সতীশচন্দ্র মিত্র
মহারাজ মহীপালের রাজত্বকালে সামন্ত সেন নামক এক ব্যক্তি কর্ণাট দেশ হইতে আসিয়া সুবর্ণরেখা নদীতীরে এক ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করেন। সিরাজগঞ্জের তাম্রশাসন হইতে জানা যায়, তিনি কর্ণাট ক্ষত্রিয়।[১] তৎপুত্র হেমন্ত সেন; তিনি একজন প্রসিদ্ধ যোদ্ধা ছিলেন। হেমন্তের পুত্র বিজয় সেন। তিনি বরেন্দ্র মণ্ডলে আসিয়া রাজ্য স্থাপন করেন।[২] হেমন্ত সেন বা বিজয় সেনের সহিত বিবাহসূত্রে শূরবংশীয় নৃপতিদিগের সহিত সম্বন্ধ হইয়াছিল।[৩] বিজয় সেনের বরেন্দ্রাধিকার উপলক্ষ্যে গৌড়াধিপ পালরাজের সহিত যুদ্ধসংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল। তজ্জন্যই মদন পাল মগধে বিতাড়িত হন। সেখানে তাঁহারা আরও কিছুকাল রাজত্ব করিয়াছিলেন। বিজয় সেন কামরূপ ও কলিঙ্গ জয় করেন এবং মিথিলাধিপতি নান্য দেবকে পরাজিত ও কারারুদ্ধ করেন। বরেন্দ্র মণ্ডলে বিজয়পুরে[৪] তাঁহার রাজধানী ছিল। বিজয় সেনের তিন পুত্র ছিল বলিয়া জানা যায়। এক স্ত্রীর গর্ভে দুই পুত্র— মল্ল ও শ্যামল বর্ম্মা,[৫] অন্য স্ত্রীর গর্ভে— বল্লাল সেন।[৬] সম্ভবতঃ বিজয় সেনের জীবদ্দশায় মল্ল ও শ্যামল উভয়ই মৃত্যুমুখে পতিত হন; এজন্য বিজয় সেন পরলোকগত হইলে বল্লালই তাঁহার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
বিজয় সেনের রাজ্যারোহণের পর শ্যামল বৰ্ম্মা দিগ্বিজয়ে বহির্গত হন এবং সমগ্র উপবঙ্গের অধিকাংশ জয় করেন।
‘গঙ্গায়াঃ পূৰ্ব্বভাগঞ্চ মেঘনদ্যাশ্চ পশ্চিমম্।
উত্তরাল্লরণাক্কেশ্চ বারেন্দ্রাচ্চৈব দক্ষিণম্॥
করদং রাজ্যমাসাদ্য শ্যামলাখ্যোহপ্যশাসয়ৎ।
সেনবংশীয়ভূপানামাশ্রয়েণ স্বধৰ্ম্মভাক্।।’
—সামন্তসারের বৈদিক কুলার্ণব
অর্থাৎ ভাগীরথীর পূর্ব্ব ভাগে বরেন্দ্রের দক্ষিণে মেঘনা নদীর পশ্চিমে এবং লবণ সমুদ্রের উত্তর ভাগে শ্যামলনামা নৃপতি সেনরাজগণের আশ্রয়ে এক করদ রাজ্য লাভ করিয়া স্বধর্ম্মনিরত হইয়া রাজত্ব করিতেছিলেন। উপবঙ্গের যে সীমার কথা পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে, ইহার সহিত তাহা সম্পূর্ণ মিলিয়া যাইতেছে। এই বর্ণনা হইতে শ্যামলবর্ম্মাকে বিজয়সেনের পুত্র বলিয়া বোধ হয় না।[৭] যাহা হউক, তিনি যাহাই হউন এবং সেনরাজের সহিত তাঁহার রাজনৈতিক যে সম্বন্ধই থাকুক, তিনি যে দূরদেশে একপ্রকার স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতেছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।[৮] আমাদের আলোচ্য যশোহর-খুলনা এই বর্ম্মরাজের অধীন হইয়াছিল। বহুকাল হইতে এ প্রদেশে অরাজকতা হইতেছিল, এই শ্যামলবর্ম্মাই তাহার পরিহার করেন। সে অনৈতিকতার যুগে দেশের উপর দিয়া নানা বিপ্লব চলিয়া গিয়াছিল। শুধু রাজ্যবিপ্লব নয়, ধৰ্ম্মবিপ্লব, সমাজবিপ্লব এবং সর্ব্বোপরি সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বিপ্লবে দেশকে বিপর্যস্ত করিয়াছিল। এই সময় হইতে পূর্ণ একশত বৎসর কাল পুনরায় দেশে সর্ব্ববিধ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইল। রাজ্যে সুশাসন চলিতে লাগিল, বৌদ্ধধর্ম সম্পূর্ণরূপে হিন্দুধর্ম্মের নিকট পরাজয় স্বীকার করিল, সমাজ পুনরায় নূতন করিয়া গঠিত হইল, উচ্চমন্দির, নানাবিধ হিন্দু তান্ত্রিকবিগ্রহ, জলাশয় প্রভৃতির উদ্ভব হইতে লাগিল, আর সঙ্গে সঙ্গে বনগ্রাম, জঙ্গল বাধাল ও ‘বুনিয়ার’ দেশ মাথা তুলিয়া জনকোলাহলময় হইতে লাগিল। ইংরাজরাজত্বের পূর্ব্বে বঙ্গদেশে সেনরাজগণের মত আর কেহ শাসনদণ্ড পরিচালনা করিতে পারেন নাই।
শ্যামলবর্ম্মা যখন দক্ষিণ বঙ্গ শাসন করিতেছিলেন, বল্লাল তখন পূর্ব্ববঙ্গের শাসনকর্তা ছিলেন। বিক্রমপুরের অন্তর্গত রামপালে তাঁহার রাজধানী ছিল। পালবংশীয় রামপালই এই নগরীর প্রতিষ্ঠাতা।৯ শ্যামলবর্ম্মার রাজধানীও বিক্রমপুরের সন্নিকটে ছিল। পূৰ্ব্বেই কথিত হইয়াছে বিজয় সেনের জীবদ্দশায় শ্যামলের মৃত্যু ঘটে। ১১১৯ খৃষ্টাব্দে পিতার মৃত্যু হইলে বল্লালসেন সিংহাসন লাভ করেন।[১০] ‘দানসাগর’ হইতে জানা যায় তিনি ১১৬৯ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহার রাজত্বকাল ৫০ বৎসর। বল্লালসেন রাজ্যলাভ করিয়াই মিথিলার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন ও অবশেষে জয়লাভ করিয়াছিলেন। এই সময়ে রামপালে তাঁহার পুত্র লক্ষ্মণ সেনের জন্ম হয়। একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, মিথিলা-যুদ্ধে বল্লালের মৃত্যুকথা প্রচারিত হইয়াছিল, তদনুসারে লক্ষ্মণ সেনের জন্মমাত্রই রাজ্যপ্রাপ্তি যোগ ঘটে। মিথিলা-বিজয় ও পুত্রের জন্ম এই উভয় ঘটনা চিরস্মরণীয় করিবার নিমিত্ত বল্লাল একটি নূতন সম্বৎ প্রবর্তন করেন; পুত্রের নামানুসারে উহারই নাম রাখা হয় লক্ষ্মণ সম্বৎ বা লসং। মিথিলায় এখনও এই লসং চলিতেছে।[১১] বল্লাল এইভাবে ক্রমে ক্রমে মিথিলা, বঙ্গ, রাঢ়, বরেন্দ্র ও বাগড়ী জয় করেন, এই পঞ্চরাজ্যে রীতিমত প্রতিনিধি নিৰ্ব্বাচন করিয়া সুশাসন প্রবর্তিত করেন। সর্ব্বত্রই তাঁহার সবল শাসনে সুফল ফলিয়াছিল। দেশে দস্যু-দুর্বৃত্তের উৎপত্তি ছিল না। এই সময়ে সমতটেরই পশ্চিমাংশের নাম বাড়ী হইয়াছিল। যশোহর-খুলনা এই বাড়ী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া বল্লালের শাসনাধীন ছিল।
বল্লালসেন এক নীচজাতীয় স্ত্রীর রূপে মুগ্ধ হইয়া তাহাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করেন। তজ্জন্য লক্ষ্মণসেন পিতার উপর অত্যন্ত বিরক্ত হন। তিনি মাতার দ্বারা উদ্রিক্ত হইয়া পিতার ঐ সমাজবিরুদ্ধ কার্য্যের তীব্র প্রতিবাদ করিলে, বল্লালসেন সেই দুষ্টা রমণীর কুমন্ত্রণায় পুত্রকে নিৰ্ব্বাসিত করেন। ইহার পর কিছু কাল অতীত হইল। এমন সময়ে বর্ষাকালে একদিন বল্লাল আহার সময়ে অন্দরে গিয়া দেখিতে পাইলেন যে, তাঁহার ভোজনগৃহের প্রাচীরে কে যেন একটি শ্লোক লিখিয়া রাখিয়াছে :
পতত্যবিরলং বারি নৃত্যন্তি শিখিনো মুদা।
অদ্য কান্তঃ কৃতান্তো বা দুঃখস্যান্তং করিষ্যতি ॥
বল্লালের বুঝিতে বাকি থাকিল না যে, ইহা তাঁহার পতিবিধূরা পুত্রবধূরই মর্ম্মোক্তি। তখন লক্ষ্মণসেনের কথা তাঁহার মনে পড়িল, প্রিয় পুত্রকে নির্ব্বাসিত করিবার জন্য মনে মনে বড় অনুতপ্ত হইলেন। তৎক্ষণাৎ রাজদ্বারে আসিয়া রাজনাবিকগণকে ডাকিলেন এবং প্রচার করিলেন যে, তাহাদের মধ্যে যদি কেহ পরদিন সূর্যোদয়ের পূর্ব্বে তাঁহার পুত্র লক্ষ্মণসেনকে আনিয়া দিতে পারে, তবে সে রাজ্যাংশ পুরস্কার প্রাপ্ত হইবে। সূর্য্যনামক এক দুঃসাহসিক ধীবর এই দুরূহ কাৰ্য করিতে অগ্রবর্ত্তী হইল। সে অসংখ্য ক্ষেপণীযুক্ত এক তরণী লইয়া তন্মুহূর্তে যাত্রা করিল। বল্লাল নিম্নলিখিত শ্লোকটি পুত্রের নিকট প্রেরণ করিলেন :
সন্তপ্তা দশমধ্বজাগতিনা সন্তাপিতা নির্জনে।
তুর্য্য্যদ্বাদশবৎ দ্বিতীয়মতিমন্নেকাদশেভস্তনী।।
সা ষষ্টী নৃপঞ্চমস্য ভবিতা ভ্রূসপ্তমী বর্জ্জিতা।
প্রাপ্নোত্যষ্টমবেদনাং প্রথম হে তৃৰ্ণং তৃতীয়ো ভব।।[১২]
সূর্য্যনারায়ণ এই অদ্ভুত কার্য্যের পুরস্কারস্বরূপ সূর্য্যদ্বীপ[১৩] অঞ্চল প্রাপ্ত হন। যশোহরের অন্তর্গত মহেশপুরে তাঁহার প্রাচীন রাজধানীর চিহ্ন এখনও বর্ত্তমান। এই দেশকে এখনও সূর্য্যমাঝির দেশ বা ধীবর রাজ্য বলে। কেহ কেহ সেই মাঝির নাম মহেশ ছিল এবং তজ্জন্য তাহার বাসস্থানের নাম মহেশপুর হয়, এই নির্দ্দেশ করেন। কিন্তু প্রচলিত প্রবাদে তাহার সূর্য্যমাঝি নামই রক্ষা করিয়াছে; মহেশ নামে তাহার কোন পুত্র থাকিতে পারে।
বল্লালের মৃত্যুকালে লক্ষ্মণসেন উপস্থিত ছিলেন না। পিতার সহিত তাঁহার অসদ্ভাব শেষ পৰ্য্যন্ত চলিয়াছিল। তিনি স্বীয় জ্যৈষ্ঠপুত্র মধু বা মাধব সেনকে পিতার মৃত্যুকালে তৎসমীপে প্রেরণ করিয়াছিলেন। বল্লাল স্বরাজ্য বালক মধুসেনকে দিয়া যান। তাঁহার মৃত্যুর পর লক্ষ্মণ আসিয়া রাজদণ্ড গ্রহণ করেন। সেন-রাজগণের মধ্যে তিনি সর্ব্বাপেক্ষা প্রতাপশালী ও সুবিখ্যাত ছিলেন। বাখরগঞ্জের অন্তর্গত ইদিলপুরের প্রাপ্ত তাম্রশাসন হইতে জানা যায়,[১৪] লক্ষ্মণসেন দক্ষিণ সমুদ্রের কূলে শ্রীক্ষেত্রে, বারাণসীতে বিশ্বেশ্বরস্থানে এবং গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমে ত্রিবেণীতে ‘সমরজয়স্তম্ভমালা’ স্থাপন করিয়াছিলেন। মাধাই নগরের তাম্রশাসন হইতে জানা যায়, তিনি কাশীরাজকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়াছিলেন। পিতার রাজত্বকালে যুবরাজ লক্ষ্মণসেন তাঁহার নানা অভিযানের সহায়ক ছিলেন; বল্লাল সেন কলিঙ্গ বিজয় করিয়াছিলেন বলিয়া উল্লিখিত আছে, তাহা লক্ষ্মণসেনের বাহুবলেই সম্পাদিত হইয়াছিল। সুতরাং দেখা যাইতেছে, লক্ষ্মণসেন বীরদর্পে বহিঃশত্রুর আক্রমণ হইতে দেশ রক্ষা করিয়াছিলেন। কিন্তু দেশের মধ্যে তেমন শৃঙ্খলা স্থাপন করিতে পারিয়াছিলেন কিনা সন্দেহস্থল। কারণ, তাহা হইলে তাঁহার রাজত্ব হিন্দুরাজত্বের শেষ রাজত্ব হইত না।
লক্ষ্মণসেন পরম পণ্ডিত, নানাশাস্ত্রবিৎ, সুকবি ও একান্ত বিদ্যোৎসাহী এবং দানের কল্পতরু ছিলেন। তাঁহার রাজত্বের শেষভাগে তিনি শস্ত্রচর্চ্চা অপেক্ষা শাস্ত্রচর্চ্চাতেই অধিকতর মনোযোগী হইয়াছিলেন। তাঁহার রাজসভা পণ্ডিতপরিষদে পরিবর্তিত হইয়াছিল; সে পঞ্চরত্নপরিষদ্ অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন: ‘গীতগোবিন্দ’-রচয়িতা জয়দেব, ‘পবন-দূত’-প্রণেতা কবিরাজ ধোয়ী, অসাধারণ কবি শরণ, মহামন্ত্রী উমাপতিধর, আর ‘আর্য্যাসপ্তশতী’র গ্রন্থাকার গোবর্দ্ধন।[১৫] সেনরাজগণের সঙ্গে সঙ্গেই বোপদেবকৃত মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ দক্ষিণাপথ হইতে বঙ্গদেশে আসে এবং তাঁহাদের অবসানের পরেও বঙ্গের অনেক প্রদেশে রাজত্ব করিতেছে। কিন্তু তবুও তখন পাণিনির অনাদর ছিল না। এবং উহার সাহায্যে বৈদিক শাস্ত্রচর্চ্চার পথ সুগম করিবার জন্য লক্ষ্মণসেনের আদেশে পুরুষোত্তমের ‘ভাষাবৃত্তি’ রচিত হয়। লক্ষ্মণসেনের প্রাড়ু বিবাক বা প্রধান বিচারপতি হলায়ুধ বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের প্রচলন জন্য ‘ব্রাহ্মণসর্ব্বস্ব’ রচনা করেন। মহারাজ লক্ষ্মণ নিজেও সুকবি ছিলেন, তৎপ্রণীত অনেক শ্লোক তাঁহার মৃত্যুর পর শ্রীধরদাস কর্তৃক ‘সদুক্তিকর্ণামৃতে’ সংগ্রহীত হয়। আরও কত কবি ও পণ্ডিত যে লক্ষ্মণসেনের রাজসভার শোভাবর্দ্ধন করিতেন, তাহার ইতিহাস নাই। মহাকবি জয়দেবের ‘মধুর কোমলকান্ত পদাবলী’ বঙ্গদেশে সেই তান্ত্রিকযুগে যে এক অপূর্ব্ব প্রেমোন্মাদের উন্মেষ করিয়া দিয়াছিল, তাহাই হইয়াছিল চৈতন্য-যুগের ধর্ম্মস্রোতের প্রবর্ত্তক। এই বিদ্যাচর্চ্চার প্রভাব সমগ্র বঙ্গে বিস্তৃত হইয়াছিল।
শুধু বিদ্যাচর্চ্চা নহে, ধর্ম্ম ও সমাজসংস্কারও সেনরাজগণের প্রধান কৰ্ত্তব্য হইয়াছিল। বল্লালসেন সমাজের দুরবস্থা অপনয়নজন্য ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যদিগের কৌলীন্য-মৰ্য্যাদা সংস্থাপন করেন; লক্ষ্মণসেনের সময়ে তাহার বিশেষ ব্যবস্থা ও উৎকর্ষ সাধিত হয়। আমরা পরে তাহার বিশেষ বিবরণ দিব। এ কৌলীন্যজন্য সমাজমধ্যে মহা আন্দোলন হয় এবং রাজমধ্যে সর্ব্বত্র কুলীনদিগের বসতি স্থাপন জন্য দেশের অবস্থারও পরিবর্তন সাধিত হয়।
বল্লালের পূর্ব্ব পর্য্যন্ত বৌদ্ধমতই দেশের মধ্যে প্রধান ধৰ্ম্ম ছিল। বল্লালসেনও প্রথমে এই মতের পক্ষপাতী ছিলেন। পরে তিনিও তান্ত্রিক হিন্দুধর্ম্মে দীক্ষিত হন। লক্ষ্মণসেন পরম ভক্ত হিন্দু ছিলেন। পিতাপুত্রের রাজত্বকালে তাঁহাদের রাজমধ্যে তন্ত্রোক্ত দেবদেবী মূৰ্ত্তি নির্ম্মিত হইয়া প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এখনও বহুস্থানে এই সকল মূৰ্ত্তি নিৰ্ম্মিত হইয়া প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এখনও বহুস্থানে এই সকল মূর্ত্তি বর্তমান রহিয়াছে। ইহা ব্যতীত আরও কত সহস্র মূর্ত্তি বিধর্মীর অত্যাচারে ও দৈশিক বিপ্লবে কতক বিনষ্ট, কতক ভূপ্রোথিত বা নদীগর্ভর্গত হইয়াছিল, তাহার ইয়ত্তা নাই। যশোহর-খুলনার সর্ব্বত্র এই সকল মূর্ত্তি এখনও দেখিতে পাওয়া যাইতেছে। এই সকল মূর্তির কতক ঠিক এই যুগেই নিৰ্ম্মিত হইতে পারে, পরবর্ত্তী যুগে সেনরাজগণের মূর্তির অনুকরণে নির্ম্মিত হওয়া বিচিত্র নহে। এই সকল মূর্তির মধ্যে চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূৰ্ত্তি, গণেশমূর্তি এবং নানা জাতীয় তন্ত্রোক্ত দেবীমূৰ্ত্তিই প্রধান।[১৫ক]
চতুর্ভুজ বাসুদেব প্রভৃতি চতুৰ্ব্বিংশতি প্রকার বিষ্ণুমূর্তিমধ্যে অনেক প্রকার মূর্ত্তি যশোহর- খুলনায় আছে। শঙ্খচক্রগদাপদ্মের স্থাপনাভেদে এই বিষ্ণুমূৰ্ত্তি সকল বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হইয়াছে।[১৫খ] ইহার অধিকাংশ মূর্ত্তিই পাষাণময়ী, স্থানে স্থানে দুই একটি পিত্তল বা অন্য ধাতু নির্ম্মিত মূৰ্ত্তিও পাওয়া যায়। এখানে আদর্শস্বরূপ যে একটি বিষ্ণুমূর্ত্তির চিত্র প্রদত্ত হইল, উহার নাম শ্রীধর বা দামোদর। এই মূর্তিটি কয়েক বৎসর পূর্ব্বে মহেশ্বরপাশা নিবাসী দুর্গাদাস মজুমদার মহাশয়দিগের বাড়ীতে একটি পুষ্করিণী খনন কালে ৮/১০ হাত মৃত্তিকার নিম্নে প্রাপ্ত হওয়া যায়। উহা এক্ষণে ঐ গ্রামনিবাসী শ্রীগোপালচন্দ্র ভদ্রের বাটীতে পূজিত হইতেছেন।
সেনরাজগণের পূর্ব্বে এতদঞ্চলে মূর্তিদ্বারা গণেশ পূজা ছিলনা। ভারতবর্ষের অন্যত্র আবহমান কাল এই গণেশ মূর্তির পূজা প্রচলিত আছে। কিন্তু বঙ্গদেশে সেনরাজগণের আমলেই উহা প্রচলিত হয়। আবার সে রাজত্বের শেষেই উহার বিলোপ হইয়াছে। গাণপত্য মত এদেশে নাই। ইহা দ্বারা বুঝা যায়, গণপতি মূর্ত্তি এ অঞ্চলের অধিবাসিগণের অন্তঃকরণে কোন স্থায়ী ভক্তিভাবের প্রতিষ্ঠা করিতে পারে নাই।
দিগ্বিজয়প্রকাশে বিবৃত হইয়াছে যে, মহারাজ লক্ষ্মণসেন যশোরেশ্বরীর মন্দিরসন্নিধানে চণ্ডভৈরবের এক মন্দির নির্মাণ করাইয়া দেন। বর্ত্তমান সময়ে যশোরেশ্বরী মায়ের মন্দিরে যে চণ্ডভৈরবের বাণলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত আছেন, ঐ মূৰ্ত্তি ঐ সময়ে নির্ম্মিত হইয়াছিলেন কিনা বলা যায় না। যেখানেই কোন কারণে লক্ষ্মণসেনের সম্বন্ধ ঘটিয়াছিল, সেখানেই তিনি কোন দেবমূর্তি প্রতিষ্ঠা দ্বারা সে সম্বন্ধ চিরস্মরণীয় করিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। সম্ভবতঃ তিনিই গঙ্গাসাগরের মোহনায় সগরদ্বীপে এক পৃথক্ মন্দিরে একটি গঙ্গামূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়া যান। সুন্দরবনের বিপ্লবে যশোরেশ্বরীর প্রতিমার মত সে মূর্তিও জঙ্গলের মধ্যে জঙ্গলাবৃত হইয়াছিলেন। প্রতাপাদিত্যের সগরদ্বীপ অধিকারকালে উক্ত গঙ্গামূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হন।[১৬] পুরাতন যশোরেশ্বরী দেবী সত্যযুগ হইতে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন বলিয়া লোকে তাঁহার কথা জানিত। গঙ্গামূর্তি আবিষ্কারের পর প্রতাপাদিত্য ঐ অপূর্ব্ব মূর্ত্তি নিজ রাজধানীতে আনিয়া প্রতিষ্ঠিত করেন এবং উহার সেবার জন্য দেবোত্তর সম্পত্তি নির্দ্দিষ্ট করিয়া দেন। তাঁহার পতনের পর সুন্দরবনের পতনাবস্থায় রাজধানী কিছুকাল জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। এমন কি সেই বিপ্লবের মধ্যে কিছুকাল অদৃষ্ট অবস্থায় থাকায় লোকে সে গঙ্গামূর্তির নাম পর্য্যন্ত ভুলিয়া গিয়া তাহাকে অন্নপূর্ণা দেবী স্থির করিয়া লইয়াছিল। পরবর্তীযুগের দলিলপত্রে এই অন্নপূর্ণা নামই প্রচলিত হইয়া আসিতেছে। এ মূর্ত্তি অতি সুন্দর; যে অপূর্ব্ব ভাস্কর-শিল্প এই মূৰ্ত্তি গড়িয়াছিল, পাঠান আমলের তামসযুগে তাহার কোন চর্চ্চা না থাকায়, পরবর্ত্তী আমলে এমন প্রতিমা প্রস্তুত করা অসম্ভব হইয়াছিল। এই মকরবাহনা, মাল্যহস্তা দেবীর দেহভঙ্গিমা অতীব মধুর এবং তাঁহার সুন্দর মুখমণ্ডল হইতে যে দিব্যলাবণ্যপ্রভা বিকীর্ণ হইতেছে তাহাও অতুলনীয়। আমাদের মনে হয়, এই অপূর্ব্ব মূর্ত্তি সেনরাজত্বেরই সম্পত্তি। দুঃখের বিষয় গঙ্গাদেবী অন্নপূর্ণা নামে পূজিত হইতেছেন এবং তাঁহার দেবোত্তর সম্পত্তিও সেই নামে চলিয়া আসিতেছে।[১৭]
যশোহর-খুলনার সহিত সেনরাজগণের আরও সম্বন্ধ ছিল। পূর্ব্বে বলিয়াছি, এই যুক্ত জেলা এক্ষণে যে স্থান অধিকার করিয়াছে, তাহা পূর্ব্বে বাগড়ী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বল্লালসেনের সমগ্র রাজ্য পাঁচটি প্রধান ‘ভুক্তি’ বা প্রদেশে বিভক্ত ছিল, যথা : বঙ্গ, মিথিলা, বরেন্দ্র, রাঢ় ও বাগড়ী; মিথিলার পূর্ব্বনাম তীরভুক্তি। এই ভুক্তিগুলি পুনরায় ‘মণ্ডল’ বা মণ্ডলিকায় বিভক্ত ছিল। মণ্ডল অতি প্রাচীন হিন্দু শব্দ। ভাগবতাদি পুরাণেও মণ্ডলের কথা আছে। মুসলমান যুগ হইতে মহল বা জেলা শব্দ এই একই অর্থে ব্যবহৃত হইতেছে। প্রত্যেক জেলায় যেমন এক্ষণে কতকগুলি করিয়া সবডিভিসন বা উপবিভাগ আছে, সেনরাজত্বে মণ্ডলসমূহও সেইরূপ কতগুলি ‘বিষয়’ বা ‘শাসনে’ বিভক্ত ছিল। এখনও বিষয় কথা চলিয়া আসিতেছে, ক্ষুদ্র জমিদার বা তালুকদার প্রভৃতি ‘বিষয়ী’-লোকে বিষয় কার্য্য দেখেন এবং বিষয় রক্ষা করেন। দেশে কু-শাসন থাকিলেও এখন আর ‘শাসন’ কথার পূৰ্ব্ব অর্থ নাই, ব্রহ্মশাসন প্রভৃতি গ্রামের নাম পূর্ব্ব শাসনের চিহ্ন রাখিয়াছে।
বল্লালসেনের ৫টি খণ্ড রাজ্য বা ভুক্তির জন্য পাঁচটি প্রাদেশিক রাজধানী ছিল। বঙ্গের রাজধানী ছিল, বিক্রমপুরের অন্তর্গত রামপালে। লক্ষ্মণসেনের সময়ে তৎপুত্র বিশ্বরূপ এই স্থানে থাকিয়া প্রতিনিধিস্বরূপ বঙ্গ শাসন করিতেন। বল্লালের সময়ে বরেন্দ্রের রাজধানী ছিল পৌণ্ড্রবর্দ্ধনে। প্রকাণ্ড দীর্ঘিকা, দুর্গপরিখা ও ইষ্টকস্তূপ ঐ স্থানের প্রাচীনত্বের সাক্ষী আছে। বর্তমান মালদহ সহরের সন্নিকটে একটি স্থানকে ‘বল্লাল বাড়ী’ বলে; সেখানেও বল্লালের কোন বাড়ী বা দুর্গ থাকা সম্ভব। লক্ষ্মণসেন রাজা হইয়া পৌণ্ড্রবর্দ্ধনের কিছুদূর দক্ষিণে গঙ্গার ভাগীরথী নামক শাখার তীরে সুরম্য লক্ষ্মণাবতী নগরী নির্ম্মাণ করেন। মুসলমানেরা উহাকেই লক্ষ্ণৌতি বা গৌড় বলিতেন। রাঢ়ের রাজধানী ছিল সম্ভবতঃ বীরভূমের অন্তর্গত লক্ষ্ণৌর নামক স্থানে। বঙ্গবিজয়ের পর পাঠানেরা এই স্থানে আড্ডা করিয়াছিলেন। লক্ষ্ণৌরে মুদ্রিত পাঠান আমলের মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। মিথিলার রাজপাট কোথায় ছিল জানা যায় না। হয়ত লক্ষ্মণসেন ইহার শাসনকেন্দ্রের জন্য বর্তমান পূর্ণিয়া জেলার মধ্যে রামাবতী নগরী নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। ‘সেকশুভোদয়া’ গ্রন্থে লিখিত আছে : ‘পুরী রামাবতী যত্র ভুবি বিখ্যাতনামিকা’।[১৮] কিন্তু বাড়ীর শাসনকেন্দ্র কোথায় ছিল?
নবদ্বীপে সেনরাজগণের কোন রাজনৈতিক শাসনকেন্দ্র ছিল না। বল্লালসেন বৃদ্ধ বয়সে এইস্থানে গঙ্গাবাসের আবাস স্থির করিয়াছিলেন। কুলকারিকা হইতে জানা যায় :
‘মুক্তিহেতু বল্লাল আসিল গঙ্গা স্নান
জহ্নুনগরোত্তরে করে যে বাসস্থান।’
নবদ্বীপে যেখানে বল্লাল নগর প্রতিষ্ঠিত হয়, এখনও যেখানে বল্লাল দীঘি ও প্রকাণ্ড ভগ্ন অট্টালিকা পূর্ব্ব পরিচয় প্রদান করিতেছে, তাহা এক সময়ে তিন দিকে ভাগীরথী দ্বারা বেষ্টিত একটি সুন্দর দ্বীপ এবং তীর্থস্থান ছিল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ বৃদ্ধ নৃপতির সহচর হইয়া এখানে আসিয়া নানা স্থানে বাস করিতেছিলেন। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের আগমনে এইস্থান একটি প্রসিদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্ৰ হইয়া পড়িয়াছিল। লক্ষ্মণসেনের সময়েও এখানে রাজধানী ছিল না, দুর্গ বা সৈন্যাবাস ছিল না। সুতরাং ইহাকে আমরা প্রাদেশিক রাজধানী বলিতে পারি না। কিন্তু কানন-কুন্তলা বাড়ী ভূমি নানা দুর্বৃত্ত জাতির বসতি হেতু দুৰ্দ্দমনীয় ছিল। সেখানে নিশ্চয়ই কোনও শাসনকেন্দ্র ছিল। তাহা কোথায়?
আমরা এই প্রশ্নের উত্তরস্বরূপ একটি অনুমান উপস্থিত করিতেছি। বহুদিন ভ্রমণ ও চিন্তার পর এই অনুমান সমীচীন বলিয়া মনে করিয়াছি; এজন্য অসঙ্কুচিত ভাবে ইহা সাধারণের সমক্ষে প্রকাশিত করিলাম। হয়ত ইহা অনুমান মাত্র। কিন্তু যে ঘটনা-পরম্পরার সমাবেশে এই দিকে চিন্তা-প্রবাহ সমাকৃষ্ট করিয়াছে, পাঠকের অবিশ্বাসের পূর্ব্বে তাহা বিশেষভাবে বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। যশোহর জেলায় নড়াইল সবডিভিসনের মধ্যে, সিঙ্গিয়া রেলওয়ে ষ্টেশনের সন্নিকটে সেখহাটি বলিয়া একটি গ্রাম আছে। ইহার নিম্নদিয়া এক্ষণে ভৈরব প্রবাহিত, অপর পারে জগন্নাথপুর গ্রাম। পূর্ব্বে ভৈরব জগন্নাথপুরের দক্ষিণ দিয়া প্রবাহিত হইত এবং তখন জগন্নাথপুর ও সেখহাটি একপারে পরস্পর সংলগ্ন ছিল। ভৈরব ক্রমান্বয়ে দক্ষিণ হইতে উত্তরের দিকে গতি পরিবর্তন করিয়াছে; ভৈরবের সে প্রাচীন খাতগুলি জগন্নাথপুর গ্রামে এখনও বিদ্যমান আছে। এই জগন্নাথপুর-সেখহাটিতে পূর্ব্বে কোন প্রাদেশিক রাজধানী ছিল বলিয়া মনে করি।
স্থানের অবস্থান এ অনুমানের প্রথম কারণ। এক্ষণে নদী নানা ভাবে প্রবাহিত হইয়া স্থানটিকে নানা খণ্ডে বিভক্ত করিয়াছে বটে, কিন্তু পূৰ্ব্বকালে এখানে একটি প্রকাণ্ড নগরী ছিল। বর্তমান সময়ে চারিটি গ্রাম এই বিস্তীর্ণ নগরীর চারি অংশ নির্দ্দেশ করিতেছে। উত্তর দিকে বহির্ভাগ (বৰ্ত্তমান নাম বাহিরভাগ), পূর্ব্বদিকে দেবভাগ (বর্তমান নামও তাহাই), দক্ষিণদিকে তপোবন ভাগ বা তর্পণভাগ[১৯] (বর্তমান নাম তপন ভাগ) এবং পশ্চিম দিকে প্রেমভাগ (বৰ্ত্তমান পমভাগ)। ইহা লইয়া নগরটি ৪ মাইল দীর্ঘ ও চারি মাইল প্রস্থ হইবে। জগন্নাথপুর ও প্রেমভাগ প্রভৃতি গ্রামগুলি সেখহাটির সহিত এক পারেই ছিল। বহির্ভাগ হইতে রাজবর্ম পশ্চিমে কপোতাক্ষ ও পূর্ব্বে চিত্রা পর্য্যন্ত ছিল। দেবভাগে নগরীর প্রধান প্রধান দেবালয় ছিল, উহার নিদর্শন আছে। তপোবনভাগে নিষ্ঠাবান্ ব্রাহ্মণগণের বাস ছিল, এখনও তপনভাগ একটি ব্রাহ্মণ প্রধান প্রসিদ্ধ স্থান। প্রেমভাগে পান্থনিবাস, দেবালয় প্রভৃতি থাকিবার সম্ভব। দক্ষিণে দেবপাড়া (বৰ্ত্তমান দেয়াপাড়া) নামক স্থানেও বিগ্রহ-মন্দির থাকিতে পারে, এখনও সে প্রাচীন পল্লীতে অনেক ব্রাহ্মণের বহু পুরুষানুক্রমে বসতি ও তথাকার পণ্ডিতবর্গ দেশে বিদেশে খ্যাতিমান। এই সকল স্থানের মধ্যস্থলে নগরীর বাজার হাট ছিল, হয়ত সেখহাটি নামও পূর্ব্বে সেনহট্ট, শঙ্করহট্ট, শঙ্খহট্ট, বা শাঁখ হাট ছিল। পাঠান আমলে সে স্থানে সেখের বাসহেতু ‘সেখপাড়া’ গ্রাম হইলে হাটের নামও সেখহাটি হইয়া গিয়াছে। এখন নিকটবর্ত্তী শাঁখারিগাতি, বাণিয়াগাতি কিছু পূৰ্ব্ব পরিচয় দিতেছে। দেয়াপাড়া সংলগ্ন একটি গ্রামের নাম এখনও ‘নগর’ আছে; এখনও দেয়াপাড়াকে নগর-দেয়াপাড়া বলে। সে যুগে দেবতার মন্দিরের জন্য অনেক পল্লীই দেবপল্লী বা দেয়াপাড়া হইত। নগরসংলগ্ন দেয়াপাড়াকে বিশেষ করিবার জন্য নগর-দেয়াপাড়া বলা হইত। সেই প্রথা এখনও চলিতেছে, কিন্তু সে নগর কোথায় ছিল? বর্ত্তমান নগর নামক গ্রাম প্রাচীন নগরীর একাংশ বা তোরণ-দ্বার হওয়া কি একেবারেই অসম্ভব?
যেদিকে দেবভাগ অবস্থিত, সেই অংশে একটি স্থানকে বিজয়তলা বলে। স্থানীয় প্রবাদ এই— ঐ স্থানে বিজয়সেন রাজার বাড়ী ছিল। তিনি যে একটি দেবমন্দির নির্ম্মাণ করেন, তাহার ভগ্নাবশেষ আছে এবং তাহার সন্নিকটে একখানি পর্ণকুটীরে দেবীর উদ্দেশে নিত্য পূজা হয়। এই মন্দিরের ভগ্নচিহ্ন যে চতুৰ্দ্দিকে আরও কত ভগ্নাবশেষ দ্বারা পরিব্যাপ্ত রহিয়াছে, তাহা বলা যায় না। সমস্ত জঙ্গলাকীর্ণ স্থানটি কতকগুলি প্রকাণ্ড অচিনের গাছের[২০] অন্ধকারময়ী ছায়ায় সমাচ্ছন্ন হইয়া, মানুষের বসতিনিলয়ের বহুদূরে থাকিয়া, ভয়াতুরের রোমাঞ্চ সঞ্চার করিয়া থাকে। প্রবাদ একেবারে প্রত্যাখ্যাত হইবার নহে। উক্ত বিজয়সেন মহারাজ বল্লালসেনের পিতা। তিনি বরেন্দ্রে প্রাদুর্ভূত হইবার পূর্ব্বে, সম্ভবতঃ তাঁহার বিজয়বাহিনী এই পথে গিয়াছিল এবং তিনি এখানে কোন মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন; অথবা তাঁহার পুত্র বল্লাল বাড়ীর শাসনদণ্ড গ্রহণ করিয়া এই স্থানে যে রাজধানী প্রস্তুত করেন, তাহাতে কোন দেবমন্দিরের দ্বারা পিতৃনাম স্মরণীয় করিয়া রাখিয়াছিলেন।
সিঙ্গিয়া ষ্টেশন ছাড়িয়াই ভৈরব নদের যে বাঁক চক্রাকারে বসুন্দিয়া ঘুরিয়া আসিয়াছে, সেই বাঁক হয়ত পূৰ্ব্বে ছিল না। নদীস্রোত সোজা পূৰ্ব্বদক্ষিণ মুখে বর্তমান জগন্নাথপুর গ্রামের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া দেয়াপাড়ার কাছে আসিয়া মিশিয়াছিল। সেই প্রাচীন খাতের পার্শ্ব দিয়া পুরাতন রাস্তা ছিল, তাহা এখনও আছে। কিন্তু এখন নদী বাঁকিয়া যাওয়ায় উহার বর্ত্তমান খাত রাস্তা হইতে দূরে পড়িয়াছে, অথচ দেয়াপাড়ার পরপার হইতে রাস্তা পুনরায় নদীর পাশে আসিয়াছে। এখন যাহাকে লোকে আফরার খাল বলে, উহাই চিত্রা নদীর একাংশ ছিল। তন্ত্রমধ্যে চিত্রা-ভৈরবের সঙ্গমের উল্লেখ আছে এবং উহা মহাতীর্থ বলিয়া কথিত হয়; সে সঙ্গম সম্ভবতঃ জগন্নাথপুরের সন্নিকটেই হইয়াছিল। নড়াইলের নিম্ন দিয়া যে চিত্রা নদী প্রবাহিত, তাহা গোবরা নামক স্থানের দক্ষিণ হইতে একটু বঙ্কিমভাবে দক্ষিণদিকে আসিয়া ভৈরবে মিশিয়াছিল। গোবরার পরবর্ত্তী বর্ত্তমান প্রবাহ সম্ভবতঃ চিত্রা হইতে বহির্গত কোন কৃত্রিম খাত। চিত্রার যে অংশ পূর্ব্বের আফরা গ্রামের নিম্ন দিয়া প্রবাহিত ছিল, তাহা পূর্ব্বোক্ত কৃত্রিম খাতের জন্য ক্রমে সঙ্কীর্ণ হইয়া যাওয়ায় আফরার খাল নামে পরিচিত হইল। বাহিরভাগ এবং বাহিরগ্রাম প্রভৃতি স্থানগুলি ঐ প্রাচীন খাতের অপর পারে থাকিয়া স্বীয় নামের সার্থকতা সম্পাদন করিয়াছিল। সেখহাটির নিম্নে এখন যেখানে চিত্রা-ভৈরবের সঙ্গমতীর্থ বিরাজিত, পূর্ব্বে উহা আরও দক্ষিণ-পূৰ্ব্বদিকে দেয়াপাড়ার সন্নিকটে হওয়া বিচিত্র নহে। তখন হয়ত সেই সঙ্গমস্থানের অপর পারে ছিল মহাকাল বা মাকাল গ্রাম। শতাধিক বর্ষ পূৰ্ব্বে মহাকাল যে একটি বিশিষ্ট স্থান ছিল, তাহা প্রাচীন ম্যাপ হইতে দেখা যায়। শাঁখহাটিতে ছিল দেবীর মন্দির, আর ভৈরবকূলবর্তী মহাকালে ছিল সেই দেবীর ভৈরব মহাকালের মন্দির। কালের সর্ব্বধ্বংসী কবলে সে মহাকালেরও কালপ্রাপ্তি ঘটিয়াছে। এখন মহাকালে কোন শিবমন্দির নাই, প্রাচীন কালীবাড়ীও নদীগর্ভস্থ হইয়াছে, কিন্তু এইস্থান হইতে সিঙ্গিয়া পৰ্য্যন্ত কয়েক মাইল স্থান এমনভাবে ছিন্নভিন্ন, জনশূন্য ও জঙ্গলপূর্ণ হইয়া মাত্র স্বল্প সংখ্যক ধর্মান্তরিত পীরালি মুসলমান এবং সংস্রব-দুষ্ট পীরালি হিন্দুদের বাসভূমিরূপে মুসলমান প্রচারকের সদর্প অত্যাচারের পরিচয় বহন করিতেছে যে, প্রাচীন দেববিগ্রহাদির কোন সন্ধান করিবার উপায় নাই। এখনও চেঙ্গুটিয়া জগন্নাথপুরে শিবলিঙ্গ ও ভগ্ন মন্দির আছে, মুসলমানের বাটীর উপর পুরাতন মন্দিরের ভগ্নস্তূপ আছে। এই স্থানের উপর এক সময়ে যে ঘোর বিপ্লব হইয়াছিল, শত চিহ্ন হইতে তাহা অনুমান করা সহজ, কিন্তু প্রাচীন ইতিহাসের জীর্ণ কঙ্কালও উদ্ধার করা সহজ নহে।
উক্ত প্রাচীন শাকহাটী বা বর্তমান সেখহাটী সেনরাজগণের শাসনকালে তাহাদের বাগড়ী ভুক্তি বা উপবিভাগের কোন প্রধান মণ্ডলিকা বা রাজস্ব সংগ্রহের কেন্দ্র ছিল। প্রতাপাদিত্যের সমসাময়িক কবিরাম-কৃত ‘দিগ্বিজয়প্রকাশ’ নামক গ্রন্থ হইতে জানিতে পারি, মহারাজ লক্ষ্মণসেন যশোরেশ্বরী দেবীর মন্দির সন্নিধানে চণ্ডভৈরবের এক মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দেন এবং এই অঞ্চলে সেনহট্ট নামক এক নগর প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু সে সেনহট্ট খুলনা জেলার অন্তর্গত বৈদ্যপ্রধান সেনহাটি গ্রাম হইতে পারে না। আধুনিক বৈদ্যনিবাস সেনহাটির পূর্ব্বনাম ছিল ‘ছুঁচোখালি’ বা ‘ছুঁচোহাটি’; বৈদ্য বংশাবতংস ধন্বন্তরি-গোত্রীয় যে বিমল সেন মহারাজ লক্ষ্মণসেনের সভায় কৌলীন্য লাভ করেন, তাঁহার বৃদ্ধ প্রপৌত্র হিঙ্গুসেনের বসতি স্থাপনের সময়[২১] হইতে উক্ত ছুঁচোখালির নাম পরিবর্তিত হইয়া সেনহাটি হয়। সুতরাং চতুৰ্দ্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বৈদ্য সেন বংশীয়দিগের বসতিস্থান দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মণসেনের সেনহট্ট হইতে পারে না।[২২]
যখন লক্ষ্মণসেন রাজা, তখন সেনহাটি গ্রামে লোকের বাস ছিল না। এই স্থান প্রথমে জলমগ্ন ছিল, তাহারই মধ্যে গ্রামের উদ্ভেদ হইতে থাকে। এই জলমগ্ন স্থানকে চুঁচহাটির বিল বলিত। পরে যেখানে জমির পত্তন হইয়া ক্রমে জঙ্গল হইয়া গেল, তথায় আসিয়া চক্রবর্ত্তিগণ জঙ্গল কাটাইয়া বাস করেন; উহারাই এখানকার ‘কাটিকাটা বাসিন্দা’, এজন্য উহাদের উপাধি হয়, ‘কাটানি।’ ইহারা কাটানি গাঁইভুক্ত ব্রাহ্মণ। কাটানিগণ এখন একটি স্বতন্ত্র পাড়ায় বাস করিতেছেন। ক্রমে এখানে অন্য ব্রাহ্মণ ও নিম্নশ্রেণীর কায়স্থগণের বাস হইতে থাকে। তৎপরে বৈদ্য ধন্বন্তরি বংশের পূর্ব্বপুরুষ কৌলীন্যে খ্যাতিমাম্ হিঙ্গুসেন এখানে আসিয়া বাস করেন। হিঙ্গুসেন হইতে এক্ষণে ১৯ পুরুষ হইয়াছে। বৈদ্যবংশের উন্নতি, বাল্যবিবাহ ও বংশবৃদ্ধি বিবেচনা করিয়া প্রত্যেক পুরুষে ২৫ বৎসর ধরিলে উহাতে কোন ক্রমে ৫০০ বৎসরের অধিক হয় না। কিন্তু লক্ষ্মণসেন সাত শত বৎসরের পূর্ব্বে প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন। সুতরাং লক্ষ্মণসেনের আমলে সেনহাটি নাম ছিল কিনা বিচারসাপেক্ষ। হয়ত লক্ষ্মণসেনের সময়ে সেখহাটির নামই হইয়াছিল সেনহট্ট। পরে সেস্থান সেখহাটি হইয়া গেলে হিঙ্গুসেনের সময় হইতে চুঁচহাটির নাম হয় সেনহাটি। অবশ্য ইহাকে অনুমান ভিন্ন আর কিছুই বলিতে পারি না। এই অনুমান দ্বারা সেনহাটি গ্রামকে কোনমতে ‘নিষ্প্রভ করা হইতেছে না।[২৩] বৰ্ত্তমান সময়ে সেনহাটি গ্রাম বোধ হয় বঙ্গদেশের মধ্যে সর্ব্বপ্রধান বৈদ্যপ্রধান স্থান। আমার বক্তব্য এই, লক্ষ্মণসেনের পলায়নের শতাধিক বর্ষ পরে এই স্থান প্রথম বৈদ্যনিবাস হয়। অপর পক্ষে পূর্ব্বোক্ত শঙ্খহট্ট বা আধুনিক সেখহাটিকে লক্ষ্মণসেনের সেনহট্ট বলিয়া অনুমান করিবার অনেকগুলি কারণ আছে।
প্রথমতঃ, ইহা একটি প্রাচীন স্থান এবং বহু বিস্তৃত পুরাতন হিন্দু নগরী। সে কথা আমরা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি।
দ্বিতীয়তঃ, এই স্থানে লক্ষ্মণসেনের সমকালীয় অনেক সুন্দর হিন্দু-বিগ্রহের আবিষ্কার হইয়াছে। তন্মধ্যে সৰ্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ এবং সুন্দর মূর্ত্তি ভুবনেশ্বরী দেবীর। তদ্বিষয়ে বিশেষভাবে পরে আলোচনা করিতেছি। ইহা ব্যতীত ছোট বড় দুইটি গণেশ মূর্ত্তি এবং কয়েকটি চতুর্ভুজ বাসুদেব মূর্ত্তি সমধিক উল্লেখযোগ্য। দুইটি গণেশ মূর্ত্তি ও একটি বাসুদেব মূর্ত্তি নড়াইলের জমিদার বাবুদিগের বাটীতে নীত হইয়া প্রাচীর গাত্রে গ্রথিত রহিয়াছে। ছোট বড় আরও ২/১ খানি মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে এবং আরও কত মূৰ্ত্তি যে এখনও মৃত্তিকা গর্ভে অলক্ষিত রহিয়াছে, তাহা বলা যায় না। সেনরাজগণের আমলের বহু বিষ্ণুমূৰ্ত্তি ক্রমশঃ এতদঞ্চলে আবিষ্কৃত হইতেছে। গত একবৎসর মধ্যে খুলনায় ৩ খানি ও যশোহরে ২ খানি এইরূপ বিষ্ণুমূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে।[২৪] এই সব মূর্ত্তিগুলি কৃষ্ণ কষ্টি পাথরের নির্ম্মিত বা উৎকীর্ণ। সেরূপ কঠিন পাষাণ এখন এক প্রকার দুষ্প্রাপ্য।
তৃতীয়তঃ, ভাস্কর্য্যের প্রকৃতি দেখিলেও এই ভুবনেশ্বরী বা অন্য মূর্ত্তিগুলি মুসলমান রাজত্বের পূর্ব্বকালীয় বা সেনযুগের সম্পত্তি বলিয়া প্রতীত হয়। এতগুলি দেবমূর্তি গঠন করিয়া একটি স্থানে নানা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করিবার সৌভাগ্য পাঠান আমলে বা পরবর্ত্তী যুগে হয় নাই। বৈদেশিক পাঠান আক্রমণের প্রথম বন্যায়, অত্যাচারের ফলে বা অতর্কিত ভাবে অনেক বিগ্রহ ভাঙ্গিয়া চুরিয়া ফেলায় হিন্দু মন্দির ভূমিসাৎ হইয়া গিয়াছিল। যেখানে হিন্দু বা বৌদ্ধের কোন কীর্ত্তিপীঠ দেখা যাইত, পাঠানেরা সেইখানেই আসিয়া আক্রমণ ও বসতি স্থাপন করিতেন। শাঁখহাটির পূৰ্ব্ব- সংলগ্ন জগন্নাথপুর প্রভৃতি সেইরূপ স্থান। সেখানে এখনও চৌদ্দআনা পীরালি মুসলমান বা পীরালি হিন্দু। সে কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি। এখনও জগন্নাথপুরের একাংশকে ‘পাঠান পাড়া’ বলে।
চতুর্থতঃ, এতদঞ্চলে গণেশমূর্ত্তির পূজা বহু যুগ পূর্ব্বে ছিল, এখন আর নাই। সে পূজা পদ্ধতি মুসলমান আক্রমণের প্রাক্কালে অপ্রচলিত হইয়াছিল। শাঁখহাটিতে গণেশমূর্তির আবিষ্কার ঐ স্থানের প্রাচীনত্বের প্রমাণ দিতেছে।[২৫]
পঞ্চমতঃ, চতুর্ভুজ বাসুদেব বা সেই জাতীয় বিষ্ণুমূর্তি এবং ভুবনেশ্বরী প্রভৃতি তন্ত্রোক্ত দেবীমূর্তির পূজাপদ্ধতি প্রকৃষ্ট ভাবে সেনরাজগণই বঙ্গদেশে প্রবর্তিত করিয়াছিলেন। সেখহাটির ভুবনেশ্বরী মূর্ত্তির পাষাণ গাত্রে কোথায়ও কোন লিপি নাই। কিন্তু ১০/১২ বৎসর পূর্ব্বে ঢাকায় দাল বাজারে একখানি চণ্ডীমূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে। উহার পাদদেশে একটি শিলালিপি আছে এবং উহাতে জানা যায়, ঐ মূর্তিটি শ্রীলক্ষ্মণসেনদেবের রাজত্বের তৃতীয় বর্ষে সম্পন্ন হয়। আর সেই চণ্ডীমূর্তিখানি সেখহাটির এই ভুবনেশ্বরী প্রতিমার পাশাপাশি রাখিয়া তুলনা করিলে দেখা যায় যে, উভয়ই যেন এক প্রকার পাথরে একই শিল্পী দ্বারা একই সময়ে গঠিত হইয়াছে। মূৰ্ত্তি দুইটি বিভিন্ন দেবতার হইলে কি হয়, উহাদের ভাবভঙ্গি ও বস্ত্রালঙ্কারের সুস্পষ্ট ঐক্য দেখিলে শিল্পী ও সময়ের অভিন্নতা সহজে উপলব্ধি করা যায়। দুইটি মূর্তির প্রভেদ এই, চণ্ডীমূর্ত্তি চতুর্ভুজা ও দণ্ডায়মানা এবং ভুবনেশ্বরী মূর্ত্তি ষড়ভুজা ও উপবিষ্টা। কিন্তু উভয় মূর্তিতে একই প্রকারের কারুকার্য খচিত বস্ত্র একই ভাবে পরিহিত, অলঙ্কারগুলি প্রায় সবই এক—মস্তকের মুকুট, কর্ণের কুণ্ডল, কণ্ঠের হার, বক্ষের কঞ্চুলী, পীনপয়োধরের উপর একই ভাবে প্রলম্বিত রত্নমালা, উন্মুক্ত নাভি, তনিম্নে প্রশস্ত রত্নকাঞ্চী, একই প্রকারে বঙ্কিম কটিদেশ, হস্তদ্বয়ে একই ভাবে সংবদ্ধ কেয়ূরমালা ও পদদ্বয়ে মঞ্জরী, একই প্রকার শূর্পাকৃতি প্রস্তরফলকে উভয় মূৰ্ত্তি উৎকীর্ণ এই প্রকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও অলঙ্কারের ভঙ্গিমা দেখিলে চণ্ডীমূৰ্ত্তি যে লক্ষ্মণসেনদেবের গৌরবময় রাজত্বের পরিচায়ক, এই ভুবনেশ্বরী মূর্তিও তাঁহারই অনুশাসনে গঠিত ও প্রতিষ্ঠিত— এ অনুমান কেহই অপ্রতিপন্ন করিতে পারিবেন না। এই সকল প্রমাণ হইতে দেখা যাইতেছে যে, প্রাচীন শঙ্খহট্ট বা শাখহাটের নাম যে লক্ষ্মণসেনদেব সামান্য পরিবর্তন করিয়া সেনহট্ট রাখিতে পারেন, তাহা অযৌক্তিক নহে।
মীনহাজ্-উদ্দীন-কৃত ‘তবকাত্-ই-নাসিরী’ নামক ইতিহাস-গ্রন্থে আমরা দেখিতে পাই যে, ১১৯৯ খৃষ্টাব্দে মহম্মদ-ই-বতিয়ার সদলবলে নদীয়া নগরী অধিকার করিয়া বসিলে, লক্ষ্মণসেন শঙ্খনট (Sankanat) ও বঙ্গাভিমুখে পলায়ন করেন।[২৬] এই শঙ্খনট বা শাঁখনাটকে আমরা প্রস্তাবিত শাঁখহাটি বা বর্তমান সেখহাটির সহিত অভিন্ন মনে করি। কেহ কেহ মুসলমান ঐতিহাসিকের উক্তি হইতে সাত নকলে আসল নষ্ট করিয়া উক্তি করিয়াছেন যে, লক্ষ্মণসেন নদীয়া হইতে জগন্নাথে পলায়ন করেন। পারসীক নোক্তায় শাঁখনাটকে জগন্নাথ করা বেশী কঠিন কথা নহে, অপর পক্ষে শাঁখনাটের সংলগ্ন গ্রামের নাম ছিল জগন্নাথপুর, সে কথাও ভাবিবার বিষয়। পূৰ্ব্বকথিত বঙ্গ বলিতে পূৰ্ব্ববঙ্গই বুঝাইতেছে; লক্ষ্মণসেন যে নদীয়া হইতে নৌকাপথে পূর্ব্ববঙ্গের দিকে পলায়ন করিয়াছিলেন, তাহা সহজ ও স্বাভাবিক বলিয়া বোধ হয়। নদীয়া হইতে নৌকাপথে জগন্নাথ বা পুরী যাওয়া যায় না, আমাদের প্রস্তাবিত শাঁখহাটিতে আসা চলে। লক্ষ্মণসেন বৃদ্ধ বয়সে জ্যেষ্ঠপুত্র মাধবসেনকে গৌড়ের সিংহাসন দিয়া নিজে নবদ্বীপে গঙ্গাবাস করিতেছিলেন। তাঁহার অন্য দুই পুত্র কেশব ও বিশ্বরূপসেন, সে সময়ে পূৰ্ব্ববঙ্গে বিভিন্ন স্থানে শাসনদণ্ড পরিচালনা করিতেছিলেন। শাঁকহাটি বা সেনহট্টে লক্ষ্মণসেনের নিজ প্রতিষ্ঠিত প্রাদেশিক রাজধানী ছিল তাহা তখন কেশবসেনের রাজ্যখণ্ডের অন্তর্গত ছিল। সুতরাং বৃদ্ধ নৃপতির পক্ষে পলায়ন করিয়া সোজা নৌকাপথে ভৈরবনদ দিয়া শাঁখহাটে আসাই স্বাভাবিক।
কেশবসেনের প্রসিদ্ধ ইদিলপুর তাম্র-শাসন ও বিশ্বরূপসেনের মদনপাড় গ্রামের তাম্রশাসন আবিষ্কৃত ও বিবৃত হইয়াছে। ইদিলপুরের তাম্রশাসনে দেখা যায় কেশবসেন কর্তৃক তালপড়া পাটক (গ্রাম) নামক যে গ্রাম শ্রুতিপাঠক বাৎস্য-গোত্রীয় ঈশ্বরশর্ম্মাকে প্রদত্ত হইয়াছিল, উহার পূর্ব্ব সীমা দীগ্রাম, দক্ষিণে শঙ্করপাশা ও গোবিন্দকেলিনী, পশ্চিমে শঙ্করগ্রাম এবং উত্তরে বাগুলী-বিভাগদী বলিয়া উল্লিখিত। এই গ্রাম বৰ্ত্তমান নওয়াপাড়া রেলষ্টেশনের নিকটবর্ত্তী কোন স্থান হওয়া সম্ভবপর। উহার নিকট শঙ্করপাশা আছে, পার্শ্বে গোবিন্দপুর-লক্ষ্মীপুর আছে, নিকটবর্ত্তী দেয়াপাড়া দ্বীগ্রাম হইতে পারে, বাগুলী-বিভাগদী যে বর্তমান নওয়াপাড়ার অপর পারস্থ বাঘুটিয়া-বিভাগদী, তাহাতে কোন সন্দেহই নাই। এই নামের দুইটি জোড়া গ্রাম বঙ্গদেশের অন্যত্র নাই। শঙ্খহট্ট শঙ্করগ্রাম হওয়া বিচিত্র নহে। সম্ভবতঃ কেশবসেন কয়েক বৎসরের জন্য আমাদের প্রস্তাবিত শাঁখহাটিতে রাজত্ব করিবার সময় ঈশ্বরশর্ম্মাকে উক্ত গ্রামখানি দান করেন। পরে হঠাৎ প্লাবনাদি জন্য বা অন্য কারণে ঈশ্বরশর্ম্মার ভ্রাতা বিশ্বরূপ এই স্থান ত্যাগ করিয়া যখন ফরিদপুর জেলায় কোটালীপাড়ে বসতি করেন, তখন তিনি বিশ্বরূপসেনের নিকট হইতে তথাকার পিঞ্জারি গ্রাম প্রাপ্ত হন। এই সকল প্ৰমাণ হইতেও দেখা যায় যে, প্রাচীন শাঁখহাটি বা সেনহট্টে সেনরাজগণের সময়ে একটি প্রাদেশিক রাজধানী ছিল। সেখহাটির একাংশস্থিত “বিজয়তলা’ নামক স্থান এখনও বল্লালসেনের পিতা বিজয়সেনের নামে প্রতিষ্ঠিত বলিয়া লোকপ্রবাদ চলিতেছে। এবং গ্রামের মধ্যবর্ত্তী মঠবাড়ীতে এখনও কোন প্রাচীন মন্দিরের ইষ্টকস্তূপ রহিয়াছে। সেখহাটির পার্শ্ববর্ত্তী তপনভাগের কায়স্থ দাস- বংশীয়দিগের পূর্ব্বপুরুষগণ সেনরাজত্বকালের গৌড়নগরীতে সান্ধিবিগ্রহিক প্রভৃতি উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত ছিলেন বলিয়া এখনও কায়স্থ-সমাজে সে বংশের খ্যাতি আছে।
এই শাঁখহাটিতে লক্ষ্মণসেনের সময়ে অন্যান্য মূর্ত্তির মত এই ভুবনেশ্বরী দেবীর দিব্য মূর্তিও উপযুক্ত মন্দিরমধ্যে বিরাজিত হইয়াছিলেন। পাঠান আমলে নদীয়ার মত এই প্রাদেশিক রাজধানীর উপর মুসলমানদিগের আক্রোশ পড়িয়াছিল। তাহারই ফলে পাঠানেরা আসিয়া জগন্নাথপুর প্রভৃতি স্থানে বাস করেন। এখনও ঐ গ্রামের একটি অংশের নাম ‘পাঠানপাড়া’ রহিয়াছে। পাঠানেরা এই সময়ে বহু হিন্দুকে মুসলমান করিয়া লন। যাহা বাকী ছিল, খাঁজাহান আলির সময়ে তাঁহার দক্ষিণ হস্তস্বরূপ হিন্দুসন্তান নবদীক্ষিত পীরআলি (মহম্মদ তাহির) সাহেবের উৎকট চেষ্টায় তাহা ষোল আনা সম্পূর্ণ হইয়াছিল। এখনও জগন্নাথপুর প্রভৃতি স্থানে এমন মুসলমানবংশীয় আছেন, যাঁহাদের প্রপিতামহীও শিবপূজা করিতেন। এই সকল পীরআলি মুসলমানের বাস হেতু অনেক স্থানের নাম ও প্রকৃতি পরিবর্ত্তিত হইয়া গিয়াছিল। সেখেরা আসিয়া শাঁখহাটিকে সেখহাটি করিয়া দিয়াছিলেন। তাঁহাদের ভয়ে দেববিগ্রহ মৃত্তিকাতলে লুক্কায়িত হইল, বহু দিন মধ্যে উহার খবর পাওয়া গেল না।
বহুদিন পরে খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের পতনের পর, তাঁহার ঢালী সৈন্যাধ্যক্ষ কল্কীশ-গোত্রীয় দত্ত-উপাধিধারী কায়স্থবীর কালিদাস রায় বিস্তীর্ণ ইশপপুর পরগণা দখল করিয়া বিভাগদি গ্রামে আসিয়া বাস করিলেন। তৎপূর্ব্ব হইতে উহার খুল্লপিতামহ শ্রীরাম রায়চৌধুরী সেখহাটিতে বাস করিতেছিলেন। কালিদাস রায়ের সময়ে সেখহাটিতে ভুবনেশ্বরী-মূর্ত্তি পুষ্করিণীর খাত হইতে আবিষ্কৃত হন। কালিদাস রায় তৎক্ষণাৎ দেবীমূর্ত্তির জন্য মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দিয়া রীতিমত পূজার সুব্যবস্থা করিয়া দেন। তিনিই প্রতাপাদিত্যের আশ্রিত ধলবাড়িয়ার প্রসিদ্ধ ভট্টাচার্য্যবংশীয় সুবিজ্ঞ তান্ত্রিক পণ্ডিতকে আনাইয়া মূর্তিটির ধ্যান ও পূজা-পদ্ধতি স্থির করেন। লক্ষ্মণসেন যে মূর্ত্তির প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন, কালিদাস রায় তাহার দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা।
বহুদিন পর্য্যন্ত উক্ত পরগণার জমিদারী রায়বংশীয়দিগের হস্তে ছিল, পরে নবাব সরকারে উহাদের খাজনা বাকী পড়িলে চাঁচড়ার প্রতাপান্বিত জমিদার রাজা মনোহর রায় ১৬৯৬ খৃষ্টাব্দে বাকী খাজনা পরিশোধ করিয়া জমিদারী স্বকরভুক্ত করিয়া লন। তখন হইতে প্রায় একশত বৎসর যাবৎ মায়ের পূজার বিহিত ব্যবস্থা চাঁচড়ার রাজগণ করিয়াছিলেন। অবশেষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ১৭৯৭ খৃষ্টাব্দে এ প্রদেশ বাকী রাজস্বে নীলামে বিক্রীত হইয়া গেল। কলিকাতার সুপ্রসিদ্ধ ঠাকুর বংশের পূৰ্ব্বপুরুষ গোপীমোহন ঠাকুর উহা খরিদ করেন। তিনিই মাতা ভুবনেশ্বরীর মন্দির সংস্কার ও বেষ্টন প্রাচীর নির্ম্মাণ করিয়া দেন। কালক্রমে সেখহাটি কীৰ্ত্তিমান ও কৃতবিদ্য নড়াইলের জমিদারদিগের বিষয়ভুক্ত হইয়াছে। তাঁহারাই মন্দির সংস্কারের ব্যবস্থা করিয়াছেন। কয়েক বৎসর হইতে এই স্থানে পৌষসংক্রান্তিতে একটি বার্ষিক উৎসব হইতেছে। তাহাতে ঐদিনে বহু সহস্র লোকের সমাগম হয়।
শিল্পকলা হিসাবেও এই মূর্ত্তির যথেষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে; মূৰ্ত্তিখানি প্রকৃতই দেখিবার জিনিষ ইহা শিল্পীর অসামান্য কারুকৌশলময়ী প্রতিমা। মায়ের নামটি ভুবেনেশ্বরী বটে, কিন্তু ইনি প্রকৃত পক্ষে তন্ত্রোক্ত ত্রিপুটেশ্বরী। নিম্নলিখিত ধ্যানে মায়ের পূজা হয় :
‘পারিজাত বনে রম্যে মণ্ডপে মণিকুট্টিমে।
রত্ন-সিংহাসনে রম্যে পদ্মে ষট্কোণ-শোভিতে।।
অধস্তাৎ কল্পবৃক্ষস্য নিষাং দেবতাং স্মরেৎ।
চাপং পাশাম্বুজ-সরসিজান্যঙ্কুশং পুষ্পবাণান্॥
সংবিভ্রাণাং করসরসিজৈঃ রত্নমৌলীং ত্রিনেত্রাং।
হেমাজাভাং কুচভরনতাং রত্নমঞ্জীরকাঞ্চীং।।
গ্রৈবেয়াদ্যৈর্বিনমিততনুং ভাবয়েচ্ছক্তিমাদ্যাং।
চামরাদর্শ-তাম্বুল-করন্ড-সমুদ্কান্।।
বহন্তীভিঃ কুচাৰ্ত্তভি দূর্নীভিঃ পরিবারিতাং।
করুণামৃতবর্ষিণ্যা পশ্যন্তীং সাধকং দৃশা।[২৭]
পারিজাতকাননে, কল্পবৃক্ষচ্ছায়ায়, সুরম্য মন্দিরে, মণিময় বেদীর উপর মা জগন্ময়ী উপবিষ্টা। তিনি ষড়ভুজা; বামাধঃক্রমে সেই ষড়ভুজে যথাক্রমে শঙ্খ-কমণ্ডলু, অভয়, অঙ্কুশ, পদ্ম, পুষ্পবাণ ও বরমুদ্রা প্রদর্শিত হইতেছে। বরাভয়-মুদ্রাযুক্ত হস্ত দুইখানির সুভঙ্গিমার সহিত অধর-প্রান্তে হাসির রেখা এবং করুণামৃতবর্ষিণী দৃষ্টিতে কি যেন এক অপার্থিব দৈব ভাব সুস্পষ্ট ফুটিয়াছে। মা যেন কি বলিতে যাইতেছেন, করুণাময়ীর অধরপ্রান্তে পাষাণের মুখে যেন কি প্রচ্ছন্ন ভাষা আত্মপ্রকাশ করিবার জন্য চেষ্টা করিতেছে; এ যে যুগের প্রতিমা, তখন প্রতিভাসম্পন্ন শিল্পীর সুকৌশলে কঠিন পাষাণেও কথা কহিত, সৰ্ব্বজনবোধগম্য ভাস্কর্য্যের ভাষায় হৃদয়ের কথা অভিব্যক্ত করিত। সর্ব্বাঙ্গেই বা কি বস্ত্রালঙ্কারের পারিপাট্য! রত্নমুকুটে মস্তক মণ্ডিত, কর্ণাভরণ অংসোপরি বিন্যস্ত; কণ্ঠে বিলম্বিত রত্ন-কঞ্চুলীর উপর কনকহারলহরী পীনপয়োধর আবৃত করিয়া রহিয়াছে, অলঙ্কার ভারে মায়ের দেহখানি স্তোকনম্র করিয়া রাখিয়াছে। ষড়ভুজে কেয়ূরমালা ও কুণ্ডলের আভায় প্রভাকরেরও লজ্জা পায়। কারুখচিত সুচিক্কণ দুকূলে জঘনদেশ সমাবৃত, তাহার উপর কাঞ্চী-মেখলা শোভা পাইতেছে। মাতা বামপদতলে মূলাধারে সন্নিবিষ্ট করিয়া সাধিকার মত পদ্মাসনে নিষণা, দক্ষিণ চরণ প্রলম্বিত করিয়া সিংহ-চতুষ্টয়ের পৃষ্ঠোপরি সন্নিবেশিত করিয়া দিয়াছেন। তাঁহার রাতুল চরণে রত্নমঞ্জীর বা নূপুর শোভা পাইতেছে। পদতলে একপ্রান্তে চামরদর্পণ ও তাম্বুলপাত্রাদি করে ধরিয়া দূতীগণ শ্রেণীবদ্ধভাবে দণ্ডায়মানা। মায়ের মূর্ত্তির দুই পার্শ্বে দুইটি স্তম্ভ ও উপরে মন্দির-তোরণের চিত্র আছে, সর্ব্বোপরি শূর্পাকৃতি প্রস্তরের শীর্ষকোণের দুই দিকে দুইটি বিদ্যাধরের মূর্ত্তি প্রকটিত হইয়াছে। হৃদয়ের চিত্র টানিয়া আনিয়া নয়নপটে কিরূপে অঙ্কিত করা যায়, দর্শকের প্রাণে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের উদ্রেক করিয়া দিয়া এ মূৰ্ত্তি তাহা বুঝাইয়া দিতেছে। যে বৌদ্ধযুগে জ্ঞানবৈরাগ্যদীপ্ত ধ্যানী বুদ্ধমূর্তিতে এবং হিন্দুযুগে আগমানুশাসিত দেব-প্রতিমায় নরশিল্পী মানুষের আদর্শে পাষাণপিণ্ডে দেবদেবী গড়িয়া তাহাতে মানুষ ও দেবতার পার্থক্য প্রত্যক্ষরূপে বুঝাইয়া দিতেন, এ মূৰ্ত্তিও সেই যুগের সম্পত্তি। সেনরাজগণ যেমন সাহিত্যে, তেমনই শিল্পে, বঙ্গদেশে এক নবযুগের অবতারণা করিয়াছিলেন। তাঁহাদের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু রাজত্বের অবসানে সে যুগ আর প্রত্যাগত হয় নাই। কত যুগান্তর হইয়া গিয়াছে, তাই আমরা সে গৌরবময় যুগের কথা ভুলিয়া গিয়াছি। এখন আমাদের মুখের কথা—’তে হি নো দিবসা গতাঃ।’ এ মূৰ্ত্তি দেখিয়া কে বলিবেন যে, বঙ্গদেশে ভাস্কর-শিল্পের কোন প্রাধান্য ছিল না এবং বঙ্গের বাহিরে এমন মূর্ত্তি না দেখিয়া কে বলিবেন যে, বঙ্গদেশে ভাস্কর্য্যের কোন বিশেষত্ব ছিল না? ভুবনেশ্বরীর মত এমন বিচিত্র বিভবলাঞ্ছিত মধুর মূর্ত্তি সমতটে বা দক্ষিণবঙ্গে বোধ হয় আর নাই। মুসলমান শাসনের পূর্ব্বে মধ্যযুগে হিন্দুশাসনসময়ে বঙ্গদেশে ভাস্কর-শিল্পের যে নূতন অভ্যুত্থান ও চরমোন্নতি সাধিত হইয়াছিল, সেখহাটির এই ভুবনেশ্বরী মূর্ত্তি তাহারই একটি প্রধান নিদর্শন।
স্থানিক প্রকৃতি, প্রমাণিত পুরাকাহিনী এবং আবিষ্কৃত মূর্তিসমূহের শিল্পতত্ত্ব প্রভৃতি সকল বিষয়ের সম্যক্ আলোচনা করিয়া, আমরা মোটামুটি নিম্নলিখিত এই কয়েকটি সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি :
১।। যশোহর জেলায় চিত্রা-ভৈরব সঙ্গমস্থলে শঙ্খহট্ট বা শাঁখহাটি এইরূপ কোন নামে একটি সুপ্রাচীন সুবিস্তীর্ণ হিন্দু-নগরী ছিল। সেই সময়ের গণেশ ও বিষ্ণুমূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে।
২॥ স্থান-মাহাত্ম্যে বিজয়সেনদেবের সহিত কোন সূত্রে এই নগরীর সম্বন্ধ স্থাপিত হয়, পরে তৎপৌত্র মহারাজ লক্ষ্মণসেনদেব এই স্থানটিকে তদীয় বাড়ী উপবিভাগের শাসনকেন্দ্র নিৰ্ব্বাচন করিয়া; ইহার নাম দেন সেনহট্ট। তাহার অনেককাল পরে বৈদ্য-সেনবংশীয়দিগের বসতিজন্য এখান হইতে ২০/২৫ মাইল দূরে ভৈরবকূলে সেনহট্ট বা সেনহাটি নামক অন্য গ্রাম প্রতিষ্ঠালাভ করে। লক্ষ্মণসেনদেবের সেনহট্টে ভুবনেশ্বরী-মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩।। লক্ষ্মণসেনদেব খিলিজীর আক্রমণে নবদ্বীপ হইতে পলায়ন করিয়া এই শঙ্খহট্ট বা সেনহট্টে আসেন। ইহা মীনহাজের গ্রন্থে শাঁকনাট (Raverty র অনুবাদে Sanknat) বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে।
৪।। পাঠানাক্রমণকালে খাঁ জাহান আলির সময়ে শাঁখহাটি গ্রাম সেখহাটিতে পরিণত হয়।
পূর্ব্বেই বলিয়াছি, যশোহর-খুলনায় ক্রমাগত নানাস্থানে মৃত্তিকাগর্ভ হইতে বহু বাসুদেব-মূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছেন। ভবিষ্যতে আরও মূর্ত্তি বাহির হইতে পারে। পালরাজগণের সময়েই মূর্তিশিল্পের বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়; পরবর্ত্তী সেনযুগেও সে শিল্পের সমাদর ছিল। সুতরাং যে সকল বিষ্ণুমূর্ত্তির কথা বলিয়াছি, তাহার অধিকাংশই পাল বা সেন রাজত্বের সম্পত্তি। ঐ দুই রাজত্ব যে যশোহর-খুলনার সৰ্ব্বত্র বিস্তৃত হইয়াছিল, এই সকল মূর্তির আবিষ্কার হইতে তাহা প্রমাণিত হয়। খুলনার ভূতপূর্ব্ব ম্যাজিষ্ট্রেট ফ্রেন্স (Mr. J. C. French) ভারতীয় শিল্পের পক্ষপাতী ছিলেন এবং বিশেষভাবে পাল- শিল্পকলার চর্চ্চা করিতেন। তিনি খুলনা জেলায় শ্রীপুরের নিকটবর্ত্তী গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের নিকট হইতে একটি সুন্দর বাসুদেব মূর্ত্তি সংগ্রহ করেন। খুলনা হইতে বদলী হইয়া ময়মনসিংহ যাইবার কালে তিনি সেই খুলনার সম্পত্তিটি সঙ্গে লইয়া যান। পরে আমার একান্ত অনুরোধক্রমে ঐ মূৰ্ত্তিটি আমাকে পাঠাইয়া দিয়াছেন। মূৰ্ত্তিটি এক্ষণে দৌলতপুর কলেজ লাইব্রেরীতে রক্ষিত রহিয়াছেন। মূর্তি- পরিচয়ের নিয়মানুসারে এই বিগ্রহের নাম—নারায়ণ। মূর্ত্তিটিতে বিশেষ কোন স্থান ভগ্ন হয় নাই। উহার শূর্পাকৃতি কৃষ্ণপ্রস্তরখানি পাদপীঠ পর্য্যন্ত ২-৬ ১-৩; নিম্নে কীলক আছে।
কিন্তু যে সব বিষ্ণুমূর্ত্তির কথা এ পর্য্যন্ত নানা স্থানে উল্লেখ করিয়াছি, তদপেক্ষা বৃহৎ এবং সৰ্ব্বোৎকৃষ্ট মূৰ্ত্তিটি গত ১৩২৯ সালের মাঘমাসে আধুনিক যশোহর শহরের পশ্চিমোত্তর কোণে ভূগর্ভ হইতে আবিষ্কৃত হন। এখনও ঐ স্থানকে পুরাতন কসবা বলে। অনেকদিন হইল সেখানে নলডাঙ্গারাজের বাসাবাটীর সন্নিকটে ‘পদ্মপুকুর’ নামক পুষ্করিণী খনন করিবার সময় একটি মন্দিরের ভগ্নাবশেষ স্বরূপ কতকগুলি পাথর বাহির হয়। কয়েকখানি পাথর ইতস্ততঃ নীত হয়; শুনিয়াছি আর ৪/৫ খানি তথাকার রাস্তার মোড়ে পুলের জন্য ব্যবহৃত হয়। সে পুল এক্ষণে ভাঙ্গিয়া না দেখিলে ঐ পাথরগুলি বাহির হইবে না। অবশিষ্ট পাথরের মধ্যে একখানি এখনও পদ্মপুকুরের সন্নিকটে পড়িয়া রহিয়াছে, দুইখানি পুলিস সাহেবের বাড়ীর সম্মুখে নীত হইয়াছে, একখানি ‘কাৰ্ব্বালা পুকুরের’ সন্নিকটে অর্দ্ধপ্রোথিত অবস্থায় দুগ্ধাদি ধৌত হইয়া পূজিত হইতেছে, আর একখানি নিকটবর্ত্তী বচর গ্রামে প্রাচীন জগন্নাথ মন্দিরের সন্নিকটে মৃত্তিকা নিম্নে আবিষ্কৃত হইয়াছে। সবগুলিই রাজমহল অঞ্চলের কঠিন পাষাণ। প্রত্যেকখানি ১৫ ইঞ্চি বিস্তৃত এবং ৯/১০ ইঞ্চি পুরু, দৈর্ঘ্য ৬ ফুট হইতে ৬ ফুট ১১ ইঞ্চি পর্যন্ত। পুলিস সাহেবের বাড়ীর একখানি পাথরের মধ্যস্থলে মঙ্গল-কলসহস্তা চতুর্ভুজা লক্ষ্মীমূৰ্ত্তি, অপরখানিতে একটি অস্পষ্ট বিদ্যাধর মূর্ত্তি, পদ্মপুকুরের নিকটবর্ত্তী পাথরখানিতে দণ্ডায়মান পুরুষমূর্ত্তি এবং বচরের পাথরখানিতে একটি মকরবাহনা গঙ্গামূর্ত্তি দণ্ডায়মানা। কাৰ্ব্বালা ট্যাঙ্কের নিকটবর্ত্তী পাথরখানিতে কি মূর্ত্তি ছিল, দেখা যায় নাই; হয়ত তাহাতে দণ্ডায়মানা যমুনামূর্ত্তি থাকিতে পারে। এই মূর্তিযুক্ত চারিখানি পাথর যে কোন প্রাচীন বিষ্ণুমন্দিরের সদর দরজার চারিখানি ফ্রেম ছিল, তাহা অনুমান করিবার কারণ আছে। সম্ভবতঃ লক্ষ্মীমূর্তিযুক্ত পাথরখানি দ্বারের উপরিভাগে, বিদ্যাধরমূর্তিযুক্ত পাথরখানি নিম্নভাগে, গঙ্গামূর্তিযুক্ত পাথরখানি দক্ষিণভাগে ও পদ্মপুরের সন্নিকটবর্ত্তী বা কাব্বালা পুকুরের কোণস্থিত পাথরখানি বামভাগে ছিল। বর্তমান গ্রন্থের ১ম খণ্ড প্রকাশিত হইবার পূর্ব্বে এ সম্বন্ধে বিশেষ তথ্য কিছুই জানিতে পারি নাই, পরবর্তী খণ্ডের ইংরাজ আমল ১১শ পরিচ্ছেদে বিষ্ণুমন্দির সম্বন্ধীয় এই অনুমান বিজ্ঞাপিত করিয়া ১৩২৯ সালের পৌষ মাসে সেই পুস্তক প্রকাশিত করি। তাহার পর মাসার্দ্ধকাল যাইতে না যাইতে, পুরাতন কসবায়, উক্ত পদ্মপুকুরের অনতিদূরে, পূৰ্ব্বে যে স্থান বামনপাড়া বলিয়া কথিত হইত, সেই স্থানে, এক ইটখোলায় তিন হাত মাটীর নিম্নে, হিন্দুস্থানী শ্রমিকগণ কর্তৃক এক সুবৃহৎ চতুর্ভুজ বাসুদেব মূর্ত্তি অন্যান্য আবরণ দেবতার মূর্ত্তি সহিত শায়িত অবস্থায় আবিষ্কৃত হন। যে শূর্পাকৃতি কষ্টিফলকের উপর মূর্ত্তিগুলি উৎকীর্ণ, উহা ৫’-৯’’ * ২’-৯’’ ইঞ্চি। উহার অধোদেশে অন্য পাথরের উপর মূর্ত্তিফলকখানি বসাইবার একটি কীলক আছে। বাসুদেবের প্রধান মূৰ্ত্তিটি দৈর্ঘ্যে ৫’-৩’’ ইঞ্চি, অর্থাৎ মূর্ত্তিটি একটি পূর্ণাবয়ব পুরুষের তুল্য।
এই প্রধান বিগ্রহটি বামাধঃকর ক্রমানুসারে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী। হিমাদ্রিধৃত ‘সিদ্ধান্ত- সংহিতার’ মতে এই মূর্ত্তির নাম ‘উপেন্দ্র’ হইলেও, অন্যান্য লক্ষণানুসারে উহা কালিকা পুরাণোক্ত প্রকৃত ‘বাসুদেব’-মূৰ্ত্তি। কালিকা-পুরাণের কয়েকটি শ্লোক এই :
‘পূর্ণচন্দ্রোপমঃ শুক্লঃ পক্ষিরাজোপরিস্থিতঃ।
চতুর্ভুজ পীতবস্ত্রৈস্ত্রিভিঃ সংবীতদেহভূৎ।।
দক্ষিণোর্দ্ধে গদাং ধত্তে তদধো বিকচাম্বুজম্।
বামোৰ্দ্ধে চক্রমত্যুগ্রং ধত্তেহধঃ শঙ্খমেব চ।।
শীর্ষে কিরীট সদ্যোতং কর্ণয়োঃ কুণ্ডলদ্বয়ম্।
আজানুলম্বিনীং চিত্রাং স্বর্ণমালাং গলস্থিতাম্।।
দধানং দক্ষিণে দেবীং শ্রিয়ং পার্শ্বে বিভ্রতম্।
সরস্বতী বামপার্শ্বে চিন্তয়েদ্ বরদং হরিম্।।’
মূর্ত্তিটি অতীব মনোরম। যদিও ইহার কয়েকখানি করাংশ ও নাসিকাগ্র কোন নিদয়াঘাতে ভগ্ন হইয়াছিল, তবুও সেই ক্ষতাঙ্গ মুখমণ্ডলের সুস্পষ্ট প্রতিমায় যে হাস্যময়ী দৈবী প্রতিভা বিচ্ছুরিত হইতেছে, তাহা দেখিবার বেলায় পিপাসু নেত্র নিমীলিত করা যায় না। কৃষ্ণ প্রস্তর হইতে যে আজানুলম্বিনী অপূৰ্ব্ব স্বর্ণমালা খচিত হইয়াছিল, তাহা এখনও পুষ্পরচনার কারুশিল্প প্রদর্শন করিতেছে। বাসুদেবের পদপার্শ্বে দক্ষিণে লক্ষ্মী ও বামে সরস্বতী প্রতিমা সুবঙ্কিম ভাবে দণ্ডায়মান, তাঁহাদের দুই পার্শ্বে দুইটি বিদ্যাধর মূর্ত্তি এবং বিষ্ণুপদতলে গরুড় মূর্ত্তি ও উভয় পার্শ্বে নানাস্থানে সিদ্ধচারণগণ সমঙ্কিত রহিয়াছেন।[২৮]
কবে শত্রুহস্তে নিপতিত হওয়ায় এই মূর্ত্তির অঙ্গহানি হয়, কবে কেন ইহার মন্দির ভগ্ন ও পূজা বন্ধ হয়, তাহা এখন জানিবার উপায় নাই। কিম্বদন্তী ও স্থানীয় অনুসন্ধান হইতে এই মাত্র জানা যায়, যেখানে মূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে, সেখানে একদা পরমানন্দ ভট্টাচার্য্যের বাড়ী ছিল। তৎপুত্র ঈশ্বর ভট্টাচার্য্যের সময়েও সে বাটীতে এই বিগ্রহের পূজা হইত। কিন্তু ঈশ্বরের ভ্রষ্টচরিত্র কুপুত্র নবীন ভট্টাচার্য্যের কুক্রিয়াদোষে পূজা বন্ধ হয়। একটি আশ্চর্য্য ঘটনা এই, যেখানে পূৰ্ব্ব-পশ্চিম ভাবে শায়িত মূৰ্ত্তিটি পাওয়া গিয়াছে, তন্নিন্মে দুইটি শবদেহের অস্থিপঞ্জর ছিল। আমি সে অস্থিরাশি স্বচক্ষে দেখিয়াছি। উহা নিশ্চয়ই মুসলমানের কবর নহে, কারণ তাহা হইলে পূৰ্ব্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ হইত না। সুতরাং হিন্দুর শবদেহ মূর্ত্তির নিম্নে কেন, বুঝা কঠিন। অত্যাচারী আততায়ীর হস্ত হইতে ইষ্টমূৰ্ত্তি রক্ষা করিবার জন্য কি উহারা বীরের মত, ত্যাগীর মত প্রাণ বিসর্জ্জন করিয়াছিলেন? হইতে পারে, সেই বীরদ্বয়ের শবই প্রস্তর-ফলকের নিম্নে ফেলিয়া এই ভাবে কোন বিধর্মী শত্রু উহাদিগকে সমাহিত করিয়া গিয়াছেন। এরূপ কালাপাহাড়ী দুষ্কীর্তি এদেশে কতস্থানে কতবার যে অনুষ্ঠিত হইয়াছে, তাহা বলিবার নহে। সত্যনিষ্ঠ চৈনিক পরিব্রাজক সমতটের মধ্যে শতসংখ্যক দেবমন্দিরের উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, তাহাদের একটিও এখন সে পুরাতন যুগের সাক্ষীরূপে দণ্ডায়মান নাই। উহাদের অবস্থার পরিণতি সম্বন্ধে কি কিছুই অনুমান করিবার নাই? কোন রাজা ব্যতীত এইরূপ বিরাটকায়, অতীব সুন্দর, কারুশিল্প -সমন্বিত বিষ্ণুমূৰ্ত্তি পাষাণ-নির্ম্মিত মন্দিরে কেহ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। সে নৃপতি কে? বিগ্রহের পদ্ধতি ও ভাস্কৰ্য্য দেখিয়া বোধ হয়, উহা পাল রাজত্বের বা সেন রাজত্বের সময় গঠিত। মহারাজ লক্ষ্মণসেন, এ অঞ্চলে আসিয়াছিলেন, যশোরেশ্বরীর পীঠস্থান দর্শন করিয়া চণ্ডভৈরবের মন্দির নির্মাণ করিয়াছিলেন। সম্ভবতঃ তিনিই সগর দ্বীপে গঙ্গামূর্ত্তির প্রতিষ্ঠাতা ভৈরব-তীরে সেখহাটি-জগন্নাথপুরে তাঁহার সময়ে বাড়ী বিভাগীয় শাসন-কেন্দ্র ছিল, তাহার অনেক প্রমাণ ও নিদর্শন পূর্ব্বে দিয়াছি; সেই মহারাজ লক্ষ্মণসেনকে যশোহরের এই বিরাট বিষ্ণমূর্ত্তির প্রতিষ্ঠাতা বলিয়া কি অনুমান করিতেও পারা যায় না?
পাদটীকা :
১. ‘বংশে কর্ণাটক্ষত্রিয়নাম জনি কুলশিরোদাম সামন্তসেনঃ’। [দেওপাড়া-প্রশস্তিলিপিও ইহাই ইঙ্গিত করে – History of Bengal. Dacca Univ. Vol. 1. P. 205-fat fal
২. বল্লালসেনকৃত ‘দানসাগর’ গ্রন্থে আছে : হেমন্তসেনের পর, ‘তদনু বিজয়সেনঃ প্রাদুরাসীৎ বরেন্দ্রে’।
৩. ‘অপূৰ্ব্বভক্তিভবদেবদেবেম্বব্দে শশাঙ্কস্মররন্ধ্রশাকে।
জাতো বিজয়সেনো গুণিগণগণিতস্তস্য দৌহিত্রবংশে।’—সম্বন্ধতত্ত্বার্ণব
শশাঙ্ক-১, স্মর-৫, রন্ধ্র-৯, উল্টাইয়া ৯৫১ শকে ১০২৯ খৃষ্টাব্দ হয়। ইহাই বিজয় সেনের জন্ম তারিখ বলিয়া উক্ত হইয়াছে। বাঙ্গালার পুরাবৃত্ত ২৪৯ পৃ। দুর্গাচরণ সান্যাল প্রণীত ‘বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাসে’ দেখিতে পাই শূরবংশীয় চন্দ্রসেনের জামাতা ছিলেন বিজয় সেন। কিন্তু তিনি শিবভক্ত পরম যোগী, নিঃসন্তান শ্বশুরের রাজত্ব লাভে স্বীকৃত হন না। ‘সেকশুভোদয়ায় দেখিতে পাই, বিক্রমপুরের রামপালের মৃত্যুর পর দৈবাদেশে বিজয়সেনকে রাজা মনোনীত করা হয়। যদিও সান্যাল মহাশয় ভূমিকায় বলিয়াছেন যে, ‘তৎকৃত ইতিহাসে সম্পূর্ণ অমূলক কোন বৃত্তান্ত নাই। তথাপি তিনি কোথায়ও কোন প্রমাণ উদ্ধৃত করেন নাই বলিয়া তাঁহার মত অসঙ্কোচে গ্রহণ করা কঠিন হয়। বিশেষতঃ পূর্ব্বোক্ত বারেন্দ্রকূল-পঞ্জিকাধৃত বচনের সহিত তাঁহার কথার বিরোধ হয়। ‘সেকশুভোদয়া’ নানা কাল্পনিক গল্পে পরিপূর্ণ বলিয়া ঐতিহাসিকের উপজীব্য হইতে পারে না। বিশেষতঃ আমরা রাম পালের পর কুমার পালকে তদীয় বীর সেনাপতি বৈদ্যদেবের সাহায্যে কিছুকাল রাজত্ব করিতে দেখি। কুমার পালের পরও বিক্রমপুরে পাল রাজত্বের শেষ হয় নাই। সেকশুভোদয়ার একটি শ্লোকের (শিবচন্দ্র শীল দ্বারা পরিশোধিত পাঠ) “শাকে যুগ্ম করেণুরন্ধ্রগণিতে’ হইতে জানা যায়, রাম পাল ৯৮৮ শকে বা ১০৬৬ খৃষ্টাব্দে পরলোকগত হন। সুতরাং বিজয় সেনের রাজত্ব ইহার পরে আরম্ভ হইয়াছিল, এরূপ অনুমান করা যায়। (বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস, ১৯ পৃ; সাহিত্য, ১৩০১ বৈশাখ ৮-১৪ পৃ; J. A. S. B. 1894; গোবিন্দচন্দ্ৰ গীত, ৫৩ পৃ; সাহিত্য, ১৩২০, চৈত্র ৪৬০-১ পৃ; গৌড়রাজমালা, উপক্রমণিকা,1/. পৃ) [বিজয় সেনের রাজত্ব আরম্ভ হয় আ ১০৯৫ খৃঃ অব্দে— History of Bengal, Dacca Univ. Vol. 1 –শি মি]
৪. বরেন্দ্র-অনুসন্ধান সমিতির চেষ্টায় রাজসাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার অন্তর্গত বিজয়নগরই বিজয় সেনের বিজয়পুর রাজধানী বলিয়া আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহা এ প্রদেশে ‘বিজয় রাজার বাড়ী’ বলিয়া খ্যাত। এখানে বিজয় সেনের প্রদ্যুম্নেশ্বরের মন্দিরের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গিয়াছে। এই মন্দিরের প্রশস্তিতে কবি উমাপতি ধর যে সকল বিস্তৃত জলাশয়ের কথা উল্লেখ করিয়াছিলেন, তাহার অনেকগুলি এই প্রদেশে আছে। প্রত্নতাত্ত্বিক মনোমোহন চক্রবর্ত্তী মহোদয় [J. A. S. B., N. S. 1–শি মি] নবদ্বীপকেই বিজয়পুর বলিয়া প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। [যেহেতু ‘পবনদূতে’ বিজয়পুর সম্পর্কে গঙ্গানদী পার হইবার কোন প্রসঙ্গ নাই, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বর্তমান নদীয়াকে এখনও বিজয়পুর বলিয়া অনুমান করেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’, ১৩৫৬, ১০২ পৃ— শি মি], কিন্তু যাঁহারা গৃহে বসিয়া কেবল মাত্র পুস্তকের সাহায্যে ঐতিহাসিক তথ্যের উদঘাটনে চেষ্টা করেন, তাঁহাদের তর্কজাল বিপুলতা লাভ করে বটে, কিন্তু সব সময়ে সফলতা লাভ করে না।
৫. ‘মহিষ্যামথ মালত্যাং গুণবত্যাং স ভূমিপঃ।
মল্লশ্যামলবর্ম্মাণৌ জনয়ামাস নন্দনৌ’-ঘটককূলপঞ্জী
কেহ কেহ শ্যামল বর্ম্মাকে বল্লালের পুত্র বলিয়া মানিয়া লন নাই। বাস্তবিক যেখানে শ্যামলের দিগ্বিজয়কাহিনী আছে, তথায় তিনি সেনবংশীয় বলিয়া উল্লিখিত হন নাই। পরেশনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বহু পঞ্জিকা হইতে প্রমাণ করিয়াছেন যে, তিনি বিজয় সেনের পুত্র। বাঙ্গালার পুরাবৃত্ত, ২৪৪, ২৪৯, ২৫১ পৃ।
৬. বল্লালের জন্ম নানা উপকথায় পূর্ণ। কেহ বলেন তিনি বিজয়সেনের ঔরসপুত্র নহেন, তিনি ক্ষেত্রজ পুত্র। রামজয়-কৃত বৈদ্যকুলপঞ্জীতে আছে :
কলিতে ক্ষেত্রজপুত্রের নাহি ব্যবহার
কিন্তু বৈদ্যবংশে এক পাই সমাচার।
আদিশূর বংশধ্বংস সেনবংশ তাজা
বিশ্বকসেনের ক্ষেত্রজপুত্র বল্লালসেন রাজা।
কেহ বলেন শৈববরে পুত্র লাভ করিয়া বিজয়সেন পুত্রের নাম রাখিয়াছিলেন বরলাল, উহাই বল্লাল হইয়াছে। কেহ বা বল্লালকে ব্রহ্মপুত্র নদের পুত্র বলিয়া বর্ণনাও করিয়াছেন। ‘সামাজিক ইতিহাস’, ২৩ পৃ; ‘বিক্রমপুরের ইতিহাস’, ৩০-৩৪ পৃ; Marshman’s History of Bengal.
৭. রমাপ্রসাদ চন্দ্র মহোদয় লিখিয়াছেন : ‘দক্ষিণ দিকে, বঙ্গে ও রাঢ়ে, বর্ম্মরাজ কর্তৃক বিজয়সেনের গতি রুদ্ধ হইয়াছিল’, (গৌড়রাজমালা, ৬৫ পৃ)। ইহা হইতে বোধ হয়, বর্ম্মরাজ বিজয় সেনের শত্রু ছিলেন। কিন্তু তাহার কোন প্রমাণ প্রদত্ত হয় নাই। বর্ম্মরাজের ঐতিহাসিক তথ্য মীমাংসিত না হইলে এ বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট মত প্রকাশ করা যায় না।
৮. পরবর্তীকালে ঢাকা জিলার অন্তর্গত বেলাব গ্রামে প্রাপ্ত তাম্রশাসন এবং সামন্তসার গ্রামে প্রাপ্ত হরিবর্ম্মার তাম্রশাসন প্রধানতঃ এই বর্ম্মরাজ বংশের ইতিহাসে কিয়ৎপরিমাণে আলোকপাত করিয়াছে। ইহা জানা গিয়াছে যে, ইঁহাদের রাজধানী বিক্রমপুরে ছিল। বজ্রবর্ম্মার পুত্র জাতবর্ম্মা নিজের বাহুবলে বঙ্গ, কামরূপ ও বরেন্দ্রে বিজয়াভিযান করিয়া বঙ্গে এক স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয় অনুমান করেন যে, পালরাজ্য আক্রমণকালে কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেব ও কর্ণের অধীনস্থ সামন্তরূপে জাতবর্ম্মা প্রথম বঙ্গদেশে আসেন। জাতবর্ম্মার পর হরিবর্ম্মা রাজত্ব করেন। এবং তাঁহার এক পুত্রের পর জাতবর্ম্মার অপর পুত্র শ্যামলবর্ম্মা রাজা হন। ইহা অনুমিত হয় যে, শ্যামলবর্ম্মা ও তাঁহার পুত্র ভোজবর্ম্মা দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে রাজত্ব করেন। ইহার পর আর বিশেষ কিছু জানা যায় নাই। সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধেই বিজয় সেন ইহাদের পতন সাধন করেন। History of Bengal, Dacca Uni., Vol. 1 PP. 197-204. – Fat Fat শি মি
৯. আদিশূরের রাজধানী এই রামপালে ছিল বলিয়া যে পূর্ব্ব উল্লেখ করা গিয়াছে (১৯৩ পৃ), তদ্বিষয়ে মতভেদ আছে। পূৰ্ব্ববঙ্গবাসিগণ রামপালেই আদিশূরের আনীত পঞ্চব্রাহ্মণের আগমন নির্দ্দেশ করিতেছেন। পঞ্চব্রাহ্মণের যোদ্ধৃবেশ দেখিয়া আদিশূর বিরক্ত হইলে, উহারা ব্রাহ্মণ্য প্রভাব দেখাইবার জন্য আশীর্ব্বাদ-বারিদ্বারা শুষ্ক মল্ল কাষ্ঠকে যে সজীব গজারি বৃক্ষে পরিণত করিয়াছিলেন, সে বৃক্ষও রামপালে প্রদর্শিত হইয়া থাকে (‘আদিশূর ও বল্লাল সেন’, বিক্রমপুরের ইতিহাস ২২-৩০ পৃ; কালীপ্রসন্ন ঘোষ প্রণীত ‘ভক্তির জয়’ ১০-১৬ পৃ; ঢাকার ইতিহাস, ৫০৩ পৃ; ফরিদপুরের ইতিহাস ২৬ পৃ; ‘গৌড়ে ব্রাহ্মণ’, ২৬২ পৃ)। অপর পক্ষে ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’-প্ৰণেতা নগেন্দ্রনাথ বসু এবং গৌড়বিবরণের সম্পাদক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহোদয় বলেন, রামপালে আদিশূরের রাজধানীর প্রবাদ মূলে কোন ঐতিহাসিক সত্য নাই এবং পঞ্চবিপ্র ‘সুরসরিদবধৌত’ গৌড়েই আগমন করিয়াছিলেন (বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণখণ্ড, ১০৯ পৃ; বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস, ১৮ পৃ)। যাহা হউক এ বিষয়ে কোন সৰ্ব্ববাদিসম্মত মত এখনও স্থির হয় নাই।
১০. আমরা এ বিষয়ে নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের মতই গ্রহণ করিলাম (J. A. S. B 1896 PP. 25-27 ) ‘দানসাগরে’ আছে : ‘শশি নবদশমিতে শকবর্ষে দানসাগরো রচিতঃ’; ইহাতে ১০৯১ শক বা ১১৬৯ খ্রীষ্টাব্দ হয়। এ সময়ে বল্লাল জীবিত ছিলেন। রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর মহাশয় বল্লালের অন্য গ্রন্থ ‘অদ্ভুতসাগর’ হইতে দেখাইয়াছেন, বল্লাল ‘খ নব খেন্দুব্দে’ অর্থাৎ ১১৬৮ খ্রীষ্টাব্দে এই গ্রন্থ আরম্ভ করিয়া উহা শেষ করিবার পূর্ব্বে মৃত্যুমুখে পতিত হন। — Report on the Search of Sanskrit Mss. in Bombay, 1887-91 P. XXXV.
তাহা হইলে বল্লালের মৃত্যু ও লক্ষ্মণের রাজ্যারোহণ-১১৬৯ বা ১১৭০ খ্রীষ্টাব্দে হইয়াছিল বলিয়া ধরা যায়। লক্ষ্মণ সেন ১১২০-৭১ খ্রীষ্টব্দের পূর্ব্বে মৃত্যুমুখে পতিত হন বলিয়া কেহ কেহ প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন (Indian Antiquary, vol. XIX; J. A. S. B. 1913 vol. IX. P. 277)। কিন্তু সে মতের সহিত পরবর্ত্তী ঘটনার সামঞ্জস্য রক্ষা করা কঠিন।
[পরবর্ত্তীকালে ‘অদ্ভুতসাগরের’ অন্য একখানি পুঁথি আবিষ্কারে (Indian Historical Quarterly, III, 574 ff) এই বিতর্কের অবসান হইয়াছে বলা যাইতে পারে। রাজা টোডরমল কর্তৃক উল্লেখিত শকাব্দ সম্বলিত পংক্তিও এই পুঁথিতে আছে। মোটামুটিভাবে সেনরাজত্বের নিম্নোক্ত তারিখগুলি সাধারণভাবে অধুনা স্বীকৃত :
বিজয়সেন — আনুমানিক রাজ্যভিষেক ১০৯৫ খৃষ্টাব্দ
বল্লালসেন — আনুমানিক রাজ্যভিষেক ১১৫৮ খৃষ্টাব্দ
লক্ষ্মণসেন — আনুমানিক রাজ্যভিষেক ১১৭৯ খৃষ্টাব্দ
বিশ্বরূপসেন — আনুমানিক রাজ্যভিষেক ১২০৬ খৃষ্টাব্দ
কেশবসেন — আনুমানিক রাজ্যভিষেক ১২২৫ খৃষ্টাব্দ
দ্রষ্টব্য : History of Bengal. Dacca Univ. Vol. 1 P. 231 –শি মি
১১. সন হইতে শকাব্দ ও লসং বাহির করিবার জন্য মৈথিলী ভাষায় এক সঙ্কেতসূচক শ্লোক আছ :
‘সনমহ লিখহু শরশশি বাণ
সো শাকে জানহুঁ পরমাণ;
পুনি-সন বাণ ইন্দ্র শর খোএ
বাঁকি বাত্রে লসং বিলোএ।।’
অর্থাৎ সনের অঙ্কের সহিত ৫১৫ যোগ দিলে শকাব্দ এবং সন হইতে ৫১৫ বাদ দিলে লসং হয়। এতদনুসারে ১১০৮ খৃষ্টাব্দে লসং আরম্ভ হয় (ভারতী, ১৩১৭ চৈত্র)। এই শ্লোকে ‘ইন্দ্ৰ’ শব্দটি ‘দ্বন্দ্ব’ হইবে কি না সন্দেহস্থল।
১২. সেন রাজত্বে সংস্কৃত চর্চ্চার বিশেষ উন্নতি হয়। বল্লাল ও লক্ষ্মণ উভয়েই পণ্ডিত এবং সুকবি ছিলেন। অন্তঃপুরবাসিনীরাও সাহিত্য চর্চ্চা করিতেন। এইরূপ শ্লোক দ্বারা উত্তর প্রত্যুত্তর চলিত। বল্লাল নীচজাতীয় স্ত্রীকে গ্রহণ করিলে পিতা পুত্র এইরূপ শ্লোকে কথা কাটাকাটি চলিয়াছিল। এখানে বল্লালসেন এই শ্লোকটিকে এমনভাবে রচনা করেন যে ইহার অর্থ যাহাতে সাধারণের নিকট অবোধ্য থাকে, কারণ লক্ষ্মণকে আনিবার কারণ কাহারও নিকট প্রকাশ্য নহে। বল্লালের সময়ে জ্যোতিষ শাস্ত্রের আলোচনা হয়। তিনি স্বয়ং এই বিষয়ে অদ্ভুতসাগর পুস্তক লিখেন ও তাহা লক্ষ্মণসেনের সময়ে শেষ হয়। এই শ্লোকে সংখ্যাদ্বারা দ্বাদশরাশির নামোল্লেখ করিয়া কৌশলে উদ্দেশ্য প্রকাশ করা হইয়াছে। প্রথম দ্বিতীয় প্রভৃতি দ্বারা রাশিগুলি সূচিত হইয়াছে।
শ্লোকার্থ : হে বৃষ (২য়) বৎ বলী (পুত্র), মকর (১০ম) সমাগমে কর্কটও মীনবৎ (৪র্থ ও ১২শ), মকরকেতন (কন্দর্প) সমাগমে করি কুম্ভ (১১শ ) স্তনী (বধু) প্রপীড়িতা এবং সেই তুলা (৯ম) বা তুলনা রহিত অর্থাৎ অতুলনীয় ভ্রূসম্পন্না কন্যা (৬ষ্ঠ) সিংহ (৫ম) তুল্য রাজকুমারের পত্নী হইয়াও বৃশ্চিক (৮ম) বৎ যন্ত্রণা ভোগ করিতেছে; হে মেষবৎ (১ম) বিনীত পুত্র, শীঘ্র আসিয়া উভয়ে মিথুন (৩য়) অর্থাৎ মিলিত হও। কিন্তু এই দুইটি সংস্কৃত শ্লোক বল্লালের প্রতি আরোপিত হইলেও উহা এদেশে প্রচলিত পুরাতন উদ্ভট শ্লোক। গদাধর ভট্টের কুলজীতে দেখা যায়, দেশাধ্যক্ষ ভবানন্দ দূর দেশে থাকিবার কালে তদীয় পত্নী মন্দির প্রাচীরে প্রথম শ্লোকটি লিখিয়া রাখেন। উহা দেখিয়া ভবানন্দের পিতা ২য় শ্লোক সহ দ্বিসপ্ততি ক্ষেপণীযুক্ত তরণী পাঠাইয়া এক ধীবর দ্বারা পুত্রকে গৃহে আনয়ন করেন। ভবানন্দ ঐ কার্য্যের পুরস্কার স্বরূপ যখন ধীবরের জল আচরণীয় করিবার প্রচেষ্টা করেন, তখন কৈবর্ত্তগণ দেশ ছাড়িয়া পলায়ন করেন। সুতরাং ধীবরেরা যে কৈবর্ত্তসম্প্রদায়ের একাংশ, তাহা সত্য বলিয়া বোধ হয় না। ‘নব্যভারত’, ৩৪ খণ্ড, ২৯২-৩ পৃ দ্রষ্টব্য।
১৩. আমি এই পুস্তকের ১ম খণ্ডের ৯৬ পৃষ্ঠায় বা পরবর্ত্তী খণ্ডে ইংরাজ আমল, ১০ম পরিচ্ছেদে সূর্য্য মাঝিকে কৈবর্ত্তজাতীয় ভাবিয়া যে মত প্রকাশ করিয়াছি, তাহা ভিত্তিহীন বলিয়া মনে হইতেছে। বল্লাল সূৰ্য্য মাঝির জল আচরণীয় করিলেও সমাজ তাহা মানে নাই; এখন সূর্য্যমাঝির অধস্তন বংশধরগণ মহেশপুরে ও নিকটবর্ত্তী বহুস্থানে বাস করিতেছেন, কিন্তু তাহাদের জল চলে না। কিন্তু কৈবর্ত্তেরা সকলেই বঙ্গের সর্ব্বত্র বিশেষতঃ মেদিনীপুর অঞ্চলে সম্মানিত আচরণীয় জাতি। এক সময়ে বরেন্দ্র মণ্ডলে কৈবর্তরাজগণ কিছুদিন সপ্রতাপে রাজত্ব করিয়াছিলেন। কৈবর্তরাজ দিব্বোক ও ভীমের কীর্তিকাহিনী দিনাজপুরে সর্ব্বত্র প্রচারিত। ‘গৌড়রাজমালা’, ৪৮ পৃ দ্রষ্টব্য।
১৪. J. A. S. B. 1896, part 1, plate 1, lines 18-19 and P. 12 এই দানপত্র বিশ্বরূপ সেন কৃত বলিয়া নগেন্দ্রবাবু উল্লেখ করেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় ইহাকে কেশবসেনের দানপত্র বলিয়া সপ্রমাণ করিতে চান।
১৫. ‘গোবর্দ্ধনশ্চ শরণো জয়দেব উমাপতিঃ।
কবিরাজশ্চ রত্নানি পঞ্চৈতে লক্ষ্মণস্য চ।।’
শ্রীরূপসনাতন লক্ষ্মণসেনের সভামণ্ডপের দ্বারে এই শ্লোকটি উৎকীর্ণ দেখিয়াছিলেন।
১৬. সাগর দ্বীপে প্রতাপাদিত্যের একটি দুর্গ ও নৌবাহিনীর প্রধান আড্ডা ছিল। পরবর্ত্তী খণ্ডে মোগল আমল, ১৯শ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
১৭. ১০৬ পৃষ্ঠার তৃতীয় স্তবক হইতে ১০৭ পৃষ্ঠার ২৭নং পাদটীকা পৰ্য্যন্ত দ্রষ্টব্য।
১৮. সাহিত্য, ১৩০১, ১৭ পৃ; বাঙ্গালার পুরাবৃত্ত, ৫৫৪ পৃ।
১৯. দিনাজপুরে তর্পণদীঘিতে লক্ষ্মণসেনের রাজত্বের সপ্তম বর্ষে প্রদত্ত দানপত্রের এক তাম্রলিপি পাওয়া গিয়াছিল। (J. A. S. B. Vol. XI. IV.) এখানেও তপনভাগের এক কোণে এক প্রকণ্ড দীঘি আছে, উহা উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ ৭০০x৪০০ হাত হইবে; উহার পার্শ্ববর্তী গ্রামের নাম দীঘির পাড়।
২০. অচেনা বা অজানিত বৃক্ষ। এরূপ গাছ আমাদের দেশে নাই। বটজাতীয় বৃক্ষ, পাতাগুলি কতকটা যজ্ঞডুম্বুরের মত, ইহাতে এক নূতন রকমের ফল হয়। কোন কোন প্রাচীন কীৰ্ত্তিস্থানে ইহা দৈবাৎ দেখা যায়। কিন্তু সেখহাটিতে বিজয়তলায় যেমন অনেকগুলি গাছে স্থানটিকে জঙ্গলাকীর্ণ করিয়া রাখিয়াছে, তেমন আর অন্যত্র দেখি নাই।
২১. ‘রাঢ়ং ত্যত্ত্বা সেনহাট্টনগরীমধ্যুবাস সঃ।’
–কবিকণ্ঠহার প্রণীত ‘সদ্বৈদ্যকুলপঞ্জিকা’, ৪৭ পৃ
২২. ধন্বন্তরি হিঙ্গুর অধস্তন ১২শ পুরুষ রাজবল্লভ পলাশীর যুদ্ধকালে (১৭৫৭ খৃঃ) বৰ্ত্তমান ছিলেন। ১২ পুরুষে ৪০০ বৎসর ধরিলে, সময় ১৩৫৭ খৃষ্টাব্দ হয়। দাস বংশীয় পুরন্দরের অধস্তন ১০ম পুরুষ কবিকণ্ঠহার ১৫৭৫ খৃষ্টাব্দে কুলপঞ্জিকা প্রণয়ন করেন। পুরন্দর হিঙ্গুর সমসাময়িক। সে হিসাবেও হিঙ্গুর সময় চতুৰ্দ্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হয়। পরবর্ত্তী খণ্ডে ইংরাজ আমল, দশম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
২৩. এই ঐতিহাসিক তত্ত্বানুসন্ধানের ফলে আমি সেনহাটি গ্রাম বা বৈদ্যজাতির প্রতি কোন কটাক্ষ করি নাই, বা কোন উদ্দেশ্য লইয়া কোন বর্ণের প্রতি কোন প্রকার বিদ্বেষভাব আমি কখনও পোষণ করি না, সেভাবের কোন মন্তব্যে আমার এই পুস্তক কোথায়ও কলঙ্কিত করি নাই। স্বাধীনভাবে তথ্যালোচনা করিয়া আমি যাহা পাইয়াছি তাহাই অপক্ষপাত ভাবে প্রকাশ করিয়াছি। সেখহাটি বা সেনহাটিতে বসতিস্থাপনের সাময়িক পৌর্ব্বাপৌর্য্যের জন্য কোনস্থানের বোধহয় সম্মান-গৌরবের হানি হইতে পারে না। এই প্রসঙ্গে রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন মহোদয় ‘বৈদ্য-সম্মিলনী’ পত্রে আমার প্রতি যে কটাক্ষ করিয়াছেন, তাহা বোধহয় সমীচীন হয় নাই। ধীরভাবে বিবেচনা করিলে তিনি নিজেই বুঝিবেন, তাঁহার অনুমানগুলি ভিত্তিহীন ও অনর্থক।
২৪. যশোহরের প্রকাণ্ড বিষ্ণুমূর্তির কথা পরে বলিতেছি। অপর একখানি ছোট মূৰ্ত্তি কোতোয়ালী বাজারে বাটীর ভিত্তি খননকালে বাহির হইয়াছে। একই বৎসরে খুলনার চন্দনীমহলে ১ খানি, সেনহাটিতে ১ খানি ও গৌররম্ভার নিকট ১ খানি পাওয়া গিয়াছে।
২৫. সেখহাটিতে আবিষ্কৃত দুইটি গণেশ মূর্ত্তি ব্যতীত আর একটিমাত্র গণেশ মূর্ত্তি নলডাঙ্গায় আছে। যশোহর-খুলনার মধ্যে এরূপ মূর্ত্তি আর নাই!
২৬. ‘When he whole of Mahammad-i- Bakhtyar’s army arrived and the city (Nadia ) and round about had been taken possession of, he then took up his quarters and Rai Lakhmaniah got away towards Sankanat and Bang, and there the period of his reign shortly afterwards came to a termination.’ Raverty’s translation of Tabakat-i-Nasiri, Vol. 1, P. 558.
২৭. তন্ত্রসারে দেখিতে পাই যে অম্বুজ ও সরসিজ উভয় শব্দের প্রয়োগে পদ্মযুগল বুঝাইবে, অম্বুজ বলিতে শঙ্খ বুঝাইবে না। কিন্তু এখানে দেবীর হস্তে শঙ্খই আছে।—তন্ত্রসার, রসিকমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সংস্করণ, ১৭৯-৮০ পৃ।
কুট্টিম = বেদী; অম্বুজ = শঙ্খ; সরসিজ = পদ্ম; মঞ্জীর = নূপুর; গ্রৈবেয় = কণ্ঠহার; আদর্শ = দর্পণ; তাম্বুলকরন্ড = তাম্বলপাত্র; সমুদ্গক = কৌটা বা ঝাপি।
২৮. পূৰ্ব্ববিভাগীয় আর্কিওলজিকাল সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট মহাশয় আমার অনুরোধক্রমে আসিয়া বিষ্ণুমন্দিরের দরজার পাথরগুলি পরীক্ষা করিয়া গিয়াছিলেন। বিষ্ণুমূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হইবার পর সংবাদ পাইবামাত্র, তিনি উহার আলোক-চিত্র গ্রহণ করিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। মূর্ত্তি বাহির হইবামাত্র, স্থানীয় মাড়োয়ারীগণ উহা গোযানে করিয়া লইয়া গিয়া বেণীমাধব মিশ্র মহাশয়ের মন্দিরপার্শ্বে রাখিয়া দিয়াছেন; অঙ্গহানির জন্য মূর্তির সংস্কার করিবার জন্য তাঁহারা চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু তাহাতে অসমর্থ হওয়ার পর অঙ্গহানির জন্য মূর্ত্তির পূজা যে হইতে পারে না, তাহা তাঁহারা জানিয়াছেন। এ জন্য মাড়োয়ারী ভ্রাতৃগণের যত্ন ও চেষ্টা প্রশংসনীয়। কিন্তু স্থানীয় অধিবাসিগণ এতৎপ্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন। যশোহরের এই অতুলনীয় নিজ সম্পত্তি যশোহরবাসীদিগের দ্বারা কোন মন্দিরে সংরক্ষিত হওয়া উচিত। ভারতবর্ষ, ১৩৩০, আশ্বিন, দ্রষ্টব্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন