সতীশচন্দ্র মিত্র
সুন্দরবন চিরকালই সমতট বা গাঙ্গোপদ্বীপের বর্ম্মস্বরূপ। শতমুখী গঙ্গা ভূমিগঠন করিতে করিতে উপদ্বীপ সীমা যতই দক্ষিণদিকে সরাইয়া লইতেছেন, সুন্দরবনও তত দক্ষিণে সরিযা যাইতেছে। কতই পরিবর্তন হইতেছে, কিন্তু সুন্দরবনের সেই দেশরক্ষা কার্য্যের পরিবর্তন হয় নাই। দেশের জলবায়ু এবং ক্ষেত্রের উর্ব্বরতার উপর বনভাগের বিশেষ আধিপত্য আছে। জলই বনের প্রাণ; এজন্য বনভাগ স্বভাবতঃ সর্ব্বত্রই মৃত্তিকার নিম্নে বর্ষার জল সঞ্চয় করিয়া রাখে এবং বনবৃক্ষসমূহ সেই সঞ্চিত জল হইতে উৎপন্ন রসাংশ পত্রসমূহের ভিতর দিয়া বায়ুতে সঞ্চারিত করিয়া দেয়। ইহা দ্বারা আকাশের বায়ু-শৈত্য রক্ষিত হয়। বসন্তাগমে বনভূমিতে যে পত্রপ্রাচুর্য্য দেখা যায়, তদ্বারা পরবর্ত্তী গ্রীষ্মের কঠোরতা কমাইয়া দিয়া থাকে। এবং দেখা গিয়াছে যেখানে গাছের পাতা সরস থাকে, সেখানে গ্রীষ্মের গরম কষ্টদায়ক হয় না। যেখানে জঙ্গল নাই, সেখানে অতিবৃষ্টিতে ভীষণ অনিষ্ট উৎপাদন করে। বৃক্ষহীন উলঙ্গপ্রদেশ ভাসিয়া যায়; সেখানকার মৃত্তিকা যথেষ্ট জলগ্রহণ করিতে পারে না; অথচ সে জল-প্রবাহ দূরবর্তী স্থানে গিয়া প্লাবনের সৃষ্টি করে। মৃত্তিকামধ্যে জলাংশ এবং বায়ুস্তরে জলীয় বাষ্প কমিয়া যাওয়ায় আবশ্যক শস্যাদির সমধিক ক্ষতি হয়। এজন্য পাশ্চাত্য সভ্যদেশে অতিবৃষ্টির অনিষ্ট নিবারণ জন্য কৃত্রিম চেষ্টায় জঙ্গল প্রস্তুত করা হইয়া থাকে। দক্ষিণ বঙ্গে কিন্তু জঙ্গলের আধিক্যে স্বভাবতঃ সে অনিষ্টের সম্ভাবনা নাই। এইরূপে স্বভাবের জল নিষ্কাশন ব্যবস্থার মধ্যে জঙ্গলের অস্তিত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জঙ্গলে যেরূপ নিজ দেহের শৈত্য হইতে বায়ুস্তরের জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি করিতে করিতে মেঘেরও অঙ্গপুষ্টি করিয়া থাকে, মেঘ প্রস্তুত হইয়া সঞ্চালিত হইলে, জঙ্গলে আবার তাহাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করিয়া, উহার দূরে যাইবার পথে অন্তরায় হয়। বঙ্গের দক্ষিণে সাগরকূলে যদি বিশাল অরণ্য না থাকিত, তাহা হইতে। বঙ্গোপসাগরের মেঘসমূহ উত্তর মুখে দূরে চলিয়া গিয়া হিমালয়ের উপত্যকায় বারিবর্ষণ করিত; তখন দক্ষিণ বঙ্গ বালুকা প্রান্তরে পরিণত হইয়া একপ্রকার মানুষের বাসের অযোগ্য হইয়া পড়িত। এখন যেমন ভাটিরাজ্যের উত্তর হইতে দক্ষিণদিকে অগ্রসর হইতে লাগিলে, প্রথমে পদ্মার প্রবল প্রবাহ, পরে নদীমাতৃক উচ্চদেশে মানুষের বসতি, তাহার পরে মানুষের খাদ্যের জন্য নিম্নতল উর্ব্বর ক্ষেত্রে ধানের প্রাচুর্য্য এবং সর্ব্বশেষে দুর্ভেদ্য প্রাকারের মত সুন্দরবনের এই নিবিড় জঙ্গলশ্রেণী—এমন দৃশ্য আর দেখা যাইত না।
জঙ্গলের জন্য আরও অনেক বিপদ হইতে দেশ রক্ষা হইতেছে। সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস একান্ত প্রবল হইলেও সম্পূর্ণভাবে দেশ ভাসাইতে পারে না; সমুদ্রের ঝটিকাবর্ত বা বায়ুপ্রবাহ বসতিস্থানসমূহ উৎখাত করিতে পারে না। পুরী প্রভৃতি স্থানে সমুদ্রের বায়ুপ্রবাহ বা বালুকাময় আবর্ত্ত হইতে সহর রক্ষা করিবার জন্য কর্তৃপক্ষকে অসংখ্য ঝাউগাছ দিয়া সমুদ্রোপকূল ঢাকিয়া রাখিতে হইয়াছে। অনেক সভ্যদেশে আজকাল এইরূপ কৃত্রিম ব্যবস্থায় জঙ্গল প্রস্তুত করিবার প্রথা প্রবর্ত্তিত হইয়াছে। এক সময়ে সমস্ত সুন্দরবনের জঙ্গল নির্মূল করিয়া সমস্ত স্থান আবাদ করিবার কল্পনা চলিতেছিল; অনেক বিষয় ভাবিয়া পরে সে প্রস্তাবনা স্থগিত করা হইয়াছিল। যথাস্থানে তাহার আলোচনা করা যাইবে। জঙ্গল রক্ষা করিবার অনুকূলে যে সমস্ত কারণ আছে, উপরোক্ত কয়েকটি কথাও তাহার অন্তর্ভুক্ত।
সুন্দরবন আবাদ করিবার কল্পনা করিলেই যে তাহা কার্য্যে পরিণত করা যায়, তাহা নহে। এ জঙ্গলের জমি নিজে না উঠিলে তাহাকে উঠান যায় না। যে স্থানে জমি নিম্ন থাকে, সেখানে তাহার প্রকৃতিই এইরূপ যে শত চেষ্টা করিয়াও তাহার জঙ্গল ধ্বংস করা যায় না। জঙ্গল কাটিলে আবার হয়, জঙ্গলের বীজ মাটীর সঙ্গে মিশিয়া থাকে, জলপ্রবাহ ও পলির সঞ্চয় তাহার সাহায্য করে। ক্রমে যখন আপনার হইতে জমি উন্নত হইতে থাকে, অমনি জঙ্গল আপনি কমিয়া আসে; তখন মানুষের হস্তকৌশলের সাহায্য পাইলে, আবাদের উপযোগী ক্ষেত প্রস্তুত হইতে পারে। তখন আবার তাহাতে ধান্যাদি হয়, বৎসরে বৎসরে স্বল্পায়াসে প্রচুর শস্য জন্মায়। ক্রমে জমি আরও উচ্চ হয়, তখন ধান্যোৎপাদনের উর্ব্বরতা লুপ্ত হইতে থাকে। উচ্চ জমি পাইয়া মানুষে গৃহাদি নির্ম্মাণ করিয়া বসতি করে। বসতির পার্শ্বে ফলের বাগান প্রস্তুত হয়। তখন সুন্দরবনের স্মৃতি লুপ্ত হয়। কেবল মাত্র পুষ্করিণী ও কূপ খনন করিবার সময়ে, মৃত্তিকার নিম্নে কোথায়ও জোব মাটী, কোথায়ও সুন্দরী প্রভৃতি বৃক্ষের গুঁড়ি, কখন কখন বৃহৎ পাটুলি প্রভৃতি নৌকার ভগ্নাবশেষ প্রাচীনকালের পরিচয় প্রদান করে।
এইরূপে ভাটিরাজ্যের জমি ক্রমে দক্ষিণ দিকে নিম্ন হইতে হইতে, সমুদ্রের সহিত সমতল হইয়াছে। যখন সমুদ্রে প্লাবন উঠে, তখন তাহাতে নিম্ন প্রদেশ প্রতি পক্ষে কয়েকদিন জলে ডুবিয়া থাকে। পক্ষে পক্ষে এইরূপে ডুবে এবং সমস্ত জঙ্গলের ভূমি-পৃষ্ঠ কৰ্দ্দমাক্ত হইয়া পড়ে। এই অবস্থাই আবার সুন্দরী প্রভৃতি বন্যবৃক্ষের জীবন ধারণ পক্ষে বিশেষভাবে সহায়তা করে। সাধারণতঃ সুন্দরবনের এই অবস্থা চলিতেছে।
কিন্তু সময় সময় এক একটি বিপ্লব উপস্থিত হইয়া, ঘোর পরিবর্তন ঘটাইয়া থাকে। কখনও কখনও ভীষণ ঝটিকা উঠিয়া, বহু বৃক্ষ উন্মূলিত করিয়া দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গল এরূপ দুর্ভেদ্য ও ভয়সঙ্কুল হয় যে, লোকের পক্ষে আবাদ করা বা কাষ্ঠ সংগ্রহ করা, উভয়ই অসম্ভব হইয়া পড়ে। এই সকল ঝটিকার সময় নদীর গতি দুই একস্থলে এমন বিপর্যস্ত করিয়া দেয় যে, কোন প্ৰকাণ্ড নদী বালুকা-মণ্ডিত হইয়া প্রবাহশূন্য হয় এবং নিকটবর্ত্তী অন্য একটি ক্ষুদ্রখাল সামান্য পয়ঃপ্রণালী হইতে প্রবল নদীতে পরিণত হয়। কোন স্থান বসিয়া গিয়া জলমগ্ন হয় এবং অন্য কোন স্থান কারণ বিশেষ দ্রুতবেগে উন্নত হইবার সুযোগ পায়।
ঝটিকা ব্যতীত অন্য কারণেও যে সুন্দরবনের জমি বসিয়া যায়, তাহা জানা গিয়াছে। হঠাৎ কোন সুন্দরবনের অঞ্চলবিশেষ এমন ভাবে ডুবিয়া যায় যে, ঐ প্রদেশে যে সমস্ত লোকের বসতি ছিল বা অট্টালিকাদি নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল, তাহা সমস্তই অধোগত বা জলমগ্ন হইয়া লোকের বাসের অযোগ্য হইয়া পড়ে। তখন অধিবাসীরা ঘরবাড়ী ও মনুষ্যের সভ্যতা চিহ্ন ফেলিয়া রাখিয়া, প্রাণ লইয়া স্থানান্তরে যায়। নিম্ন জমিতে জঙ্গল-বৃক্ষসমূহ পূর্ণস্ফূর্ত্তিতে বাড়িয়া উঠে; ইষ্টকগৃহ থাকিলে, তাহা জঙ্গলাবৃত হইয়া অমাবস্যা পূর্ণিমার জলপ্লাবনকালে ব্যাঘ্রের আশ্রয়স্থানরূপে পরিণত হয় এবং ভবিষ্যতের কোন অনুসন্ধিৎসু ভ্রমণকারীর বিস্ময় উৎপাদন করে।
সুন্দরবনের এরূপ অল্প বিস্তর উত্থান পতন যখন তখন হইয়া থাকে। কিন্তু বহু বৎসরের ইতিহাসের পর্যালোচনা দ্বারা সপ্রমাণ হইয়াছে যে, সুন্দরবনে ২/৩ বার ভীষণ অবনমন (Subsidence) হইয়াছিল।[১] স্থানে স্থানে পুষ্করিণী খনন কালে দেখা গিয়াছে যে ৩০ ফুট নিম্নতল পর্যন্ত গেলেও সুন্দরবনের চিহ্ন পাওয়া যায়। বর্ত্তমান খুলনা সহরের পশ্চিমধারে এবং কলিকাতা শিয়ালদহে পুষ্করিণী খননকালে নিম্নস্থ ভূপঞ্জরের যেরূপ অবস্থা হইয়াছিল তাহার দুইটি প্রতিকৃতি প্রদত্ত হইল।[২] খুলনার পুকুর হইতে দেখা যাইতেছে যে, 8 ́-8 ́ ́ ইঞ্চি দো-আস্লামাটীর নিম্নে ৩ ফুট বালুকা, পরে ৯ ́-২ ́ ́ বালি-সংযুক্ত মাটী ও পরে পরিষ্কার কদম। তাহার নিম্নে জোব মাটী বাহির হয়, উহার মধ্যে অর্থাৎ ১৮ ফুটের নিম্নে প্রথম সুন্দরী গাছের গুঁড়ি দেখা যায় এবং ২৫ ফুট পর্য্যন্ত এইরূপ অসংখ্য গুঁড়ি বৰ্ত্তমান ছিল। দৌলতপুর কলেজ প্রাঙ্গণে ১৯০৮ খৃষ্টাব্দে আমাদের তত্ত্বাবধানে খুলনা ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ড দ্বারা যে বড় পুষ্করিণী খনিত হয়, তাহাতে ৯ ফুটের নিম্নে সামান্য জোবমাটী, পরে একটু বালি এবং ক্রমে ২১ ফুট পর্যন্ত পরিষ্কার আটাল মাটী। তাহার নিম্নে পুনরায় ২/৩ ফুট জোবমাটী এবং সঙ্গে সঙ্গে ২৬ ফুট পর্যন্ত তলভাগটি অসংখ্য সুন্দরী প্রভৃতি গাছের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গুঁড়িদ্বারা সম্পূর্ণরূপে সমাচ্ছন্ন ছিল। এই গুঁড়িগুলির নিম্নে কিছুদূর পর্য্যন্ত দু’ধে মাটী (শ্বেতাভ অত্যন্ত আটাল মাটী) পাওয়া যায়। ২৯ ফুটের পর পুনরায় জোবমাটী ও বৃক্ষাবশেষ দেখা গিয়াছিল। এ পুকুরে ৯ ফুট হইতে ৪০ ফুট পর্যন্ত কোন বালিস্তর দেখা যায় নাই। কলিকাতা শিয়ালদহের নিকট খনিত পুষ্করিণীর ৩০ ফুট নিম্নে অসংখ্য গুঁড়ি পাওয়া যায়।[৩] এই সকল পরীক্ষা হইতে সমস্ত দক্ষিণ অঞ্চলের একটা সাধারণ মৃত্তিকার অবস্থা জানা যায় এবং সর্ব্বত্র যে একটা সাধারণ নিমজ্জন হইয়াছিল, তাহা প্রমাণিত হয়।
মাতলা নামক একটি স্থানে পোর্ট বা বন্দর খুলিবার পর যখন সেখানে একটি পুষ্করিণী খনন করা হয়, তখন দেখা গিয়াছিল যে ৮/১০ ফুট মাটীর নিম্নে একটু সংকীর্ণ স্থানে ৪০টি সুন্দরী বৃক্ষ সোজা দণ্ডায়মান রহিয়াছে; খুলনা বা শিয়ালদহে যেমন বৃক্ষগুলির গুঁড়িমাত্র পাওয়া গিয়াছিল, মাতলায় কিন্তু বৃক্ষগুলি প্রায় সম্পূর্ণ দণ্ডায়মান ছিল।[৪] নিমজ্জন ব্যতীত আর কোন কারণে এরূপ হইতে পারে না। কি কারণে বা কতবার এইরূপ অবনমন হইয়াছিল, তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। খুলনা ও শিয়ালদহে ভগবৃক্ষের গুঁড়ি ও উপরে জোব মাটী দেখিয়া বোধ হয় যে, ভূমির নিমজ্জনের সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রবল ঝটিকা বা জলোচ্ছ্বাস ছিল এবং মাতলার অবস্থায় বোধ হয় শুধুই নিমজ্জন হইয়াছিল, তখন কোন ঝটিকা বা আবৰ্ত্ত উঠে নাই। সুতরাং বিভিন্ন সময়ে যে বিভিন্ন কারণে জমি বসিয়া গিয়াছে, তাহা সহজে অনুমান করা যাইতে পারে।
কি কারণে এইরূপ অবনমন হইয়াছে, তদ্বিষয়ে অনেক মতভেদ আছে। কেহ কেহ বলেন বঙ্গোপসাগরে মালঞ্চ মোহানা ও রায়মঙ্গল হইতে দক্ষিণ দিকে একস্থানে অতলস্পর্শ (Swatch of No Ground) আছে, উহা ২১° হইতে ২১°-২২ ́ অক্ষরেখার মধ্যবর্ত্তী। এইস্থানের চারিদিকে জলের গভীরতা ৫০/৬০ ফুট, কিন্তু অতলস্পর্শের গভীরতা হঠাৎ একেবারে ১৭/১৮ শত ফুট হইবে।[৫] ফার্গুসন সাহে। বলেন যে, বঙ্গোপসাগরের পূর্ব্ব-পশ্চিম দিক্ হইতে বিপরীতমুখী স্রোতের সংঘাত জন্য ঐ স্থানে আবর্ত্তের সৃষ্টি করিয়াছে, সুতরাং তথায় কোন প্রকার মাটী পড়িয়া জমিতে পারে না।[৬] ঘূর্ণিত মৃত্তিকা কতক সুন্দরবনের দক্ষিণোপকূলে বিক্ষিপ্ত হইয়া চর বৃদ্ধি করে, কতক সাগরের মধ্যে দূরবর্তী স্থানে গিয়া দ্বীপ গঠন করিতেছে। বঙ্গোপসাগরে পড়িবার কালে সকল নদীরই গতি এই অতলস্পর্শের দিকে প্রবর্তিত দেখিতে পাওয়া যায়, এজন্য সুন্দরবনের দক্ষিণে নদীমুখে যে সকল চর পড়িয়াছে, তাহাদের সকলের অগ্রভাগই— অতলস্পর্শাভিমুখে রহিয়াছে। পূর্ব্বদিকস্থ চরের মুখ পশ্চিম দিকে এবং পশ্চিমদিকস্থ চরের মুখ পূর্ব্বাভিমুখে আছে। সুন্দরবনের ভূপঞ্জরের নিম্নদেশ হইতে কদমবৎ মৃত্তিকা অবিরত অল্পে অল্পে ধুইয়া ধুইয়া স্রোতের গতি অনুসারে এই অতলস্পর্শের গহ্বরে পড়িতেছে; এইরূপে বহুদিন পর্য্যন্ত নিম্নস্থ মৃত্তিকা সরিয়া যাওয়ায় সুন্দরবনের উপরিস্থিত জঙ্গলাকীর্ণ ভূভাগের অতিরিক্ত গুরুভার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জমিকে একস্থানে বসাইয়া দেয়;[৭] জমি নিম্ন হইয়া গেলে তৎক্ষণাৎ জলপ্লাবনে সে দেশ ডুবিয়া যায় এবং সেই জলের সহিত মিশ্রিত পলি ক্রমে স্থির হইয়া নিম্নে পড়িতে থাকে ও জমির উচ্চতা সম্পাদন করে। অতলস্পর্শের জন্য এইভাবে সুন্দরবনের উত্থান পতন হয়।[৮] সুতরাং এই অতলস্পর্শই সুন্দরবনের অবনমন ও তজ্জন্য উহার সাময়িক ধ্বংসের প্রথম ও প্রধান কারণ।[৯]
এই অতলস্পর্শ যেমন এইরূপ ধ্বংসনামা বা অবনমনের কারণ, তেমনি ইহাকে আরও একটি অদ্ভুত ঘটনার মূল বলা হইয়া থাকে। এতদঞ্চলে সমস্ত স্থানে আষাঢ় শ্রাবণ মাসে সময়ে সময়ে দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূৰ্ব্ব কোণ হইতে কামানের শব্দের মত এক প্রকার গুরুগম্ভীর শব্দ শুনা যায়। খুলনা, যশোহর বা চব্বিশ পরগণায় এই শব্দ বরিশালের দক্ষিণাংশ হইতে আসিতেছে বলিয়া বোধ হয়; এ জন্য সাহেবেরা ইহাকে ‘Barisal guns’ বা বরিশালের কামান বলিয়া থাকেন। বরিশালের নিম্নশ্রেণীর লোকে বলে ইহার নাম ‘গাইবী আওয়াজ’ বা দৈব শব্দ। এ সম্বন্ধে বহু প্রবাদ প্রচলিত আছে। হিন্দুরা বলে লঙ্কাদ্বীপে রাবণের বিশাল তোরণদ্বার খোলা বা বদ্ধ করিবার সময়ে এইরূপ শব্দ হয়; মুসলমানেরা বলে তাহাদের ইমাম আসিতেছে, তাঁহারই যুদ্ধোদ্যমের জন্য কামানের শব্দ শ্রুত হয়। কারণ প্রদর্শন করিতে গিয়া কেহ বলেন, ইহা বিবাহাদি সমারোহের জন্য বন্দুকের শব্দ, কেহ ভাবেন ইহা সমুদ্রের তরঙ্গাভিঘাত শব্দ,[১০] কেহ মনে করেন ইহা সেইরূপ তরঙ্গাভিঘাতে জলনিক্ষিপ্ত ভূমিখণ্ডের পতন শব্দ। কিন্তু ইহার কোন কারণই বিশ্বাস করা চলে না; কারণ, শব্দটি মাত্র বর্ষাকালে শুনা যায়, এবং উহা এতদূরবর্তী স্থান হইতে আসে যে, সাধারণ পরিজ্ঞাত কোন শব্দ তত দূরে যায় না। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বদর্শীদের মধ্যে কেহ অনুমান করেন যে, বঙ্গোপসাগরের অতলস্পর্শ হইতেই এই শব্দ সমুত্থিত হয়।[১১] বর্ষাকালে যখন নদীসমূহের জলবাহুল্যে সমুদ্রে স্রোতোবেগ বৃদ্ধি করে, তখন উক্ত অতলস্পর্শ স্থানে জলপতন শব্দ হইতে এই ভীষণ নিনাদ উত্থিত হয়। যখন এতদঞ্চলের অনেক স্থান হইতে আষাঢ় শ্রাবণ মাসে এবং বিশেষতঃ কোন একটি প্রবল বৃষ্টির পর এই শব্দ অতি স্পষ্টভাবে শুনা যায়, তখন বর্ষা বা জলপ্রবাহের সহিত ইহার কোন সম্বন্ধ আছে, এরূপ স্বচ্ছন্দে বলা যাইতে পাবে। তবে একটি কথা আছে, শব্দটি খুলনা জেলার দক্ষিণ-পূর্ব্বে এবং বরিশালের ঠিক দক্ষিণে শুনা যায়; তাহা হইলে বরিশালের দক্ষিণাংশে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে উহার স্থান হওয়া উচিত, কিন্তু অতলস্পর্শের স্থানটি রায়মঙ্গলে মোহানার সন্নিকটে অর্থাৎ খুলনা ও চব্বিশ-পরগণার দক্ষিণে অবস্থিত। সেখান হইতে শব্দ আসিলে খুলনার দক্ষিণে ও বরিশালের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে শব্দ শুনা উচিত। শ্রীযুক্ত বিভারিজ সাহেব বরিশালের দক্ষিণস্থিত কুকরি-মুকরি দ্বীপে ভ্রমণসময়ে তথাকার বিশ্বস্ত মগজাতীয় অধিবাসিগণের নিকট অবগত হন যে, তাহারা দক্ষিণ, পশ্চিম এবং উত্তর, এই তিন দিক্ হইতে শব্দ শুনিতে পায়।[১২] দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের কারণ বুঝিতে পারি, কিন্তু উত্তর দিক্ হইতে কিরূপে শব্দ আসিতে পারে, তাহা স্থির করা দুঃসাধ্য। বাবু গৌরদাস বসাক বলিতেছেন যে, সমুদ্রের দিক্ হইতে শব্দ আসিলে, খুলনা-বরিশালে যতই দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হওয়া যাইবে, শব্দ ততই উচ্চতর হওয়া স্বাভাবিক; কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তাহা নহে। তিনি মোরেলগঞ্জের পথে টাইগার পয়েন্ট (Tiger Point) পৰ্য্যন্ত গিয়াছিলেন, কিন্তু শব্দ উচ্চতর হয় নাই।[১৩] কেহ কেহ বলেন, এই ভীষণ শব্দ গভীর সমুদ্রে তরঙ্গাভিঘাত জন্য হইয়া থাকে। যখন প্রচণ্ড বেগে প্রধাবিত তরঙ্গে তরঙ্গে আঘাত লাগে, তখন জলোচ্ছ্বাস প্রথমে উর্দ্ধমুখী হইয়া উঠে, পরে হঠাৎ গা ছাড়িয়া দিয়া ভীমবেগে নিম্নে পতিত হয়। ঐ পতন সময়ে একটা ভীষণ শব্দ হইয়া থাকে, তাহাই ‘বরিশাল গান’। এই শব্দটি সাগরের মধ্যে নানা সময়ে নানাস্থানে হয়, এজন্য কখনও পূৰ্ব্ব-দক্ষিণ, কখনও দক্ষিণ এবং কখনও বা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে শুনা যায়। এরূপ তরঙ্গসম্ভূত শব্দ হইলে প্রত্যেক সমুদ্রকূলে এ শব্দ শুনা যাইত। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবনের নিকটবর্ত্তী অংশ ব্যতীত অন্য অংশে এ শব্দ শুনা যায় না। সুতরাং ‘বরিশাল গানের’ প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা কঠিন। বহু গবেষণার পর মহামতি বিভারিজ স্থির করিয়াছেন যে, ইহা বায়ুমণ্ডলের কোন বৈদ্যুতিক ব্যাপার হইতে সম্ভূত।[১৪] কেহ কেহ অনুমান করেন, আরাকানের উপকূলে ভূগভে একটি আগ্নেয় গিরির শ্রেণী আছে। চট্টগ্রামের অন্তর্গত চন্দ্রনাথ প্রভৃতি স্থানে তাহার প্রত্যক্ষ পরিচয় পাওয়া যায়। ইহার অগ্ন্যুদগমের সহিত ‘বরিশাল গানের’ শব্দোৎপত্তির সম্বন্ধ থাকা বিচিত্র নহে। কিন্তু ইহা একটি অনুমান মাত্র। এখনও এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয় নাই।[১৫]
যাহা হউক, ‘বরিশাল গান’ বা অতলস্পর্শ এই উভয়ের ভিতর কার্য্যকারণ-সম্পর্ক আছে কিনা, অথবা উভয় ঘটনারই পৃথক্ পৃথক্ মূলকারণ কি কি, তাহা এখনও স্থির হয় নাই। এদিকে বৈজ্ঞানিক বা ভূতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতবর্গের সাগ্রহ দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাইতে পারে। তবে উভয়ই যে সত্য ঘটনা, তাহাতে সন্দেহমাত্র নাই এবং এই অতলস্পর্শের সহিত যে সুন্দরবনের অবনমনের একটা সম্বন্ধ আছে, তাহা নিঃসংশয়রূপে বলিতে পারি। সুতরাং দেখা গেল, এই অতলস্পর্শ সুন্দরবনের অবনমনের প্রধান কারণ। সুন্দরবনের নিম্নস্থিত মৃত্তিকার কদম-প্রকৃতি অবনমনের দ্বিতীয় কারণ এবং ভূমিকম্প প্রভৃতি দৈব উৎপাত তাহার তৃতীয় কারণ। অবনমনের আরও কারণ থাকিতে পারে; কিন্তু যে কারণেই হউক, বহুবার সুন্দরবনে এইরূপ অল্পবিস্তর অবনমন হইয়াছে এবং তদ্বারা যে সুন্দরবনের অবস্থার অত্যন্ত অবনতি হইয়াছে, তৎপক্ষে সন্দেহ নাই। সুতরাং এই অবনমনকেই আমরা সুন্দরবন ধ্বংসের প্রথম কারণ ধরিতে পারি।
সুন্দরবন ধ্বংসের দ্বিতীয় কারণ ঝটিকাবর্ত ও জলপ্লাবন। অতি প্রাচীণকালে কি হইয়াছে, তাহা জানিবার উপায় নাই। তবে গত চারি পাঁচ শত বৎসরের মধ্যে কয়েকবার ঝটিকা ও জলপ্লাবনাদিতে সুন্দরবনের যে অসংখ্য প্রাণিহত্যা ও অত্যন্ত অনিষ্ট সাধন করিয়াছে, তাহার প্রমাণ আছে। বাদশাহ আকবরের রাজত্বের ২৯শ বর্ষে অর্থাৎ ১৫৮৫ খৃষ্টাব্দে এক দিন অপরাহ্নে সমুদ্রের জল বৃদ্ধি পায়; উহাতে অল্প সময়ের মধ্যে এমন জলপ্লাবন হয় যে, সমস্ত বালা সরকার বা চন্দ্রদ্বীপ জলমগ্ন হইয়া যায়। ক্রমাগত ৫ ঘণ্টা ভয়ানক ঝড়বৃষ্টি ও বজ্রাঘাত হইয়াছিল; সমুদ্র উত্তালতরঙ্গ তুলিয়া রাজ্য গ্রাস করিয়াছিল। ঘরবাড়ী, নৌকা, জাহাজ সমস্ত ভাঙ্গিয়া চুরিয়া যায় এবং প্রায় দুই লক্ষ লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়।[১৬] এতদ্বারা খুলনার দক্ষিণস্থিত সুন্দরবনের যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়। উহার জন্যই মহারাজ প্রতাপাদিত্য স্বীয় রাজধানীর দক্ষিণে যমুনা ও আড়পাঙ্গাসিয়ার নদীদ্বয়ের মধ্যবর্ত্তী অংশে এবং উত্তরে কালীগঞ্জ হইতে পূৰ্ব্বমুখে কপোতাক্ষ পর্য্যন্ত ও পশ্চিমমুখে ভাগীরথী তীরে রায়গড় পর্য্যন্ত মৃত্তিকার বাঁধ নির্ম্মাণ করিয়া রাজ্যরক্ষার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ঐ সকল বাঁধের অনেকাংশ এখনও বৰ্ত্তমান থাকিয়া দর্শকের বিস্ময় উৎপাদন করিতেছে।
পরবর্ত্তী ভীষণ ঝটিকা ১৬৮৮ খৃষ্টাব্দে হয়। উহাতে সাগরদ্বীপে ৬০ হাজারেরও অধিক লোক মারা গিয়াছিল।[১৭] প্রতাপাদিত্যের যুগ পর্য্যন্ত সাগরদ্বীপের উন্নতির সময় ছিল। প্রতাপকে সাগরদ্বীপের শেষ নৃপতি বলিয়া থাকে। প্রতাপের পতনের অব্যবহিত পরে সুন্দরবনের একটি অবনমন হয়, তজ্জন্য অল্পদিন মধ্যে উহার অবস্থা নিতান্ত খারাপ হইয়া পড়ে। তখন হইতে একশত বৎসর পর্য্যন্ত সাগরদ্বীপের কিছু সৌষ্ঠব ছিল, এই ঝটিকাই তাহার সর্ব্বনাশ সাধন করিয়াছিল।
১৭০৭ খৃষ্টাব্দে এক প্রকাণ্ড সাইক্লোন বা ঝটিকাবর্ত সুন্দরবনের উপর দিয়া প্রবাহিত হয়। উহাতে বৃক্ষাদি ও মনুষ্যজীবনের ভীষণ ক্ষতি করিয়াছিল। সুন্দরবন বা সন্নিহিত প্রদেশে যাহারা অধিবাসী ছিল, তাহারা সকলে স্থান ত্যাগ করিয়া উত্তরমুখে পলায়ন করিতেছিল। ১৭৩৭ খৃষ্টাব্দে ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গে আর এক ভয়ানক ঝড় হয়। তদ্বারা ইংরাজদিগের কলিকাতা বা হুগলীস্থিত কারখানা সমূহের বিশেষ ক্ষতি হয়। এই ঝড়ের পর সুন্দরবন সম্পূর্ণরূপে মনুষ্যের আবাসশূন্য হইয়া পড়ে। ইহাতে ত্রিশ হাজার লোক মরে এবং গঙ্গার জল ৪০ ফুট উঠিয়াছিল।[১৮] ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে ১৪ই মে (১২৬৯ সালের ২রা জ্যৈষ্ঠ) যশোহর-খুলনা ও সুন্দরবনে প্রবল ঝড় হয়, উহাতেও কম ক্ষতি করে নাই, ইহার নাম বিখ্যাত ‘জ্যৈষ্ঠ ঝড়’। ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দের ৫ই অক্টোবর একটি ঝড় ও তৎসহ প্রবল জলোচ্ছ্বাস হইয়া কলিকাতা ও নিকটবর্ত্তী জেলা সমূহের ভীষণ ক্ষতি করিয়াছিল। ইহাতে বহুসংখ্যক বড় জাহাজ, লক্ষ লক্ষ নৌকা ও অগণিত মনুষ্যজীবন নষ্ট হয়।[১৯] ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর (১২৭৪ সালের ১৬ই কার্ত্তিক) আর একটি বিখ্যাত ঝড়ে সাগরদ্বীপ হইতে পাবনা পর্য্যন্ত সমস্ত দেশের সর্ব্বনাশ সাধন করিয়া যায়। খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদীতে তীরের উপর ৪ হাত জল হইয়াছিল; আরও দক্ষিণে সুন্দরবনের মধ্যে ৯ হইতে ১২ ফুট পৰ্য্যন্ত জল হয়। ইহা দ্বারা যমুনা নদী কালীগঞ্জের দক্ষিণে একেবারে মরিয়া যায়। তাহা না হইলে প্রাচীন যশোহর রাজধানীর আজ এ দুর্দ্দশা হইত না। এই ‘কাৰ্ত্তিকে ঝড়ে’ সুন্দরবনের যে ক্ষতি হইয়াছিল, তাহা বহু বৎসরে পূরণ হয় নাই। ইহার দুই বৎসর পরে ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দের ৩১শে অক্টোবর সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ সন্দ্বীপ, হাতিয়া দ্বীপ হইতে আরম্ভ করিয়া বরিশাল পৰ্য্যন্ত এক ভয়ঙ্কর ঝটিকা ও সামুদ্রিক প্লাবন প্রবাহিত হয়। ইহাতে দৌলতখাঁ উপবিভাগের সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক ক্ষতি করিয়াছিল। উচ্চ বৃক্ষাগ্র পর্যন্ত জল উঠিয়া গৃহাদি ও জীবজন্তু ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিল। বাখরগঞ্জ ও নোয়াখালি অঞ্চলের দশ লক্ষ লোক গৃহশূন্য হয় ও দুই লক্ষের অধিক লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয় বলিয়া জানা গিয়াছিল। কিন্তু প্রকৃত মৃত্যুসংখ্যা অগণিত। এই সময় হইতেই সুন্দরবনের পূৰ্ব্বভাগ বৃক্ষশূন্য হইয়া পড়ে।
সুন্দরবন ও খুলনা প্রভৃতি জেলা বঙ্গসাগরের নিকট থাকিয়া সর্ব্বদাই ঝড়ের অত্যাচার সহ্য করে। সে সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝটিকাবর্ত্তের হিসাব দেওয়া যায় না। গত বিংশাধিক বৎসরের মধ্যে সৰ্ব্বাপেক্ষা ভীষণ ঝড় হইয়াছিল ১৯০৯ খৃষ্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর (বা ১৩১৬ সালের ৩০শে আশ্বিন)। এ ঝড় খুলনা অঞ্চলেই সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক হইয়াছিল। এতদ্বারা দেশের এবং বিশেষতঃ সুন্দরবনের যে দুর্দ্দশা হইয়াছিল, তাহা স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছি। ইহার পরে সুন্দরবনের প্রাচীন বা বড় বৃক্ষ প্রায় সমস্তই বিনষ্ট হইয়াছিল, বলা যাইতে পারে। ভগ্নবৃক্ষের গুঁড়ি ও শাখাপ্রশাখায় সুন্দরবনের নিবিড় বন বহুদিন পৰ্য্যন্ত সম্পূর্ণ দুর্গম হইয়াছিল। ১৩২৬ সালের আশ্বিন মাসে এইরূপ আর একটি ভীষণ ঝড় হইয়া বহু ক্ষতি করিয়াছে।
এইরূপে বারংবার ঝটিকা, জলস্তম্ভ, প্রবল প্লাবন প্রভৃতি আকস্মিক উৎপাতে সুন্দরবনের ধ্বংস সাধন করিয়া তাহাকে মনুষ্যাবাসের পক্ষে অযোগ্য করিয়া তুলিয়াছে। কিন্তু শুধু ইহাই নহে, ভূমিকম্পকেও তাহার ধ্বংসের অন্যতম বা তৃতীয় কারণ ধরা যাইতে পারে। ১৭৩৭ খৃষ্টাব্দের ভূমিকম্পের কথা পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে। ১৭৬২ খৃষ্টাব্দে ২রা এপ্রিল তারিখে একটি ভূমিকম্পে আরাকান হইতে চট্টগ্রাম ও ঢাকা দিয়া কলিকাতা পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল। ইহা দ্বারাও সুন্দরবনের অনেক পরিবর্তন ঘটে। ইহাতে সুন্দরবন এক প্রকার ডুবিয়া গিয়াছিল, কলিকাতার সন্নিকটে গঙ্গার জলও ৬ ফুট উচ্চ হইয়া উঠে।[২০] ১৮১০ ও ১৮২৯ খৃষ্টাব্দে গঙ্গোপদ্বীপে দুইটি ভূমিকম্প হইয়াছিল বটে, কিন্তু তাহা তত গুরুতর নহে। ১৮৪২ খৃষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর যে ভূমিকম্প হয়, তাহাই অত্যন্ত গুরুতর, ইহা দ্বারা গঙ্গোপদ্বীপ হইতে আফগানিস্তান পৰ্য্যন্ত সমস্ত উত্তর ভারত আলোড়িত হইয়াছিল। চব্বিশ-পরগণা বা যশোহরের মধ্যে কোন স্থানে এই ভূমিকম্পন প্রথম আরম্ভ হয়।[২১] বরিশাল প্রভৃতি স্থানে ভীষণ শব্দের সহিত জমি উচ্চ হইয়া উঠে। ইহা দ্বারা সুন্দরবনেও অশেষ ক্ষতি ও পরিবর্তন সাধিত হয়। কিন্তু সৰ্ব্বাপেক্ষা ভীষণ ভূমিকম্প হইয়াছিল ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দের ১২ই জুন তারিখে। ইহাতে আসাম হইতে সাহাবাদ ও সিকিম হইতে পুরী, অর্থাৎ সমস্ত বঙ্গ বিলোড়িত হয়। ইহা দ্বারা রাজসাহী বিভাগ, কুচবেহার, ঢাকা ও ময়মনসিংহের সর্ব্বপেক্ষা অধিক ক্ষতি হইলেও পদ্মার দক্ষিণে গাঙ্গেয় উপদ্বীপেও নিতান্ত কম ক্ষতি হয় নাই।[২২]
সুন্দরবন ধ্বংসের চতুর্থ বা শেষ কারণ মগ ও ফিরিঙ্গিদের[২৩] অমানুষিক অত্যাচার। সময় সময় প্রদেশ বিশেষের অবনমনে, বঙ্গসাগরোপকূলের চিরসহচর ঝটিকা, প্লাবন ও ভূমিকম্পে সুন্দরবন ধ্বংসের যাহা বাকী ছিল, এই আরাকানবাসী মগ ও পাশ্চাত্য দেশ হইতে আগত ফিরিঙ্গি জাতীয় জলদস্যুগণের দৌরাত্ম্যে তাহা শেষ করিয়া দিয়াছিল। এই ফিরিঙ্গি জলদস্যুদিগকে হারমাদও বলিত।[২৪] ইহারা গঙ্গাসাগর-সমীপবর্ত্তী প্রদেশকে উৎসন্ন করিয়া— ‘ফিরিঙ্গির দেশ’ করিয়া লইয়াছিল এবং মগেরাও সুন্দরবনের অনেক স্থান লোকশূন্য করিয়া পার্শ্ববর্তী দেশে এক ভীষণ অরাজকতার সৃষ্টি করিয়া ‘মগের মুল্লুক’ করিয়া লইয়াছিল। স্থানান্তরে এই অত্যাচার- কাহিনী বিশদভাবে বর্ণিত হইবে।[২৫] সুন্দরবনের অনেক স্থানে পূর্ব্বে লোকের বসতি ছিল। এখন আর সে বসতি নাই বটে, কিন্তু বসতিচিহ্নের অভাব নাই।
পাদটীকা :
১. ‘That a general subsidence has operated over the whole extent of; the Sunderbans, it not of the delta entire, is, I think, quite clear from the result of examination of cuttings or sections made in various parts where tanks were being excavated’. Gastrell’s Statistical Report of the Districts of Jessore, Faridpur and Backerganj, P. 29.
২. J. A. S. B. No. XXXIII of 1864, PP. 154-8. Gastrell’s Report Appendix IV.
৩. ‘The point of chief interest in the Sealdah section is the occurrence of tree stumps in situ at the depth of 30 ft. and the evidence afforded thereby of a general depression of the delta.’–H. F. Blanford in J. A. S. B. No, XXXIII, 1864, PP. 156-7.
৪. দ্রষ্টব্য : R. K. Mukerjee. Changing Face of Bengal (1938), P. 119–শি মি
৫. ‘In the sea outside the middle of the delta there is a singularly deep area known and marked on the charts as the ‘Swatch of No Ground, in which soundings which are from 5 to 10 fathoms all round, change almost suddenly to 200 and even to 300 fathoms.’-R. D. Oldham’s Manual of Geology [Manual of Geology of India – Calcutta, 1893–শি মি]
৬. Mr. J. Fergusson in his paper on the delta of the Ganges published in the Quarterly Journal of the Geographical Society, 1863. See also ‘Khulna Gazetter’ P. 199.
৭. Calcutta Review : The Gangetic Delta, 1850.
৮. বঙ্গদর্শন, ২য় ভাগ, ১২৮০-’অতলস্পর্শ’ প্রবন্ধ, ২১৪ পৃ।
৯. “The present desolate condition of the Sunderbans may be due to a subsidence of the land and that this may have been contemporaneous with formation of the submarine hollow known as the ‘Swatch of No Ground.”-Beveridge. History of Bakarganj, P. 169.
১০. Opinion of Mr. Pellew, Superintendent of Survey at Barisal. See J. A. S. B. Vol, 36, P. 118 &c.
১১. Beveridge. History of Bakarganj. P. 14.
১২. Babu Gourdas Basak. Antiquities of Bagerhat, J. A. S. B. 1867-8.
১৩. Ibid, Pp. 167-8.
১৪. ‘The conclusion which I come to, is that the sounds are atmospheric and in some way connected with electricity’ – Beveridge. History of Bakarganj, P. 168.
১৫. “The ‘Barisal Guns’ prove that there is some volcanic action going on below the land or the Bay”-G. D. Bysack’s letter to the Englishman, 17-6-1897.
“Whether this volcanic action contributes in anything to cause the sounds popularly know as the ‘Barisal Guns’ has yet to be established’-H. J. Rainey.
১৬. Ain-i-Akbari, Gladwin’s Edition, 1897, p. 304; Jarrett’s Edition, Vol. II, P. 123.
১৭. Imperial Gazetteer, Vol. XII, P. 110.
১৮. Gentleman’s Magazine, 1838-39; Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, December, 1863. অনেকে-এ বিবরণী অতিরঞ্জিত বলিয়া মনে করেন। H. B. H’s letter to the Englishman, 2-7-1897.
১৯. Bengal under Lieutenant – Governors, Vol. I. PP. 298-302.
২০. Report of the Rev. William Hirst, sent to the Royal Society, 1762.
২১. Opinion of Lieutenant Baird Smith. See ‘Friend of India’. 17-11-1842.
২২. The Earthquake in Bengal and Assam, 1897; Bengal under Lieutenant Governors, Vol. II, P. 1001. ২৩. ফিরিঙ্গি (Feringi, Firingi, Feringee বা Feringhee) শব্দ ফরাসী ফ্রাঙ্ক (Frank) কথা হইতে উৎপন্ন। আরব ও পারসিকদিগের সহিত ধর্ম্মরাজ্য প্যালেষ্টাইন লইয়া সংঘর্ষের (Crusade) সময় সমস্ত ইয়োরোপীয় খৃষ্টানগণ ফ্রাঙ্ক নামে অভিহিত হইতেন। ঐ সময় সকলের বোধগম্য যে এক নূতন ভাষার সৃষ্টি হয়, তাহার নাম Lingua Franca বা ফ্রাঙ্ক ভাষা। এই ফ্রাঙ্ক কথা পারসীক ও আরবীয়েরা ফেরঙ্গ (Ferang, per. Frang, Ar. Firanji) উচ্চারণ করিত। উহারই অপভ্রংশে ফিরিঙ্গি হইয়াছে। পাশ্চাত্য দেশকে ফিরঙ্গ দেশ ও তদ্দেশবাসীকে ফিরঙ্গি (পুং) এবং ফিরঙ্গিণী (স্ত্রী) বলা হইত [শব্দকল্পদ্রুমে ২৮০৪ পৃ ও বাচস্পত্যে ৪৫৫৫ পৃ ‘ফিরঙ্গ’ শব্দ দেখ]। ইহাদের আনীত রোগবিশেষকে ফিরঙ্গব্যাধি ও এক প্রকার রোটিকাকে ফিরঙ্গ রুটি বা পাউরুটি বলে। ইংরাজী কোন কোন অভিধানে (Webster’s, Annandale’s, Slang Dictionary) হিন্দুরা ইয়োরোপবাসিগণকে ফিরিঙ্গি বলে, এইরূপ ব্যাখ্যাত হইয়াছে; কোন কোন অভিধানে (Chambers &c.) ইংরাজদিগকেই ফিরিঙ্গি বলে এইরূপ উক্ত হইয়াছে। কিন্তু ইংরাজ প্রভৃতি কোন উচ্চবংশীয় জাতি এদেশীয়দিগের দ্বারা ফিরিঙ্গি নামে অভিহিত হইতে অপমানিত বোধ করেন। তাহার যথেষ্ট কারণও আছে। পর্তুগীজেরাই প্রথম পশ্চিম ভারতে উপনিবেশ স্থাপন করে। সেখান হইতে পর্তুগীজ বা অন্য জাতীয় দুৰ্ব্বত্তাগণ কোন অপরাধ করিয়া শাস্তির ভয়ে পলায়নপূর্ব্বক বঙ্গদেশে চট্টগ্রাম অঞ্চলে আসিত, কেহ বা দস্যুবৃত্তি উদ্দেশ্য করিয়াই এদেশে আসিত। এই সকল পলায়িত বা দলচ্যুত পর্তুগীজ প্রভৃতি জাতীয়গণ এদেশে ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত হইত। ‘Franguis (I mean these fugitive portugals and other straggling Christians that had put themselves in the service of the king of Arracan) ‘ — Bernier’s Travels. আইন-ই-আকবরিতে ও ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গলে’ ফিরিঙ্গি বলিতে পর্তুগীজদিগকেই বুঝায়। এক্ষণে ইয়োরোপীয়দিগের সংস্রবে উৎপন্ন বর্ণসঙ্করকে ফিরিঙ্গি বলে। (‘The mixed descendants of Europeans’ — See Dr. Rajendra Lal Mitra’s Indo-Aryans Vol. II, P. 203 & note).
২৪. ‘The word Harmad is evidently Armad, a corruption of Armada. Armad is used in the sense of fleet in Kalimat-i-taiyabat,’—Prof. J. N. Sarkar. Anecdotes of Aurangzeb, P. 202; J. A. S. B. June, 1907. P. 425. ফিরিঙ্গির দেশ খান বাহে কর্ণধারে,
রাত্রিতে বাহিযা যায়, হারমদের ডরে।’—কবিকঙ্কণ চণ্ডী
২৫. যশোহর-খুলনার ইতিহাস, ২য় খণ্ড, মোগল আমল, ১৮শ পরিচ্ছেদ
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন