৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ

সতীশচন্দ্র মিত্র

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – জৈন-বৌদ্ধ যুগ

আমরা দেখিয়াছি অতি প্রাচীন যুগে বঙ্গদেশের কোন কোন অংশ তীর্থস্থানে পরিণত হইয়াছিল। ঐ সকল স্থানে, দেবমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, সাধুসন্ন্যাসীরা অন্যদেশ হইতে সে সকল স্থান দর্শন করিতে আসিতেন। উত্তরাপথ হইতে যখন ক্ষত্রিয়েরা দিগ্বিজয়ে আসিতেন, বঙ্গবাসীরা তাঁহাদের সহিত যুদ্ধ করিতেন। মহাভারতের যুদ্ধে বঙ্গাধিপতি গজসৈন্য লইয়া যুদ্ধ করিয়াছিলেন; রঘুর সময়ে বঙ্গবীরগণ নৌযুদ্ধে অসামান্য রণকৌশল প্রদর্শন করিয়াছিলেন। এ সময়ে বঙ্গদেশে সভ্যতা বিস্তৃত হইতেছিল, কিন্তু দেশ প্রকৃতভাবে আর্য্যভূমি হয় নাই। বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছেন, ‘যখন ভারতে বেদ, স্মৃতি, ইতিহাস সঙ্কলিত হইতেছিল, তখন বঙ্গদেশ ব্রাহ্মণশূন্য অনার্য্যভূমি।’[১] তাঁহার মতে খৃষ্টের ছয় শত বৎসর পূর্ব্বে বা তদ্বৎ কোন কালে এ দেশে প্রকৃতভাবে আর্য্যজাতির অধিকার বিস্তৃত হইয়াছিল। এই আর্য্যাধিকারের পূর্ব্বে পুণ্ড্র প্রভৃতি জাতিগণ সমুদ্রকূলবর্তী বঙ্গের অধিবাসী ছিলেন। এখনও সমুদ্রকূল হইতে আরম্ভ করিয়া উত্তরে পদ্মা পর্যন্ত প্রদেশে বহুসংখ্যক পুঁড়া বা পোদ জাতীয়ের বাস আছে। পুঁড়া বা পোদ পুণ্ড্রশব্দের অপভাষা। চাষী পোদগণ এক্ষণে পৌণ্ড্র-ক্ষত্রিয় বলিয়া আত্মপরিচয় দেন। তাঁহারা পতিত ক্ষত্রিয় বলিয়া ব্রাত্য হইয়া গিয়াছেন বলিয়া বিশ্বাস হয় [দ্বিতীয় অংশ : তৃতীয় পরিচ্ছেদ, আদি হিন্দু-যুগের প্রথম পৃষ্ঠাসহ ১, ২ ও ৩ নং পাদটীকা দ্রষ্টব্য]। ইহা ব্যতীত চণ্ডাল বা চান্দালগণ বরেন্দ্র হইতে আসিয়া উপবঙ্গের নানা স্থানে বসতি করিয়াছেন। তাঁহারা এক্ষণে নমঃশূদ্র বলিয়া আত্মপরিচয় দেন। যশোহর-খুলনায় বহুসংখ্যক নমঃশূদ্রের বাস। বাছাড় নামক ইঁহাদের এক থাক আছে। খুলনার দক্ষিণাংশে বাছাড়েরা ধনধান্যে বিশেষ সঙ্গতিসম্পন্ন। ইঁহারে ব্যবহাৰ্য্য দক্ষিণদেশীয় এক প্রকার শক্ত নাতিদীর্ঘ নৌকাকে বাছাড়ী নৌকা বলে। খুলনায় সৰ্ব্বদা জিনিসপত্র বহন করিবার জন্য এই বাছাড়ী নৌকার চলন আছে। যশোহর জেলায় পুঁড়া বা খুলনার দক্ষিণাংশে পোদ, চণ্ডাল, বাগ্‌দি প্রভৃতি বহুজাতি বাস করেন। ইঁহারাই এ মণ্ডলের আদিম অধিবাসী [দ্বিতীয় অংশ : দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, দ্বীপের প্রকৃতির ৩নং পাদটীকা দ্রষ্টব্য]। ইঁহারা লবণাক্ত জলাভূমিতে স্বাস্থ্য রক্ষা করিয়া বাস করিতে সক্ষম।

খৃঃ পূঃ ষষ্ঠ শতাব্দীতে যৌধেয় এবং যাদব জাতি বঙ্গাধিকার করে। সম্ভবতঃ বঙ্গে আসিয়া রাষ্ট্রকূট জাতি যে অংশে বাস করে, তাহারই নাম হয় রাঢ় বা লাঢ়। প্রাচীন জৈন গ্রন্থে ইহার উল্লেখ আছে।[২] মৌর্য্য চন্দ্রগুপ্তের সময়ে গ্ৰীকদূত মেগাস্থিনিস্ তাঁহার রাজসভায় ছিলেন। তিনি স্বকীয় বিবরণীতে গঙ্গারিডি রাজ্যের উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। সম্ভবতঃ এই গঙ্গারিডি গঙ্গারাষ্ট্র বা গঙ্গারাঢ়ী শব্দের বিকৃতি মাত্র। মেগাস্থিনিস্ বলিয়াছেন, ‘গঙ্গারাঢ়ীদিগের হস্তিসৈন্যের ভয়ে অন্য রাজগণ তাহাদিগকে আক্রমণ করিতেন না।’ তিনি ইহাও লিখিয়াছেন যে, ‘স্বয়ং সৰ্ব্বজয়ী আলেকজেণ্ডার গঙ্গাতীরে উপনীত হইয়া গঙ্গারাঢ়ীদিগের প্রতাপ শুনিয়া সেইখান হইতে প্রস্থান করেন।[৩] সত্য মিথ্যা জানি না, তবে গঙ্গারিডি যে একটি বিস্তৃত রাজ্য ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই; বঙ্গদেশ ইহার অন্তর্গত ছিল।[৪] সুতরাং উপবঙ্গ বা যশোহর-খুলনা এই গাঙ্গরাষ্ট্র বা গঙ্গারিডিদেশেরই অংশ মাত্র। প্লিনি বলিয়া গিয়াছেন যে, গঙ্গাসঙ্গমের পার্শ্বে একটি দ্বীপে মোদ্গালিঙ্গী জাতি বাস করিতেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে বুড়ন, বালা, সন্দ্বীপ প্রভৃতি পূর্ব্ববঙ্গের কতকাংশ লইয়া এই দ্বীপ গঠিত এবং মোদ্গলিঙ্গী শব্দ মোলঙ্গী শব্দের নামান্তর।[৫] এই লবণাক্ত সমুদ্রবেষ্টিত দেশ হইতে পূৰ্ব্বকালে যথেষ্ট পরিমাণ লবণ উৎপন্ন হইত। ঐ লবণ প্রস্তুত করিবার জন্য যে একপ্রকার ভাণ্ড ব্যবহৃত হইত, তাহাকে মোলঙ্গা এবং যাঁহারা লবণ প্রস্তুত করিতেন তাঁহাদিগকে মোলঙ্গী বলিত। এখন চব্বিশ-পরগণা ও খুলনা জেলার দক্ষিণাংশে বহুসংখ্যক মোলঙ্গীর বাস আছে, কিন্তু তাঁহারা এক্ষণে লবণ প্রস্তুত করিবার অধিকারে বঞ্চিত।

পূর্ব্বোক্ত গঙ্গারিডি রাজ্যের একটি প্রধান নগর ছিল— গঙ্গে বা গঙ্গারেজিয়া। ইহা সমগ্র ভারতের মধ্যে একটি প্রধান বাণিজ্য বন্দর ছিল। খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে গ্রীক ভাষায় লিখিত পেরিপ্লাসেও গঙ্গেবন্দর হইতে প্রবাল, উৎকৃষ্ট মসলিন প্রভৃতি দ্রব্য বিদেশে যাইত বলিয়া উল্লিখিত আছে।[৬] আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি কলিকাতার দক্ষিণে সমুদ্র পর্য্যন্ত বিস্তৃত সমগ্র ভূভাগ প্রবাল দ্বীপ নামে পরিচিত।[৭] গঙ্গে বা গঙ্গারেজিয়া এই প্রবাল দ্বীপের অন্তর্গত বলিয়া মনে করি। পরেশনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এই গঙ্গারেজিয়া যশোহর জেলার অন্তর্গত বলিয়া অনুমান করিয়াছেন।[৮] আমাদের মনে হয় ইহা বর্তমান যশোহর জেলার অন্তর্গত নহে, প্রাচীন যশোর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বর্তমান চব্বিশ-পরগণার মধ্যবর্তী বারাশত হইতে হাসনাবাদ যাইবার রেলপথের পার্শ্বে দ্বিগঙ্গা নামক একটি স্থান আছে। ইহাকে কেহ দেগঙ্গা, কেহ দ্বিগঙ্গা বলে। সে দ্বিগঙ্গার কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি। সম্ভবতঃ উহা দেবগঙ্গা, দ্বীপগঙ্গা বা দীর্ঘগঙ্গা এইরূপ কোন শব্দের অপভ্রংশ। প্রকাণ্ড দীঘি এবং বহুদূর বিস্তৃত ভগ্নস্তূপমালা এখনও এস্থানের প্রাচীনত্বের পরিচয় দিতেছে। ইহারই নিকটে দেউলিয়ায় চন্দ্রকেতু প্রভৃতি প্রাচীন রাজার কীর্ত্তিস্থান। ইহারই দক্ষিণে প্রাচীন বালবল্লভী রাজ্যের রাজধানী বালাণ্ডা অবস্থিত। মুসলমান ধর্ম্ম-প্রচারকগণ এই বিখ্যাত প্রাচীন স্থানে আসিয়া হিন্দুর উপর বহু অত্যাচার করিয়াছিলেন। নিকটবর্ত্তী হাড়োয়াতে সেই অত্যাচারী প্রচারকগণের অন্যতম গোরাই গাজীর সমাধি আছে। দ্বিগঙ্গা বীরধর্মী সেনবংশীয় কায়স্থগণের প্রথম নিবাস ছিল। ইহারা দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ; দ্বিগঙ্গা দক্ষিণরাঢ়ের অন্তর্গত ছিল। এই দীর্ঘ গঙ্গা বা দ্বিগঙ্গা ভাগীরথী তীরে ছিল বলিয়া ‘বাসুকী কুলগাথায়’ উল্লিখিত আছে।[৯] ইহা প্রকৃত পক্ষে ভাগীরথীর কূলবর্তী নহে বটে, কিন্তু ইহার ভিতর দিয়া যমুনার পদ্মা নাম্নী এক শাখা প্রবাহিত ছিল। প্রাচীনকালে পদ্মা বা গঙ্গার নামের প্রভেদ লক্ষিত হইত না। মধুমতী নদীরও অপর নাম বড় গঙ্গা।[১০] উক্ত সেনবংশীয়গণ এক সময়ে প্রবল শক্তিশালী ছিলেন। সুন্দরবনের উত্থান পতনে দ্বিগঙ্গা বাসের অযোগ্য হইয়া উঠিলে, তাঁহারা পূর্ব্ববঙ্গে গিয়া বরিশাল ও খুলনা জেলায় রায়েরহাটি, বনগ্রাম প্রভৃতি স্থানে রাজ্য স্থাপন করেন। এখনও তাঁহারা ‘দ্বিগঙ্গার সেন’ বলিয়া বিশেষ সম্মানিত। এই দ্বিগঙ্গাই ছিল, ‘গঙ্গারেজিয়া’ বা গঙ্গাবন্দর—ইহাই আমাদের বিশ্বাস।[১১] প্রাচীন যশোহরের কতস্থান যে দেশে বিদেশে আত্মগৌরব প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল, তাহার শেষ নাই।[১২]

বুদ্ধদেবের সমসময়ে গাঙ্গরাঢ় হইতে বিজয়সিংহ তাম্রপর্ণী দ্বীপে গিয়া সিংহল রাজ্য সংস্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা পূৰ্ব্বে উক্ত হইয়াছে। সিংহল পুরুষানুক্রমে এই সিংহদিগের অধিকৃত ছিল। ‘মহাবংশ’ নামক সিংহলদেশীয় ঐতিহাসিক গ্রন্থে এই উপনিবেশ স্থাপনের বর্ণনা আছে। বাস্তবিকই ‘ভারতবর্ষীয় আর কোন জাতি বাঙ্গালীর মত ঔপনিবেশিকতা দেখাইতে পারেন নাই।’ উত্তরকালে সিংহলে যে বৌদ্ধ ধর্ম্মের একটি প্রধান কেন্দ্র হইয়াছিল, বাঙ্গালী বীর তাহার পথ দেখাইয়াছিলেন। ভগীরথের শঙ্খনিনাদের অনুবর্ত্তী হইয়া যেমন গঙ্গাস্রোত বহিয়াছিল, বঙ্গবীরের বিজয়শঙ্খনিনাদে তেমনি বৌদ্ধধর্মপ্রবাহের পথ নির্দ্দেশ করিয়াছিল। এইরূপে যাহারা ভারত-মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিল, পশ্চিমে তাম্রলিপ্তি, পূর্ব্বে চট্টগ্রাম এবং মধ্যে দ্বিগঙ্গা প্রভৃতি নগরী তাহাদের প্রধান বন্দর এবং সদর স্থান ছিল। প্রাচীন যশোর ঔপনিবেশিকতায় বঙ্গদেশের বহু স্থানের অগ্রদূত হইয়াছিল।

এইভাবে দেখা গেল, আমাদের পূর্ব্বগৌরবের অনেক আভাস এখনও পাওয়া যায়। লুপ্ত গৌরবের কোন ক্ষীণাভাস দিতে গিয়া যদি কোন গৰ্ব্বভঙ্গি প্রকাশ পায়, আমাদের বোধ হয় তাহাও মার্জ্জনীয়। বঙ্কিমচন্দ্র সত্যই বলিয়াছেন, ‘অহঙ্কার অনেক স্থলে মানুষের উপকারী। এখানেও তাই। জাতীয় গর্ব্বের কারণ লৌকিক ইতিহাসের সৃষ্টি বা উন্নতি; ইতিহাস সামাজিক বিজ্ঞানের এবং সামাজিক উচ্চাশয়ের একটি মূল।’[১৩] গঙ্গারেজিয়া যশোহরে টানিয়া লইয়া, গঙ্গারাঢ়ের সহিত যশোহরের ঘনিষ্ঠতা জ্ঞাপন করিতে গিয়া, যদি কোন দেশ-গৌরব প্রতিষ্ঠার কল্পনা করিয়া থাকি, তাহাতে বাঙ্গালীর কিছু অগৌরব হইবে না। গঙ্গারেজিয়ার মত আরও কত জিনিসই যে যশোহরের বক্ষে, খুলনার কক্ষে টানিয়া লইতে হইবে, তাহার সংখ্যা নাই। কত অনুমান, কত প্রমাণ তাহার পোষকতা করিবে। অনুমানও একপ্রকার প্রমাণ এবং তাহা অপ্ৰমাণ করিতে কাহারও বাধা নাই। উত্তেজনাই প্রমাণের পথ সুগম করে, ইতিহাসের সৃষ্টি করে। ইতিহাসই সারগর্ভ গর্ব্বের মূল; গর্বিত জাতিরই ইতিহাস আছে। আমাদের আছে কি?

খৃষ্টের জন্মের ৬/৭ বৎসর পূর্ব্ব হইতে এদেশে এক নূতন হাওয়া বহিয়াছিল। আর্য্যেরা ক্রমশঃ এদেশে আসিতেছিলেন। প্রথমে ক্ষত্রিয়, পরে বৈশ্য, সর্ব্বশেষে ব্রাহ্মণ। ক্ষত্রিয়েরা রাজ্য জয় করিয়া রাজ্য স্থাপন করিলে, বৈশ্যেরা আসিয়া পণ্য যোগাইতেন। এই ভাবে কতদিন গেল, দেশে ক্ৰিয়াকৰ্ম্ম রহিত হইল; তখন আবার ধর্মভাব জাগিল। তখন ব্রাহ্মণের আবশ্যক হইল, ব্রাহ্মণ আসিলেন। সেই ধৰ্ম্মভাব, সেই যাগযজ্ঞ ক্রিয়াকাণ্ড লইয়া ব্রাহ্মণ আসিলেন। কিন্তু ক্ষত্রিয় আর সে ক্ষত্রিয় ছিলেন না। অনাৰ্য্য স্পর্শে ক্ষত্রিয়দিগের নানাবিধ অবনতি হইতেছিল। ব্ৰাহ্মণ আসিয়া বসিতে বসিতে এক নূতন হাওয়া আসিল, বঙ্গবাসীর নবার্জ্জিত ব্রাহ্মণ্য জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম্মের প্রবল প্লাবনে ভাসিয়া গেল। সেন রাজগণের পূর্ব্বে আর তেমন ভাবে ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম্ম জাগে নাই।

এ যুগে মগধই ভারতের ঐতিহাসিক কেন্দ্র। ধর্ম্মই সে কেন্দ্রের মূল শক্তি। শুধু ধৰ্ম্মশক্তি নহে, সঙ্গে সঙ্গে রাজশক্তিও সেখানে কেন্দ্রীভূত হইল। বঙ্গ প্রভৃতি কোন প্রত্যঙ্গের কিছু মাত্র ঐতিহাসিকতা বুঝিতে গেলে, সে কেন্দ্রতত্ত্বের সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়োজন হয়। খৃঃ পূঃ অষ্টম শতাব্দীতে নেমিনাথ প্রথম জৈনধর্ম প্রচার করেন। খৃঃ পূঃ ষষ্ঠ শতাব্দীতে মগধে বিম্বিসারের রাজত্বকালে জৈন ধর্ম্মের প্রধান প্রবর্তক বর্দ্ধমান মহাবীর এবং বৌদ্ধ ধর্ম্মের প্রবর্ত্তক গৌতম বুদ্ধ প্রাদুর্ভূত হন।[১৪] উভয় ধর্ম্ম প্রথমতঃ মগধেই প্রচারিত হয়। যদিও বুদ্ধদেব সম্বোধি লাভের পর স্বয়ং মগধের সীমা অতিক্রম করিয়া পার্শ্ববর্ত্তী নানাস্থানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন বলিয়া বর্ণিত আছে, কিন্তু তখন ইহা প্রচারধর্ম্মের মত বঙ্গদেশে আসিয়াছিল কিনা বলা যায় না।

যাহাকে আমরা উপবঙ্গ বলিয়াছি, বৌদ্ধযুগে তাহারই নাম হয় সমতট। ইহা সমুদ্র হইতে পদ্মা পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ভাগীরথী হইতে পূর্ব্বমুখে সমতট কমলাঙ্ক (কুমিল্লা) ও চট্টল (চট্টগ্রাম) রাজ্য পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলিয়া জানা যায়। চীনদেশীয় পরিব্রাজক ইউয়ান চোয়াং[১৫] তদীয় ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখিয়া গিয়াছেন যে, বুদ্ধদেব স্বয়ং কর্ণসুবর্ণ, সমতট প্রভৃতি স্থানে আসিয়াছিলেন এবং তিনি সমতটের রাজধানীর উপকণ্ঠে যেস্থানে সাতদিন পর্যন্ত ধর্ম্মপ্রচার করেন, তথায় মগধরাজ অশোকের সময়ে এক স্তূপ নির্মিত হয়। ইউয়ান চোয়াং এ স্তূপ স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন। ইহা হইতে বোধ হয় বুদ্ধদেবের জীবদ্দশা হইতেই সমতটে বৌদ্ধ ধর্ম্মের প্রচার আরম্ভ হয়।

বৌদ্ধ ধর্ম্মের পূর্ব্বেই জৈন ধৰ্ম্ম প্রচারিত হইতে থাকে। জৈন গ্রন্থ হইতে জানা যায়, নেমিনাথ অঙ্গ, বঙ্গ প্রভৃতি দেশে জৈন ধর্ম প্রচার করেন। জৈনগুরু পার্শ্বনাথ খৃঃ পূঃ অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে নির্ব্বাণ লাভ করেন। ছোটনাগপুরে সমেত-শেখরে তিনি সমাহিত হইলে, সেই পাহাড়ের নামই পার্শ্বনাথ বা পরেশনাথ হয়। এই উত্তুঙ্গ পর্ব্বতশিখরে সমস্ত জৈন তীর্থঙ্করগণের সমাধিমন্দির আছে। পার্শ্বনাথ পুণ্ড্র ও বঙ্গ প্রভৃতি দেশে আগমন করিয়া বহু লোককে জৈন ধৰ্ম্মে দীক্ষিত করেন। জৈনগুরু মহাবীরের অন্য নাম বৰ্দ্ধমান। সম্ভবতঃ তাহা হইতে রাঢ়ীয় বৰ্দ্ধমান প্রদেশের নাম হয়। পুরাণাদির আলোচনা হইতে জানিতে পারা যায়—জৈনদিগের ২৪ জন তীর্থঙ্করের মধ্যে ২৩ জনের সহিত বাঙ্গালীর সংস্রব ঘটিয়াছিল।[১৬]

ইহা হইতে বুঝা গেল যে, জৈন ধৰ্ম্মই প্রথম বঙ্গদেশে প্রচারিত হয়। বৌদ্ধ ধর্ম্ম পরে আসিয়াছিল। জৈন ধর্ম্মের প্রভাববশতঃ বৌদ্ধমত সহজে প্রসার লাভ করিতে পারে নাই। অনেক দিন পর্য্যন্ত এই উভয় ধর্ম্মের মধ্যে পরস্পর এবং উভয়ের সহিত ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের প্রবল সংঘর্ষ চলিয়াছিল।

বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রুর রাজত্বকালে বুদ্ধদেব নির্ব্বাণ লাভ করেন। অজাতশত্রুর পর শূদ্রজাতীয় নন্দবংশীয়েরা মগধের রাজা হন। এই বংশীয় মহানন্দের রাজত্বকালে মাসিডনাধিপতি আলেকজেণ্ডার ভারত আক্রমণ করেন (৩২৭–৩২৫ খৃঃ পূঃ)। মহানন্দের এক পুত্র চন্দ্রগুপ্ত। ইনি মুরা নাম্নী দাসীর গর্ভজাত বলিয়া মৌৰ্য্য নামে খ্যাত। চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে বঙ্গদেশে সৰ্ব্বত্র ব্রাহ্মণাচার একপ্রকার বিলুপ্ত হইয়াছিল এবং সর্ব্বত্রই জৈন ধর্ম্মের প্রবল প্রতিপত্তি বিস্তৃত হইয়াছিল। তিনি স্বয়ং জৈন মতের পক্ষপাতী বলিয়া ব্রাহ্মণদিগের নিকট ‘বৃষল’ আখ্যায় লাঞ্ছিত হইয়াছিলেন।

চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র অশোক ২৭২ খৃঃ পূর্বাব্দে রাজ্যারোহণ করেন। মহারাজ অশোকের শুদ্ধ শান্ত দেবান্তঃকরণর প্রবাহে, সেই রাজর্ষির ভিক্ষুমূর্তির আদর্শে এবং তাঁহার স্বরচিত লিপিমালায় ও বহু শিলানুশাসনে ভারতবর্ষের বহু স্থান সুকীর্ত্তিত হইয়াছেন।[১৭] সে প্রবাহ বঙ্গে আসিয়াছিল, সমতটে আসিয়াছিল, যশোহর-খুলনায় আসিয়াছিল। যখন পূর্ব্বদিকে চট্টলরাজ্য পর্য্যন্ত তাঁহার বিজয়-বৈজয়ন্তী উড়িয়াছিল, তখন সমতট বা যশোর প্রদেশেও বৌদ্ধপ্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউয়ান চোয়াং সমতটে যে বহুসংখ্যক সংঘারামের কথা উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, সে সব এবং অসংখ্য চৈত্য বা মন্দির এই যুগে প্রতিষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধমতের এবম্বিধ প্রসার লাভের অনেক প্রমাণ আছে। চৈনিক পরিব্রাজকের বিবরণী প্রথম প্রমাণ; এখনও এদেশে বহু বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া যাইতেছে, স্তূপাদির নিদর্শন আছে, সে সকল তাহার দ্বিতীয় প্রমাণ; আর ভারতের অনেকস্থানে বৌদ্ধধর্ম্ম মরিলেও তাহা বঙ্গদেশে-যশোহর-খুলনায়, এখনও সম্পূর্ণ বিনাশ প্রাপ্ত হয় নাই, এখনও প্রচ্ছন্নভাবে আত্মগোপন করিয়া পূর্ব্বচিহ্ন বজায় রাখিয়াছে, ইহাই তাহার তৃতীয় প্রমাণ। আমরা ক্রমে ক্রমে ইহার আলোচনা করিব।

পাদটীকা :

১. বঙ্গদর্শন, ১২৮০, ‘বঙ্গে ব্রাহ্মণাধিকার’ শীর্ষক প্ৰথম প্ৰবন্ধ।

২. আচারাঙ্গ সূত্র ১/৮৩; ‘গৌড়রাজমালা’ ১ম পৃ দ্রষ্টব্য। [আচারাঙ্গসূত্রে রাঢ় দেশকে দুইভাগে দেখান হইয়াছে—বজ্ৰভূমি (land of dia- monds) এবং সুহ্মভূমি – History of Bengal, Dacca Univ., Vol. 1, P 9-10. –শি মি]

৩. বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাঙ্গালার কলঙ্ক’ প্রবন্ধ, ১২৯১, শ্রাবণ। রজনীকান্ত গুহ কর্তৃক অনুবাদিত মেগাস্থিনিসের ভারত-বিবরণ, ৭২ পৃ।

৪. তত্ত্বদর্শী রমাপ্রসাদ চন্দ এই রূপই অনুমান করিয়াছেন, ‘গৌড়রাজমালা’, ২ পৃ।

৫. Pliny. Histaria Naturalis, VI, 21. 8-23; মেগাস্থিনিসের ভারত-বিবরণ ১৯১ পৃ; বাঙ্গালার পুরাবৃত্ত, ১৩৫ পৃ।

৬. The Periplus of the Erythraean Sea, ed. by Wilfred H. Schoff.

৭. ১৪২ পৃ।

৮. বাঙ্গালার পুরাবৃত্ত, ১৪৫ পৃ।

৯. ১৭৪ পৃ।

১০. নদীয়া রাজ্যের বিস্তৃতির বর্ণনায় ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গলে’ আছে : পূর্ব্ব ‘সীমা ধূল্যাপুর বড় গঙ্গা পার।’ ধূলিয়াপুর পরগণা মধুমতীর পূর্ব্বপারে ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত।

১১. পরিশিষ্ট-গ দ্রষ্টব্য : আশুতোষ মিউজিয়ামের কিউরেটর ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর দেবপ্রসাদ ঘোষ বলেন, ‘On the exam- ination of the recent findings of excavation at Berachapa and Chandraketugarh this conclusion of Prof. Mitra may be said to be most prophetic.’—শি মি।

১২. পরবর্ত্তীকালে ঐতিহাসিক হেম রায় চৌধুরি মহাশয় গ্রীক ও লাতিন প্রামাণিক গ্রন্থ বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইয়াছেন যে, Gangaridai গঙ্গা- ভাগীরথীর পূর্ব্ব তীরে অবস্থিত ছিল— History of Bengal, Dacca Univ. Vol. 1, pp. 41-44—শি মি

১৩. বিবিধ প্রবন্ধে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, বঙ্গদর্শন, ১২৮১।

১৪. ইহাদের উভয়ের জন্মমৃত্যুর তারিখ লইয়া বহু তর্ক আছে। সাধারণতঃ গৃহীত হয় যে মহাবীর ৪২৭ খৃঃ পূর্ব্বাব্দে এবং বুদ্ধদেব ৪৮৭ খৃঃ পূর্ব্বাব্দে দেহত্যাগ করেন। এ সম্বন্ধে বহু মত আছে। See Smith, V. A. Early History, 3rd ed. P. 42.

১৫. এই পরিব্রাজকের নামের উচ্চারণ ও বানান লইয়া বহু মতভেদ আছে। Huen Tsang (Encyclopaedia), Hiuen Tsiang (V. A. Smith) এবং Thomas Watters-এর সম্পাদিত ভ্রমণ-বৃত্তান্তের সংস্করণের উপক্রমণিকায় Rhys Davids বহু গবেষণার পর Yuan Chwang এই উচ্চারণ স্থির করিয়াছেন। আমরা উহারই অনুবাদে ইউয়ান চোয়াং করিলাম।

১৬. বিশ্বকোষ, ১৭শ খণ্ড, ৪০৬ পৃ।

১৭. Smith, Early History, PP. 178-9.

সকল অধ্যায়

১. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. ২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. ৩. নদী-সংস্থান
৪. ৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. ৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. ৬. সুন্দরবন
৭. ৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. ৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. ৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. ১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. ১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. ১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
১৩. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
১৪. ২. দ্বীপের প্রকৃতি
১৫. ৩. আদি হিন্দু-যুগ
১৬. ৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
১৭. ৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
১৮. ৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
১৯. ৭. মাৎস্য-ন্যায়
২০. ৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
২১. ৯. সেন-রাজত্ব
২২. ১০. সেন-রাজত্বের শেষ
২৩. ১১. আভিজাত্য
২৪. ১. তামস যুগ
২৫. ২. বসতি ও সমাজ
২৬. ৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
২৭. ৪. খাঁ জাহান আলি
২৮. ৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
২৯. ৬. পয়োগ্রাম কসবা
৩০. ৭. খালিফাতাবাদ
৩১. ৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৩২. ৯. হুসেন শাহ
৩৩. ১০. রূপ-সনাতন
৩৪. ১১. লোকনাথ
৩৫. ১২. হরিদাস
৩৬. ১৩. রামচন্দ্র খাঁ
৩৭. ১৪. গাজীর আবির্ভাব
৩৮. ১৫. মুকুট রায়
৩৯. ১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
৪০. ১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
৪১. পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
৪২. পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
৪৩. পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
৪৪. পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন