বল্লালের দ্বারে আভিজাত্য প্রত্যাশী হন নাই। এজন্য বল্লালের ক্রোধের পরিসীমা রহিল না। তিনি তাঁহাদিগকে নানাভাবে অপমানিত করেন; তাঁহাদের উপবীত ছিন্ন করেন, এমন কি দেশ হইতে বিতাড়িত করিয়া দিয়াছিলেন।
এই অত্যাচারপ্রপীড়িত সুবর্ণবণিকেরা কতক সুন্দরবন অঞ্চলে, কতক উড়িষ্যায় এবং কতক রাঢ়ে সরস্বতীকূলে সপ্তগ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করেন। উহা হইতে কটকী, সপ্তগ্রামী ও দক্ষিণরাঢ়ী প্রভৃতি সমাজ হইয়াছে। মহাপ্রভু নিত্যানন্দের পার্ষদ পরমভক্ত উদ্ধারণ দত্ত সপ্তগ্রামের সুবর্ণবণিক্ – কুল উজ্জ্বল করিয়াছিলেন। যাঁহারা সুন্দরবন অঞ্চলে নির্ব্বাসিত হইয়াছিলেন, তাঁহারা অনেকে যশোহরের উত্তরে ভূষণা অঞ্চলে বর্তমান মামুদপুর প্রভৃতি স্থানে অবস্থিতি করেন। এক্ষণে যশোহর-খুলনায় প্রায় দশ সহস্র সুবর্ণবণিকের বাস।
সুবর্ণবণিকগণের মত যোগী জাতিকেও বল্লালী কোপে পড়িতে হইয়াছিল। কিন্তু তাহার কারণ স্বতন্ত্র। এই যোগী বা জুগীরা পূর্ব্বে বৌদ্ধ ছিলেন। তাঁহারা আদিনাথ, মীননাথ, মৎস্যেন্দ্রনাথ, গোরক্ষনাথ প্রভৃতি নাথসম্প্রদায়ভুক্ত যোগী বা সন্ন্যাসিগণের মতাবলম্বী ছিলেন। বৌদ্ধ যুগের শেষ ভাগে যখন বঙ্গীয় তান্ত্রিকতা বৌদ্ধমত বা সদ্ধর্ম্মের উপর হস্তক্ষেপ করিয়া নানা বিপর্য্যয় উপস্থিত করিয়াছিল, তখন গোরক্ষনাথ সেই মত গ্রহণ করেন। তাঁহারা হঠযোগের বলে নানা অদ্ভুত প্রক্রিয়া দেখাইয়া শিষ্যসংখ্যা বৃদ্ধি করিতেন। হাড়ি, ডোম প্রভৃতি নিম্নশ্রেণী হইতে উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ পর্য্যন্ত তাঁহাদের দলভুক্ত হইতেন। বস্তুতঃ তাঁহাদের কোন জাতি বিচার ছিল না। রাজা গোপীচন্দ্র কিরূপে এক হাড়িজাতীয় যোগীর নিকট মন্ত্রগ্রহণ করিয়া রাজ্যত্যাগ করিয়াছিলেন, তাহা পূৰ্ব্বে উক্ত হইয়াছে। বল্লালের সময়ে ইঁহারা প্রকাশ্য ভাবে বৌদ্ধ বলিয়াই পরিচিত হইয়াছিলেন, উত্তরকালে ইহারা নূতন শৈবমত অবলম্বন করেন।[১১] ইঁহারা প্রকাশ্য বৌদ্ধ, ইঁহাদের জাতিবিচার বা অন্নবিচার ছিল না, এইজন্য ইঁহাদের দ্বারা সমাজের অনিষ্ট হইবে আশঙ্কায় বল্লাল ইঁহাদিগকে বিশেষভাবে নির্যাতিত ও দেশ হইতে বিতাড়িত করেন। তদবধি ইঁহাদের জল অনাচরণীয় হইয়া রহিয়াছে। যশোহর-খুলনার বহুস্থানে বহুসংখ্যক যোগীর বাস। ইঁহারা এতদঞ্চলে বাস করিয়া বহুদিন পর্য্যন্ত পূর্ব্বধর্ম্মাচার রক্ষা করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন; তাহার অনেক নিদর্শন বর্তমান আছে। স্থানান্তরে আমরা তাহার উল্লেখ করিব।[১২]
বল্লাল এই দুই জাতির উপর অত্যাচার করেন বটে, কিন্তু দুই একটি নিম্ন জাতির উপর সদয় হইয়াছিলেন। সূৰ্য্যমাঝি নামক এক ধীবর লক্ষ্মণসেনকে আনিয়া দিয়া কিরূপে বল্লালের তুষ্টি সম্পাদন করিয়াছিলেন, তাহা পূৰ্ব্বে উক্ত হইয়াছে। সূৰ্য্যমাঝি যেমন সূর্য্যদ্বীপের সম্পত্তি পুরস্কার পাইয়াছিলেন, তেমনি বল্লাল তাহাদের জল আচরণীয় করিয়া দেন। কিন্তু বল্লালের মৃত্যুর পর সমাজের উপর তাঁহার সে রাজাদেশ চলে নাই; এখনও ধীবর বা মৎস্য ব্যবসায়ীদিগের জল অস্পৃশ্য। তাঁহারা আবার নমঃশুদ্র-জাতীয় মৎস্য ব্যবসায়ীদিগের (জালিয়া বা জীয়ানি) হইতে পৃথক্ হইয়া আপনাদিগকে মালো বলিয়া পরিচয় দেন। যশোহর-খুলনায় আদিযুগ হইতে নদীতীরবর্ত্তী স্থানে বহু মালো বাস করিতেছেন।
পাদটীকা
১. প্রবাসী, ১৩১৯, শ্রাবণ, ৩৯৭ পৃ।
২. যাঁহারা এবিষয়ে বিস্তৃত বিবরণ জানিতে চান, তাঁহারা অনুগ্রহপূর্ব্বক লালমোহন বিদ্যানিধি প্রণীত ‘সম্বন্ধনির্ণয়’, নগেন্দ্রনাথ বসু প্রণীত ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’, সতীশচন্দ্র রায় চৌধুরী প্রণীত ‘বঙ্গীয় সমাজ’, ‘কায়স্থকারিকা’র উপক্রমণিকা, বিশ্বেশ্বর ঘোষ প্রণীত ‘কায়স্থকুলদর্পণ’, শব্দকল্পদ্রুম ও বিশ্বকোষের ব্রাহ্মণাদি প্রবন্ধ, কবিকণ্ঠহারের ‘সদ্বৈদ্য-কুল পঞ্জিকা’ এবং পুঁথিতে হরিমিশ্র, ধ্রুবানন্দ মিশ্র ও এডুমিশ্রের ‘কারিকা’ ও নুলো পঞ্চাননের ‘গোষ্ঠীকথা’ পাঠ করিবেন।
৩. এখানে আবৃত্তি শব্দের একটি বিশেষ অর্থ আছে। আবৃত্তি দ্বারা কুলীনদিগের আদান প্রদান ও পরিবর্ত্ত বুঝায়। ইহা দ্বারা কুলধর্ম্মের সমতা হয়। ব্রাহ্মণকাণ্ড, ১ম অংশ, ১৪৪ পৃ।
৪. এই বিষয় লইয়া কিছুদিন ঘোরতর তর্কযুদ্ধ চলিয়াছিল। এমন কি, এই সূত্রে বঙ্গদেশে কায়স্থ-বৈদ্যে বিকট মনোমালিন্যের সৃষ্টি হইয়াছিল। বৈদ্য পক্ষে বৈদিক শাস্ত্রে সুপণ্ডিত উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং কায়স্থ পক্ষে প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় সমরাঙ্গণে অবতীর্ণ ছিলেন। ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে যাঁহারা কায়স্থের উপনয়নে বিরক্ত হইয়া মনে মনে কায়স্থবিদ্বেষীয় তাঁহারাও কখন কখন বৈদ্য-পক্ষসমর্থনে চেষ্টিত ছিলেন। কোন ঐতিহাসিক তথ্য উদঘাটনের জন্য আলোচনা ও তর্ক যত অধিক হয়, ততই ভাল। কিন্তু সেই তর্ক ও বিচার যদি জাতীয় বিদ্বেষ ও গালিবর্ষণে পৰ্যবসিত হয়, তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। বিদ্যারত্ন মহাশয় ‘বল্লাল-মোহমুদ্গার’ প্রভৃতি গ্রন্থে সমগ্র কায়স্থ জাতির উপর তীব্র গালিবর্ষণ করিয়া যে ভাবে লেখনী কলঙ্কিত করিয়াছিলেন, তাহা তাঁহার মত প্রবীণ প্রগাঢ়পাণ্ডিত্যসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে নিতান্ত অনুপযুক্তই হইয়াছিল। বিদ্যারত্ন মহাশয় যশোহরবাসী; তিনি জাতিধর্ম্ম ও জন্মভূমি ত্যাগ করিয়া ‘আদিগেহের’ বৈদিক সন্ধানে ব্যাপৃত থাকিলেও তাঁহার আদিগেহ তাঁহাকে ত্যাগ করিতে চায় নাই। সমগ্র যশোহর তাঁহার পাণ্ডিত্যগৌরবে গৌরবান্বিত। আমাদিগকেও তাঁহার জীবনীকথার, তাঁহার শাস্ত্রচর্চ্চার ইতিবৃত্ত সংকলন করিতে হইবে। তাঁহার মত ব্যক্তির লেখনীমুখে যদি যশোহর-খুলনার লোকের কোন অনিষ্ট হয়, তাহা বড় দুঃখের বিষয়। কায়স্থ-বৈদ্য-বিদ্বেষ দেশের এমনই অবস্থা করিয়াছে যে, যশোহর-খুলনায় যেখানেই এই দুই জাতির একত্র বাস, সেখানেই ঘোর বিবাদ-বহ্নি প্রজ্বলিত হইয়া স্থানীয় সমাজ, এমন কি, স্কুল, বারোয়ারী, লাইব্রেরী পর্য্যন্ত আক্রমণ করিয়াছে। ইহাতে দেশের যে কত ক্ষতি হইয়াছে, তাহা বলিবার নহে। সকলেই উন্নতিকামী। ত্রিংশ বৎসর পূর্ব্বে দেশময় আন্দোলনের মধ্যে যশোহর-খুলনার উপবীতবিহীন বৈদ্যগণ উপবীত গ্রহণ করিয়া দ্বিজাচারের দাবী করিয়াছেন। আজ কায়স্থসম্প্রদায় ক্ষত্রিয়াচার গ্রহণের জন্য ব্যস্ত। সবাই উচ্চ হইতে চায়। হস্তবিহীন ঘটকরাজ বলিয়াছেন : ‘হাতে ঘুরাইয়া নুলো কয়, সবাই ত উচ্চ হ’তে চায়, দেখি কার আছে কত পুণ্য শক্তি।’ আসুন, আমরাও তাহাই দেখি সময় যোগ্যাযোগ্য প্রমাণ করিবে। জাতি বা জাতীয়তার হিসাবে বল্লালসেনের মত ক্ষেত্রজ পুত্র ও ব্যভিচারী রাজাকে আপন জাতি বলিয়া টানাটানি করিয়া কায়স্থ বা বৈদ্যের সামাজিক কোন উৎকর্ষ নাই। প্রত্নতত্ত্বদর্শীর হস্তে তাঁহার জাতিতত্ত্ব নির্ণয়ের ভার দিয়া, আমরা কায়স্থ বৈদ্য পূর্ব্ববৎ সম্প্রীতিতে পরস্পর কণ্ঠলগ্ন হইয়া বাস করি এবং দেশের ও দশের কল্যাণভাজন হইয়া বাস করি। বৈদ্য পণ্ডিতের অসাধারণ শাস্ত্রচর্চ্চা এবং দৈবীশক্তিসম্পন্ন চিকিৎসাবিদ্যা ও মসীজীবী কায়স্থের উর্ব্বর মস্তিষ্ক, তীক্ষ্ণ বিষয়বুদ্ধি ও অসাধারণ প্রতিভা এক সময়ে বঙ্গের অলঙ্কার স্বরূপ ছিল। এ পুস্তক তাহার কতকটা আভাস দিবে। সম্প্রতি বৈদ্যগণ বৈদ্য বা বেদবিৎ ব্রাহ্মণ বলিয়া ব্রাহ্মণত্বের দাবি করিতে গিয়া এক নূতন আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছেন। কিছুদিন পূর্ব্বে কায়স্থ- বৈদ্যে যে কলহ ছিল, তাহাই ব্রাহ্মণ-বৈদ্যবিদ্বেষে পরিণত হইয়াছে। ইহার পরিণতি কোথায়, দেশের ভবিষ্যৎ ইতিহাস তাহার সাক্ষ্য দিবে। কলিকাতায় এক বৈদ্যব্রাহ্মণ-সম্মিলনী’ গঠিত হইয়াছে এবং রায় বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন, মহামহোপাধ্যায় গণনাথ সেন, কবিরাজ শ্যামাদাস বাচস্পতি উহার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। যশোহরে বৈদ্যপ্রধান কালিয়ায় এবং খুলনায় বিখ্যাত সেনহাটি গ্রামে উহার শাখাসমিতি স্থাপিত হইয়াছে। সমিতির সভ্যেরা সেনশর্ম্মা, দাসশৰ্ম্মা প্রভৃতি উপাধি ধারণ করিতেছেন।
৫. পরবর্ত্তী খণ্ড, ইংরাজ আমল, দশম পরিচ্ছেদ, ‘বৈদ্যবংশ’ দ্রষ্টব্য।
৬. পরবর্ত্তী খণ্ড, ইংরাজ আমল, দশম পরিচ্ছেদ, ‘কায়স্থ সমাজ’ দ্রষ্টব্য।
৭. এই সকল বিষয়ে সূক্ষ্মতত্ত্বের জন্য কায়স্থকারিকা, কায়স্থকৌস্তভ, কায়স্থকুলপ্রদীপ, কায়স্থকুলদর্পণ, কায়স্থ – সমাজ, প্রভৃতি কুলগ্রন্থ দেখিতে হইবে।
৮. ইহাদের সাহায্যে পুরাকালে পরশুরাম ক্ষত্রিয় বীর্য্য খর্ব্ব করিয়াছিলেন। সম্বন্ধনির্ণয়, ১৭৮ পৃ।
৯. বিশ্বকোষ, ১৯শ, ৬৬০ পৃ।
১০. গন্ধবণিকতত্ত্ব, ২৩৭ পৃ।
১১. It is stated in Pagsam Jon Zau (by Sampo Khanpo, a renowned Buddhist teacher of Tibbet) that about (13th century) this time foolish Jogis, who were followers of Buddhist Jogi Goroksha, became Civaite Sannyasia,-J. A. S. B. 1898, part 1. P. 25; Dr. Oldfield’s Nepal. Vol. II. P. 264.
১২. ১ম খণ্ডের শেষ পরিচ্ছেদে এবং পরবর্ত্তী খণ্ডের ইংরাজ আমল, ১০ম পরিচ্ছেদে যোগীজাতির প্রসঙ্গ আছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন