সতীশচন্দ্র মিত্র
২৩১ খৃঃ পূর্ব্বাব্দে মহারাজ অশোকের মৃত্যুর পর অল্পকালমধ্যেই তদ্বংশীয়দিগের রাজত্ব শেষ হয়। পরবর্ত্তী প্রায় পাঁচ শত বৎসর ভারতবর্ষ নানা খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত হইয়া সুঙ্গ, কণ্ব, অন্ধ্র প্রভৃতি রাজন দ্বারা শাসিত হয়। খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমে মগধের গুপ্তরাজগণ রাজত্ব করিতে আরম্ভ করেন। চন্দ্রগুপ্ত এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁহার ছয় বৎসর রাজত্বের পর আনুমানিক ৩২৫ খৃষ্টাব্দে তৎপুত্র সমুদ্রগুপ্ত পিতৃ-সিংহাসনে অধিরূঢ় হন। ইনি বহু রাজ্য জয় করেন। সমুদ্র হইতে নেপাল, কামরূপ হইতে কর্তৃপুর[১] পর্যন্ত সমস্ত উত্তরাপথ ও মধ্যভারত তাঁহার রাজ্যসীমার অন্তর্গত ছিল। প্রয়াগে বৰ্ত্তমান দুর্গমধ্যে যে অশোকস্তম্ভ রহিয়াছে, তাহার গাত্রে উৎকীর্ণ কবি হরিষেণ বিরচিত প্ৰশস্তিতে সমুদ্রগুপ্তের এই দিগ্বিজয় বাৰ্ত্তা বিজ্ঞাপিত হইয়াছে। তাহা হইতে জানা যায়, তিনি সমতট, ডবাক, নেপাল, কামরূপ ও কর্তৃপুর প্রভৃতি প্রত্যন্ত নৃপতি কর্তৃক সম্পূজিত হইতেন।[২] এইস্থানে সমতটের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। যশোহর-খুলনা এই সমতটের অন্তর্গত। ভাগীরথী হইতে পদ্মা পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত সমস্ত সমুদ্রকূলবর্তী প্রদেশই সমতট। ভাগীরথীর পশ্চিম পারে বঙ্গ এবং পদ্মার উত্তর পারে বর্তমান বগুড়া, দিনাজপুর, রাজসাহী প্রভৃতি স্থান লইয়া ডবাক রাজ্য গঠিত ছিল বলিয়া অনুমিত হইয়াছে। কেহ কেহ বলেন, ডবাক হইতেই ঢাকা নামের উৎপত্তি।[৩] এতদনুসারে পূর্ব্ববঙ্গ ডবাক হইলে, বৰ্ত্তমান প্রেসিডেন্সি বিভাগ ও ফরিদপুর এবং বরিশাল জেলা লইয়া প্রধানতঃ সমতট গঠিত হয়, ধরা যাইতে পারে। তবকাত্-ই-নাসিরি গ্রন্থে সমতটকে সঙ্কট বা সাঁকট বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। সমতট সমুদ্রগুপ্তের সময়ে একটি সীমান্ত রাজ্য; ইহার অধিপতিগণ সামন্ত রাজা হইলেও তাঁহারা যে সম্পূর্ণরূপে অধীনতা শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়াছিলেন, এমন বলা যায় না।
সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। তাঁহার উপাধি ছিল বিক্রমাদিত্য। কেহ কেহ উজ্জয়িনীরাজ যশোধর্ম্মদেব বিক্রমাদিত্যকে পরিত্যাগ করিয়া এই গুপ্ত নৃপতিকেই নবরত্ন সভার অধীশ্বর বলিয়া বর্ণনা করেন।[৪] কারণ চন্দ্রগুপ্তও উজ্জয়িনী জয় করিয়াছিলেন বলিয়া জানা যায়। দিল্লীতে কুতব মিনারে সন্নিকটে পিথোরা দুর্গ-প্রাঙ্গণে যে এক লৌহস্তম্ভ আছে, তাহার গাত্রে উৎকীর্ণ লিপিতে চন্দ্র নামধেয় এক রাজার কথা পাওয়া যায় : তিনিও এই চন্দ্রগুপ্ত হইতে পারেন। তিনি বঙ্গ বা সমতট রাজ্য জয় করিয়াছিলেন বলিয়া উল্লিখিত আছে।[৬] চন্দ্রগুপ্তের পর তৎপুত্র কুমারগুপ্ত (৪১৩-৪৫৫ খৃষ্টাব্দ) ও পরে কুমার-পুত্র স্কন্ধগুপ্তের পর কয়েকজন গুপ্ত সম্রাট রাজত্ব করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহারা সকলেই হীনবীৰ্য্য ছিলেন। এই সময়ে পশ্চিম ভারতে দুর্দ্ধর্ষ হূণদিগের প্রবল আক্রমণ হয়। মালবের যশোধর্ম্মদেব উহাদিগকে নিরস্ত করিয়া এক প্রবল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়া গুপ্ত নৃপতিদিগের মত ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধি গ্রহণ করেন। তাঁহার প্রশস্তি হইতে দেখা যায়, তিনিও ব্রহ্মপুত্র নদ সীমা হইতে পূর্ব্ববঙ্গ ও সমতট দিয়া কলিঙ্গ পর্য্যন্ত রাজ্য বিস্তার করিয়াছিলেন।[৭] যশোধর্ম্মের পর কান্যকুব্জের অধীশ্বরগণ উত্তর ভারতে সার্বভৌম নৃপতি হন। কিন্তু এই সময়ে গৌড়াধিপ শশাঙ্ক কর্ণসুবর্ণে রাজধানী স্থাপন করিয়া পূর্ব্বদেশ অধিকার করিয়া লন। সুতরাং সমতটও তাঁহার অধীন হইয়া পড়ে।
শশাঙ্ক সবিক্রমে কান্যকুব্জ অধিকার করেন এবং অন্যায় ভাবে সম্রাট রাজ্যবর্দ্ধনের হত্যা সাধন করেন। শশাঙ্ক ঘোর বৌদ্ধ-বিদ্বেষী ছিলেন এবং মগধ ও কনৌজের বৌদ্ধ নৃপতিগণের প্রবল শত্রু হইয়া দাঁড়ান। তিনি বুদ্ধগয়ার বোধিদ্রুম উৎপাটিত করেন, তথায় শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করেন এবং মগধে বৌদ্ধদিগের যে প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাহা বিনষ্ট করিয়া ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের পুনঃ প্রতিষ্ঠা করিতে চেষ্টা করেন।[৮] কিন্তু অচিরে অকালে তাঁহার মৃত্যু হইলে বঙ্গ হইতে সমগ্র উত্তরাপথের আধিপত্য রাজ্যবর্দ্ধনের ভ্রাতা হর্ষবৰ্দ্ধন শীলাদিত্যের হস্তগত হইয়া পড়ে। কোন বিদ্রোহী রাজন্যের আবির্ভাব না হওয়াতে এবং পরাক্রান্ত নৃপতির মধুর শাসনের ফলে আবার কিছুকালের জন্য দেশে শান্তি সংস্থাপিত হয়। এই সময়ে মগধের অন্তর্গত নালন্দার বিশ্ববিদ্যালয় সমগ্র বিশ্বপৃষ্ঠে একটি প্রধান শিক্ষাকেন্দ্ররূপে পরিগণিত হইয়া প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় নামের উপযুক্ত হইয়াছিল। শীলভদ্র নামক একজন বাঙ্গালী-কুলতিলক মহাপণ্ডিত এই সময়ে নালন্দা বিদ্যালয়ের সৰ্ব্বাধ্যক্ষ ছিলেন। প্রসিদ্ধ চৈনিক পরিব্রাজক ইউয়ান চোয়াং তাঁহারই শিষ্যরূপে পাঁচ বৎসর কাল যাবতীয় বৌদ্ধশাস্ত্র শিক্ষা করিয়া ‘মহাযান-দেব’ উপাধি লাভ করেন। ৬২৯ হইতে ৬৪৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ১৬ বৎসর কাল ইউয়ান চোয়াং ভারতের প্রায় অধিকাংশ স্থান ভ্রমণ করিয়া এক বিস্তৃত বিবরণী লিপিবদ্ধ করেন। উহার মধ্যে তাঁহার সমতটের বিবরণী হইতে আমরা যশোহর-খুলনার ইতিহাস সম্বন্ধে অনেক কথা জানিতে পারি।
গুপ্ত-রাজগণ হিন্দু তান্ত্রিক এবং কেহ কেহ পরম বৈষ্ণব ছিলেন। স্কন্ধগুপ্তের সময়েই বৌদ্ধধর্ম্মের প্রতি তাঁহাদের মতি আকৃষ্ট হয়। বালাদিত্য বৌদ্ধ ছিলেন। সমুদ্রগুপ্ত বা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়ে বিষ্ণমূর্তির পূজাপদ্ধতি বিশেষভাবে প্রচলিত হয়। আমাদের দেশে যে সকল সুন্দর চতুর্ভুজ বাসুদেব প্রভৃতি বিষ্ণুমূৰ্ত্তি দৃষ্ট হয়, তাহার কতক এই যুগে এবং কতক পরবর্ত্তী সেনরাজত্বকালে প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু ব্রাহ্মণ এবং বৌদ্ধ শ্রমণে যে চিরবিবাদ চলিয়া আসিতেছিল, গুপ্তযুগে হিন্দুরা কতক বৌদ্ধভাবাপন্ন এবং বৌদ্ধেরা হিন্দুভাবাপন্ন হওয়ায় তাহার মীমাংসা হইয়া আসিতেছিল।
বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর তাঁহার ধর্ম্মের বহু মত-বিপর্য্যয় হয়। খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে কুষণ সম্রাট কণিষ্কের রাজত্বকালে বৌদ্ধদিগের এক মহাসম্মিলনে বৌদ্ধধর্ম্ম দুইটি প্রধান সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়। নাগার্জুন নামক প্রসিদ্ধ বৌদ্ধাচাৰ্য্য কতকগুলি হিন্দু ও নূতন দেবদেবী স্বীকার করিয়া যে উদার বৌদ্ধ মতের প্রবর্তন করেন, তাহাই হইল মহাযান। আর প্রাচীন অর্থাৎ বুদ্ধদেবের প্রচারিত মতে যাঁহারা বিশ্বাসবান রহিলেন, তাঁহারাই হীনযান সম্প্রদায়ভুক্ত হইলেন। ইহাকে প্রাচীন বা স্থবির মতও বলে। কালে ইহার সহিত মহাযান মতের কতকটা সংমিশ্রণে স্থবির মহাযান মত হইয়াছিল। কণিষ্ক স্বয়ং মহাযান-মতাবলম্বী ছিলেন; তখন হইতে মহাযানেরই আধিপত্য বিস্তৃত হয়। ক্রমে বসুবন্ধু নামক বৌদ্ধমুনি পাতঞ্জল-দর্শনের যোগাচার ও মন্ত্রাদি মহাযানের অন্তর্ভুক্ত করিয়া দেন। তখন হইতে নাগার্জুনের মতের নাম হইল মাধ্যমিক ও বসুবন্ধুর প্রবর্তিত নব মহাযান মত যোগাচার নামে অভিহিত হইল। এই ভাবে হিন্দু তান্ত্রিকতা যত বৌদ্ধধর্ম্মে প্রবিষ্ট হইতে লাগিল, হিন্দু দেবদেবী যত বৌদ্ধমূর্ত্তি পরিগ্রহ করিতে লাগিলেন, ততই হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম্মে একটা মিলন হইয়া গেল। বুদ্ধদেব হিন্দুদিগের দশ অবতারের অন্তর্গত হইয়া পড়িলেন। পরবর্ত্তী কালে পুরুষোত্তমে বুদ্ধ, সংঘ ও ধর্ম্ম—বৌদ্ধদিগের এই ত্রিমূর্তি, হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি ধারণ করিয়া জাতিধর্ম নির্ব্বিশেষে সকল ভারতবাসী দ্বারা সমভাবে পূজিত হইতে লাগিলেন।
হিন্দু তান্ত্রিকতা বৌদ্ধধর্ম্মে এমনভাবে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া পড়িল যে, দেবদেবীর সংখ্যা যেন হিন্দুদিগের অপেক্ষাও বৌদ্ধধর্ম্মে অধিক হইবার উপক্রম হইল। ইহাই দেখিয়া হিন্দুদের প্রাচীন আগম শাস্ত্রের পুনঃ সংস্কার আরম্ভ হইল। হিন্দু তান্ত্রিকতা আবার জাগিয়া উঠিল। নানা স্থানে তান্ত্রিক দেবদেবীর মূর্ত্তি স্থাপিত হইল। গুপ্ত সম্রাটগণ এই তান্ত্রিকতার পুনরুত্থান যুগে তদীয় প্রবল পৃষ্ঠপোষক হইলেন। কেহ কেহ অনুমান করেন, সতীর ছিনন্দেহ হইতে যে সকল পীঠমূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহা এই যুগেই হয়। আমাদের মনে হয় সে সকল পীঠমূৰ্ত্তি ইহা অপেক্ষাও প্রাচীন। তবে সেই পীঠস্থানগুলিতে এই যুগে মন্দিরাদি নির্ম্মিত হইয়া রীতিমত পূজাপদ্ধতি প্রচলিত হওয়া বিশেষ সম্ভবপর। হিন্দুধর্ম্ম এই সকল উপায়ে বৌদ্ধপ্লাবিত দেশে আত্ম-প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পাইতেছিল। গুপ্তযুগে পীঠ-দেবতা ব্যতীত অন্য বহুসংখ্যক দেবদেবীর পূজা হইতে থাকে। পাণিঘাটের অষ্টাদশভুজা বা আমাদির চামুণ্ডা-মূর্ত্তি এ যুগের হওয়া অসম্ভব নহে।
কর্ণসুবর্ণরাজ শশাঙ্ক শৈব ছিলেন। তিনি বৌদ্ধমত নিষ্প্রভ করিয়া শৈব মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তাঁহার সময়ে বুদ্ধগয়ার বুদ্ধমূর্ত্তি প্রাচীর দ্বারা সমাবৃত করিয়া শিবমূর্তি স্থাপিত করা হয়। শশাঙ্ক বৌদ্ধমতের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইলেও বুদ্ধমূর্ত্তির শত্রু হইয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। তখন সমগ্র সমতট তদীয় অধীন ছিল। সেখানে তিনি কোন বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করিয়াছিলেন বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যায় না। সময়ের প্রভাবেই শিবকল্প বুদ্ধদেব শিব হইয়া যাইতেছিলেন, কোথায়ও তিনি দেবীপীঠে ভৈরব হইতেছিলেন, কোথায়ও জীব বলি দিয়া তাহার অহিংসা মতের অবমাননা করা হইতেছিল! আমরা পরে ইহার অনেক প্রমাণ দিব। শশাঙ্কের রাজত্বকালে সমতটের নানানস্থানে শিবমূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইতেছিল। হাতিয়াগড়ে প্রসিদ্ধ অম্বুলিঙ্গ শিব, কালীঘাটে নকুলেশ্বর, দ্বিগঙ্গায় গঙ্গেশ্বর শিব, কুশদহে যমুনাতটে লাউপালা নামক স্থানে পোড়া মহেশ্বর শিব ও জলেশ্বর নামক স্থানে জলেশ্বর শিব এই সময়ে বা তাহার অব্যবহিত পরবর্তী যুগে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয়। জলেশ্বর একটি প্রধান স্থান ছিল। এখানে এখনও শিবচতুদর্শীর দিন বহু যাত্রীর সমাগম হয়। এখানে শিবের মন্দির নাই, লিঙ্গমূর্ত্তি পুষ্করিণীর জলমধ্যে নিমগ্ন আছেন। শিবচতুদর্শীর দিন উপরে উঠান হয়। এই পুষ্করিণী হইতে যমুনাতট পৰ্য্যন্ত এক মাইল পথের দুই পার্শ্ব নানা ইষ্টকস্তূপ ও প্রাচীন ভিত্তিচিহ্নে পূর্ণ দেখিতে পাওয়া যায়। বারবাজার প্রভৃতি স্থানে আরও কত শিবমন্দির ছিল, তাহা জানি না। মুসলমান বিজয়কালে হিন্দুর কত মন্দির যে কাল-কবলিত হইয়াছিল, তাহা এক্ষণে স্থির করিবার উপায় নাই।
এই যুগে সমতট ও কলিঙ্গের কত স্থান হইতে কত লোক সমুদ্রপথে বালী, লম্বক, সুমাত্রা প্রভৃতি দ্বীপে গিয়া শৈবমত প্রচার এবং বহুসংখ্যক শিবমন্দির প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। এই নব মত ঔপনিবেশিক বাঙ্গালীর শক্তিবৃদ্ধি করিয়াছিল। শিবের লিঙ্গমূর্ত্তি সব জাতীয় লোকে স্পর্শ করিতে বা পূজা করিতে পারে, শিবপূজা সকলের কর্তব্য, ইহাতে অধিকারী ও অনধিকারীর ভেদ নাই, দীক্ষিত না হইলেও বালক-বালিকায়ও ইচ্ছামত জলে, ফুলে, বিল্বদলে শিবপূজা করিতে পারে—এই উদার পদ্ধতি হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্ম্মের সমন্বয় করিয়া দিয়াছিল। ক্রমে ক্রমে এ অঞ্চলে লোকে এত শৈব- মতাবলম্বী হইয়াছিল যে সকলে শিবপূজা করিত, শিব-কথা কহিত, শিব-গীত গাহিত এবং শিবের তত্ত্বকথা এমন ভাবে সকল বর্ণে প্রবেশ লাভ করিয়াছিল যে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’—এ দেশের একটি প্রবাদবাক্য হইয়া রহিয়াছে।
এই ভাবে দেখিতে পাই গুপ্ত রাজগণের ও শশাঙ্কের রাজকীয় ধৰ্ম্মসম্বন্ধীয় প্রাধান্য সমতটের সর্ব্বত্র প্রসার লাভ করিয়াছিল। গুপ্ত সম্রাটদিগের তান্ত্রিকতা তাঁহাদের সকল কার্য্যে প্রতিফলিত হইত, তাঁহাদের প্রচলিত মুদ্রাতেও ইহা প্রকটিত হইয়াছে। চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রায় সিংহবাহিনী দেবমূৰ্ত্তি ছিলেন, সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রায় যজ্ঞাশ্বের প্রতিকৃতি আছে। যশোহর জেলায় ইঁহাদের মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। কতদূর তাঁহাদের রাজ্য বিস্তৃত হইয়াছিল, ইহা হইতেও তাহা এক প্রকারে সপ্রমাণ হইতে পারে। ১৮৫২ খৃষ্টাব্দে যশোহর জেলার উত্তরাংশে মহম্মদপুরে এলেংখালি বা মধুমতী নদীর সন্নিকটে একটি কূপখননকালে এক ব্যক্তি মৃৎপাত্রে কতকগুলি মুদ্রা প্রাপ্ত হয়। ঐ মুদ্রাগুলি তৎকালীন যশোহরের ম্যাজিষ্ট্রেট F. L. Beaufort সাহেবের হস্তে পড়ে। তিনি তাহা এসিয়াটিক সোসাইটিতে উপহারস্বরূপ প্রেরণ করেন। মুদ্রাগুলির কতকগুলির চন্দ্রগুপ্ত, কুমারগুপ্ত প্রভৃতি গুপ্তরাজগণের মুদ্রার মত, তাহাতে সন্দেহ নাই। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র ইহার তিনটি মুদ্রা সম্বন্ধে আলোচনা করেন।[৯] এই তিনটি মুদ্রার একটি কর্ণসুবর্ণরাজ শশাঙ্কের, দ্বিতীয়টি কোন পরবর্ত্তী গুপ্ত নৃপতির এবং তৃতীয়টি সম্বন্ধে এখনও কোন স্থির মত ধার্য্য হয় নাই।[১০]
পাদটীকা :
১. Dr. Fleet হিমালয়ের পশ্চিমভাগে কুমায়ুন অঞ্চলে কর্তৃপুরের স্থান নির্দ্দেশ করেন।
২. ‘সমতট-ডবাক-কামরূপ-নেপাল-কর্তৃপুরাদি প্রত্যন্ত-নৃপতিভিঃ সর্ব্বকরদানাজ্ঞাকরণপ্রণামাগমন-পরিতোষিত প্রচণ্ড-শাসনস্য।’-Fleet. Gupta Inscription, P. 66; গৌড়রাজমালা, ৪ পৃ; J. R. A. S. 1898. P. 198; Smith. Early History, PP. 270-1.
৩. Early History, P. 271; বাঙ্গালার পুরাবৃত্ত, ১৪৮ পৃ।
৪. Early History, P. 287; J. R. A. S. 1901, P. 579 & 1903, P. 551.
৫. Meherauli Iron Pillar Inscription-fat fat
৬. পার্শ্ববর্তী এক প্রাচীরগাত্রে নানা ভাষায় ঐ প্রশস্তির যে সকল অনুবাদ প্রদত্ত হইয়াছে, তন্মধ্যে ইংরেজী ভাষা আছে : ‘He on whose arm fame was inscribed by the sword when in battle in Vanga countries (Bengal). He kneaded and turned back with his breast the enemies that united together came against him.’ এই ইংরেজী অনুবাদ প্রশস্তির সময় খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী বলিয়া অনুমতি হইয়াছে দেখিয়াছিলাম। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়ও ৩৭৫ হইতে ৪১৩ খৃষ্টাব্দ পৰ্য্যন্ত। (See Hist. of Bengal, Dacca Univ., Vol. 1, PP. 47-48–শি মি)
৭. গৌড়রাজমালা ৫ পৃ; Fleet. Gupta Inscriptions, p. 146; Smith, Early History. P. 301.
৮. কেহ কেহ প্রমাণ করিতে চাহেন যে, বোধিদ্রুম-বিনাশক শশাঙ্ক ও কর্ণসুবর্ণরাজ শশাঙ্ক একব্যক্তি নহেন। কর্ণসুবর্ণরাজ সমতটের অধীশ্বর ছিলেন, কিন্তু তথায় কোন বৌদ্ধমূর্ত্তির উপর কিছুমাত্র অত্যাচার করেন নাই। মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, ১ম খণ্ড, ১০৩-১১০ পৃ।
৯. Notes on three ancient coins found at Mahammadpur in the Jessore District, J. A. S. B. 1852, Vol. XXI, P. 401.
১০. Indian Museum Catalogue of Coins. Vol. I, P. 122. pl XVI.—শি মি
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন