সতীশচন্দ্র মিত্র
হুসেন শাহের পুত্র নসরৎ শাহের রাজত্বকালে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করিয়া মোগল-কেশরী বাবর দিল্লীশ্বর হন। নসরতের পর তাঁহার ভ্রাতা মামুদ শাহের সময় বিহারাধিপতি শের খাঁ গৌড়ের সিংহাসন কাড়িয়া লন (১৫৩৮)। কিন্তু তাঁহাকে বাবরের পুত্র হুমায়ুনের আক্রমণ জন্য ব্যতিব্যস্ত হইতে হয়। তবে শের খাঁ এত সুদক্ষ, এত পরাক্রমশালী শাসনকর্তা ছিলেন যে, হুমায়ুনকে তাঁহার প্রতাপে প্রথম বঙ্গ হইতে, ও পরে, এমন কি দিল্লী হইতে বিতাড়িত হইতে হয়। তখন বঙ্গেশ্বর শের খাঁ দিল্লীশ্বর শের শাহ হইয়া, প্রাচীন ইন্দ্ৰপ্ৰস্থ দুর্গে মসনদ পাতিয়া কিছুকাল সবল হস্তে পঞ্জাব হইতে আসাম পর্যন্ত সমগ্র আর্য্যাবর্ত শাসন করেন। যশোহর-খুলনা সে শাসন বহির্ভূত হয় নাই।
আইন-ই-আকবরীতে স্পষ্টই লিখিত আছে, শের শাহ মহম্মদাবাদ জয় করেন। হুসেনী বংশীয় কে তখন যশোহরের উত্তরাংশে তাঁহার গতিরোধ করিয়াছিলেন, তাহা জানা যায় না। তবে তিনি যে যুদ্ধে পরাজিত হইয়া কতকগুলি হস্তী ছাড়িয়া দিয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হন, তাহার উল্লেখ আছে। ঐ সকল হস্তী খালিফাতাবাদের জঙ্গলে বন্য হইয়া গিয়াছিল। আকবরের শাসনকালে যশোহর-খুলনায় যথেষ্ট বন্য হস্তী পাওয়া যাইত।[১] ইহা হইতেই প্রতাপাদিত্য তাঁহার হস্তি-সৈন্য গঠন করিয়াছিলেন। শের শাহ শস্যের পরিবর্তে রৌপ্য মুদ্রা বা রূপেয়া দ্বারা রাজকর দিবার প্রথা প্রবর্তিত করেন। তাঁহার সময়ে রাজস্বের হারও অতি কম ছিল। মোগল আমলে উক্ত হারের বিশেষ পরিবর্ত্তন হয় নাই। শের শাহ সুশাসক হইলেও তাঁহাকে নবাৰ্জ্জিত বাদশাহী রক্ষা করিবার জন্য এত বিড়ম্বিত থাকিতে হইয়াছিল যে, তাঁহার সে শাসনের অন্তরালেও সমগ্র বঙ্গে, এমন কি, মহম্মদাবাদ, খালিফাতাবাদ, ফতেয়াবাদ সরকারে অর্থাৎ যশোহর-খুলনায় যথেষ্ট প্রাদেশিক শাসন বিভ্রাট ঘটিয়াছিল। উহারই ফলে ভুঞা রাজগণের আবির্ভাব হইতেছিল। আমরা দেখিব, পরবর্ত্তী ত্রিশ বৎসর কালের মধ্যে যশোহর-খুলনার উত্তরাংশে ফতেয়াবাদে মুকুন্দরাম রায় এবং দক্ষিণাংশে যশোহর-রাজ্যে বিক্রমাদিত্য ও তৎপুত্র প্রতাপাদিত্য মস্তকোত্তোলন করেন। এই ভুঞা রাজগণকে পরাভূত করিবার জন্য যথেষ্ট বল ক্ষয় করিয়া মোগল কুলতিলক আকবরকে বঙ্গদেশে জয়পতাকা উড্ডীন করিতে হইয়াছিল। বর্ত্তমান পুস্তকের পরবর্ত্তী খণ্ডে সে বিষয়ের অবতারণা করা যাইবে। আমরা এক্ষণে পাঠান আমলের সাধারণ অবস্থার কতক স্থূল মর্ম্ম দিয়া এ খণ্ডের উপসংহার করিব।
পাঠান ও মোগল। নবাগত পাঠান বঙ্গে প্রবেশ করিবার সময়ে হিন্দুর দেশে পদে পদে বাধা পাইয়া, ধর্ম্ম প্রচারে, রণরঙ্গে বা অত্যাচারে আত্মপ্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। আবর্তের প্রথম স্তর পার হইলে, তাঁহারা স্থির হইলেন; তখন দেখা গেল, তাঁহারা ধনলুণ্ঠন বা দূরে বসিয়া রাজ্যশাসন করিবার জন্য আসেন নাই। তাঁহারা আসিয়াছিলেন ধর্মপ্রচার করিতে এবং স্থায়িভাবে বঙ্গদেশে বাস করিতে। সুতরাং তাঁহারা পরকে আপন করিয়া, হিন্দুকে মুসলমান করিয়া, হিন্দু-মুসলমান উভয়ের হিতকর কার্য্যাদির প্রতিষ্ঠান করিয়া মিলিয়া মিশিয়া বসতি স্থাপন করিলেন। কিন্তু মোগলেরা তাহা করেন নাই; মোগলেরা আসিয়াছেন, গিয়াছেন, রাজ্য শাসন করিয়াছেন, কিন্তু বঙ্গদেশে বিশেষ কিছু চিহ্ন রাখিয়া যান নাই। অথচ প্রাচীন যুগের পাঠান কীর্তিসমূহ এখনও বর্তমান। এই কীর্ত্তি-মন্দিরগুলির স্থাপত্যেরও একটা বিশেষত্ব আছে।
স্থাপত্য ॥ কুটীরই ভারতবর্ষের আদর্শ আবাসস্থলী-বিশেষতঃ গাঙ্গেয় উপদ্বীপে এবং তদন্তর্গত যশোহর-খুলনায়। এ দেশে পাহাড় পৰ্ব্বত নাই; লোনামাটীতে ইট ভাল হয় না; যাহা হয়, তাহা বহুকাল টিকে না। অথচ এই গরিব দেশে কাঠ, খড়, বাঁশ, নল, গোলপাতা প্রচুর জন্মে; সুতরাং কাঠ বা বাঁশের সাহায্যে পর্ণশালা নির্ম্মাণ করিয়া বাস করাই এ দেশের চিরন্তন প্রথা। এই পর্ণশালাগুলি চৌচালা বা দোচালা হইয়া থাকে; চৌচালা ঘরের আদর্শ রাঢ় হইতে আসিয়াছিল, উহাকে সাধারণতঃ চৌরি ঘর বলে; দোচালা ঘরের পদ্ধতি পূর্ব্ববঙ্গ হইতে আসিয়াছিল, এজন্য উহাকে বাঙ্গালা ঘর বলে। এই চৌরি বা বাঙ্গালা ঘর নির্ম্মাণ করিতেই এদেশের লোক অভ্যস্থ। মন্দিরাদির জন্য তাহারা যখন ইটের দ্বারা স্থায়ী গৃহ নির্ম্মাণ করিতে লাগিল, তখনও এই চৌচালা বা বাঙ্গালা ঘরের আদর্শ ভুলে নাই। এজন্য এ দেশীয় মন্দিরের ছাদ প্রায়ই চৌচালা ঘরের মত। গোলগুম্বজ মুসলমান আমলে আমদানী হইয়াছিল। কোন কোন স্থানে ইট দ্বারাই দোচালা বাঙ্গালা ঘর হইত; কখনও বা ঐরূপ দুইখানি বাঙ্গালা একত্র জুড়িয়া জোড় বাঙ্গালা নির্ম্মাণ করা হইত। চৌরি ঘরে চারিধারে চারিখানি বারান্দায় চাল দিয়া যেমন আটচালা ঘর হয়, মন্দিরেও ঠিক ঐ ভাবে চারিধারে ঘুরাইয়া বারান্দা দেওয়া হইত। বড় চৌচালা মন্দিরের উপরে চারি কোণে চারিটি এবং মধ্যস্থলে একটি চূড়া দেওয়া হইত, এজন্য ঐরূপ মন্দিরের নাম পঞ্চরত্ন। আটচালা মন্দিরে উক্ত পাঁচটি চূড়া ব্যতীত বারান্দার চারি কোণে চারিটি চূড়া থাকিত, এজন্য সেরূপ মন্দিরের নাম নবরত্ন। এই নবরত্ন মন্দিরের খোলা বারান্দায় দুই দুইটি স্তম্ভে তিনটি করিয়া খিলান থাকিত, সেই স্তম্ভে, খিলানে, ছাদের সীমান্তে চারিধারে নানা কারুকার্য্য থাকিত। এইরূপ কারুকার্য্য হিন্দু-স্থাপত্যের বিশেষত্ব ছিল।
হিন্দু-স্থাপত্যের কোন নিদর্শন দিবার উপায় নাই, কারণ যশোহর-খুলনায় প্রাচীন হিন্দু-যুগের কোন মন্দির নাই। সে সব লবণাক্ত দেশের দোষে এবং অবশেষে পাঠানের অত্যাচারে বিলুপ্ত হইয়াছে। পাঠান আমলের প্রথমভাগেরও কোন হিন্দু-মন্দিরাদি পাওয়া যায় না; মাত্ৰ পাঠান আমলের শেষভাগের দুই একটি মন্দিরের পরিচয় পাওয়া যায়। উহারা মোগল বিজয়ের অব্যবহিত পূৰ্ব্বকালে নির্ম্মিত বলিয়া তাহাদিগকে মোগল-স্থাপত্যের অন্তর্ভুক্তও করা যায়। ডামরেলীর নবরত্ন এবং ইচ্ছাপুরের ও সোনাবাড়িয়ার নবরত্ন এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ইহাদের বিষয় আমরা মোগলযুগে বিচার করিব।
পাঠানেরা যে সকল মজিদাদি নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, তাহাতে মোটামুটি একটা নূতন পদ্ধতির পরিচয় পাওয়া যায়। ঐ পদ্ধতি মুসলমানের নিজস্ব হইতে পারে; কিন্তু উহার অধিকাংশই ভারতবর্ষে অর্জিত। সমষ্টিতে পদ্ধতিটি মুসলমানীয় হইলেও, ব্যষ্টিতে উহা হিন্দুর নিকটই ঋণী। হিন্দু-মন্দিরের মত এক গুম্বজ, সেইরূপ স্তম্ভ, কার্নিশ ও কারুকার্য্য। পাঠানদিগকে বাধ্য হইয়াও এরূপ অনুকরণ করিতে হইয়াছিল। অনেক সময়ে তাহাদিগকে হিন্দু-মিস্ত্রী দ্বারা কাজ করাইতে হইত; হিন্দু-মন্দিরের উপাদান মজিদে লাগাইতে হইত, সুতরাং হিন্দুর ছাঁচ থাকিয়া যাইত। ২ পাঠানেরা শুধু গোল গুম্বুজে এবং গুম্বুজের সংখ্যাধিক্যে বিশিষ্টতা দেখাইতেন। এই সংখ্যা বৃদ্ধি করিবারও একটা নূতন রীতি ছিল। সংখ্যার মধ্যে তাঁহারা ১, ৩, ৫ প্রভৃতি বিজোড় সংখ্যাগুলির সম্মাননা করিতেন। কোথায়ও ২, ৪, প্রভৃতি জোড় সংখ্যার গুম্বজওয়ালা মজিদ নাই। খাঁ জাহানের সমাধি মন্দির হইতে আরম্ভ করিয়া একগুম্বজ মসজিদের অভাব নাই, উহা যেখানে সেখানে দেখিতে পাওয়া যায়। সমাধি গৃহগুলি প্রায় একগুম্বজই হইত। তিনগুম্বজ মসজিদও সাধারণ প্রভৃতি; গৃহস্থ মুসলমান মজিদ নিৰ্ম্মাণ করিয়া কীর্তি রাখিলে প্রায় ত্রিগুম্বজ মসজিদই করিয়া থাকেন। পঞ্চগুম্বজ মসজিদ সচরাচর দেখা যায় না; বাগেরহাটে হুসেন শাহের যে মজিদ আছে, তাহা পঞ্চগুম্বুজের দুই সারিতে অর্থাৎ দশগুম্বুজে সম্পূর্ণ। আমরা পরে দেখিতে পাইব প্রতাপাদিত্য তাঁহার পাঠান সেনার জন্য যে বিখ্যাত ‘টেঙ্গা মসজিদ’ নির্ম্মাণ করিয়া দিয়াছিলেন তাহা পঞ্চগুম্বুজবিশিষ্ট। আবার বিজোড় সংখ্যাগুলিকে পরস্পর গুণ করিয়াও গুম্বুজের সংখ্যা নির্ণীত হইত, যেমন ৩×৩=৯; ৩২৫ = ১৫; ৩X১১=৩৩; ৭×১১=৭৭ প্রভৃতি। আমরা দেখিয়াছি, বাগেরহাটে দিদার খাঁ মজিদ ও মজিদকুড়ে বুড়া খাঁর বিখ্যাত মজিদ, উভয়ই নবগুম্বজবিশিষ্ট। আমরা পূর্ব্বে দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি যে, খাঁ জাহান দিল্লীশ্বর মামুদ তোগলকের উজীর ছিলেন; ঐ মামুদের পিতামহ বিখ্যাত নৃপতি ফিরোজ শাহের এক উজীর ছিলেন, তাঁহারও নাম খাঁ জাহান। সেই খাঁ জাহান ১৩৬১ খৃষ্টাব্দে দিল্লীতে বিখ্যাত ‘কালান মজিদ’ নির্ম্মাণ করেন। দিল্লীতে ইহা একটি অতি প্রাচীন কীৰ্ত্তি। ঐ মজিদে পশ্চিমদিকে তিন সারিতে ১৫টি গুম্বজ ও অপর তিনদিক্ ঘুরাইয়া ১৫টি গুম্বজ আছে। খাঁ জাহান উহা দেখিয়াছিলেন এবং উহারই আদর্শে প্রকাণ্ড মসজিদ নিৰ্ম্মাণ করিবার কল্পনা করিয়াছিলেন; বঙ্গে ছোটপাণ্ডুয়ায় ফিরোজ শাহের ভাগিনেয় শাহ সফি কর্তৃক যে ৩×৭×৩=৬৩ গুম্বজওয়ালা মজিদ নির্ম্মিত হইয়াছিল, তিনি তাহাও দেখিয়াছিলেন। এ সকলগুলি অপেক্ষা অধিক সংখ্যক গুম্বুজের মসজিদ নিৰ্ম্মাণ জন্য খাঁ জাহান ৭×১১=৭৭ গুম্বুজে বিখ্যাত মসজিদ নির্মাণ করেন। এই সকল মজিদাদির জন্য ইট সে সময়ে ছাঁচে বা ফর্ম্মায় প্রস্তুত হইত না। উৎকৃষ্ট কদম প্রস্তুত করিয়া তাহা সমতল স্থানে চালিয়া দেওয়া হইত, পরে রৌদ্রে শুকাইলে কোন অস্ত্র দ্বারা কাটিয়া কাটিয়া আবশ্যক মত নানা আকারের ইট প্রস্তুত হইত। উহাই পাজায় পোড়াইলে ইট হইত। মসল্যার জন্য সুরকীর ব্যবহার কম ছিল; সাধারণতঃ বালি চুণ দ্বারাই মসল্যা হইত। আমরা সর্ব্বত্রই সেই একই উপাদানে মসল্যা প্রস্তুত হইত বলিয়া প্ৰমাণ পাইয়াছি।
ধৰ্ম্ম॥ হিন্দুধৰ্ম্মই প্রধান ধর্ম্ম ছিল। এ সময়ে হিন্দুরা সকলেই দেবতাপূজক। তন্মধ্যে শাক্ত ও বৈষ্ণবের সংখ্যাই অধিক। শৈব বলিয়া কোন বিশেষ সম্প্রদায় ছিল না। কারণ শাক্ত বৈষ্ণব সকলেই শিবপূজা করিতেন, কেহই শিবের বিরোধী ছিলেন না। দেবীমন্দির বা বিষ্ণুমণ্ডপের পার্শ্বেই শিবমন্দির শোভা পাইত। এ দেশীয় হিন্দু-স্থাপত্যের বিশেষ নিদর্শন শিবমন্দিরেই প্রকাশ পাইত। পূজার মধ্যে শিবপূজা সহজ, সকল জাতীয় লোকে শিবপূজা করিতে পারে, ইহার জন্য পৃথক্ দীক্ষার প্রয়োজন নাই, এই সকল কারণে শিবপূজা সর্ব্বপ্রিয় হইয়াছিল। বিষ্ণুমণ্ডপে বা দেবীমণ্ডপে ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্যের প্রবেশাধিকার নাই, কিন্তু শিবমন্দিরে এরূপ কোন বাধা দিবার উপায় হয় নাই। উহার মধ্যে সর্ব্বজাতীয় লোকে যাইতেন, ইচ্ছামত পূজা করিতেন। বৌদ্ধধৰ্ম্ম বিলুপ্ত হইয়াছিল। শিবই বৌদ্ধদিগের আরাধ্য দেবতা হইয়াছিলেন।
পূর্ব্বে এদেশের অধিকাংশ লোক বৌদ্ধ ছিলেন। তখন বৌদ্ধধৰ্ম্ম একটা বিশেষ মত না হইয়া সর্ব্বজাতীয় লোকের সাধারণ মত ছিল। ব্রাহ্মণেরা শূন্যবাদী বৌদ্ধ শ্রমণের উপর এমন ভীষণ অত্যাচার করিয়াছিলেন যে, বৌদ্ধের নাম পর্য্যন্ত উচ্চারণ করিতে দিতেন না। যেটুকু বাকী ছিল, পাঠানদিগের অত্যাচারে তাহা শেষ করিয়া দিয়াছিল। পূর্ব্বে দেখিয়াছি, পাঠানেরা কিরূপে বৌদ্ধ সংঘারাম ধ্বংস করিতেন এবং সহজ উপায়ে অধিক সংখ্যক বৌদ্ধকে মুসলমানধর্ম্ম পরিগ্রহ করিতে বাধ্য করিতেন। এইরূপে এত বড় একটা বৌদ্ধ-জাতির যাহা কিছু প্রতিপত্তি ছিল, তাহার লোপ হইয়াছিল। আবুল ফজল এত অনুসন্ধান দ্বারা যে প্রকাণ্ড ‘আকবর-নামা’ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, তাহার মধ্যে প্রসঙ্গক্রমেও বৌদ্ধ কথাটি নাই। ব্রাহ্মণ ও পাঠান উভয়ে বড় দক্ষ হস্তে কাৰ্য্যসিদ্ধি করিয়াছিলেন। জাতিচ্যুত ও সমাজচ্যুত হইবার ভয়ে কেহ বৌদ্ধবিশ্বাসে ভর করিয়া ব্রাহ্মণের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইতে সাহস করিতেন না। যাহারা ক্রমে ব্রাহ্মণের বশ্যতা স্বীকার করিলেন, তাহারা ‘নবশাখ’ বা নূতন গঠিত এক শাখা-সম্প্রদায়ে স্থান পাইলেন। আর যাহারা তখনও বশীভূত হইলেন না, ব্রাহ্মণের চেষ্টায় ও রাজাদেশে তাহাদের জল অনাচরণীয় হইয়া রহিল। পশ্চিমবঙ্গে লোকে ভয়ে ভয়ে বুদ্ধ নাম ত্যাগ করিয়া ধর্ম্মনামে তাঁহার পূজা করিতে লাগিলেন। ক্রমে সেই ধৰ্ম্মপূজাপদ্ধতি যশোহর-খুলনার পশ্চিমাংশে কুশদ্বীপে প্রবেশ করিয়াছিল। এখনও পশ্চিমবঙ্গে গ্রামে গ্রামে ধর্মঠাকুরের পূজা হয়; কুশদ্বীপ অঞ্চলেও নিম্নশ্রেণীর লোকের মধ্যে সে পূজা দেখা যায়। মতান্তর গ্রহণ করা বড় কঠিন কার্য্য; নিম্নশ্রেণীর লোকে তাহা সহজে পারেন না। তাহারা সব ত্যাগ করিতে পারেন, ধর্ম্মত্যাগ করিতে চাহেন না। এইজন্য ডোম, হাড়ি প্রভৃতি জাতিরা ধর্ম্মত্যাগ করিতে না পারিয়া প্রচ্ছন্নভাবে বৌদ্ধধর্ম্মের আচার অনুষ্ঠান অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন।
আমাদের দেশে এখন এইরূপ যে সকল প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ জাতি আছেন, তন্মধ্যে যোগী জাতি প্রধান।[৩] ইঁহাদের আচার ব্যবহার ও প্রকৃতি দেখিলে সাধারণ হিন্দু অপেক্ষা কিছু পৃথক্ বলিয়া বোধ হয়। যোগী জাতির কোন ব্রাহ্মণ গুরু-পুরোহিত নাই; তাঁহারা আবশ্যক গৃহপূজা ও দীক্ষাদান প্রভৃতি কাৰ্য্য নিজেরা সম্পন্ন করেন। যোগীরা সংস্কৃত চর্চ্চার কিছু অধিক পক্ষপাতী ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ ছাড়া এত অধিক সংস্কৃতানুরাগী জাতি নাই। যোগীদিগের সাধারণতঃ গায়ের রঙ বেশ ফরসা; ইহাতে তাঁহাদিগকে যেন এদেশের লোক বলিয়া বোধ হয় না। যোগীরা কিছু নিরীহ, ধর্ম্মপ্রাণ, তাঁহারা মোকদ্দমা-মামলার বিশেষ পক্ষপাতী নহেন। যোগীরা অনেকে নিরামিষ আহার ভালবাসেন, পূজাদিতে পশুবলি দেন না। তাঁহাদের মৃতদেহ পূর্ব্বে অগ্নিদগ্ধ করিত না; যোগাসনে উপবিষ্ট অবস্থায় পুঁতিয়া রাখিত।[৪] এই সকল দেখিলে বোধ হয়, ইঁহারা যেন এ দেশের লোক নহেন, ইহারা যেন কোন উচ্চ সম্প্রদায়ভুক্ত এবং পৃথক ধৰ্ম্মাবলম্বী। ঐতিহাসিক অনুসন্ধান দ্বারাও তাহাই স্থিরীকৃত হইয়াছে।
বৌদ্ধ-যুগের শেষাবস্থায় একদল যোগাচারী বৌদ্ধ এক নূতন সম্প্রদায় গঠন করেন। তাঁহারা ‘নাথ’ উপাধিধারী বলিয়া ঐ সম্প্রদায়কে নাথসম্প্রদায় বলা হয়। ইঁহাদের মধ্যে আদিনাথ, মীননাথ, গোরক্ষনাথ, মৎস্যেন্দ্রনাথ, চৌরঙ্গীনাথ প্রভৃতি প্রধান। এক সময়ে ইঁহারা ভারতবর্ষের নানাস্থানে ভারতীয় রাজন্যবর্গের গুরুপদে বরিত হইয়াছিলেন। নেপাল ও তিব্বতে এখনও ইঁহাদের অনেকের পূজা হয়। নেপালে পশুপতিনাথদেবের মন্দিরের সম্মুখে গোরক্ষনাথের মন্দির বর্তমান আছে। ইঁহাদের ধর্মমত ক্রমে পরিবর্তিত হইলেও হিন্দু অপেক্ষা তাঁহারা বৌদ্ধমতেরই অধিকতর পক্ষপাতী ছিলেন।[৫] নাথযোগিগণ সেনরাজত্বে বঙ্গের অনেক স্থানে প্রতিপত্তিশালী ছিলেন। ‘দেশাবলীবিবৃতি’ নামক পুস্তকে কথিত হইয়াছে, জনৈক বৌদ্ধ নরপতি বঙ্গদেশীয় যোগিপণ্ডিতের রাজধানী ধর্মপুর অধিকার করিয়া লইয়াছিলেন।[৬] নাথগণ বঙ্গদেশে নানা জাতি হইতে বহু শিষ্য গ্রহণ করিয়া শিক্ষা-দীক্ষা দ্বারা তাহাদিগকে উন্নত করিবার চেষ্টা করিতেন।[৭] ইঁহারাই বর্ত্তমান যোগী জাতির পূর্ব্বপুরুষ। যখন বৌদ্ধধর্ম্মের নাম পৰ্য্যন্ত এদেশ হইতে মুছিয়া ফেলিবার চেষ্টা হইতেছিল, তখন নিরীহ যোগিগণ শৈবমত পরিগ্রহ করিলেন।[৮] ক্রমে যোগী ও অন্যান্য প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধজাতির মধ্যে দেউল বা চড়কপূজাপদ্ধতি প্রচলিত হইল।
এই দেউল পূজাটিই প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধোৎসব বলিয়া বোধ হয়। ইহাতে পূৰ্ব্বে ব্রাহ্মণ লাগিত না, এখনও নিম্নশ্রেণীর মধ্যে লাগে না। ব্রাহ্মণ কায়স্থাদি উচ্চজাতির বাড়ীতে রাত্রিতে যে ছাগবলি দিয়া নীলপূজা বা শিবপূজা করা হয়, সে পদ্ধতি ব্রাহ্মণদিগের দ্বারা পরে সংযোজিত হইয়াছে। নতুবা এই উৎসবের অধিকাংশ ক্রিয়াদি বৌদ্ধমতমূলক। গর্জ্জন শব্দের অপভ্রংশ ‘গাজন’ শব্দে পাঠান আমলে দেশের অবস্থা ধর্ম্মপ্রচারের জয়োল্লাস বা হুঙ্কার বুঝায়,[৯] ঘূর্ণমান চড়ক বৌদ্ধধর্ম্মচক্র প্রবর্তনের আভাস দেয়, হবিষ্যাশী সন্ন্যাসীরা বৌদ্ধশ্রমণের প্রতিকৃতি। এখনও যশোহর-খুলনায় দেউল পূজার প্রকৃত পুরোহিত যোগী জাতি। উঁহারা শিবপূজায় পাঁচালি গান না করিলে অঙ্গহানি হয়। এই শিবগায়কদিগের নাম ‘বালা’ এবং তাহারা নূপুর পায়ে দিয়া নাচিয়া নাচিয়া যে গান করেন, তাহাকে ‘বালাকি’ বলে। হস্তলিখিত পুঁথি অনুসারে বালাকি গান করা হয়। ঐ বালাকি পুঁথির সৰ্ব্বপ্রথমে অতীব অশুদ্ধ গ্রাম্যভাষায় সৃষ্টি বিবরণের সম্বন্ধে এই কথাগুলি পাইয়াছি
‘অনাহেতু নাছিল, নাছিল ঋষিমেদিনী
রূপ রেক নাহি প্রভুর অবর্ণ পরিমাণি॥
না ছিল রবি শশী, শূন্যসতি পার্শ্বঋষি, না ছিল এ মেউর মন্দার।
এ সব দেবগণ, সবে ছিল একজন, শূন্যে ভ্রমিলে নৈরাকার।।
হ’য়ে শূন্য নহে শূন্য, নহে শূন্যাকার।
এই শূন্য স্থল যে প্রভু আপনি নৈরাকার।।’
পাঠক এই বালাকি পাঁচালির সহিত শূন্যপুরাণের প্রারম্ভেই সৃষ্টিপত্তনের প্রথম কয়েক পংক্তি তুলনা করিতে পারেন :
‘নহি রেক নহি রূপ নহি ছিল বন্ন চিন্।
রবি সসী নহি ছিল নহি রাতি দিন।
নহি ছিল জল থল নহি ছিল আকাস
মেরু মন্দার নছিল নছিল কৈলাস।’
‘দেবতা দেহারা নহিল পূজিবাক দেহ
মহাশূন্য মধ্যে পরভুর আর আছে কেহ।’-ইত্যাদি।[১০]
যে সংস্কৃত ধ্যান দ্বারা কোন কোন স্থানে ধর্ম্ম ঠাকুরের পূজা হইয়া থাকে, তাহা এই :
‘যস্যান্তো নাদিমধ্যে নচ কর-চরণ নাস্তিকায় নিদান
নাকারং নাদিরূপং নাস্তি জন্ম চ যস্য।
যোগীন্দ্রো জ্ঞানগম্যো সকলজনগতং সৰ্ব্বলোকৈকনাথ
তত্ত্বং তঞ্চ নিরঞ্জনং মরবরদ পাতু নঃ শূন্যমূত্তিঃ।।’[১১]
ইহাতে স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে, শূন্যপুরাণে যে বৌদ্ধ শূন্যমূর্ত্তির পূজা আছে, দেউল পূজারও আরাধ্য মূর্ত্তি তিনি। এই বৌদ্ধ মহোৎসর ক্রমে শিবের নামে শিবের গল্প সমেত হিন্দুর ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। যোগীরা ‘বালা’রূপে তাঁহাদের পূর্ব্বতন মতেরই পরিচয় দিতেছেন।[১২] তাঁহাদের অবস্থা পাঠান আমলে যেরূপ ছিল, এখনও প্রায় সেইরূপ আছে।
এই যুগে পাঠানেরা ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য কিরূপ চেষ্টা করিয়াছিলেন, আমরা পূৰ্ব্বে তাহার আভাস দিয়াছি। পাঠানবিজয়ের প্রারম্ভে মুসলমানের প্রতি হিন্দুদের যেমন বিজাতীয় বিদ্বেষ ছিল, শেষভাগে তাহা ছিল না। তখন উভয় জাতি অনেকটা মিলিয়া মিশিয়া বাস করিতেছিলেন। যাঁহারা নূতন মুসলমান ধর্ম্ম পরিগ্রহ করিয়াছিলেন, তাঁহারা প্রাচীন হিন্দু-রাজনীতি পরিত্যাগ করিতে পারেন নাই। এমন কি হিন্দুর মত পূজা ও ব্রতপালনাদি করিতেন।[১৩] রাজা গণেশের সময় হিন্দু দেবতা সত্যনারায়ণ, সত্যপীর হইয়া মুসলমানেরও আরাধ্য হন। তখন মুসলমানী প্রথায় হিন্দু মুসলমানে সির্ণী দিতে আরম্ভ করেন, সম্ভবতঃ হুসেন শাহ প্রভৃতি ইহার উৎসাহ দিতেন।[১৪] কিছুদিন পরে ফরিদপুর হইতে ‘ত্রিনাথের মেলা’ প্রবর্তিত হয়; ইহাতে রাত্রিতে গাঁজা ও মিষ্ট দ্রব্য দিয়া বিনামন্ত্রে শিবের পূজা করা হইত। হরিদাসই ‘হরির লুঠ’ দিবার প্রথা আরম্ভ করেন। এইরূপে গাজীর সির্ণী, ‘মুস্কিল আসান’ বা গোরাচাঁদের পূজা, বনবিবি ও দক্ষিণ রায়ের পূজা আরম্ভ হয়। বৌদ্ধ হারিতী দেবী হিন্দুদের শীতলাদেবী হইয়া পূজা পাইতেছিলেন।
সমাজ।। সামাজিক রীতিনীতি ধর্মেরই অনুরূপ হয়। ইহাতেও মুসলমানী প্রভাব বিস্তৃত হইয়া পড়ে। বল্লালের কৌলীন্যপ্রথার পর তদ্বংশীয় দনুজমাধবের সময়ে জাতিসমূহের সমীকরণ হইয়া কিছু কিছু নূতন সংস্কার হইয়াছিল। কিন্তু তদবধি ২/৩ শত বৎসরের মধ্যে উহার উপর আর কেহই হস্তক্ষেপ করেন নাই। এই দীর্ঘকালমধ্যে সহজে নানা গোলযোগ এবং কুলীনদিগের প্রকৃতিতে নানা দোষ প্রবেশ করিয়াছিল। তাহাই দেখিয়া প্রসিদ্ধ দেবীবর ঘটক ব্রাহ্মণের মধ্যে মেল বন্ধন করেন। তিনি দোষের হিসাবে ব্রাহ্মণ কুলীনগণকে ৩৬টী মেলে বা বিভাগে বিভক্ত করেন এবং উহাদের কোন্ ঘরের সহিত কাহার আদান-প্রদান হইবে, তাহাও ঠিক করিয়া দেন। দেবীবর চৈতন্যদেবের সমসাময়িক, অথচ বয়সে তাঁহার অপেক্ষা কিছু বড়। কিছুকাল পরে, অর্থাৎ মোগল আমলে তাঁহার মেল বন্ধন হইতে ব্রাহ্মণসমাজে অনেক কুফল ফলিয়াছিল। সুলতান হুসেন শাহ হিন্দুদিগের গুণের মর্য্যাদানুসারে পুরস্কৃত করিতেন এবং তাঁহাদিগকে নানা সম্মানিত উপাধি দিতেন। তাঁহার অমাত্য বসুবংশীয় পুরন্দর খাঁ কায়স্থ-সমাজের নানা সংস্কার করেন। সে সংস্কারের ফল এতদঞ্চলে এখনও বিদ্যমান রহিয়াছে।
এ যুগে দুই দিক্ হইতে দুইটি বিভিন্ন সমাজের শক্তি-স্রোত যশোহর-খুলনাকে প্লাবিত করিয়াছিল। পশ্চিমদিক্ হইতে নবদ্বীপ সমাজ ও পূর্ব্বদিক্ হইতে চন্দ্রদ্বীপ সমাজ যশোহর-খুলনার উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিল। কপোতাক্ষ নদ উভয় প্রতিপত্তির মধ্যসীমা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। চৈতন্যদেবের সমসাময়িক রঘুনন্দন সমগ্র স্মৃতিশাস্ত্র মন্থন করিয়া অষ্টাবিংশতি-তত্ত্ব প্রকাশ করেন এবং উহা দ্বারা লৌকিক ক্রিয়ানুষ্ঠানের ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। তাঁহার সে ব্যবস্থা সমস্ত বঙ্গদেশের উপর কার্য্যকরী হইলেও নদীয়ার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রীতিনীতিগুলি কুশদ্বীপ পার হইয়া কপোতাক্ষের ‘পূৰ্ব্বদিকে গিয়াছিল কিনা সন্দেহ। সে অঞ্চলে পূর্ব্ববঙ্গের ব্যবস্থাই প্রধান ছিল। একাদশী তিথিতে পশ্চিমবঙ্গে ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের বিধবাগণ ‘নির্জ্জলা’ উপবাস করেন; কিন্তু কপোতাক্ষের পূর্ব্বদিকে একটা ধারণা আছে যে বিধবাদিগের বিশেষতঃ পুত্রবতী বিধবাগণের নির্জ্জলা একাদশীর উপবাস করা পাপজনক। প্রকৃত যশোর রাজ্য নদীয়ার সীমা-বহির্ভূত ছিল। বনগ্রাম মহকুমা তখন নদীয়ার অংশ এবং বাগেরহাট মহকুমা তখন বরিশালের অংশ ছিল। সুতরাং এখনকার যশোহর-খুলনার সীমানুসারে সমাজের অবস্থা স্থির করিতে হইলে, তিনটি সমাজের অবস্থা বুঝিতে হয়। চন্দ্রদ্বীপ, যশোহর ও নদীয়া-আচার-ব্যবহারে ও আহার-পরিচ্ছদে পৃথক্ পৃথক্ ছিল।
সমাজের মধ্যে ব্রাহ্মণগণ সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন; কিন্তু বৈষয়িক প্রতিপত্তি কায়স্থেরই অধিক ছিল। আইন-ই-আকবরিতে বঙ্গদেশে অসংখ্য কায়স্থ রাজন্যের নাম আছে; ভুঞা রাজগণের মধ্যেও অনেকে কায়স্থ ছিলেন। তবুও পাঠান আমলে রামচন্দ্র খাঁ, মুকুটরায় প্রভৃতি প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ ভূম্যধিকারীর পরিচয় পাই; এবং এ যুগের শেষভাগে কুশদ্বীপের অন্তর্গত ইচ্ছাপুরে হেড় চৌধুরীগণ ও ঝিনাইদহ অঞ্চলে নলডাঙ্গার প্রসিদ্ধ রাজবংশ প্রধান হইয়া উঠিয়াছিলেন। বৈদ্যগণ তখনও কোন জমিদারী স্থাপন করেন নাই; তাঁহারা শাস্ত্রচর্চ্চা ও চিকিৎসা ব্যবসায় দ্বারা সর্ব্বজাতীয় লোকের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। কায়স্থ জমিদারগণ ভূমিবৃত্তি দিয়া ব্রাহ্মণদিগকে প্রতিপালন করিতেন। ব্রাহ্মণেরা সর্ব্বত্র এখনও যে নিষ্কর ভোগ করিতেছেন, তাহা কায়স্থদিগের দ্বারা প্রদত্ত। দ্বিগঙ্গার সেন, বনগ্রামের দত্ত, বোধখানার চৌধুরী, দাঁতিয়ার মিত্র, নলতার ভঞ্জ, হরিঢালী ও মহেশ্বরপাশার গুহমজুমদার, পাঁজিয়ার সিংহ ও বিষ্ণু, বাসড়ীর মিত্র, সেখহাটির চৌধুরী প্রভৃতি বিখ্যাত কায়স্থ-বংশ পাঠান যুগে প্রতিপত্তি লাভ করেন। তিওর, কৈবর্ত্ত ও সাহা বংশীয় ভূম্যাধিকারীও কোন কোন স্থানে ছিলেন। মাণিকপুরের তিওর রাজা, মহেশপুর ও চেঙ্গুটিয়ার মাঝিগণ এবং সিঙ্গিয়ার পাতালভেদী রাজার কথা উল্লেখযোগ্য।
সমাজে কঠোর শাসন ছিল; শাসন-দণ্ড ব্রাহ্মণের হাতেই ছিল। তবে প্রত্যেক জাতির মধ্যে দলপতি বা সমাজপতিরা আভ্যন্তরিত ব্যবস্থা করিতেন। ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থের মধ্যে কুলীনদিগের বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। নবাগত কায়স্থ কুলীনেরা মৌলিকদিগের উপর যথেষ্ট আবদার চালাইতেন। ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে সেনহাটী প্রভৃতি স্থানের সর্ব্ববিদ্যা-সন্তানগণ, সারল ও সেনহাটীর কাঞ্জরী বংশ এবং নলডাঙ্গার আখণ্ডল রাজবংশ বিশেষ সম্মানিত ছিলেন। সেনহাটী বৈদ্য-কুলীনের একটি প্রধান স্থান ছিল। সুবর্ণবণিকেরা সমাজে অত্যন্ত নিন্দিত হইতেন। বৈশ্যদিগের মধ্যে গন্ধবণিকেরাই বাণিজ্য ব্যবসায়ে দেশে বিদেশে সমৃদ্ধিসম্পন্ন হইয়াছিলেন। বাঙ্গালীর ঔপনিবেশকতার অনেক ইতিহাস ইহাদের বাণিজ্যকাহিনীর সহিত জড়ীভূত রহিয়াছে। চাঁদ সওদাগরের ‘সপ্ত ডিঙ্গা’, বেহুলার কলার মান্দাসের বিচিত্র অভিযান বাঙ্গালীর নিকট এমনভাবে চিরপরিচিত হইয়া রহিয়াছে যে, গ্রামে গ্রামে চাঁদ সওদাগরের ভিট্টা বাহির হয়, বেহুলা আদর্শ সতীরূপে সীতা সাবিত্রীর পার্শ্বে স্থান পাইয়াছেন, ‘রামায়ণ’ ও ‘কৃষ্ণলীলার’ মত ‘বেহুলার ভাসান’ও গৃহে গৃহে গীত হইয়া গৃহস্থের মঙ্গল বৃদ্ধি করে। ইহা হইতেই যশোহর-খুলনার পূর্ব্বভাগে ও বরিশাল জেলায় মনসাদেবীর পূজার এত প্রচলন হইয়াছে।[১৫]
শিক্ষা। সেনরাজত্বের মত পাঠান আমলেও শাস্ত্রচর্চ্চা ছিল। যদিও পাঠানবিজয়ের জন্য রাষ্ট্রীয় উৎপাতে অনেক স্থানে ব্রাহ্মণেরা শত্রুর ভয়ে পাঠ বন্ধ ও পুঁথি লেখা বন্ধ করিয়াছিলেন, কিন্তু সে ভাব চিরকাল ছিল না। খাঁ জাহানের আমলে ও হুসেন শাহের রাজত্বকালে পুনরায় ব্রাহ্মণপ্রধান গ্রামমাত্রেই টোল খুলিয়াছিল এবং শাস্ত্রচর্চ্চা হইত। হুসেন শাহ সর্ব্বত্র শিক্ষার উৎসাহদাতা ছিলেন। বৈদ্য পণ্ডিতের টোলেও কাব্য, ব্যাকরণ এবং বৈদ্যক শাস্ত্রের অধ্যাপনা হইত। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগ হইতে ন্যায় স্মৃতি পড়িবার জন্য দলে দলে ছাত্র নবদ্বীপে যাইত। ইহা ব্যতীত সামান্য বাঙ্গালা পড়িবার জন্য পাঠশালা বা ‘চৌপাড়ি’ ছিল; এবং মুসলমানদিগের মধ্যে কাজী ও মৌলবীগণ স্বীয় স্বীয় বাড়ীতে পারসী ও আরবী পড়াইতেন। তাঁহারাও ভট্টাচার্য্য অধ্যাপকদিগের মত ছাত্রদিগের আহার ও বাসস্থান দিতেন। পাঠশালায় প’ড়োগণ ‘সিদ্ধিরস্তু’ বলিয়া পাঠ আরম্ভ করিত, এবং নাম্তা, শকিয়া, কড়াকিয়া, গণ্ডাবুড়ির হিসাব, কাঠাকালি, বিঘাকালি, মণকষা প্রভৃতি মুখে মুখে অভ্যাস করিত। পাঠান আমলের শেষভাগ হইতে মুসলমানেরা গুরুগিরিতে বিশেষ দক্ষ হইয়াছিলেন। তখন হিন্দুর বাড়ীতেও মুসলমান গুরু রাখিবার প্রথা আরম্ভ হইয়াছিল। বুড়ন পরগণা নিবাসী পীরালি মুসলমান গুরুমহাশয়গণ ‘বুড়নীর খাঁ’ সাহেব নামে হিন্দুর পাঠশালায় শিক্ষকতা করিয়া ছাত্রবর্গের ভয়-ভক্তি আকর্ষণ করিতেন। কিন্তু হিন্দু অধ্যাপকেরা কখনও নিম্ন বা অপর জাতিকে সংস্কৃত শিখাইতেন না। পড়িবার পুঁথিপত্র সমস্তই তালপত্রে লিখিত হইত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কাগজের প্রথম প্রচলন হয়। তখন এ দেশীয় লোকে অনেকে কাগজ প্রস্তুত করিতে শিখিয়াছিলেন। খুলনা জেলায় এখনও অনেক কাগজীদিগের বাড়ী আছে।
শিল্প। যশোহর-খুলনায় যথেষ্ট কার্পাস জন্মিত। তুলসী ও বিল্বের মত প্রত্যেক ব্রাহ্মণ- বাড়ীতে কার্পাসের নিশ্চিত ব্যবস্থা থাকিত। গৃহে গৃহে চরকা ছিল; ব্রাহ্মণীগণ কার্পাসতুলা হইতে সূতা প্রস্তুত করিতে পারিতেন এবং অতি সূক্ষ্ম সূত্রে নবগুণ উপবীত প্রস্তুত করিয়া যথেষ্ট শক্তিনৈপুণ্যের পরিচয় দিতেন। ভাল পৈতা তৈয়ার করা একটা বিশেষ প্রশংসার জিনিস ছিল। দরিদ্র গৃহস্থেরা সূতা প্রস্তুত করিতেন এবং তাঁতিবাড়ী লইয়া গিয়া সামান্য ‘বাণী’ বা পারিশ্রমিক দিয়া, উহা দ্বারা আবশ্যক কাপড় প্রস্তুত করিয়া আনিতেন। এ প্রদেশে কোন কোন স্থানে উৎকৃষ্ট সূক্ষ্মবস্ত্ৰ প্ৰস্তুত হইত। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার মত অধিক পরিমাণ বস্ত্র প্রস্তুত হইত কি না বলা যায় না। বাঁশের খণ্ড হইতে গৃহ-নির্মাণের সরঞ্জাম প্রস্তুত করিতে লোকে যথেষ্ট সৌন্দর্য্যজ্ঞান ও শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দিতেন। বাঁশের ছিঁচে বা কাচনীর বেড়ায়, বেতের বান্ধনে বড় কারুকার্য্য প্রকাশ করিত। নানাবিধ জলজ গাছের ছাল বা ‘বেতী’ হইতে মাদুর ও শীতলপাটী প্রস্তুত হইত; নলের দরমা, মলুয়াপাটী ও হোগলা চাঁচ ঘরের বেড়ায় লাগিত এবং অন্যান্য প্রয়োজনসিদ্ধি ও করিত। বেতের ধামা, বাঁশের ‘বেতী’ হইতে ডালা, কুলা, ঝাঁকা সংসারীর একান্ত আবশ্যক ছিল। জগন্নাথের রথে, ঠাকুরের দোলায়, কাঠের সিন্দুকে, কাঁঠালের কাঠের কার্য্যে কাষ্ঠশিল্পীর ক্ষমতা প্রকাশ পাইত। এ দেশীয় কামারেরা উৎকৃষ্ট খাণ্ডা, দাঁ, কোদালী, কুড়ালি, খন্তা, জাতি, বঁটী প্রভৃতি নিত্যব্যবহার্য্য অস্ত্র প্রস্তুত করিতে অতুলনীয় ছিলেন। উৎকৃষ্ট ‘আঁটালি’ বা মাঁচালি প্রস্তুত করিয়া ঘরের মধ্যে টাঙ্গাইয়া, উহাতে লোকে গৃহসজ্জা রাখিতেন; স্ত্রীলোকেরা কাঁথা সেলাই ও ‘সিকা’ প্রস্তুত করিয়া অন্য দেশকে পরাজয় করত যশোলাভ করিতেন। বিবাহাদি শুভকৰ্ম্ম উপলক্ষে ‘আই’ গড়ান, পীড়ি, কুলা, ও সরা চিত্রিত করা প্রভৃতি কার্য্যে গ্রামে গ্রামে দুই একজন স্ত্রীলোক প্রভুত সম্মান ও পুরস্কার পাইতেন। নৈবেদ্য রচনা, শিবগড়ান ও আলিপনা দেওয়া গৃহশিল্প ছিল। উৎসবাদিতে স্ত্রীলোকেরা বহুজনে মিলিয়া উলুধ্বনি বা জোকার (জয়কার) দিতেন এবং কখনও সমস্বরে গান করিতেন বটে, কিন্তু গানে বিশেষ দক্ষতা ছিল বলিয়া মনে হয় না। তাঁহারা পুরুষেরা দেহতত্ত্ব ও ‘ভবানী-বিষয়’ প্রভৃতি সম্বন্ধে গান করিতেন; যাঁহারা দক্ষ, তানপুরারও সাহায্য লইতেন, রামকথা, কৃষ্ণকীর্ত্তন ও কালীকীৰ্ত্তন লইয়া পাঁচালি গান হইত, ইহাতে চামর ও মন্দিরার ব্যবহার ছিল। শেষভাগে হিন্দুর মধ্যে মনসার ভাসান ও মুসলমানের মধ্যে গাজীর গান প্রচলিত হইয়াছিল। চৈতন্যযুগে মৃদঙ্গ ও করতাল সহযোগে হরিনাম সংকীৰ্ত্তনে দেশ মাতাইয়া তুলিত। রাজা মুকুট রায়ের সময়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গ হইতে কিন্নরজাতি আনিয়া তাঁহার রাজধানীর সন্নিকটে বসতি করান; ইঁহারা নৃত্য-গীতে অতীব সুদক্ষ ছিলেন। মুকুট রায়ের পতনের পর ইঁহারা উলসী প্রভৃতি স্থানে গিয়া বাস করিয়াছিলেন। নদীমাতৃক দেশে অনেক লোক নৌকায় বাস করেন; তাহারা আত্মতৃপ্তির জন্য যে গান গাহিতেন, সেই ‘সারী’ গান আবার পরের চিত্ত-বিনোদন করিত। যশোহর-খুলনার ‘সারী’ গানের মত আর মিষ্ট জিনিস কিছু আছে কি না সন্দেহ। এ যুগে লোকে মৃত্তিকার দ্রব্যের উপর সুন্দর রঙ ফলাইয়া ‘মীনা’ (enamel) বা এনামেল করিতে পারিতেন। হাঁড়ি কলসীর উপর এইরূপ মীনার কাজ হইত, তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। খাঁ জাহানের সমাধি-মন্দিরের মেজের উপর মীনা করা ইট দিয়া ঢাকা ছিল। উহাতে ঘরের ভিতর অতি সুন্দর দেখাইত।
সাংসারিক জীবন। মুসলমানের আক্রমণ বা অত্যাচার দ্বারা দেশের শান্তি যতই নষ্ট হউক, অধিবাসীরা মোটের উপর সুখী ছিলেন; কারণ খাদ্যদ্রব্য তখন সুলভ ছিল। পাঠান ও মোগলে বিশেষ পার্থক্য এই ছিল যে, পাঠানেরা এদেশে বাস করিতেন, দেশের অর্থ দেশে রাখিতেন, তাঁহারা মোগলদিগের মত বাঙ্গালার অর্থ লইয়া দিল্লী আগ্রার সৌষ্ঠব বাড়াইতেন না। দেশের অর্থ দেশে থাকায় খাদ্যদ্রব্য সুলভ ছিল, পরিচ্ছদে বিলাসিতা ছিল না, প্রাচীন হিন্দুভাব পরিবর্তিত হয় নাই; দুই চারি জন লোকে নূতন মুসলমানী ধরন গ্রহণ করিলেও, সাধারণতঃ দেশের অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয় নাই। খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে ‘দুধ-মাছ’ সস্তা ছিল, উহাই প্রধান খাদ্যোপকরণ। ধান চাউল অত্যন্ত সুলভ ছিল; ‘সকল ধান ২২ পাহারী’ বলিয়া একটি কথা আছে, অর্থাৎ ধান এত সস্তা যে ধানের ভালমন্দ বিচার করিয়া দামের তারতম্য ছিল না; ব্রাহ্মণেরা অনেকে নিরামিষভোজী এবং প্রায় সকলেই পৰ্ব্বদিনে, কার্ত্তিক, মাঘ ও বৈশাখ মাসে মৎস্য খাইতেন না বলিয়া মৎস্যাশীর সংখ্যা কম ছিল। মৎস্য কিনিয়াও অতি কম লোকে খাইতেন; খাল বিল নদী পুষ্করিণীর সংখ্যাধিক্য বশতঃ মাছ ধরিবার বিশেষ সুবিধা ছিল। প্রতি গৃহে গরু পোষা হইত; গোপালন গার্হস্থ্য ধর্ম্মের প্রধান অঙ্গ; বিশেষতঃ গরু বিক্রয় করা একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল। কারণ, মুসলমানেরা কিনিয়া লইয়া গোবধ করিতে পারেন, ইহার আশঙ্কা ছিল। গোবধের জন্য হিন্দুরা মুসলমানের সহিত দাঙ্গা হাঙ্গামা করিতেন। ঘৃতই প্রধান খাদ্য ছিল; ঘৃত সংস্পর্শ ব্যতীত চাউল বা অন্ন শুদ্ধ হইত না, ঘৃতবিহীন আহার অতীব নিন্দনীয় ছিল। লোকে দুগ্ধ হইতে প্রস্তুত করিয়া দধি, ক্ষীর, নবনীত খাইতেন। দধি মাঙ্গলিক দ্রব্য ছিল, উহা ব্যতীত কোনও উৎসব বা নিমন্ত্রণ পূর্ণাঙ্গ হইত না। লোকে ছানা খাইতেন, চিনি খাইতেন, কিন্তু তখন সন্দেশ রসগোল্যা প্রভৃতির আস্বাদ জানিতেন না। মুসলমানেরা নিজেদের মত কোরমা, কোপ্তা, কাবাব প্রভৃতি খাইতেন; তাঁহাদের খাদ্যের মধ্যে মাংসই অধিক থাকিত।
অধিবাসিগণ একখানি ছোট ধুতি পরিতেন, উহা এখনকার ধুতি অপেক্ষা দৈর্ঘ্যপ্রস্থে অনেক কম। গামছা চিরসহচর ছিল। কোনস্থানে যাইতে হইলে ধুতির সহিত একখানি চাদর বা উড়ানি ব্যবহার করা হইত এবং অল্পলোকে চটি জুতা লইতেন। কিন্তু দূরপথে যাইবার সময় চটী জুতা হাতেই চলিত, গন্তব্য স্থানের নিকট গিয়া চটি পায়ে দেওয়া হইত। মোজাজুতার প্রচলন ছিল না, মুসলমানেরা নাগরী জুতার আমদানী করিয়াছিলেন, রৌদ্র-বৃষ্টির জন্য তালপত্রের ছত্র ব্যবহৃত হইত। একটি টাকার মধ্যে একজন সাধারণ ভদ্রলোকের পরিচ্ছদ হইত। চাঁদরটি কোঁচাইয়া কখনও কাঁধে ফেলা হইত এবং কখনও মাজায় বাঁধা হইত; শীতকালে ঐ চাদরের উপর শাল জামিয়ার গায়ে দেওয়া হইত। শাল, জামিয়ারও বনাত ধনীদিগের শীতবস্ত্র ছিল; উহার একখানি কিনিলে ৩/৪ পুরুষ চলিত। গায়ে লাগিয়া ময়লা হইবার ভয়ে উহার নিম্নে একটি চাদর ব্যবহৃত হইত। সাধারণ লোকে দোপাট্টা গায়ে দিত, কিন্তু কোঁচার কাপড়ের মত কিছুতেই শীতবারণ হইত না। লোকে দেবপিতৃকার্য্যে বা উৎসবে তসর, চেলি প্রভৃতি পট্টবস্ত্র ব্যবহার করিতেন গুরুঠাকুরেরা শিষ্যবাড়ী যাইবার সময় পট্টবস্ত্রই পরিতেন, কেহ কেহ রক্তবস্ত্রই অধিক পছন্দ করিতেন। বালক-বালিকারা শীতকালে অঙ্গরাখা বা আঙ্গা এবং ছিটের দোপরদা দোলাই গায়ে দিত, গরিব সন্তানেরা পরিধানের ধুতিখানি ভাঁজ করিয়া গায়ে দিত; কাঁথাও শীতনিবারণের প্রধান উপায় ছিল। সধবা স্ত্রীলোকেরা লালপেড়ে শাড়ী পরিতেন, পাঠান-আমলে ডুরে কাপড় আসিয়াছিল কিন্তু পাছাপা’ড় হয় নাই। বশোহর-খুলনার পূর্ব্বাদ্ধের স্ত্রীলোক দোবেড়া কাপড় পরিতেন, কুশদ্বীপে সে পদ্ধতি ছিল না। কাপড়ের আঁচল বা অন্য ভাঁজ করা কাপড় ব্যতীত স্ত্রীলোকের বিশেষ শীতবস্ত্র ছিল না। উষ্ণীষ না বাঁধিয়া কোন ধর্ম্মকার্য্য করা হইত না, ব্রাহ্মণেরা দূরবর্ত্তী স্থানে যাইবার সময়ও উষ্ণীষ বাঁধিতেন। অন্য জাতিও তাহার অনুকরণ করিতেন। মুসলমানেরা পাগড়ী বাঁধিতেন, তাঁহারা অনেক সময়ে পাগড়ী বদল করিয়া হিন্দুর সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করিতেন; এইরূপে ‘পাগড়ী বদল ভাই’ হইত।
পাঠান রাজত্বকালে মুসলমানী কায়দা অনেক হিন্দু-সমাজে প্রবেশ করিয়াছিল। ব্রাহ্মণেরাও দাড়ি রাখিতেন এবং কেহ কেহ বা ইজার পরিতেও আরম্ভ করিয়াছিলেন। দুই একটি পারসী বয়েদ না জানিলে ভদ্র-মজলিসে পসার হইত না। কাহাকেও গালাগালি দিবার কালে পারসী ভাষায় গালি দিয়া বলদর্প দেখান হইত! দাঁতে মিশি ও চক্ষুতে সুরমা দেওয়া ক্রমে সংক্রামক হইতেছিল। দাড়ি রাখার পদ্ধতি ক্রমে এত বিস্তৃত হইতেছিল যে, মুসলমান হইতে পৃথক বলিয়া পরিচয় দিবার জন্য শুশ্রুধারীরা ব্রাহ্মণ হইলে টীকি, পৈতা ও তিলক এবং অন্য জাতিরা তুলসী বা রুদ্রাক্ষ মালা বা টীকি সাধারণের দৃষ্টিপথবর্ত্তী করিয়া রাখিতেন। বৈদ্যগণ কপালে তিলক, মস্তকে উষ্ণীষ ও স্কন্ধে বৈদ্যকগ্রন্থ লইয়া রোগীর বাড়ীতে যাইতেন। মোল্যাগণ এবং অন্য মুসলমানেরা নমাজ পড়িবার সময় কাছা দিতেন না; কিন্তু হিন্দুরা ইহা ভালবাসিতেন না। তাহারা মুসলমানদিগকে ‘কাছাখোলা’ বলিয়া ঠাট্টা করিতেন। অধ্যাপকগণ মুক্তকচ্ছ হইলে, বিষয়-জ্ঞানবিহীন বলিয়া উপহসিত হইতেন।
এযুগে হুক্কায় তামাক খাওয়ার রীতি ছিল না। কিন্তু ব্রাহ্মণের মধ্যে নস্য অনবরত চলিত। নস্যহীন বা পৈতাহীন একই প্রকার অসম্ভব কথা হইয়া দাড়াইয়াছিল; বৈদ্যেরাও নস্যসেবী ছিলেন। এদেশীয় বৈদ্য কায়স্থ বা অন্য কোন ব্রাহ্মণেতর জাতির পৈতা ছিল না। মদ্যপায়ীর সংখ্যা কম ছিল, তবে হাটে বাজারে মদ্য বিক্রয় হইত। তথায় বেশ্যারা বাস করিত। গৃহস্থের ঘরে সতীলক্ষ্মীরা দেবতার মত পূজিত হইতেন। অনেক স্ত্রীলোক ‘সহমরণ’ যাইতেন; বিধবারা হিন্দু-গৃহে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন; দেব-সেবা ও অতিথি-সেবার ভার এবং সংসারে কর্তৃত্ব দিয়া তাহাদিগকে সন্তুষ্ট ও কার্য্যনিরত রাখা হইত। ইঁহারা চুল কাটিয়া বিলাস-ভূষা পরিত্যাগ করিয়া কঠোর ব্রহ্মচর্য্য পালন করিতেন; তাঁহাদের অনেকেই রোগ হইলে ঔষধ খাইতেন না। সধবারা চুলে বেণী, লোটন প্রভৃতি নানাবিধ খোঁপা বাঁধিতেন; কঙ্কণ, বলয়, হার ও নথ পরিতেন; পাঠান আমলে চুড়ী, পৈছা, ঝুমকা, গোট প্রভৃতি গহনারও প্রবর্তন হইতেছিল। পুরুষেরাও লম্বা চুল রাখিতেন ও স্ত্রীলোকের মত বাঁধিয়া রাখিতেন। পাঠান আমলে লাঠিয়ালেরা ‘বাবরী’ (স্কন্ধ পর্য্যন্ত দোদুল্যমান) চুল রাখিতেন।
হাটে বাজারে রাজা বা জমিদারের লোক থাকিতেন; তাহারা রাজস্ব আদায় করিতেন; ওজনের বাটখারা পরীক্ষা করিতেন ও বিবাদ মিটাইতেন। চৌকিদারেরা পাহারা বা চৌকী দিতেন, সংবাদ লইয়া মণ্ডল বা পঞ্চায়েতের নিকট যাইতেন এবং তাহাদের আজ্ঞা প্রজাদিগকে জানাইতেন। গ্রামের মধ্যে নাপিত ক্ষুর, ভাঁড় ও দর্পণাদি লইয়া ক্ষৌরী করিয়া বেড়াইতেন, আবশ্যক মত অস্ত্র-চিকিৎসাও করিতেন, বরের সহিত দর্পণাদি লইয়া বিবাহবাড়ী যাইতেন। নাপিতই ছিলেন গ্রামের গল্পগুজব ও গুপ্ত সংবাদের ভাণ্ডার, তিনি রামের কথা শ্যামকে বলিয়া বেশ আসর জমাইতেন এবং সময়ে সময়ে বিবাদ বাধাইয়া দিতেন। তহশীলের কার্য্য প্রায় কায়স্থদিগেরই এক চেটিয়া ছিল; তাহারা হিসাব নিকাশে যেমন দক্ষ, শাসন দমনে তেমনি সমর্থ, পরের নিকট হইতে ছলে-বলে বা সদ্ভাবে পয়সা আদায় করিতেও তেমনি মজবুত। পুরোহিতেরা যেমন যজমানের সাত পুরুষের মৃত্যুতিথি ঠিক রাখিয়া সময় মত পিতৃকার্য্য করাইয়া আপন গণ্ডা বুঝিয়া লইতেন, তেমনই সময় অসময়ে সন্ধান লইয়া কায়মনোবাক্যে যজমানের বিপদ উদ্ধার করিয়া দিতেন। স্ত্রীলোকে চিড়া কুটিতেন, খই ভাজিতেন এবং ধান ভানিতেন। মুড়ি সে সময় ছিল না।
মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ঘরে কাঠের সিন্ধুকই প্রধান গৃহসজ্জা ছিল! উহার ভিতরে জিনিসপত্র থাকিত, রাত্রিতে উহার উপর শুইবার বিছানা পড়িত। ইহা হুড়কা ও প্রকাণ্ড কুলুপ দিয়া বন্ধ থাকিত। গরিব লোক ঘরের মধ্যস্থলে গর্ত কাটিয়া তাহার ভিতর জিনিসপত্র রাখিয়া উপরে বিছানা পাতিয়া শুইতেন। চোরের ভয় কম ছিল না। সাধারণ লোকে ভাত খাইবার জন্য থালা অপেক্ষাও পাথরের পাত্র অধিক ব্যবহার করিতেন; পিত্তলের ঘটী ও গাড়ু, কাঁসার বাটী ও ফেরুয়া ব্যবহৃত হইত; মুসলমানেরা বদ্না ও আবখোরা প্রভৃতি চালাইয়াছিলেন। হিন্দুরা তাম্রনির্ম্মিত পূজার সাজ ব্যবহার করিতেন, কিন্তু তামার কোন পাত্র সাধারণ সাংসারিক কাজে লাগাইতেন না। মুসলমানেরা তামার বদ্না তাঁহাদের জাতীয় চিহ্নের মত করিয়া লইয়াছিলেন। যাঁহারা নূতন মুসলমান ধৰ্ম্ম লইতেন, তাঁহাদের বাড়ীর সম্মুখে একটি বদ্না টাঙ্গান থাকিলে লোকে প্রকৃত ব্যাপার বুঝিত। মুসলমানেরা বড় বড় তামার ডেক কালাই করিয়া ব্যবহার করিতেন; হিন্দুদের ছিল পিত্তলের হাঁড়ি এবং বহু কাৰ্য্যে বহুভাবে ব্যবহৃত বহুগুণা বা বগুণা। হুসেন শাহের গৌড়ে ধনীরা স্বর্ণপাত্রে পান ভোজন করিবার প্রবাদ থাকিলেও, তেমন ভাগ্য দীনা যশোহর-খুলনার লোকের হইয়াছিল কি না সন্দেহ। কারণ, গ্রাম্য লোকের দিন স্বভাবজাত সুলভ দ্রব্যে সুখে চলিয়া যাইত বটে, কিন্তু তাঁহারা বাহিরের অর্থ আনিয়া অনর্থক বিলাস-বিভ্রাটে সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করিবার অবসর পাইতেন না। পরবর্ত্তী যুগে যখন বঙ্গের চক্ষু যশোরে নিপতিত হইয়াছিল, তখন যশোর গৌড়ের যশঃ হরণ করিয়াছিল বলিয়া প্রমাণ আছে। ভগবানের আশীর্ব্বাদে, আমরা দ্বিতীয় খণ্ডে সে যুগের কথা বলিব।
পাদটীকা :
১. ‘The ruler of this District (Mahammadabad) at the time of its conquest by Sher khan let some of his elephants loose in its forests from which time they have abounded…The Sarkar Khalifatabad. is well- wooded and holds wild elephants’,—Ain-i-Akbari, tr. by Jarrett, 2nd ed. by J. N. Sarkar, 1949. P. 135.
২. Though general plan is Saracenic, the details are broadly Hinduistic. This Hindu influence was quite natural. They (Mahomedan Governors) had to depend almost entirely on Hindu artisans for construction and for materials they utilised the fragments of Hindu temples they had demol- ished.’-J.A.S.B. 1910. PP. 24-25. see also Havell’s Indian Architecture, PP. 2-3. 13, 21.
৩. যোগীদিগকে যুঙ্গী বা জুগী নির্দ্দেশ করিয়া উঁহাদের সম্বন্ধে যে বিরুদ্ধ মত আছে, তজ্জন্য ‘সম্বন্ধনির্ণয়’ গ্রন্থের ৬৫৬-৬৬২ পৃ দ্রষ্টব্য। এই জাতি সম্বন্ধে অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় The Yagis of Bengal, a Monograph by Radhagovinda Nath, নামক পুস্তকে প্রকাশিত হইয়াছে।
৪. আমাদের দেশে এখনও কাহারও গায়ের রং অতিরিক্ত ফরসা দেখিলে তাহাকে ‘যুগেন সুন্দর’ বলা হয়; অর্থাৎ যেন তেমন শ্বেতবর্ণ এদেশীয় লোকের প্রকৃত রঙ নহে। যোগীরা এখন হিন্দুর মত শবদেহ পুড়াইয়া থাকেন; পূর্ব্বে তাহা পুঁতিয়া রাখিতেন, উপবিষ্ট অবস্থায় পুঁতিয়া রাখা হিন্দুর চক্ষে বিসদৃশ লাগিত, তাঁহারা মনে করিতেন উহাতে যেন শবদেহ কষ্ট পায়। এখনও লোকে যুগেন পোঁতা পুঁতিবার ‘ ভয় দিয়া থাকেন।
৫. Basu. N.N., Modern Buddhism P. 16; J. A. S. B., 1895-’Buddhism in Bengal.’
৬. A. S. B. Mr. No. 3582 : Sastri, Haraprasad. Discovery of living Buddhism in Bengal P. 5.
৭. এই নবদীক্ষিত যোগীরা গুরুর কথামত শুদ্ধ ভাষায় কথা কহিতেন। উহা হইতে এদেশে একটা প্রবাদ হইয়াছে—’কালকের (কল্যকার) জুগী, ভাতকে বলে অন্ন।
৮. ‘বঙ্গদেশে চৌকি দিল রাজা যত চর।
জুগী পাইলে প্রাণ বধ্য না করিহ ডর—গোবিন্দচন্দ্রগীত, ১২৩ পৃ, আমরা পূর্ব্বে এ বিষয়ের কিছু আলোচনা করিয়াছি (এই বই-এর দ্বিতীয় অংশ : একাদশ পরিচ্ছেদ— আভিজাত্য দ্রষ্টব্য)।
৯. গাজন ধর্ম প্রচারের অঙ্গ ছিল। গোবিন্দচন্দ্রগীতে তাহার বিশেষ উল্লেখ আছে। ‘হুঙ্কার ছাড়িল জুগী জোগ করি সার’ (১২৫ পৃঃ); ‘ভস্ম কৈলা গোবিন্দচন্দ্র হুঙ্কার ছাড়িয়া।’ (১০৫ পৃ), এই হুঙ্কারের একটা অর্থ আছে। একটা সাধারণ প্রবাদ আছে যে, ‘অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’, অর্থাৎ বহুলোকের একত্র সমাগমে কাৰ্য্য সুসম্পন্ন হয় না।
১০. রমাইপণ্ডিত, ‘শূন্যপূরাণ’, সম্পা, নগেন্দ্রনাথ বসু, ১ পৃ।
১১. ‘Discovery of Living Buddhism’. P. 12
১২. যোগিগণ পৌষ সংক্রান্তিতে হিন্দু দিগের বাস্তুপূজার মত ‘ধলাই পূজা’ করিয়া থাকেন। এই ধলাই পূজা অন্য কোন জাতি করেন না। এই উপলক্ষে তাহারা কতকগুলি গান গাহিয়া থাকেন, তাহার নাম ‘হেচো’। ধলার গুণ গাহিয়া যাওয়াই উহার উদ্দেশ্য। এই ধলার গুণ গাওয়া একটা প্রবাহে পরিণত হইয়াছে।
১৩. আমরা পূর্ব্বে ইহার আলোচনা করিয়াছি, এই বই-এর দ্বিতীয় অংশ : পাঠান রাজত্ব, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ— পয়োগ্রাম কসবা দ্রষ্টব্য।
১৪. গৌড়ের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, ১৪৯ পৃ।
১৫. পদ্মপুরাণোক্ত মনসামঙ্গল লইয়া বেহুলার কথা ২২ জন কবি বর্ণনা করিয়াছেন। তন্মধ্যে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, বংশীদাস ও বিজয় গুপ্তের পুস্তক বিশেষ বিখ্যাত। ‘বাইস কবি মনসা’ নামক পুস্তকে সকলের কবিতা একত্র প্রকাশিত হইয়াছে। এই সকল পুস্তক হইতে জানিতে পারা যায়, চন্দ্রধর বা চাঁদসওদাগরের ডিঙ্গা কিরূপে সাগরদ্বীপের পথে সুন্দরবনের মধ্য দিয়া দিগঙ্গার নিকট চন্দ্রকেতু রাজার দেশে বাণিজ্য করিতে আসিত; এবং বেহুলার মান্দাসও সম্ভবতঃ এই পথে পূৰ্ব্বমুখে গিয়াছিল। নেতি ধোপানীর ঘাটে মনসা পূজার প্রথম প্রচার হয় বলিয়া উল্লেখ আছে। সাগরদ্বীপ হইতে পূৰ্ব্বমুখে যাইতে আমরা নেতি ধোপানীর নদী দেখিতে পাই। রেনেলের ম্যাপ দ্রষ্টব্য। কেহ কেহ বলেন ধুবড়ীতেই নেতি ধোপানীর ঘাট ছিল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন