সতীশচন্দ্র মিত্র
পাঠান-বিজয়ের প্রথম দুইশত বর্ষ বঙ্গদেশে কিরূপ অরাজকতায় অতিবাহিত হইয়াছিল, তাহা বর্ণিত হইয়াছে। তৎপরে রাজা গণেশ কিছুকালের জন্য পাঠানদিগের হস্ত হইতে গৌড় রাজ্য কাড়িয়া লন। কয়েক বৎসর পরে গণেশের মৃত্যু হইলে (১৪১৪) রাজ্যমধ্যে পুনরায় একটা গণ্ডগোল উপস্থিত হয়। এই সময়ে দনুজমর্দন দেব চন্দ্রদ্বীপে আসিয়া এক রাজ্য সংস্থাপন করেন। শীঘ্রই খুলনার দক্ষিণপূর্ব্বাংশ সম্পূর্ণরূপে তাঁহার করায়ত্ত হইয়া পড়ে। সুন্দরবনের মধ্যে দনুজমর্দনের যে রজতমুদ্রা প্রাপ্ত হইয়াছি, উহাই এ বিষয়ের অন্যতম প্রমাণ।
খুলনা জেলার দক্ষিণাংশে খোলপেটুয়া নদীর কূলে অবস্থিত বাসুদেবপুর গ্রামনিবাসী জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায় মহাশয়ের নিকট হইতে আমি উক্ত মুদ্রাটি প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। তথাকার একজন মুসলমান কবর খনন করিবার সময়ে এই প্রাচীন মুদ্রাটি পাইয়া জ্ঞানেন্দ্রবাবুকে দিয়াছিলেন এবং তিনি দয়া করিয়া উহা আমার হস্তে প্রদান করেন।[১] মুদ্রাটির সর্ব্বপ্রধান বিশেষত্ব উহার বাঙ্গালা অক্ষর। বাঙ্গালা অক্ষরে প্রাচীন মুদ্রা পূর্ব্বে আর দেখি নাই। বহু চেষ্টা করিয়াও অদ্যাবধি মহারাজ প্রতাপাদিত্যের নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রাপ্ত হই নাই, সুতরাং তাহাতে কিরূপ বাঙ্গালা অক্ষর উৎকীর্ণ ছিল, তাহা জানি না। ইণ্ডিয়ান মিউজিয়ামের তাৎকালিক বিশিষ্ট কৰ্ম্মাধ্যক্ষ, মুদ্রাতত্ত্ববিৎ সুপণ্ডিত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহোদয় আমার এই মুদ্রার আকৃত্রিমতা সপ্রমাণ করিয়াছিলেন এবং ইহা যে কিরূপে কতকগুলি তর্কসঙ্কুল ঐতিহাসিক তথ্যের উদ্ধারের পথ পরিষ্কার করিয়াছে, তাহারও উল্লেখ করিয়াছেন।[২] মুদ্রাটি বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদে উপহারস্বরূপ প্রদান করিয়াছি। উহা এক্ষণে তত্রত্য মুদ্রাবিভাগে রক্ষিত হইতেছে।[৩]
আমার এই মুদ্রা প্রাপ্তির পূর্ব্বে মালদহের স্বনামধন্য ঐতিহাসিক স্বর্গীয় রাধেশচন্দ্র শেঠ মহাশয় এইরূপ দুইটি রজতমুদ্রা প্রাপ্ত হন। উহা তিনি মালদহে উত্তর-বঙ্গ সাহিত্য-সম্মিলনের চতুর্থ অধিবেশন কালে প্রদর্শন করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে একটি দনুজমর্দন দেবের এবং অপরটি মহেন্দ্র দেবের। রাধেশ বাবুর মৃত্যুর পূর্ব্বে রঙ্গপুর শাখা-পরিষদের পত্রিকায় উক্ত মুদ্রা দুইটি সম্বন্ধে একটি নাতি-দীর্ঘ প্রবন্ধ ও উহাদের আলোক-চিত্র প্রকাশিত হইয়াছিল।[৪] তাহা হইতেই চিত্রানুলিপি দিলাম। এক্ষণে মুদ্রাত্রয়ের বিশেষ বিবরণ দেওয়া যাইতেছে।
১॥ রাধেশ বাবুর আবিষ্কৃত মহেন্দ্র দেবের মুদ্রা :
গোলাকৃতি, ওজন ১৭০ গ্রেণ, পরিধি সোয়া ৩ ইঞ্চি। উহার প্রথম পৃষ্ঠে বঙ্গাক্ষরে লিখিত আছে—‘শ্ৰীশ্ৰীমন্মহেন্দ্র দেবস্য’; দ্বিতীয় পৃষ্ঠে— ‘শ্রীচণ্ডীচরণ-পরায়ণত ‘পাণ্ডুনগর, শকাব্দ () ৩৩৬’।
২॥ রাধেশ বাবুর আবিষ্কৃত দনুজমর্দন দেবের মুদ্রা :
আকার প্রায় গোল, ওজন ১৬৭ গ্রেণ, পরিধি সোয়া ৩ ইঞ্চি। প্রথম পৃষ্ঠে বৃত্তমধ্যে বঙ্গাক্ষরে—‘শ্রীশ্রীদনুজমর্দন দেব’; দ্বিতীয় পৃষ্ঠে চতুষ্কমধ্যে ‘শ্রীচণ্ডীচরণ-পরায়ণ’ ও উহার বাহিরে ‘পাণ্ডুনগর, শকাব্দ () ৩৩৯’।
এই দুইটি মুদ্রাতেই marginal deletion বা পার্শ্বক্ষয়ের জন্য তারিখের সহস্রাঙ্কটি কাটিয়া গিয়াছে, তজ্জন্য মহা অসুবিধা হইয়াছিল। উক্ত পার্শ্বক্ষয়ের কথা না ভাবিয়া বঙ্গাক্ষরযুক্ত মুদ্রা দুইটিকে খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মুদ্রা বলিয়া নির্দ্দেশ করিতে গিয়া রাধেশ বাবুকে সুধী সমাজে হাস্যাস্পদ হইতে হইয়াছিল। কিন্তু তিনি তাহার জন্য দায়ী নহেন। তিনি যেমন পাইয়াছিলেন, তেমনই নির্দ্দেশ না করিয়া পারেন নাই। আমাদের মুদ্রা আবিষ্কৃত না হইলে, এই সহস্রাঙ্ক কাটিয়া যাওয়ার কথা সহজে ধরা যাইত না।
৩॥ আমাদের আবিষ্কৃত দনুজমর্দন দেবের মুদ্রা :
গোলাকৃতি, ওজন ১৬০ গ্রেণ, পরিধি সাড়ে ৩ ইঞ্চি। প্রথম পৃষ্ঠে ষড়ভুজের মধ্যে বঙ্গাক্ষরে-’শ্রীদনুজমর্দন দেব। দ্বিতীয় পৃষ্ঠে— ‘শ্রীচণ্ডীচরণ-পরায়ণ, শকাব্দ ১৩৩৯, চন্দ্ৰ দ্বীপ।’
ইহাতে তারিখটি অতি সুস্পষ্ট ভাবে আছে। উহাতে ১৩৩৯ শকাব্দ বা ১৪১৭ খৃষ্টাব্দ হয়। রাধেশ বাবুর মুদ্রায় ১ এই সহস্রাঙ্কটি কাটিয়া গিয়াছে, ইহা স্বচ্ছন্দে অনুমান করা যায়। তাহা হইলে মহেন্দ্র দেবের মুদ্রায় ১৩৩৬ শকাব্দ বা ১৪১৪ খৃষ্টাব্দ এবং দনুজমর্দ্দনের অপর মুদ্রায় ও ১৪১৭ খৃষ্টাব্দ হয়। স্বাধীন রাজা না হইলে কেহ স্বনামে মুদ্রা প্রচার করেন না। সুতরাং মুদ্রায় হইতেই প্রমাণিত হইতেছে যে, মহেন্দ্র দেব পাণ্ডুনগর বা পাণ্ডুয়ার স্বাধীন রাজা ছিলেন, তাঁহার রাজত্বের ১৪১৪ খৃষ্টাব্দের একটি মুদ্রা পাওয়া যাইতেছে; তাহার পর দনুজমর্দন দেব পাণ্ডুনগরে রাজা হন (১৪১৭)। তিনি যে বৎসর রাজা হন, সেই বৎসরই চন্দ্রদ্বীপে আসিয়া নূতন রাজ্য সংস্থাপনপূর্ব্বক মুদ্রা প্রচার করেন। ইঁহারা উভয়েই ‘দেব’ উপাধিধারী কায়স্থ এবং ‘শ্রীচণ্ডীচরণ-পরায়ণ’ উপাধিভূষিত শাক্ত হিন্দু। মুদ্রা হইতে এই যে কয়েকটি তথ্য প্রমাণিত হইতেছে, তাহা সম্পূর্ণ সংশয়শূন্য।
এক্ষণে এই দনুজমৰ্দ্দন কে? তিনি কোথা হইতে আসিয়া রাজ্যস্থাপন করিলেন? এ সম্বন্ধে অনেকগুলি মত আছে। আমরা এক একটি করিয়া সংক্ষেপে সবগুলি বিচার করিব।
১॥ ‘বল্লালসেনের কায়স্থজাতীয়া উপপত্নীর পুত্র কালু রায়কে তিনি চন্দ্রদ্বীপে করদ রাজা নিযুক্ত করেন। দনুজদমন রায় তাঁহার বংশধর।’[৫] অবশ্য এখানে দনুজদমন ও দনুজমৰ্দ্দন অভিন্ন ব্যক্তি বলিয়া ধরা হইয়াছে। এ মতের কোন বিশিষ্ট প্রমাণ নাই। সমস্ত প্রবাদ-কাহিনী ইহার বিরোধী। এ মতের পরিপোষক গ্রন্থকার বিনা প্রমাণে ইহা উত্থাপিত করিয়াছেন বলিয়া আমরা উহা পরিত্যাগ করিতে পারি।
২॥ লক্ষ্মণসেনের পৌত্র দনুজমাধব বহুবৎসর পূর্ব্ববঙ্গে রাজত্ব করিয়াছিলেন, তাহা উল্লিখিত হইয়াছে। এই দনুজমাধব বিভিন্ন ঐতিহাসিকের দ্বারা নানা নামে পরিচিত হইয়াছেন। দনুজ, দনৌজা, ধিনুজ রায় (Stewart), নোজা (Raja Nodia, Tieffenthaler), নৌজা (আবুল ফজল), দনুজ রায় (Zeauddin Barni and Elliot), দনোজামাধব বা দনুজমর্দন এবং দনুজদমন—এই সকলই একই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন নাম বলিয়া কথিত হয়। অর্থাৎ বিক্রমপুরের দনৌজামাধব এবং চন্দ্রদ্বীপের দনুজমৰ্দ্দন অভিন্ন ব্যক্তি।[৬] দনুজমাধব বিশ্বরূপের মৃত্যুর পর পূর্ব্ববঙ্গে রাজত্ব করেন। তাঁহার রাজত্বকালে ১২৮০ খৃষ্টাব্দে দিল্লীশ্বর বুলবন পূর্ব্ববঙ্গের অন্যতম বিদ্রোহী শাসনকর্তা মঘীসুদ্দীন তোগ্রলকে দমন করিতে স্বয়ং বঙ্গদেশে আসেন। এ সময়ে দনুজমাধব সৈন্য দিয়া নৌপথে তাঁহার সাহায্য করিয়াছিলেন।[৭] দনুজমাধবের সহিত বুলবনের এক সন্ধি হয়। কিন্তু তৎপরে অল্পদিনের মধ্যে পূর্ব্ববঙ্গের অনেকস্থান মুসলমান অধিকারভুক্ত হইলে, দনুজমাধব চন্দ্রদ্বীপে আসিয়া নূতন রাজ্য সংস্থাপন করেন এবং স্বকীয় গুরুদেব চন্দ্রশেখর চক্রবর্ত্তীর নির্দেশানুসারে নবোত্থিত দ্বীপে তিনি যে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, গুরুদেবের নামে তাহার নাম রাখেন—চন্দ্রদ্বীপ।[৮] চন্দ্রদ্বীপের রাজবংশীয়গণ এই দনুজামাধবের বংশধর। এবং রাজবংশীয় কেহ কেহ এখনও জীবিত আছেন। তাঁহারা সম্মানিত গোষ্ঠীপতি কায়স্থ। সুতরাং ইহা দ্বারা বল্লালসেন যে কায়স্থ ছিলেন তাহা প্রতিপন্ন হইতে পারে। এইরূপে প্রমাণের বলে নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় সুবিখ্যাত ‘বিশ্বকোষে’ বল্লালের কায়স্থত্ব প্রতিপাদন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। বল্লালসেন কায়স্থ ছিলেন কিনা তাহা প্রতিপন্ন করা বর্ত্তমান প্রসঙ্গের উদ্দেশ্য নহে। তবে আমরা এখানে দেখাইতেছি যে, বিক্রমপুরের দনুজমাধব ও চন্দ্রদ্বীপের দনুজমর্দন এক ব্যক্তি নহেন।
প্রথমতঃ, নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় সেনরাজগণের সময় নির্দ্ধারণ জন্য এসিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় যে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন, তাহাতে ঘটক-কারিকা হইতে উদ্ধৃত করিয়া দনুজমদানের বংশীয় জয়দেবকে ‘চন্দ্রদ্বীপস্য ভূপালো দেববংশসমুদ্ভবঃ’ বলিয়া ব্যাখ্যা করত প্রবন্ধ শেষ করিয়াছেন; ‘পুনশ্চ’ দিয়া ফরিদপুরের এক বৃদ্ধ ঘটকের বংশাবলী হইতে দেখাইতেছেন যে, উক্ত পংক্তি ‘চন্দ্রদ্বীপস্য ভূপালো সেনবংশসমুদ্ভবঃ’ এইরূপ হইবে।[৯] সেনকে দেব করিবার চেষ্টার মত ‘দেব’ও যে দৈবাৎ ‘সেন’ হইয়া পড়িতে পারে, তাহা বিচিত্র নহে। এখানে ‘সেন’ প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। এইরূপ পাঠান্তর কুলগ্রন্থের উপর সাধারণের আস্থা কমাইয়া দিতেছে।
দ্বিতীয়তঃ, নগেন্দ্রবাবু প্রভৃতি বলিতেছেন যে ১২৮০ খৃষ্টাব্দে বুলবনের আক্রমণের পর ২০ বৎসরের মধ্যে দনুজমাধব চন্দ্রদ্বীপে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিব্বতীয় গ্রন্থকার তারানাথের মতেও ১৩০০ খৃষ্টাব্দে সেনবংশের প্রকৃত রাজত্ব শেষ হয়। তাহা হইলে ধরিতে পারি ১৩০০ অব্দে দনুজমাধব চন্দ্রদ্বীপে রাজ্য স্থাপন করেন। তাঁহার পর ৪ জন চন্দ্রদ্বীপে রাজত্ব করেন। পঞ্চম রাজার নাম পরমানন্দ রায়। ৪ জনের রাজত্বকাল মোট ১৫০ বৎসর ধরা যাইতে পারে। দনুজমাধব ১২৫০ অব্দে সুবর্ণগ্রামে রাজ্যারোহণ করিয়াছিলেন বলিয়া উক্ত হয়। তাহা হইলে তিনি ১৩০০ অব্দের পর অধিক দিন জীবিত ছিলেন না। যদি তাঁহার রাজত্ব আরও ১৫ বৎসর ধরা যায়, তাহা হইলে পরমানন্দের রাজত্ব ১৪৬৫ খৃষ্টাব্দে আরব্ধ হইয়াছে, বলিতে পারি। কিন্তু আইন আকবরীতে পাইতেছি যে, আকবরের রাজত্বের ২৯শ বৎসরে অর্থাৎ ১৫৮৫ খৃষ্টাব্দে বালায় (চন্দ্রদ্বীপে) যে জলপ্লাবন হয়, তখন পরমানন্দ রায় অল্পবয়স্ক যুবক।[১০] তাহা হইলে এই ১২০ বৎসর কালের কি গতিবিধান করা যায়, বুঝিতে পারিতেছি না।
তৃতীয়তঃ, বিখ্যাত ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় মহাশয় দেখাইতেছেন যে, পাঠান বিজয়ের পর লক্ষ্মণসেনের বংশধরগণ ১২০ বৎসর বিক্রমপুরে রাজত্ব করেন এবং পরে তাঁহারা চন্দ্রদ্বীপে একটি ক্ষুদ্র রাজত্ব স্থাপন করেন।[১১] সুতরাং (১২০০ খৃষ্টাব্দে পাঠান বিজয় ধরিলে) ১৩২০ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত পূর্ব্ববঙ্গে সেনরাজত্ব ছিল। তাহা হইলে ৭০ বৎসর রাজত্বের পর অতিবৃদ্ধ দনুজমাধবকে চন্দ্রদ্বীপে নবরাজ্য পত্তন করিতে হয়। ইহা সম্ভবপর বলিয়া বোধ হয় না। বিশেষতঃ দনুজমাধবই বিক্রমপুরের শেষ সেনরাজা নহেন, তাঁহার পরেও তদ্বংশীয়গণ প্রায় একশত বৰ্ষ তথায় রাজত্ব করিয়াছিলেন।
চতুর্থতঃ, সমস্ত সন্দেহের নিরসন পক্ষে আমাদের নবাবিষ্কৃত দনুজমৰ্দ্দনের রজত মুদ্রাই অকাট্য প্রমাণ। পূর্ব্বোক্ত মুদ্রাত্রয় হইতে সপ্রমাণ হইয়াছে যে, দনুজমর্দনের রাজ্য প্রতিষ্ঠার তারিখ ১৪১৭। যে দনুজমাধব ৩০ বৎসর রাজত্বের পর ১২৮০ খৃষ্টাব্দে সম্রাট বুলবনকে সাহায্য করিয়াছিলেন, তিনি আর ১৩৭ বৎসর পরে বাঁচিয়া থাকিয়া চন্দ্রদ্বীপ হইতে যে মুদ্রা প্রচলন করিতে পারেন না, তাহা আর কাহাকেও বুঝাইয়া দিতে হইবে না।
সুতরাং নিঃসংশয়রূপে সপ্রমাণ হইল যে, বিক্রমপুরের দনুজমাধব ও চন্দ্রদ্বীপের দনুজমর্দন এক ব্যক্তি নহেন। সেন-বংশীয়দিগের সহিত চন্দ্রদ্বীপের বঙ্গজ কায়স্থকুলোদ্ভব দেব-বংশীয় দনুজমৰ্দ্দনের কোন প্রকার সম্বন্ধ আছে বলিয়া বোধ হয় না। ‘নামের সাদৃশ্য ব্যতীত দনৌজমাধব ও দনুজমৰ্দ্দনের এক ব্যক্তি হওয়ার কোন বলবৎ প্রমাণ নাই।’[১২] সুতরাং যাঁহারা এই দুই ব্যক্তি অভিন্ন ধরিয়া লইয়া সেনরাজগণকে কায়স্থ প্রতিপন্ন করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগকে প্রমাণান্তরের আশ্রয় লইতে হইবে। এক্ষণে তাহা হইলে জিজ্ঞাস্য, এ দনুজমৰ্দ্দন কে?
সম্প্রতি কায়স্থ দেব-বংশের ইতিবৃত্তসম্বলিত যে একখানি হস্তলিখিত প্রাচীন কুলগ্রন্থ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতেই এ প্রশ্নের উত্তর দিতেছে। এই পুঁথিখানি ১৬২২ শকে বা ১৭০০ খৃষ্টাব্দে অন্য একখানি পুঁথি হইতে নকল করা হয়। পুঁথিখানিকে প্রামাণিক বলিয়া বোধ হয়।[১৩] দেব বংশীয়েরা রাজকীয় কার্য্যে সংশ্লিষ্ট ছিলেন; সুতরাং তাঁহাদের বংশেতিহাসের সহিত প্রাদেশিক ইতিহাসের সম্বন্ধ ছিল। বর্তমান কুলগ্রন্থে প্রসঙ্গক্রমে কতকগুলি রাষ্ট্রকাহিনী সুন্দরভাবে বিবৃত হইয়াছে। এই কুলগ্রন্থ হইতে দেব-বংশ সম্বন্ধে নিম্নলিখিত তথ্য জানিতে পারি।
অতি প্রাচীনকালে দেবগণ হরিদ্বার হইতে আসিয়া কর্ণসুবর্ণনগরে বাস করেন। ইঁহারা ক্ষত্রজ কায়স্থ, দ্বিজ ও ক্ষত্রিয়-কুলসম্ভব। কর্ণসুবর্ণের রাজা কর্ণসেনের নির্দেশমত দেববংশীয়েরা শাণ্ডিল্য, মৌদ্গল্য, বাৎস্য, পরাশর, ভরদ্বাজ, ঘৃতকৌশিক ও আলম্যান, এই সপ্তগোত্রে বিভক্ত হন। তন্মধ্যে শাণ্ডিল্য দেবগণ কুলনায়ক ছিলেন। তাঁহারা কণ্টকদ্বীপে এক রাজ্য স্থাপন করেন। এই শাণ্ডিল্য-দেবকুলে সুরদেব জন্মগ্রহণ করেন, তৎপুত্র দনুজারি। পাঠান-বিজয়কালে তিনি সেনরাজগণের সামন্তস্বরূপ বহুদিন ধরিয়া পাঠানদিগের সহিত যুদ্ধ করেন। তিনি বন্দ্যবংশীয় মকরন্দের পুত্র দাশরথিকে কণ্টকদ্বীপে স্থাপন করেন ও তাঁহার পাঁচ পুত্রকে পাঁচখানি গ্রাম দান করেন এবং চণ্ডীপরায়ণ বন্দ্যবংশের শিষ্য হওয়ায় দেব-বংশীয়েরা ‘শ্রীশ্রীচণ্ডীচরণ-পরায়ণ’ উপাধি গ্রহণ করেন। (আমরা মহেন্দ্র দেব ও দনুজমর্দন দেবের মুদ্রায় এই উপাধি উৎকীর্ণ দেখিয়াছি)। দনুজারির পুত্র হরিদেব কণ্টকদ্বীপ হইতে পাণ্ডুনগরে গমন করেন। হরিদেবের পুত্র নারায়ণ এবং নারায়ণের দুই পুত্র— পুরন্দর ও পুরুজিৎ। তন্মধ্যে পুরন্দর সন্ন্যাসী হন। পুরুজিতের আদিত্য নামে মহাতপা পুত্র জন্মে। আদিত্যের দুই পুত্র- শ্রীশ্রীচণ্ডী। পরায়ণ দেবেন্দ্র ও ক্ষিতীন্দ্ৰ। দেবেন্দ্রের পুত্র সুপ্রসিদ্ধ মহেন্দ্র। তিনি যবনদিগকে দূরীভূত ও কংসকুল নিহত করিয়া পাণ্ডুনগরে দেবরাজ্য স্থাপন করেন।[১৪] এই কুলগ্রন্থের আবিষ্কারের পূর্ব্বে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও অনুমান করিয়া ছিলেন যে, ‘রাজা গণেশ বা কংসনারায়ণের মৃত্যুর পর যদু স্বধর্ম্ম পরিত্যাগ করিলে, মহেন্দ্র দেব বিদ্রোহী হইয়া পাণ্ডুনগরে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন ও স্বনামে মুদ্রাঙ্কন আরম্ভ করেন।[১৫] মহেন্দ্র দুষ্টঘাতক কর্তৃক নিহত হইলে, তৎপুত্র দনুজমর্দন রাজা হন।[১৬] তিনি বন্দ্যবংশীয় চন্দ্রাচার্য্যের নিকট দীক্ষিত হইয়াছিলেন। তিনি গুরুর আদেশে ধর্ম্মরাজ্য সংস্থাপন জন্য সপরিবারে সমুদ্রোপকূলে গমন করেন এবং রণচণ্ডীর প্রসাদে একটি নবোথিত দ্বীপে রাজ্য স্থাপন করিয়া গুরুর প্রীতির জন্য উহার নাম রাখেন চন্দ্রদ্বীপ।[১৭] মুদ্রা হইতেও আমরা দেখিয়াছি যে, দনুজমর্দন পাণ্ডুনগরে রাজ্যপ্রাপ্তির বৎসরই চন্দ্রদ্বীপে গিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ও স্বনামে মুদ্রাঙ্কন করিতে থাকেন। চন্দ্রদ্বীপে রাজা হইয়া দনুজমৰ্দ্দন সে প্রদেশে কায়স্থ সমাজে গোষ্ঠীপতিত্ব লাভ করেন। দ্বিজ বাচস্পতিকৃত ‘বঙ্গজ কুলজী সার সংগ্রহে’ লিখিত আছে :
‘দনুজমর্দন রাজা চন্দ্রদ্বীপপতি।
সেই হৈল বঙ্গজ কায়স্থ গোষ্ঠীপতি।।
দেব পদ্ধতিতে হোম মহিমা অপার।
সমাজ করিতে রাজা হৈলা চিন্তাপর।।
গৌড় হইতে আনিলা কায়স্থ কুলপতি।
কুলাচার্য্য আনাইয়া করাইল স্থিতি॥’[১৮]
দনুজমর্দন নিজ রাজধানীতে কুলীন কায়স্থগণের সমীকরণ করেন। তদবধি বাক্লা-চন্দ্রদ্বীপ একটি প্রসিদ্ধ সমাজস্থান হয়।[১৯]
দনুজমর্দন চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্গত কচুয়া নামক স্থানে এবং পরে তদ্বংশীয় কন্দর্পনারায়ণ মাধবপাশা নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। কচুয়ায় কমলাসাগর দীঘি এবং মাধবপাশা দুর্গাসাগর দীঘি (১৪৪০’ × ৯৮০’) ও বিরাট রাজবাটীর বহুসংখ্যক জীর্ণগৃহ পূর্ব্ব গৌরবের পরিচয় দিতেছে। এইস্থানে এখনও দনুজমর্দ্দনের ইষ্টদেবী কাত্যায়নীর মূর্ত্তির পূজা হইতেছে। দনুজমৰ্দ্দনের রাজ্য পশ্চিমে যশোহর ও পূর্ব্বে সমুদ্র পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল। তিনি এমন দোৰ্দ্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করিয়াছিলেন যে, খাঁ জাহান আলি প্রভৃতি পাঠান সামন্তগণ বলেশ্বরের পূর্ব্বপারে অগ্রসর হইতে সাহসী হন নাই। খাঁ জাহানের গতি বাগেরহট আসিয়াই রুদ্ধ হইয়াছিল। দনুজমৰ্দ্দনের পর তদ্বংশীয় বহুপুরুষ চন্দ্রদ্বীপ বা বালায় রাজত্ব করিয়াছেন।[২০] কিন্তু সে দিন আর নাই, এক্ষণে দনুজমদ্দনের হীনাবস্থ বংশধরেরা নির্জীবভাবে মাধবপাশায় বাস করিতেছেন।
পাদটীকা :
১. বর্তমান ইতিহাসের উপকরণ সংগ্রহ জন্য আমাকে বহুবার সুন্দরবন অঞ্চলে ভ্রমণ করিতে হইয়াছে। উহার মধ্যে একবার ১৯১১ অব্দে ২৬ শে ডিসেম্বর তারিখে আমরা খোলপেটুয়ার কূলবর্তী বিছটগ্রামে যাই, তথা হইতে নিকটবর্ত্তী বাসুদেবপুরে গিয়া উক্ত মুদ্রাটি প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। স্বনামধন্য রায়সাহেব নলিনীকান্ত রায় চৌধুরী এইবার আমার সহযাত্রী ছিলেন। মুদ্রাটির জন্য উক্ত মুসলমান গ্রামবাসী এবং জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায় মহাশয় বিশেষভাবে ধন্যবাদার্হ।
২. প্রবাসী, ১২শ ভাগ, ৪র্থ সংখ্যা, ১৩১৯, শ্রাবণ।
৩. বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদ্ ঊনবিংশ সাংবৎসরিক কার্য্যবিবরণীতে এই মুদ্রা সম্বন্ধে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করিয়া, আমরা ইহার ‘উদ্ধার করিয়া বঙ্গের হিন্দুরাজত্বের একটি তর্কসঙ্কুল অধ্যায়ের সুমীমাংসার সহায়’ হইয়াছি বলিয়া মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন।—সাহিত্য-পরিষৎ-পঞ্জিকা ১৩২০, ১৬৮ পৃ।
৪. এই দুইটি মুদ্রা পাণ্ডুয়ার আদিনা-মজিদের উত্তর-পূর্বাংশে ন্যূনাধিক দুই ক্রোশ মধ্যে সাঁওতাল কৃষকের আগরওয়ালা মহাশয় উহা সংগ্ৰহ করিয়া রাধেশ বাবুকে প্রদান করেন। মুদ্রা দুইটি রাধেশ বাবুর আকস্মিক মৃত্যুর পর কলিকাতায় হারাইয়া যায়। পূর্ব্ব প্রকাশিত আলোকচিত্র হইতে উহার চিত্রানুলিপি প্রকাশিত করিলাম। এই অনুলিপির জন্য পরম শ্রদ্ধেয় ‘প্রবাসী’ সম্পাদক মহাশয়ের নিকট আমি বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ! রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় ও আমার দুইটি প্রবন্ধ দনুজমৰ্দ্দনের মুদ্রা সম্বন্ধে প্রবাসীতে প্রকাশিত হয়; ঐ সময় মুদ্রাগুলির আলোকচিত্র দেওয়া হইয়াছিল।—প্রবাসী, ১৩১৯, শ্রাবণ।
৫. দুর্গাচরণ সান্যাল, ‘বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস’, ১১৯ পৃঃ।
৬. ‘The Emperor occupied Sonargaon having been joined in advance by dhinwaj Rai, Zamindar of the City with all his troops. This is probably the same person as Dhinaj Madhub who is believed to have been a gradson of Ballal Sen.’-Dr. Wise, J. R. A. S. 1874, No. 1. P. 83.
‘It is not improbable that the founder of this family (Chandradwip family) is the same person as the Rai of sonargaon by name Dhanuj Rai’—ibid. No. 3. P. 206. see also N.N. Vasu. J.R.A.S. 1896. P. 35; সতীশচন্দ্র রায় চৌধুরী, ‘বঙ্গীয় সমাজ’, ৭৯ পৃ।
৭. Stewart. History of Bengal, Bangladesh Edition. P. 82; Elliot. Vol. iii. P. 116.
৮. ব্রজসুন্দর মিত্র, ‘চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশ’।
৯. J. R. A. S., 1896. Part 1. P. 37.
১০. Gladwin’s Ayeen Akbari, I. P. Society. P. 304; Jarret’s Ain-i-Akbari, II, P. 123. Beveridge’s Bakarganj. P. 27.
১১. নিখিলনাথ রায়, ‘প্রতাপাদিত্য’, উপক্রমণিকা, ৬৭ পৃ।
১২. রজনীকান্ত চক্রবর্ত্তী, ‘গৌড়ের ইতিহাস’ ১ম খণ্ড, ১১৮ পৃ।।
১৩. ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ সবডিভিসনের পুড্ডাগ্রামনিবাসী ক্ষিতীশচন্দ্র দেব রায় মহাশয়ের নিকট এই কুগ্রন্থখানি পাওয়া গিয়াছে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু এবং প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় মহাশয়গণ ইহা যে একখানি দুইশত বৎসরাধিক কালের প্রাচীন পুঁথি এবং প্রামাণিক কুলগ্রন্থ তাহা স্বীকার করিয়াছেন। নিখিল বাবু তাঁহার শাশ্বতী’ পত্রিকায় টীকা টিপ্পনী সহ এই গ্রন্থ প্রকাশিত করিয়াছিলেন। গ্রন্থখানি বটুভট্ট নামক একজন ঘটক দ্বারা সংস্কৃত ভাষায় লিখিত। পুঁথির শেষে শকনরপতেরতীতাব্দা ১৬২২ সৌরবৈশাখস্য পঞ্চম দিবসে’, বলিয়া লিখিত আছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহোদয় এই গ্রন্থখানিকে প্রামাণিক বলিয়া স্বীকার করেন নাই। তিনি বলেন “ইহা হয় খৃষ্টীয় দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লিখিত নতুবা ইহা কৃত্রিম। বৰ্ত্তমান যুগের শত শত কুলপঞ্জিকার ন্যায় দুই দশ বৎসর পূর্ব্বে লিখিত এবং বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ‘প্রাচীনীকৃত’। দনুজমৰ্দ্দনের মুদ্রা সম্বন্ধে আমি ও রাখালবাবু উভয়ে ‘প্রবাসী’ পত্রে যে দুইটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম, উহার মধ্যে রাখালবাবু যে সকল অনুমান করিয়াছিলেন, কুলগ্রন্থের বিবরণীতে অবিকল তাহাই খাটিয়া যাইতেছে দেখিয়া রাখালবাবু মনে করেন রাধেশবাবু ও আমার মুদ্রার আবিষ্কারের পর এ গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। অনুমানের যথার্থ বর্ণে বর্ণে মিলিতে দেখিলে সন্দেহ হয় বটে, কিন্তু তাই বলিয়াই গ্রন্থখানিকে অপ্রামাণিক বলা সঙ্গত বোধ হয় না। আমাদের বিশ্বাস রাখালবাবু এ গ্রন্থখানি বিশেষভাবে পরীক্ষা করিবার অবসর পাইলে তাঁহার মত প্রত্যাহার করিতে পারেন। এই বিষয় লইয়া ‘শাশ্বতী’ পত্রে যথেষ্ট বাদ প্রতিবাদ চলিয়াছিল এবং গ্রন্থখানির দুইটি পাতার আলোকচিত্র প্রকাশিত হইয়াছিল (শাশ্বতী, ১৩২০, শ্রাবণ, ২৪০-২৫৬ পৃ)।
[পরবর্তীকালে ঢাকা বিভাগের স্কুল ইন্সপেক্টর H. E. Stapleton মহোদয় রাখালদাস মহাশয়কে মহেন্দ্রদেবের অনেকগুলি রজত-মুদ্রা দেন। এই সমস্ত মুদ্রাই নিঃসন্দেহে ১৪১৮-১৪২৭ খৃষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ের। ইহা হইতেই রাখালদাস মহাশয় সিদ্ধান্তে আসেন যে, পূর্ব্বে এই গ্রন্থকারের সঙ্গে একমত হইয়া পাণ্ডুনগরের মুদ্রার যে তারিখ (১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ) অনুমান করিয়াছিলেন, তাহা সঠিক পাঠোদ্ধার নহে। পাণ্ডুনগরের সে মুদ্রা এখন কোথায় তাহা জানা যায় না (রাধেশচন্দ্র শেঠ মহাশয় উক্ত মুদ্রা বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদে দিবার জন্য কলিকাতায় আসিলে অকস্মাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন। ফলে সে মুদ্রার আর সন্ধান পাওয়া যায় নাই।—প্রবাসী, শ্রাবণ, ১৩১৯ দ্রষ্টব্য)। অতএব তাঁহার মতে মূল মুদ্রা পুনরায় পরীক্ষা না করিয়া পাঠোদ্ধার সম্পর্কে কোন মত প্রকাশ করা উচিত নহে।
ইহা ব্যতীত তিনি আরও নূতন সিদ্ধান্তে আসেন যে, মহেন্দ্রদেব দনুজমর্দন দেবের পিতা হইতে পারেন না, হয় তিনি দনুজমর্দন দেরের পুত্র, অথবা কোন উত্তরাধিকারী হইতে পারেন। কারণ, বাসুদেবপুরের দনুজমর্দন দেবের মুদ্রা ১৪১৭ খৃষ্টাব্দের এবং Stapleton কর্তৃক সংগৃহীত মহেন্দ্রদেবের মুদ্রা ১৪১৮ হইতে ১৪২৭ খৃষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ের; এবং এই মুদ্রাগুলির বলে তিনি বলেন যে, বটুভট্টের ‘দেববংশের ঐতিহাসিক অংশগুলি গ্রহণযোগ্য নহে।—রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, ৩য় সংস্করণ, ১৫৬-৫৮ পৃ।—শি মি]
১৪. যবনাঞ্চ দূরীকৃত্য কংসকুলং নিহত্য চ।
পাণ্ডুয়ায়াং দেবরাজ্যমনেনৈব প্রতিষ্ঠিতম্॥’
১৫. প্রবাসী, ১৩১৯, শ্রাবণ, ৩৮৮ পৃ।
১৬. [পরবর্ত্তীকালে আইন-ই-আকবরী, তারিখ-ই-ফিরিস্তা, রিয়াজ-উস-সালাতীন প্রভৃতি গ্রন্থের উক্তি বিশ্লেষণ করিয়া ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার মহাশয় ডাঃ নলিনীকান্ত ভট্টশালীর বক্তব্য স্বীকার করিয়া বলেন যে, রাজা গণেশ ও দনুজমৰ্দ্দন দেব অভিন্ন ব্যক্তি। শাসনচক্রের ইসলাম-দলীয়দের ক্ষমতা খর্ব্ব করিয়া সিংহাসন আরোহণের পর রাজা গণেশ এই উপাধি ধারণ করেন।
এই পর্ব্বের সকল প্রকার ঐতিহাসিক তথ্যের মোট স্বীকৃত ঘটনাগুলি গ্রহণ করিয়া, অন্যান্য প্রদেশের রাজদণ্ড লইয়া অনুরূপ দলাদলি ও কলহের উদাহরণ সম্মুখে রাখিয়া এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টির বিচারে স্যার যদুনাথ সরকার এক আনুমানিক ও সম্ভাব্য ইতিবৃত্ত লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তিনি অবশ্য স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন, ইহা নিতান্ত আনুমানিক। ইহার সারাংশ নিম্নরূপ :
গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের রাজত্বের শেষে দিনাজপুরের ভূম্যধিকারী গণেশই রাজদরবারের সর্ব্বাপেক্ষা শক্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহার নিজস্ব সৈন্যদলও ছিল। গিয়াসুদ্দিনের মৃত্যুর পর নাবালক উত্তরাধিকারিগণ থাকাতে রাজ-অন্তঃপুরের দলাদলির সুযোগে গণেশই কাৰ্য্যতঃ শাসনকর্তা হন। অবশেষে বৃদ্ধবয়সে গণেশ ১৪১৪ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। রাজা গণেশের দুই পুত্র— যদুসেন ও মহেন্দ্রদেব। ইহার পর মুসলমানদের আমন্ত্রণে জৌনপুর সুলতান ইব্রাহিম শাহের কোন সেনাপতি বঙ্গদেশ আক্রমণ করেন। দুই পক্ষই প্রায় সমকক্ষ থাকাতে শেষ পর্যন্ত এক সন্ধি হয়। এই সন্ধি অনুযায়ী রাজা গণেশ সিংহাসনেই থাকেন, কিন্তু তাঁহার পুত্র যদুসেনকে ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্রহণ করাইতে হয়। এই সময় রাজা গণেশ দনুজমৰ্দ্দনদেব উপাধি গ্রহণ করেন। যদুসেনের নাম হয় জালালুদ্দিন। রাজা গণেশ যদুসেন- জালালুদ্দিনকে পুনরায় হিন্দুধর্ম্মে দীক্ষিত করেন এবং ইহার জন্য ব্রাহ্মণদের মধ্যে বহু অর্থ ও স্বর্ণ বিতরণ করেন। স্বর্ণ-নির্ম্মিত গাভীর গর্ভ হইতে যদুসেনকে নিষ্কাষন করিয়া তাহাকে হিন্দুরূপে পুনর্জন্ম দেওয়া হয়। ১৪১৮ খৃষ্টাব্দে হয়ত হিন্দু রাজকর্ম্মচারীরা মহেন্দ্রদেবকে সিংহাসনে বসান। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে যদুসেনই পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়া জালালুদ্দিন নামে মসনদে বসেন। এবং ব্রাহ্মণেরা অর্থলোভে হিন্দুধর্ম্মে তাঁহাকে দীক্ষিত করিলেও তখন তাহাকে উপযুক্তভাবে মৰ্য্যাদা দেন নাই বলিয়া জালালুদ্দিন অত্যন্ত হিন্দু-বিদ্বেষী হইয়া উঠিয়াছিলেন।
যাহা হউক, ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলিয়াছেন, ইহা তাঁহার আনুমানিক ইতিবৃত্ত। এই ইতিবৃত্তের সঙ্গে ষ্টেপলটন কর্তৃক আবিষ্কৃত মুদ্রাগুলির তারিখগুলি এখনও পরিপূর্ণরূপে ব্যাখ্যাত হয় নাই।— See, History of Bengal, Dacca Univ. vol. II. PP. 120-29—–শি মি]।
১৭. প্রচলিত প্রবাদে এই গুরুদেবের নাম চন্দ্রশেখর চক্রবর্ত্তী এবং এখানে দেখিতে পাইতেছি চন্দ্ৰাচাৰ্য্য। মোটকথা গুরুদেবের চন্দ্র নাম হইতেই যে চন্দ্রদ্বীপ নামের উৎপত্তি, ইহাই বোধ হয়। কিন্তু আমরা দনুজমৰ্দ্দনের বহুপূর্ব্বে চন্দ্রদ্বীপের অস্তিত্বের প্রমাণ পাই, এই দ্বীপ চন্দ্ৰবৎ হ্রাসবৃদ্ধি পাইত বলিয়া উহাকে চন্দ্রদ্বীপ বলিত (এডুমিশ্র)। দনুজমৰ্দ্দনের পূর্ব্বেও এ দ্বীপ অনেকবার উঠিয়াছে পড়িয়াছে, এবং একবার উত্থানের পর দনুজমর্দনের রাজ্য স্থাপিত হয়। এ সম্বন্ধে আমরা পূর্ব্বে আলোচনা করিয়াছি। দ্বিতীয় অংশ : প্রথম পরিচ্ছেদ- উপবঙ্গে দ্বীপমালা দ্রষ্টব্য।
১৮. এই সময় হইতে কুলাচার্য্যেরা বহু কারিকা প্রস্তুত করেন। ইদিলপুর ও দেহেরগাতির ঘটককারিকা বিখ্যাত। সেই সব কারিকা হইতে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের বিস্তৃত বংশপরিচয় পাইয়াছি। ইদিলপুরের ঘটকেরা ঘটক-স্বর্ণামাত্য উপাধিযুক্ত ছিলেন। J. A. S. B. Part 1. No.3 1876; ‘বালা’ ১৬১ পৃ।
১৯. দনুজমৰ্দ্দনের বংশাবলী পরিশিষ্টে প্রদত্ত হইবে।
২০. নগেন্দ্রনাথ বসু, ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’, রাজন্যকাণ্ড, ৩৭০ পৃ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন