৪. খাঁ জাহান আলি

সতীশচন্দ্র মিত্র

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – খাঁ জাহান আলি

পাঠান কর্তৃক বঙ্গবিজয়ের পূর্ব্ব হইতেই মুসলমান দরবেশগণ ধর্ম্মপ্রচারার্থ বঙ্গদেশে আসিতেছিলেন। খৃষ্টীয় মিশনরী বা ধর্ম্মযাজকগণ যেমন ইংরাজ, ফরাসী প্রভৃতি জাতির পক্ষে রাষ্ট্রবিজয়ের পথ পরিষ্কার করিয়া দিয়াছিলেন, এই মুসলমান আউলিয়া বা ফকিরগণও সেইরূপ মুসলমান প্রতিপত্তির ভিত্তি পত্তন করেন। আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি, লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালে শাহ জালালউদ্দিন তাব্রেজী বঙ্গে আসিয়া বিরাগভাজন মুসলমানের জন্যও হিন্দুর নিকট হইতে ভক্তি-শ্রদ্ধা অর্জ্জন করিয়াছিলেন। ইনি একজন প্রসিদ্ধ বুজরুক অর্থাৎ ঐশ্বরিক শক্তি দ্বারা অদ্ভুত কাৰ্য্য সম্পাদনে সক্ষম ছিলেন। সেই অদ্ভুত ক্ষমতাকে বুজরুকী বলিত এবং উহা আধ্যাত্মিক উন্নতির পরিচায়ক ছিল। লক্ষ্মণসেনের সঙ্গে যখন জালালউদ্দীনের প্রথম সাক্ষাৎ, তখন তিনি দেখিলেন, সেই দুর্ব্বেশ (দরবেশ) জলের উপর দিয়া হাঁটিয়া নদী পার হইতেছেন। দরবেশ আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?’ গৰ্ব্বিতভঙ্গিতে লক্ষ্মণসেন আত্মপরিচয় দিলেন। ফকির বলিলেন, “আচ্ছা, তুমি বলিতেছ পৃথিবীর রাজা; ঐ যে বক মৎস্য ধরিয়া বসিয়া আছে, তাহাকে মৎস্য পরিত্যাগ করিতে বল, সে অবশ্য রাজার কথা শুনিবে।’ লক্ষ্মণ বলিলেন, ‘বক তির্য্যযোনি, জ্ঞানহীন, সে আমার কথা শুনিবে কেন? তোমার ক্ষমতা থাকে, উহাকে আদেশ কর।’ ফকির বককে মৎস্য ত্যাগ করিতে আদেশ করিবামাত্র সে তাহা ত্যাগ করিয়া উড়িয়া গেল। লক্ষ্মণসেন অবাক্ হইয়া রহিলেন, ভাবিলেন ইন্দ্রদেব এই দরবেশ আকৃতি ধারণ করিয়া আগমন করিয়াছেন।[১] এই যে ঝঙ্কার লাগিল, তাহাতে মহম্মদ-ই-বক্তিয়ারের অসি অপেক্ষাও অধিক শক্তি দেখাইয়াছিল। হিন্দু চিরকাল আধ্যাত্মিক শক্তির নিকট দাসানুদাস; ঈশ্বরে প্রগাঢ় নির্ভরশীলতা জাগিলে সে শক্তি সৰ্ব্বধৰ্ম্মীতে জাগে। মুনি-ঋষি এই শক্তিতে হিন্দুরাজ্য জয় করিয়াছেন, মুসলমান দরবেশও এই শক্তিবলে সেই হিন্দুর রাজ্যে ইসলামধর্মের বিজয়পতাকা সংস্থাপন করিয়াছিলেন। এই শাহ জালালউদ্দীন শেষে এইরূপ বহু বুজরুকী দেখাইয়া নবধর্ম্মের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছিলেন। ক্রমে পাঠানেরা যত দেশ জয় করিয়া যেখানে সেখানে রাজপাট বসাইতে লাগিলেন, তত এইরূপ দরবেশগণ এদেশে আসিতে লাগিলেন। হিন্দুরা ধর্ম্মের খাতিরে তাঁহাদিগকে নির্যাতন করিতেন কিন্তু দরবেশগণও নির্যাতনের মধ্যে সহিষ্ণুতা দেখাইয়া স্বধৰ্ম্মপ্রচারের জন্য জ্বলন্ত স্বার্থত্যাগের দৃষ্টান্ত দেখাইয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের সেই আত্মবলিদানের উপর আজ ইসলামধর্ম্মের বিজয়-বৈজয়ন্তী উড়িতেছে।

খৃষ্টীয় চতুৰ্দ্দশ শতাব্দীতে এইরূপ বহু দরবেশ বঙ্গদেশে আসিয়াছিলেন। তাহার মধ্যে ঢাকার বাবা আদম ও শ্রীহট্টের শাহজালালের নাম বিখ্যাত। এই সকল দরবেশগণ এত অধিক শিষ্যপরিবৃত হইতে হইতে অগ্রসর হইতেন যে, তাঁহাদের শিষ্যসম্প্রদায় সৈন্যশ্রেণীর মত বোধ হইত। দ্বিতীয় বল্লালসেন যখন ঢাকায় রাজত্ব করিতেছিলেন, তখন রাজধানী রামপালের নিকটবর্ত্তী আবদুল্যাপুর গ্রামে বাবা আদম দলবল সহ আগমন করেন, এবং হিন্দুদুর্গের ভিতর গোমাংস-খণ্ড নিক্ষেপ করায় রাজার বিষ-নজরে পড়েন।[২] রাজার সহিত আদমের যুদ্ধ হইয়াছিল এবং সেই যুদ্ধে তিনি আদমের হত্যা সাধন করেন। আদমের মৃত্যুতে মুসলমানেরা ক্ষিপ্ত হইয়াছিলেন এবং ক্রমে বহুসংখ্যক দরবেশ ঢাকা অঞ্চলে আসিয়া দেশময় মুসলমান ধর্ম্ম প্রচার করিয়া যান। এই সময়ে মীর সৈয়দালি তাব্রেজী বা সৈয়দালি পাতশা বহু অনুচর সহ ঢাকার অন্তর্গত ধামরাই অঞ্চলে আসেন। ধামরাই নগরে বড় দরগা উক্ত তাব্রেজীর নাম রক্ষা করিতেছে।

চতুৰ্দ্দশ শতাব্দীর শেষভাগে গৌড়, লাউড় ও জয়ন্তীয়া, এই তিন অংশে শ্রীহট্ট বিভক্ত ছিল। উহার গৌড় অংশের রাজা ছিলেন গোবিন্দ। এইজন্য সেই রাজা গোবিন্দকে গৌড়-গোবিন্দ বলিত। হিন্দুনৃপতি গৌড়-গোবিন্দ গোবধ-নিবারণ জন্য জনৈক মুসলমানের উপর অত্যাচার করিলে, সেই কথা দিল্লীতে পৌঁছিল। তাহাই শাহ জালাল নামক[৩] এক দরবেশের আগমনের কারণ। এ সময় সাসুদ্দীন ইলিয়াস বঙ্গের স্বাধীন রাজা, তাঁহার পুত্র সেকন্দর শ্রীহট্ট প্রদেশের ভারপ্রাপ্ত শাসনকর্তা। শাহ জালাল শ্রীহট্টে আসিয়া নানা অমানুষিক ক্রিয়া দ্বারা এক প্রকার বিনা রক্তপাতে গৌড়-গোবিন্দকে পরাভূত করিয়া রাজ্য অধিকার করেন; কিন্তু রাজ্য নিজে গ্রহণ না করিয়া উহা সুলতান সেকন্দর শাহকে দেন।[৪] শাহ জালাল প্রথমতঃ ১২ জন শিষ্য লইয়া যাত্ৰা করেন, পথে আসিতে আসিতে তাঁহার শিষ্য বা আউলিয়া (ফকির) গণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে থাকে। উহার মধ্যে প্রধান ৩৬০ জন আউলিয়া দ্বারা শ্রীহট্ট বিজিত হয়; এইজন্য শ্রীহট্টকে ‘৩৬০ আউলিয়ার মুলুক’ বলে।[৫]

প্রবাদ-মুখে যখন ইতিহাসের কথা রক্ষিত হয়, তখন এক স্থানের ঘটনা অন্যত্র পুনরভিনীত হইয়াছে বলিয়া দেখা যায়। ইসলাম ধৰ্ম্ম-প্রচারকগণের এইরূপ ১২ জন সঙ্গী লইয়া আসা ও পরে সে সংখ্যা ৩৬০ হইয়া যাওয়া একটি প্রবাদ। অনেক স্থলে এরূপ হইয়াছে, বিশেষতঃ যশোহর-খুলনায় খাঞ্জালির ইতিহাসে। ১২ মাসে ও ৩৬০ দিনে বৎসর ধরা হইত বলিয়া, এই দুইটি সংখ্যা হিন্দু মুসলমানের নিকট কিছু অধিকতর পরিচিত বলিয়া মনে হয়। চির পরিচিত সংখ্যা দ্বারা সংজ্ঞাজ্ঞাপন না করিলে তাহা সকলেই মনে রাখিতে পারে না। জানি না, এইরূপ সংখ্যা নির্দেশের মূলে এরূপ কোন তথ্য নিহিত আছে কি না। তবে এই মাত্র জানি যে যশোহর-খুলনায়ও একটি প্রবাদ আছে যে, শাহ জালালের সমসময়ে, বার জন ফকির ধর্মপ্রচারার্থ যশোহর অঞ্চলে আসিয়া ভৈরবতীরে যে স্থানে প্রথম আস্তানা করিয়াছিলেন, তাহারই নাম হইয়াছিল বারবাজার। এই বার জনের নায়ক ছিলেন খাঁ জাহান আলি। তিনি যখন বাগেরহাটে স্থায়ী হাবেলী বা বাসস্থান নিৰ্দ্দেশ করেন, তখন তাঁহার শিষ্যসংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়া ৩৬০ জন হইয়াছিল। এই শিষ্যগণের জন্য তিনি বাগেরহাট অঞ্চলে ৩৬০টি মসজিদ নির্মাণ ও ৩৬০টি দীঘি খনন করেন। উহার অনেকগুলি এখনও আছে। আমরা সে শিষ্যসম্প্রদায়ের কথা শেষে তুলিব, প্রথম দেখা যাউক এই খাঁ জাহান আলি কে?

দীর্ঘকাল সুশাসনের পর এবং বহু পুণ্যকর্মে দেশ অলঙ্কৃত করিয়া যে দিন তোগলক- কুলতিলক দিল্লীশ্বর ফিরোজশাহ নবতি বর্ষ বয়সে দেহত্যাগ করিলেন (১৩৮৮), সেই দিন হইতে দিল্লীতে এক ভীষণ বিভ্রাট উপস্থিত হইল। সিংহাসন লইয়া মহা গণ্ডগোল চলিতে লাগিল। ৫ বৎসরে পাঁচ জন রাজা পার হইলেন। অবশেষে সম্রাট হইলেন ফিরোজের এক নাবালক পৌত্র মামুদ্র তোগলক। একে অরাজকতা, তাহাতে এক নিৰ্জ্জীব বালক শাসনের পদে সমাসীন; সুতরাং অচিরে দেশময় এক বিপ্লব উপস্থিত হইল; যাহা কিছু বাকী ছিল, ৪ বৎসর পরে নরদস্যু তৈমুরলঙ্গের নৃশংস আক্রমণে (১৩৯৮) তাহাও শেষ হইয়া গেল, দিল্লী শ্মশানে পরিণত হইল। পলায়িত মামুদ ফিরিয়া আসিয়া ২০ বৎসর কাল নামে মাত্র সম্রাট ছিলেন বটে, কিন্তু দেশ সম্পূর্ণরূপে তাঁহার শাসনবহির্ভূত ছিল।

এই মামুদের এক উজীর ছিলেন, খাজা জাহান। তিনি সুযোগ পাইয়া বালক মামুদের রাজ্যের প্রারম্ভেই (১৩৯৪) জৌনপুরে এক নূতন রাজ্য স্থাপন করেন। তিনি এমন প্রবল প্রতাপে শাসন করিতে থাকেন যে, সম্রাট তাঁহাকে ‘মালিক-উস-শর্ক’ (পূৰ্ব্বদেশীয় রাজ্যসমূহের অধিপতি) উপাধি প্রদান করিতে বাধ্য হন।[৬] তবে তিনি কাৰ্য্যতঃ একপ্রকার স্বাধীন হইলেও নিজের নামে মুদ্রাঙ্কন করেন নাই এবং চিরকাল আপনাকে প্রতিনিধি বলিয়া পরিচয় দিতেন। এই সময়ে বঙ্গদেশেও এক প্রকার অরাজকতা চলিতেছিল।

ফিরোজশাহ বঙ্গের অধিপতি সামসুদ্দীন ইলিয়াসের পুত্র সেকন্দর শাহকে স্বাধীন নরপতি বলিয়া স্বীকার করেন। এই সেকন্দরের সময়ে শাহ জালাল শ্রীহট্টে আসেন। সেকন্দরশাহ বঙ্গদেশ জরিপ করিয়া রাজত্ব নির্ণয় করেন এবং তথায় সৰ্ব্বত্র এক দৃঢ়শাসন প্রবর্তিত করিয়াছিলেন। এখনও তাঁহার ব্যবহৃত মাপকাটিকে সেকন্দরী গজ বলা হয়। এই সাধু প্রকৃতিক নরপতি অত্যন্ত ধর্মপ্রবণ ছিলেন বলিয়া ‘পীর’ (দেবতা বা saint) আখ্যা পান। তিনি ‘পাঁচ পীরের’ অন্যতম, সে কথা পরে বলিব। সেকন্দরের মৃত্যুর অল্পদিন পরেই রাজা গণেশ বাঙ্গালার রাজত্ব কাড়িয়া লন। প্রথম কয়েক বৎসর গণেশকে আত্মরক্ষার জন্য এত বিব্রত থাকিতে হইত যে, তিনি সুশাসনের দিকে কোনরূপ দৃষ্টিপাত করিতে পারেন নাই। এই সময়ে খাজা জাহান বঙ্গে আবির্ভূত হন।

এই খাজা জাহান, খোজা বা নপুংসক ছিলেন, তাঁহার কোন পুত্র সন্তান ছিল না।[৭] তিনি স্বীয় পালিত পুত্র ইব্রাহিমের উপর জৌনপুরের শাসনভার দিয়া ইসলাম ধর্ম্ম প্রচার ও পুণ্যকাৰ্যে শেষ জীবন অতিবাহিত করিবার জন্য পূর্বাঞ্চলে আসেন। ইব্রাহিমের শাসন আরম্ভের পূর্ব্বে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিলেন, সেটি অনুমান মাত্র বলিয়া বোধ হয়। নবরাজ্য পত্তনের কয়েকবর্ষ মধ্যে পুত্রহীন ব্যক্তি মৃত্যুমুখে পতিত হইলে, তাঁহার রাজ্য লইয়া ভীষণ রক্তকাণ্ড চলিত; কিন্তু তাহা হয় নাই। ইব্রাহিম এমন দৃঢ় হস্তে শাসনদণ্ড পরিচালন করিতেছিলেন যে, তাঁহার ভয়ে ও কৌশলে গণেশের পুত্র যদুকে মুসলমান হইতে হইয়াছিল এবং যদুর বংশধরকে আত্মরক্ষার জন্য তৈমুরলঙ্গের পুত্র শাহরুখের নিকট কৃপাপ্রার্থী হইতে হইয়াছিল। শাহরুখের সহিত বিবাদ করা অনর্থক এবং হয়ত অনিষ্টকর হইতে পারে বলিয়া ইব্রাহিম বঙ্গেশ্বরের বন্দীদিগকে মোচন করেন। এই সুযোগে খাঁ জাহান পূর্ব্বদেশে সুন্দরবন অঞ্চলে এক প্রকার স্বাধীনভাবে দেশ শাসন ও ধর্ম্মকার্য্যের অনুষ্ঠান করিতেছিলেন।

যশোহর-খুলনার ‘খাঞ্জালি পীর’ বা খাঁ জাহান আলি এবং জৌনপুর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা খাজা জাহান অভিন্ন ব্যক্তি বলিয়া মনে করি। প্রথমতঃ, সাধারণ প্রবাদে চলিয়া আসিতেছে, তিনি দিল্লীশ্বর মামুদ শাহের সময় জায়গীর পাইয়া বঙ্গে আসেন; কাৰ্য্যতঃ দেখা যাইতেছে, দিল্লীশ্বর মামুদ (তোগলক) শর্কী রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁহার আমলেই খাঁ জাহান উক্ত শর্কী বা পূৰ্ব্ব দেশীয় রাজ্যের অধিপতি হন এবং বঙ্গে আসেন। দ্বিতীয়তঃ, ঢাকায় একটি মসজিদের দ্বারদেশে একখানি শিলালিপি হইতে জানা যায়, উক্ত মসজিদ যিনি নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন তিনি একজন খাঁ, ‘মামুদ শাহের রাজত্বকালে তাঁহার উপাধি ছিল খাজা জাহান’;[৮] উক্ত মসজিদের নির্মাণ তারিখ ১৪৫৯ অব্দের ১৩ই জুন। ব্লকম্যান সাহেব অনুমান করেন যে, এই খাজা জাহান ও বাগেরহাটের খাঁ জাহান এক ব্যক্তি। উক্ত লিপি হইতে দেখা যাইতেছে, যে খাঁ মামুদ শাহের রাজত্বকালে খাজা জাহান উপাধিধারী ছিলেন, তিনিই ১৪৫৯ খৃষ্টাব্দে ঢাকার মজিদ নির্ম্মাণ করিয়াছেন। সুতরাং শৰ্কী শাসক খাজা জাহান ও খাঁ জাহান আলি এক ব্যক্তি। উক্ত মসজিদ বঙ্গেশ্বর নাসির শাহ বা নাসির উদ্দীন মামুদ শাহের (১৪৪২-১৪৬০) সময়ে নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল, কিন্তু উক্ত লিপিতে যে মামুদ শাহের কথা আছে, তিনি দিল্লীশ্বর মামুদ শাহ (১৩৯৪-১৪১৪) বলিয়াই বোধ করি, তাহারই সময়ে খাজা জাহান উপাধি হয়। বিশেষতঃ বঙ্গেশ্বর নাসির শাহ বলিয়াই খ্যাত, মামুদ শাহ বলিয়া তেমন পরিচিত নহেন; কারণ দিল্লীতে ও বঙ্গে বহু সংখ্যক মামুদ শাহ শাসনদণ্ড পরিচালনা করিয়াছেন।

তৃতীয়তঃ, একটি সন্দেহ হইতে পারে যে, খাজা জাহান যখন পালিত পুত্রের হস্তে জৌনপুরের রাজ্যভার দিয়া বঙ্গে আসেন, তখন তিনি অবশ্য প্রবীণবয়স্ক ছিলেন, সে ১৪০০ খৃষ্টাব্দের কথা; তাঁহার সমাধিতে তাঁহার মৃত্যুর তারিখ আছে, ১৪৫৯। তাহা হইলে সেই প্রবীণবয়স্ক ব্যক্তি আরও ৫৯ বৎসর কিরূপে বাঁচিয়াছিলেন? ইহারও উত্তর আছে। সবলে রাজ্য প্রতিষ্ঠার ৬ বৎসর পরে খাজা জাহান বঙ্গে আসেন; তখন তাঁহার বয়স ৪০ বৎসরের অতিরিক্ত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না; তখন তাঁহার পালিত পুত্র ইব্রাহিম ২০/২৫ বৎসর বয়স্ক থাকিতে পারেন; ইব্রাহিম ৪০ বৎসর কাল রাজত্ব করিতে পারিতেন কি না সন্দেহ। খাঁ জাহান যদি ৪০ বৎসর বয়সে বঙ্গে আসিয়া থাকেন, তবে তৎপরে আর ৫৯ বৎসর অর্থাৎ প্রায় ১০০ বৎসর বাঁচিয়া থাকা বিচিত্র নহে। খাঁ জাহানের মত সাধু পীরগণ খুব দীর্ঘজীবী হইতেন। শাহ জালাল তাব্রেজী ১৫০ বৎসর জীবিত ছিলেন। খাঁ জাহান যে অতি বৃদ্ধ বয়সে জরাজীর্ণ দুর্ব্বল দেহে বিদেশে জীবনলীলা সমাপ্তি করিয়াছিলেন, তাহা তাঁহার সমাধিলিপির আত্মপরিচয় হইতে জানা যায়।[৯]

চতুর্থতঃ, তিনি যে বঙ্গে আসিয়া ৫৯ বৎসর ছিলেন, তাঁহার বিস্তীর্ণ কার্য্যক্ষেত্র ও অসংখ্য পুণ্যকীর্তির তুলনায় তাহা অতিরিক্ত বোধ হয় না। তিনি যে জীবনের অন্ততঃ শেষ দশ বর্ষ কাল মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন, তাহা সহজে বুঝা যায়। তাঁহার সমাধিমন্দির ও প্রস্তরফলকসমূহ যেরূপ বহু যত্নে দূরদেশ হইতে সংগৃহীত হইয়া নানা কারুকার্য্যরঞ্জিত হইয়াছিল, তাহা সময়সাপেক্ষ বলিয়া বোধ হয়। তাঁহার কোন পুত্রসন্তান ছিল না। তিনি নিজের সমাধির জন্য যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করিয়া ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখে পতিত হন। বাগেরহাটে তাঁহার যে সমস্ত কীৰ্ত্তিচিহ্ন বর্তমান রহিয়াছে, তাহা সম্পন্ন করিতে অন্ততঃ ২০ বৎসর লাগিয়াছিল, তাহাতে অনুমাত্র সন্দেহ নাই। ইহার পূর্ব্বে পয়োগ্রাম কসবায় তাঁহার রাজধানী অন্ততঃ ১০ বৎসর কাল ছিল। তৎপূর্ব্বে সুন্দরবনের নানা স্থান আবাদ করা এবং যশোহর ও বারবাজারে অধিষ্ঠান করা প্রভৃতি কারণে ১০/১২ বৎসরের কম হয় নাই। ইহা হইতে মোটামুটি দেখা যাইতেছে যে, ৫৯ বৎসর কাল অতিরিক্ত গণনা নহে।

পঞ্চমতঃ, শাহ জালাল প্রভৃতি দরবেশের মত খাঁ জাহান সাধু চরিত্র ছিলেন; কিন্তু তিনি ঠিক তাঁহাদের মত কেবলমাত্র ধর্ম্মপ্রচারার্থ শিষ্যপরিবৃত হইয়া আসেন নাই। তাঁহার সহিত সৈন্যসামন্ত, লোকলস্কর, ধনদৌলত, সকলই ছিল, তিনি রাষ্ট্রবিজয়ী সেনাপতির মত বীর প্রতাপে রাজ্য জয় করিতে করিতে কীর্ত্তিচিহ্ন রাখিতে রাখিতে অগ্রসর হইতেছিলেন; তাঁহার কার্য্যগণ্ডী যশোহর হইতে চট্টগ্রাম পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ইহা দেখিয়াও তাঁহাকে খাজা জাহানের মত পদস্থ ও ক্ষমতাশালী শাসনকৰ্ত্তা বলিয়া বোধ হয়। বঙ্গে বা গৌড় রাজ্যে তখন যতই অরাজকতা বা গণ্ডগোল থাকুক, জৌনপুরের সুবিখ্যাত খাজা জাহান ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তিকে তেমন বিনারক্তপাতে দেশমধ্যে প্রবেশ করিতে হইত না, ইহা নিশ্চিত।

যাহা হউক, আমরা যতদূর বুঝতে পারিতেছি, তাহাতে জৌনপুরের শাসনকর্তা খাজা জাহান ও যশোহর-খুলনার খাঁ জাহানালি এক ব্যক্তি।[১০] প্রবাদ এই, হিন্দু-মুসলমান-ঘটিত কোন গুরুতর বিবাদের মীমাংসা জন্য তিনি সসৈন্যে বঙ্গে আসেন। আসিতে তাঁহার অনেক দিন লাগিয়াছিল। গঙ্গাপার হইয়া নদীয়ার মধ্য দিয়া ভৈরবের কূল দিয়া তিনি প্রথম বারবাজারে উপনীত হন। হয়ত তৎসন্নিকটেই তাঁহার কার্য্য ছিল এবং সেখানে থাকিয়া সেই কার্য্যের মীমাংসা করেন। এই বারবাজারেই তাঁহার কর্ম্মক্ষেত্রের দ্বার উদ্ঘাটিত হয়।

পাদটীকা :

১. ‘দুৰ্ব্বেশমাস্থায় সাক্ষাদিদ্ৰ ইহাগতঃ’–সেকশুভোদয়া। সাহিত্য, ১৩০১, ১০-১১ পৃ।

২. J. R. A. S. Vol. XIII. part 1. P. 285; বিক্রমপুরের ইতিহাস ৪৭ পৃ। রামপালে বল্লাল-বাড়ীর সন্নিকটে বাবা আদমের মজিদ আছে।

৩. লক্ষ্মণসেনের সময়ের দরবেশের নাম শাহ জালালউদ্দীন তাব্রেজী। জালালউদ্দীন তাঁহার নাম, তিনি তাব্রিজ সহরে জন্ম গ্রহণ করেন বলিয়া তাব্রেজী বলিয়া খ্যাত। শ্রীহট্টের শাহ জালালের নাম শাহ জালাল ইমনি। তিনি ইমন সহর হইতে আগত এবং সাধারণতঃ শাহ জালাল বলিয়া খ্যাত।– সাহিত্য, ১৩০১, ২ পৃ; ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’, (১৩১৭), ২য় ভাগ, ২য় খণ্ড, ১১ পৃ; Bloch’s Archaeological Survey Report, 1903, P. 24.

৪. ‘Sylhet appears to have been conquered by a small bandof Mahammadans in the reign of Bengal king Shamsuddin in 1384 A. D. The supernatural powers of the last Hindu king, Gour Govinda, proved ineffectual against the still more extraordinary powers of the Fakir Shah Jalal, who was the real leader of the invaders. Hunter, W. W. Statistical Accounts, Assam. Vol. II. কিন্তু এখানে সামউদ্দীন বলিতে সম্ভবতঃ সামসুদ্দীন ইলিয়াসকেই বুঝাইতেছে। কারণ হান্টার সাহেব যে দ্বিতীয় সামসুদ্দীনের কথা বলিয়াছেন, তাহার পুত্র সেকন্দর নহেন এবং দ্বিতীয় সামসুদ্দীনকে নিহত করিয়া রাজা গণেশ রাজ্যলাভ করেন। যাহা হউক, চতুৰ্দ্দশ শতাব্দীর শেষভাগে শ্রীহট্ট বিজয় হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই।

৫. অচ্যুতচরণ চৌধুরী মহাশয় আউলিয়াদিগের নাম দিয়া এই ৩৬০ সংখ্যা পূর্ণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন।— শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ ২য় ভাগ, ২য় খণ্ড ৩৮-৫১ পৃ।

৬. ‘The founder of the Jaunpur dynasty was the eunuch Khwajah-i-Jahan, Uizir of Sultan Mahmud II, of Delhi. In A. H. 796 (A. D. 1394 ) he had been governor of the Eastern provinces of the Delhi Empire with the title of Malik-us Sharq (East)’, Wright, H. N. Catalogue of Coins. Vol. II. P. 206; Elphinstone’s History, Bk. VI. P. 359; Stewart’s History. P. 110.

৭. ‘Mahmud first bestowed the title of Sultan-us Sharq on Malik Sarwar, a eunuch who already held the title of Khajah Jahan . ‘ – Riyaz-us-Salatin, ed. by M. A. Salam, P. 114.

৮. ‘A khan whose title is Khaja Jahan in the reign of Mahmud Shah.’-J. A. S. B., part 1. 1872, PP. 107-8; Khulna Gazetteer, P. 27.

৯. Sunder’s Antiquities of Bagerhat, PP. 8-15

১০. অন্য কেহ কেহও এইরূপ মনে করিয়াছেন। ব্লকম্যানের অনুমানের কথা পূর্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি। ‘পল্লীচিত্র’, ১৩২০, ভাদ্র, জনাব মোতাহারউল হক্ লিখিত ‘খাজাহান’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. ২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. ৩. নদী-সংস্থান
৪. ৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. ৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. ৬. সুন্দরবন
৭. ৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. ৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. ৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. ১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. ১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. ১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
১৩. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
১৪. ২. দ্বীপের প্রকৃতি
১৫. ৩. আদি হিন্দু-যুগ
১৬. ৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
১৭. ৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
১৮. ৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
১৯. ৭. মাৎস্য-ন্যায়
২০. ৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
২১. ৯. সেন-রাজত্ব
২২. ১০. সেন-রাজত্বের শেষ
২৩. ১১. আভিজাত্য
২৪. ১. তামস যুগ
২৫. ২. বসতি ও সমাজ
২৬. ৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
২৭. ৪. খাঁ জাহান আলি
২৮. ৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
২৯. ৬. পয়োগ্রাম কসবা
৩০. ৭. খালিফাতাবাদ
৩১. ৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৩২. ৯. হুসেন শাহ
৩৩. ১০. রূপ-সনাতন
৩৪. ১১. লোকনাথ
৩৫. ১২. হরিদাস
৩৬. ১৩. রামচন্দ্র খাঁ
৩৭. ১৪. গাজীর আবির্ভাব
৩৮. ১৫. মুকুট রায়
৩৯. ১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
৪০. ১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
৪১. পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
৪২. পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
৪৩. পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
৪৪. পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন