সতীশচন্দ্র মিত্র
চৈনিক পরিব্রাজকের উল্লিখিত ৩০টি সংঘারাম কোথায় ছিল, তাহা নির্ণয় করা কঠিন। এ বিষয় লইয়া এ পর্যন্ত কেহ মস্তক বিড়ম্বিত করিতে উদ্যোগী হন নাই। পুরাতত্ত্ববিৎ পরেশনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় পূর্ব্ববঙ্গের অধিকাংশ সমতটের অন্তর্ভুক্ত করিয়া লইয়া অনুমান করিয়াছেন যে, রায়পুরা, বজ্রযোগিনী, মহেশপুর, মঠবাড়ী, রামপাল, সুবর্ণগ্রাম, জম্বুসর, বেজিনীসার (বজ্রিনীসার), জয়পুর, পাংশা, বাজাসন (বজ্রাসন), যোগীডিহা, সুখডিহা, শ্রীনগর, কুমার হট্ট, শৈলকুপা, তেলিগ্রাম প্রভৃতি স্থানে সংঘারাম ছিল।[১] কিন্তু দুঃখের বিষয়, এইরূপ অনুমান করিবার কি কারণ আছে, তাহা কিছুমাত্র উল্লেখ করেন নাই। প্রদত্ত স্থানগুলির অধিকাংশ ঢাকা জেলায় অবস্থিত। তন্মধ্যে বজ্রযোগিনী, বজ্রাসন, বনিীসার, সুবর্ণগ্রাম ও রামপালে বৌদ্ধ মঠাদির নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে।[২] এতদ্ভিন্ন ঢাকার অন্তর্গত সম্ভার বা সাভার একটি প্রধান বৌদ্ধকেন্দ্র ছিল বলিয়া জানা গিয়াছে। বৌদ্ধতান্ত্রিক পরমজ্ঞানী দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ বজ্রযোগিনীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং বজ্রাসন বিহারে দ্বাদশবৎসর অধ্যয়ন করেন, পরে প্রাচ্যবৌদ্ধের সর্ব্বপ্রধান স্থান সুবর্ণদ্বীপের[৩] মহাসংঘিকাচার্য্যের নিকট আরও দ্বাদশবর্ষকাল বৌদ্ধধর্মের নিগূঢ়তত্ত্ব শিক্ষা করিয়া প্রত্যাগত হইলে, মহারাজ ন্যায়পাল[৪] তাঁহাকে বিক্রমশিলা বিহারে সর্ব্বাধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। তাঁহার সময়ে ভারতবর্ষে তাঁহার মত বৌদ্ধপণ্ডিত কেহ ছিল না।[৫] তাঁহার দ্বারাই তিব্বতে বৌদ্ধধৰ্ম্ম পুনর্জীবিত হয়। তিনি তিব্বতে অবস্থানকালে তথায় স্বকীয় জন্মস্থানের নামানুসারে যে বজ্রযোগিনী মূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠা করেন, উহা অদ্যাপি বিদ্যমান আছে। শীলভদ্রের মত দীপঙ্করের নামও বঙ্গভূমিকে পবিত্র করিয়াছে। উপরোক্ত তালিকায় কেবলমাত্র মহেশপুর ও শৈলকূপা যশোহর জেলায়। এ দুইটি প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ স্থান বটে, কিন্তু বৌদ্ধপ্রতিপত্তির প্রধান নিদর্শন পাওয়া যায় না। খুলনা জেলার কোন স্থান উক্ত তালিকাভুক্ত হয় নাই। আমরা এই দুই জেলায় যাহা কিছু প্রত্যক্ষ নিদর্শন পাইয়া থাকি, তাহাই এখানে বর্ণিত হইতেছে। সমতটের রাজধানী বারবাজারে ছিল ধরিয়া, তথায় ২/১টি সংঘারামের অস্তিত্ব বিষয়ে অনুমান করিয়াছি। বারবাজার ত্যাগ করিয়া দক্ষিণে অগ্রসর হইলে, বর্ত্তমান যশোহর সহরের সন্নিকটে মুড়লীতে একটি বৌদ্ধস্থান ছিল বলিয়া বোধ হয়। কানিংহাম সাহেব এখানেই সমতটের রাজধানী কল্পনা করিয়াছেন। মুড়লী অতি প্রাচীন স্থান। এমন কোন প্রাচীন ম্যাপ বা ভৌগোলিক বৃত্তান্ত নাই, যাহাতে মুড়লীর নাম নাই। পাঠান, মোগল ও ইংরাজ আমলে ইহার প্রাধান্যের অনেক ইতিহাস আছে। পাঠান আমলে বারজন ফকিরের মধ্যে দুইজন এখানে স্থায়িভাবে আস্তানা করিয়া বহুলোককে মুসলমান ধৰ্ম্মে দীক্ষিত করেন। তৎপূর্ব্বেও ইহা একটি বিখ্যাত স্থান ছিল বলিয়া অনুমান করা যায়। বিস্তৃত ভৈরবের কূলে এই সুন্দর স্থানে হিন্দু বৌদ্ধের বাস ছিল, এজন্য এখানে মুসলমান ফকিরগণ স্থায়ী আস্তানা করা কর্তব্য মনে করিয়া থাকিবেন। এইরূপ প্রসিদ্ধ স্থান দেখিয়া পাঠানেরা সহর বসাইতেন, এখানেও তাঁহাদের একটি সহর ছিল। তাহার নাম ছিল, মুড়লীকসবা। পুরাতন কসবায় এখনও গরিব সাহ ও বেহরাম সাহের সমাধিস্থান আছে।[৬] আধুনিক সময়ে মুড়লীতে একটি অতি সুন্দর ইমামবারা বা মুসলমানদিগের ভজনালয় আছে। প্রাচীনকালে এখানে এক সন্ন্যাসীর প্রতিষ্ঠিত কালীবাড়ী ছিল। এক প্রকাণ্ড বটবৃক্ষের কোটরে সেই প্রাচীন মন্দিরের প্রাচীরগুলি দেখা যায়। চাঁচড়া রাজের উদার ব্যবস্থায় এখানে পূজাদির বিশেষ আয়োজন ছিল। কালে তাহা নষ্ট হইয়াছে। কালীমূর্ত্তির হস্তপদবিহীন দেহপিণ্ডটি আছে; কিন্তু শায়িত শিবমূর্তির প্রায় সম্পূর্ণই আছে। এখনও সেখানে প্রতি অমাবস্যায় পূজা হয়। আধুনিক যুগের নানা দেবমন্দির ও দেবালয়, আখড়া প্রভৃতি প্রাচীনত্বের ইঙ্গিত করিতেছে। এখানে কোন বৌদ্ধ সংঘারাম ছিল বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।
বর্তমান যশোহর নগরী হইতে আরম্ভ করিয়া কপোতাক্ষের পূর্ব্বকূল দিয়া দক্ষিণে চাঁদখালি পৰ্য্যন্ত গেলে, অনেক স্থানে পুরাতন বাটীর ভগ্নাবশেষের স্তূপ পাওয়া যায়। ঝাপার কাছে, তালার নিকটবর্ত্তী আগরঝাড়ায় ও কপিলমুনির সান্নিধ্যে আগ্রা নামক গ্রামে অনেকগুলি স্তূপ আছে। আগরঝাড়ার দক্ষিণে শ্রীপদগুহা গ্রাম। ঐ স্থানে হাড়দহ ও শ্রীপদদহ পুষ্করিণী বৌদ্ধসম্বন্ধের সন্দেহ জন্মায়। নিকটবর্ত্তী আটারই ও বারুইহাটি গ্রামে কতকগুলি ইষ্টকগৃহের ভগ্নাবশেষ আছে। কপিলমুনির বাজার হইতে ১ মাইল উত্তর-পূৰ্ব্ব কোণে আগ্রা গ্রাম। এখানে প্রধানতঃ তিনটি ঢিপি আছে; তন্মধ্যে ২টি বড় ও একটি ছোট। যোগীরা বৌদ্ধ ছিলেন, তাহা আমরা প্রমাণ করিব। এখানে যোগীর বাস পূৰ্ব্ব হইতে আছে। সমস্ত আগ্রা গ্রামটিই একটা ভগ্নাবশেষ। গ্রামের যেখানে খনন করা যায়, সেখানেই ইষ্টক বাহির হয়। গ্রামের মধ্যে একটি রাস্তা গিয়াছে, উহা পূর্ব্বে সম্পূর্ণ পাকা রাস্তা ছিল, অনেক স্থানে তাহার নিদর্শন আছে। গ্রামমধ্যে সকল স্থানেই গর্ত খনন করিতে হইলেই ইট বাহির হয়। হা’জোর পুকুর নামে একটি অতি প্রাচীন বাঁধাঘাটওয়ালা পুকুর আছে। ওয়েষ্টল্যাণ্ড সাহেব এখানকার একটি স্তূপ খনন করাইয়াছিলেন; উহার গর্ভের মধ্যে অবতরণ করিলে প্রাচীর ও জানালার ভগ্নাবশেষ সুস্পষ্ট দেখা গিয়াছিল।[৭] আগ্রার উত্তর কাশিমনগর গ্রামে ২টি স্তূপ আছে। উহার একটি এখনও যোগিপাড়ার মধ্যস্থানে। যোগিগণ এখানকার প্রাচীন বাসিন্দা। কপিলমুনি গ্রামেই বহুসংখ্যক যোগীর বাস আছে। তাঁহাদের মধ্যে বাগনাথ মহান্ত নামক এক সাধুর নাম বিশেষ প্রসিদ্ধ। তাঁহার জীবন্ত কবর হইয়াছিল। বাগনাথের সে সমাধিস্থান সকল লোক দ্বারা সম্মানিত হয়। সুন্দরবন অঞ্চলের একটি বিপ্লবের পর পাঠান আমলের মধ্যস্থলে যখন এ প্রদেশে পুনরায় বসতি পত্তন হইতে থাকে, তখনই বাগনাথ ও তাঁহার গুরু শিশুনাথ অধিবাসিগণের অগ্রদূতরূপে এইস্থানে উপনীত হন এবং তাঁহারাই প্রথম জঙ্গলাবৃত কালীবাড়ীর আবিষ্কার করেন। এই জন্য সাধারণ লোকে বলে কালীবাড়ী তাঁহারাই স্থাপিত করিয়াছিলেন। বাগনাথ বাক্সিদ্ধ সাধুপুরুষ ছিলেন। ইহার বংশীয়গণ এক্ষণে বৈষ্ণব বলিয়া পরিচয় দেন।
১৩০৩ সালে কপিলমুনিবাসী বিনোদবিহারী সাধু খাঁ মহাশয়ের বাড়ীতে একটি পুষ্করিণী খননকালে ১৭/১৮ হাত মাটীর নিম্নে ৪টি প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায়। তন্মধ্যে ৩টি রক্তপ্রস্তরের ও একটি কৃষ্ণ প্রস্তরের। একটি কৃষ্ণপ্রস্তরের ও একটি রক্তমূর্ত্তি ভাঙ্গিয়া যায়, তজ্জন্য নদীগর্ভে নিক্ষিপ্ত হয়। যাঁহারা দেখিয়াছিলেন, তাঁহাদের বর্ণনা হইতে অনুমান করা যায়, উহার মধ্যে একটি অবলোকিতেশ্বর মূর্ত্তি ছিল। অবশিষ্ট ২টি মূৰ্ত্তি নিকটবর্ত্তী প্রতাপকাটি গ্রামনিবাসী রসিকলাল হালদার মহাশয়ের বাড়ীতে আছে। দুইটিই রক্ত প্রস্তর নির্ম্মিত। বড়টির পরিমাণ ১১ ́ ́X৬ ́ ́ ইঞ্চি। ইহা চারি হস্তবিশিষ্ট দণ্ডায়মান মূৰ্ত্তি; দক্ষিণদিকের উপরের হস্তে চক্র ও নিম্নে গদা এবং বামদিকে উর্দ্ধে শঙ্খ ও নিম্নে পদ্ম। পুরাণাদিতে যে চতুৰ্ব্বিংশতি প্রকার বিষ্ণুমূর্ত্তির উল্লেখ আছে, তদনুসারে এ মূর্তির নাম মাধব। ছোট মূর্তিটিও চারি হস্তবিশিষ্ট; উপরোক্ত ক্রমে হস্তগুলিতে চক্র, পদ্ম, শঙ্খ ও গদা আছে। পরিমাণ সাড়ে ৭ ́ ́X৪ ́ ́, এ মূর্ত্তির নাম জনাৰ্দ্দন।[৮] হালদার মহাশয়েরা বড়টিকে ব্রহ্মা এবং ছোটটিকে বিষ্ণু বলিয়া পূজা করেন।
উপরোক্ত পুকুর খননকালে প্রাচীর সমেত একটি ভগ্ন মন্দির বাহির হয়। তাহার মধ্যেই মূর্ত্তিগুলি ছিল। এই মন্দির মধ্যে মোমবাতিতে আলোক দেওয়া হইত; তাহা হইতে এক রাশি মোম সঞ্চিত হইয়াছিল। উহার একটি পিণ্ডও ঐ সময়ে পাওয়া যায়। মোম মাটীর নিম্নে যুগযুগান্তর থাকিলেও নষ্ট হয় না। ইহা হইতে বুঝা যায় যে, মন্দিরটি হঠাৎ ভূপ্রোথিত হইয়া গিয়াছিল এবং মন্দিরমধ্যে হিন্দু বৌদ্ধ মূর্ত্তি একত্র সমভাবে পূজিত হইতেন। কপিলমুনির উৎপত্তি প্রাচীনত্বের যথেষ্ট প্রমাণ আমরা পূর্ব্বে দিয়াছি। তাহার সহিত এস্থলে যে সব বিবরণ দেওয়া গেল, তাহা একত্র পর্যালোচনা করিয়া আমরা স্বচ্ছন্দে অনুমান করিতে পারি যে, কপিলমুনিতে একটি বৌদ্ধ সংঘারাম ছিল।
খুলনা জেলায় দৌলতপুর হইতে সাতক্ষীরা যাওয়ার রাস্তায় দক্ষিণ মুখে ১৩ মাইল গেলে বুড়ীভদ্র নদীর কূলে ভরতভায়না গ্রাম। এই স্থানে নদীর সন্নিকটে এক প্রকাণ্ড ইষ্টকস্তূপ আছে। উহা এখনও ৫০ ফুট উচ্চ আছে; লোকে বলে উহা পূর্ব্বে আরও উচ্চ ছিল, কিন্তু একবার ভূমিকম্পে অনেকটা বসিয়া গিয়াছে। স্তূপটি প্রায় গোলাকার; উহার পরিধি পাদদেশে ৯০০ ফুটেরও অধিক হইবে। ইহার দক্ষিণ-পূর্ব্ব ও পূর্ব্বদিক দিয়া নদী প্রবাহিত, অন্য তিন দিকে গড়খাই ছিল, তাহার চিহ্ন আছে। দক্ষিণদিকে নদীর নিকটে একটি পুকুরের খাত দেখিতে পাওয়া যায়। স্তূপটি সম্পূর্ণ ইষ্টকরাশিতে পরিপূর্ণ। পাদদেশে ২/১ স্থান খনন করিয়া প্রাচীরের চিহ্ন পাওয়া গিয়াছিল। একটু দূর হইতে এই বনাচ্ছন্ন বিশাল স্তূপ দেখিলে তত্ত্বানুসন্ধিৎসু ব্যক্তিমাত্রকে চিন্তকুল করিয়া তুলে। কিছুদিন পূর্ব্বে আর্কিওলজিকাল বিভাগের সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট মহোদয় ইহাকে একটি প্রাচীন বৌদ্ধ স্তূপ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। তিনি বলেন, ইহা ইউয়ান চোয়াংএর বর্ণিত সমতটের ৩০টি সংঘারামের অন্যতম হইতে পারে।[৯]
এ স্তূপ কাহার? স্থানের নাম ভরতভায়না। লোকে স্তূপটির নাম রাখিয়াছে ভরত রাজার দেউল। এ কোন্ ভরত? গল্প অনেক আছে, তাহার হাতে জড়ভরতও নিস্তার পান নাই। কেহ বলেন ভরত একজন ব্রাহ্মণ, তিনি এই মন্দির দ্বারা একধার মাতৃস্তন্যের ধার শোধ দিতে ইচ্ছুক ছিলেন, তাই মন্দিরের শীর্ষভাগ ভাঙ্গিয়া মাতৃস্তন্যের মূল্য নির্দ্ধারণ করিলেন। আবার কেহ বলেন, ভরত একজন ক্ষত্রিয় নৃপতি। তিনি এই প্রদেশে রাজত্ব করিতেন। সম্ভবতঃ ইহাই ঠিক। পালরাজত্বের প্রাক্কালে যখন সমগ্র বঙ্গে মাৎস্য-ন্যায় বা অরাজকতা উপস্থিত হইয়াছিল, বোধ হয় সেই সময়ে ভরত নামক এক রাজা এই প্রদেশে রাজ্য স্থাপন করিয়া একপ্রকার স্বাধীনভাবে শাসন করিয়াছিলেন; সুন্দরবনে ১২৮নং লাটে যে এক ভরতরাজার গড়ের কথা পূর্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি;[১০] সেখানকার সে ভরত রাজা ও এখানকার রাজা অভিন্ন ব্যক্তি হইতে পারেন। পার্শ্ববর্তী গৌরীঘোনা গ্রামে ভরত রাজার বাড়ীর ভগ্নাবশেষ আছে।[১১] ঐ স্থানে ২ খানি সুন্দর প্রস্তর সুদূর অতীতের কিছু সাক্ষ্য দিতেছে। একখানি পাথর ২ ́-২ ́ ́ X ১ ́- সাড়ে ৬ এবং উচ্চতা ১ ́ ফুট, উহা কোন প্রস্তর স্তম্ভের পাদপীঠ হইতে পারে। পাথরখানি গয়ার পাথরের মত কৃষ্ণবর্ণ। অন্য পাথরখানি একটি প্রস্তরনির্ম্মিত কুমীরের নিম্নার্দ্ধের একাংশ বা সম্মুখভাগ। ইহা ৫ ́-৬ ́ ́× ১ ́-৫ ́ ́ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ১ ফুট হইবে। কুমীরটি যখন সম্পূর্ণ ছিল, তখন তাহার পরিমাণ আনুমানিক ১৫ ́ × ১ ́-৫ ́ ́ এবং উচ্চতা প্রায় ২ ́ ফুট ছিল। ইহা কোন সিঁড়ির পার্শ্বে বা তোরণ প্রাচীরের উপরিভাগে বসান থাকিতে পারে। সে বাড়ী কি প্রকাণ্ড রাজার বাড়ী ছিল তাহা ইহা হইতে সহজে অনুমান করা যায়। এই রাজবাটীর সম্মুখে অর্থাৎ দক্ষিণে নদী অন্য তিন দিকে গড়খাই ছিল, তাহার খাতের চিহ্ন আছে। ভরতের দেউলের অর্দ্ধ মাইল মাত্র দক্ষিণে কাশিমপুর গ্রামে ডালিঝাড়া বলিয়া একটা স্থান আছে। ইহাও একটি ভগ্ন স্তূপ। এখানে ভরতরাজার কোন প্রধান কর্মচারীর বাড়ী থাকিতে পারে।
চুকনগরের দক্ষিণ-পূর্ব্বে ভদ্রনদীর ধারে বরাতিয়া কাঁটালতলার হাটের সন্নিকটে মঠবাড়ী গ্রামে একটি মঠ এক্ষণে বসিয়া গিয়াছে, ঐ মঠ বৌদ্ধ আমলের কারুকার্য্যমণ্ডিত ইষ্টকে গ্রথিত ছিল। মঠবাড়ী নামেও বৌদ্ধ মঠের কথা স্মরণ করাইয়া দিতেছে। ভরতভায়নার একাংশকে আগরহাটি বলে। এখানে বহুসংখ্যক কপালী জাতীয় লোকের বাস। ইঁহারা এদেশে এক নূতন জাতি। ইঁহারা পূর্ব্বকালে কাশ্মীর হইতে এদেশে আসিয়াছিলেন বলিয়া জানা যায়। বল্লালসেন সুবর্ণবণিকের মত ইঁহাদের উপর ক্রুদ্ধ হইয়া ইঁহাদের জল অনাচরণীয় করিয়া দেন। ইঁহারা নিশ্চয়ই পূর্ব্বে বৌদ্ধ ছিলেন। এখন তাহার নিদর্শন আছে। ইঁহারা কৃষিব্যবসায়ী ও ধর্ম্মমতে বৈষ্ণব। শাক্ত যে কতকাংশ না আছে, তাহা নহে; তবে সংখ্যায় কম। ইঁহারা কাহারও দাসত্ব করেন না। ইঁহাদের গুরু পুরোহিত সকলই স্বতন্ত্র। নিকটবর্ত্তী ১৪/১৫ টি গ্রামে কপালীর বাস।
এই সকল বিষয় বিবেচনা করিলে মনে হয়, ভরতভায়নায় একটি বৌদ্ধ সংঘারাম ছিল। নিকটবর্ত্তী বহুসংখ্যক গ্রামে এই সংঘারামের সংশ্লিষ্ট বহু বৌদ্ধের বাস ছিল। তাঁহারা সকলেই এখন হিন্দু বলিয়া পরিচয় দেন। ভরতরাজা ছিলেন এই সংঘারামের একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তাঁহার রাজকীয় ব্যয়ে বহু বৌদ্ধ শ্রমণ সংসারত্যাগী হইয়া এই সংঘারামে আদর্শ জীবন অতিবাহিত করিতেন। ভরতভায়না স্তূপের ইটগুলি দেখিলেই উহার প্রাচীনত্বের আভাস পাওয়া যায়।[১২] গবর্ণমেণ্টের স্থাপত্য বিভাগ ও জেলার ম্যাজিষ্ট্রেট মহোদয়ের তত্ত্বাবধানে এই স্তূপ খনিত হইলে, এই প্রাচীন বৌদ্ধ সংঘারামের ভগ্নাবশেষ হইতে যথেষ্ট পুরাতত্ত্বের প্রামাণ্য উপাদান পাওয়া যাইতে পারে।[১৩]
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয় সাহিত্য-সম্মিলনের অভিভাষণে বলিয়াছিলেন, ‘প্ৰায় হাজার বৎসর পূর্ব্বেও ২৪-পরগণার নানাস্থানে বৌদ্ধবিহার ছিল। বৌদ্ধপণ্ডিতেরা পুঁথি পাঁজি লিখিতেন, ধর্মপ্রচার করিতেন। এমন কি, এখন যে হাতিয়াগড় ও বালাণ্ডা পরগণা নগণ্য পরগণার মধ্যে গণ্য, সেখানেও বৌদ্ধবিহার ছিল। পণ্ডিতেরা প্রজ্ঞাপারমিতার চর্চ্চা করিতেন, তাহার নিদর্শন পাওয়া যায়।’ হাতিয়াগড় ও বালাণ্ডা উভয়ই প্রাচীন যশোর রাজ্যের অন্তর্গত এবং উহার পশ্চিম অংশে অবস্থিত ঐ রাজ্যের পূর্ব্বদিকেও বৌদ্ধবিহার বিস্তৃত হইয়াছিল।[১৪] যমুনা তীরে বর্তমান গোবরডাঙ্গার সন্নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে, কপোতাক্ষকূলে বোধখানা নামক স্থানে, ভদ্রকূলে বিদ্যানন্দকাটি গ্রামে, পূর্ব্বে বৌদ্ধনিবাস ছিল বলিয়া সন্দেহ হয়। উত্তর দিকে নবগঙ্গার কূলে জগদল, সত্রাজিৎপুর প্রভৃতি কোন স্থানে, এরূপ কোন বিহার বা মঠ থাকিবার সম্ভব। দক্ষিণে কপোতাক্ষকূলে যেখানে আমাদির নিকট মসজিড়ে একটি খাঁজাহান আলির আমলের মসজিদ্ আছে এবং পূর্ব্বে ভৈরবকূলে যেখানে বাগেরহাট অবস্থিত, সেখানে পূর্ব্বে বৌদ্ধবিহার ছিল বলিয়া অনুমান করি।
অনুমান সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন নহে। বিদ্যানন্দকাটিতে পুরাতন দুর্গপ্রাকারের মধ্যে কয়েক স্থানে স্তূপ বা চৈত্যের নিদর্শন পাওয়া যায়। স্থানীয় উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ প্রকাণ্ড দীঘির ইতিহাসের সহিত অনেক প্রাচীন কাহিনী বিজড়িত আছে। বোধখানায় অপেক্ষাকৃত আধুনিকযুগের ভগ্নবাটী প্রভৃতি থাকিলেও উহা যে একটি পুরাতন স্থান তাহাতে সন্দেহ নাই এবং উহার নামেও কিছু বৌদ্ধ সম্বন্ধের ইঙ্গিত করে। গোবরডাঙ্গার সন্নিকটে যমুনাগর্ভে সুন্দর ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গিয়াছে এবং উহা এখনও বনগ্রামের সন্নিকটে এক গ্রামে রক্ষিত আছে। মজিদকুড় বা বাগেরহাট পাঠান পীরের লীলাক্ষেত্র। এখানকার হিন্দু-বৌদ্ধ-নিদর্শন মুসলমান কীর্ত্তির কুক্ষিতলে বিলুপ্ত হইয়াছে। তবুও কিছু আছে।
মজিদকুড়ে একটি নবগুম্বজ মসজিদ আছে, উহাতে চারিটি প্রস্তরস্তম্ভ বিদ্যমান। বাগেরহাটে একটি ৭৭ গুম্বজওয়ালা বিরাট্ ভজনালয় আছে, উহাতে ৬০টি স্তম্ভ কিন্তু লোকে তাহাকে ষাট গুম্বজ বলে। এ সকল দীর্ঘকাল স্থায়ী হর্ম্মরাজি এখনও আছে। দেশের লবণাক্ত বায়ু এবং স্বার্থসেবী মানুষের খনিত্রের আঘাত সহ্য করিয়া তাহারা এখনও অক্ষুণ্ণ অবস্থায় দণ্ডায়মান রহিয়াছে। উক্ত ষাট গুম্বুজের অনতিদূরে খাঁজাহানের আবাসগৃহের বিরাট হর্ম্মের ভগ্নাবশেষমধ্যে ১৪/১৫টি পাথরের থাম পাওয়া গিয়াছে। এই সকল প্রস্তর কোথা হইতে আসিল? সমতটে প্রস্তর নাই; কিন্তু শুধু উক্ত দুই অট্টালিকায় বা খাঁজাহানের আবাসবাটীতে নহে, আরও কতস্থানে প্রস্তরস্তম্ভ পড়িয়া রহিয়াছে। কোথায়ও কৃষ্ণপ্রস্তর এবং কোথায়ও রাজমহল অঞ্চলের প্রস্তর দেখা যাইতেছে। অনেকে বলেন, এ সকল প্রস্তর খাঁজাহন আলি চট্টগ্রাম হইতে জাহাজে আনিতেন। কিন্তু পাথরগুলি দেখিলে তাহার সবগুলি চট্টগ্রামের প্রস্তর বলিয়া বোধ হয় না। বিশেষতঃ কৃষ্ণ বা রক্ত প্রস্তরগুলি যে চট্টগ্রামের নহে, তাহা নিশ্চিত। ইহাই প্রথম সন্দেহ।
দ্বিতীয়তঃ, কেহ মজিদাদি নির্মাণের জন্য স্বয়ং স্তম্ভ প্রস্তুত করিবার ব্যবস্থা করিলে, উহার সকলগুলি সমান, উপযুক্তভাবে পুষ্ট এবং পরিমাণানুযায়ী করিয়া লইয়া থাকেন। প্রাচীন গ্রীকদের মত এদেশে মুসলমানেরা নক্সা স্থির করিয়া শিল্পীকে দিতেন। যাহারা পাথর কাটিত, তাহারা সেই নক্সা মত পাথর কাটিয়া দিত। সুতরাং কোন একটি গৃহের জন্য নির্মিত স্তম্ভের গঠনাদি একরূপ হইবারই কথা। কিন্তু খাঁজাহান আলির ষাট গুম্বুজে বা মসজিদকুড়ের নবগুম্বুজে স্তম্ভগুলি দেখিলে সেরূপ বোধ হয় না। উহার অনেকগুলি দৈর্ঘ্যে কম বেশী আছে, অনেকগুলি বিপৰ্য্যস্ত করিয়া লাগান হইয়াছে। ষাট গুম্বুজের পাথরগুলি সব ভারবহনক্ষম হইবে না ভাবিয়া হয়ত সবগুলিই ইষ্টকদ্বারা ঢাকিয়া দেওয়া হইয়াছিল, এখনও ৪/৫টি ইষ্টকমণ্ডিত রহিয়াছে। মসজিদকুড়ে দক্ষিণ- পূর্ব্বকোণের স্তম্ভটি প্রথম, উত্তর-পূর্ব্বকোণের স্তম্ভ দ্বিতীয়, উত্তর-পশ্চিম কোণের স্তম্ভ তৃতীয় ও দক্ষিণ-পশ্চিমকোণের স্তম্ভ চতুর্থ ধরিয়া লইলাম। প্রত্যেক স্তম্ভ দুইখানি খণ্ড প্রস্তরে নির্ম্মিত। কিন্তু উহার প্রত্যেক খানির মাপ ভিন্ন ভিন্ন। প্রথম স্তম্ভে ৩ ́ ফুট ও ৪ ́-৭ ́ ইঞ্চি প্রস্তরে মোট ৭ ́-৭ ́ ́ ইঞ্চি দীর্ঘ তৃতীয় স্তম্ভ ৩ ́-১০ ́ ́ ও ৪ ́-৯ ́ ́ ইঞ্চি দীর্ঘ দুইখানি পাথর মোট ৮ ́-৭ ́ ́ ইঞ্চি দীর্ঘ। নিম্নে পাদপীঠ প্রস্তর বা ইষ্টক কম বেশী দিয়া মোট দৈর্ঘ্য ঠিক রাখা হইয়াছে। প্রথম স্তম্ভের উপরের অষ্টকোণ ৩ ́ ফুট পাথরখানি যেভাবে লাগান হইয়াছে, চতুর্থ স্তম্ভে নিম্নের ঠিক সেই ভাবের একখানি পাথর উল্টা করিয়া লাগান হইয়াছে। প্রথম স্তম্ভে পাদপীঠে একখানি কালো পাথর আছে, কিন্তু অপর তিনটি স্তম্ভে ঐস্থানে লাল পাথর আছে। এই সকল দেখিয়া সন্দেহ হয় যে, এ পাথরগুলি পূৰ্ব্বে অন্য কোন প্রয়োজন সিদ্ধ করিয়াছিল। বৈদেশিক দর্শকও এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন।[১৫]
তৃতীয়তঃ, মুসলমানের স্তম্ভাদিতে কোন জীবজন্তুর মূর্ত্তি ক্ষোদিত থাকিতে পারে না। কিন্তু খাঁজাহান আলির দুই একটি স্তম্ভে দেবমূর্ত্তি ক্ষোদিত আছে। বাগেরহাটে ষাট গুম্বজ হইতে অৰ্দ্ধ মাইল উত্তর দিকে মগরার খালের উপর একটি স্থানকে জাহাজঘাটা বলে। প্রবাদ এই— ঐ স্থানে খাঁজাহান আলির জাহাজ সকল আসিয়া লাগিত। ঐ স্থানে ঘাটের উপর একখানি প্রস্তরস্তম্ভ প্রায় সম্পূর্ণরূপে ভূপ্রোথিত রহিয়াছে, মাত্র সাড়ে ৪ ́ ফুট উপরে আছে। ঐ অংশে একটি দেবীমূর্ত্তি উৎকীর্ণ রহিয়াছে। ইহা অষ্টভুজা মহিষমৰ্দ্দিনী মূৰ্ত্তি। দেবী বামদিকের এক হস্তে মহিষাসুরের মস্তকের কেশ ধরিয়া, দক্ষিণদিকের এক হস্তে তরবারি রহিয়াছে, ইহা সুস্পষ্ট বুঝা যায়। এই মূৰ্ত্তি সিন্দূর-চর্চিত হইয়া হিন্দুর নিকট পূজিত হইতেছেন। ষাট গুম্বুজের স্তম্ভ ও নিকটবর্ত্তী স্থানে পতিত অন্যান্য স্তম্ভের মত এই স্তম্ভ একই প্রস্তরে নির্ম্মিত বলিয়া বোধ হয় এবং বারবাজারে যেমন একখানি প্রস্তর প্রোথিত আছে, এখানিও সেই একই আদর্শে গঠিত। লোকের প্রবাদ, খাঁজাহান আলির সময়ে এই প্রস্তরখানি নিকটবর্ত্তী রাজাপুর গ্রামে সোণাই পণ্ডিতের পুকুর হইতে উঠিয়াছিল। এই গ্রাম এবং লোকের নাম উভয়ই সন্দেহজনক। পালরাজত্বের সময়ে যেখানে সেখানে যেমন রাজা হইয়াছিল, এখানে তেমন রাজা থাকা বিচিত্র নহে; আর পণ্ডিত উপাধি যে বৌদ্ধত্বজ্ঞাপক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। মজিদকুড়ের সন্নিকটেও আমাদিতে রাজা ইন্দ্রনারায়ণের বাড়ী ছিল। তিনিই সম্ভবতঃ এখানকার বিখ্যাত কালিকা দীঘি খনন করেন। এই জলাশয় পাহাড় সমেত ১০০ বিঘা হইবে। দীর্ঘিকার এক কোণে বর্তমান সময়ে কৈলাসচন্দ্ৰ ঘোষ ও যদুনাথ ঘোষ মহাশয়দিগের বসতি বাটীতে উক্ত রাজবাটীর ভগ্নাবশেষ লুক্কায়িত আছে। পার্শ্বে একটি জলটুঙ্গি পুকুর অর্থাৎ পুকুরের মধ্যস্থানে মাটীর ঢিপি আছে; ঐস্থানে গ্রীষ্মকালে রাজপরিবার বায়ু সেবন করিতেন। হাতিবাঁধা নামে আর একটি দীর্ঘ পুকুরের খাতচিহ্ন আছে। উহার পার্শ্বে একখানা সুন্দর প্রস্তর পড়িয়াছিল। ইহাও কোন বিশেষ কারুকার্যখচিত হর্ম্মস্তম্ভের অংশবিশেষ।
এই সকল নানা নিদর্শন হইতে মনে হয়, এই দুই স্থানে প্রাচীনকালে কোন কোন বৌদ্ধবিহার বা হিন্দুমন্দির ছিল। বৌদ্ধযুগে যে সকল প্রস্তরে ভারতের নানাস্থানে বিশাল চৈত্য, স্তম্ভ বা স্তূপ নির্ম্মিত হইয়াছিল, যে ভাস্কর্য্যের ফলে প্রস্তরগাত্রে মানুষের চিত্তপ্রকৃতি সহজে ফুটিয়া উঠিত, তাহারই আয়াসহীন অস্ত্রকৌশলে উক্ত দুই স্থানের স্তম্ভ ও পাদপীঠ নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল। বৌদ্ধবিহার বা হিন্দুমন্দিরের প্রস্তর আনিয়া মুসলমান-শিল্পী তাহার সাহায্যে এবং নিজেদের উদ্ভাবিত নূতন প্রণালীর ইষ্টক দ্বারা গুম্বজ ও মিনার গড়িয়া, বঙ্গদেশে মহম্মদীয় স্থাপত্যের নিদর্শন রাখিয়া গিয়াছেন। পাঠান শাসনকালে কোন স্থান বিশেষে অত্যাচার হউক বা না হউক, অত্যাচারের ভয়ে, অধিবাসীরা দেবমূর্ত্তি সকল পুষ্করিণীর জলে, নদীগর্ভে বা জঙ্গলে নিক্ষেপ করিত। এই ভাবে কত মূর্ত্তি যে লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়িয়াছিল, তাহার ইয়ত্তা নাই। পাঠান বা মোগলের হাতে যাহা নিস্তার পাইয়াছিল, পাশ্চাত্য নীলকরের হস্তে তাহা ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে। এক সময় যশোহর ও খুলনার নানা স্থানে যে শত শত নীল-কুঠি প্রস্তুত হইয়াছিল, তাহার অনেক উপকরণ নিকটবর্ত্তী ভগ্ন মন্দির বা মজিদ হইতে গৃহীত হইয়াছিল। যে স্থানে নদীর কূলের নিকটে ভগ্ন অট্টালিকা ও বিস্তৃত সমুচ্চ প্রান্তর ছিল, নীলকরগণ সেইস্থানে প্রবল প্রতাপে কুঠি নির্ম্মাণ করিয়া ব্যবসায়ে আত্মসমর্পণ করিতেন। ইউয়ান চোয়াংএর বর্ণিত ৩০টি সংঘারামের মধ্যে যশোহর -খুলনায় যেগুলি ছিল, তাহার ভাগ্য সম্বন্ধে চিন্তা করিবার কি কিছুই নাই?
বাগেরহাটে যে বৌদ্ধ সংঘারাম ছিল, আমরা তাহার আরও প্রমাণ দিব। বাগেরহাট হইতে বৰ্ত্তমান খুলনা পর্য্যন্ত ২০/২১ মাইল স্থানে বহুগ্রামে যোগী জাতির বাস রহিয়াছে। বাগেরহাটের সন্নিকটে যোগীদহ পুকুর এবং কিছুদূরে যোগীখালি ঐ একই প্রসঙ্গের অবতারণা করে। যোগীদিগের চরিত্র, রীতিনীতি ও ধর্ম্মমত হইতে আমরা প্রমাণ করিব যে তাহারা সকলেই বৌদ্ধ।[১৬] গন্ধবণিক, ভড়ং, এমন কি নিম্নশ্রেণীর কায়স্থ প্রভৃতি এই প্রদেশের আদিম অধিবাসিগণও বৌদ্ধমতাবলম্বী ছিলেন। আমরা দেখাইব দেশীয় অনেক প্রবাদবাক্য ইহাদের অনেক প্রাচীন কাহিনী অভিব্যক্ত করে। নিশ্চয়ই ইহাদের কোন প্রধান ধর্মস্থান বা সংঘারাম ছিল এবং তাহা বাগেরহাটে বা তাহার সন্নিকটে নদীর এপারে বা ওপারে কোথাও ছিল বলিয়া মনে হয়।
এ সম্বন্ধে আরও একটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে। খাঁজাহান ১৪৫০ খৃষ্টাব্দে বা তাহার প্রাক্কালে যখন বাগেরহাটে তাঁহার সমাধিমন্দিরের নিকটে একটি বহুবিস্তৃত পুষ্করিণী খনন করাইতেছিলেন, তখন কয়েক হাত মাটীর নিম্নে একখানি প্রকাণ্ড কৃষ্ণপ্রস্তরের বৌদ্ধ প্রতিমা পান। প্রতিমাখানি উত্থিত হইলে উহা খাঁজাহান মহেশচন্দ্র ব্রহ্মচারী নামক একজন ব্রাহ্মণকে দান করেন। ব্রাহ্মণ উহা লইয়া গিয়া বাগেরহাটের ৪ মাইল দূরে শিবপুর নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন। তদবধি উহা সেই স্থানেই আছেন; কিন্তু বুদ্ধরূপে পূজিত না হইয়া শিবরূপে পূজিত হইতেছেন। সেই জন্যই গ্রামের নাম হইয়াছে শিবপুর। যে বাটীতে মূর্ত্তি আছেন, তাহার নাম শিববাড়ী। এই স্থানে শিবচতুৰ্দ্দশীতে মেলা হয়; অহিংসা যাঁহার ধর্ম্মমতের প্রাণস্বরূপ, তাঁহাকে স্বচ্ছন্দে কালভৈরব কল্পনা করিয়া তাঁহার উদ্দেশ্যে ছাগ বলি দেওয়া হয়। বৌদ্ধ মতের এতদপেক্ষা আর কত পরাজয় হইতে পারে? কিন্তু তবুও একটি আনন্দের কথা আছে। প্রস্তরের গুণে ও মাধুর্য্যে পূজারীর হাতে তাহা বিনষ্ট না হইয়া সযত্নে রক্ষিত হইয়াছে এবং তাঁহার পূজার উপস্বত্ব হইতে প্রকারান্তরে কতকগুলি ব্রাহ্মণ পরিবারের উদরান্নের সংস্থান হইতেছে।
এই মূৰ্ত্তি-প্রাপ্তি সম্বন্ধে কতকগুলি কিম্বদন্তী একত্র বিজড়িত হইয়া রহিয়াছে। খাঁজাহান আলি প্রথমতঃ ষাটগুম্বুজের সন্নিকটে নিজের বাটীতে বাস করিতেন। মুসলমানদিগের মধ্যে কৃতী লোক মাত্রেরই নিয়ম আছে, তিনি মৃত্যুর পূর্ব্বে স্বকীয় সমাধিস্থান নির্ম্মাণ করিয়া যান। খাঁজাহান মৃত্যুর প্রাক্কালে সাতিশয় বৃদ্ধ হইয়াছিলেন। তিনি কোন্ স্থানে জরাজীর্ণ দেহ রক্ষা করিবেন, জানিতে চাহিলে ভগবান্ তাঁহাকে যে স্থান নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন, তিনি তথায় মসজিদ ও সমাধি নিৰ্ম্মাণ করাইয়া জলাশয় খনন করাইতে আরম্ভ করেন। তৎসম্বন্ধে প্রথম কিম্বদন্তী এই যে, অনেক দূর খনন করিলেও জল পাওয়া গেল না। শেষে আরও খনন করিলে একটি মন্দির বাহির হইল। সেই মন্দিরমধ্যে প্রবেশ করিয়া খাঁজাহান আলি এক হিন্দু যোগীর সাক্ষাৎ পাইলেন। তিনি যোগীর নিকট জল চাহিলে উৎস-মুক্ত জল দ্রুতবেগে বাহির হইতে লাগিল। খাঁজাহান ও তাঁহার অনুচরবর্গ বহুকষ্টে কূলে উঠিয়া আত্মরক্ষা করিলেন। লোকের বিশ্বাস, এই মন্দির এখনও জলতলে বিদ্যমান।[১৭]
দ্বিতীয় কিম্বদন্তী বাগেরহাটের ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট সুপ্রসিদ্ধ গৌরদাস বশাক কর্তৃক সংগৃহীত। তিনি শুনিয়াছিলেন যে মন্দিরের মধ্যে হিন্দু যোগী না থাকিয়া একজন মুসলমান ফকির ছিলেন। ফকির ভৈরবের কূলে আশ্রম স্থাপিত করিয়া ধ্যানস্থ হন। যখন তাঁহার ধ্যানভঙ্গ হয়, তখন মন্দির মৃত্তিকালে প্রোথিত হইয়া গিয়াছিল।[১৮]
তৃতীয় কিম্বদন্তী সাধারণ লোকের। তাঁহারা বলেন, পুষ্করিণী খনন কালে অনেক দূরে গেলেও জল উঠিল না। তখন এই প্রস্তরখানি পাওয়া গেল। প্রস্তরখানি এত ভারী বোধ হইল যে, খাঁজাহানের খনকেরা তাহা স্থানান্তরিত করিতে পারিল না। পরে স্বপ্নাদিষ্ট হইয়া এক ব্রাহ্মণ বালক আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং তিনি স্বচ্ছন্দে পাথরখানি নিজে মস্তকে করিয়া লইয়া গেলেন। বাগেরহাট হইতে চারি মাইল আসিয়া প্রস্তরখানি মস্তক হইতে অবতরণ করিয়া একটু বিশ্রাম করিতে গেলেন। কিন্তু তথা হইতে আর উহা উঠাইতে পারিলেন না।[১৯] তখন সেস্থানে কোন লোকের বসতি হইয়াছিল না। ব্রাহ্মণই সেখানে আদিম বাসিন্দা হইলেন। খাঁজাহান স্বপ্নাদিষ্ট ব্রাহ্মণের এই অদ্ভুত ক্ষমতা দেখিয়ে তাঁহার দেবমূর্ত্তির সেবার ব্যবস্থার জন্য ৩৬০ বিঘা ভূমি ব্রাহ্মণকে দান করেন। উক্ত ব্রাহ্মণের বংশধরগণ এখনও সেই ব্রহ্মোত্তর ভোগ করিতেছেন।
এক্ষণে এই তিনটি কিম্বদন্তীর কি কোন সমন্বয় করা যায় না? আমাদের মনে হয়, এই স্থানে পূর্ব্বে একটি বৌদ্ধমন্দিরে এই মূর্ত্তি ছিল। সুন্দরবনের এক বিপ্লবে প্রতিমা সমেত এই মন্দিরটি ভূপ্রোথিত হইয়া যায়। জলপ্লাবিত স্থানে ক্রমে পলি জমিয়া মন্দির অনেক মৃত্তিকার নিম্নে পড়ে। মাটীর নিম্নে কোন মন্দির অভগ্ন এবং দণ্ডায়মান অবস্থায় থাকিতে পারে না। এ মন্দিরও তাহা ছিল না। উর্দ্ধতন মৃত্তিকার চাপে সব মন্দিরই ভগ্ন হইয়া যায়, এ মন্দিরও সেইরূপ ভগ্ন হইয়াছিল। ভূগর্ভস্থ সেই ভগ্ন মন্দিরের মধ্যে যে হিন্দুযোগী ধ্যানস্থ ছিলেন, তাহা আমাদের আলোচ্য প্রস্তরখণ্ডে উৎকীর্ণ ধ্যানী বুদ্ধমূৰ্ত্তি ব্যতীত আর কিছুই নহে। ভাস্কর্য্যপ্রভাবে মূৰ্ত্তি জীবন্তবৎ প্রতিভাত হইলেও যোগী অস্থিমাংসে জীবিত ছিলেন না। গৌরদাস বাবুর মুসলমান ফকিরের কথা মুসলমানগণের আত্মগৌরব প্রতিষ্ঠার অতিরঞ্জিত সংস্করণ ভিন্ন কিছুই নহে। কিন্তু তাহার প্রবাদ হইতে একটি কথা স্বচ্ছন্দে বুঝা যায় যে, বিপ্লবাদি কোন কারণে মন্দির সমেত মূর্ত্তিটি ভূপ্রোথিত হইয়া গিয়াছিল। মন্দির অভগ্ন ভাবে দণ্ডায়মান ছিল এবং খাঁজাহান মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন, ইহা মিথ্যা কথা। তাহা হইলে খনকের আঘাতে প্রতিমার প্রধান বুদ্ধমূর্ত্তির বাম হস্তখানি ভগ্ন হইত না। উহা সেইরূপ ভগ্ন অবস্থায় এখনও আছে। খাঁজাহান আলি যে প্রস্তরখানি ব্রাহ্মণকে সমর্পণ করিয়া উহার সেবার জন্য কিছু বৃত্তির ব্যবস্থা করিয়াছিলেন তাহা সত্য হইতে পারে।[২০] তাঁহার সেই দানের প্রমাণকল্পে কোন দলিল বর্ত্তমান পূজারিদিগের নিকট নাই। যদি পূৰ্ব্বে কোন দলিল থাকিয়া থাকে, তাহা গৃহদাহে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। তৎকাল প্রচলিত সনন্দ, তাম্রনির্ম্মিত ‘পাঞ্জা’ এই পরগণা জরিপকালে ব্রহ্মোত্তরের প্রমাণ জন্য আদালতে দাখিল করা হইয়াছিল, আর আনয়ন করা হয় নাই। এই প্রতিমা বা ঠাকুর উঠিয়াছিল বলিয়া খাঁজাহানের খনিত সেই জলাশয়ের নাম হইয়াছিল ঠাকুর দীঘি।
আমরাই প্রথম এই মূর্ত্তির প্রতিকৃতি ও বিবরণ প্রকাশ করি।[২১] গৌরদাস বশাক লিখিত বাগেরহাটের বিবরণে বা ওয়েষ্টল্যাণ্ড কৃত যশোহরের ইতিহাসে এ মূর্ত্তির উল্লেখ নাই। সাত্তার সাহেব তাঁহার ষাট গুম্বজ সম্বন্ধীয় পুস্তিকায় লিখিয়াছেন, ‘শুনিয়াছি শিববাড়ীতে এই মূৰ্ত্তি আছে।’ ‘খুলনা গেজেটিয়ার’ প্রণেতা বিখ্যাত ওম্যালী সাহেব মহোদয় তাঁহার পুস্তকে লিখিয়াছেন যে ‘শিবমূর্তিটি শিববাড়ী গ্রামে আছে।’ যাঁহারা বাগেরহাটের কীর্তিকলাপের প্রামাণিক বিবরণী প্রকাশ করিতে অগ্রসর হন, তাঁহারা কিরূপে অদূরবর্ত্তী শিববাড়ী গ্রামের মূর্তিটি পরিদর্শন না করিয়া থাকিতে পারেন, তাহা বিষ্ময়কর বটে। এই জন্যই দুঃখের সহিত বলিতে হয়, আজকাল ঐতিহাসিকেরা চক্ষু অপেক্ষা কর্ণের উপর অধিক আস্থা স্থাপন করেন।
শিববাড়ীর এই বুদ্ধ প্রতিমার যথেষ্ট বিশেষত্ব আছে। ইহা খুলনার ইতিহাসের একটি প্রধান উপজীব্য। এজন্য আমরা ইহার বিস্তৃত বিবরণ দিতেছি। সম্পূর্ণ প্রস্তরখানি শূর্পাকৃতি এবং উহা পাদপীঠ বাদে সাড়ে ৩ ফুট দীর্ঘ, ১ ফুট সাড়ে ৮ ইঞ্চি প্রস্থ। প্রতিমার নিম্নে একটি কীলক আছে, উহা নিম্নঙ্কিত পাদ পীঠের মধ্যস্থলে যে একটি ছিদ্র আছে, তাহার মধ্যে প্রবিষ্ট থাকে। প্রয়োজনমত দুইখানি প্রস্তর পৃথক্ করা যায়। প্রতিমা-প্রস্তরের সম্মুখভাগ অৰ্দ্ধচন্দ্রাকৃতি; মধ্যভাগে উহার বেধ প্রায় ১ ফুট হইবে। এই প্রস্তরখণ্ডে বুদ্ধদেবের অসংখ্য নিজ মূর্ত্তি ও তাঁহার জীবনের ঘটনাসমূহ ভাস্কর-শিল্পে সুন্দর ভাবে অভিব্যক্ত হইয়াছে। এরূপ প্রতিমাকে মূর্ত্তিস্তবক বা stele বলা হয়।[২২] শিববাড়ীর এই প্রতিমার মত এরূপ অপূর্ব্ব কারুকার্যখচিত সুন্দর ষ্টীল বা মূৰ্ত্তিস্তবক অতীব দুর্লভ। যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে, ভারতবর্ষে এরূপ সম্পূর্ণ আর একখানি মাত্র ষ্টীল আছে। উহাও শিববাড়ীর প্রতিমা অপেক্ষা আকারে অনেক ছোট, উহাতে মূর্তিসংখ্যা কম আছে এবং উহার বড় বুদ্ধমূর্তিটিতে তেমন শান্ত সাম্যভাব প্রতিফলিত হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। সেখানি কলিকাতার যাদুঘরে (Indian Museum) রক্ষিত হইয়াছে।[২৩] তুলনার জন্য শিববাড়ীর মূর্তির সঙ্গে যাদুঘরের সে প্রতিমারও প্রতিকৃতি প্রদত্ত হইল। সরকারী বিবরণীতে লিখিত আছে, সেখানি বিহার হইতে সংগৃহীত হইয়াছিল, তাহার কোন স্থির নিশ্চয়তা নাই। প্রত্নতত্ত্ববিৎ সুপণ্ডিত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় মৎসংগৃহীত শিববাড়ীর এই বুদ্ধ প্রতিমা এবং অন্যান্য কয়েকটি মূর্ত্তির সাহায্যে প্রমাণ করিতে প্রয়াস পাইয়াছেন যে বঙ্গদেশে প্রস্তর না থাকিলেও উড়িষ্যা, গান্ধার বা মগধের ন্যায় সেখানেও প্রস্তরশিল্পের এক স্বতন্ত্র পদ্ধতি ছিল। ইহাকে আমরা বঙ্গীয়ভাস্কৰ্য পদ্ধতি (Bengal School of Sculpture) বলিয়া অভিহিত করিতে পারি।[২৫]
প্রতিমার মধ্যস্থানে একটি বড় বুদ্ধমূর্তি রহিয়াছে। এই উপবিষ্ট মূৰ্ত্তি এক ফুটের অধিক উচ্চ হইবে। বুদ্ধ যোগাসনে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় ধ্যানস্থ; বহুযুগবর্ষী মালিন্যমণ্ডিত প্রস্তরমূর্ত্তির বদনমণ্ডল হইতে এখনও দিব্যজ্যোতিঃ বিস্ফুরিত হইয়া পড়িতেছে। যে যুগে শিল্পী পাথরকে কথা বলিবার মত ভঙ্গি দিতে জানিতেন, এ সেই যুগের উৎকৃষ্ট মূর্ত্তি। মূর্ত্তির মুখমণ্ডলে শান্ত সৌম্য দেবভাব এমন সুন্দর ভাবে প্রতিফলিত হইয়াছে যে, তাহা দেখিলে কিছুক্ষণ অবাক্ হইয়া থাকিতে হয়। এই বড় মূর্তিটি একটি চৈত্যের মধ্যে স্থাপিত। চৈত্যের দুইটি গোলাকার স্তম্ভ মূর্ত্তির দুই পার্শ্বে লম্বমান। এই চৈত্যের উপর বুদ্ধগয়ার প্রসিদ্ধ মন্দিরের এক অনুকৃতি রহিয়াছে; কিন্তু তাহার স্থাপত্য ভুবনেশ্বরের মন্দিরের মত। তাহার মধ্যে আর একটি ক্ষুদ্রাকৃতি ধ্যানী বুদ্ধ ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় অবস্থিত। উপরিস্থ মন্দির এবং নিমস্থ চৈত্য, এই উভয়ের মধ্যস্থানে দুই পার্শ্বে দুইটি বিদ্যাধর কল্পনা করা হইয়াছে; তাহারা চৈত্যের খিলান এবং মন্দিরের তলদেশ উভয়কে হস্ত দ্বারা রক্ষা করিতেছে। বড় মূর্ত্তির পায়ের কাছে দুই পার্শ্বে দুইটি পদ্মপাণি বুদ্ধমূৰ্ত্তি আছে।
বড় মূর্তিটির বাম ভাগ হইতে আরম্ভ করিয়া ক্রমে নিম্নদিকে গিয়া পরে আবার উপর মুখে দক্ষিণদিক্ পৰ্য্যন্ত অসংখ্য ছোট ছোট মূৰ্ত্তি দেখা যায়। উহা দ্বারা বুদ্ধদেবের জীবনলীলা পর্যায়ক্রমে প্রকটিত হইয়াছে। বুদ্ধদেবের জন্মের পূর্ব্বে স্বপ্নে এক শ্বেত হস্তী মায়া দেবীর গর্ভস্থ হয়, তাহার কোন উল্লেখ এখানে নাই; তবে শিববাড়ীর মূর্ত্তিতে বুদ্ধদেবের আসনের নিম্নে হস্তিমুণ্ড অঙ্কিত আছে, যাদুঘরের ছবিতে তাহা নাই। বড় মূর্ত্তির বামভাগে চৈত্য স্তম্ভের পার্শ্বে প্রথমতঃ বুদ্ধের জন্মলাভ চিত্র। লুম্বিনী উদ্যানে মায়াদেবী প্রসবকালে অশোকশাখা ধরিয়া দণ্ডায়মানা, তাঁহার দক্ষিণ পার্শ্ব হইতে সিদ্ধার্থ বাহির হইতেছেন। দক্ষিণ পার্শ্বে ইন্দ্রদেব এবং বামভাগে ভগিনী প্রজাপতি দণ্ডায়মান। ইন্দ্রের পার্শ্বে আর একটি মূৰ্ত্তি আছে, সম্ভবতঃ ব্রহ্মা। এই চিত্রের নিম্নে সপ্তপদ গমন প্রদর্শিত হইয়াছে। তন্নিম্নে নারদ ও অসিত, তাঁহারা শিশুকে হস্তে গ্রহণ করিয়া উহার জন্মপত্রিকা প্রস্তুত করিতেছেন। তাহার নিম্নে বিদ্যালয়। এ ছবি যাদুঘরের চিত্রে আছে, কিন্তু শিববাড়ীর চিত্রে নাই। শিক্ষক উপবিষ্ট; নিম্নে তিনটি বালক ভক্তিভাবে যোড়করে দণ্ডায়মান। তৎপরে প্রথম চিন্তা, সিদ্ধার্থের রথের উপর নগর পরিভ্রমণ ইত্যাদি। তদনন্তর মহাভিনিষ্ক্রমণ। চিত্রে বড় মূর্ত্তির নিম্নে তিন শ্রেণী মূৰ্ত্তি আছে। প্রথম শ্রেণীতে বিদ্যাধর বা উপাসকমণ্ডলী। দ্বিতীয় শ্রেণীতে সিদ্ধার্থের গার্হস্থ্য জীবনের আভাস দেওয়া হইয়াছে। কিরূপে তাঁহার পিতা তাঁহার নির্ব্বেদভাব পরিহারের জন্য যৌবনের প্রথমে তাঁহার বিবাহ দিয়া বহু যুবতীজনসঙ্গে আমোদ প্রমোদে কাল কাটাইবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন, কিরূপে সদ্যঃপ্রসূত সন্তান কোলে করিয়া তাঁহার স্ত্রী ও সহচরীবর্গ নিদ্রিত হইলে, তিনি পরিবার ত্যাগ করিয়া পলায়ন করেন, তাহাই সংক্ষেপে প্রদর্শিত হইয়াছে। সৰ্ব্বনিম্ন শ্রেণীর মূর্ত্তিগুলির বাম দিক্ হইতে আরম্ভ করিলে দেখা যায়: সিদ্ধার্থ কপিলাবাস্তু হইতে অশ্বপৃষ্ঠে চলিয়া যাইতেছেন; কণ্টককে (অশ্ব) পরিত্যাগ; ছন্দকের (সারথি) সহিত বস্ত্রালঙ্কার বিনিময়; কেশ কর্তন; বোধিসত্ত্বের সর্বত্যাগ; প্রলোভনের বিভীষিকা; মার কর্তৃক আক্রমণ; অবশেষে সর্ব্বজয় করিয়া সিদ্ধার্থের সম্বোধিলাভ। বুদ্ধত্ব লাভ করিয়া তিনি ভূমিস্পর্শ করত ধরণীকে তাঁহার সম্বোধিলাভের সাক্ষী হইতে আহ্বান করিতেছেন। মূর্ত্তির দক্ষিণদিকে একটু উপরিভাগে ধর্ম্ম-চক্র-প্রবর্তনের চিত্র এবং প্রতিমার শীর্ষদেশে বুদ্ধদেবের দেহত্যাগ বা মহাপরিনির্ব্বাণ। উহার নিম্নদিকে দুই পার্শ্বে দেবতাগণ বুদ্ধের দেবত্ব লাভের সময় সমুপস্থিত হইয়াছেন, এইরূপ অনেক ছবি আছে। দক্ষিণ দিকে মেষবাহন অগ্নি, মহিষবাহন যম, ময়ূরবাহন কার্তিকেয়, মকরবাহন বরুণ, গরুড়বাহন বিষ্ণু প্রভৃতি এবং বাম দিকে হস্তিবাহন ইন্দ্র ও শচী, বৃষবাহন শিব, হংসবাহন ব্রহ্মা, নরবাহন কুবের, শববাহনা নৈঋতী দেবী প্রভৃতি এবং ছত্রচামরধারী কতকগুলি মূৰ্ত্তি আছে। বুদ্ধদেব এক প্রকার খট্রাঙ্গের উপর শায়িত, চারি কোণে চারি মনুষ্যমূর্তিতে সে খট্টাঙ্গ ধরিয়া রহিয়াছে। সর্ব্বশীর্ষে একটি চৈত্য। ইহা ব্যতীত উভয় পার্শ্বে প্রস্তরের অবশিষ্টাংশে কতকগুলি ক্ষুদ্র চৈত্য, তন্মধ্যে ধ্যানী বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের নানা প্রতিকৃতি দ্বারা পূর্ণ। বড় বুদ্ধমূর্তির বাম হস্তে খনকের অস্ত্রাঘাতে হস্ততল ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল; যাদুঘরের চিত্রে প্রতিমার হস্ত অঙ্কিত রহিয়াছে।
এখানে যে বিবরণ দেওয়া হইল, অনুসন্ধিৎসু পাঠক ইহার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া চিত্রপট পরীক্ষা করিলে, প্রস্তরবিহীন খুলনা জেলায় এমন মূৰ্ত্তি যে দুর্লভ পদার্থ এবং ইহা যে একান্ত দর্শনীয়, তাহা সহজে স্বীকার করিবেন। যে প্রদেশে বৌদ্ধ প্রভাবের চাক্ষুষ নিদর্শন অতীব বিরল সেখানে এমন মূর্তির আবির্ভাব যেমন বিস্ময়কর, ইহার প্রবীণত্বও তেমনই নিশ্চিত। সম্ভবতঃ সেনরাজত্বের সময়ে এ প্রদেশে যে বিপ্লব হয়, তাহাতেই মন্দির সমেত এ মূর্ত্তি ভূপ্রোথিত হয়। তাহারও পূর্ব্বে ২/১ শত বৎসর ইহা আবির্ভূত ছিল। তাহা হইলে অনুমান করা যায়, খ্রীষ্টীয় ৯ম বা ১০ম শতাব্দীতে এ মূর্ত্তি নির্মিত ও প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সুতরাং এ মূর্তির বয়স সহস্র বর্ষের কম হইবে না। তাহা হইলে সহস্র বৎসর পূর্ব্বে এদেশে যে বৌদ্ধ-প্রভাব বিস্তৃত ছিল, এ মূর্ত্তি তাহার বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালার ইতিহাসের এক অধুনাবিলুপ্ত অধ্যায়ের প্রতি আমাদের সাগ্রহ দৃষ্টি আকৃষ্ট করিতেছে।
সমতট বিস্তীর্ণ রাজ্য। আমাদের আলোচ্য যশোহর-খুলনার বাহিরে সমতটের অনেক অংশ ছিল। ইউয়ান চোয়াং-এর বর্ণিত ৩০টি সংঘারাম ও ১০০ দেবমন্দিরের মধ্যে কয়টি এ প্রদেশে ছিল এবং কয়টি ইহার বাহিরে ছিল, তাহা নির্দ্ধারণ করিবার উপায় নাই। একস্থানে সমতটের রাজধানী ছিল বলিয়া আমরা কতকগুলি প্রমাণ উত্থাপিত করিয়াছি; সে প্রমাণ যে পৰ্য্যাপ্ত নহে, তাহা আমরাই সৰ্ব্বাপেক্ষা ভালভাবে বুঝি। হয়ত সেখানে একটি সংঘারাম মাত্র ছিল এবং সমতটের রাজধানী প্রকৃতপক্ষে পূৰ্ব্ববঙ্গে ছিল। যতদিন অকাট্য প্রমাণবলে এই বিপ্লববহুল দেশের পুরাতত্ত্ব মীমাংসিত না হয়, ততদিন শুধু মানসিক সন্তাড়নে পরকে নিজের মতাবলম্বী হইতে বলা যায় না। নিজে যাহা বিশ্বাস করা যায়, অন্যে তাহা কিভাবে গ্রহণ করিবেন, নিজের কোন জাতি বা অভ্যাসগত ধারণার ফলে ঐতিহাসিক সত্যকে বিপর্যস্ত করিতেছি কি না, ঐতিহাসিককে পদে পদে ইহারই উপর লক্ষ্য রাখিয়া অগ্রসর হইতে হইবে। কিন্তু আবার কোন একটি বিষয়ে বিশেষরূপে বিশ্বাস করিয়া পুরাতত্ত্বের অনুসন্ধান না করিলে, প্রকৃত তথ্যের উদ্ঘাটন হয় না। এই জন্য আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি, যদি কোন স্থানে কোন একটি অনুমান উত্থাপিত করিয়া উহাকে কতকগুলি সবল বা দুৰ্ব্বল প্রমাণের বলে পরিপুষ্ট করিয়া থাকি, অন্যে সুবিধা হইলে স্বচ্ছন্দে তাহা অপ্রমাণ করিতে পারেন। মত থাকিলেই মতান্তর হয়; সমীচীন মতান্তর গ্রহণ করিতে আমরা সর্ব্বদাই প্রস্তুত থাকিব। আমি নিজের চেষ্টায়, চিন্তায়, চাক্ষুষ দর্শনের ফলে যতটুকু সত্যের সন্ধান পাইয়াছি, অকপটে অসঙ্কোচে তাহাই লোকলোচনের পথবর্ত্তী করিয়া ভবিষ্যতের প্রতি চাহিয়া রহিলাম।
এতক্ষণে আমরা বৌদ্ধযুগের শেষ সীমায় উপনীত হইলাম। ইহার পরে আর বৌদ্ধধর্ম্ম জাগে নাই। পরবর্ত্তী হিন্দু সেনরাজগণ ও পাঠানদিগের রাজত্বকালে নানাভাবে বৌদ্ধধর্ম্মের অবনতি এবং এক প্রকার বিলোপ সাধিত হইয়াছিল। এই বিলোপের পর বৌদ্ধমত হিন্দুধর্ম্মের অন্তরালে, বালুকা মধ্যে ফল্গুধারার মত, প্রচ্ছন্ন ভাবে কোন প্রকারে একটু আত্মরক্ষা করিয়াছিল। আমরা সেন ও পাঠান আমলের পর তাহার অবতারণা করিব।
পাদটীকা :
১. বাঙ্গালার পুরাবৃত্ত, ১৭৭ পৃ।
২. যতীন্দ্রমোহন রায়—’ঢাকার ইতিহাস,’ ৪৮৮-৮৯, ৫১৭-১৮, ৫২১ পৃ।
৩. পেগুর অন্তর্গত সুধর্মনগর, বর্ত্তমান নাম থেটন।
৪. মহীপালের পুত্র ন্যায়পাল, [আঃ ১০৩০-১০৫৫ খৃষ্টাব্দ — History of Bengal, Dacca Univ, Vol. 1. —শি মি]
৫. Indian pundits in the Land of Snow. PP, 50-51; Rockhill’s Life of Buddha, P. 227.
৬. কাব্বালা পুকুরের সন্নিকটে পশ্চিমে যে বিস্তৃত উচ্চ ইষ্টক-বেদীকে বেহরাম বা বরোণ সাহের সমাধি বলা হয়, উহা একটি প্রাচীন বৌদ্ধস্তূপ বলিয়া অনুমান করি। বেদীটি দোলমঞ্চের মত, উহা ইদ্গা নহে, এমন সমাধি দরগাও অন্য কোথাও দেখি নাই। মঞ্চটি ২৪ ́×১৮ ́, নিম্নের বেদীটি এখনও ৪/৫ ফুট উচ্চ আছে। উহা প্রাচীরে ঘেরা ছিল। দোলমঞ্চ হইলে সেরূপ প্রাচীর থাকে না। নিম্ন বেদীর উপর তাকে তাকে আরও তিনটি বেদী আছে। উহা একটি প্রাচীন কালের ছোটখাট বৌদ্ধস্তূপ হওয়া বিচিত্র নহে। বেদীর দক্ষিণধারে যে সুন্দর পাকা কবর আছে, তাহাই বেহরাম সাহের কবর হইতে পারে।
৭. Westland, J. – Report on the District of Jessore : and its antitquities. 1871. P. 54 –শি মি
৮. বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থ প্রণীত ‘বিষ্ণুমূর্ত্তি-পরিচয়’, ৩-৮ পৃ।
৯. ‘Some of he bricks here measure 16”x13”x3” which bespeaks a high antiquity for the stupa. Comparing with this the dimensions of bricks of known periods found in the excavations of Saheth-Maheth it can be safely surmised that the stupa at Bharat Bhayna dates back at least from the Gupta period, roughly the fifth century A. D. It is probable that this was one of the 30 sanghara- mas mentioned by Hieun Tsang as existing in his time in the Samatata country in which modern Khulna must have been comprised at the time. ‘ – Report of K. N. Dikshit, পরিশিষ্ট (গ) দ্রষ্টব্য।
১০. ৪৮ পৃ দ্রষ্টব্য।
১১. বুড়ীভদ্র নদীর একটি সুন্দর বাঁকের মুখে গৌরীঘোনা গ্রামে রূপচাঁদ কুণ্ডুর বাড়ীর পশ্চিম গায়ে ভরত রাজার বাড়ী ছিল। বিস্তৃত স্থানে সর্ব্বত্র ইষ্টকখণ্ড বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। এখান হইতে ইট লইয়া নিকটবর্ত্তী লোকেরা বাড়ীতে প্রাচীরাদি নির্ম্মাণ করিয়াছেন। কিছুকাল পূৰ্ব্বে গৌরীঘোনা গ্রামের নীলকুঠিও মীর্জ্জানগরের জনৈক ব্যবসায়ী কর্তৃক এই স্থান হইতে ইট লইয়া নিৰ্ম্মিত হয়।
১২. এমন সুন্দর লালবর্ণ এবং প্রকাণ্ড আকারবিশিষ্ট ইট এ প্রদেশে কুত্রাপি দেখি নাই। ইটগুলি ১-২ ×২ ইঞ্চি পরিমিত। স্তূপের যেখানে সেখানে খনন করায় যথেষ্ট ইট বাহির হইয়াছিল। স্তূপের উত্তর পার্শ্বেই শ্রীনীলাম্বর গড়গড়ির বাড়ী। তিনি এই স্তূপ ও উহার বেষ্টনপ্রাচীরের ভগ্নাবশেষ হইতে ইট লইয়া নিজের বাড়ীতে একখানি প্রকাণ্ড ঘরের পোতা, দেওয়াল ও বারাণ্ডার পিপা নির্মাণ করিয়া লইয়াছেন।
১৩. বঙ্গীয় স্থাপত্য বিভাগের সুপারিন্টেন্ডেন্ট মহোদয় আশা দিয়া লিখিয়া গিয়াছিলেন ‘Steps are being taken to bring the mound within the provisions of the Ancient Monuments Preservation Act.’ এখনও আশানুরূপ কোন ব্যবস্থা হয় নাই। পরিশিষ্ট (খ) দ্রষ্টব্য—শি মি
১৫. Sir James Westland writes of Masjidkur pillars: ‘These stones were not brought there and were not fashioned for the purpose they at present fulfil. They belonged to some other structure, and they were taken from it or from its ruins to form pillars in this mosque.’-Report on the District of Jessore, 1871, P. 21.
১৬. এই অংশের একাদশ পরিচ্ছেদ, এই খণ্ডের শেষ পরিচ্ছেদ এবং পরবর্ত্তী খণ্ডে ইংরাজ আমলের দশম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য—শি মি
১৭. Westland’s Report on Jessore. P. 15 : আর্য্যাবৰ্ত্ত, জ্যৈষ্ঠ ১৩২০, ৯৪৫ পৃ।
১৮. J. A. S. B., 1867-8 Vol. XXXVI, P. 118.-The Antiquities of Bagerhat. by G. D. Basak.
১৯. মূর্তিখানি এত ভারী যে আমাদের ফটো তুলিবার সময় ৮ জন সবলকায় ব্রাহ্মণ দ্বারা প্রস্তর প্রতিমা গৃহ হইতে বাহিরে আনিতে হইয়াছিল।
২০. মহেশচন্দ্র ব্রহ্মচারীর আদিম বাস ছিল চরকাটি। তিনি মূর্ত্তিপ্রতিষ্ঠা করিয়া বর্ত্তমান শিবপুরে বাস করেন। তাহা হইতে বৰ্ত্তমান শ্ৰীমন্মথনাথ এবং বিহারীলাল ব্রহ্মচারী পর্যন্ত ১৬ পুরুষ হইয়াছে। মহেশ ব্রহ্মচারী নিঃসন্তান। তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র শিবরাম। উহার সপ্তম বা অষ্টম পুরুষ বংশধর রামনারায়ণ। তাহা হইতে দুই একটি ধারা এই :
রামনারায়ণ-শিবরাম-ঘনশ্যাম-ভবানী-স্বরূপ-উমেশ-মন্মথনাথ। ঘনশ্যামের অপর পুত্র গঙ্গাপ্রসাদ-উগ্রকণ্ঠ-অম্বিকা-হরিনাম-যামিনী। কেহ বলেন, মূর্ত্তির জন্য দেবোত্তর খাজাহান আলি দেন নাই। পরবর্ত্তী সময়ে গৌড়ের বাদশাহের জনৈক কর্মচারী এখানে আসিয়া প্রত্যক্ষ শিবের চড়কপূজায় অত্যদ্ভুত ব্যাপারাদি দর্শন করিয়া বাদশাহের পাঞ্জায় ৩৬০ বিঘা ভূমি নিষ্কর দেন। এ কথা অসম্ভব নহে, কারণ খাঁজাহানের মৃত্যুর কিছুকাল পরে হুসেন শাহ গৌড়ের বাদশাহ ছিলেন; তিনি হিন্দুদিগের প্রতি অত্যন্ত পক্ষপাতী ছিলেন। বাগেরহাটের সহিত তাহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। তাঁহার পুত্র নসরৎ কিছুদিন স্বয়ং বাগেরহাটে ছিলেন। সে সকল বিবরণ আমরা পরে প্রদান করিব। সদাশয় হুসেন শাহ বা তাঁহার পুত্র এই নিষ্কর ভূমি দান করিতে পারেন।
২১. গত ১৩২০ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের ‘আর্য্যাবর্ত্তে’ আমার ‘শিববাড়ীর বুদ্ধমূর্তি’ শীর্ষক প্রবন্ধ ও মূর্ত্তির চিত্র প্রকাশিত হয়। উক্ত পত্রের লব্ধপ্রতিষ্ঠ সম্পাদক শ্রদ্ধেয় বন্ধু হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ মহাশয় আমার অনুরোধ ক্রমে শিববাড়ীর মূর্ত্তি স্বয়ং দেখিয়া আমরা প্রবন্ধের সঙ্গে তাঁহার নিজ বিবরণী প্রকাশ করেন। আমি যে ফটো লইয়া ব্লক প্রস্তুত করিয়াছিলাম, সেই ফটো হইতে ১৩১৯ সালের গৌষ মাসে বাগেরহাটের ‘পল্লীচিত্রে’ হঠাৎ বিনা বিবরণীতে একটি ছবি মাত্র প্রকাশিত হয়। পরবর্ত্তী মাসে ‘গৃহস্থ’ পত্রে উহার একটি অনুকৃতি প্রকাশিত হয়। মদীয় প্রবন্ধে গবর্ণমেন্টের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল। পরম শ্রদ্ধেয় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বুদ্ধমূর্তি দেখিতে যাইবার জন্য আয়োজন করিয়াছিলেন, ঘটনাচক্রে এখন পর্যন্ত তাঁহার যাওয়া হয় নাই। তিনি গেলে, পাষাণে কিছু কথা কহিত। আর্কিওলজিকাল বিভাগের বর্তমান (১৯২৮) সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট কাশীনাথ দীক্ষিত মহোদয় কয়েক বৎসর পূর্ব্বে স্বয়ং আমার সঙ্গে শিববাড়ী গিয়া উহার বিস্তৃত বিবরণ লিখিয়াছিলেন।
২২. ‘The image of Buddha in the middle and the ornamental reliefs round about provided another model for these representations. The steles in the centre of which Buddha stands or sits, are then much reduced; beside him are disciples and monks, above rises a pointed arch in which a conver- sion scene is represented.’ Buddhist Art in India: Stele Representations (translated from the Hand Book of Professor A. Grunwedel, PP. 133-4).
২৩. Br. 5. Catalogue of the Indian Museum Vol 11.
২৪. ‘The history of the sculpture is unknown and it is supposed to be from Behar.’ Ibid., Vol. II, P. 80.
২৫. এই বঙ্গীয় ভাস্কৰ্য্য পদ্ধতি সম্বন্ধে আমি বিস্তৃতভাবে অন্যত্র আলোচনা করিয়াছি। See my articles on ‘Bengal School of Art’ published in Indian Historical Quarterly, 1925 P. 76.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন