১১. লোকনাথ

সতীশচন্দ্র মিত্র

একাদশ পরিচ্ছেদ – লোকনাথ

অতি প্রাচীন যুগ হইতে বৃন্দাবন বিশাল অরণ্যই ছিল, সেখানে মুনিদিগের তপোবন হইয়াছিল। বৃন্দাবন ব্রজমণ্ডল বা পুরাতন শূরসেন রাজ্যের অন্তর্গত। মধুদৈত্যের নির্ম্মিত মধুপুরীরই পরবর্ত্তী নাম মথুরা। শূরসেনবংশীয় যাদবগণ মথুরার অধিবাসী ছিলেন। সেই যাদবকূলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয় এবং বৃন্দাবনে তাঁহার মধুর লীলা প্রকটিত হওয়ায় উহা পুণ্যতীর্থে পরিণত হইয়াছিল। অৰ্জ্জুন-পৌত্র মহারাজ পরীক্ষিৎ যখন ইন্দ্রপ্রস্থের সম্রাট, তখন তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্রনাভকে ব্রজমণ্ডলের রাজাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। বজ্রনাভই প্রপিতামহের স্মৃতিপূজার জন্য মদনমোহন, গোবিন্দ প্রভৃতি শ্রীবিগ্রহের সৃষ্টি ও সেবারম্ভ করেন। কালক্রমে শতাব্দীর পর শতাব্দীর নানা প্রাকৃতিক ও দৈশিক বিপ্লবে শ্রীবৃন্দাবনের পতন ঘটে। হিন্দু-বৌদ্ধের কলহ ও পরে বৈদেশিক শক ও মুসলমানের আক্রমণে ক্রমে ব্রজভূমি পুনরায় গহন কাননে পরিণত হয়। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে উহার পুনরুদ্ধার সাধিত হয় এবং তাহা সাধন করিয়াছিলেন মহাপ্রভুর শিষ্য ও ভক্তবর্গ। তন্মধ্যে অগ্রদূত হইয়াছিলেন, প্রসিদ্ধ লোকনাথ গোস্বামী। তিনি আমাদের যশোহর জেলার অধিবাসী। সেই কথাই এখানে বলিব।

কান্যকুব্জ হইতে আগত পঞ্চ ব্রাহ্মণের অন্যতম শ্রীহর্ষ ছিলেন ভরদ্বাজ গোত্রীয়। তাহার অধস্তন ১২শ পুরুষ উৎসাহ মহারাজ বল্লালসেনের সভায় এবং উৎসাহের পুত্র আহিত লক্ষ্মণসেনের রাজসভায় প্রকৃষ্ট কুলমর্য্যাদা পান। আহিতের পৌত্র শিয়ো বা শিরোভূষণের তিন পুত্র ছিলেন—নৃসিংহ, রাম ও দ্যাকর বা দিবাকার। ফুলের মুখটি কবি কৃত্তিবাস উক্ত নৃসিংহের বৃদ্ধ প্রপৌত্র। তৎ-প্রণীত রামায়ণের আত্মবিবরণ হইতে জানা যায়, পূর্ব্ববঙ্গে বিপ্লব বা মুসলমান আক্রমণ জন্য (আনুমানিক ১৩১০ খৃষ্টাব্দে) নৃসিংহ পূর্ব্ববঙ্গ হইতে গঙ্গাতীরে আসিয়া শান্তিপুরের নিকটবর্ত্তী ফুলিয়া গ্রামে বাস করেন, মধ্যম ভ্রাতা রামও সেখানে ছিলেন; পরে তাঁহার বংশধরগণ কেহ কেহ যশোহরের কয়েক স্থানে বাস করেন। রামের বংশধরদিগের কতক পীরালি দোষযুক্ত হইয়া এখনও চেঙ্গুটিয়ার নিকট বাস করিতেছেন। কনিষ্ঠ ভ্রাতা দ্যাকর বা দিবাকর গঙ্গাতীরে কাঞ্চনপল্লী বা কাচনা গ্রামে বসতি করেন। এই জন্য তাঁহার অধস্তন বংশীয়েরা ‘কাচনার মুখটি, দ্যাকরের সন্তান’ নামে পরিচিত।

দ্যাকরের পৌত্র ধর্ম্ম যশোহর জেলায় নড়াইল মহকুমার অন্তর্গত চিত্রানদীর তীরবর্ত্তী তালেশ্বর গ্রামে উঠিয়া যান। ধর্ম্মের পরবর্ত্তী তিন পুরুষ ঐস্থানে বাস করেন। তালেশ্বর গ্রামের যে মধ্যপাড়ায় তাঁহাদের বাস ছিল, তাহা এখনও মাঝপাড়া নামে খ্যাত। তথায় দ্যাকরের সন্তান বা ধর্ম্মের বংশধরেরা এখনও ‘মাঝপাড়া’র ভট্টাচাৰ্য্য’ বলিয়া সম্মানিত। ধর্ম্মের পুত্র পুরুষোত্তম, তৎপুত্র জগন্নাথ ঘটক, তৎপুত্র গোবিন্দ তালেশ্বরে বাস করিতেন। গোবিন্দের পুত্র পদ্মনাভ চক্রবর্ত্তী শিক্ষালাভের জন্য শান্তিপুরে আসিয়া মহাপণ্ডিত শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের কৃপালাভ করেন এবং সাধারণ শাস্ত্রের সঙ্গে ভক্তিশাস্ত্রে অধিকার লাভ করিয়া অবশেষে শ্রীঅদ্বৈতের মন্ত্রশিষ্য হন; সম্ভবতঃ সেই সময়েই তাঁহার গুরুদত্ত নাম হইয়াছিল পরমানন্দ। শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের জন্ম হয় ১৪৩৪ খৃষ্টাব্দে, পদ্মনাভ বয়সে তাঁহার ৫/৬ বৎসরের কনিষ্ঠ, সুতরাং তাঁহার জন্ম ১৪৪০ খৃষ্টাব্দে ধরিতে পারি। পদ্মনাভ যখন শান্তিপুরে শিক্ষার্থী, তখন তাঁহার পিতৃবাসের সন্নিকটে পীরালির অত্যাচার আরব্ধ হইয়াছে। এজন্য পদ্মনাভ পাঠশেষ করিবার পর তালেশ্বরে বাস করিতে সাহসী না হইয়া, বর্তমান মাগুরা মহকুমার অন্তর্গত তালখড়ি গ্রামে আসিয়া বসতি করেন ও চতুষ্পাঠী খুলেন। তিনি মধ্যে মধ্যে শান্তিপুর ও নবদ্বীপে আসিয়া ভক্তিচর্চ্চা করিতেন এবং শ্রীচৈতন্যের জন্মের বহুপূর্ব্বে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের প্রচারিত ভক্তিভাব-লহরী দেশে আনিয়া বিতরণ করিতেন।

পদ্মনাভ মধ্যে মধ্যে সস্ত্রীক গুরুগৃহে আসিতেন। তাঁহার পত্নীর নাম সীতা, এবং শ্রী অদ্বৈতের পত্নীও ছিলেন সীতাদেবী, উভয় সীতাদেবীর পরম সম্প্রীতি ছিল। যেমন পদ্মনাভ তেমনই তাঁহার স্ত্রী, পরম ভক্তিমতী ছিলেন।

‘যৈছে পদ্মনাভ তৈছে তার পত্নী সীতা।
পরম বৈষ্ণবী ঘেঁহো অতি পতিব্রতা’— নরোত্তম-বিলাস, ১ম।

এই আদর্শ দম্পতীর চারি পুত্র হয়— ভবনাথ, প্রগল্ভ বা পূর্ণানন্দ, লোকনাথ ও রঘুনাথ। তৃতীয় পুত্র লোকনাথ চক্রবর্ত্তীর কথাই আমরা বলিব।’’ তিনিই চৈতন্যযুগে সৰ্ব্বপ্রথমে বৃন্দাবনে গিয়া তীর্থোদ্ধারের কার্য্য আরম্ভ করেন এবং কালে লোকপাবন লোকনাথ গোস্বামী নামে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্যতম গুরু হন। আনুমানিক ১৪৮৩/৪ খৃঃ অব্দে তালখড়ি গ্রামে লোকনাথের জন্ম হয়, বয়সে তিনি মহাপ্রভু অপেক্ষা ২/৩ বৎসরের বড়।

পদ্মনাভ তাঁহার প্রতিভাসম্পন্ন পুত্র লোকনাথকে অল্পবয়সে বিদ্যাশিক্ষার জন্য শান্তিপুরে নিজগুরু শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের নিকট পাঠাইয়া দেন এবং ‘কৃষ্ণলীলামৃত শ্রীমদ্ভাগবত’ পড়িবার জন্য পুত্রকে আদেশ করেন। আচার্য্য প্রভু লোকনাথকে শিষ্যরূপে পাইয়া আনন্দিত হইলেন; লোকনাথও গদাধর পণ্ডিতের সঙ্গে গুরুর নিকট সটীক শ্রীমদ্ভাগবত পড়িলেন। তখন উঁহাদের সতীর্থ ছিলেন, স্বয়ং গৌরাঙ্গ। মহাপুরুষের সঙ্গে ভেষজের ন্যায় লোকনাথের উপর কার্য্যকারী হইল :

‘শ্রীগৌরাঙ্গ সঙ্গের গুণে অতি চমৎকার।
লোকনাথের হৈল ভাগবতে অধিকার।।’—অঃ প্রঃ ১২ শ

ভাগবতে অধিকার লাভের ফল কখনও ব্যর্থ হয় না। লোকনাথ কৃষ্ণলাভের জন্য ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। তখন আচার্য্য প্রভু তাঁহাকে মন্ত্রদীক্ষা দিলেন। দীক্ষার অবশ্যম্ভাবী ফল ফলিল; লোকনাথের অপূর্ব্ব শুদ্ধা প্রেম-ভক্তির উদয় হইল। এমন সময়ে শ্রীঅদ্বৈত তাঁহাকে প্রকৃত তত্ত্বানুসন্ধান শিক্ষার জন্য নিজশিষ্য শ্রীগৌরাঙ্গের হস্তে সমর্পণ করিলেন। গৌরাঙ্গও তাঁহাকে হাতে পাইয়া একেবারে আত্মসাৎ করিলেন।

‘এত কহি প্ৰিয় শিষ্য গৌরে সমর্পিলা।
শ্রীগৌরাঙ্গ লোকনাথে আত্মসাথ কৈলা॥’

লোকনাথ ক্রমে সকল শাস্ত্রে অসাধারণ পণ্ডিত হইলেন বটে, কিন্তু তাঁহার ‘ভক্তিপথে মহা আর্ত্তি’ হইল, মহা বৈরাগ্য আসিয়া তাঁহার হৃদয় অধিকার করিতেছিল। লোকনাথ শান্তিপুর হইতে গৃহে আসিয়া শাস্ত্রচর্চ্চা করিতে লাগিলেন, সে দেশে তখন তাঁহার ন্যায় পণ্ডিত কেহ ছিলেন না।

কিছুদিন পরে পূর্ব্ববঙ্গ ভ্রমণে যাইবার সময় শ্রীগৌরাঙ্গ নিজগণ সহ একদিন লোকনাথের বাসভূমি তালখড়ি গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ‘অদ্বৈত প্রকাশে’ আছে, তখন :

‘পদ্মনাভ তাঁরে সৎকার কৈলা বিধিমত।
মহাপ্রভু তথি বাস কৈলা দিন কত।।’

তখন গৌরাঙ্গদেব নিমাই পণ্ডিত নামে অধিক পরিচিত, তাঁহার ব্যাকরণের টিপ্পনী সকল টোলে পড়িত, তাঁহার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি দেশময় বিস্তৃত ছিল। যশোহর তখন পণ্ডিতের দেশ ছিল, শত শত অধ্যাপক বহু ভদ্রপল্লীর গৌরববর্দ্ধন করিতেন। নিমাই পণ্ডিতের আগমন সংবাদে নিকটবর্ত্তী স্থানের বহুপণ্ডিত পদ্মনাভের গৃহে সমবেত হইলেন; রাত্রিতে দীপালোকে এক মহতী সভা হইল; বহুক্ষণ তর্কযুদ্ধ চলিয়াছিল; অবশেষে শ্রীগৌরাঙ্গ নিজমত স্থাপন করিয়া জয়ী হইলেন। তাহাতে পদ্মনাভও আপনাকে ভাগ্যবান বলিয়া মনে করিলেন।

‘পদ্মনাভ চক্রবর্ত্তীর অতি ভাগ্যোদয়।
যাঁর ঘরে শ্রীচৈতন্যের হইল বিজয়।।’

শ্রীগৌরাঙ্গ পূর্ব্ববঙ্গ ভ্রমণের পর লোকনাথকে তালখড়িতে রাখিয়া নবদ্বীপে ফিরিলেন। কয়েক বৎসর আর তাঁহার সহিত লোকনাথের দেখা হয় নাই।

লোকনাথের বৈরাগ্য ক্রমেই বাড়িতেছিল। তিনি বিবাহ করেন নাই, তাঁহার জ্যেষ্ঠদ্বয়ের বিবাহ হইয়াছিল। ক্রমে ক্রমে অল্পদিনের অগ্রপশ্চাতে তাঁহার পিতামাতার কালপ্রাপ্তি হইল। তখন লোকনাথ নির্মুক্ত, একদিন নিশীথরাত্রিতে তিনি পাগলের মত ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ বলিতে বলিতে জন্মের মত গৃহত্যাগ করিলেন।

“বিষম সংসার সুখ ত্যজি মল প্ৰায়।
প্রভু সন্দর্শনে যাত্রা কৈলা নদীয়ায়॥’

আর তিনি গৃহে ফিরেন নাই; যশোহরের সহিত তাঁহার সম্বন্ধ এইখানেই শেষ।

লোকনাথ উন্মত্তের মত ছুটিয়া শ্রান্ত ক্লান্ত দেহে নবদ্বীপে পৌঁছিয়া শ্রীগৌরাঙ্গ সাক্ষাৎ করিলেন। শ্রীগৌরাঙ্গ তখন ভাবাবেশে বাতুল, বৃন্দাবন-লীলারস-পানে আত্মহারা। তখনও তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নাই বটে, কিন্তু কৰ্ম্ম সন্ন্যাস হইয়াছে, সৰ্ব্ববিধ আসক্তিনাশ করিয়া একমাত্র কৃষ্ণলীলারসে নিমজ্জিত হইয়া যেন কালের অপেক্ষা করিতেছিলেন। এমন সময় লোকনাথ গিয়া উপস্থিত হইলেন, লোকনাথ তাঁহার মর্ম্মী ভক্ত, তাহা তিনি জানিতেন; লোকনাথ গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়া নবজীবনের পন্থা দেখাইয়াছেন। সময় বুঝিয়া শ্রীগৌরাঙ্গ তৎক্ষণাৎ লোকনাথকে বৃন্দাবনে যাইয়া তীর্থোদ্ধারের জন্য আজ্ঞা দিলেন। বৃন্দাবনের যে ভাবী চিত্র তিনি মনে মনে অঙ্কন করিতেছিলেন, নাট্যরঙ্গে লীলাভিনয়ে যে ধামের চিত্র উদ্ভাসিত করিবার জন্য তাঁহার দিবসযামিনী বিগত হইতেছিল, যে স্থানকে তাঁহার নূতন মতের কেন্দ্রস্থল করিয়া নূতন ধর্ম্ম গড়িয়া ভারত ভাসাইবার কল্পনা জাগিয়াছিল, তাহারই উদ্ধারের অগ্রদূত করিয়া তিনি উপযুক্ত ভৃত্য লোকনাথকে পাঠাইলেন। সমরক্ষেত্রে সৈনিকের মত তিনি সে আদেশ প্রতিপালন করিয়াছিলেন।

ভূগর্ভ গোস্বামী নামক একজন সমধর্মী ভক্তের সঙ্গে লোকনাথ অবিলম্বে বৃন্দাবন যাত্রা করিলেন, আর তিনি দেশে ফিরিয়া আসেন নাই। তাঁহার পরবর্ত্তী জীবন নববৃন্দাবনের ইতিহাসের সঙ্গে দৃঢ়সম্বন্ধ। সেখানে তিনি আত্মপ্রকাশ না করিয়া শুধু প্রভুর আদেশ পালন করেন। এমন কি, শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী যখন শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনার কালে সকল ভক্ত পণ্ডিত ও গোস্বামী প্রভুদিগের অনুমতি প্রার্থনা করেন, তখন লোকনাথ তাঁহাকে আশীষ দান করিলেন বটে, কিন্তু স্পষ্টতঃ বলিয়া দিলেন, তিনি যেন গ্রন্থমধ্যে তাঁহার কথা কিছুমাত্র উল্লেখ না করেন। কবিরাজ গোস্বামী সে কঠোর আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতে সাহসী হন নাই। এজন্য আমরা এই নিস্পৃহ ভক্তের অনেক বৃত্তান্ত জানিতে পারি না। তবুও পরবর্ত্তী যুগের কয়েকখানি প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব গ্রন্থে কিছু কিছু তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। যাহা জানা যায়, তাহা উহার বৃন্দাবন-জীবনের ইতিহাস, যশোহরের ইতিহাস নহে। সুতরাং এখানে অপ্রাসঙ্গিক।[২]

শ্রীবৃন্দাবনে লোকনাথই এমন রাধাবিনোদ নামক শ্রীবিগ্রহ লাভ করিয়া অলৌকিক নিষ্ঠার সহিত তাঁহার সেবারম্ভ করেন এবং দীনহীন নিষ্কিঞ্চন ভক্তের চিত্র জগৎবাসীকে দেখান; শ্রীগৌরাঙ্গের আদেশমত বৃন্দাবনে তিনি প্রথম প্রথম বনে বনে ঘুরিয়া তিন শতাধিক তীর্থের আবিষ্কার ও মাহাত্ম্য প্রচার করেন; অবশেষে তিনি নির্জ্জন কুঞ্জকুটীরে দিবারাত্রি যে কঠোর সাধনা করিতেন, তাহাতে সমগ্র বৃন্দাবনে রোমাঞ্চ সঞ্চার করিয়াছিল। তিনি আত্মগোপন করিয়া লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকিতেন; নিজের সম্বন্ধে কোন কথা কাহাকেও জানিতে দিতেন না; কাহাকেও শিষ্য করিতেন না; সৰ্ব্বজাতীয় প্রতিষ্ঠাকে শূকরী-বিষ্ঠার মত পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। কিন্তু একটি মাত্র স্থলে তাঁহার পরাজয় হইয়াছিল-সে শিষ্যের নিকটে, শিষ্যের একান্ত ভক্তির শক্তিতে। রাজসাহী জেলার জনৈক লক্ষপতি জমিদার-পুত্র নরোত্তম দত্ত যখন বিপুল সম্পত্তি পরিত্যাগ করিয়া পাগলের মত গৃহত্যাগী হইয়া বৃন্দাবনে যান, তখন তিনি লোকনাথের রূপ ও প্রতিভা দেখিয়া মুগ্ধ হন এবং মনে মনে তাঁহার চরণে আত্মসমর্পণ করিয়া গুরুরূপে তাঁহাকেই বরণ করেন। কিন্তু লোকনাথ শিষ্য করিবেন না বলিয়া প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সুতরাং নরোত্তমের পক্ষে গুরুকৃপা লাভ করা দুঃসাধ্য হইল। কিন্তু একান্ত ভক্তিতে সকলই সাধ্য হয়, নরোত্তমের গুরুলাভ তাহার দৃষ্টান্তস্থল। একলব্য বনে বসিয়া দ্রোণাচার্য্যের শক্তিলাভ করিয়াছিলেন, নরোত্তম কি কঠোর সাধনায়, অদ্ভুত অলক্ষিত সেবায় অবশেষে গুরুদেবের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়াছিলেন, তাহা প্ৰেম- বিলাস প্রভৃতি কয়েকখানি ভক্তিগ্রন্থে বিবৃত আছে। যে নরোত্তম ঠাকুর অপূর্ব্ব ভাবমিশ্রিত কীৰ্ত্তন- রঙ্গে সমগ্র উত্তর বঙ্গে ও আসামে শ্রীচৈতন্য প্রবর্ত্তিত ভক্তিধর্ম্মের প্লাবন প্রবাহিত করিয়াছিলেন, যে নরোত্তমের প্রাণস্পর্শী নাম বা পদ গান না করিলে ভক্ত বৈষ্ণবের সুপ্রভাত হয় না, ভিক্ষান্ন জুটে না, সে নরোত্তমের ভক্তি-প্রস্রবণের মূলস্থান লোকনাথ। আর লোকনাথের জন্মস্থান আমাদের যশোহর প্রাচীন যুগ হইতে বহুভাবে বহুদেশে আধিপত্য বিস্তার করিয়া যশোমণ্ডিত হইয়াছে।

পাদটীকা :

১. যশোহর দেশেতে তালগৈড়া গ্রামে স্থিতি।
মাতা সীতা, পিতা পদ্মনাভ চক্রবর্ত্তী।- ভক্তিরত্নাকর, ১ম তরঙ্গ

এই তালগৈড়াকে নরোত্তম-বিলাস, প্রেম-বিলাস, প্রভৃতি গ্রন্থে তালগড়ি বলা হইয়াছে। প্রকৃতপক্ষে ইহা তালখণ্ডী বা তালখড়ি গ্রাম। এই গ্রাম যশোহরের অন্তর্গত। পদ্মনাভের ‘যশোরিয়া’ বলিয়া খ্যাতি ছিল (অদ্বৈতপ্রকাশ, ১২শ)। এইস্থানের ভরদ্বাজ-গোত্রীয় দ্যাকরের সন্তানেরা তালখড়ির ভট্টাচার্য্য বলিয়া প্রসিদ্ধ। ঐ স্থানের এবং ঐ বংশের কৃতী সন্তান, বাৎস্যায়ন ভাষ্যের অনুবাদক মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ তর্কবাগীশ মহাশয় এক্ষণে কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের প্রখ্যাতনামা অধ্যাপক ও দেশপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত। তিনি পূর্ণানন্দের অধস্তন বংশধর। জ্যেষ্ঠ ভবনাথের বংশে প্রসিদ্ধ নীলাম্বর ও ঋষিবর মুখোপাধ্যায় জয়দিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরিশিষ্টে বংশলতিকা প্রদত্ত হইল।

২. সমুৎসুক ভক্তপাঠকবর্গ মৎপ্রণীত ‘সপ্ত-গোস্বামী’ গ্রন্থে লোকনাথের সংক্ষিপ্ত জীবনকথা পাঠ করিবেন। অন্যত্র একত্র সব কথা পাওয়া যায় না।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. ২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. ৩. নদী-সংস্থান
৪. ৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. ৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. ৬. সুন্দরবন
৭. ৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. ৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. ৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. ১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. ১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. ১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
১৩. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
১৪. ২. দ্বীপের প্রকৃতি
১৫. ৩. আদি হিন্দু-যুগ
১৬. ৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
১৭. ৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
১৮. ৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
১৯. ৭. মাৎস্য-ন্যায়
২০. ৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
২১. ৯. সেন-রাজত্ব
২২. ১০. সেন-রাজত্বের শেষ
২৩. ১১. আভিজাত্য
২৪. ১. তামস যুগ
২৫. ২. বসতি ও সমাজ
২৬. ৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
২৭. ৪. খাঁ জাহান আলি
২৮. ৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
২৯. ৬. পয়োগ্রাম কসবা
৩০. ৭. খালিফাতাবাদ
৩১. ৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৩২. ৯. হুসেন শাহ
৩৩. ১০. রূপ-সনাতন
৩৪. ১১. লোকনাথ
৩৫. ১২. হরিদাস
৩৬. ১৩. রামচন্দ্র খাঁ
৩৭. ১৪. গাজীর আবির্ভাব
৩৮. ১৫. মুকুট রায়
৩৯. ১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
৪০. ১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
৪১. পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
৪২. পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
৪৩. পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
৪৪. পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন