সতীশচন্দ্র মিত্র
যশোহর-খুলনার সমতল ভূমি ক্রমে দক্ষিণদিকে নিম্ন।[১] সুতরাং জলের গতি সর্ব্বত্রই দক্ষিণদিকে। নদীগুলির মধ্যে অধিকাংশই দক্ষিণবাহিনী। যে দুই চারিটি নদী পূর্ব্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত আছে, তাহারা বহুধা বিভক্ত হইয়া শুধু দক্ষিণমুখী শাখাসমূহের দেহপুষ্টি করে। পূর্ব্বদিক হইতে আরম্ভ করিলে দেখা যায়, কুষ্ঠিয়ার সন্নিকটে গৌরী, গোরাই বা গড়ই নদী পদ্মা হইতে বাহির হইয়া নদীয়া জেলা দিয়া যশোহরে প্রবেশ করিয়া কুমার নদের সহিত মিশে এবং পরে কুমারের শাখা বারাসিয়া দিয়া দক্ষিণ মুখে প্রবাহিত হয়। কিন্তু কালে গৌরীর জলপ্রবাহ এত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় যে, বারাসিয়া হইতে এলেংখালি নামে একটি পৃথক শাখা বাহির হইয়া যায়। পূর্ব্বে বারাসিয়ার নিম্নে মধুমতী নাম ছিল, এখন এই এলেংখালিও বিস্তার লাভ করিয়া মধুমতীর অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। অনেক দূরে আসিয়া যেখানে মাণিকদহের সন্নিকটে মধুমতী ডানদিকে আঠারবাঁকী শাখা প্রসারিত করিয়াছে, সেখান হইতে ইহা খুলনা জেলার পূর্ব্বসীমা ধরিয়াছে। ক্রমে যাইতে যাইতে ইহার বিস্তার ও বলবৃদ্ধির সঙ্গে মধুমতী নাম পরিবর্তিত হইয়া বলেশ্বর হইয়াছে। কচুয়ার সন্নিকটে ভৈরব আসিয়া এই বলেশ্বরে মিশিয়াছে। বলেশ্বর ক্রমে বিষখালি, পানগুচি, কচা, ভোলা, পাঁকাসিয়া প্রভৃতি বহুনদীর জলস্রোত লইয়া হরিণঘাটার বিখ্যাত মোহানায় সমুদ্রের আকারে বঙ্গোপসাগরে আত্মোৎসর্গ করিয়াছে।
গৌরী পূর্ব্বে অত্যন্ত প্রবল ছিল। এমন কি ৬০/৭০ বৎসর পূর্ব্বে পদ্মার জলোচ্ছ্বাস ইহাকেই প্রধান পথ করিবে বলিয়া আশঙ্কাও হইয়াছিল। কিন্তু হঠাৎ পদ্মার গতি-পরিবর্তন জন্য সে আশঙ্কা দূর হইয়াছে। অধিকন্তু গৌরী এক্ষণে হীনবীর্য্য হইয়া পড়িয়াছে। যাহা বাকী ছিল, কুষ্ঠিয়ার নিকট রেলওয়ে লাইনের সেতু নির্ম্মাণ হওয়াতে, তাহাও হইয়াছে। এক্ষণে গৌরী স্থানে স্থানে মজিয়া আসিতেছে; বৎসরের কতক সময়ে বড় বড় নৌকা চলাচলেরও অসুবিধা উপস্থিত হয়। তবুও গৌরী-মধুমতীই যশোহর-খুলনার মধ্যে এক্ষণে সৰ্ব্বাপেক্ষা প্রবল নদী।
গৌরীর পশ্চিমদিকে মাথাভাঙ্গা নামক শাখা পদ্মা হইতে বাহির হইয়াছে। নদীয়ার অন্তর্গত আলমডাঙ্গা রেলওয়ে ষ্টেশনের কাছে, এই মাথাভাঙ্গা হইতেই কুমার নদ প্রবাহিত হইয়া যশোহরে প্রবেশ করিয়াছে। প্রায় ৮০ বৎসর পূর্ব্বে মাথাভাঙ্গার মূলস্রোত দুর্ব্বল হওয়াতে কুমারের প্রতাপ খর্ব্ব করিবার জন্য উহার মুখে বাঁধ দিয়া বা অন্যোপায়ে স্রোতের গতি ফিরাইবার চেষ্টা হইয়াছিল। কিন্তু নদী আপন পথ লয়, পরের বাধা মানে না। সুতরাং চেষ্টা সফল হয় নাই। বহুদিন পর্য্যন্ত কুমার বৎসর ভরিয়া সুপেয় সলিলপূর্ণ থাকিয়া সৰ্ব্ববিধ তরণীর গমনপথ হইত। কিন্তু এখন আর ইহার সে অবস্থা নাই।
কুমারের পর মাথাভাঙ্গা হইতে আর একটি শাখা বাহির হইয়াছিল, তাহার নাম নবগঙ্গা। কিন্তু সেই মুখের কাছে, চুয়াডাঙ্গার পূর্ব্বদিকে এক বিলের মধ্যে পড়িয়া কালে মূল মাথাভাঙ্গার সহিত উহার সংযোগ নষ্ট হইয়া যায়। সুতরাং তথা হইতে নদী মজিয়া জলজবৃক্ষে পরিপূর্ণ হইয়া রুদ্ধগতি হইয়াছে। মাগুরা নগরের উত্তরাংশে মুচিখালি নামক একটি খালের দ্বারা নবগঙ্গার সহিত কুমারের মিলন হইয়াছিল। কুমার এই সংযোগের ফলে নবগঙ্গাকে পুনর্জীবিত করিয়াছে। কুমার পূর্ব্বমুখে গৌরীতে মিশিয়া গিয়াছে এবং অপর পার হইতে বাহির হইয়া চন্দনা নামক পদ্মার অন্য শাখার সহিত ইহার সংযোগ হইয়াছে। কুমার পুনরায় আত্মপ্রকাশ করিয়া ফরিদপুর জেলায় বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত আছে। নবগঙ্গা কুমারের জলে সঞ্জীবিত হইয়া স্বচ্ছসলিলে উভয়কূলে সোণা ফলাইয়া, যশোহর জেলার উত্তরাংশের যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি সাধন করিয়াছে। মাগুরা, বিনোদপুর, সত্রাজিৎপুর, নহাটা, সিঙ্গিয়া, নলদী, রায়গ্রাম, লক্ষ্মীপাশা, লোহাগড়া প্রভৃতি বিখ্যাত স্থানগুলি নবগঙ্গার ক্রীড়াভূমির ফল। মাগুরা হইতে ৩/৪ মাস কাল এবং বিনোদপুর হইতে লোহাগড়া পর্য্যন্ত বারমাস সমভাবে নবগঙ্গার নৌকার যাতায়াত চলে। ইহার ‘সুধাসম স্বাদু নীর’ স্বাস্থ্যের পক্ষে পরম উপাদেয়। ইহার তীরভূমিতে অপরিমিত শস্য ফলে। খাদ্যদ্রব্যের দুর্গতি সর্ব্বত্র হইলেও এখনও নবগঙ্গার পার্শ্ববর্ত্তী স্থানের লোকে মৎস্য-দুগ্ধের তেমন অভাব অনুভব করে না। লোহাগড়া হইতে নবগঙ্গা সোজা কালনার নিকট মধুমতীতে মিশিয়াছিল, কিন্তু সে অংশ এক্ষণে মজিয়া গিয়াছে, কারণ বাণকাণা নামক একটি শাখা এই স্থান হইতে নবগঙ্গার জল লইয়া কালিয়ার পার্শ্ববর্ত্তী কালীগঙ্গায় মিশাইতেছে। এবং কালীগঙ্গা গাজির হাটের নিকট আতাই নদীতে আত্মসমর্পণ করিয়াছে। আতাই গিয়া খুলনার নিকট ভৈরবে পড়িয়াছে। সম্প্রতি বড়দিয়ার একটি খাল (Halifax Canal) কাটিয়া মধুমতীর সহিত কালীগঙ্গার যোগ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ঐ পথে মধুমতীর মিষ্টজল কালীগঙ্গা, আতাই ও মুজদখালি দিয়া ভৈরবে পড়িয়া উহার বেগবৃদ্ধি করিয়া অন্বর্থনামা করিতেছে।
নবগঙ্গা যেখানে মাথাভাঙ্গা হইতে জন্মলাভ করিয়াছিল, তাহারই ২/৩ মাইলের মধ্যে, জয়রামপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের উত্তরে চিত্রা নামক আর এক শাখা বাহির হয়। ভাগ্য উভয়েরই এক। নবগঙ্গার মত চিত্রাও মাথাভাঙ্গার জলস্রোতে বঞ্চিত হইয়া, আঁকাবাঁকা ভাবে পূৰ্ব্ব- দক্ষিণমুখে প্রবাহিত হইয়াছে। অন্যদিকে ঝিনাইদহের উত্তর-পশ্চিম কোণে মথুরাপুরের সন্নিকটে ব্যাঙ্ নামক একটি ক্ষুদ্র স্রোত নবগঙ্গা হইতে বাহির হইয়া নলডাঙ্গার পার্শ্ব দিয়া কিছু দূরে আসিয়া ফটকী[২] বা যদুখালি নাম ধারণপূর্ব্বক চিত্রার সহিত মিশিয়াছে। ঘোড়াখালি নামক একটি খনিতখাল নলদীর নিম্নে নবগঙ্গাকে নড়াইলের উত্তরস্থিত চিত্রা ও ফটকীর সম্মিলিত প্রবাহের সহিত মিশাইয়া দিয়াছে।[৩] এতদূরে আসিয়া চিত্রা নবগঙ্গার স্রোতঃসলিলে সঞ্জীবনী শক্তি লাভ করিয়াছে এবং বিস্তীর্ণ নদীরূপে নড়াইলের পার্শ্বদিয়া চলিয়া গিয়াছে। যাহাকে এক্ষণে আফ্রার খাল বলে, উহাই পূর্ব্বে চিত্রার মূল প্রবাহ ছিল এবং ঐ পথে চিত্রানদী আফ্রা ও সেখহাটির সন্নিকটে ভৈরবে মিশিয়াছিল। প্রাচীন তন্ত্রশাস্ত্রে সেই চিত্রা-ভৈরব সঙ্গমস্থানের প্রসিদ্ধি আছে। এক্ষণে চিত্রার প্রবাহ নড়াইলের কিছুদূরে গোবরা হইতে একটি খাল দিয়া গাজীরহাটের সন্নিকটে আতাই নদীতে মিশিয়াছে। এইরূপে চিত্রা ও কালীগঙ্গার দ্বারা নবগঙ্গার জলভার বহন করিয়া, এই প্রাচীন মালুয়ার খাল বা আতাই নদী কতক জল সুজদখালি নামক সোজাপথে ভৈরবকে দিয়াছে এবং অবশিষ্ট জলভার লইয়া গিয়া নিজে শোলপুরের নিকট ভৈরবে বিলীন হইয়াছে। এক্ষণে দেখা যাউক, এই যে কত নদী আসিয়া যে ভৈরবে মিশিতেছে, সে ভৈরবের গতি বা অবস্থা কি।
ভৈরবই এতদঞ্চলের সর্ব্বপ্রধান সুদীর্ঘ নদ। ‘সিন্ধু-ভৈরব-শোণ’ একত্রযোগে নদ-পৰ্যায়ে পড়িয়া ইহার মাহাত্ম্য কীৰ্ত্তন করিতেছে। ইহা একটি তীর্থনদ। কত নদীর নামে অন্য নদীর নাম আছে, কিন্তু ভৈরবের নামে অন্য কোন নদ ভারতবর্ষে নাই। এক সময়ে ইহা নামের অনুরূপ ভয়ঙ্কর মূর্তিতে বিরাজ করিত। উপদ্বীপে বড় নদীগুলি প্রায়ই মোটামুটি দক্ষিণমুখী। ভৈরব তাহা নহে। সুতরাং যাইতে যাইতে বহুনদীর সহিত ইহার সম্মিলন হইয়াছে। ভৈরব নানাস্থানের নানা নদীর সহিত আত্মাহুতি দিতে দিতে, নিজে সঙ্কুচিত হইয়া গিয়াছে। সুতরাং ভৈরবের আর সেদিন নাই।
মালদহের মধ্য দিয়া আসিয়া শ্রুতকীৰ্ত্তি মহানদ যেখানে পদ্মায় পড়িয়াছে, তাহারই অপর পারে যেন সেই নদই ভৈরব নাম ধারণপূর্ব্বক বাহির হইয়াছিল। অনেক দূর আসিয়া ইহা পদ্মার অন্য একটি দক্ষিণবাহিনী শাখা জলঙ্গীর সহিত মিশিয়াছে। যুক্ত প্রবাহ হইতে মুক্ত হইয়া ভৈরব পুনরায় মেহেরপুরের পশ্চিমদিয়া বর্ত্তমান জয়রামপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের পশ্চিমে পদ্মার আর একটি শাখা মাথাভাঙ্গার সহিত মিশিয়াছে। বৰ্ত্তমান দর্শনা রেলওয়ে ষ্টেশনের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণ হইতে একটি প্রকাণ্ড বৃত্তাকার বাঁকে এই যুক্তপ্রবাহ ঘুরিয়াছিল। ঐ বাঁকের দক্ষিণ-পূর্ব্ব কোণ হইতে ভৈরব মাথাভাঙ্গা হইতে বিচ্যুত হইয়া যশোহরে প্রবেশ করিয়াছে। ইহা ক্রমে কোটচাঁদপুর পর্য্যন্ত পূৰ্ব্বমুখে আসিয়া পরে দক্ষিণমুখী হইয়াছে। ৫/৭ মাইল আসিয়া চৌগাছার উত্তরে তাহিরপুর নামক স্থানে ভৈরব দক্ষিণদিকে কপোতাক্ষ শাখা ত্যাগ করিয়া, নিজে পূৰ্ব্বদিকে প্রবাহিত হইয়াছে। এই স্থান হইতে উভয় নদী অগ্রসর হইতে হইতে ক্রমশঃ প্রবল আকার ধারণ করিয়াছে। যশোহর-খুলনার আৰ্য্যসভ্যতা এই দুই নদীপথে প্রবাহিত হইয়া উভয়ের কূলে কূলে সমৃদ্ধ ও জ্ঞানালোক-দীপ্ত পল্লীর সৃষ্টি করিয়াছে।
ভৈরব ক্রমান্বয়ে বামে দক্ষিণে বারবাজার, মুড়লী কসবা (বর্তমান যশোহর), বসুন্দিয়া, সেখহাটী (জগন্নাথপুর), আলিনগর (নওয়াপাড়া), পয়ঃগ্রাম (কসবা), ফুলতলা, দৌলতপুর, সেনহাটী, সেনেরবাজার, আলাইপুর (চাঁদপুর), ফকরিহাট, পাণিঘাট, বাগেরহাট (খলিফাতাবাদ) ও কচুয়া প্রভৃতি প্রসিদ্ধ স্থান রাখিয়া বলেশ্বরে মিশিয়াছে। এদিকে কপোতাক্ষ বামে দক্ষিণে গুয়াতলী, চৌগাছা, গঙ্গানন্দপুর, পলুয়া, মাগুরা বোধখানা, লাউজানি (ব্রাহ্মণনগর), ত্রিমোহানী, সাগরদাঁড়ি, কুমিরা, তালা, কপিলমুনি, রাডুলি, কাটিপাড়া, বড়দল, চাঁদখালি, আমাদি প্রভৃতি স্থানের উদ্ভবসাধন করিয়া সুন্দরবনের মধ্যে খোলপেটুয়ার সহিত মিশিয়াছে। এই সঙ্গমস্থানেই বর্তমান কপোতাক্ষ ফরেষ্ট ষ্টেশন। তথা হইতে যুক্তনদী বিশাল বিস্তার লাভ করিয়া আড়পাঙ্গাসিয়া নামে মালঞ্চ মোহানায় বঙ্গোপসাগরে পড়িয়াছে।
পূৰ্ব্বেই বলা হইয়াছে যে, অনেক সময় আপাততঃ প্রয়োজনীয় একটা সুবিধার জন্য কোন সহৃদয় কর্তৃপক্ষ একটা খাল কাটিয়া বিষম অনর্থের উপৎপত্তি করিয়াছেন। ভৈরবের ভাগ্যে এভাবে নানা বিপত্তি হইয়াছে। পদ্মার ২/৩টি প্রধান শাখার সহিত ভৈরবের সংযোগ বলিয়া, ইহাতে যথেষ্ট পার্বত্য স্রোত প্রবেশ করিবার সুবিধা ছিল। কিন্তু ভৈরব তাহাতে বঞ্চিত হইয়াছে। সরকারী রিপোর্টে দেখা যায়, যেখানে ভৈরব হইতে কপোতাক্ষ বাহির হইয়াছিল, ১৭৯৪ খৃঃ অব্দে ঐ স্থানে চর পড়িতেছিল। যশোহরের কালেক্টারের চেষ্টার ফলে বাঁধদ্বারা কপোতাক্ষ-স্রোত বন্ধ করিয়া যশোহর প্রভৃতি সহরের জন্য ভৈরবকে অব্যাহত রাখিবার চেষ্টা হয়। কিন্তু দুৰ্দ্দান্ত স্রোতে সে চেষ্টা মানিল না। তাহিরপুরের নিকট বাঁধটা বাদ দিয়া মূলস্রোত পুনরায় দক্ষিণমুখে কপোতাক্ষে প্রবাহিত হইতে লাগিল। ফলে ভৈরব দুৰ্ব্বল হইয়া পড়িল। দর্শনা ষ্টেশনের কাছে ভৈরব-মাথাভাঙ্গার চক্রাকৃতি বাঁকের কথা বলা হইয়াছে। ২০/২৫ বৎসর পরে নদীয়ার কালেক্টার সেক্সপীয়র সাহেব একট ক্ষুদ্র খাল কাটিয়া ঐ বাঁকে মাথাভাঙ্গার পথ সোজা করিয়া দেন।[৪] বাঁকের দক্ষিণপূর্ব্ব কোণ হইতে ভৈরব বাহির হইয়াছিল। সোজা পথ পাইয়া সমস্ত জল মাথাভাঙ্গায় চলিতে লাগিল, বাঁধ মজিয়া ভৈরবের সম্বন্ধ এক প্রকার রহিত করিয়া দিল। পদ্মার জল এ পথে বড় একটা আসিত না; যাহা আসিত, তাহাও প্রায় সবটুকু কপোতাক্ষ টানিয়া লইত। ফলে ভৈরব অচিরে মরিয়া গেল; বসুন্দিয়ার নিম্নে যেখানে আফ্রার খালের দ্বারা চিত্রার জল ভৈরবে আসিয়া পড়িতেছিল, সেই পৰ্য্যন্ত ভৈরবে নৌকার চলাচলও বন্ধ হইয়া গেল। আফ্রার খালের মুখ হইতে আলাইপুর পর্য্যন্ত ভৈরব বেশ বিস্তৃত রহিল। এখনও সেইরূপ আছে। কারণ মুজদখালি, আতাই, আঠারবাঁকী দিয়া পার্ব্বত্য স্রোত উহার পুষ্টি সাধন করিতেছিল। এবং এই জলোচ্ছ্বাস লইয়া ভৈরব ভীষণ বিক্রমে আলাইপুর হইতে যাত্রাপুর পর্য্যন্ত প্রবাহিত ছিল।
পশর এক সুন্দরবনের নদী। উহার সহিত কোন দিকে পাৰ্ব্বত্য জলের সংযোগ ছিল না; ইহাতে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা খেলিত মাত্র। পশর তখন খুলনার পূর্ব্বদিকে বিল পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উহার সহিত ভৈরবের কোন সম্বন্ধ ছিল না। বিল পাবলা হইতে শ্মশান ঘাটের খাল’ নামক ক্ষুদ্ৰ নদী খুলনার দক্ষিণে মৈয়ার গাঙ্গে মিশিয়াছিল। এবং এই মৈয়ারগাঙ্গ কাঁচিপাতা নামক প্রবল শাখা দিয়া ঘুরিয়া পশরে পড়িয়াছিল। শ্রীরামপুরের ঘোষ বংশের পূর্ব্ব-পুরুষ রামনারায়ণ ঘোষ। স্বনামে ‘নারায়ণ খালির’ খাল কাটিয়া কাঁচিপাতার সহিত পশরের সোজা সংযোগ করিয়া দেন।[৫] সেই সংযোগস্থান হইতে ভৈরব নদ মাত্র ৩ মাইল দূরবর্তী ছিল। রূপসাহা নামক এক ব্যক্তি একটি ক্ষুদ্র পয়ঃপ্রণালী কাটিয়া ভৈরবের সহিত কাঁচিপাতার সংযোগ সাধন করে।[৬] সেই ক্ষুদ্র খাল অচিরে ভীষণমূর্ত্তি পরিগ্রহ করিল। ভৈরবের জল পথ পাইয়া ভীষণবেগে প্রবাহিত হইয়া ক্ষুদ্র খালকে প্ৰবল নদী করিয়া দিল। উহাই এখনকার রূপসা নদী। একে দক্ষিণ দিকের সোজাপথ, তাহাতে পশরের মত বিস্তৃত সমুদ্রগামী নদী। আঠারবাঁকী ও ভৈরবের জল আলাইপুর পার না হইয়া অধিকাংশই রূপসা পথে ছুটিল। জোয়ারের জল রূপসা হইতে উঠিয়া পূৰ্ব্ব-পশ্চিমে উভয়মুখে ভৈরবে ও কতক আঠারবাঁকীতে প্রবেশ করিতে লাগিল। সুতরাং আলাইপুর পার হইয়া সে মুখে অধিক জল যাইত না। সেদিকে ভৈরব তেমন বেগবান্ রহিল না। তখন ভৈরব সে অঞ্চলে বিস্তীর্ণ নদ ছিল। এখন যাহাকে আলাইপুরের খাল বলে, তাহা প্রাচীন ভৈরবের সূক্ষ্মরেখা মাত্র।
যাত্রাপুরের কাছে ভৈরবে উত্তরাবর্তে একটি বৃত্তাকার বাঁক ছিল। ইহার প্রাচীন খাত এখনও বর্তমান। ইংরেজ আমলের প্রারম্ভে ঐস্থানে অল্পদূর খাল কাটিয়া পথের সংক্ষেপ করা হয়। পুনরায় বাগেরহাটের সন্নিকটে দড়াটানার খাল কাটিয়া দক্ষিণদিকে আর একটি সংযোগ সাধিত হয়। এইরূপে বাগেরহাটের দক্ষিণদিকে জোয়ারের জল আসিয়া কতক আলাইপুরের দিকে, কতক কচুয়ার দিকে যাইতে লাগিল। একদিকে কচুয়া হইতে মধুমতীর জোয়ার ও অন্যদিকে আলাইপুর দিয়া রূপসার জোয়ার ভৈরবে প্রবেশ করিয়া দুই দিকে নদীকে দোটানা করিয়া ফেলিল। ফলে কচুয়া হইতে আলাইপুর পর্য্যন্ত ভৈরবের সমস্তটাই মজিয়া আসিতেছে। গবর্ণমেণ্ট হইতে দুইবার অপরিমিত অর্থব্যয়ে এই নদী কাটাইবার ব্যবস্থা করায়ও বিশেষ ফল হয় নাই। প্রকৃত রোগ না সারিলে সাময়িক উপশান্তিতে কাজ হয় না। যশোহর-খুলনার সর্ব্বপ্রধান নদী ভৈরব এইভাবে নানা স্থানে ভরাট হইয়া গিয়া দুই জেলার কত যে অপকার করিতেছে, তাহা বলিবার নহে। কপোতাক্ষে শৈবাল জমিয়া জলজ উদ্ভিদাদির জন্য শীর্ণকায় হইলেও তাহাতে এখনও নৌকাদি চলে, ঝিকারগাছা হইতে দক্ষিণ দিকে ষ্টীমারও যাতায়াত করিতেছে; কিন্তু ভৈরবের মাত্র বসুন্দিয়া হইতে আলাইপুর পর্য্যন্ত ৩০ মাইল পথে রীতিমত নৌকাপথ আছে।
কপোতাক্ষের মত বেতনা (বেগবতী বা বেত্রবতী) ভৈরবের একটি শাখা। ইহা যশোহরের অন্তর্গত মহেশপুরের সন্নিকটে ভৈরব হইতে বাহির হইয়া, বর্তমান রেলষ্টেশন নাভারণ (যাদবপুর), উলসী, সামটা, বাগ আঁচড়া প্রভৃতি স্থানের পার্শ্ব দিয়া খুলনার সীমায় প্রবেশ করিয়াছে এবং ‘বুধহাটার গাঙ্গ’ বলিয়া পরিচিত হইতে হইতে নিম্নে আসিয়া খোলপেটুয়া হইয়াছে। খোলপেটুয়া নানাদিক হইতে গালঘেসিয়া প্রভৃতি অসংখ্য ছোটবড় শাখার সহিত যুক্ত হইয়া বিশাল বিস্তার লাভ করিয়াছে এবং ১৬ মাইল এইভাবে গিয়া কপোতাক্ষে মিশিয়াছে। তথা হইতে সম্মিলিত প্রবাহের নাম আড়পাঙ্গাসিয়া।
কপোতাক্ষ হইতে হরিহর ও ভদ্র নামক আর দুইটি শাখা পূর্ব্ব-দক্ষিণ মুখে প্রবাহিত ছিল। এক সময়ে হরিহরের কূলে লাউজানি, মণিরামপুর ও কেশবপুর প্রভৃতি প্রসিদ্ধ স্থান শোভা পাইত। হরিহর গিয়া ভদ্রে মিশিয়াছিল, কিন্তু ভদ্রের আশ্রয়েও মৃত্যুর হাতে নিস্তার পায় নাই। কারণ ভদ্রনদ নামে ভদ্র হইলেও তখন কাযে বড় অভদ্র ও তরঙ্গসঙ্কুল ছিল। মঙ্গলবারের মত ভদ্রনদও নামে এক, কাযে অন্য বুঝাইয়া দিত। প্রাচীন কালে এই ভদ্রই ছিল যশোর রাজ্যের উত্তর সীমা। ভদ্রের সহিত কপোতাক্ষের সঙ্গমস্থানে ত্রিমোহানী ও মীর্জ্জানগরে মোগল ফৌজদারের রাজধানী ছিল, সেখান হইতে ভদ্র কেশবপুর ঘুরিয়া গৌরীঘোনা, ভরতভায়না প্রভৃতি স্থানের শোভা বর্দ্ধন করিয়া এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বহু সামাজিক কায়স্থ ব্রাহ্মণের বসতি করাইয়াছিল। আজ ভদ্র ডুমুরিয়া পর্য্যন্ত প্রদেশকে কাণা করিয়া নিজে এক প্রকার মজিয়া গিয়াছে। কিন্তু ডুমুরিয়া ছাড়িয়া ভদ্র সুন্দরবনের নদী- এখনও পূর্ব্ববৎ অভদ্র। নানা শাখা বিস্তার করিয়া অবশেষে ভদ্র শিবসা ও পশরে মিশিয়া গিয়াছে। শিবসাও একটি রীতিমত সুন্দরবনের বড় নদী। ইহাও পশরের মত সমুদ্র পর্য্যন্ত গিয়াছে। সমুদ্রে পড়িবার পূর্ব্বে ইহার নাম হইয়াছে মর্জ্জাল (মার্জ্জার)। উপর হইতে ঢাকি, ভদ্র, মেনস ও কয়রা প্রভৃতি অনেকগুলি ছোটবড় নদী শিবসার পুষ্টিসাধন করিয়াছে। ঢাকি ইহাকে পশরের সহিত মিশাইয়াছে এবং মেনস ও কয়রা ইহাকে কপোতাক্ষের সহিত সংযুক্ত করিয়া দিয়াছে।
এতক্ষণে আমরা ভৈরব-কপোতাক্ষ ছাড়িয়া পশ্চিম-দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হইতে পারি। ভৈরব-কপোতাক্ষ যেমন দেশ জুড়িয়া বহুনদীর সহিত সম্বন্ধ পাতাইয়াছে, এ দিকে ইচ্ছামতী-যমুনাও তেমনি বহু বিস্তৃত প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। মাথাভাঙ্গা ভৈরব ছাড়িয়া দক্ষিণ দিকে আসিয়া কৃষ্ণগঞ্জের কাছে চূর্ণী নাম ধারণ করিয়াছিল। সেই স্থান হইতে উহার একটি শাখা বাহির হইয়া পূৰ্ব্বমুখে আসিয়াছে, তাহার নাম ইচ্ছামতী। ইচ্ছামতী এখনও মরে নাই, সে এখনও পদ্মার জল লইয়া স্বচ্ছ-সলিলে গভীরখাতে প্রবাহিত হইতেছে। ইচ্ছামতী বর্তমান বনগ্রাম রেলষ্টেশনের পূৰ্ব্বদিক্ দিয়া আসিয়া, গোবরডাঙ্গার দক্ষিণে টিপি নামক স্থানে যমুনার সহিত মিশিয়াছে।
এ যমুনা সেই যমুনা। যে যমুনার তটে ইন্দ্রপুরীতুল্য রাজপাট বসাইয়া কুরুপাণ্ডবে ইন্দ্রপ্রস্থ হস্তিনাপুরে রাজসূয় যজ্ঞ সুসম্পন্ন করিয়াছিলেন, যে কালিন্দীতটে বংশীবটে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমধর্ম্মের অপূৰ্ব্ব লীলাভিনয় হইয়াছিল, যে যমুনার তীরে দিল্লী-আগ্রায়, মথুরা-প্রয়াগে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃষ্টান, মোগল-ইংরাজ শত শত রাজরাজেশ্বর সমগ্র ভারতের রাজদণ্ড পরিচালনা করিতেন এবং এখনও করিতেছেন, এ সেই একই যমুনা। সেই তমালকদম্বপরিশোভিত, কোকিল-কূজন-মুখরিত, নিৰ্ম্মল সলিলে প্রবাহিত ‘তটশালিনী সুন্দর যমুনা।’ সকলেই জানেন যমুনা ও সরস্বতী বিভিন্ন পথে আসিয়া প্রয়াগ বা এলাহাবাদের নিম্নে গঙ্গার সহিত মিশিয়া গিয়া বিলুপ্ত হইয়াছে। এইজন্য প্রয়াগের নাম যুক্তত্রিবেণী। সুরতরঙ্গিণী গঙ্গা সেই যুক্তপ্রবাহে বলদৃপ্ত হইয়া বঙ্গভূমিতে ভাগীরথী নামে সপ্তগ্রাম পৰ্য্যন্ত আসিয়াছে। সেখানে আসিয়া সরস্বতী দক্ষিণে ও যমুনা বামে বিমুক্ত হইয়া পড়িয়াছে।[৭] এজন্য সপ্তগ্রামের নিকট সেই সঙ্গমস্থলের নাম মুক্তত্রিবেণী। এই ত্রিবেণী হইতে যমুনা কিছুদূর পর্য্যন্ত চব্বিশ পরগণা ও নদীয়া এবং তৎপরে চব্বিশ পরগণা ও যশোহরের সীমা নির্দেশ করিয়া, পূৰ্ব্ব-দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হইয়াছে। যমুনা যেখানে ভাগীরথী হইতে প্রথম উঠিয়াছে, তথাকার সেই দুরবস্থ প্রাচীন খাত সাধারণের নিকট বাঘের খাল বলিয়া পরিচিত হইয়াছে। যমুনা ক্রমে চৌবেড়িয়া, জলেশ্বর, ইচ্ছাপুর ও গোবরডাঙ্গা ঘুরিয়া, দক্ষিণ দিকে পদ্মা নামক শাখা বিস্তার করিয়া, অবশেষে চারঘাটের কাছে টিপির মোহানায় ইচ্ছামতীর সহিত মিলিত হইয়াছে। যমুনার যেন একটা স্বভাব এই যে, সে অধিক দূর পর্য্যন্ত একক অগ্রসর হইতে পারে না; একবার যেমন গঙ্গায় ডুবিয়াছিল, এবার তেমনি ইচ্ছামতীতে আত্মসমর্পণ করিয়া নিজের নাম বিলুপ্ত করিয়া দিল। ইচ্ছামতী সোজা দক্ষিণ দিকে চলিল। বসুরহাট (বসিরহাট), টাকী, শ্রীপুর, দেবহট্ট, বসন্তপুর ও কালীগঞ্জ দিয়া একেবারে ইচ্ছামতী যশোরেশ্বরীর পাঠমন্দিরের সন্নিকটে যশোর নগরের পাদদেশে পৌঁছিল। সেখানে আবার যমুনা পৃথক্ হইল, সে ডানদিকে আসিয়া মামুদো নদী হইয়া দক্ষিণ মুখে সমুদ্রে পড়িয়াছে এবং ইচ্ছামতীও বামভাগে গিয়া কদমতলী, মালঞ্চ প্রভৃতি নাম পরিবর্ত্তনপূর্ব্বক সাগরে মিশিয়াছে। এই ‘যমুনেচ্ছা-প্রসঙ্গমে’ প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসপ্রসিদ্ধ যশোহর ও ধূমঘাটের রাজধানী ছিল। যথাস্থানে তাহার বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া হইবে।
বসন্তপুর হইতে এই যমুনা একদিন যে ঐশ্বর্য্য, প্রতিভা ও রণরঙ্গ দেখিয়াছিল, আজ তাহার চিহ্নগুলিও বিলুপ্তপ্রায়। যে যোজনবিস্তীর্ণ নদী প্রতাপের যশোরদুর্গের সমীপে অসংখ্য নৌবাহিনীর মাস্তুলসজ্জায় কণ্টকিত দেখা যাইত, আজ সে অভিশপ্ত নদী একগাছি শীর্ণকায় খালের মত বদ্ধজলপূর্ণ রহিয়াছে। কালের বিপর্যয়ে যমুনার অনেক বিপর্য্যয় হইয়াছে। এবং তজ্জন্য খুলনা দক্ষিণাংশবাসী লোকসমূহের অবস্থাস্তর ঘটিয়াছে। বসন্তপুরের উত্তরাংশে যমুনা-ইচ্ছামতী হইতে কালিন্দী নামক একটি ক্ষুদ্র শাখা দক্ষিণ দিকে গিয়াছিল। প্রতাপাদিত্যের সময় উহা সাধারণ খালের মত ছিল, বিশেষ প্রবল নদী ছিল না। ইংরাজ আমলে ১৮১৬ খৃঃ অব্দে ইহা হইতে একটি খাল কাটিয়া বড় কলাগাছিয়া নদীর সহিত মিশাইয়া দেওয়া হয়। ইহাকে সাহেবখালি বলে। ইচ্ছামতীর ভাটার জল অনেক পরিমাণে এই পথে সরিয়া যাইতে লাগিল, তাহাতে কালিন্দী ক্রমে বড় হইয়া উঠিল। ইহার পূর্ব্বে গুডল্যাড সাহেব যখন চব্বিশ পরগণার কালেক্টর, তখন কালীগঞ্জ হইতে একটি খাল কাটিয়া যমুনাকে বাঁশতলী নদী দিয়া খোলপেটুয়ার সহিত মিশাইয়া দেওয়া হয়; ইহাকে কাঁকশিয়ালীর খাল (বা Goodlad creek) বলে। পূৰ্ব্বদেশীয় নদীসমূহ এই খাল দিয়া কালিন্দীপথে সহজে কলিকাতায় আসিতে পারিত। সেই জলপথকে আরও সংক্ষিপ্ত করিবার জন্য ১৮৩০ খৃঃ অব্দে হাসনাবাদের খাল খনিত হয়। এই তিনটি খালের জন্য বসন্তপুর ও ঈশ্ববীপুরের মধ্যে যমুনা-ইচ্ছামতীর দুর্দ্দশা আরম্ভ হয়। এমন সময় ১২৭৪ সালের ১৬ই কার্ত্তিক (১৮৬৭, ১লা নভেম্বর) তারিখে এতদঞ্চলে এক ভীষণ ঝড় হয়। উহাতে সুন্দরবনে এক রাত্রিতে ১২ ফুট পৰ্য্যন্ত জল বাড়িয়া ছিল। তাহার পরদিনই দেখা গেল, যমুনার স্রোতের ভীষণ পরিবর্ত্তন হইয়াছে। বালি জমিয়া যমুনার গতি অনেক পরিমাণে মন্দীভূত হওয়ায়, কালিন্দীর জোয়ার যমুনায় প্রবেশ করিয়া উহাকে দোটানা করিয়া দিল। ইহাতে অল্পদিন মধ্যে যমুনা ভরাট হইয়া এক প্রকার শুষ্ক হইয়াছে। যমুনার এই আকস্মিক পরিবর্তন ও ভীষণ অবস্থা বহু প্রাচীন তথ্য বিলুপ্ত করিয়া দিয়াছে।
এতক্ষণে আমরা দেখিতে পাইলাম যে, প্রকৃত সুন্দরবনের নদীগুলির কথা ছাড়িয়া দিলে, কেবলমাত্র গৌরী-মধুমতী, নবগঙ্গা-চিত্রা এবং ইচ্ছামতী-কালিন্দী গঙ্গার পার্ব্বত্য স্রোত বহন করিতেছে। এই তিনটি মাত্র নদীস্রোত মিষ্টজল আনিয়া দেশের শোভা, সমৃদ্ধি ও উর্ব্বরতা বৃদ্ধি করিতেছে এবং ইহারাই চিরানুগত প্রথায় গঙ্গার ভূমিগঠন কার্য্যের সহায়তা করিতেছে। কোন প্রকারে ইহাদের গতিরুদ্ধ হইলে, দেশের যে কি গতি হইবে, তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য।
পাদটীকা :
১. ‘…lands rise very gradually as we go up the rivers. In many parts of Gangetic delta the level of the country is less than 20 feet above sea level at a distance of 100 miles from the sea and only at its highest does reach 100 feet… – A Short Geography of Bengal, by W. H. A. Wood, 1895–শি মি
২. ফটকীকে কেহ কেহ কটকী (Westland), কেহ নটকী (Deare) করিয়াছেন। – See Westland’s Report. 1871, P. 14
৩. এই খালের সন্নিকটে পূর্ব্বে এক বণিক্ পরিবার বাস করিত। তাহাদের বহু বাণিজ্যতরী ছিল। তাহারা বহু অর্থব্যয়ে এক রাত্রিতে এই খাল কাটিয়া দেয়, এরূপ প্রবাদ আছে।
৪. Westland’s Report. 1871, P. 7.
৫. শ্রীরামপুরের ঘোষ বংশে রামনারায়ণের পর ৬/৭ পুরুষ হইয়াছে। সম্ভবতঃ ১৭৩০ খৃঃ অব্দের নিকটবর্ত্তী সময়ে নারায়ণখালি খনিত হয়।
৬. রূপচাঁদ সাহা নামক একজন সৌলুক বংশীয় বণিক খুলনার কাছে নেমকের কারবার করিতেন। তিনি দক্ষিণ দেশীয় লবণের ভার কাঁচিপাতা মোহানা হইতে সোজা পথে ভৈরবের তীরে আনিবার জন্য একটি ক্ষুদ্র খাল খনন করিয়া দেন। উহা প্রথমে এত ক্ষুদ্র ছিল যে লাফ দিয়া পার হওয়া যাইত। নড়াইলের উত্তরে ধোন্দা নামক স্থানে রূপচাঁদের বাস ছিল।
৭. ‘প্রদ্যুম্নননরায়ম্যে সরস্বত্যাস্তথোত্তরে।
তদ্দক্ষিণে প্রয়াগস্তু গঙ্গাতো যমুনা গত॥’— রঘুনন্দনকৃত প্রায়শ্চিত্ততত্ত্ব।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন