সতীশচন্দ্র মিত্র
রাজশক্তির আনুগত্যই রাজভক্তি নহে। শুধু বলের দ্বারা দেশ শাসিত হয় না। প্রজার ভক্তি আকর্ষণ করাই রাজার প্রধান কৰ্ত্তব্য। পূৰ্ব্বে দেখান হইয়াছে যে, পাঠানেরা দেশ জয় করিতে পারিতেন, অধিকার বা শাসন বিস্তার করিতে জানিতেন না। অসির সাহায্যে দেশ জয় করা যায়, মনের উপর আধিপত্য লাভ করা যায় না। দৈবক্রমে অসিজীবীর সাহায্য করিতে বহুসংখ্যক মুসলমান সাধু এই সময়ে ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন; তাঁহারাই অগ্রদূত হইয়া দেশমধ্যে নানা স্থানে প্রবেশ করিয়া তাঁহাদের দৈবীশক্তি ও ধর্ম্মজীবনের আদর্শ দেখাইয়া লোক বশীভূত করিয়াছিলেন। খাঁ জাহান ইহাদের অন্যতম; দুর্দ্ধর্ষ সুন্দরবন প্রদেশে তিনি না আসিলে, কোনক্রমে মুসলমান ধৰ্ম্ম বা প্রভুত্ব প্রবেশ লাভ করিতে পারিত না। খাঁ জাহানের জীবনে চরিত্রশক্তি ও রাজকীয় শক্তি উভয়ের অপূৰ্ব্ব সমাবেশ দেখিতে পাওয়া যায়। এক কথায়, খাঁ জাহান একজন রাজনৈতিক সন্ন্যাসী।
তাঁহার জীবনের তিনটি প্রকৃতি; তিনি চরিত্রে সাধু, জনহিতৈষণা তাঁহার ধর্ম্ম, এবং শাসন ও ধর্ম্ম বিস্তার তাঁহার উদ্দেশ্য। তাঁহার সাধুতা, হিতৈষণা ও শাসন বিস্তার এক সঙ্গে চলিত। খাঁ জাহানের সৈন্য ছিল, তাহারা আবশ্যক হইলে যুদ্ধ করিতে পারিত; কোন কোন স্থলে যুদ্ধ করিয়াছিল। কিন্তু অধিক বার যুদ্ধ করিতে হয় নাই। বাগেরহাটের কাছে রণবিজয়পুর, রণজিৎপুর, রণভূমি, ফতেপুর প্রভৃতি কতকগুলি স্থান আছে। ইহাদের সহিত কাহার কোন্ যুদ্ধের সম্বন্ধ চিরস্থায়ী হইয়াছে, তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। মোট কথা, শাসন প্রতিষ্ঠিত করিতে তাহাকে বিশেষ আয়াস স্বীকার করিতে হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয় না; কারণ, এ অঞ্চলের অধিবাসিগণ তাঁহার জনহিতকর কার্য্যের জন্য মুগ্ধ হইয়াছিল এবং সর্ব্বশেষে তাঁহার ধর্ম্মজীবন ও সাধুচরিত্র দেখিয়া ভক্তিমান্ না হইয়া পারে নাই। সাধারণ লোকের এই ভক্তি ও প্রীতি শুধু যে তাঁহার ও তাঁহার অনুচরদিগের মুখ্য সাধনা সহজসাধ্য করিয়া দিয়াছিল, তাহা নহে; ইহা দ্বারা সমস্ত পাঠান ও এমন কি, সমগ্র মুসলমানদিগকে কতকটা আত্মীয় ও আপনজনের মত দেখিতে হিন্দুদিগকে প্রবর্তিত করিয়াছিল। ইহারই ফলে ক্রমশঃ পাঠানগণ কোষবদ্ধ অসি লইয়া দেশবাসীর নিকট হইতে রাজস্ব সংগ্রহের সুযোগ পাইয়াছিলেন। নূতন দেশে আত্মপ্রাধান্য স্থাপনের এমন ভিত্তি আর কিছুতেই হইতে পারে না।
হিন্দুবৌদ্ধের দেশে ধর্ম্মতত্ত্বের বিচার দ্বারা নব-মত সংস্থাপন করা অতীব দুঃসাধ্য। কিন্তু জাতিধর্ম্মনির্বিশেষে সর্ব্বজনহিতকর কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে, তাহার দৃষ্টান্ত অতীব জ্বলন্ত হয়। খাঁ জাহান দেশমধ্যে অসংখ্য জলাশয় খনন করিয়া জলকষ্ট দূরীভূত করিলেন; সুপ্রশস্ত এবং ছায়াবহুল রাস্তা নির্ম্মাণ করিয়া যাতায়াতের প্রণালী সুগম করিলেন; নানা উপায় অবলম্বন করিয়া কৃষিকার্য্যের উন্নতি সাধন করিলেন। তিনি প্রজার নিকট হইতে রাজস্ব বলিয়া যে অর্থ সংগ্রহ করিতেন, তাহার কতক দান প্রভৃতি সৎকার্য্যে প্রজার মধ্যে বিতরণ করিতেন, কতক মজিদাদি ইমারত নির্মাণ করিতে গিয়া দেশীয় শ্রমজীবীদিগের হস্তে পৌঁছাইয়া দিতেন, অবশিষ্ট সঞ্চিত অর্থ প্রজার জন্য মৃত্তিকাগর্ভে গচ্ছিত রাখিতেন। তাঁহার সময় হইতে প্রচার হইয়াছিল যে, তিনি ৩৬০ বিঘা জমিতে অপরিমিত ধন রাশি লুক্কায়িত রাখিয়াছেন। একথা সত্য। তাঁহার মৃত্যুর পর হইতে বহুলোকে তাঁহার হর্ম্যাদির ভিতর বা অন্যত্র মৃত্তিকানিম্নে যথেষ্ট অর্থ পাইয়া সমৃদ্ধিশালী হইয়াছে। লোকে বলিয়া থাকে, বাগেরহাটের নিকটবর্ত্তী প্রধান প্রধান সমৃদ্ধিসম্পন্ন জমিদারবংশের উন্নতি লাভের ইহাই মুখ্য কারণ। এমন কি, এখন দুইজন লোকে একত্র কোন জমিতে হলকর্ষণ করে না, পাছে হঠাৎ ধন পাইলে উহার বণ্টন লইয়া গোলযোগ উপস্থিত হয়। কেহ কেহ বলেন, খাঁ জাহান আলির এইরূপ ধন পুঁতিয়া রাখিবার একটি উদ্দেশ্য ছিল। জমি গভীর করিয়া খনন করিলে, তাহার উর্ব্বরতাশক্তি বহুগুণ বৰ্দ্ধিত হয়; এদেশীয় কৃষকেরা স্বল্প পরিশ্রমে ধান্য জন্মাইতে পারে বলিয়া তাহাদের জমি রীতিমত চাষ করে না; কিন্তু অনেকে অর্থের লোভে যথেষ্ট গভীর করিয়া গর্ত করিয়া থাকে। ইহা দ্বারা জমি উল্টাপাল্টা হইলে উহার শক্তিবৃদ্ধি হইয়া থাকে। বাস্তবিকই এইরূপ কোন উদ্দেশ্যে তিনি সঞ্চিত অর্থ লুক্কায়িত রাখিতেন কি না, তাহা জানিবার উপায় নাই। তবে এইভাবে যথেষ্ট অর্থ রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহা নিঃসন্দেহ। ইহা দ্বারা তাঁহার কীর্তিমন্দিরগুলির অনেক অনিষ্টও হইয়াছে; লোকে ধনের লোভে ষাটগুম্বজ প্রভৃতি মজিদের নানাস্থানে ভিত্তিগাত্র ভাঙ্গিতে গিয়া মূলকীর্তির বিশেষ ক্ষতিসাধন করিয়াছে। অন্য উদ্দেশ্য না থাকিলেও, এই আশায় অনেক মজিদ খুঁড়িয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে। ষাটগুম্বুজের যে স্থানে তিনি একটি উচ্চ বেদীর উপর বসিয়া দরবারে কার্য্য নির্ব্বাহ করিতেন, তাহার পশ্চাদ্ভাগে প্রস্তরের আড়ালে যথেষ্ট অর্থ ছিল, এবং তাহা প্রাচীরগাত্র ভাঙ্গিয়া কোন ব্যক্তি আত্মসাৎ করিয়াছে, তাহার নিদর্শন এখনও আছে। এরূপ নিদর্শন বহু মজিদে পাওয়া যায়।
খাঁ জাহান আলী রাস্তা নির্মাণে বিশেষ সুদক্ষ ছিলেন। ইহার জন্য তাঁহার কোন কার্পণ্য ছিল না। পার্শ্ববর্ত্তী জমি হইতে যথেষ্ট উচ্চ করিয়া মাটী ফেলিয়া দীর্ঘপথ সৰ্ব্বত্র সমানভাবে প্রশস্ত করিয়া নির্ম্মাণ করা সহজ ব্যাপার নহে। স্বপ্রতিষ্ঠিত নগরীর শোভাবর্দ্ধন এবং তাঁহার নাগরিক প্রজাগণের সুবিধার জন্য তিনি খালিফাতাবাদে রাস্তাগুলি পাকা করিয়া প্রস্তুত করিয়াছিলেন। ৫০০ বৎসর পূর্ব্বে এমন পাকা রাস্তা নিম্নবঙ্গে কোথায়ও ছিল না। এই রাস্তা পাকা করিবারও তাঁহার একটা সুন্দর প্রণালী ছিল। তিনি আধুনিক প্রণালীর মত এক পরদা ইষ্টক পাতিয়া তাহার উপর খোয়া ফেলিয়া রাস্তা করিতেন না; হয়ত তিনি বুঝিতেন যে, সেরূপ রাস্তা দুই চারি বৎসর মেরামত না করিলে অব্যবহার্য্য হইয়া পড়ে। খাঞ্জালি ইটের আকার কিছু ছোট ছিল; উহা দৈৰ্ঘ্য প্রস্থে পাঁচ ছয় ইঞ্চি করিয়া এবং দুই ইঞ্চিরও কম পুরু ছিল। ইটগুলি এখনকার মত ফৰ্ম্মায় ফেলিয়া প্রস্তুত করা হইত না। খাঞ্জালি এই ইট অভগ্ন অবস্থায় লইয়া তাঁহার রাস্তা প্ৰস্তুত করাইয়াছিলেন। রাস্তাতে লম্বালম্বি পাঁচ সারি ইট থাকিত, প্রত্যেক সারিতে ২ খানি করিয়া ইট এবং সারিগুলি সমদূরবর্ত্তী ছিল। দুই একটি সারি মধ্যে চারি পাঁচখানি ইট এড়োএড়িভাবে বসান হইত। কোন ইটই ‘পট-গাথা’, অর্থাৎ চিৎ করিয়া লাগান হইত না; লম্বালম্বি এড়োএড়ি সব ইটগুলিই ‘খাদরী’ করিয়া অর্থাৎ পাশাপাশি কাত করিয়া বসান হইত। দুইটি লম্বা সারির মধ্যে প্রায় ২ ফুট বিস্তৃতি থাকিত। সাধারণতঃ খাঞ্জালীর পাকা রাস্তার বিস্তৃতি প্রায় ১০ ফুট। সহরের মধ্যে প্রধান প্রধান রাস্তা এবং এমন কি, চট্টগ্রামের দিকে যে রাস্তা গিয়াছে, তাহারও কতকদূর পৰ্য্যন্ত এই ভাবে পাকা করিয়া নির্ম্মাণ করা হইয়াছিল। প্রায় ৫০০ শত বৎসর এই সকল পাকা রাস্তার কোন প্রকার সংস্কার হয় নাই, তবুও ইহা ঠিক আছে। অবশ্য স্বার্থপর লোকের খনিত্র সর্ব্বক্ষেত্রেই পুরাকীর্ত্তি নষ্ট করিয়া দশজনের অপকার করে, এক্ষেত্রেও তাহা হইয়াছে। রাস্তার ইট লইয়া লোকে সামান্য সামান্য গৃহকার্য্যে লাগাইয়াছে; অনেক স্থলে উঁচুনীচু হইয়া পড়িয়াছে। তবুও খাঞ্জালির রাস্তা অন্য কোন গ্রাম্য রাজপথ অপেক্ষা কোন প্রকারে নিকৃষ্ট নহে।
শক্তিসম্পন্ন মুসলমানদিগের মধ্যে একটি সাধারণ নিয়ম আছে, তাঁহারা মৃত্যুর পূর্ব্বে স্বীয় স্বীয় সমাধিস্থান প্রস্তুত করিয়া যান। এই সকল সমাধিস্থান তাঁহাদের জীবদ্দশায় মজিদরূপে ব্যবহৃত হয় এবং মৃত্যুর পর উহার মধ্যে শবদেহ সমাহিত করিয়া তাহার উপর সমাধিবেদী নির্ম্মিত হয়। এমন কি, সমাধির উপর কোন্ পাথরখানি কিভাবে বসাইয়া বেদী গঠিত হইবে, কোন্ পাথরে কি কি লিপি উৎকীর্ণ থাকিবে, তাহাও সমস্ত ঠিক হইয়া থাকে। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হইয়া কর্মী পুরুষ কোরাণ হইতে নিজের পছন্দ মত স্থান উদ্ধৃত করিয়া এবং অনেক সময়ে স্বয়ং বা মৌলবী দ্বারা নিজের পছন্দ মত লিপিকথা রচনা করিয়া রাখিয়া যান। মৃতব্যক্তির অনুচরবর্গ সমাধি গঠন করিয়া নির্দ্দিষ্ট স্থলে মৃত্যুর তারিখটি মাত্র লিখিয়া রাখে। এই প্রণালীতে ইতিহাসের পক্ষে একটা অসুবিধা হয়, নিজের গুণের পরিচয় স্বয়ং কেহ স্পষ্ট করিয়া লিখে না এবং পরবর্ত্তী লোকের জন্যও সে সব লিখিবার স্থান পৰ্য্যন্ত থাকে না। এজন্য সমাধিলিপি পাঠ করিলে ধর্মগ্রন্থের উদাস নীতিকথা যথেষ্ট পাওয়া যায়, কিন্তু মৃতব্যক্তির পরিচয় বিষয়ে কেবল মাত্র তাঁহার নাম ও মৃত্যু তারিখের উপর নির্ভর করিতে হয়। খাঁ জাহান আলির বেলায়ও একথা বিশেষভাবে প্রযুক্ত হইতে পারে।
ষাটগুম্বজ হইতে ১ মাইল পূর্ব্বদিকে এবং বাগেরহাট হইতে ৩ মাইল পশ্চিমদিকে গেলে, একটি রাস্তা দক্ষিণমুখে গিয়াছে, দেখা যায়।[১] এই রাস্তার প্রায় অৰ্দ্ধ মাইল অতিক্রম করিয়া খাঁ জাহান আলির একটি প্রধান জলাশয়ের কূলে উপনীত হইতে হয়। এই দীঘির নাম ‘ঠাকুর দীঘি’। আমরা প্রসঙ্গতঃ পূর্ব্বে এই দীঘির কথা উল্লেখ করিয়াছি।[২] শিববাড়ীতে এখনও যে বুদ্ধ প্রতিমার পূজা হইতেছে, উহা এই দীঘির মধ্যে পাওয়া গিয়াছিল; বুদ্ধ ঠাকুর পাওয়া গিয়াছিল বলিয়াই এ দীঘির নাম ‘ঠাকুর দীঘি’ হয়। সম্ভবতঃ এস্থলে পুরাতন বৌদ্ধ আমলে একটি উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ পুষ্করিণী ছিল। কোন বিপ্লব বা পরজাতীয় আক্রমণের সময়ে বুদ্ধমূর্ত্তি সেই পুষ্করিণীর মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল। বৌদ্ধদিগের প্রতি হিন্দুর অত্যাচারবশতঃ এরূপ দুর্ঘটনা হওয়া বিচিত্র নহে। খাঁ জাহান আলি সেই প্রাচীন পুষ্করিণীর খাতে প্রকাণ্ড দীর্ঘিকা খনন করেন, তৎসম্বন্ধে যে সকল কিম্বদন্তী আছে, আমরা পূর্ব্বে তাহার আলোচনা করিয়াছি। এ দীর্ঘিকার দৈর্ঘ্য প্রস্থ প্রায় সমান, এক একদিকে প্রায় ১৬০০ ফুট হইবে। ইহার পাহাড়ের উপর এমন ভীষণ নিবিড় জঙ্গল হইয়াছে যে, তন্মধ্য দিয়া যাতায়াত করা বা জলাশয় পরিমাপ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। শুধু উত্তর পাহাড়টির কতকাংশ একটু পরিষ্কৃত আছে, কারণ সেখানে ৬০ ফুট প্রশস্ত এক প্রকাণ্ড বাঁধা ঘাট রহিয়াছে। ঐ ঘাটের উপর খাঁ জাহানের সমাধি-মন্দির।
জলাশয়ের উপরিভাগের অধিকাংশ দামদলে সমাকীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে বটে, কিন্তু তবুও জল অতি নির্মূল এবং সুস্বাদু; সেই স্ফটিকবৎ নিৰ্ম্মল সলিলের কূলে দণ্ডায়মান হইলে, কিছুদূর পর্য্যন্ত বিচরণশীল ক্ষুদ্র মৎস্যটি এবং এমন কি, তলভূমিস্থ শুভ্র বালুকাকণাগুলি সুস্পষ্ট দেখা যায়; আর মুখ উন্নত করিয়া দূরদৃষ্টি নিক্ষেপ করিলে, সেই বহুদূর বিস্তৃত বিশাল জলাশয় যে এক মহান্ দৃশ্য প্রকটিত করে এবং তাহার অমেয় গভীরতার যে সন্দিগ্ধ আভাস দেয়, তাহা বাস্তবিকই উপভোগের বিষয়। খাঁ জাহান সাধ করিয়া এই জলাশয়ে কালাপাড় ও ধলাপাড় নামক দুই কুমীর ছাড়িয়া দিয়াছিলেন; হয়ত এই কৃত্রিম জলাশয়কে স্বাভাবিক জলাশয়ের মত সর্ব্বপ্রকার জীবজন্তুতে পূর্ণ করিতে তাঁহার ইচ্ছা হইয়াছিল এবং মানুষের চিরশত্রুকে অভ্যাস দ্বারা অনপকারী করিয়া তুলিবার খেয়ালও এই ইচ্ছার অন্তর্ভুক্ত ছিল কিনা বলা যায় না। নদীর সহিত সংযোগবিশিষ্ট নিকটবর্ত্তী বিল হইতে কুমীর আসিয়া এই বিরাট দীঘিতে পড়াও আশ্চর্য্যের বিষয় নহে। হয়ত শেষে তাহাদিগকে খাদ্য দিয়া বশীভূত করিয়া খাঁ জাহান তাহাদের নামকরণ করিয়াছিলেন। যাহা হউক, খাঁ জাহানের সে কালাপাড়, ধলাপাড়, এখন আর নাই, তাহাদের পরে বহুপুরুষ পার হইয়াছে। কিন্তু সেই বীরপুরুষেরা নরমাংস-লোভ পরিহার করিয়াছিল বলিয়া তাহাদের বংশধরগণও সে গুণ পাইয়াছে। এখনও ঠাকুর দীঘিতে এবং ঘোড়া দীঘিতে কতকগুলি কুমীর আছে; তাহারা মানুষকে আক্রমণ করে না, তবে তাহাদের নিকট খাদ্যের দাবি করিবার জন্য স্নানের সময় নিকটবর্ত্তী স্থানে ভাসিয়া থাকে। কিন্তু বহুপুরুষের সংস্কার কি একেবারে যায়? বিশেষতঃ ইহারা মানুষের মাংস না পাইয়া পায়রা মুরগীর মাংস এবং মৎস্য খায় ত বটে। কয়েক বৎসর হইল, এক অশিক্ষিত দম্পতী প্ৰথম সন্তানটিকে পূর্ব্বের মানসা মত সির্ণী দিতে আসিয়া ভাবিলেন, কুমীরকে দেখাইয়া জলে ডুবাইয়া শিশুটিকে ফেরত লইতে পারিবেন, কিন্তু তাহা হইল না, হঠাৎ একটি কুমীর উহাকে ছোঁ মারিয়া লইয়া গেল আর ফেরত দিল না। খাঞ্জালি এখন একজন পীর। সে পীরের নিকট হিন্দু-মুসলমান সির্ণী মানসা করে; এবং কুমীরদিগকে খাওয়াইলে খাঞ্জালি পীরকে তুষ্ট করা হয়, এই বিশ্বাস পোষণ করে। কত লোক যখন তখন সির্ণী দিতে আসে। খই চিড়া, চিনি বাতাসা, মোরগ পায়রা— এমন কি, দুই এক হিন্দুতে পাঁঠা পৰ্য্যন্ত সির্ণী দেয়। এই সকল নৈবেদ্য দ্রব্য উৎসর্গ করিবার জন্য তাহারা দীঘির কূলে দাঁড়াইয়া কালাপাড় ধলাপাড়কে ‘আয় আয়’ বলিয়া ডাকে, তখন কালাপাড় ধলাপাড়ের বংশধরেরা ঘাটের পার্শ্বে চারিদিক্ হইতে মাথা উঁচু করিয়া ভাসিতে থাকে এবং খাদ্যদ্রব্য নিক্ষেপ করিলে অনেক সময় সিঁড়ির উপর আসিয়াও উহা লইয়া যায়। মৎস্যে খায়, কুমীরে খায়, তাহাতেই জীবভক্ত কীৰ্ত্তিমান খাঁ জাহানের পারলৌকিক তুষ্টি সাধন হয়। প্রতি বৎসর চৈত্রমাসে ঠাকুর দীঘির কূলে একটি প্রকাণ্ড খাঞ্জালি মেলা হইয়া থাকে, বহু দূরবর্ত্তী স্থানের হিন্দু-মুসলমান এ মেলায় আসিয়া থাকে। যিনি সকল জাতিকে ভালবাসেন, তিনি সৰ্ব্বজনপ্রিয় হইয়া থাকেন।
প্রবাদ আছে, মৃত্যুর কয়েক বৎসর পূর্ব্বে খাঁ জাহান ভগবানের নিকট কোথায় তিনি দেহত্যাগ করিবেন, সে স্থান নির্দ্দেশ করিয়া দিবার জন্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রার্থনা অনুসারে ভগবান্ স্থান নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন। সেই স্থানেই তিনি উক্ত দীঘি খনন ও তাহার উত্তর তীরে স্বীয় সমাধি মন্দির স্থাপন করেন। হিন্দুর মত মুসলমানেরাও শবদেহ উত্তরশিয়রে রাখে এবং কবরের মধ্যেও সেই ভাবে সমাহিত করে। এজন্য হিন্দু-মন্দিরের মত মুসলমানের সমাধি-মন্দির দক্ষিণদ্বারী হইয়া থাকে। ঠাকুর দীঘির ঘাট হইতে উপরে উঠিলে একটি বেষ্টন-প্রাচীরের ভিতর সুন্দর একটি একগম্বুজ ইমারত দেখা যায়, উহারই মধ্যে খাঁ জাহান চিরনিদ্রায় অভিভূত। উক্ত বেষ্টন-প্রাচীরের বাহিরেও আর একটি প্রাচীর ছিল এবং নগর হইতে সমাধিস্থানে আসিতে হইলে সেই বহিঃপ্রাচীরের তোরণদ্বার দিয়া প্রবেশ করিতে হইত। এখন সে দ্বার ও প্রাচীর ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে।
সমাধি-মন্দির সমচতুষ্কোণ; উহার বাহিরের মাপ ৪৬x৪৬ ফুট। উহার চারিকোণে চারিটি স্তম্ভ দেওয়ালের সঙ্গে গ্রথিত রহিয়াছে। উহারা মিনারের মত উচ্চ হইয়া উঠে নাই। খাঁ জাহান নিশ্চিতই জানিতেন, লবণাক্ত দেশে কোন অট্টালিকায় মৃত্তিকা হইতে ৩/৪ ফুট পর্যন্ত লোণা ধরে; ঐ অংশে ভাল ইট দিলেও তাহা অল্পবিস্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হইতে থাকে। এইজন্য খাঁ জাহান তাঁহার সমাধি-মন্দিরকে চিরস্থায়ী করিবার নিমিত্ত, উহাতে মৃত্তিকা হইতে তিন ফুট উপর পর্য্যন্ত সমস্ত অংশ প্রস্তরদ্বারা গাঁথাইয়াছিলেন। এই সকল পাথর তিনি চট্টগ্রাম হইতে আনাইতেন। প্রস্তরগুলি সাধারণতঃ প্রায় ২ ফুট দীর্ঘ, ১ ফুট প্রস্থ, এবং ৯ ইঞ্চি পুরু দেখা যায়। গৃহটির দেওয়ালের ভিত্তি ৮ ́-৩ ́ ́ ইঞ্চি। ইহার বাহিরের দেওয়াল চতুষ্কোণ বটে, কিন্তু ভিতরের দেওয়াল অষ্টকোণ। এই অষ্টকোণ দেওয়াল ২৪ ফুট উচ্চ হইয়া সেখান হইতে একটি গোলাকার গুম্বজ নির্ম্মিত হইয়াছিল। গুম্বুজের উপরিভাগে নানাবিধ কারুকার্য্য করা ছিল। এখন কারুকার্য্য নাই। তবে গুম্বুজের উপর জমাট এত শক্ত ও সুন্দর যে, এ পর্যন্ত এক প্রকার বিনা মেরামতে এই সমাধি-গৃহ এখনও সুন্দর অবস্থায় আছে। গৃহটির মেজে পূর্ব্বে ‘মীনা’ করা ইটে মণ্ডিত ছিল, এখন তাহার চিহ্ন আছে, ইটগুলি অপহৃত হইয়াছে।
সমাধি-মন্দিরের দক্ষিণে, পূর্ব্বে ও পশ্চিমে তিনটি দরজা। উত্তরদিকে কোন দরজা নাই। দরজাগুলি ৬ ́-১০ ́ ́ বিস্তৃত। উহাদের উপর পাথর ছিল, পাথরের গায়ে সম্ভবতঃ এক একখানি করিয়া লোহাও ছিল। তাহা নষ্ট হইয়া যাওয়ায় গবর্ণমেণ্ট হইতে এক একটি ৪ ́ ́×২ ́ ́ লোহার কড়ি বসাইয়া দেওয়া হইয়াছে। গৃহের মধ্যস্থলে খাঁ জাহানের সমাধিমঞ্চ। প্রথমে মেজের উপর একটি ইষ্টকবেদী। এ বেদীটিও মীনা করা টালি (tile) দ্বারা আবৃত ছিল; এখন টালিগুলি নাই। এই ইষ্টকবেদীর উপর প্রথমতঃ একটি তাক ৬ খানি বড় বড় কৃষ্ণপ্রস্তর দ্বারা গঠিত; তাহার উপর আর একটি পাথরের তাক, তাহাও ঐরূপ ৪ খানি কৃষ্ণপ্রস্তরে নির্ম্মিত। সর্ব্বোপরি একখানি অর্দ্ধগোলাকৃতি ৬ ফুট দীর্ঘ সুন্দর কৃষ্ণপ্রস্তর। এই শীর্ষ প্রস্তরখানি ও তাহার নিম্নবর্ত্তী দুই স্তরের প্রস্তরগুলি সকলই আরবী ও পারসীক লিপিতে সম্পূর্ণ সমাবৃত ছিল। লিপিগুলি খোদিত নহে; সকলগুলি সুন্দরভাবে সযত্নে উৎকীর্ণ। এই লিপি ভাস্কর্য্যে যে যথেষ্ট সময় ও শ্রমকৌশল লাগিয়াছিল, তাহাতে দ্বিমত নাই। আমরা ভাষান্তরিত করিয়া ক্রমে ক্রমে ঐ লিপিগুলির সারমর্ম্ম প্রদান করিতেছি।[৩]
সমাধিবেদীর শীর্ষপ্রস্তরের উত্তরগাত্রে মুসলমান-ধর্ম্মের সেই চিরপ্রসিদ্ধ সার মত উৎকীর্ণ আছে : ‘ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়; মহম্মদ তাঁহার রসুল (ধর্ম্মোপদেশক) বা প্রতিনিধি।’ ঐ অর্দ্ধগোলাকৃতি প্রস্তরের উপরিভাগে প্রথম দুই লাইনে আছে : ‘হে ভগবান্! আমাকে সয়তানের প্রলোভন হইতে রক্ষা কর; আমি তোমার দয়ার্দ্র, করুণাময় নামে আরম্ভ করিতেছি।’ ইহারই নিম্নে উপরিভাগের অধিকাংশ স্থান ১০৪টি চতুষ্কোণক্ষেত্র দ্বারা পূর্ণ। উহার প্রথম ৫টি চতুষ্কোণের মধ্যে আছে : ‘ঈশ্বর, একমাত্র অদ্বিতীয় ঈশ্বর, যিনি’—ইহারই উপর অবশিষ্ট ৯৯টি চতুষ্কোণের মধ্যে ভগবানের গুণানুকীৰ্ত্তন করিবার উদ্দেশ্যে এক একটি বিশেষণ শব্দ লিখিত রহিয়াছে। উহার সবগুলি এখানে অনূদিত করিবার প্রয়োজন নাই; কতকগুলি দৃষ্টান্ত দিতেছি : ‘রাজা, রাজরাজেশ্বর, সত্য, নিত্য, অনন্ত, অমূল্য, অতুল্য, আদি, অন্ত, প্রকাশিত, জাগ্রত, গুপ্ত, লুপ্ত, রক্ষক, শাসক, পালক, স্রষ্টা, নির্মাতা, শ্রোতা, দর্শক, সৰ্ব্বব্যাপক, জ্ঞানী, ন্যায়বান, বিচারক, বিবেচক, দয়ালু, ক্ষমাশীল, পথের আলো, পথিকের সঙ্গী প্রভৃতি। এই ৯৯টি বিশেষণের নিম্নে লেখা আছে : ‘ঈশ্বরের তুলনা নাই; তিনি দ্রষ্টা ও শ্রোতা; তিনি (সকলের) তুষ্টিসম্পাদন করেন; তিনি সৰ্ব্বপ্রধান প্রভু, শ্রেষ্ঠ সহায়ক।’ অৰ্দ্ধগোলাকৃতি পাথরের দক্ষিণের দিকে আরবীয় ভাষায় আছে : ‘প্রধান পুরুষ, খাঁ জাহান আলির এই সমাধি স্বর্গীয় কাননের অংশবিশেষ। ভগবান্ তাঁহার প্রতি কৃপালু হউন। ৮৬৩ হিজরীর ২৬শে জেলহজ্জ তারিখ।
শীর্ষপ্রস্তরের নিম্নবর্ত্তী প্রস্তরের তাকের উপরিভাগে চারিধার ঘুরাইয়া লেখা আছে :
‘লুব্ধ লিপ্সা মমতায় ভুলি ভগবান্,
সংসারচিন্তায় তুমি রয়েছ মগন;
সময় আসিবে যবে একথা ভাবিবে,
মৃত্যু সন্নিহিত হলে এ চিন্তা জাগিবে;
আছয়ে নরক, তাহা ত্বরায় জানিবে,
নরক দর্শনে শেষে কষ্ট উপজিবে;
তোমার কাজেতে হবে তোমার বিচার
তাহাতে সন্দেহ নাই কিছু মাত্র আর।’
এই প্রস্তরপীঠের পূর্ব্বপার্শ্বে নিম্নলিখিত উপাসনা লিপিগত আছে : ‘হে জাগ্ৰত ভগবান্। তুমি অনন্ত, তুমি পাপীর আর্তনাদে কর্ণপাত করিয়া থাক; তুমি গৌরবময়, পবিত্র; তুমি রাজরাজেশ্বর, তুমি ক্ষমাশীল, তুমি চৈতন্যস্বরূপ; তুমি স্রষ্টা, তুমি স্বর্গমর্ত্যের গঠনকর্তা; আমাকে নরক হইতে নিস্তার কর।
এই প্রস্তরপীঠের পশ্চিমপার্শ্বে আছে : ‘হে অবিশ্বাসিগণ! তোমরা যাঁহাকে পূজা করিবে, আমি তাঁহাকে পূজা করিব না; আমি যাঁহাকে পূজা করিব, তোমরা তাঁহাকে পুজা করিবে না; তোমরা যাঁহাকে পূজা কর, আমি তাঁহার পূজা করি না; আমি যাহার পূজা করি, তোমরা তাঁহার পূজা কর না; তোমাদের ধর্ম্ম তোমাদের আছে এবং আমার ধর্ম্ম আমার আছে।
এই প্রস্তরপীঠের দক্ষিণপার্শ্বের মধ্যস্থলে একটি চতুষ্কোণ এবং তন্মধ্যে একটি বৃত্ত অঙ্কিত আছে। চতুষ্কোণের চারিকোণে আরবীয় ভাষায় আছে :
কে মরিল— জনৈক প্রবাসী :
তিনি মরিলেন— (ধর্ম্মের জন্য) আত্মোৎসর্গ করিয়া।
বৃত্তটির মধ্যেও আরবীর ভাষায় লিখিত আছে : ‘যিনি ঈশ্বরের দাসানুদাস, যিনি বৃদ্ধ, দুৰ্ব্বল ও কৃপাভিখারী, যিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধির (মহম্মদের) বংশধরগণের আত্মীয়, যিনি সুধীবর্গের প্রকৃত বন্ধু এবং অবিশ্বাসীর শত্রু, যিনি মুসলমানের সহায় এবং ইসলাম ধর্ম্মের পৃষ্ঠপোষক, তিনি দেহত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহার নাম আলঘ খাঁ জাহান। (ভগবান তাঁহার প্রতি কৃপাযুক্ত হউন)। তিনি উর্দ্ধতন (স্বর্গ) লোকের আশায় ৮৬৩ হিজরীর ২৬শে জেলহজ্জ বুধবারে এ জগৎ ত্যাগ করিয়াছেন এবং ২৭শে জেলহজ্জ তাঁহাকে সমাহিত করা হয়।’
ইংরাজী গণনানুসারে খাঁ জাহানের মৃত্যুতারিখ ১৪৫৯ খৃষ্টাব্দের ২৩শে অক্টোবর হইবে। খাঁ জাহান যে অত্যন্ত অধিক বয়সে জরাজীর্ণ দুর্ব্বল দেহে প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন, তাহা তাঁহার এই প্রাণস্পর্শী স্বরচিত মৰ্ম্মগাথা হইতে বেশ বুঝিতে পারা যায়। তিনি নিজের লিপি নিজেই লিখিয়া গিয়াছিলেন, তারিখটি মাত্র অন্যলোক পরে বসাইয়া দিয়াছিল। সমস্ত না থাকিলে একদিনের মধ্যে প্রস্তরনির্ম্মিত সমাধিমঞ্চ নির্ম্মাণ করা যায় না।
দুইটি পাথরের স্তরের উপর একখানি শীর্ষপ্রস্তর দিয়া খাঁ জাহানের সমাধি নির্ম্মিত হয়। উহার উপরিস্থ পাথরের স্তরের উপরিভাগে বা পার্শ্বদেশে যে সমস্ত লিপি আছে, আমরা তাহার কথা বলিয়াছি। নিম্নবর্ত্তী প্রস্তরপীঠেও এরূপ অনেক লিপি আছে। উহার অনেকগুলি একরূপ অস্পষ্ট বলিয়া এখনও পাঠোদ্ধার হয় নাই। সাণ্ডার্স সাহেব সেগুলিকে কোরাণ হইতে উদ্ধৃত পবিত্র ধৰ্ম্মগাথা বলিয়া অনুমান করিয়াছেন। কিন্তু এই নিম্নস্থ পাদপীঠেই দক্ষিণদিকে কয়েকটি সুন্দর তত্ত্ববাণী আছে। উহার কতক আরবীয়, কতক পারসীক ভাষায় লিখিত। আমরা কবিতায় উহার যথাযথ অনুবাদ প্রদান করিলাম :
‘জগতে ক্রন্দন লয়ে খুলি এ জীবন,
কত বা যাতনা কষ্ট করে আক্রমণ!
পরীক্ষার নাহি পার জীবন ভরিয়া,
(কিন্তু) সব শেষ করে শেষে মরণ আসিয়া।
মৃত্যুই নিশ্চিত, ভাই, মৃত্যুই নিশ্চয়,-–
জীবন-উদ্যানে তীক্ষ্ণ কণ্টকের ন্যায়,
মরণ নিশ্চয়, ভাই, মরণ নিশ্চয়।
জীবনের হেন অরি নাহি কেহ আর,
অন্য শত্রু হতে এর প্রভেদ বিস্তর,
দুষ্ট সয়তান আছে অরাতি তোমার,
টলাতে বিশ্বাস তব চেষ্টা সদা তার;
সকল সমাজে দেখি এই রীতি আছে—
দুৰ্ব্বল লভয়ে ক্ষমা সবলের কাছে;
ক্ষমা নাই— দয়া নাই— মৃত্যু দুর্নিবার,
মরণ নিশ্চিত, ভাই, আছয়ে সবার।’
জীবন্মুক্ত পুরুষের মত দীর্ঘ জীবন যাপন করিয়া ভক্ত সাধু যে উদাসপ্রাণে দেহত্যাগ করিয়াছিলেন, তাঁহার সমাধি-বেদীর নানা লিপিতে সেই উদাস ভাবের অভিব্যক্তি রহিয়াছে তাঁহার কীর্ত্তির সহিত তাঁহার এই মৃত্যুনীতির মিলন করিয়া বহু দর্শক তাঁহার সমাধি গাত্র হইতে উপদেশ সংগ্রহ করিতে পারেন।
খাঁ জাহানের সমাধিমন্দির হইতে পশ্চিমের দরজা দিয়া বাহির হইলেই পীর আলি মহম্মদ তাহেরের সমাধি। ইঁনি খাঁ জাহানের উজীর বা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পীরালি ব্রাহ্মণের ইতিবৃত্তে ইঁহার বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। মহম্মদ তাহের এখানে মারা যান নাই; এখানে মাত্র তাঁহার একটি শূন্যগর্ভ সমাধিবেদী গাঁথা রহিয়াছে। খাঁ জাহানের সমাধির মত উহার উপরে কয়েকটি লিপি আছে; আর আছে : ‘এই স্থান স্বর্গীয় কাননের অংশবিশেষ এবং ইহা এক বিশেষ বন্ধুর সমাধি, তাঁহার নাম মহম্মদ তাহের, তারিখ ৮৬৩ জেলহজ্জ।’ বন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন রাখা কর্ত্তব্য, এই বুদ্ধিতে খাঁ জাহান মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব্বে সেই একই জেলহজ্জ মাসে মহম্মদ তাহেরের জন্য এই স্মৃতিস্তম্ভ গঠিত করিয়া রাখিয়া যান। সমাধির উপরিভাগটি প্রায় খাঁ জাহানের সমাধির ন্যায়, তবে ইহার ভিতরে কিছু নাই, একটি সিঁড়ি দিয়া তন্মধ্যে অবতরণ করা যায়।
পীর আলির সমাধি পার হইলেই মধ্যবর্তী বেষ্টনপ্রাচীর শেষ হইল। তাহার বাহিরে একটি প্রকাণ্ড এক-গুম্বজ ইষ্টকগৃহ আছে; উহাকে বাবুর্চিখানা বা রন্ধনশালা বলা হয়। খাঁ জাহান শেষ জীবনে যখন সমাধিমন্দিরে বাস করিতেন, তখন তিনি প্রত্যহ অসংখ্য দীন দুঃখী বন্ধুবান্ধবকে ভোজন করাইতেন। উহাদের জন্য অন্নব্যঞ্জনাদি বহুসংখ্যক বাবুর্চি এই গৃহের মধ্যে প্রস্তুত করিত। ইহা এখনও ভাল অবস্থায় দণ্ডায়মান রহিয়াছে। ইহার বাহিরের মাপ ৪০x৪০ফুট; ভিতরের মাপ ২৬×২৬ ফুট, ভিত্তি ৭ ফুট। গৃহটির পশ্চিমে কোন দরজা নাই; উত্তর ও দক্ষিণে একটি করিয়া দরজা আছে এবং পূৰ্ব্বদিকে আছে তিনটি, উহার মধ্যে পার্শ্ববর্ত্তী দুইটির প্রত্যেকের বিস্তার ৩ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং মধ্যবর্তী বড় দরজাটির বিস্তার ৬ ফুট; উত্তর ও দক্ষিণের দরজার প্রত্যেকের বিস্তার ৪ফুট ১০ ইঞ্চি। গুম্বুজের উচ্চতা প্রায় ৩৬ ফুট।
বাবুর্চিখানা হইতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঠাকুরদীঘির উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি মসজিদ আছে, উহাকে জেন্দাপীরের মসজিদ বলে। এই জেন্দাপীর খাঁ জাহানের একজন প্রিয় অনুচর এবং বিখ্যাত বুজরুক ছিলেন। খাঁ জাহান নিজে যেমন অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন, তেমনি অন্য কোন ফকিরকে সেইরূপ বুজরুকীতে পারদর্শী দেখিলে, তাহাকে আনিয়াও নিজের দলভুক্ত করিয়া লইতেন। প্রবাদ আছে, তিনি চাঁদ খাঁ, বাঘ খাঁ নামক অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন দুই ভ্রাতাকে ফরিদপুর হইতে আনাইয়া খালিফাতাবাদের নিকটবর্ত্তী ধোপাখালি গ্রামে বসতি করাইয়া ছিলেন। জেন্দাপীরও এইরূপ একজন প্রিয় সদস্য। জেন্দাপীর তাঁহার নাম নহে, ইহা একটি উপাধি মাত্র। এই ফকিরের প্রকৃত নাম কি ছিল, জানিবার উপায় নাই। শ্রীহট্টে শাহ জালালের সঙ্গী শিষ্যগণের মধ্যেও এক জেন্দাপীর ছিলেন, দেখিতে পাই; শ্রীহট্টে জিন্দা-বাজার ইঁহারই নামে স্থাপিত। খাঁ জাহানের জেন্দাপীর সম্বন্ধে অনেক অলৌকিক গল্প আছে; তন্মধ্যে একটি এখানে দেওয়া যাইতেছে। কথিত হয়, জেন্দাপীর এমনই ধৰ্ম্মনিষ্ঠ ছিলেন যে প্রতিরাত্রিতে নমাজের পর তিনি ঈশ্বরানুগ্রহে সহস্র সুবর্ণমুদ্রা পাইতেন এবং প্রত্যহ প্রাতে গাত্রোত্থান করিয়া তিনি এই সমস্ত অর্থ পুণ্যকর্ম্মে ব্যয়িত করিতেন; সঞ্চয়ার্থ কিছুই রাখিতেন না। একদিন তাঁহার স্ত্রী ঐ অর্থ হইতে কিছু সঞ্চয় করিয়াছিলেন, তাহার পর হইতে সেরূপ ঈশ্বরদত্ত অর্থপ্রাপ্তি বন্ধ হইয়া গেল। তাহার কয়েকদিন পরেই পীরসাহেব একখানি কোরাণ হাতে লইয়া, উহা পাঠ করিতে করিতে কবরে প্রবেশ করেন, আর উঠেন নাই। জনশ্রুতি এইরূপ যে, অদ্যাবধিও তিনি সেই কবরমধ্যে কোরাণ পাঠে নিরত আছেন; নিষ্ঠাবান মুসলমানগণ সে পাঠধ্বনি শুনিতে পান।
যে সকল কীর্তিচিহ্নের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে দেওয়া গেল, তাহা ব্যতীত আর শত শত চিহ্ন সমস্ত খালিফাতাবাদে যেখানে সেখানে পড়িয়া আছে। সে সকলেরও প্রকৃত ঐতিহাসিক অনুসন্ধান হয় নাই। যেখানে এক্ষণে বাগেরহাট সহর, সেখানে খাঞ্জালির বাগান ছিল; উত্তরকালে সেই বাগানে যে হাট বসিয়াছিল, তাহাই বাগেরহাট নামে অভিহিত হয়। বাগেরহাট নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে আরও অনেক অনুমান আছে। যথাস্থানে তাহা বিবৃত হইবে। পূৰ্ব্ব-পশ্চিমে ৫ মাইল এবং উত্তর- দক্ষিণে প্রায় ৪ মাইল, এই বিস্তৃত স্থান লইয়া প্রাচীন খালিফাতাবাদ সহর হইয়াছিল; সহরকে হাবেলী কাও বলিত। খালিফাতাবাদ বহু বিস্তৃত পরগণা ছিল। খালিফাতাবাদ সহর এক্ষণে বাগেরহাট, দশানি, কৃষ্ণনগর, বাসাবাটী, কাড়াপাড়া, রণবিজয়পুর, কাঁটাল, কাঁটালতলা, বাদামতলা, সুন্দরের ঘোনা, বারাকপুর, মগরা প্রভৃতি বহুসংখ্যক গ্রামে বিভক্ত হইয়াছে।
খাঁ জাহান প্রথম জীবনে যেরূপ এক প্রকার স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করিয়াছিলেন, শেষভাগে বোধ হয় তাহা ছিল না। তখন সম্ভবতঃ বঙ্গেশ্বর মামুদ শাহের সহিত তিনি সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হইয়াছিলেন; বঙ্গীয় সুলতানের প্রতিনিধিস্বরূপ তিনি রাজ্যস্থাপন করিয়া তাহার নাম রাখিয়াছিলেন, খালিফাতাবাদ অর্থাৎ খালিফা বা প্রতিনিধির সংস্থাপিত নবোত্থিত রাজ্য। খাঁ জাহান প্রকাশ্যভাবে স্বাধীন হইয়া যে রাজ্যশাসন করেন নাই, তাহার কয়েকটি প্রমাণ আছে। প্রথমতঃ, তিনি নিজ নামে কোন মুদ্রা অঙ্কিত করেন নাই। দ্বিতীয়তঃ, ঢাকায় একটি মসজিদের দ্বারদেশে যে খাঁ জাহানের নামাঙ্কিত লিপি পাওয়া গিয়াছিল, তাহাতে তিনি এবং খালিফাতাবাদের খাঁ জাহান অভিন্ন ব্যক্তি বলিয়া স্থির হইয়াছে। সে লিপির মর্মার্থ এই যে, উক্ত মসজিদ মামুদ শহের রাজত্বকালে খাঁ জাহান নামধেয় এক খাঁ কর্তৃক নির্ম্মিত হইয়াছিল। উহাতে যে তারিখ আছে, তাহা ১৪৫৯ খৃষ্টাব্দের ১৩ জুন বলিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে। এখানে দেখা যাইতেছে খাঁ জাহান বঙ্গেশ্বর মামুদ শাহের নামোল্লেখ করিয়াছেন, সুতরাং তিনি তাঁহার বিরুদ্ধাচারী ছিলেন বলিয়া মনে হয় না। তৃতীয়তঃ, নাসির উদ্দীন মহম্মদ শাহের ৪৮৫ হিজরী বা ১৪৫৪ খৃষ্টাব্দে অঙ্কিত একটি মুদ্রায় প্রথম আমরা মধুমতীর কূলবর্তী মামুদাবাদের উল্লেখ পাই। সুতরাং মামুদ শাহই উক্ত মামুদাবাদ প্রতিষ্ঠিত করেন, ইহা অনুমিত হইতে পারে।[৫] সুতরাং এতদঞ্চলে মামুদ শাহের রাজ্য ছিল। চতুর্থতঃ, মামুদ শাহের পর তৎপুত্র বার্ব্বাক শাহ বঙ্গেশ্বর হন। সুন্দরবনের মধ্যে বরিশালের অন্তর্গত পটুয়াখালি সবডিভিসনে মজিদবাড়ী নামক স্থানে একটি প্রাচীন ইষ্টকনির্ম্মিত মসজিদ আছে। উহাতে যে একখানি পারস্যলিপি ছিল, তাহা এক্ষণে এসিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত হইয়াছে। ঐ লিপির মর্ম্ম এই : ‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলিয়াছেন, যিনি একটি মসজিদ নির্ম্মাণ করিবেন ঈশ্বর তাঁহার জন্য ৭০টি রাজপ্রাসাদ নির্ম্মাণ করিয়া দিবেন। এই মজিদ সুলতান মামুদ শাহের পুত্র, ধর্ম্ম ও রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ আবুল মুজঃফর বার্ব্বাক শাহের রাজত্বকালে, ৪৭০ হিজরীতে (১৪৬৫ খৃষ্টাব্দ), মুয়াজ্জম উজিল খাঁ দ্বারা নিৰ্ম্মিত হয়।[৬] সুতরাং খালিফাতাবাদের পূর্বাঞ্চলও যে বাৰ্ব্বাক শাহের শাসনাধীন ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। খাঁ জাহানের মৃত্যুর পর, খালিফাতাবাদ রাজ্য খাঁ জাহানের কোন সুযোগ্য অনুচরের হস্তে শাসনার্থ প্রদত্ত হইয়াছিল। তাঁহার অনুচরবর্গের মধ্যে অনেকে বহুদিন পৰ্য্যন্ত জীবিত থাকিয়া তাঁহার প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন। এখন পর্য্যন্ত ফকিরেরা বংশানুক্রমে খাঁ জাহানের সমাধিগৃহের তত্ত্বাবধান করিতেছেন এবং তজ্জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ভূমিবৃত্তি ভোগদখল করিতেছেন।
পাদটীকা :
১. অপর দিকে এই সুদীর্ঘ রাস্তাটি পশরনদীর কূলবর্ত্তী কুড়লতলা পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত। উচ্চ রাস্তাটির প্রশস্ততা সর্ব্বত্রই ৪০ ফুটের অধিক।
২. দ্বিতীয় অংশ : বৌদ্ধ সংঘারাম কোথায় ছিল-; এর ১৫নং স্তবক থেকে শেষ পর্যন্ত দ্রষ্টব্য।
৩. মহামতি ওয়েষ্টল্যাণ্ড সকৃত রিপোর্টে কতকগুলি লিপির মূল ও ইংরাজী অনুবাদ দিয়াছেন। Westland. Report, 1871. P. 28; Basak, G. D. Antiquities of Bagerhat. J. A. S. B. Vol. 36, 1867-8; Sunder, D. H. E. Antiquities of Bagerhat.
৪. H. Blochmann. Notes on Arabic and Persian Inscriptions-J. A. S. B., 1872. Part 1, PP. 107-8.
৫. Indian Museum Catalogue. Vol. II. P. 164; Jessore Gazetteer, P. 25.
৬. J. A. S. B., 1860, Vol. IV, P. 406; Beveridge, History of Bakarganj P. 39.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন