সতীশচন্দ্র মিত্র
বঙ্গেশ্বর মামুদ শাহের মৃত্যুর পর (১৪৬০) তৎপুত্র বাৰ্ব্বাক শাহ কয়েক বৎসর রাজত্ব করেন। তিনিই প্রথম আবিসিনীয় বা হাস্ত্রী দাস ও খোজাদিগকে রাজকার্য্যে নিযুক্ত করেন। হাসীদিগের দ্বারা একদল উৎকৃষ্ট অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য গঠিত হইয়াছিল। ইহারা নগররক্ষী ও শরীররক্ষী রূপে প্রবল পরাক্রান্ত হইয়াছিল। সুযোগ পাইয়া দলে দলে হাসীগণ গৌড়ে প্রবেশ করিতে লাগিল এবং নগরে বিষম অশান্তির সৃষ্টি হইল।[১] বাব্বাকের বংশধরেরা ১৪৮৭ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত কোন প্রকারে শাসনকার্য সম্পন্ন করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু আর পারিলেন না। হাসী খোজাগণ অন্দরে প্রবেশ লাভ করিয়া স্বেচ্ছামত প্রভুহত্যা করত যাহাকে ইচ্ছা রাজতক্তে বসাইতে লাগিল। ইহাদের অত্যাচার অনবরত গুপ্তহত্যা চলিল। অবশেষে তাহারা রাজবংশ নিপাত করিয়া আপনাদের একজনকে রাজসিংহাসনে বসাইল; তখন দেশময় এক ভীষণ অরাজকতা উপস্থিত হইল। ১৪৯৩ খ্রীষ্টাব্দে হুসেন শাহ্ এই অরাজকতা হইতে দেশের উদ্ধার সাধন করেন।
হুসেন শাহের ত্রিংশবর্ষব্যাপী রাজত্বকাল বঙ্গেতিহাসের একটি স্মরণীয় যুগ। দেশে শান্তি, প্রজার সমৃদ্ধিবৃদ্ধি এবং সাহিত্য ও ধর্ম্মের উন্নতি— ইহাই এ যুগের প্রকৃতি। দুঃখকষ্টের মধ্যে কোন সুখশান্তিময় যুগের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইলে, যশোর-খুলনার লোকে সাধারণতঃ বলিয়া থাকেন, ‘সে হুসেন শাহের আমল আর নাই।’ মরুভূমির মধ্যে ওয়েসিসের মত পাঠানযুগে হুসেন শাহের রাজত্ব। শ্রীচৈতন্যের জন্ম ও ধর্মপ্রচারে এই যুগে বঙ্গ পবিত্র হইয়াছিল। আর সে পবিত্র ধর্ম্মের উৎসাহদাতা হইয়া হুসেন শাহ বিখ্যাত হইয়া রহিয়াছেন। তাই জনৈক বৈষ্ণব কবি গাহিয়াছেন :
‘শ্রীযুক্ত হসন, জগতভূষণ, সেহ এ রস জান।
পঞ্চ গৌড়েশ্বর, ভোগপুরন্দর, ভণে যশোরাজ খান॥’
এই হুসেন শাহ কে? তিনি পূর্ব্বোক্ত মামুদ শাহের বংশধর নহেন, তাহা জানি। হাবসীবংশীয় মুজঃফর শাহ যখন গৌড়ের রাজা, তখন হুসেন রাজসরকারে উজীর ছিলেন। মুজঃফরের ঘোর অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হয়, হুসেন ছিলেন তাহার নেতা। কিন্তু সহজে মুজঃফর দমিত হন নাই। চারিমাসকাল অজস্র রণরঙ্গ ও নরহত্যা চলিয়াছিল, তৎপরে তিনি পরাজিত ও নিহত হইলে সকলে মিলিয়া হুসেনকে রাজা করিল;[২] তখন তাঁহার নাম হইল, সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ। এই সৰ্ব্বজনপ্রিয় তীক্ষ্ণবুদ্ধি রণকুশল উজীর কে? তাঁহার প্রথম জীবনের ইতিহাস অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। আমরা সেই অন্ধকারের মধ্যে দুই একটি আলোকপাত করিতে পারি; এবং তাহারই ফলে দেখা যাইবে, গৌড়েশ্বর হুসেনের সহিত যশোহর-খুলনার ইতিহাসের কিছু সম্বন্ধ আছে।
রিয়াজ-উস্-সালাতিন হইতে আমরা জানিতে পারি হুসেন শাহ তুর্কিস্থানের অন্তর্গত তরমুজ সহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম সৈয়দ আাফল হুসেনী।[৩] তিনি মুসলমান ধর্মপ্রবর্তক মহম্মদের বংশীয় এবং হুসেনী শাখার অন্তর্গত। আস্ত্রাফল বা তাঁহার কোন পূর্ব্বপুরুষ মক্কানগরের সরিফ বা নগরপাল ছিলেন, এজন্য হুসেন শাহকে সরিফ-ই-মেকী (মক্কী) বলিত। ঘটনাক্রমে আলাউদ্দীন ও তাঁহার ভ্রাতা ইউসফ্ পিতার সহিত বঙ্গদেশে আসেন। প্রবাদ আছে, যখন তাঁহারা বঙ্গে আসেন, তখন তাঁহাদের অবস্থা বড় শোচনীয় ছিল এবং হুসেনের বয়সও খুব কম। কেহ বড়লোক হইলে, তাহার শৈশব-জীবনের অনেক অদ্ভুত কাহিনী শুনা যায়। হুসেন অতি সামান্য অবস্থা হইতে এত বড়লোক হইয়াছিলেন যে, তাঁহার শৈশবের কথা শেষে একপ্রকার লুপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। সম্ভবতঃ বঙ্গে আসিবার পর কোন আকস্মিক বিপদে হুসেনের পিতার মৃত্যু হয় এবং বালকেরা নিঃসহায় অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় লয়। জনশ্রুতি আছে, হুসেন এক ব্রাহ্মণের বাড়ীতে রাখালী করিতেন।[৪] এই ব্রাহ্মণের কি নাম ছিল, তাহা আমরা জানিতে পারি নাই। তবে তাঁহার পুত্রের নাম শান্তিধর, হুসেন শাহ বঙ্গেশ্বর হইলে শান্তিধর তাঁহার নিকট রাম খাঁ উপাধি পান। তাই শান্তিধর সাধারণতঃ রামচন্দ্র খাঁ নামে পরিচিত। তিনি শেষে হুসেনের কৃপায় ধনশালী হইয়া যশোহর জেলার অন্তর্গত বেণাপোলের সন্নিকটে কাগজপুকুরিয়ায় রাজার মত বাটী নিৰ্ম্মাণ করিয়া প্রবল জমিদারের মত বাস করিতেন। বেণাপোল রেলওয়ে ষ্টেশনের অনতিদূরে রামচন্দ্র খাঁর বাটীর বিস্তীর্ণ ভগ্নাবশেষ বর্তমান রহিয়াছে। আমরা পরে তাঁহার কথা বলিব।
এদেশে কতকগুলি মামুলী গল্প আছে। হঠাৎ যদি কেহ নীচ অবস্থা হইতে বড়লোক হন, তবে তাঁহার শৈশবকালে দেখা যায়, তিনি কোথায়ও নিদ্রিত হইলে সর্পে আসিয়া তাঁহার মস্তকের উপর ফণা বিস্তার করিয়া ছায়া দান করে। বামানী রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন গঙ্গু হইতে আরম্ভ করিয়া কত শত শত ক্ষুদ্র ও বৃহৎ নৃপতিদিগের বাল্যেতিহাসে এই চিরাগত গল্প একই ভাবে আরোপিত হইয়াছে। হুসেনের আশ্রয়দাতা একদা দেখিলেন, তাঁহার গো-রাখাল প্রান্তরে এক বৃক্ষতলে নিদ্রিত রহিয়াছে, তাহার মস্তকের উপরে দুইটি সর্পে ফণা বিস্তার করিয়া ছায়া করিয়া রহিয়াছে; তদবধি তিনি বুঝিলেন বালকের ভবিষ্যৎ সমুজ্জ্বল, এজন্য তিনি নিরাশ্রয় বালককে স্নেহের চক্ষে দেখিতেন। হুসেন উত্তরকালে সে স্নেহের মূল্য কড়া-গণ্ডায় শোধ করিয়াছিলেন 1 হুসেন উক্ত ব্রাহ্মণের আশ্রয়ে থাকিতে থাকিতেই সম্ভবতঃ খাঁ জাহান আলি তাঁহার উচ্চবংশের পরিচয় অবগত হন এবং তাঁহাকে খালিফাতাবাদে লইয়া যান।
পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, খাঁ জাহানের সময়ে অনেক উচ্চবংশীয় সৈয়দ প্রভৃতি মুসলমানগণ তাঁহার সহিত বঙ্গে আসেন। উহাদের কতক প্রথমতঃ পয়োগ্রামে বাস করেন; খাঁ জাহান খালিফাতাবাদে গেলে কেহ কেহ তাঁহার সঙ্গে তথায় গিয়াছিলেন। উহাদের মধ্যে কয়েক ঘর খুলনা জেলার আলাইপুরের সন্নিকটে চাঁদপুরে বাস করেন। তাঁহারা কেহ কেহ খাঁ জাহানের শাসনাধীনে, কেহ বা গৌড়ের রাজসরকারে বিচারকের কার্য্য করিতেন। এজন্য তাঁহাদিগের ‘কাজি’ উপাধি হইয়াছিল। এক্ষণে এই বংশীয়েরা ‘আলাইপুরের কাজি’ বলিয়া খ্যাত। খাঁ জাহানের শেষ জীবনে বা তাঁহার মৃত্যুর পর ইঁহারা গৌড়ে গিয়া প্রতিপত্তির সহিত কাজির কাজ করিতেন। চাঁদপুরের কাজিগণ বিদ্যাচর্চ্চার জন্য সমধিক বিখ্যাত ছিলেন। অধ্যাপকের টোলের মত তাঁহাদের বাড়ীতে বহু ছাত্র থাকিয়া শিক্ষা লাভ করিত। খাঁ জাহান হুসেনের শিক্ষাবিধানের জন্য তাঁহাকে চাঁদপুরে কাজিদিগের বাড়ীতে রাখিয়া দেন। অল্পদিন মধ্যেই হুসেন বিদ্যাশিক্ষায় বিশেষ উন্নতি লাভ করেন। তাঁহার সুন্দর মূর্ত্তি, তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং অবশেষে তাঁহার উচ্চবংশীয়তার পরিচয় পাইয়া কাজিদিগের মধ্যে একজন তাঁহার সহিত কন্যার বিবাহ দেন।[৫]
চাঁদপুরের অবস্থান লইয়া অনেক তর্ক আছে। ব্লকমান সাহেব অনেক অনুসন্ধানের পর স্থির করিয়াছেন যে, খুলনার পূর্ব্বদিকে ভৈরবর্তীরে আলাইপুরের সন্নিকটেই চাঁদপুর অবস্থিত। আলাউদ্দীন হুসেনের নামানুসারে আলাইপুরের নাম হইয়াছে। প্রাচীন ম্যাপে আলাইপুরের নাম থাকুক বা না থাকুক, তৎসন্নিকটে চাঁদপুর বা চাঁদেরবাজারের নাম আছে। আলাইপুর হইতে একমাইল পূৰ্ব্বদিকে গেলেই চাঁদেরবাজার, উহার অপর পারে অর্থাৎ ভৈরবের উত্তরপারে চাঁদপুর নামক গ্রাম। উহার একাংশে এখনও ‘কাজিডাঙ্গা’ নামক স্থান আছে। যেখানে ২/১টি পুকুর এবং ভগ্ন মজিদাদির ইষ্টকস্তূপ আছে; কিন্তু, এক্ষণে তথায় কোন মুসলমানের বাস নাই। ঐ স্থানে এক্ষণে কয়েক ঘর মুচি বাস করিতেছেন। কাজিডাঙ্গা এক্ষণে ঘাটভোগের চট্টোপাধ্যায় মহাশয়গণের সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত। কাজিডাঙ্গার প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে চাঁদপুরের মুসলমানগণের মধ্যে অনেক প্রবাদ প্রচলিত আছে। কাজিডাঙ্গায় কয়েক ঘর মাত্র লোকের বাস ছিল; উহার উত্তর ও পশ্চিমদিকে বিল এবং অন্য দুইদিকে গড়খাই ছিল। এখনও তাহার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। গড়ের বাহির হইতে একটি প্রশস্ত রাস্তা প্রান্তর ও গ্রাম পার হইয়া ভৈরবের কূল পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যদিও ঐ রাস্তার অনেক স্থান নিকটবর্ত্তী লোকে আত্মসাৎ করিয়াছে, তবুও একটু যত্ন করিয়া দেখিলে সোজা প্রশস্ত রাস্তাটি বাহির করা যায়। এত প্রশস্ত পথ সাধারণ কোন গ্রামে নাই। প্রবাদ আছে, হুসেন শাহ গৌড়েশ্বর হইবার পরেও অনেকবার চাঁদপুর আসিয়াছিলেন, তখন তাঁহার রাজতরণী আসিয়া উক্ত রাস্তার মাথায় ভৈরবের ঘাটে লাগিত; তাম্রকূট-সেবননিরত গল্পরসিক বৃদ্ধ অঙ্গুলি-সঙ্কেতে সেস্থান প্রদর্শন করিয়া থাকেন। কিন্তু গল্প বলিয়াই ইহা উড়াইয়া দেওয়া চলে না। সাধারণ লোকের মধ্যে বহু পুরুষ ধরিয়া যে গল্প চলিয়া আসিতেছে, তাহার অতিরঞ্জনের অন্তরালে একটা কিছু সত্য কথা নিহিত থাকে। এই গল্পের সহিত অন্যান্য ঘটনার সামঞ্জস্য সাধিত হইলে, সজীব তথ্য স্বচ্ছন্দে ঐতিহাসিক উপাদানরূপে গৃহীত হইতে পারে।
কাজিডাঙ্গায় এক্ষণে কাজিদিগের বসতি নাই বটে, কিন্তু তথাকার কাজিগণ খুলনা সহর বা তন্নিকটবর্ত্তী স্থানে বাস করিতেছেন এবং এখনও তাঁহারা এতদঞ্চলে সৰ্ব্বাপেক্ষা সম্মানিত বংশ বলিয়া বিশেষিত হইয়া থাকেন। হুসেন শাহের সহিত সম্বন্ধসূত্র তাঁহাদের গৌরব বর্দ্ধিত করিয়াছিল। হুসেন শাহ, তাঁহার ভ্রাতা ইয়ুসফ, পুত্রদ্বয় নসরৎশাহ ও মামুদশাহ, এই চারিজনের নামে যশোহর-খুলনার প্রধান চারিটি পরগণার নাম হইয়াছে। খালিফাতাবাদ অঞ্চলে যে হুসনে শাহের সম্বন্ধ ছিল, তাহার আরও প্রমাণ আছে। খাঁ জাহানের সহরে হুসেন শাহের প্রকাণ্ড মজিদ ও দীঘি আছে। বর্তমান বাগেরহাট সহর হইতে পশ্চিমমুখে দুই মাইল গেলে ডানদিকে যে সুন্দর দশগুম্বজ মসজিদ আছে, উহাই হুসেন শাহের মসজিদ। উহার ভিতরের মাপ ৬১×২৪ ফুট; প্রতি গুম্বুজের তলদেশের মাপ ১২×১২ ফুট; এক এক সারিতে ৫টি করিয়া গুম্বজ। প্রাচীরের ভিত্তি ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি। মসজিদের সন্নিকটে প্রকাণ্ড দীঘি। স্থাপত্য বিষয়ে এই মসজিদ খাঁ জাহানের অন্য কোন মসজিদ অপেক্ষা ভিন্ন নহে; একই উপাদানে একই প্রকার স্থপতির হাতে গড়া। সম্ভবতঃ ইহা খাঁ জাহানের মৃত্যুর প্রাক্কালে বা অব্যবহিত পরে নির্ম্মিত হইয়াছিল। হুসেন শাহ গৌড়েশ্বর হইলে তাঁহার প্রভুত্ব প্রথমে তাঁহার এই পূর্ব্বপরিচিত প্রদেশেই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল; কারণ, দেখা গিয়াছে যে, তাঁহার প্রথম মুদ্রা ফতেহাবাদ বা ফরিদপুরের টাঁকশালেই মুদ্রিত হয়।[৭] হুসেনের রাজত্বকালে তাঁহার জীবদ্দশাতেই তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র নসরৎ শাহ খালিফাতাবাদের টাঁকশাল হইতে স্বীয় নামে মুদ্রাঙ্কিত করিয়াছিলেন। কেহ বলেন নসরৎ শাহ পিতার জীবদ্দশায় বিদ্রোহী হইয়া কিছুকাল খালিফাতাবাদে বাস করেন, তখনই স্বনামে মুদ্রাঙ্কিত করিয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু তাহা বিশ্বাস হয় না; সম্ভবতঃ বৃদ্ধ বয়সে হুসেন শাহ পুত্রকে পূর্ব্বাঞ্চল শাসন করিবার এবং নিজ নামে মুদ্রাঙ্কনের ভার দিয়াছিলেন। বঙ্গীয় স্বাধীন সুলতানগণের-রাজত্বকালে বঙ্গদেশে যে একুশটি স্থানে টাকশাল ছিল বলিয়া জানা যায়, খালিফাতাবাদ তাহার অন্যতম। খালিফাতাবাদের তিন প্রকার রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। উহার দুইটি নসরৎ শাহের নামাঙ্কিত এবং তৃতীয়টি তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ও পরবর্ত্তী সুলতান, আবুল মুজঃফর মামুদশাহের (তৃতীয় মামুদশাহ) নামাঙ্কিত। প্রথম দুইটির তারিখ ৯২২ হিজরী বা ১৫১৬-৭ খৃষ্টাব্দ এবং তৃতীয়টির তারিখ ৯৪২ হিজরী বা ১৫৩৫-৬ খৃষ্টাব্দ। প্রথমটির ওজন ১৫৪ গ্রেণ এবং আকার এক ইঞ্চি অপেক্ষা কিছু কম অর্থাৎ ৯/১০ ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট; দ্বিতীয়টির ওজন ১৬৩১/২ গ্রেণ ও ব্যাস ১ ইঞ্চির কিছু অধিক; তৃতীয়টির ওজন ১৬৮ গ্রেণ এবং ব্যাস ১ ইঞ্চির কিছু কম। এই তিন প্রকার মুদ্রাই কলিকাতার যাদুঘরে রক্ষিত হইয়াছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকার মুদ্রায় পারস্যভাষায় যাহা লিখিত আছে, তাহার বঙ্গানুবাদ এই :
প্রথম পৃষ্ঠ—‘রাজা, রাজতনয়, পৃথিবীর মধ্যে বিশ্বাসবান্
এবং ধর্ম্মভীরু আবুল, মুজঃফর,’—
অপর পৃষ্ঠ—‘নসরৎ শাহ, রাজা, হোসেনীবংশীয় রাজা
হুসেন শাহের পুত্র। জগদীশ্বর তাঁহাকে এবং তাঁহার
রাজ্য রক্ষা করুন। খালিফাতাবাদ, ৯২২।’
তৃতীয় প্রকার মুদ্রায়ও ঐরূপ আছে :
প্রথম পৃষ্ঠ—‘রাজা, রাজতনয়, পৃথিবীর মধ্যে বিশ্বাসবান্
ও ধর্ম্মভক্ত আবুল মুজঃফর মামুদ, খালিফাতাবাদ, ৯৪২’–
অপর পৃষ্ঠ—‘শাহ রাজা, সুলতান হুসেন শাহের পুত্র,
জগদীশ্বর তাঁহাকে, তাঁহার রাজ্য ও রাজত্ব রক্ষা করুন।’
এই মুদ্রা হইতে জানা যায় যে, খালিফাতাবাদ অঞ্চলের সহিত হুসেন ও তদ্বংশীয়দিগের কিছু ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। আবার মাতুলালয়ের মত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কাহারও সহিত হয় না। নসরৎ শাহ পিতার মৃত্যুর পূর্ব্বে কেন সমস্ত দেশ ছাড়িয়া এ প্রদেশে আসিয়া থাকিতেন, তাহাও ইহা হইতে অনুমান করা যায়। স্থানীয় লোকে চাঁদপুরের সন্নিকটবর্ত্তী আলাইপুর, খোজাডাঙ্গা, সামন্তসোণা, কাজিদিয়া, হোসেনপুর, ইউসফপুর প্রভৃতি গ্রামের সহিত হুসেনের সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া থাকে।[১০] তাঁহার সৈন্যেরা যেখানে শিবিরবদ্ধ ছিল, তাহাই কাজিদিয়া; কাজিদিয়া শব্দের ঐরূপ অর্থও আছে।[১১] হুসেনের কোন আত্মীয়ের বাড়ী ছিল বলিয়া একটি গ্রামের নাম হোসেনপুর হয়।
পূর্ব্বোক্ত সমস্ত কথাগুলি একত্র পর্যালোচনা করিলে হুসেন শাহের সহিত চাঁদপুরের ইতিহাস বিজড়িত রহিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ থাকে না। চাঁদপুর হইতে হুসেন পরে গৌড়ের রাজসরকারে প্রবেশ করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি হঠাৎ যে উজীর হইয়া বসিয়াছিলেন তাহা নহে। তাঁহার সম্বন্ধে আর একটি গল্প প্রচলিত আছে। মুর্শিদাবাদ জেলায় জঙ্গী সবডিভিসনের মধ্যে ‘একআনা- চাঁদপাড়া’ নামে একটি গ্রাম আছে। এইস্থানে সুবুদ্ধি রায় নামক একজন সমৃদ্ধ জমিদার বাস করিতেন। কথিত আছে, নবাব সরকারে প্রবেশ লাভের পূর্ব্বে হুসেন এই সুবুদ্ধি রায়ের বাড়ীতে কর্ম্মচারী ছিলেন। একদা সুবুদ্ধি একটি দীঘি খনন করিতেছিলেন, উহার তত্ত্বাবধানকৰ্ম্মে তিনি যুবক হুসেনকে নিযুক্ত করেন এবং পরে কোন দোষ পাইয়া তাঁহাকে চাবুক মারিয়াছিলেন।[১২] হুসেন গৌড়েশ্বর হওয়ার পরে, পূর্ব্ব প্রভু সুবুদ্ধি রায়কে চাঁদপাড়া গ্রাম দান করিয়াছিলেন; মুসলমানের দান লইতে সুবুদ্ধি রায় অস্বীকৃত হইলে, হুসেনই উহার এক আনা মাত্র কর ধার্য্য করিয়া দেন। তদবধি ঐ গ্রামের নাম হইয়াছে, একআনা-চাঁদপাড়া। হুসেন তাঁহার পৃষ্ঠদেশে চাবুকের কথা গুপ্ত রাখিয়াছিলেন। তিনি রাজা হইলে কোন সময়ে তাঁহার স্ত্রী তাহা দেখিতে পান। তখন স্ত্রীর প্ররোচনায় হুসেন সুবুদ্ধি রায়কে জাতিচ্যুত করিয়াছিলেন। হুসেন চাঁদপুরে কাজির কন্যা বিবাহ করেন এবং পরে চাঁদপাড়ায় সুবুদ্ধি রায়ের চাকরী করেন। কেহ কেহ ইহা হইতে চাঁদপুর ও চাঁদপাড়া অভিন্ন গ্রাম বলিয়া স্থির করিয়াছেন; এজন্য কাজির কন্যার নিকট চাবুকের ব্যাপারটা অনেকদিন পরে জানিতে পারা একটা অস্বাভাবিক ঘটনা হইয়াছে। বাস্তবিক চাঁদপুর ও চাঁদপাড়া এক গ্রাম নহে। চাঁদপুর খুলনা জেলায় এবং চাঁদপাড়া মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত। হয়ত চাঁদপাড়া গ্রামে চাঁদপুরের কাজিদিগের কোন পরিচয়সূত্রে হুসেন তথায় যাইতে পারেন। তাহা হইতে তিনি গৌড়ে উপস্থিত হন। সৈয়দ বংশীয়দিগের রাজত্বকালেই তিনি রাজসরকারে প্রবেশ করেন। ভাগ্য ও প্রতিভার পথ সৰ্ব্বত্রই উন্মুক্ত থাকে। তাই গোপালননিরত নগণ্য বালক স্বীয় প্রতিভাবলে একদিন গৌড়ের রাজতক্তে উপবিষ্ট হইয়া বিশালবিস্তীর্ণ রাজ্য রামরাজ্যের মত শাসন করিয়াছিলেন। সে রাজ্য শুধু বঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল না, উহা বিহার, উড়িষ্যা, আসাম ও আরাকাণ পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল— সৰ্ব্বত্রই প্রজারা তাঁহার দুর্দ্ধর্ষ পরাক্রম, উদার শাসনপ্রণালী এবং উচ্চ হৃদয়ের পরিচয় পাইত। এই বিখ্যাত নরপতির বাল্যলীলা-ভূমিরূপে খুলনার কিছু গৌরব করিবার আছে। উহাই আমরা এখানে আলোচনা করিয়াছি, নতুবা তাঁহার রাজত্বের বিস্তৃত বিবরণী প্রদান করা এখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।
পাদটীকা :
১. “Through caprice of fortune these low foot soldiers for a considerable time played an important part in the state’—Ain-i-Akbari, ed. by jarrett. Vol. II. P. 149. ‘ফেরিয়া ডি সোসা’র ইতিহাসে এ যুগের জ্বলন্ত বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে।— গৌড়ের ইতিহাস, ১০০ পৃ দ্রষ্টব্য। [ফিরিশ্তার বর্ণনায় আছে, বাব্বাকের ৮০০০ হাসী দাস ছিল।—শি মি
২. ‘During the period of his vizarat he used to treat the people with affability. The nobles looked upon him as their friend, patron and sympathiser; when Mujaffar was slain. people selected Syed Sheriff Maki to be their king.’-Riyaz-us-salatin.
৩. গৌড়ের কদম রসুল মজিদে ৯৩৭ হিজরী বা ১৫৩০ খৃষ্টাব্দের যে লিপি পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে হুসেনের পিতার নাম আছে।—J. A. S. B., 1802. P. 338.
৪. কেহ কেহ এই ব্রাহ্মণের নাম চাঁদ ঠাকুর ও তাঁহার বাড়ী মুর্শিদাবাদের অন্তর্গত চাঁদপাড়ায় ছিল বলিয়া গল্প শুনিয়াছেন।—গৌড়ের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, ১২২ পৃ।
৫. ‘The cazy of Chandpore. having been informed of his illustrious descent, gave him his daughter.’- Stewart’s History of Bengal. P. 126.
৬. J. A. S. B. 1873. P. 228 note : ‘Professor Blochmann is inclined to identify the Chandpore in ques tion near Alaipur or Alauddin’s town on the Bhairab, east of Khulna in the Jessore District, as the place where the Hossain Dynasty of Bengal independent kings had its adopted home.’-Riyaz-us- Salatin, ed. by A. Salam. P. 48 note.
৭. ‘Hussein first obtained power in the adjacent district of Faridpur of Fathahabad, where his first coin was struck in 899 A. H.’-Riyaz-us-Salatin P. 129 (note).
৮. স্বাধীন সুলতানগণের রাজত্বকালে বঙ্গের নিম্নলিখিত ২১টি স্থানে টাঁকশাল ছিল; লক্ষ্মৌতি (গৌড়), ফিরোজাবাদ (পাণ্ডুয়া), সাতগাঁও (সপ্তগ্রাম), সোণার গাঁও, মুয়াজ্জামাবাদ (সম্ভবতঃ ময়মনসিংহ), সহরিনো (গঙ্গার তীরে), গিয়াসপুর (গৌড়ের সন্নিকটে) ফতেহাবাদ (ফরিদপুর), হুসেনাবাদ, খালিফাতাবাদ (বাগেরহাট), মুজঃফরাবাদ (পাণ্ডুয়ার সন্নিকটে), চট্টগ্রাম, মহম্মদাবাদ (২টি), আরাকাণ, তাণ্ডা, রোটাসপুর, জিন্নতাবাদ (গৌড়), নসরতাবাদ, বারবকাবাদ, চালিস্তান (কামরূপের সন্নিকটে)। ইহার মধ্যে সুলতান হুসেন শাহই ৬/৭টি টাকশালে মুদ্রা প্রস্তুত করিয়াছিলেন। যশোহর-খুলনায় নানাস্থানে এখনও যথেষ্ট সংখ্যক হুসেনশাহী মুদ্রা পাওয়া যায়।
৯. Wright, H. N. ‘Catalogue of the Coins in the Indian Museum, Calcutta’. Voll. II. PP. 135-40.
১০. সামন্তসোণায় ৪০ বিঘা জমিতে হুসেনের এক গড় ছিল। বর্ত্তমান মুন্সী খয়রাতূল্যা সর্দ্দারের প্রপিতামহ সমস্ সর্দ্দার ঐ গড়ে বাস করিতেন, শুনা যায়।
১১. ‘সহিদ-ই-কারবোলা’ পুস্তক দ্রষ্টব্য।
১২. “পূর্ব্বে যবে সুবুদ্ধি রায় ছিলা গৌড় অধিকারী।
সৈয়দ হুসেন খাঁ করে তাহার চাকরী।।
দীঘি খোদাইতে তারে মনসীব কৈল।
ছিদ্র পাঞা রায় তারে চাবুক মারিল॥”-শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃত, মধ্যলীলা।
সুবুদ্ধি রায় গৌড়াধিপ ছিলেন না, ‘গৌড় অধিকারী’ পাঠ বোধহয় ঠিক নহে। রায়সাহেব দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের নিকট যে ২০৩ বৎসরের অধিককালের প্রাচীন পুঁথি আছে, তাহাতে গৌড় শব্দ নাই। ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’, ৩৮৬ পৃ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন