সতীশচন্দ্র মিত্র
লক্ষ্মণসেনদেব যখন পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন তাঁহার বয়স ৫০ বৎসর। তাঁহার রাজত্বকাল ২৭/২৮ বৎসর। তন্মধ্যে প্রথম কয়েক বৎসর তিনি পূর্ণ প্রতাপে রাজত্ব করেন। তাঁহার বীরত্বের অভিযানের যে সব কথা আছে, তাহার কতক তাঁহার পিতার রাজত্বকালে সম্পন্ন করিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয়। যখন তাঁহার বয়স ৭০ বৎসর পার হইল, তখন তিনি রাজকার্য্য একপ্রকার পরিত্যাগ করিয়া গঙ্গাবাসের জন্য নবদ্বীপ আসেন। এ সময় তাঁহার পুত্র মাধব, কেশব ও বিশ্বরূপ তিনজনই প্রাপ্তবয়স্ক। জ্যেষ্ঠ মাধব ভাবী উত্তরাধিকারী। পিতার রাজত্বকালে তিনি তৎসঙ্গে লক্ষ্মণাবতীতেই থাকিতেন। কেশব সম্ভবতঃ রাঢ় অঞ্চল শাসন করিতেন। এবং বিশ্বরূপ একপ্রকার স্বাধীনভাবেই সুদূর বিক্রমপুরে শাসনদণ্ড পরিচালনা করিতেছিলেন। বাড়ীর অন্তর্গত যশোহর-খুলনা তখন তাঁহারই তত্ত্বাবধানে ছিল। এখানে পৃথক কোন রাজপ্রতিনিধি ছিলেন কিনা, বা কে ছিলেন, ঠিক জানা যায় না।
লক্ষ্মণসেন যখন গঙ্গাবাসের জন্য নবদ্বীপ আসেন, তখন মাধবই গৌড়ের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন, এই সময়ে তিনি একবার বঙ্গত্যাগ করিয়া তীর্থযাত্রায় কেদারনাথ যান; কুমায়ুনে যোগেশ্বরের মন্দিরে মাধবসেন কৃত দানপত্রের তাম্রফলক আবিষ্কৃত হইয়াছে,[১] তৎপরে মাধবসেনের আর কোন সংবাদ পাওয়া যায় না। সম্ভবতঃ তিনি রাজধানীতে প্রত্যাগত হইবার অব্যবহিত পরে অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। এজন্য বৃদ্ধ নৃপতিকে আরও বৈরাগ্যপরায়ণ করিয়াছিল। এখন হইতে কেশব রাঢ় ও বরেন্দ্র উভয় প্রদেশ শাসন করিতে থাকেন। কিন্তু তিনি বিশ্বরূপের মত বীর বা সুদক্ষ ছিলেন না। এজন্য ফল হইল, রাজ্যমধ্যে বিপ্লব ও ষড়যন্ত্র। বল্লাল ও লক্ষ্মণ যে কৌলীন্যের সৃষ্টি করিয়া সমাজসংস্কারে হস্তক্ষেপ করেন, সেই দেশময় আন্দোলনেই লোক ব্যতিব্যস্ত ছিল। কাহার কুল গেল, শীল গেল, কে কিরূপ মৰ্য্যাদা পাইল, তাহাই তখন একমাত্র আলোচ্য বিষয় ছিল। বল্লাল কুলীনদিগের কুল-লক্ষণ রক্ষার পর্যবেক্ষণ জন্য যে ঘটকগণকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, তাঁহারা প্রাপ্তিযোগের অনুপাতে স্তাবকতা বা কুৎসারটনা দ্বারা দেশ তোলপাড় করিয়া তুলিয়াছিলেন।
সেনরাজত্বে সংস্কৃতের নবচর্চ্চা ঘটক-কারিকারই পুষ্টিসাধন করিতে লাগিল। যখন সকলেই সমাজ লইয়া ব্যস্ত, রাজমন্ত্রণা-গৃহ সামাজিক বিচারে কোলাহলময়, মহাসান্ধিবিগ্রহিকের মস্তিষ্ক কূলের কূটতর্কে বিলোড়িত, তখন দেশের দিকে কাহারও দৃষ্টি ছিল না।
বৃদ্ধ রাজা ব্রাহ্মণপণ্ডিত দ্বারা পরিবৃত হইয়া শাস্ত্র ও পরলোকচর্চ্চায় স্বচ্ছন্দে নবদ্বীপে গঙ্গাবাস করিতেছিলেন। গৌড় হইতে নবদ্বীপ পর্য্যন্ত গঙ্গার দুই ধারে অসংখ্য ব্রাহ্মণ কায়স্থ কুলীনের বাস হইয়াছিল। সকলেই নবদ্বীপে রাজার সভায় আসিতেন, কিন্তু আসিতেন কুলমর্য্যাদার জন্য, রাজকার্য্যের জন্য নহে। পূৰ্ব্বে বলা হইয়াছে যে, নবদ্বীপে শাসনকেন্দ্রস্বরূপ কোন রাজধানী ছিল না। বৃদ্ধ রাজার প্রাসাদ রক্ষার জন্য সামান্য সংখ্যক প্রহরী মাত্র ছিল। এই সময়ে মুসলমান আক্রমণ হয়।
মহম্মদ-ই-বক্তিয়ার[২] নামক খিলিজীবংশীয় এক অজ্ঞাতনামা বিকটমূৰ্ত্তি তুর্ক সৈনিক, দিল্লীশ্বর কুতবউদ্দীনের নিকট হইতে এক জায়গীর পাইয়া মগধে আসেন। সেখানে দেশ লুণ্ঠনাদি দ্বারা যথেষ্ট ধন সঞ্চয় ও সৈন্যসংগ্রহ করেন এবং বিহারদুর্গ হস্তগত করিয়া লন। জিগীষা জাগিলে থামে না। বঙ্গের অবস্থা তাঁহার জানিতে বাকী ছিল না। যখন তিনি বঙ্গবিজয়ের কল্পনা করিতেছিলেন, তখন গৌড়ের ষড়যন্ত্রকারিগণের সহিত উপঢৌকনের আদানপ্রদানে পূর্ব্বেই বঙ্গের সহিত তাঁহার সম্বন্ধ স্থাপিত হইয়াছিল। বিশ্বাসঘাতকতা ব্যতীত এদেশের কখনও পরাজয় হয় নাই। উপঢৌকনের গৌরব রক্ষার জন্য ফলিতজ্যোতিষীর ভাগ্যগণনা দেশময় লোককে জড়ভাবাপন্ন করিয়া তুলিল। দেশের দুর্ভাগ্য বক্ত-ইয়ার বা ভাগ্যবানের পুত্রের ভাগ্যে পরিণত হইল। মহম্মদ- ই-বক্তিয়ার বঙ্গযাত্রা করিলেন, কিন্তু গৌড়ে না আসিয়া তিনি প্রথমেই নবদ্বীপে গেলেন; কারণ, জানিতেন বঙ্গাধিপ লক্ষ্মণসেন এইস্থানেই বাস করিতেছিলেন।
মীনহাজ্-ই-সিরাজ নামক একজন মুসলমান ঐতিহাসিকের তবকাত্-ই-নাসিরি[৩] নামক গ্রন্থে বঙ্গাধিকারের প্রসঙ্গ আছে। ঐতিহাসিক মীনহাজ বঙ্গ-বিজয়ের প্রায় ৬০ বৎসর পরে গৌড়ে আসিয়া সমসুদ্দীন নামক একজন বৃদ্ধ সৈনিকের পুরাতন গল্প হইতে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া অসঙ্কোচে সমগ্র বাঙ্গালী জাতির মুখ কালিমামণ্ডিত করিয়া গিয়াছেন। তিনি বলেন, মহম্মদ সৈন্য- সামন্ত জঙ্গলে লুকাইয়া রাখিয়া সপ্তদশ অশ্বারোহী সহ ‘নোদিয়া’ রাজধানীতে উপস্থিত হইয়া, প্রহরীদিগের হত্যাসাধন করত পুরীর মধ্যে প্রবেশ করেন এবং তখন পশ্চাদ্ভাগ হইতে বৃদ্ধ রাজা ‘লছমনিয়া’[৪] শঙ্খনাটে বা পূর্ব্ববঙ্গে পলায়ন করেন। বঙ্গবিজয়-কাহিনীর ইহাই আবার একমাত্র প্ৰমাণ।
কিন্তু এ অলৌকিক দিগ্বিজয়কাহিনী বিশ্বাসযোগ্য নহে। বঙ্কিমচন্দ্র অভিশাপ দিয়া বলিয়াছেন: ‘সপ্তদশ অশ্বারোহী লইয়া বক্তিয়ার খিলিজী বাঙ্গালা জয় করিয়াছিল, একথা যে বাঙ্গালীতে বিশ্বাস করে, সে কুলাঙ্গার।’[৫] অথচ এই কথা দেশী বিদেশী শত লেখনীমুখে চৰ্ব্বিতচর্ব্বণে এমনভাবে এই বাঙ্গালীর কলঙ্ক দ্বারে দ্বারে ছড়াইয়া দিয়াছে যে, কোন প্রাদেশিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করিতে গেলেও এ সম্বন্ধে নিৰ্ব্বাক্ থাকা যায় না। সম্প্রতি সেনরাজগণের যে সকল তাম্রশাসন ও শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার আলোকপাতে এই একমেবাদ্বিতীয়ং বৃদ্ধ সৈনিকের রঞ্জিত বর্ণনা বিচারসহ হয় না;[৬] এবং সে বর্ণনা বর্ণে বর্ণে বিশ্বাস করিলেও বৃদ্ধ লক্ষ্মণসেনের কাপুরুষতা সপ্রমাণ হয় না।[৭] হয়ত লক্ষ্মণসেন পলায়ন করিয়াছিলেন; যেমন তিনি জীর্ণতনু লইয়া বৃদ্ধ হিন্দুর মত রাজ্যত্যাগ করিয়া গঙ্গাবাসের জন্য গৌড় হইতে নবদ্বীপে পলায়ন করিয়াছিলেন, তেমনই মুসলমান আক্রমণের প্রাক্কালে অদৃষ্টভীত স্বজন ও অমাত্য কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া স্বল্প-প্রহরী-বেষ্টিত এক প্রকার অরক্ষিত রাজপ্রাসাদ পরিত্যাগ করিয়া পুত্রের নিকট যাত্রা করিতে পারেন; কিন্তু তখন তিনি প্রকৃত পক্ষে বঙ্গাধিপ ছিলেন না, এবং তাঁহার পলায়নে বঙ্গদেশ বিজিত হয় নাই।[৮] একবার যেমন মহম্মদ খিলিজী মগধে ওদন্তপুরীতে বৌদ্ধবিহার লুণ্ঠন করিয়া অবশেষে ‘কিল্লা ফতে করিবার ভুল বুঝিয়াছিলেন, এবারও তেমনই লক্ষ্মণসেনের পরিত্যক্ত নোদিয়া রাজপুরী লুণ্ঠন করিয়া দেখিলেন, এখানে রাজধানী নাই। ওদন্তপুরীর মুণ্ডিতশীর্ষ শ্রমণের পরিবর্তে এখানে চতুৰ্দ্দিকে শিখাতিলক-সম্বলিত ব্রাহ্মণেরই বাস এবং তাঁহারাও অধিকাংশ পলায়িত। যদি নবদ্বীপেই রাজধানী থাকিবে, তবে মুসলমানেরা এখানে কোন শাসনকেন্দ্ৰ করিলেন না কেন?
নদীয়া লুণ্ঠনের পর মহম্মদ গৌড় যাত্রা করেন। সম্ভবতঃ ১২০০ খৃষ্টাব্দে এই ঘটনা হয়।[১০] গৌড়ে কেশবসেন দুই বৎসর কাল সবিক্রমে যুদ্ধ চালাইয়া অবশেষে পরাজিত হইয়া পূর্ব্ববঙ্গে পলায়ন করেন। তখন গৌড় মুসলমানের করায়ত্ত হয়। এডুমিশ্রের কারিকা হইতে জানিতে পারি যে, কেশবসেনের সৈন্যসামন্ত সহ পূর্ব্ববঙ্গে এক রাজার নিকট আশ্রয় লন।[১১] সে রাজার নাম পাওয়া যায় নাই। কেহ বলেন তিনি বিশ্বরূপসেন। কিন্তু তাহা হইতে পারে না, কারণ এই রাজা কেশবসেনের নিকট বল্লালী কৌলীন্য সম্বন্ধে তথ্য জানিতে চাহিয়াছেন। বিশ্বরূপের সে তথ্য অবিদিত থাকিতে পারে না। কেহ কেহ বলেন, লক্ষ্মণসেনের সময়ে জ্যোতিবর্ম্মা সেনরাজগণের সামন্তস্বরূপ চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলে রাজত্ব করিতেছিলেন। তাহার পুত্র হরিবর্ম্মাদেব। এই হরিবর্ম্মার মন্ত্রী ছিলেন ভবদেব বালবলুভীভুজঙ্গ। সম্ভবতঃ কেশবসেন এই হরিবর্ম্মার রাজধানীতে আসিয়াছিলেন।[১২] যাহা হউক, পরে তিনি কিছুকালের জন্য বাড়ী অঞ্চলে রাজত্ব করিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয়।[১৩] অনুমান হয়, এই সময়েই সুন্দরবন অঞ্চলে জলবিপ্লব হইয়াছিল এবং তাহাতে এ প্রদেশ বাসের অযোগ্য হইলে কেশবসেন বিক্রমপুরে চলিয়া যান। তথায় বিশ্বরূপসেন স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতেছিলেন।
মুসলমানেরা গৌড় অধিকার করিবার পর কয়েক বৎসর চেষ্টা করিয়া রাঢ়ের কতকাংশ মাত্র স্বায়ত্ত করিয়াছিলেন। সেখানে লক্ষ্ণৌর তাঁহাদের রাজধানী হয় এবং উহাই তাঁহাদের দক্ষিণ সীমা ছিল। বহু বৎসর কাল পাঠান রাজ্য গৌড় হইতে লক্ষ্ণৌর পর্য্যন্ত সংকীর্ণ ভূভাগে আবদ্ধ ছিল। পূর্ব্ববঙ্গে তাঁহারা অগ্রসর হইতে পারেন নাই। সেখানে বীরনৃপতি বিশ্বরূপ পাঠানের সমস্ত অভিযান ব্যর্থ করিয়া দিয়াছিলেন এবং ‘গর্গ বনান্বয় প্রলয়কালরুদ্র’ উপাধিতে বিশেষিত হইয়াছিলেন।[১৪] বঙ্গ-বিজয়ের ৬০ বৎসর পরে যখন মীনহাজ গৌড়ে আসেন, তখনও তিনি পূর্ব্ববঙ্গে স্বাধীন সেন-রাজত্ব দেখিয়া গিয়াছিলেন। বিশ্বরূপের পর দনুজমাধব এবং পরে তাঁহাদের উত্তরাধিকারিগণ চতুৰ্দ্দশ শতাব্দীর মধ্য পর্য্যন্ত সবলে পূর্ব্ববঙ্গে শাসনদণ্ড পরিচালনা করিতেছিলেন। এ সময়ে সুন্দরবন অঞ্চলে জলপ্লাবন ও নিমজ্জন হেতু বাড়ীর দক্ষিণাংশের অবস্থা অতি শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছিল। যশোহর-খুলনার উত্তরাংশে যে সকল স্থান অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থায় ছিল, তথায় স্থানীয় মান্ডলিক জমিদারেরা লাঠির জোরে রাজ্যের গণ্ডী বিভাগ করিয়া লইয়াছিলেন; এবং দরিদ্র প্রজা সন্তুষ্টিসাধন দ্বারা তাঁহাদের হস্তে নিস্তার পাইলেও দস্যু দুৰ্ব্বত্ত এবং হিংস্র জন্তু দ্বারা বিশেষ বিড়ম্বিত হইত। শরীরের বল ও বীরত্ব তাহাদের একমাত্র অবলম্বন এবং সামাজিক বাদ-বিচার একমাত্র ব্যবসায় ছিল।
পাদটীকা :
১. Atkinson, Kumaon, P. 516; J. A. S. B. 1896. P. 28.
২. ইঁহার পুরা নাম ইতিয়ার উদ্দীন মহম্মদ-ই-বক্তইয়ার খিলিজী। বক্ত-ইয়ার ইঁহার পিতার নাম। সুতরাং বঙ্গবিজেতাকে ইতিয়ার উদ্দীন বা সংক্ষেপতঃ মহম্মদ খিলিজী নামে অভিহিত করাই সঙ্গত।
৩. Tabaqat-i-Nasiri by Minhaj-i-Siraj Abu-Umr-Usman, son of Mahammad-i-Minhaj Al-Jarjani; translated from persian, by Major H. G. Raverty, 1881.
৪. কেহ কেহ লছমনিয়াকে শুদ্ধ ভাষায় লাক্ষ্মণেয় করিয়া তদ্বারা লক্ষ্মণসেনের পুত্রকে বুঝিয়াছেন। তদনুসারে কেহ বলেন কেশবসেনই এই লছমনিয়া। কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে। সেখ শুভোদয়াতে লছমনিয়াকে স্পষ্টভাবে বল্লালের পুত্র বলিয়া উল্লিখিত আছে। তৎকালীন ঐতিহাসিকেরা লছমন অর্থাৎ লক্ষ্মণের নামের শেষে অবজ্ঞাসূচক আলেফযোগ করিয়া লছমনিয়া করিয়াছেন; লছমনিয়া ও লছমন একই কথা। সাহিত্য, ১৩০১, বৈশাখ।
৫. বঙ্গদর্শন, ১২৮৭, অগ্রহায়ণ।
৬. অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, ‘লক্ষ্মণসেনের পলায়নকলঙ্ক’ প্রবন্ধ, প্রবাসী ১৩১৫, অগ্রহায়ণ।
৭. গৌড়রাজমালা, ৭৬-৭ পৃ।
৮. রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে ১১৭০ খৃষ্টাব্দের পরে লক্ষ্মণসেন জীবিত ছিলেন না। ডাক্তার কিলহ প্রথমতঃ এই মতাবলম্বী ছিলেন, পরে তাহা পরিত্যাগ করেন। রাখালবাবু কুলগ্রন্থ ও দাসনাগরাদি গ্রন্থের উপর আস্থা স্থাপন না করিয়া দুই এক খানি খোদিত লিপির অস্পষ্ট উক্তি হইতে এই ব্যাখ্যা করিয়াছেন (প্রবাসী ১৩১৯, শ্রাবণ, ৩৯৮ পৃ)। তাঁহার মত সত্য হইলে লক্ষ্মণসেনের পলায়নকাহিনী উড়িয়া যাইবে।
৯. এখন সে ওদন্তপুরী বা উদ্দন্ডপুর মহাবিহারের ভগ্নাবশেষের উপর ক্ষুদ্র নালন্দা কলেজ সংস্থাপিত হইয়াছে এবং সেই সুবিস্তৃত ভগ্নাবশেষের মধ্য হইতে এ পর্য্যন্ত রাশি রাশি প্রস্তরমূর্তি বাহির হইয়া দেশে বিদেশে নীত হইয়াছে। এইস্থান পাটনার মহকুমা – বিহারসরিফ সহরের একাংশে অবস্থিত।
১০. এই পাঠান বিজয়ের তারিখ লইয়া নানা বিতণ্ডা হইয়াছে। ব্লকম্যান সাহেবের মতে ১১৯৮-৯ খৃঃ অব্দ। বিভারিজ আকবরনামা হইতে দেখান যে, লসং ১১১৯ খৃঃ অব্দে আরম্ভ হয় (J. A. S. B. 1818, Part 1. P. 2); কিলহৰ্ণ তাহাই সমর্থন করেন (Indian Antiquary, Vol, XIX)। মীনহাজের বর্ণনায় লক্ষ্মণের বয়স ৮০ বৎসর হইলে ১১৯৯ খৃঃ অব্দে বঙ্গবিজয় হয়। নগেন্দ্রবাবু বলেন ১১৯৯ খৃঃ অব্দের পর বল্লাল ৫০ ও লক্ষ্মণসেন ২৭/২৮ বৎসর রাজত্ব করেন, সুতরাং বঙ্গবিজয়াব্দ ১১৯৭-৮ (J. A. S. B. 1896. P. 31)। সেখশুভোদয়ায় একটি শ্লোক আছে : ‘চতুৰ্ব্বিংশোত্তরে শাকে সহস্রৈকশতাধিকে। বেহার পাটনাৎ পূর্ব্ব তুরস্কঃ সমুপাগতঃ ইহা হইতে সুপণ্ডিত উমেশচন্দ্র বটব্যাল মহাশয় দেখান, ১১২৪ শকে বা ১২০২-৩ খৃষ্টাব্দে বঙ্গবিজয় হয় (সাহিত্য, ১৩০১, ৩ পৃ)। গয়ার বিষ্ণুপাদ মন্দিরের প্রশস্তি অনুসারে গোবিন্দপালদেব ১১৬১ খৃঃ অব্দে মগধে রাজ্যারোহণ করেন (A. S. R. Vol. III. No. 18 )। তাঁহার ৩৮ বৎসর রাজত্বের পর মহম্মদ কর্তৃক বিহার বিজিত হয় (J. A. S. B 1876. pt. 1. P. 331-2)। তাহার পর বৎসর বা ‘দোয়ম্ সালে’ বঙ্গবিজয় হয় (Raverty’s Tabaqat i – Nasiri, P. 663)। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এই প্ৰমাণে ১২০০ খৃষ্টাব্দে বঙ্গবিজয়ের তারিখ নির্ণয় করিয়াছেন (J. A. S. B 1913 PP. 277. 285); আমরা ইহাই যুক্তিসঙ্গত বলিয়া মনে করি।
১১. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণকাণ্ড, ১৫৩ পৃ।
১২. বাঙ্গালার পুরাবৃত্ত, ৩২৭ পৃ। কিন্তু হরিবর্ম্মাদেবের সময় এখনও নিরূপিত হয় নাই। ‘গৌড়রাজমালায়ে’ও এবিষয় কোন নিশ্চিত তথ্য স্থির হয় নাই। রাখালবাবু বলেন, বিজয়সেনের বঙ্গাধিকারের বহু পূর্ব্বে হরিবর্ম্মাদেব স্বর্গারোহণ করিয়াছিলেন (প্রবাসী, ১৩১৯, শ্রাবণ)। তিনি সম্ভবতঃ একাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে বর্তমান ছিলেন।
[দ্বিতীয় অংশ : নবম পরিচ্ছেদ— সেনরাজত্ব, ৫-৬ নং পাদটীকা দ্রষ্টব্য। শ্যামলবর্ম্মার খণ্ডিত বজ্রযোগিণী-তাম্রশাসনে হরিবর্ম্মার উল্লেখ আছে। বেলাব-তাম্রশাসনে আছে, শ্যামলবর্ম্মা জাতবর্ম্মার পুত্র। অধুনাপ্রাপ্ত হরিবর্ম্মার অগ্নিদগ্ধ সামন্তসার-তাম্রশাসন পাঠোদ্ধারান্তে নলিনীকান্ত ভট্টশালী বলেন, সম্ভবত হরিবর্ম্মা জাতবর্ম্মার জ্যেষ্ঠপুত্র। জাতবর্ম্মা ৩য়-বিগ্রহপালের সমসাময়িক। সুতরাং হরিবর্ম্মার রাজ্যকাল ১১শ শতাব্দীর শেষাঙ্কে। – History of Bengal, Dacca Univ. Vol. 1., P. 201. – শি মি]
১৩. পরেশনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বিশ্বাস করেন যে, খুলনা জেলায় উজিরপুর অঞ্চলে কেশবসেনের রাজবাটী ছিল (বাঙ্গালার পুরাবৃত্ত, ৩২৭ পৃ), কিন্তু তিনি জানেন না যে, উজিরপুর খুলনায় নহে, যশোহরে এবং তথায় কেশবসেনের রাজবাটী ছিল না, এক দাম্ভিকপ্রকৃতিক রাজা কেশব ঘোষের রাজবাটী ছিল। আমরা যথাস্থানে তাহার উল্লেখ করিব।
১৪. ‘শশাঙ্ক পৃথিবী মমাং প্রথিতবীরবর্গাগ্রণীঃ।
স গর্গষবনান্বয় প্রলয়কাল রুদ্রো নৃপঃn’—মদনপাড়ে প্রাপ্ত বিশ্বরূপের তাম্র-শাসন, J. A. S. B. 1896. PP. 91-5.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন