৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব

সতীশচন্দ্র মিত্র

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব

মৃত্তিকা ॥ যশোর-খুলনায় কোন পৰ্ব্বত বা পাহাড় নাই, রাঢ় বা পশ্চিমাঞ্চলের মত এখানকার মাটী রক্তাভ বা কঙ্করময় নহে। গঙ্গার গৈরিকবর্ণ পলিমাটী অল্পাধিক বালুকামিশ্রিত হইলে যে ঈষৎ পাটলবর্ণ হয়, এ অঞ্চলের মাটীর তাহাই সাধারণ রঙ্। যতদূর পর্য্যন্ত মিষ্টজল যায়, বা পূর্ব্বে যাইত, ততদূর এই মাটীর রঙ্ আছে এবং ততদূর পর্য্যন্ত কতক পরিমাণে বালুকা দেখা যায়, –নদীর তলে, কূলে বা চরে শ্বেতবর্ণ বালুকা— উহার জন্য জল পরিষ্কৃত এবং নদীতীরে কদম থাকে না। কিন্তু দক্ষিণে লবণাক্ত নদীর কূলে ভীষণ কদম, তাহাতে পা দিলে কৰ্দ্দমে মানুষ ডুবিয়া যায় এবং সে গাত্রলিপ্ত কৰ্দ্দম সহজে ধৌত হইতে চাহে না। সুন্দরবনে বৃক্ষাদি পচিয়া অনেক স্থানে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মাটী হয়, তাহাই জোয়ারে বাহিত হইয়া উত্তরদিকে পার্ব্বত্য পলিকে কৃষ্ণাভ করিয়া দেয়। এ দেশের মাটী উদ্যান বা শস্যের পক্ষে ভাল, কিন্তু উহা প্রাচীরাদি নির্মাণে ভাল নহে। এজন্য মৃত্তিকার প্রাচীরবেষ্টিত গৃহের সংখ্যা খুব কম। পশ্চিমাঞ্চলে ইষ্টক গৃহ ব্যতীত সব গৃহই যেমন মৃত্তিকার প্রাচীর বিশিষ্ট, এদেশে তাহা নহে। যাহা অল্পসংখ্যক আছে, তাহা উত্তমভাবে লেপিয়া জলবৃষ্টি হইতে রক্ষা করিতে হয়। দক্ষিণভাগে মাটী অত্যন্ত লবণাক্ত, তদ্বারা প্রাচীর গাঁথিলে অচিরে খসিয়া পড়ে। ইষ্টক প্রভৃতিরও ভাল রঙ্ খুলে না এবং তেমন শক্ত হয় না। পূর্ব্বে যখন ভৈরব প্রভৃতি নদনদী দিয়া পাৰ্ব্বত্য মিষ্টজল নামিত, তখন মাটী এত লোণা ছিল না; ইট, প্রাচীরও ভাল হইত। পাঠান আমলের বা পঞ্চদশ শতাব্দের যে ইট দেখা যায়, তাহা মোগল আমলের বা ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দের ইট অপেক্ষা অনেক ভাল।

গৃহ।। দৈশিক অবস্থান অনুসারে মানুষের গৃহনির্মাণের উপাদানও পৃথক্ হইয়া থাকে। মাটীর প্রকৃতির সহিত ইহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। ইষ্টক বা মৃন্ময় প্রাচীরের গৃহ বোধ হয় এ দেশের লোকের অবস্থার অনুরূপ নহে। যশোহর-খুলনায়, বিশেষতঃ খুলনার দক্ষিণাংশে যেমন স্বল্পব্যয়ে গৃহনিৰ্ম্মাণ করা যায়, এমন বোধ হয় কুত্রাপি হয় না। যশোহরে ও খুলনার উত্তর ভাগে যথেষ্ট উলুখড় পাওয়া যায়, আর খুলনায় সুন্দরবনে পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে গোলপাতা। সুতরাং ঘরের ছাউনী প্ৰায় খড় বা গোলপাতা দ্বারা হয়। গোলপাতা সস্তা বলিয়া সাধারণের তাহাই ব্যবস্থা। এ অঞ্চলে বাঁশের অভাব নাই, এবং সে বাঁশও ভাল এবং শক্ত। কাঁটাল, সোণালি ও তালগাছে খুঁটি হয়, তাহা ছাড়া সুন্দরবন হইতে সুন্দরী, পশুর, আমুর বা গরাণ প্রভৃতি খুঁটির জন্য আমদানী হয়। পূৰ্ব্বে যত হইত, এখন তত আসে না বটে, কিন্তু তবুও কিছু কিছু আসে; লোকে পয়সার বলে শাল সেগুণের দিকে অধিক দৃষ্টি না দিয়ে আরও আসিত। বাঁশের কাঁচুনী বা ছিটে এবং নলের দড়মার বেড়া ভাল, অভাবে অল্প খরচে হোগলাপাতার ব্যবহার হয়। দক্ষিণদেশীয় বিলের মধ্যে নল এবং লবণাক্ত নদীর ধারে হোগলা অত্যধিক পরিমাণে জন্মে। এই সকল সাধারণের ব্যবহারোপযোগী ঘর তাহাদের শরীরের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর নহে।

বায়ু।। এ দেশে শীতকাল ভিন্ন সময়ে দক্ষিণদিক্ হইতে বাতাস বহে। শীতকালে উত্তরের বাতাস আসে, উহা অত্যন্ত ঠাণ্ডা। ঝড় উত্তর ও পশ্চিমদিক্ হইতে অধিক হয়, এজন্য বাড়ী প্রস্তুত করিবার সময় ঐ দুই দিকে আড়ালের ব্যবস্থা আছে। এ দেশে বায়ুকোণ বা উত্তর-পশ্চিম কোণ বায়ুকোণই বটে এবং পশ্চিমাঞ্চলের মত পশ্চিমদিক্ হইতে স্নিগ্ধ বাতাস আসে না। বাড়ী প্রস্তুত করিবার বিষয়ে একটা সাধারণ উপদেশ আছে :

দক্ষিণে ফাঁক্, উত্তরে বাগ,
পূবে হাঁস, পশ্চিমে বাঁশ।

অর্থাৎ দক্ষিণদিকে ফাঁক বা খোলাস্থান রাখিতে হইবে, উত্তরে ফল-বৃক্ষের উদ্যান হইবে, পূর্ব্বদিকে পুকুর হইবে এবং তাহাতে হাঁস চরিবে, পশ্চিমে বাঁশঝাড়ে প্রাচীরের কাজ করিবে। এ প্রণালীতে দক্ষিণদ্বারী বাড়ী করিতে হয়, এ দিকে দক্ষিণে খোলা না থাকিলে বাতাস পাওয়াই যায় না। পূর্ব্বদিকে পুকুর থাকিলে, সে দিকেও অনেকটা খোলা থাকিল এবং প্রাতঃসূর্য্যের স্নিগ্ধ কিরণ-মালা পাওয়া গেল এবং পুকুরও অন্দর এবং বাহিরের কাজে লাগিল এবং পশ্চিমপারে ঘাটে বসিয়া হিন্দুদিগের পূৰ্ব্বমুখ হইয়া সন্ধ্যাহ্নিক করা চলিল। উত্তরদিকে ঘনবিন্যস্ত বাগানে শীত বায়ু এবং ঝড় হইতে রক্ষা করিল। এই দেশ-প্রচলিত সাধারণ কথাটা এ অঞ্চলের বায়ু চলাচলের প্রকৃতি বুঝাইয়া দেয়। এ দেশের হাওয়া অত্যন্ত লবণাক্ত এবং জলীয় বাষ্পপূর্ণ। তজ্জন্য দেশের সমস্ত জিনিষই যেন বারমাস কেমন সিক্ত থাকে, শুষ্ক বা খটখটে ভাবের একপ্রকার অভাব বলিলেই হয়। এখানে রৌদ্রে কাপড় শুকাইতে বিলম্ব হয়, গ্রীষ্মকালে মানুষের অত্যন্ত ঘর্ম্ম হয় এবং ঘামাচি, খোস পাঁচড়া ও দাদ্ প্রভৃতি চর্মরোগ কিছু বেশী। লোণা হাওয়ায় মানুষের শরীর শ্লেষ্মাপ্রধান হয়, তজ্জন্য মানুষকে অলস করিয়া ফেলে। এ দেশে শীতকালে লোকে বেশী খায়, বেশী হজম করে এবং অধিক কাজ করে, কারণ, তখন লোণা হাওয়া থাকে না। গ্রীষ্মকালে তেমন খাইতে পারে না, কাজ করিতে পারে না, শুধু দিবানিদ্রাই সার হয়। লোণা হাওয়ার ক্রিয়া কমাইবার জন্য লোকে স্নানের পূর্ব্বে গায়ে প্রচুর পরিমাণে তৈল মর্দন করে।[১]

জল।। লোণা হাওয়া যেমন খারাপ, লোণা জলও তেমনি। ইহা পানীয়ের জন্য ব্যবহৃত হয় না বটে, কিন্তু স্নানের দোষ নাই; বরং লোণা জলে স্নান করিলে শরীর ভাল থাকে। এই জন্যই স্বাস্থ্যের জন্য সমুদ্রস্নানের ব্যবস্থা হইয়া থাকে। লোণা জলে চর্ম্মরোগ একটু বাড়ে বটে, কিন্তু অন্য রোগ খুব কম হয়। যশোহরে বদ্ধজলে ম্যালেরিয়া বাসা করিয়াছে বটে, কিন্তু এখনও সে দক্ষিণাঞ্চলে যাইতে অনেকটা ভয় পায়। লোণা জল-হাওয়ায় মানুষের শরীরের রঙ্ তাম্রবর্ণ করিয়া দেয়, গঙ্গার তটবর্ত্তী সে কমকান্তি এই সুন্দরবনের রাজ্যে নাই। লোণা হাওয়ার মত লোণা জল সৰ্ব্বত্র যায় নাই; উত্তরে ভৈরব পৰ্য্যন্ত লোণা জল গিয়াছে, তাহার উত্তরে নদীর জল মিষ্ট। চিত্রা, নবগঙ্গা, কুমার বা গোরাই নদীর জল অতীব উপাদেয়। ভৈরবের দক্ষিণে নদীপথে যাইতে হইলে যেমন পানীয় জল সঙ্গে লইতে হয়, উত্তরদিকে তেমনি শুধু জলেই মানুষকে তৃপ্তি দেয়। নবগঙ্গা প্রভৃতি নদীর তলে ও চড়ায় বালুকা অধিক, এজন্য জল স্ফটিকবৎ দেখায়। কপোতাক্ষের জল এখনও উত্তরাংশের কপোতচক্ষুর মত নির্ম্মল। একপ্রকার রুদ্ধগতি হইলেও যমুনা এখনও উত্তরাংশে নিৰ্ম্মলসলিলা। দক্ষিণদেশীয় নদীমাত্রে শুধু কৰ্দ্দম, জল ঘোলা, নদীর কূলে কোথায়ও বালুকা নাই, এজন্য সে অঞ্চলে স্নান করিয়াও তৃপ্তি নাই। পূর্ব্বে দক্ষিণ অঞ্চলে লোণা জল জ্বালাইয়া প্রচুর পরিমাণে লবণ প্রস্তুত করিত। সন্দ্বীপ প্রভৃতি দ্বীপ হইতে শত শত জাহাজ লবণ বোঝাই করিয়া বিদেশে যাইত। এখন দেশীয় লোকের সে ব্যবসায় নাই, এমন কি নিজেদের ব্যবহারোপযোগী লবণটুকুও প্রস্তুত করিতে পারে না। গবর্ণমেণ্ট লবণের একচেটিয়া ব্যবসায় হাতে লইয়াছেন। এখন লোকে পরের লবণই খায়, তবুও তাহার মর্য্যাদা রক্ষা করে।

জীবজন্তু।। জীব-জন্তু বা বৃক্ষলতা সম্বন্ধে সুন্দরবন সম্পূর্ণ বিভিন্ন। এজন্য তাহার বিশেষ বিবরণ পৃথকভাবে প্রদত্ত হইল। এস্থলে উত্তর ভাগের কথাই আমাদের আলোচ্য। যশোহর-খুলনার লোকালয়ে গো, ছাগ, কুকুর ও বিড়াল গৃহপালিত পশু। মেষ ও মহিষ যশোহরের উত্তর ও পশ্চিম ভাগে আছে বটে, কিন্তু ইহারা খুলনার পূর্ব্ব দক্ষিণে দীর্ঘজীবী হয় না। এমন কি যশোর অঞ্চল হইতে খুলনার কৃষকগণ বর্ষার প্রাক্কালে হালে চষিবার জন্য বলদ কিনিয়া লইয়া যায়; কিন্তু লবণাক্ত ও কদমময় দেশে, অনভ্যস্ত খাদ্যের জন্য উহারা প্রায়ই বর্ষান্তে মরিয়া যায়।[২] অনেকে এরূপ ঠকিবে জানিয়াও গরু কিনে, কারণ তাহা না হইলে জমি পতিত থাকে। সুন্দরবনের আবাদের জন্য এইভাবে অনেক গো-হত্যা হয়। ভৈরবের দক্ষিণে বলদ বা গাভী উভয়ই খারাপ। যশোরের গাভীতে দুগ্ধ অধিক হয়, তাহাদের শরীর ভাল ও দীর্ঘজীবী হয়। সঙ্গতিসম্পন্ন ও উদ্যোগি-লোকে এক্ষণে বৈদেশিক গাভী ও বলদ আনিয়া পুষিতে আরম্ভ করিয়াছেন। সাধারণতঃ এক্ষণে আর গরু পুষিবার আদর নাই। গোষ্ঠ নাই। বলদের দোষে গরুকুল নির্মূল হইতে রসিয়াছে। পূর্ব্বে শ্রাদ্ধের বৃষোৎসর্গের পর ষাঁড় ছাড়িয়া দিত, উহারা অত্যাচার করিলেও লোকে কিছু বলিত না, কারণ তাহারা একভাবে দেশের উপকার করিত; লোকে দধি দুগ্ধ ঘৃতের লোভে সে উপকার বুঝিত।

বনে জঙ্গলে শিয়াল, খাটাস, বনবিড়াল, গ’লো এবং মাঝে মাঝে কেঁদো ও নেকড়ে বাঘ দেখা যায়। পুরাতন জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে বন্য শূকরের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব। খরগস ও সজারু অলক্ষিত ভাবে ফসলের ক্ষতি করে। রাঢ় বা পশ্চিমবঙ্গের মত হনুমান্ বা সুন্দরবনের মত বানরের উৎপাত এ অঞ্চলে নাই। যশোরের দুই এক স্থান ব্যতীত এ প্রদেশের সর্ব্বত্র কাঠবিড়ালীর হাতে নিস্তার পাইয়াছে।

খুলনার সীমার মধ্যে প্রত্যেক প্রবহমান নদীতেই কুমীরের অত্যাচার আছে। এজন্য স্নানের জন্য নদীতে লোকে ঘাট ঘিরিয়া লয়। যশোরের সীমায় কুমীর যায় নাই। খাঞ্জালীর দীঘিতে কয়েক স্থানে পোষা কুমীর আছে, তাহারা মানুষ খায় না। মধুমতীতে ‘ভেঁসাল’ নামে এক জাতীয় কুমীর আছে, উহারাও মানুষকে খাদ্যগণ্ডী-ভুক্ত করে নাই। দুই একটি নদীতে হাঙ্গর বা কামট দেখা যায়; উহারা পাঙ্গাস মাছের মত, কিন্তু প্রকাণ্ড এবং ৬/৭ হাত পর্য্যন্ত দীর্ঘ হয়, উহাদের তিনপাটি সুতীক্ষ্ণ দাঁতে জলের ভিতর কখন মানুষের হাত পা কাটিয়া লয়, তাহা বুঝা যায় না। তবে ভাগ্যক্রমে দুই একটি প্রবল নদীতে ব্যতীত এ উৎপাত নাই। শুশুক গভীর নদীমাত্রেই আছে। নানাবিধ কচ্ছপ নদীতে ও খালে দেখা যায়। উহাদের মধ্যে যাহারা মড়া খায় এবং আকারে প্রকাণ্ড, তাহাদিকে ‘ঢালীয়ান’ বলে। সম্ভবতঃ ইহাদের গাত্রাবরণে ঢাল প্রস্তুত হইত, তজ্জন্য এরূপ নাম। এক সময়ে এই সকল কচ্ছপের খোলা বহু পরিমাণে বিদেশে রপ্তানি হইত। সে ব্যবসায় অনেকদিন উঠিয়া গিয়াছে; কারণ বিদেশে যাওয়ার নাবিক যে মুসলমান, কচ্ছপ স্পৰ্শ করাও তাহাদের ধর্ম্মবিরুদ্ধ। নদীতে আর যে এক প্রকার ছোট কচ্ছপ বা কাটাদুর এবং বিলে ও পুষ্করিণীতে ‘সুন্ধি’ কচ্ছপ জন্মে, তাহা এদেশীয় অনেক উচ্চশ্রেণীর হিন্দুতেও তুষ্টির সহিত খায়।

দক্ষিণাংশ হইতে চিংড়ি, ভেট্‌কী, পার্শিয়া, ভাঙ্গান প্রভৃতি মৎস্য ও কাঁকড়া প্রভূত পরিমাণে খুলনা জেলায় আমদানী হয়। আজকাল বড় বড় কারখানা হইতে শুক্‌না চিংড়ি-মাছ ভারে ভারে বিদেশে যাইতেছে। মধুমতী, রূপসা ও ভৈরবে যথেষ্ট ইলিশ মাছ পড়ে; মধুমতীর ইলিশ অপরিমিত পাওয়া যায় বটে, কিন্তু খুলনার ইলিশের মত সুস্বাদু নহে। যশোর-খুলনার নদীতে উত্তরভাগে রোহিত (রুই), কাতলা, মৃগেল, বাউস, চিতল, সিলিন্দা ও আইড় প্রভৃতি উৎকৃষ্ট বড় মৎস্য এবং বিল ও বাঁওড়ে কই, মাগুর, সিঙি, শইল, বাইন, পুঁটি, খলিসা, ফলই, পাবদা, রয়না, টেংরা প্রভৃতি বহুবিধ মৎস্য পাওয়া যায়। এদেশের খাদ্যোপকরণের প্রধান মৎস্য এবং মৎস্যের মধ্যে ‘যশুরে কই’ বহু বিদেশেও পরিচিত ছিল। তেলিহাটি পরগণা পূর্ব্বে যশোরে ছিল, এখন ফরিদপুরের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। সেখানে ব্যতীত তেমন বড় কই এখন আর যশোরে পাওয়া যায় না, যাহা কিছু পাওয়া যা, তাহাও অত্যল্প। এখন ‘যশুরে কই’ নাই, ‘কশুরে যই’ আছে। ডিম ছাড়িলে কইমাছ শীর্ণকায় হইয়া মস্তকসর্বস্ব থাকে। তাহারই সহিত তুলনায় এখন ম্যালেরিয়া-প্রপীড়িত যশোরবাসীই বিদেশে ‘কশুরে যই’ বলিয়া উপহসিত হয়। কিন্তু এই মস্তকসৰ্ব্বস্ব রুগ্ন যশোরবাসীর মস্তক যে আছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।

যশোর-খুলনায় পক্ষীর সংখ্যা অল্প নহে। হাড়গিলে, শকুনি, গৃধিনী, নানা জাতীয় চিল, বাজ, বক ও পেচক মাংসাশী পক্ষী। দাঁড়কাক এবং যশোরের উত্তরাঞ্চলবাসী পাতি কাক, উভয়েই সৰ্ব্বভুক। পেঁচা ও ভুতুম্ (হুতোম পেঁচা) অমঙ্গলজনক ও নিশাচর। উত্তরভাগে বাদুড় স্থানে স্থানে লাখে লাখে একত্র বাস করে এবং রাত্রিকালে দেশের ফলবৃক্ষের উপর রাজত্ব করে। কোকিলের কুহুরব, পাপিয়ার ‘চোকগেল’ বুলি তা’ড়োর ‘ইষ্টকুটুম’ ধ্বনি, দয়েল বা শ্যামার শীস্, চাতকের ‘ফটিকজল’ ও ‘বউ কথা কও’ পাখীর চীৎকার কানন ও প্রান্তর মুখরিত করে। মানুষে শালিক ও টিয়া পুষিয়া থাকে; ময়না বা লালমোহন এ দেশের পাখী নহে। হাঁস, পায়রা ও কুক্কুট গৃহপালিত পক্ষী। ঘুঘু, চড়ুই, বাবুই, টুনি, ঝুটকুলি প্রভৃতি জঙ্গলে থাকে। যশোরের উত্তরভাগ বিল বাঁওড়ে কা’ন, সরাইল, পানি কুমড়ী ও গয়াল প্রভৃতি ঝাঁকে ঝাঁকে থাকে এবং লোকে উহাদিগকে মারিয়া খায় ও বিক্রয়ার্থ খুলনা অঞ্চলে আনে। ডাহুক ও মাছরাঙ্গা সর্ব্বত্র জলের ধারে থাকে।

বৃক্ষলতা॥ ফলের বৃক্ষের মধ্যে পূর্ব্বভাগে সুপারি, নারিকেল, মধ্যভাগে তাল ও খেজুর, উত্তরাংশে আম ও কাঁটাল ভাল হয়। বাগেরহাট অঞ্চলের সুপারি ও যশোর নলডাঙ্গার আম বিখ্যাত। লিচু, জামরুল বেশীদিন আসে নাই, তবে লিচু আমের সহিত মিত্রতা করিয়া যশোরে ভাল হয়। আগে ছিল বরই (বদরী বা টেপা কুল) এবং গ’য়ে আম (গয়ার আম বা পেয়ারা), এখন তাহারাও আছে, তবে ভাল কুল ও পেয়ারার কলম আসিয়া তাহাদের পশার মাটী করিতেছে। গোলাপ ও কালো জাম, বেল, তেঁতুল, চালিতা ও নানাবিধ লেবু সৰ্ব্বত্র ফলে। ম্যালেরিয়া-প্রপীড়িত যশোরে তেঁতুলের আদর কিছু অধিক। হুগলীর মত এখানকার লোকেও তেঁতুল কিছু ভালবাসে এবং ভাবে ইহা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারক। যেখানে জল বায়ু উভয়ই অপকারক, সেখানে তেঁতুলের অতিরিক্ত আদর দেখিয়া এক কবি লিখিয়াছে :

‘জীবনং জীবনং হন্তি প্রাণান্ হন্তি সমীরণ
যশোহরে কিমাশ্চর্য্যং প্রাণদা যমদূতিকা।’

যমদূতিকা শব্দের এক অর্থ তেঁতুল।

পূর্ব্বে কলা কয়েক প্রকার মাত্র ছিল, যথা জিন বা ঠ’টে (লম্বীর), দয়া কলা (বীচিযুক্ত), চাঁপা এবং সবরী (মর্তমান)। এখন চিনিচাঁপা, কাবুলী, রামকেলি, কানাইবাঁশীর চাষ হইতেছে। ২/৩ রকম কাচকলা পূর্ব্বেও ছিল, এখনও আছে। কতকগুলি বিদেশী ফল এদেশে আসিয়াছে, যথা মৰ্ত্তবান কলা (মাৰ্ত্তাবান দ্বীপ), বাতাপি লেবু (ব্যাটাভিয়া সহর), পেঁপে (পাপুয়া দ্বীপ), কলম্বো লেবু (কলম্বো সহর), তন্মধ্যে ডাক্তারের প্রশংসাপত্র পাইয়া পেঁপের কিছু পশার হইয়াছে। মূল্যের লোভে লোকে যত্ন করিয়া ইহা লাগাইতেছে। দেশে লোণা আসিয়া আতা ও ডালিম উঠিয়া যাইতেছে, কিন্তু লোণা দেশে নোনা মন্দ হয় না। যশোরের নানাস্থানে শীতকালে ফুটি, কাঁকুড়, শশা ও তরমুজ খুব ফলিয়া থাকে এবং দুই জেলায় বিক্রয় হয়। মধুমতীর তীরভূমির তরমুজ বেশ বড় ও মিষ্ট। আনারস পূর্ব্বে আমাদের দেশীয় ফল ছিল না কিন্তু ইহা অতি মুখরোচক। পর্তুগীজেরা প্রথম আনারস (Ananas) এদেশে আনেন।[৩] দৌলতপুরের আনারস বিখ্যাত। ইহা ব্যতীত কেফল, ডউয়া ও নানাজাতীয় আমড়া অম্লের জন্য ব্যবহৃত হয়।

রাস্তায় অশ্বত্থ, বট, বাদাম, কদম্ব, অৰ্জ্জুন, শিরীষ, আম, জাম, কাঁটাল ও (যশোরে) বাংলা ছায়াদান করে। ঝাউ ও কৃষ্ণচূড় দেবমন্দির, বিদ্যালয় বা বারোয়ারী স্থানে প্রহরীস্বরূপ। তাল, সোণালি ও কাঁটাল গাছে খুঁটি এবং আম, জাম, কাঁটাল, পুইয়া, শিরীষ, শিমুল প্রভৃতি বৃক্ষে তক্তা হয়। রয়না, মাটাম, জিওল, ছাতেনী (সপ্তপর্ণী), সাঁড়া, জিয়াপতি প্রভৃতি অন্যান্য বৃক্ষ অসংখ্য। বাঁশের বাস যে কোথায় নাই, তাহা বলা যায় না। ভালুকা, জাবা ও তল্লা, এই তিনপ্রকার বাঁশ এদেশে পাওয়া যায়। বাঁশের মত বেতও সৰ্ব্বত্র। বেতসকুঞ্জ কাহাকে বলে দেখি নাই, তবে বেতের ঝোপে হিংস্রের নিবাস ইহা সকলে জানে এবং বেতসীবৃত্তি বা অনুকরণ প্রবৃত্তিটা বাঙ্গালীর স্বভাবগত হইয়া পড়িতেছে।

তরকারীর মধ্যে শিম, বেগুন, কলা, মূলা, আলু, কচু, লাউ, কুমড়া, ঝিঙ্গা, পটোল প্রধান। ভৈরবের দক্ষিণে ডুমুরিয়া প্রভৃতি স্থানের বেগুন, ফকিরহাটের নিকটবর্ত্তী বাগ্‌দিয়া প্রভৃতি স্থানের মূলা, যশোহর সহরের নিকটে ভাল ওল ও কচু, উত্তরাংশের বোরোধান্যের ভূমির আইলের উপর প্রচুর পরিমাণে কুমড়া এবং গাজীরহাটের পটোল ও উচ্ছে বিখ্যাত। মেটে আলু পূৰ্ব্বে খুব বেশী হইত; এখনও হয়, লোকে বড় একটা খায় না। অনেকে অন্য বিলাতী জিনিষের মত আমড়া, বিলাতী আলু (গোল আলী) পছন্দ করিতেছে। মিষ্ট কুমড়াও একপ্রকার এখনও বিলাতী বলিয়া পরিচিত হয়। কুমড়া বা কুষ্মাণ্ড বলিতে চাল-কুমড়া বুঝাইত, উত্তর দিকে ইহাই ভূমির উপর হইয়া গেমি-কুমড়া নাম ধারণ করিয়াছে। ইহা ব্যতীত নানা জাতীয় ডাটা, পালংশাক, কাকরোল, পানিকচু, শাক-আলু (মিঠে বা মৌ-আলু) সৰ্ব্বত্র যথেষ্ট পাওয়া যায়। তালা ও মহেশপুর প্রভৃতি স্থানের লঙ্কা ও ডুমুরিয়ার পালংশাক বিখ্যাত। নানাবিধ কপি, শালগম ও গোল আলুর চাষও এদেশে অনেক স্থানে হইতেছে, তন্মধ্যে খুলনায় বাঁধাকপির চাষ সন্তোষজনক। চই পূর্ব্ববঙ্গের একটা বিশেষত্ব। অনেকে এই গাছ-মসল্যার কথা জানেন না। ইহাতে গোলমরিচের মত ঝাল, সুন্দর গন্ধ এবং ইহা শ্লেষ্মা কাশির ঔষধ। ইহা বরিশালে খুব অধিক, তন্নিম্নে খুলনায় পাওয়া যায়, যশোরে তেমন নাই।

এ প্রদেশের প্রধান খাদ্য চাউল। ময়দা আটা যাহা ব্যবহৃত হয়, সকলই বিদেশ হইতে আসে। যশোহর অপেক্ষা খুলনায় ধান্য ভাল হয়। যত দক্ষিণে ও পূর্ব্বে যাওয়া যাইবে, ধানের চাষ ততই সুন্দর। অর্থাৎ যে অঞ্চলে নদীসমূহ উপদ্বীপের স্বাভাবিক গঠনকার্যে লিপ্ত, ধান্য সেইদিকে ভাল হয়। বরিশাল জেলা বঙ্গে চাউলের জন্য প্রসিদ্ধ। ইহাকে বঙ্গের শস্যভাণ্ডার বলিয়া থাকে। খুলনার বাগেরহাট মহকুমার অধিকাংশ এই শস্য-ভাণ্ডারের অন্তর্গত। এক খুলনা জেলায় বিভিন্ন নামে সহস্ৰ প্রকার ধান্য জন্মে। স্থানান্তরে উহার একটি সাধ্যমত তালিকা প্রদত্ত হইবে। বরিশালে ও বাগেরহাটে একপ্রকার সরু পাতলা ধান জন্মে; উহা হইতে সুন্দরভাবে সিদ্ধ চাউল প্রস্তুত করিবার উৎকৃষ্ট প্রণালী তদ্দেশীয় লোকে জানে। এই সিদ্ধ চাউল ‘বালাম’ নামক একপ্রকার তদ্দেশীয় নৌকায় বোঝাই হইয়া দেশে দেশে বিক্রয়ার্থ যাইত, তজ্জন্য ঐ চাউলের নামই বালাম চাউল হইয়াছে। খুলনার দক্ষিণে ভাটিরাজ্যে অর্থাৎ সুন্দরবন বিভাগে নানাবিধ উৎকৃষ্ট ধান্য উৎপন্ন হয়। তাহা হইতে যে এক প্রকার শাদা মোটা আতপ চাউল প্রস্তুত হইয়া খুলনা-যশোরে বিক্রীত হয়, উহাকে লোকে ‘ভাটিয়াল’ চাউল বলে। এই সিদ্ধ বালাম ও আতপ ভাটিয়াল চাউলই যশোর-খুলনার উৎকৃষ্ট খাদ্য। যশোরে নবগঙ্গা ও মধুমতীর কূলে মটর, খেসারী, ছোলা, মুগ, মসূর প্রভৃতি কলাই এবং ধনে, সরিষা, রাঁধুনী, কালজিরা, গুয়া-মৌরি প্রভৃতি যথেষ্ট উৎপন্ন হইয়া সর্ব্বত্র হাট-বাজারে যায়। যশোরে ও খুলনায় ধান্য ও কলাইয়ের বিনিময় হইত। এখন যশোরবাসী পাঠ বা কোষ্ঠা বেচিয়া অর্থের লোভে উদরানের চাষ অনেকটা বন্ধ করিয়াছে, কাজেই ধন আসিলেও সে ধনে পেট ভরিতেছে না এবং দেশের দুর্ভিক্ষ ছাড়াইতেছে না। ভাগ্যক্রমে খুলনার লোকে পাটের ব্যবসায় এখনও তেমন বুঝে নাই। ভগবানের আশীৰ্ব্বাদে এই ব্যবসায়-বুদ্ধি দেশ হইতে লুপ্ত হউক।

পাদটীকা :

১. তৈলমৰ্দ্দনের বিশেষত্ব বিষয়ে Elphinstone বলেন :
‘They (the Bengalees) have the practice, unknown in Hindusthan’ of rubbing their limb with oil after bathing, which gives their skin a sleek and glossy appearance and protects them from the effect of their damp climate.’—History of India. P. 187. বঙ্গদেশে স্নানের পূর্ব্বে তেল মাখে, পশ্চিম অঞ্চলে স্নানের পর; বিকালে বা সন্ধ্যায় তৈলমর্দন করে। লোকের কাপড়ে ও গায়ের ময়লায় উহার পরিচয় থাকে।

২. যশোহরে প্রতিবৎসর বাহির হইতে ৬৪৪৭টি বলদ ও ২১২৯টি গাভী আসে এবং খুলনায় ঐরূপ ১০৯৯৮টি বলদ ও ৪১৬২টি গাভী খরিদ হয়। বলদের অধিকাংশই বৎসর মধ্যে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

৩. The Emperor Jahangir (Price), P. 22! Tuzuk-i-Jahangiri (Rogus), p. 5.

সকল অধ্যায়

১. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. ২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. ৩. নদী-সংস্থান
৪. ৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. ৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. ৬. সুন্দরবন
৭. ৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. ৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. ৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. ১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. ১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. ১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
১৩. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
১৪. ২. দ্বীপের প্রকৃতি
১৫. ৩. আদি হিন্দু-যুগ
১৬. ৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
১৭. ৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
১৮. ৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
১৯. ৭. মাৎস্য-ন্যায়
২০. ৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
২১. ৯. সেন-রাজত্ব
২২. ১০. সেন-রাজত্বের শেষ
২৩. ১১. আভিজাত্য
২৪. ১. তামস যুগ
২৫. ২. বসতি ও সমাজ
২৬. ৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
২৭. ৪. খাঁ জাহান আলি
২৮. ৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
২৯. ৬. পয়োগ্রাম কসবা
৩০. ৭. খালিফাতাবাদ
৩১. ৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৩২. ৯. হুসেন শাহ
৩৩. ১০. রূপ-সনাতন
৩৪. ১১. লোকনাথ
৩৫. ১২. হরিদাস
৩৬. ১৩. রামচন্দ্র খাঁ
৩৭. ১৪. গাজীর আবির্ভাব
৩৮. ১৫. মুকুট রায়
৩৯. ১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
৪০. ১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
৪১. পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
৪২. পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
৪৩. পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
৪৪. পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন