১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু

সতীশচন্দ্র মিত্র

দশম পরিচ্ছেদ – সুন্দরবনের জীবজন্তু

প্রাকৃতিক স্বাস্থ্য বিবেচনা করিলে সুন্দরবনের জীবজন্তুমাত্রের অবনতির ও নিবীর্য্যতার কল্পনা করা যায়। আবার জীবজন্তুর অবস্থা দেখিয়া যদি স্বাস্থ্যের প্রমাণ করিতে হয়, তাহা হইলে সুন্দরবন ভারতবর্ষের অন্য কোন স্থান অপেক্ষা স্বাস্থ্যের হিসাবে নিকৃষ্ট বলা যায় না। সুন্দরবনের সুন্দর গাছ ও প্রকাণ্ড লতা, সুন্দরবনের ব্যাঘ্র ও কুম্ভীর, সুন্দরবনের মহাকায় সর্প ও সবল পক্ষী স্বাস্থ্যহীনতার পরিচয় দেয়ই না, বরং এক প্রকার আভ্যন্তরিক বীর্য্য ও সবলতার সম্পূর্ণ নিদর্শন প্রদান করে। কেহ বলেন, বাঙ্গালীর মত দুর্ব্বলও কাপুরুষ জাতি আর নাই; আবার কেহ বলেন, যে দেশের জলবায়ু বঙ্গ-ব্যাঘ্রের সৃষ্টি করিয়াছিল এবং প্রতাপাদিত্যের যুগে যে দেশের কোণে কোণে বহু নরব্যাঘ্রের উদ্ভব হইয়াছিল, সে দেশ কখনও নির্ব্বীর্য্যতার কালিমা-মণ্ডিত হইতে পারে না। বাঙ্গালীর চরিত্রে কলঙ্কের রেখা থাকিতে পারে; কোন্ জাতির বা সেরূপ কিছু নাই? তবে সে কলঙ্কের সহিত কাপুরুষতার যে কোন অনিবার্য্য সম্বন্ধ আছে, এরূপ কল্পনা করা সমীচীন নহে।

সুন্দরবনের বিশাল অরণ্য ও বিরাট নদীসংস্থান সৰ্ব্বত্রই তাহাকে ভীষণ করিয়া রাখিয়াছে। তাহার স্থলভাগে ব্যাঘ্রাদি শ্বাপদকুল এবং জলে কুম্ভীর এই ভীষণতাকে ভীষণতর করিয়াছে। অন্যান্য প্রদেশের লোকে মনে করে যে, যে দেশে ‘জলে কুমীর, ডাঙ্গায় বাঘ’ সে দেশে লোকে বাস করে কিরূপে? এই বিশেষত্বের কথা মনে করিয়া নিম্নবঙ্গের প্রসঙ্গমাত্র অন্যান্য লোকের মনে আতঙ্কের সঞ্চার হয়।

বাস্তবিকই সুন্দরবনের স্থলজন্তুর মধ্যে ব্যাঘ্র (Tigris Regalis) সৰ্ব্বপ্রধান। নানা দেশে নানাজাতীয় ব্যাঘ্র দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু সুন্দরবনের ব্যাঘ্রের মত হিংস্র, এমন বলবা, এমন দর্পশালী, এমন ভীমমূর্তি এবং এমন শিকারকুশল বন্যজন্তু আর দেখা গিয়াছে কিনা সন্দেহ। এই জন্য ইয়োরোপীয়েরা ইহাকে ‘রয়াল বেঙ্গল’ ব্যাঘ্র (Royal Bengal Tiger) বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। অন্যদেশীয় ব্যাঘ্রের সহিত ইহার অনেক পার্থক্য আছে। প্রথমতঃ ইহার হরিদ্রাবর্ণ গাত্রে লম্বা লম্বা কালো ডোরা (Stripe) দেওয়া থাকে; অন্য প্রকার ব্যাঘ্রের গায়ে কোথায়ও কালো ফোঁটা বা বড় গোলাকার চিহ্ন দেখা যায়। কিন্তু কালো লম্বা ডোরা আর কাহারও নাই। সুন্দরবনের ব্যাঘ্র লেজ সমেত ১০/১২ ফুট দীর্ঘ এবং ৩/৪ ফুট উচ্চ হয়। সাধারণ পূর্ণাবয়ব ব্যাঘ্র ১০ ফুট দীর্ঘ ও ৩ ফুট উচ্চ হয়। ইহাদের সম্মুখের পা দুইটি বেশ মোটা এবং অত্যন্ত সবল, কিন্তু পশ্চাদ্ভাগ দেখিলে তেমন কিছু বোধ হয় না। বড় বাঘে গো-মহিষগুলিকে স্বচ্ছন্দে স্কন্ধে ফেলিয়া লইয়া যাইতে পারে। ইহাদের মাথাগুলি প্রকাণ্ড ও গোলাকার এবং চক্ষুদ্বয় খুব বড় ও অত্যন্ত উজ্জ্বল। জগতে বোধ হয় এমন কোন জীব নাই যাহারা ইহার চক্ষুর রোষষায়িত তীব্র দৃষ্টির সম্মুখে পড়িয়া আত্মহারা না হয়। গ্রাম্য বিড়ালের গতিবিধি ও শিকারকৌশল দেখিলে বাঘের প্রকৃতির অনেকটা আভাস পাওয়া যায়। এই জন্য গ্রাম্যলোকে বিড়ালকে ‘বাঘের মাসী’ বলে এবং বৈজ্ঞানিকেরা ব্যাঘ্রকে বিড়াল শ্রেণীভুক্ত (feline species or cat tribe) করেন। রাজকীয় ব্যাঘ্র অত্যন্ত রক্ত- পিপাসু এবং হিংস্র, উহারা শিকারের সময়ে অত্যন্ত দুর্দ্ধর্ষ মূর্ত্তি পরিগ্রহ করে। জীবজন্তু মারিয়া ফেলিলে ব্যাঘ্র প্রথমে তাহার স্কন্ধ ভেদ করিয়া যথেষ্ট রক্তপান করিয়া লয়। শিকারের সন্ধানে ইহারা অতি অল্পস্থানে সঙ্গোপনে দেহ লুকাইয়া রাখে এবং সুযোগ পাইবামাত্র ভীম বিক্রমে লম্ফ প্রদানপূর্ব্বক শিকারের উপর পড়ে। বাঘিনী ২ হইতে ৪টি পর্য্যন্ত ছানা প্রসব করে। প্রসবকাল হইতে সে ছানা লইয়া বাঘ হইতে দূরে থাকে। কারণ বাঘে ছানা দেখিলে খাইয়া ফেলে।

সুন্দরবনের প্রধান জন্তু চারিটি : ব্যাঘ্র, হরিণ, বন্যশূকর ও বানর। ইহা ব্যতীত পূৰ্ব্বভাগে বন্য মহিষ এবং দক্ষিণদিকে সমুদ্রোপকূলে গণ্ডার আছে।[১] কেহ কহে বলেন সুন্দরবনে গণ্ডার এক প্রকার নিঃশেষ হইয়াছে। ১০/১৫ বৎসর পূর্ব্বেও গণ্ডার হত্যার সংবাদ পাওয়া গিয়াছে, কিন্তু যিনি মারিয়াছিলেন তিনি জীবিত নাই।[২] বন্য মহিষ পশ্চিমভাগে কখনও দেখা যায় না, পূৰ্ব্বাংশে স্থানে স্থানে এখনও আছে। লোকে পূর্ব্বভাগে কুকুরিয়া মুকুরিয়া প্রভৃতি দ্বীপে মহিষ চরাইবার জন্য লইয়া যায়, সেখান হইতে অনেক পোষা মহিষও পলাইয়া বন্য হইয়া যায়। হাতিয়া, সন্দ্বীপ, চর ম্যাকফারসন্ প্রভৃতি স্থানে সুন্দরবনের চিহ্ন আছে, কিন্তু নিবিড় বন নাই। সুতরাং ব্যাঘ্র প্রভৃতি জন্তু একেবারেই নাই।

সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যাই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক। বনের যে কোন স্থানে যাওয়া যায়, সেখানেই হরিণের অস্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যাইবে। সুন্দরবনে জন্তুর গমনাগমনের জন্য যে বনপথ দেখা যায়, তাহা হরিণের পদচিহ্নে মণ্ডিত।[৩?] হরিণ পালে পালে চরে, পালে পালে বিশ্রাম করে। হরিণ বড় আরাম ভালবাসে; একটু উচ্চ ছায়াবহুল স্থান দেখিলে রৌদ্রের সময় হরিণগণ তথায় বিশ্রামসুখ ভোগ করে; পায়ে একটু কাদা লাগিলে, হরিণ বিরক্ত হইয়া পা ঝাড়িতে থাকে। যাহাদের সৌন্দর্য্য আছে, তাহাদিগকে উহা রক্ষা করিবার প্রবৃত্তিও ভগবান্ দিয়াছেন। হরিণের মত চঞ্চল জন্তু আর নাই; জগদীশ্বর ইহাদের আকর্ণবিস্তৃত সুন্দর চক্ষু এবং দীর্ঘ সরু সরু পা-গুলিকে চঞ্চলতার উপযোগী করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন। সুন্দরবনের বাঘ ও হরিণের প্রধান রঙ্ একই প্রকার; উভয়ই রক্তাভ হরিদ্রাবর্ণ (rufous yellow); বাঘের বেলায় এই রঙ্গের উপর কালো কালো লম্বা ডোরা, তেমন আর পৃথিবীর মধ্যে কোন জন্তুর নাই এবং হরিণের বেলায় ইহার উপর ছোট ছোট সাদা ডোরা। হিন্দুশাস্ত্রে ৯ প্রকার মৃগের কথা আছে।[৪] তন্মধ্যে হরিণজাতীয় মৃগই সুন্দরবনে পাওয়া যায়।

সুন্দরবনে দুই প্রকার হরিণ দেখা যায়; তন্মধ্যে প্রায় অধিকাংশই ডোরা হরিণ বা চিতা হরিণ (Axis maculatus, Spotted deer) এবং স্থানে স্থানে দুই চারিটি মাত্র কুকুরে হরিণ (Cervalus aureas, Barking deer or Ribfaced deer) দেখা যায়। ডোরা হরিণের গলা, পেট ও লেজের নিম্নে শাদা, উরুর নিম্নভাগ ও কাণের ভিতর শ্বেতাভ। গালটি কালো, মাথার উপর পাটল বর্ণ। ইহাদের নানাপ্রকার আকার দেখা যায়। বড়গুলি ৪/৫ ফুট দীর্ঘ এবং প্রায় ৩ ফুট উচ্চ হয়। এই বড় চিতা হরিণ শুধু সুন্দরবনে কেন, ভারতবর্ষের সমস্ত জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে যায়; হিমালয়ের পাদদেশে, মধ্যভারতের জঙ্গলে, নর্ম্মদানদীর উভয় কূলে এবং দক্ষিণ ভারতের ঘাটপর্ব্বতশ্রেণীতে এই জাতীয় হরিণ অসংখ্য পরিমাণে দেখা যায়। বঙ্গোপসাগরের পরপারে বা পঞ্জাব প্রদেশে এ হরিণ নাই। অনেকে বলেন, এই হরিণ যে যে স্থানে পাওয়া যায়, সর্ব্বত্রই এক জাতীয়, কিন্তু হগসন্ (Hodgson) প্রভৃতি কেহ কেহ উহাদের মধ্যে প্রকারভেদ করেন। বিলাতী Fallow deer or Dun- deer of Robin Hood এই হরিণ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্ জাতি।

কুকুরে হরিণের গায়ে কোন ডোরা নাই। ইহারা লাল কুকুরের মত একরঙ্গা এবং আকারে ডোরা হরিণ অপেক্ষা অনেক ছোট, একটি বড় ছাগের ন্যায়। সাহেবরা বলেন, ভারতবর্ষে যত প্রকার হরিণ আছে, তন্মধ্যে ইহার মাংস সর্ব্বোৎকৃষ্ট। জনৈক ইংরাজ লেখক (Mr. W. S. Burke) তাঁহার একখানা শিকারবিষয়ক পুস্তকে (Indian Field Shikar book) সুন্দরবনের আরও এক জাতীয় হরিণের উল্লেখ করিয়াছেন, ঐ হরিণকে Swamp deer বলে। কিন্তু এদেশীয় প্রধান প্রধান শিকারিগণও এরূপ হরিণের অস্তিত্বের সন্ধান পান নাই।

সুন্দরবনের হরিণে ছাগলের মত গাছের পাতামাত্রই খায়। তবে কেওড়া গাছের ফল ও পাতা কিছু অধিক ভালবাসে। এইজন্য জোয়ারের জল সরিয়া যাওয়া মাত্র যখন কেওড়ার তলা জাগিয়া উঠে, তখনই পালে পালে হরিণ সেই কেওড়া তলায় আসে। এই কেওড়াতলে শিকারীদিগের দ্বারা অসংখ্য হরিণ মারা পড়ে। অনেকে ‘গাছাল’ দিয়া অর্থাৎ কেওড়া গাছে লুকাইয়া থাকিয়া হরিণ শিকার করে। হরিণের মাংস ধর্ম্মনির্বিশেষে সৰ্ব্বজাতীয় লোকে শ্রদ্ধা ও আগ্রহপূর্বক খায়। হরিণের মাংস খাঁটি রক্তবর্ণ, উহাতে চর্বি খুব কম, খাইতে বিশেষ কোন তৈলাক্ত আস্বাদন নাই। তবে উদর পুরিয়া খাইলেও কোন অপকার করে না এবং ‘বাসি’ করিয়া অর্থাৎ যেদিন হরিণ মারা পড়ে, তাহার ২/১ দিন পরেও মাংস ভক্ষণ করা যায়। অনেকে বলেন, হরিণের মাংস একটু ‘বাসি’ না হইলে ভাল লাগে না। একটি হরিণে আধমণ হইতে দেড়মণ পর্যন্ত মাংস হয়। আমাদের দেশে চিরদিনই হরিণের মাংসের আদর চলিতেছে। বীরনৃপতিগণ প্রধানতঃ এই মৃগমাংসের জন্যই মৃগয়া করিতেন। তখন মৃগয়া ক্ষত্রিয়ের একটি প্রধান ধর্ম্ম ছিল। যাঁহারা জীবহিংসা করিতে সর্ব্বদা বিরত থাকিতেন, তাঁহারও মৃগয়া করিতে উদ্যোগী হইতেন। পিতৃশ্রাদ্ধাদিতে মৃগমাংসের মত কোন মাংসেরই আদর ছিল না। এখনও যাঁহারা মৃগশিকারের আনন্দানুভব করিয়াছেন এবং মৃগমাংসের স্বাদ গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহারা বহুকর্ম্মের ক্ষতি স্বীকার করিয়াও মৃগশিকারের জন্য সর্ব্বদা চেষ্টিত থাকেন।

সুন্দরবনের সর্ব্বত্র বন্যশূকরপূর্ণ রহিয়াছে। হরিণ এবং শূকর ব্যাঘ্রের প্রধান খাদ্য। কিন্তু তন্মধ্যে হরিণ শিকার করা কঠিন; হরিণ বড় চঞ্চল ও সতর্ক; কোন প্রকার একটু পত্রের মর্ম্মর শব্দ হইবামাত্র সাবধান হয় এবং দৌড়িয়া, লাফাইয়া ব্যাঘ্র কখনও হরিণের সঙ্গে পারে না। এজন্য যখন অন্য শিকার জুটে না, তখন শূকরই ব্যাঘ্রদিগের প্রধান অবলম্বন। প্রকাণ্ড বরাহ হনন করা যে নিতান্ত সহজ কাৰ্য্য তাহা নহে, তবে দুৰ্দ্দান্ত ব্যাঘ্রের সহিত বরাহ পারে না। এই বরাহগুলি (Sus Indicus) প্রায় ৪/৫ ফুট লম্বা হয়, লেজ ১ ফুট হইতে পারে, উচ্চতা ৩০ হইতে ৪০ ইঞ্চি পৰ্য্যন্ত হয়। ইহাদের রঙ্ ঈষৎ রক্তাভ কৃষ্ণবর্ণ (brownish black)। ঘাড়ের লোম, বুকের ও পেটের লোম গোড়ায় কালো এবং অগ্রভাগে শাদা হয়। সুন্দরবনের শূকর প্রায়শঃ খুব বড় হয়। মস্তকের খুলির দৈর্ঘ্য ১৪/১৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হয় এবং বড় দন্ত দুইটি সাড়ে ৭ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। আমরা সুন্দরবনে শূকরের খুলি হইতে বাহির করিয়া যে দন্ত সংগ্রহ করিয়াছিলাম, তাহাও ৭ ইঞ্চির কম হইবে না।

সুন্দরবনের বানর সাধারণ বঙ্গীয় বানর (Inuus rhesus); ইহারা হনুমান নহে। পূর্ণাবয়বের শরীর প্রায় ২ ফুট দীর্ঘ হয়, লেজ উহার অর্দ্ধেক অপেক্ষা কিছু বেশী। ইহারা অনেক স্থানে ঝাঁকে ঝাঁকে থাকে এবং স্বজাতির অনুরূপ নানাবিধ কৌতুকাবহ ক্রীড়া প্রদর্শন করে। সুন্দরবনে ইহারা হরিণের অভিভাবকের মত ভঙ্গী করে। কেওড়া গাছে উঠিয়া নিজেরা যেমন পাতা ও ফল খায়, গাছের তলে সমাগত হরিণদিগকেও সেইরূপ ডাল ভাঙ্গিয়া দেয়। কোন শিকারী দেখিবামাত্র দূর হইতে প্রথমে মুখভঙ্গী, পরে চীৎকার করিয়া উঠে, উহা শুনিবামাত্র হরিণগণ শশব্যস্ত হইয়া পলায়ন দ্বারা জীবন রক্ষা করে। বানরগুলা কখনও বা হরিণের পৃষ্ঠে চড়িয়া বেড়ায়। বানরের বান্দরামি সর্ব্বত্র সমান।

এই সকল জন্তু ছাড়া সজারু, বনবিড়াল প্রভৃতিও সুন্দরবনে দেখা যায়। বনবিভাগে শৃগাল বা শিয়াল থাকে না। বড় শিয়াল অর্থাৎ ব্যাঘ্রের ভয়ে ক্ষুদ্র জন্তুমাত্রেই বন ত্যাগ করিয়া পলায়ন করে। তবুও সুন্দরবনের গহন অঞ্চলে জীবের অভাব নাই। ডাঙ্গায় বাঘ এবং জলে কুমীর ব্যতীত ডাঙ্গায় অসংখ্য প্রকার সর্পের সমুদ্ভব হওয়াতে সুন্দরবনের ভীষণত্ব আরও বাড়িয়েছে। প্রায় সকল প্রকার সর্পই সুন্দরবনে আছে। তন্মধ্যে কেউটা, গোখুরা, পাতরাজ ও নানাবিধ বোড়া সাপই অধিক। ইহারা ব্যাঘ্র অপেক্ষাও ভীষণ; কারণ বন্দুকে, বৃক্ষারোহণে, পলায়নে ব্যাঘ্রের হাতে হয়ত প্রাণরক্ষার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে চক্ষের অন্তরালে অকস্মাৎ এই সকল ভীষণ সর্পের আঘাতে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হওয়া বিচিত্র নহে।

যশোহর-খুলনার লোকালয়ে এবং সুন্দরবনে অসংখ্য প্রকার সর্প দেখা যায়। তদ্বিষয়ে একটু সাধারণ জ্ঞানের অভাবেও অনেক সময়ে অনেক বিপদ অনিবাৰ্য্য হয়। এজন্য সর্প সম্বন্ধে দুই চারিটি কথা অনর্থক বা অপ্রাসঙ্গিক না হইতে পারে। বিশেষতঃ শ্রেণীবিভাগবিষয়ক জ্ঞান ব্যতীত কেবলমাত্র কয়েকটি সর্পের নাম করিলেই কিছু বুঝা যায় না।

সর্পের মধ্যে কতক বিষধর, অন্যগুলি বিষহীন। বিষধর সর্পকে প্রথমতঃ তিন ভাগে বিভাগ করা যায়: (১) চৌসাপা, (২) বোড়া ও (৩) বীজজড়ী। কেউটা, গোখুরা, আইরাজ ও কানড় এই চারি প্রকার সর্পই চৌসাপা সংজ্ঞাভুক্ত। ইহাদের প্রত্যেকের আবার প্রকারভেদ রহিয়াছে।[৫] কেউটার মস্তকে পদ্ম বা গোলাকার চিহ্ন এবং গোখুরার মস্তকে U চিহ্ন আছে। কেউটা, গোখুরা ও আইরাজের ফণা আছে, কানড় ফণাহীন। এই চারি প্রকার সর্পই অত্যন্ত বিষধর, ইহাদের বিষ অতিশয় তীব্র এবং সাংঘাতিক। আঘাতের প্রকৃতি দেখিয়াও ইহাদিগকে বিশেষ করিয়া বুঝিতে পারা যায়।[৬] ইহাদের আঘাত হইতে আরোগ্যলাভের কোন প্রকার বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাপ্রণালী এখনও আবিষ্কৃত হয় নাই। তবে আমাদের এদেশে এখনও অনেক গুণী বা ওঝা আছেন, যাঁহারা মন্ত্রবলে ও ঔষধাদি প্রয়োগে অনেকের জীবনদান দিয়া থাকেন। কেউটা ও গোখরা লোকালয়ে এবং আইরাজ সুন্দরবনের মধ্যে দেখা যায়। কেউটা জলাভূমিতে এবং গোখুরা শুষ্কক্ষেত্রে, ভগ্নগৃহে বা উচ্চস্থানে দেখা যায়। চৌসাপা ব্যতীত অন্য বিষধর সর্পের মধ্যে বোড়া প্রধান ইহাদের ফণা নাই, আকারে বড়, বিষ তত তীব্র না হইলেও সাংঘাতিক। ক্ষুদ্র বৃহৎ অনেক প্রকার ফণাহীন অথচ বিষধর সর্প বীজজড়ী শ্রেণীভুক্ত।[৭] বিষহীন সর্পের মধ্যে কতকগুলিকে কালাই সাপ বলে এবং দাঁড়াস প্রভৃতি অন্য গুলির কোন বিশেষ নাম দেওয়া যায় না। বরাহচিতে বা ময়াল (python) প্রভৃতি কালাই মাঝে মাঝে বড় বড় জন্তুকে উদরসাৎ করিয়া থাকে। সাপের মধ্যে কতকগুলি সাপ দেখিতে এক প্রকার অথচ উহাদের কোন কোনটির ফণা নাই অথচ বিষ আছে, তাহাদিগকে গড়া’চ বলে। আবার নানাজাতীয় সর্পের পরস্পর সঙ্গমে (Cross-breeding) সঙ্কর বা দোরোখা সাপের উৎপত্তি হয়। সুন্দরবনের জঙ্গলে কেউটা বা গোখুরার সহিত আইরাজের সম্মিলনে উৎপন্ন অনেক সঙ্কর সর্প দেখিতে পাওয়া যায়।

সুন্দরবনের নদীমাত্রই কুম্ভীরে পূর্ণ। ‘ভাসাল’ নামক এক জাতীয় কুমীর মধুমতী প্রভৃতি নদীতে দেখা যায়; শুনিয়াছি উহারা মনুষ্য শিকার করে না। কিন্তু সুন্দরবনের নদীতে এরূপ বৈষ্ণব কুমীর নাই; সুন্দরবনের কুমীর অত্যন্ত হিংস্র। বড় কুমীরগুলি ১০/১৫ হাত পর্য্যন্ত দীর্ঘ হয়। কুমীর শিকার করিতে হইলে বিশেষ আয়াস স্বীকার করিতে হয় না। প্রায়ই দেখা যায়, ছোট বড় অসংখ্য কুমীর নদীর চড়ায় উঠিয়া রৌদ্র সম্ভোগ করিতেছে; গরু প্রভৃতি মড়া ভাসিয়া যাইতে লাগিলে তৎসঙ্গে অনেক সময়ে দেখা যায়, ২/৩টি কুমীর মাংস খাইতে খাইতে ভাসিয়া চলিতেছে। বন্দুকের ভিতর প্রকাণ্ড গুলি বা জালের লৌহ কাঠি পূরিয়া লইয়া, কুমীরের পায়ের নিম্নে বা চক্ষের কোমল স্থান লক্ষ্য করিয়া কুমীর শিকার করিতে হয়। সুন্দরবনে কোথায়ও নদীতে নামিয়া স্নান করা কঠিন, সৰ্ব্বদা প্রাণের আশঙ্কা থাকে। জীবজন্তু বা মানুষ সাঁতার দিয়া নদী বা খাল পার হইতে গেলেও কুমীরের হাতে নিস্তার পাওয়া কঠিন। তবে প্রকাণ্ড ব্যাঘ্রগুলি বিস্তৃত নদীসমূহ আবশ্যকমত সাঁতার দিয়া পার হইয়া থাকে, তাহাদিগকে কুমীরে ধরিয়াছে বলিয়া শুনা যায় নাই। এরূপও শুনা যাইয়া থাকে যে কুমীর তীরে উঠিয়া গরুর দড়ি ধরিয়া জলে পড়ে এবং জল হইতে টানিতে টানিতে গরুকে জলে লইয়া ধরিয়া বসে এবং কখনও বা লেজের আঘাতে মানুষকে ছোট নৌকা হইতে জলে ফেলিয়া দিয়া শিকার করে। হাঙ্গরও প্রচুর পরিমাণে সুন্দরবনে আছে এবং এমন কি উত্তরদিকে নদীতে অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া লোকালয়ের ভীতি সঞ্চার করিয়াছে। উহারা নিঃশব্দে একজনকে ধরে এবং এক প্রকার অজ্ঞাতসারে তাহার হাত পা কাটিয়া লইয়া যায়। বড় হাঙ্গরগুলি ৬/৭ হাত দীর্ঘ হয়, দেখিয়াছি। ইহাদের গালে উপরে ২ পাটি ও নিম্নে ১ পাটি, মোট ৩ পংক্তি দাঁত। দাঁতগুলি মাংসের পুটুলি দ্বারা এক প্রকার আবৃত; এজন্য হাঙ্গরে যখন কাহারও গাত্রে মুখ দেয়, তখন সে প্রথমে জানিতেই পারে না, পরে চাপ দেওয়া মাত্র অতি সুতীক্ষ্ণ দন্তপংক্তি বাহির হইয়া মুহূর্তমধ্যে কঠিন অস্থি পর্য্যন্ত দ্বিখণ্ডিত করিয়া ফেলে। হাঙ্গরের মূর্তি অনেকটা পাঙ্গাস মাছের মত। সুন্দরবনের নদীতে শিশুকের অভাব নাই। অবিরত তাহারা মৎস্য শিকারের জন্য জলমধ্যে দৌড়াদৌড়ি করিতেছে এবং মাঝে মাঝে জলের ভিতর হইতে মাথা উঁচু করিয়া নিশ্বাস ত্যাগের সঙ্গে নাসিকাগজ্জন দ্বারা ভীতিপ্রদর্শন করিয়া থাকে।[৮]

সুন্দরবনের অন্যান্য বিশেষত্বের মত মৎস্যেরও বিশেষত্ব আছে। সে সকল মৎস্য অন্য দুষ্প্রাপ্য, এমন কি তাহাদের অনেকগুলির নাম পর্য্যন্ত অন্য স্থানের লোকে জানে না। ভেকটী বা ভেটকী এবং গল্লা বা গলদা চিংড়ি বঙ্গোপসাগরের শাখানদীসমূহ হইতে ধৃত হইয়া কলিকাতা প্রভৃতি দূরবর্ত্তী সহরে গিয়া বিক্রীত হয়; উহা সাহেবগণ এবং সহরবাসী লোকের অতি উপাদেয় খাদ্য। ছোটগুলিকে ভেকী বলে এবং খুব বড় আকারের ঐ জাতীয় মৎস্যকে এতদ্দেশে ভ্যাকট্ বা ভেকট্ বলে। সেরূপ মৎস্য রূপসা, বলেশ্বর, পশর বা শিবসাতেই পাওয়া যায়। সুন্দরবনের চিংড়ি অনেক প্রকারের আছে, তন্মধ্যে যেগুলির সম্মুখের পদ দুইখানি খুব দীর্ঘ এবং নীলবর্ণ হয়, তাহাকে গল্দা বলে, আর এক জাতীয় চিংড়িকে লোণা বা বাগ্‌দা চিংড়ি[৯] বলে, উহা অত্যন্ত দুষ্পাচ্য। চিংড়ি মৎস্য এক প্রকার পোকা জাতীয়, উহা সুন্দরবনের ওড়া প্রভৃতি বৃক্ষের পচা পাতা হইতে জন্মে। চিংড়ির জীবাণু সকল অদৃশ্যরূপে লোণাজলে মিশ্রিত থাকে। খুলনা জেলার দক্ষিণভাগে নানাস্থানে এক্ষণে যথেষ্ট চিংড়ি মৎস্য ধরিয়া সিদ্ধ ও শুষ্ক করিয়া পর্যাপ্ত পরিমাণে বস্তায় বস্তায় বিদেশে প্রেরিত হইতেছে। সুন্দরবনের পার্শিয়া এবং ভাঙ্গান মৎস্য অত্যন্ত তৈলাক্ত এবং সুস্বাদু। ইহা উর্দ্ধসংখ্যা ২/৩ সের পর্য্যন্ত হয়। কিন্তু সেরূপ বড় মাছ পাইলে তাহা তৈলাধিক্যবশতঃ উদরে পরিপাক করা কষ্টকর। খরশূল্যা মাছের আদিস্থান ভাটি অঞ্চল, কিন্তু আজকাল উহা অনেক সৌখীন ভদ্রলোকের পুষ্করিণীর শোভা বর্দ্ধন করিয়া থাকে। শিবসা প্রভৃতি নদীর মধ্যে একটু লক্ষ্য করিয়া দেখিলে নানাবর্ণে চিত্রিত চিত্রা, রেখা, রুচা ও দাঁ’তনে প্রভৃতি মৎস্য অসংখ্য দেখা যায়। চিত্রাগুলি গোলাকার ও অতি সুচিত্রিত, শ্বেতবর্ণ ও বৃহচ্চক্ষু রেখা দেখামাত্র তৃপ্তি হয়, ঈষৎ ধূসরাকৃতি রুচা মৎস্যাশী মাত্রেরই রুচি বৃদ্ধি করে। রসনায় পরীক্ষা ব্যতীত ইহাদের গুণব্যাখ্যা শুনিয়া লাভ নাই। সুন্দরবনের ছোট ছোট খালে নদীসংলগ্ন ডোবায় অনেক সময় মৎস্যে পরিপূর্ণ হইয়া থাকে; জাল দিয়া মারিতে গেলে মৎস্যের ভারে জাল টানিয়া উঠান কঠিন হয়। ভোলা, বা জাবা বা পোয়া মাছ সৰ্ব্বত্র সহজলভ্য, তবে দেখিতে বা খাইতে ভাল নহে। বড় জাতীয় এক প্রকার ভোলাকে কৈভোল বলে। ছোট মাছের মধ্যে নানাজাতীয় ট্যাংরা, ফ্যাসা এবং গায়রা বা চালিয়া মাছ সৰ্ব্বদা পাওয়া যায়; সিলিন্দা, পাঙ্গাস এবং আইড় ছোট বড় সব রকম অনেক সময়ে মৎস্যের বাজারের সৌন্দর্য্য ও পসার বৃদ্ধি করে। এতদ্ব্যতীত কর্কট বা কাঁকড়া এবং কাঠাদুর বা একজাতীয় কচ্ছপ যথেষ্ট পাওয়া যায় এবং অনেক লোক লোলুপ-জিহ্বার সাহায্যে উদরস্থ করে। মৎস্য যে শুধু মানুষে খায়, তাহা নহে; অন্য শিকার না মিলিলে ব্যাঘ্রগণ ভাঁটার সময়ে খালে নামিয়া অপরিমিত মৎস্যের দ্বারা মাংসের অভাব পরিপূর্ণ করে এবং অবিরত অসংখ্য প্রকার পক্ষী মৎস্য শিকার করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করে। নদীমাতৃক বঙ্গদেশে যেমন মৎস্যাশী মনুষ্য, মৎস্যবহুল সুন্দরবনে তদ্রূপ মৎস্যশিকারী অসংখ্য প্রকারের পক্ষী আছে।

সুন্দরবনবাসী পক্ষিগণের মধ্যে নানাজাতীয় কুল্যা, চিল, বক ও কাঁক প্রধান।[১০] মাছাল (Buzzard) এবং মাছরাঙ্গা (king-fisher) সৰ্ব্বত্র দেখিতে পাওয়া যায়। ইহারা সকলেই মংস্যাশী; সকলেরই ঠোঁট লম্বা ও অগ্রভাগে ঈষৎ বাঁকান, গলা লম্বা এবং পা দুইখানি সরু ও দীর্ঘ; কারণ এরূপ না হইলে মৎস্য শিকার করিতে পারে না। নদী বা খালের কূলে জলের অতি সন্নিকটে অতি ধীর স্থিরভাবে বক ও কাঁক বসিয়া থাকে, মাছাল ও চিল কখনও বৃক্ষাগ্রভাগে বসিয়া বিকটস্বরে চীৎকার করে এবং কখনও দলে দলে জলের উপর উড়িয়া বেড়ায় এবং মাছরাঙ্গা জলের উপর পতিত ডালের উপর বসিয়া তীব্রদৃষ্টিতে শিকারের সন্ধান করে ও সময় বুঝিয়া তীরবেগে উড়িয়া পড়িতে গিয়া বিচিত্র পক্ষসৌন্দর্য বিস্তার করে এবং প্রায়ই অব্যর্থ সন্ধানে মৎস্য ধরিয়া খায়। চাতক খাদ্যের লোভে জলের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে বেড়ায় ও উৎকট চীৎকারে দেশ মাতায়। কিন্তু নৌকা বা ষ্টীমার দেখিলে এই সকল পাখী সকলেই দলে দলে উড়িয়া গিয়া দূরে সরিয়া বসে, এইরূপে নৌকার অগ্রে অগ্রে বহুদূর চলিয়া যায়। এই সকল ব্যতীত ‘মদনা’ বা মদনটাক, ভস্মকায়, ‘শামখোল’, কৃষ্ণবর্ণ ‘মাণিক’ ও ঝুঁকে ঝুঁকে ‘গয়াল’ সুন্দরবনের নদী-পথের নির্জ্জনতা ভঙ্গ করে। বনের প্রান্তে বালিহাঁস দেখা যায়, প্রত্যূষে ও সন্ধ্যায় বন্যকুক্কুটের তীব্রস্বর নিস্তব্ধ বনস্থলীকে মুখরিত করিয়া তুলে। কুক্কুট জনস্থানে হিন্দুর নিকট নিস্তার পাইলেও বনে গিয়া হিন্দুশাস্ত্রের হাতে অব্যাহতি পায় নাই; হিন্দুদিগের বন্যকুক্কুট খাইবার ব্যবস্থা আছে, এজন্য তাহার উগ্র চীৎকার ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া’ নৈশ অন্ধকারের মধ্যে শিকারিমাত্রের নিদ্রার বিঘ্ন ঘটাইয়া থাকে। এতদ্ব্যতীত ঘুঘু, দ’লো, দয়েল, হলদে পাখী, ফিঙ্গে এবং নানাজাতীয় বাটাং[১১] প্রায়ই দেখা যায়; তবে আর যে তিন প্রকার পক্ষী দেখা যায়, তাহাদের রূপের তুলনা নাই। বৈকুণ্ঠ পক্ষীর (bird of paradise) মত ইহাদেরও দেহের কিছু বাহার আছে। দুধরাজ ছোট পাখী, শ্বেতবর্ণ, সরু শাদা লেজ খুব লম্বা; রক্তরাজ ঠিক ঐরূপ, কেবল রঙটি রক্তবর্ণ এবং ভীমরাজও ঐ একজাতীয়, বর্ণটি গাঢ় কালো। ভীমরাজ জনশূন্য বনের পাখী, কিন্তু সে নাকি বনে থাকিয়াও মানুষের মত কথা কয়, সে কথা শুনিবার ভাগ্য আমাদের হয় নাই; তবে ময়নার মত শিক্ষা পাইলে, তাহারা যে পাখীর ঠোঁটে মানুষের বুলি ফুটাইতে পারে, তাহা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি।

পাদটীকা :

১. Calcutta Review. Vol. 89, P. 299 (1889).

২. ঢাকী ফরেষ্ট ষ্টেসনের সন্নিকটে নলিয়ানের আবাদে কালাচাঁদ শিকারী ছিলেন। তিনি শেষ গণ্ডার হত্যা করিয়াছিলেন। তাঁহার পুত্র ওমর শিকারী জীবিত আছেন।

৩. রায় সাহেব নলিনীকান্ত রায়চৌধুরী ১৮৮৫ অব্দে শেষবার স্বচক্ষে গণ্ডারের পদচিহ্ন দেখিয়াছিলেন।

৪. শম্বরো রোহিতো রামো ন্যঙ্কুরঙ্কু শশো রুরুঃ।
এণশ্চ হরিণশ্চেতি মৃগো নববিধা মতাঃ।।-কালিকাপুরাণ

৫. কেউটা আট প্রকার: (১) কাল কেউটা (আকারে ছোট, চোখ লালবর্ণ, রঙ কালো), (২) আ’ল কেউটা (নীলবর্ণ), (৩) তেতুলিয়া কেউটা (লালবর্ণ, জলবোড়া সর্পের মত), (৪) ঘিতে ভাঙ্গা বা শামুক ভাঙ্গা, (৫) পদ্ম কেউটা বা তারাফুটকী (মাথায় পদ্ম সুস্পষ্ট দেখা যায়), (৬) বাঁশবুনে কেউটা (শাদা শাদা ডোরা), (৭) দু’ধে খরিষ (শাদার উপর শাদা পদ্ম) এবং (৮) খ’য়ে কেউটা। গোখুরা ৫ প্রকার : (১) কালী গোখুরা (কালো রঙ), (২) পদ্ম গোখুরা (সোণার মত রঙ্), (৩) খ’য়ে গোখুরা, (৪) হলদে গোখুরা ও (৫) নাগরাজ গোখুরা (কালোর উপর ডোরা)। আইরাজ ৮/৯ প্রকার : (১) পাতরাজ (ফনা আছে, মাথায় কোন চিহ্ন নাই), (২) দুধরাজ (শাদা), (৩) মণিরাজ, (৪) ধনীরাজ, (৫) ভীমরাজ (এই তিন প্রকারই কালো রঙ বিশিষ্ট), (৬) শঙ্খচূড় (হরিদ্রাভ, সৰ্ব্বাপেক্ষা সাংঘাতিক)। ইহা ব্যতীত মণিচূর, নাগরচাঁদ ও শঙ্কাবতী নামক আরও তিনপ্রকার আইরাজ আছে। কানড় ৪ প্রকার: (১) পাথুরে কানড় (অনেকটা আ’ল কেউটার মত), (২) শাখামুটী (বাঁশবুনে কেউটার মত), (৩) রক্ত কানড় (ইহাদের পেটের দুই পার্শ্বে মাথা পর্য্যন্ত দুইটি লাল দাগ আছে), (৪) কালাজ (কালো রঙ, ঘাড়ের কাছে একটি চৌকা দাগ আছে)।

৬. কেউটার কামড়ে কনকনে যন্ত্রণা হয়, আহত ব্যক্তি হাত পা ছুঁড়িতে থাকে ও মুখে গোজলা বা ফেনা উঠে । ইহারা বিলে বা জলা জায়গায় কামড়ায় এবং ইহাদের বিষে শরীর নীলবর্ণ হয়। গোখুরার আঘাতে জ্বালা যন্ত্রণা অত্যন্ত অধিক এবং অসহ্য। ইহারা কখনও জলে কামড়ায় না। ইহাদের বিষেও শরীর নীলবর্ণ হয় এবং গুরুতর আঘাতে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়। আইরাজের দাঁত বড়, উহাতে ক্ষত অধিক হয়। বিষ কেউটার মত, তবে বিষের গতি একটু ধীর। কানড়ের কামড় বুঝিতেই পারা যায় না, জ্বালা করে না, কেউটার আঘাতের মত দেহ নীলবর্ণ হয়, বিষ খুব মন্দগতি। ইহারা বিছানায়ও কামড়ায়।

৭. বোড়া ৬৪ প্রকার, তন্মধ্যে কতকগুলির নাম জানা গিয়াছে, যেমন চক্রবোড়া, চন্দ্রবোড়া, টিয়েবোড়া, তুলবোড়া, অমলবোড়া, ধবলবোড়া, গেছোবোড়া, জলবোড়া, হরিণবোড়া ও বি’ঘতেবোড়া প্রভৃতি। এতন্মধ্যে চক্রবোড়া ও চন্দ্রবোড়ার পেটে ছানা হয় এবং ইহারা অত্যন্ত সর্পভক্ষক। ইহারা লম্বা অধিক হয় না, কিন্তু মাথা সরু এবং দেহ বেশ মোটা হয়। ইহাদের কামড় বড় সাংঘাতিক; কামড়াইলে চোখ, মুখ, নাক দিয়া রক্ত পড়িতে থাকে। বিঘ’তে বোড়া লাফাইয়া লাফাইয়া চলে। হরিণবোড়া খুব দীর্ঘ ও মোটা, ইহারা হরিণ বা তদ্রূপ বড় জন্তুকে সশরীরে উদরস্থ করে। বীজজড়ী সাপেরও অনেক প্রকার আছে : কালনাগিনী, উদয়কাল, রুদ্রকাল, মহাকাল, নিকেনী নাগ, বঙ্করাজ, বাঁকাল, ছাঁতারে, সীতাহার, চন্দ্রভাগ, সূৰ্য্যভাগ ও সূতাসঞ্চার প্রভৃতি। এতন্মধ্যে বঙ্করাজ খুব বড়, ৫/৬ হাত লম্বা হয়, ফণাধর সর্পের মত যখন ছো মারিবার জন্য উঁচু হইয়া উঠে, তখন ইহাদের গায়ে ৪/৫টি ভাঁজ পড়ে, উহাতে দেখিতে বড় সুন্দর হয়। বাঁকাল সাপ ত্রিশির বলিয়া দেখিতে বড় সুন্দর। কালনাগিনীর কালো গায়ে লাল ফুল দেওয়া থাকে। উদয়কাল বহুরূপী, উহাতে অনেক রঙ ধরে।

৮. ইহা ভিন্ন সুন্দরবনের খালে গোসাপ (Iguana) অসংখ্য পরিমাণে আছে। ইহারা গিরগিটি জাতীয় সরীসৃপ, উভচর, সর্পভক্ষক এবং দৈর্ঘ্যে ৪/৫ হাত পর্য্যন্ত হয়। মাছের লোভে খালের ঝোপেঝাড়েও থাকে। ইহার চর্ম মূল্যবান বলিয়া সুন্দরবনের লোকে একসময় ‘তারকেল’ অর্থাৎ গোসাপ প্রচুর মারিতে থাকে। সর্পের উপদ্রব বৃদ্ধির আশঙ্কায় ইহা শিকার করা অতঃপর নিষিদ্ধ হইয়া যায়। যশোহর-খুলনার গ্রামেও ইহাদের প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়।— শি মি

৯. যে বকদ্বীপ বা বগ্‌দি কথা হইতে জাতিবাচক ‘বাগ্দী’ শব্দের উৎপত্তি, সেই কথা হইতেই চিংড়ি মাছের এই স্থানবোধক বাগ্‌দা নাম হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। [২য় অংশ ১ম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য-শি মি]

১০. কুল্যা খুব বড় পাখী, ইহা দুই প্রকার : শ্বেত কুল্যা এবং দেশী বা কালো কুল্যা। সুন্দরবনে তিন প্রকার চিল দেখা যায় : মাটিয়া চিল, শঙ্খ চিল এবং গাঙ্গচিল। তন্মধ্যে গাঙ্গচিলগুলি ধবধবে শাদা (a kind of petrel)। বক পাঁচ প্রকার : (১) কুঁচি বক, ইহাদের পাখার উপর মাটিয়া রঙ, (২) গোবক (Stork), একটু বড়, রঙ্ শাদা এবং পায়ের বর্ণ হলদে, (৩) ঢালি বক, আকারে বেশ বড়, ইহাদের রঙ্ খুব শাদা এবং পা দুইখানির বর্ণ কালো, (৪) নল ঘোগা বককে বাক্‌চোও বলে, ইহাদের রঙ কালো, (৫) রাঙ্গাবক বা কানা বকের রঙ লাল। কঙ্ক বা কাঁক (Heron) দ্বিবিধ : (১) শ্বেতকাঁক, শাদা রঙ্, গলা খুব লম্বা, (২) কঙ্ক বা কালো কাঁক, কতকটা কালো রঙ, গলা একটু লাল (হট্‌টিটি চাতক জাতীয়), গ্রাম্য কাকের সহিত এই কঙ্কের কোন সাদৃশ্য নাই।

১১. হট্‌টিটি বাটাং সাধারণতঃ দুষ্প্রাপ্য, (২) কুকড়োবাটাং আকারে খুব বড় এবং (৩) চিড়ে বাটাং অতি ক্ষুদ্রকায়।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. ২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. ৩. নদী-সংস্থান
৪. ৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. ৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. ৬. সুন্দরবন
৭. ৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. ৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. ৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. ১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. ১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. ১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
১৩. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
১৪. ২. দ্বীপের প্রকৃতি
১৫. ৩. আদি হিন্দু-যুগ
১৬. ৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
১৭. ৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
১৮. ৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
১৯. ৭. মাৎস্য-ন্যায়
২০. ৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
২১. ৯. সেন-রাজত্ব
২২. ১০. সেন-রাজত্বের শেষ
২৩. ১১. আভিজাত্য
২৪. ১. তামস যুগ
২৫. ২. বসতি ও সমাজ
২৬. ৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
২৭. ৪. খাঁ জাহান আলি
২৮. ৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
২৯. ৬. পয়োগ্রাম কসবা
৩০. ৭. খালিফাতাবাদ
৩১. ৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৩২. ৯. হুসেন শাহ
৩৩. ১০. রূপ-সনাতন
৩৪. ১১. লোকনাথ
৩৫. ১২. হরিদাস
৩৬. ১৩. রামচন্দ্র খাঁ
৩৭. ১৪. গাজীর আবির্ভাব
৩৮. ১৫. মুকুট রায়
৩৯. ১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
৪০. ১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
৪১. পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
৪২. পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
৪৩. পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
৪৪. পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন