৩. আদি হিন্দু-যুগ

সতীশচন্দ্র মিত্র

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – আদি হিন্দু-যুগ

বৈদিক যুগে বঙ্গদেশ অনাৰ্য্যনিবাস ছিল। ঐতরেয় আরণ্যকে যেখানে আমরা সর্ব্বপ্রথম বঙ্গের উল্লেখ দেখি,[১] তাহা হইতে জানিতে পারা যায় যে বঙ্গ, বগধ (মগধ) এবং চের এই তিন দেশবাসিগণ দুর্ব্বলতা, দুরাহার ও বহু অপত্যত্বে কাকচটকপারাবত সদৃশ।[২] ইহা হইতে স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে, বঙ্গে তখন অনার্য্য জাতির বাস ছিল, তাহাদের ধর্মজ্ঞান বা খাদ্যবিচার ছিল না। অবশ্য বলির পুত্রগণ যখন অঙ্গবঙ্গাদি দেশে উপনিবেশ স্থাপন করেন, তখন আর্য্যেরাই এদেশে আসিয়াছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গদেশের নানাস্থানে পবিত্র তীর্থস্থান এবং পীঠমূর্ত্তি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এই তীর্থস্থানগুলিই আবার এ প্রদেশে আর্য্যোপনিবেশ প্রতিষ্ঠার কারণ হইয়াছিল। সব চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু সেই অতি পুরাতন দেববিগ্রহ বা পূজার স্থানসমূহ এক স্মরণাতীত যুগের কথা স্মরণ করাইয়া দিতেছে। তীর্থের জন্য আর্য্যগণ এদেশে বাস করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু অসংখ্য অনার্য্য জাতির সংস্পর্শে তাঁহাদিগের ধর্ম্মহানি হইতে লাগিল। ক্ষত্রিয়েরাই দিগ্বিজয়ে আসিয়া রাজ্য স্থাপন করিয়া বাস করিতেন, ব্রাহ্মণেরা এ দূরদেশে আসিতেন না। ধর্ম্মহানির তাহাই কারণ। মনুসংহিতায় লিখিত আছে, ব্রাহ্মণ অভাবে ক্ষত্রিয়জাতীয় পৌণ্ড্রগণ বৃষলত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।[৩] তীর্থযাত্রা ব্যতীত এদেশে আগমনও নিষিদ্ধ ছিল।[৪] বৌধায়ন সূত্রে লিখিত আছে যে বঙ্গ, কলিঙ্গ, সৌবীর প্রভৃতি দেশে আগমন করিলে, যজ্ঞবিশেষের অনুষ্ঠান দ্বারা পরিশুদ্ধি লাভ করিতে হয়।[৫]

গঙ্গার প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে গাঙ্গরাষ্ট্রে সভ্যতা বিস্তৃত হয়। রামায়ণের যুগেই ভগীরথ কর্তৃক গঙ্গা আনীত হন। তৎসঙ্গে ক্রমে ক্রমে মিথিলা, পৌণ্ড্রবর্দ্ধন ও বঙ্গ প্রভৃতি দেশে আর্য্যগণের উপনিবেশ স্থাপিত হইতে থাকে। দশরথের রাজত্বকালে বঙ্গ একটি প্রধান রাজ্য বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। রামাভিষেকবাৰ্ত্তা শুনিয়া কৈকেয়ী বিষণ্ণ হইলে, অভিমানিনী ভার্য্যাকে সান্ত্বনা করিবার জন্য রাজা দশরথ বঙ্গ, অঙ্গ, মগধ, কোশল প্রভৃতি[৬] বহুদেশের নাম করিয়া বলিয়াছিলেন যে, এ সকল দেশের উৎপন্ন দ্রব্যজাত মধ্যে যাহাতে তাঁহার অভিলাষ হয়, তাহাই তাঁহাকে আনিয়া দিবেন। তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে যে, এ সকল দেশ তখন দশরথের বিস্তৃত রাজ্যমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রঘুর দিগ্বিজয়ে বর্ণিত হইয়াছে যে, বঙ্গবাসিগণ নৌবাহিনী সাজাইয়া মহাবীর রঘুর সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন। রঘু তাহাদিগকে পরাজিত করিয়া গঙ্গাস্রোতের মধ্যবর্তী দ্বীপে জয়স্তম্ভাবলী প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। এ উপবঙ্গে যে তখন সভ্যতার উন্মেষ হইয়াছিল এবং দেশের প্রকৃতি অনুসারে তদ্দেশবাসিগণ যে নৌবল সঞ্চয় করিয়া দিগ্বিজয়ী বীরের সহিত যুদ্ধ করিতে সাহসী হইয়াছিলেন, ইহা হইতে তাহার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।

রামায়ণ হইতে জানা যায়, সূর্য্যবংশীয় সগর রাজার ষষ্টিসহস্র পুত্র মহর্ষি কপিলের শাপে ভস্মীভূত হন। ভগীরথ এই সগররাজের অধস্তন বংশধর। তিনি সাধনবলে গঙ্গাকে ভূতলে আনিয়া তাঁহার পবিত্র জলস্পর্শে শাপদগ্ধ পূর্ব্বপুরুষগণের উদ্ধার সাধন করেন। যেখানে সগরের পুত্রগণ ভস্মীভূত ও পরে উদ্ধারপ্রাপ্ত হন, সেই স্থানেই কপিলাশ্রম ছিল এবং তাহারই নাম সগরদ্বীপ। সগরের পুত্রগণ কর্তৃক খাত বলিয়া সমুদ্রের অন্য নাম সাগর। গঙ্গার সহিত সাগরের সঙ্গমেই সগরদ্বীপ অবস্থিত। কবিকঙ্কণ চণ্ডী হইতে জানিতে পারি, শ্রীমন্ত সওদাগর সপ্তডিঙ্গা লইয়া যাইতে যাইতে, ক্রমে কালীঘাট, বারাশত, ছত্রভোগ পার হইয়া হাতিয়াগড়ে অম্বুলিঙ্গ শিব ও সঙ্কেত মাধবের পূজা করিয়া অবশেষে এই সগরদ্বীপে উপনীত হন।

‘যেখানে সগর বংশ,     ব্রহ্মশাপে হইল ধ্বংস
অঙ্গার আছিল অবশেষ;
পরশি গঙ্গার জলে,      বিমানে বৈকুণ্ঠে চলে
হৈয়া সব চতুভূজ বেশ।
মুক্তিপদ এই স্থান,      এইখানে করি স্নান
চল ভাই সিংহল নগর;
তর্পণ করিয়া জলে,      ডিঙ্গা ল’য়ে সাধু চলে,
গাইল মুকুন্দ কবিবর।’[৯]

সগরদ্বীপ যুগযুগান্তর ধরিয়া একটি তীর্থস্থানে পরিণত হইয়া রহিয়াছে। ইহা পূর্ব্বে একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। পাঠান যুগে শ্রীমন্ত সওদাগরের সময় হইতে মোগল আমল পৰ্য্যন্ত সগরদ্বীপের অবস্থা কবিকঙ্কণের বর্ণনা হইতে জানা গেল। ইহার অব্যবহিত পরেই প্রতাপাদিত্যের যুগ। সে সময় সগরদ্বীপ তঁহার একটি প্রধান নৌবাহিনীর আড্ডা এবং শাসনকেন্দ্র ছিল। তিনি সগরদ্বীপের শেষ নৃপতি বলিয়া উক্ত হইয়াছেন।[১০] বৈদেশিকেরা প্রতাপাদিত্যকে চ্যাণ্ডিকানের (Chandecan) অধীশ্বর বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে সগরদ্বীপই চ্যাণ্ডিকান।[১১] প্রতাপাদিত্যের পতনের পরও সগরদ্বীপের ভাল অবস্থা ছিল। ১৬৮৮ খৃষ্টাব্দে ইহাতে দুই লক্ষ লোকের বাস ছিল বলিয়া কথিত হইয়াছে। কিন্তু ঐ বৎসরই সহসা এক ভীষণ জলপ্লাবনে উহা নিমজ্জিত হয় এবং তদবধি আর উঠে নাই।[১২] অনেক চেষ্টা করিয়াও ইহাতে আবাদ পত্তন করা যায় নাই।[১৩] এখন পৌষ-সংক্রান্তিতে ২/৩ দিনের জন্য বহুসংখ্যক যাত্রী সগরদ্বীপে বা গঙ্গাসাগরতীর্থে যাইয়া থাকে। এখানে কোন লোকের বসতি নাই কেবলমাত্র জঙ্গলের মধ্যে ২/১ টি প্রাচীন ভগ্ন মন্দির কিছু প্রাচীন নিদর্শন রাখিয়াছে।

মহাভারতীয় যুগে সমগ্র বঙ্গদেশে আর্য্য-সভ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের প্রাক্কালে পাণ্ডবেরা যখন দিগ্বিজয় বহির্গত হন, তখন ভীমসেন পূর্ব্বদেশ জয় করিবার ভারপ্রাপ্ত হন। তিনি ক্রমে রাজ্যজয়ে করিতে করিতে অগ্রসর হইতে ছিলেন। তিনি ‘পুণ্ড্রাধিপতি বাসুদেব ও কৌশিকী কচ্ছবাসী মনৌজা রাজা এই দুই মহাবল পরাক্রান্ত মহাবীরকে পরাজয় করিয়া বঙ্গরাজের প্রতি ধাববান হইলেন। তৎপরে সমুদ্রসেন, চন্দ্রসেন, তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি বঙ্গদেশাধীশ্বরদিগকে এবং সুহ্মদিগের অধীশ্বর ও মহাসাগর-কূলবাসী ম্লেচ্ছগণকে জয় করিলেন।’[১৪] ইহা হইতে দেখা যাইতেছে, বঙ্গদেশ তখন নানাভাগে বিভক্ত ছিল এবং এক রাজার অধীন ছিল না। সম্ভবতঃ পূৰ্ব্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ বা রাঢ় এই তিন ভাগে বঙ্গ বিভক্ত ছিল। পূৰ্ব্ববঙ্গে সমুদ্রসেন, উপবঙ্গাদি লইয়া ভাগীরথীর উভয়কূলবর্তী পশ্চিমবঙ্গে চন্দ্রসেন এবং দক্ষিণবঙ্গ বা সুহ্ম রাঢ় প্রভৃতি অঞ্চলে তাম্রলিপ্ত রাজা ছিলেন বলিয়া বোধ হয়। বৰ্ত্তমান তাম্রলিপ্ত বা তমলুক এই তাম্রলিপ্ত রাজার রাজধানী ছিল। মহাভারতের অন্যত্র বর্ণিত হইয়াছে যে তাম্রলিপ্তকগণ ম্লেচ্ছ ছিল,[১৫] কিন্তু অন্য নৃপতিদ্বয়ের সেনা সম্বন্ধে সেরূপ কোন উল্লেখ নাই। সুতরাং যশোরাদি উপবঙ্গে তখন আর্য্য-রাজত্ব ছিল বলা যাইতে পারে। সমুদ্রসেন ও চন্দ্রসেন উভয়ে সম্পর্কিত থাকাও বিচিত্র নহে। পাণ্ডবদিগের রাজসূয় যজ্ঞকালে তাঁহারা নানা বিত্ত ও রত্ন উপহার লইয়া ইন্দ্রপ্রস্থে উপস্থিত ছিলেন। ইঁহারা ‘প্রত্যেকে সুশিক্ষিত ও পৰ্ব্বতপ্রতিম কবচাবৃত’ বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন।[১৬] রথী ও অতিরথের সংখ্যা নির্ণয় করিতে গিয়া কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে মহাবীর ভীষ্ম এক চন্দ্রসেনকে পাণ্ডবপক্ষের একজন প্রধান রথী বলিয়া বৰ্ণনা করিয়াছেন।[১৭] এই চন্দ্রসেন বাঙ্গাধিপ চন্দ্রসেন কিনা বলা যায় না।

উপরোক্ত পুণ্ড্রাধিপতি বাসুদেব পৌণ্ড্র বা পৌণ্ড্রক বাসুদেব নামে খ্যাত ছিলেন। এইভাবে তিনি শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেব হইতে পৃথক্ বলিয়া উল্লিখিত হইতেন। হরিবংশ হইতে জানা যায় পৌণ্ড্রক প্রবল বীর ছিলেন; তিনি নরক, জরাসন্ধ প্রভৃতির বন্ধু এবং শ্রীকৃষ্ণের পরম শত্রু। অবশেষে তিনি শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক নিহত হন।[১৮] বাসুদেবের পিতার নাম বসুদেব এবং মাতার নাম সুতনু। তাঁহার এক বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ছিলেন, তাঁহার নাম কপিল। কপিলের মাতার নাম নারাচী। কপিল সম্ভবতঃ তাঁহার গর্বিত ও পরাক্রান্ত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বাসুদেবের চক্রান্তে বিতাড়িত হন এবং পরে মুনিব্রতাবলম্বন করিয়া সুদূর উপবঙ্গের দক্ষিণাংশে সুন্দরবনের মধ্যে এক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ঐস্থান এক্ষণে কপিলমুনি নামে খ্যাত। ইহা খুলনা জেলার কপোতাক্ষী নদীর তীরে অবস্থিত। যিনি সাংখ্যদর্শনপ্রণেতা এবং যাঁহার অভিশাপে সগরবংশের ধ্বংস হইয়াছিল, ভগবানের অবতারকল্প সেই মহর্ষি কপিল[১৯] হইতে ইনি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তি। বাসুদেবানুজ কপিলও সন্ন্যাসী এবং ভক্তপুরুষ ছিলেন। তিনি কপিলমুনিতে আশ্রম নির্দ্দেশ করিয়া তথায় এক কালীমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ইনি কপিলেশ্বরী কালী বলিয়া খ্যাত।

কপিল মহাভারতীয় যুগের লোক। তাঁহার পর সুন্দরবন অঞ্চল দিয়া কত বিপ্লব চলিয়া গিয়াছে। যে প্রস্তরময়ী মূর্তি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন, তাহা আর এখন নাই। উক্ত স্থানে কপোতাক্ষীর কূলে একটী অশ্বত্থ বৃক্ষের মূল বেষ্টন করিয়া একটী বিস্তৃত ইষ্টকস্তূপ মুনির আশ্রম নির্দ্দেশ করে। কপিলের কালীমূর্তি ও মন্দির সম্ভবতঃ বৌদ্ধ আমলেও ছিল, বৌদ্ধযুগের কোন কোন নিদর্শন এখনও কপিলমুনিতে আছে। পরে তাহার আলোচনা করা যাইবে। বৌদ্ধযুগের শেষভাগে সুন্দরবনে যে প্রাকৃতিক বিপ্লব হয়, তাহাতেই উক্ত মন্দিরাদি ভূপ্রোথিত হইয়া যায় এবং কালীমূৰ্ত্তি বিনষ্ট হয়। ইহার পর প্রায় দুইশত বৎসর এই সকল স্থান মনুষ্যের বাস ও গতিবিধিবিহীন অবস্থায় ছিল। পরে যখন পুনরায় পত্তন হইতেছিল, তখন কপিলের কথা নানা জনশ্রুতিমুখে বিজ্ঞাপিত হয় এবং সেই স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে চৈত্রমাসে বারুণী স্নানের দিন কপিলমুনিতে এক যাত্রী সমাগম ও মেলা আরম্ভ হয়। মধুমাসীর কৃষ্ণাত্রয়োদশী কপিলের মাতৃমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা বা সিদ্ধিলাভের দিন হইতে পারে। এই মেলায় বহু দূরবর্তী স্থানের লোক আসিত। তখন হইতে সাধারণগৃহে কপিলেশ্বরীর পূজা প্রবর্তিত হয়। লোকের বিশ্বাস পূর্ব্বোক্ত তিথিতে কপোতাক্ষের জল গঙ্গাজলতুল্য পবিত্র হয় এবং উহাতে স্নান করিলে মহাপুণ্য লাভ হয়। এখন আর মাসাধিক কালব্যাপী মেলা হয় না বটে, কিন্তু চৈত্র মাসে বারুণী তিথিতে কপোতাক্ষে স্নান করিবার জন্য এখানে বহুলোকের সমাগম হয়।

কপিলমুনি একটি অতি প্রাচীন স্থান। ইহা মলই পরগণার অন্তর্গত। ইহা প্রতাপাদিত্যের রাজ্যভুক্ত ছিল। তাঁহার পতনের পর মলই পরগণা রায় উপাধিধারী এক পরাক্রান্ত ব্যক্তির হস্তগত হয়। এই বংশীয় প্রসিদ্ধ ব্যক্তি কমলাকান্ত রায় ও গোপীকান্ত রায়।[২০] তাঁহারা চাঁচড়ার অধীন জমিদার ছিলেন। এখনও এই বংশীয় ব্যক্তিগণ হরিঢালী ও রাডুলিতে বাস করিতেছেন। মলই পরগণার কর প্রভূত পরিমাণে বাকী পড়িলে, চাঁচড়া-রাজ মনোহর রায় ১৬৯৯ খৃষ্টাব্দে রায়বংশীয়দিগের নিকট হইতে কোবলা দ্বারা এই জমিদারী স্বীয় হস্তে লন। চাঁচড়ার রাজগণ চিরদিন দেবদ্বিজে ভক্তিমান্ এবং দেবসেবায় মুক্তহস্ত, তন্মধ্যে আবার রাজা মনোহর রায় এ বিষয়ে সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ। তিনি কপিলেশ্বরীর জন্য এক সুন্দর মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া সেবার জন্য যথেষ্ট বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। প্রায় দেড়শত বৎসর পরে ঐ মন্দির নদীগর্ভস্থ হয়। ইতিমধ্যে ইংরাজ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে মনোহরের বংশধর শ্রীকণ্ঠ রায়ের রাজত্বকালে মলই পরগণা বিক্রয় হইয়া যায়। উহা সাতক্ষীরার জমিদার বাবুরা ক্রয় করেন এবং তাঁহারাই কপিলেশ্বররী সেবার তত্ত্বাবধান করিতেন। কিছুকাল পরে তাঁহাদিগেরও ২/৫ অংশ বিক্রয় হওয়ায় সে অংশ দিঘাপাতিয়ার রাজা এবং শ্রীধরপুরের বসু বাবুরা ক্রয় করেন। অবশিষ্টাংশ সাতক্ষীরার বাবুরা উভয় সরিকে ভোগদখল করিতেছেন। নানা অংশে বিভক্ত হওয়ায় উক্ত জমিদারগণ কালীবাড়ীর প্রতি তাদৃশ মনোযোগী ছিলেন না। তখন ঝিকারগাছার কুঠিয়াল মেকেঞ্জি সাহেব ১৮৫০ খৃষ্টাব্দের প্রাক্কালে একটা ছাদওয়ালা ক্ষুদ্র অট্টালিকা নির্ম্মাণ করিয়া দেন।[২১] ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দের প্রবল ঝড়ে সে ইষ্টক গৃহও ভূমিসাৎ হয়। তখন অগত্যা একটী পর্ণশালায় দেবীমূর্ত্তিটি স্থাপিত হয়। কয়েক বৎসর হইল কপিলমুনি নিবাসী শ্রীবিনোদবিহারী সাধু খাঁ নামক একজন সঙ্গতিপন্ন শিক্ষিত যুবক নদীর সন্নিকটে একটী পাকা মন্দির ও নাট্যশালা নির্ম্মাণ করিয়া তন্মধ্যে মায়ের এক সুন্দর প্রস্তরময়ী মূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়া যথেষ্ট সদন্তঃকরণের পরিচয় দিয়াছেন। তিনি মায়ের মন্দিরে এক প্রস্তর ফলকে লিখিয়া রাখিয়াছেন :

‘যথা দ্বিজ, সাধু, ভক্ত তথা তীর্থ স্থান।
তাই মাগি পদধূলি দেহ পুন্যবান্।
ভরত সাধু খাঁ পুত্র শ্রীযাদব আর
বিনোদবিহারী দীন প্রিয় পৌত্র তার,
মায়ের মন্দিরপ্রান্তে লুটাইছে শির
এস সাধু সদাশয় জ্ঞানী গুণী ধীর।’

মুনিবর কপিল যেখানে পুণ্যভূমি বাছিয়া মায়ের মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, কত কত শতাব্দী ধরিয়া সাধুপদরেণুতে যে পুণ্যভূমি পবিত্র ও ধন্য হইয়াছে, সেখানে মায়ের মূর্ত্তিস্থাপনা যে এক সাধনার ফল এবং অর্থের সদ্ব্যবহার, তাহাতে সন্দেহ নাই।

মহর্ষি কপিল উক্ত মুনিবর কপিল হইতে ভিন্ন ব্যক্তি সে কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি। সেই মহর্ষি কপিলের শাপে সগরবংশ ধ্বংস হইয়াছিল। সগররাজ্যের বংশোজ্জ্বলকারী ভগীরথ যখন স্বীয় কঠোর সাধনার ফলে সুরধুনী গঙ্গাকে হিমাচল পথে বঙ্গভূমিতে আনয়ন করেন, তখন সেই ধারাস্পর্শে সগর-সন্তানগণের উদ্ধার সাধিত হয়। সেই ধারা যেখানে সমুদ্রে পতিত হয়, তাহারই নাম গঙ্গাসাগর সঙ্গম। উহা হিন্দুর পরম পবিত্র পুণ্যতীর্থ। সগরের নাম হইতেই তদবধি সমুদ্রেরও নাম হইয়াছে সাগর। উক্ত সঙ্গমতীর্থের সন্নিকটেই সগর দ্বীপ। উহা এক্ষণে ২৪-পরগণা জেলার অন্তর্গত এবং গঙ্গার মোহানার পশ্চিম গায়ে অবস্থিত। গঙ্গার সে আদি স্রোত যে এক্ষণে বহুস্থলে মজিয়া গিয়াছে, অব্যাহত নাই, ভাগীরথীর স্রোত হুগলী নদীর পথে সগর-দ্বীপের পশ্চিমে গিয়া সাগরে মিশিয়াছে, সে কথা উপদ্বীপের দ্বীপমালাপ্রসঙ্গে পূৰ্ব্বে বলিয়াছি। সগর-দ্বীপে মহর্ষি কপিল, সগর ও ভগীরথের মূৰ্ত্তি আছেন।[২২] পৌষ সংক্রান্তিতে সগর বংশের উদ্ধার হয়, সেই পুণ্যতিথিতে এখনও সগর-দ্বীপে প্রতি বৎসর মেলা হয়, তাহাতে বহুসংখ্যক সাধুর সমাগম ও বিপুল জনতা হয়। ঐ সময়ে উক্ত মূর্ত্তিত্রয়ের পূজা হয়। কিন্তু বৎসর ভরিয়া এ দ্বীপে দুই একজন পাণ্ডা ব্রাহ্মণ ভিন্ন আর কোন লোকবাস করে না। মূর্ত্তিত্রয়ের জন্য কোন স্থায়ী মন্দিরও ছিল না। সম্প্ৰতি কপিলমুনি-নিবাসী পূর্ব্বোক্ত বিনোদবিহারী সাধু খাঁ মহাশয় মূর্ত্তি তিনটির জন্য এবং পার্শ্বে সাধুর আশ্রয়ের জন্য একটি সুন্দর মঠ মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দিয়া প্রকৃত সাধুর মত অন্বর্থোপাধি হইয়াছেন। সেই মন্দিরের মেজে মর্ম্মর প্রস্তরে মণ্ডিত করিয়া বিনোদবিহারী সুবিনীত সংক্ষিপ্ত স্বীয় আত্মপরিচয়চ্ছলে যাহা লিখিয়া রাখিয়াছেন, তাহার এক স্থলে আছে :

‘জনম কপিলমুনি খুলনা জেলায়।
স্থাপিল ভকতি মঠ জলধি বেলায়।’[২৩]

এই স্মরণাতীত আদিযুগেই যশোর রাজ্যের দক্ষিণ সীমায় দুই দিকে দুইটী পীঠস্থান হইয়াছিল। বৰ্ত্তমান কলিকাতার দক্ষিণে কালীঘাটে আদিগঙ্গার তটে ঁমায়ের দক্ষিণ পায়ের ৪টী অঙ্গুলি পড়িয়াছিল এবং তথাকার ভৈরবের নাম নকুলেশ্বর।

‘কালীঘটে গুহ্যকালী কিরীটে চ মহেশ্বরী’—মহানীলতন্ত্র

‘নকুলেশঃ কালীঘটে শ্রীহট্টে হাটকেশ্বরঃ’—মহালিঙ্গেশ্বর তন্ত্র

এইরূপে যশোর রাজ্যের পূর্ব্বাংশে যমুনাকূলে মায়ের পাণিপদ্ম পতিত হয় এবং তথায় ভৈরবের নাম চণ্ড।

‘যশোরে পাণিপদ্মঞ্চ দেবতা যশোরেশ্বরী।
চণ্ডশ্চ ভৈরবস্তত্র যত্র সিদ্ধিমবাপুয়া।’ – তন্ত্রচূড়ামণি

এখানে পাণিপদ্মে হস্ত ও পদ উভয় বুঝাইতেছে। আমরা ভবিষ্যপুরাণ হইতে জানিতে পারি :

‘কলেঃ সায়ং যশোরে চ যবনানাঞ্চ রাজ্যকে
যশোরেশী মহাদেবী চান্তর্ধানং ভবিষ্যতি
তত্রৈব পতিতৌ দেব্যাঃ হস্তপদৌ পুরা দ্বিজ।’

‘দিগ্বিজয়প্রকাশে’ লিখিত আছে যে, অনরি নামক ব্রাহ্মণ যশোরেশ্বরীর পীঠমূর্তির জন্য একশত দ্বারযুক্ত বিরাট মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দেন। সম্ভবতঃ এ মন্দির সুন্দরবনের বিপ্লবে অষ্টম শতাব্দীর পর বিনষ্ট হয়। ইহার পর যখন পশ্চিমদেশ হইতে পাল, সেন ও দেব প্রভৃতি বংশীয় অনেক জাতি বঙ্গে আসিয়া নানা স্থানে রাজ্য স্থাপন করিতেছিলেন, সে সময়ে গোকর্ণকুলসম্ভূত ধেনুকর্ণ নামক রাজা এদেশে আসেন এবং তিনি তীর্থদর্শন জন্য যশোরে গিয়াছিলেন। তিনি যশোরেশ্বরীর মন্দির বিনষ্ট হইয়াছে দেখিয়া, পুনরায় মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দেন। সম্ভবতঃ ধেনুকর্ণ কিছুকাল এ প্রদেশে রাজত্বও করিয়াছিলেন এবং তাঁহার রাজ্য উত্তর দিকে বহুদূর বিস্তৃত হইয়াছিল। সেন রাজগণের প্রবল প্রতাপজন্য অবশেষে এ বংশীয়দিগের পতন হয়। দিগ্বিজয়প্রকাশেই উল্লিখিত আছে যে ধেনুকর্ণের পুত্র কণ্ঠহার বীরপুরুষ ছিলেন। তিনি ‘বঙ্গভূষণ’ উপাধিভূষিত ছিলেন। এই বঙ্গভূষণ যশোরের উত্তর ভাগ অধিকার করিয়া তাহার নাম রাখেন ভূষণ, উহাই পরে ভূষণা বলিয়া পরিচিত হয়। কণ্ঠহার এখানে বহুকাল রাজত্ব করিয়াছিলেন।[২৪]

লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে ধেনুকর্ণের মন্দির অভগ্ন অবস্থায় বৰ্ত্তমান ছিল, কিন্তু চণ্ডভৈরবের মন্দির ছিল না। তজ্জন্য তিনি ভৈরবের মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দেন। সেন রাজত্বের শেষ ভাগে সুন্দরবন অঞ্চলে যে নিমজ্জন হয়, তাহাতে উভয় মন্দির বিনষ্ট হয় এবং দেবীমূর্ত্তি ভূপ্রোথিত ও ভীষণ জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া পড়ে। প্রতাপাদিত্যের সময় পুনরায় সে মূর্ত্তির আবির্ভাব ও মন্দির নির্ম্মিত হয়।

যশোরেশ্বরী যে সত্যযুগ হইতে আছেন, তাহা তন্ত্রাদি হইতে যেমন জানা যায়, লোকের মুখে কিম্বদন্তী পরম্পরায়ও সেইরূপ শুনিতে পাওয়া যায়। ১৮৪২ খৃষ্টাব্দে যশোরেশ্বরীর সেবায়ৎ কালীকিঙ্কর অধিকারীর সহতি দেবোত্তর জমির স্বত্ব লইয়া গবর্ণমেন্টের এক মোকদ্দমা হয়, উহার রায়ের অনুবাদ হইতে জানা যায় :

‘আপীলাণ্ট যে অজুহাত দাখিল করিয়াছে তাহার খোলসা এই জে ইশ্বরিপুর গ্রামে মহাপীট শ্রীশ্রীজসরেশ্বরি ঠাকুরাণী সত্যজুগ হইতে প্রকাশ আর শ্রীশ্রীঅন্নপুর্ণা ঠাকুরাণী এ জায়গায় স্থাপীত আছেন আর বিরধিয় ভূমী অন্নপূর্ণা ঠাকুরাণীর দেবত্তর হইতেছে এবং রাজা প্রতাপ আদিত্যর আমল হইতে অদ্যতক যে যে লোক জমীদার হইয়াছেন তাহারা সকলে এই সকল জমী বহাল রাখিয়াছেন।’[২৫]

বিশেষভাবে লক্ষ্য করিলে ইহা হইতে অনেকগুলি কথা বুঝা যায়। যশোরেশ্বরী দেবী সত্যযুগ অর্থাৎ অতি প্রাচীনকাল হইতে প্রতিষ্ঠিত আছেন, তাহা স্পষ্ট জানা যাইতেছে। ‘দেবী অন্নপূর্ণা’ প্রতাপাদিত্যের সময়ে প্রতিষ্ঠিত এবং তিনি সত্যযুগের স্থাপিত নহেন, তাহা স্পষ্ট উল্লেখ দেখা যাইতেছে।[২৬]

কালীঘাটে মহাকালীর ও যশোরেশ্বরীর মূর্তির পৌরাণিকতা সম্বন্ধে সর্ব্বপ্রধান প্রমাণ এই সকল শ্রীমূর্ত্তির অপূর্ব্ব ভাস্কর্য্য। এ মূর্তিদ্বয়ের গঠন দেখিলে সহজে বুঝা যাইতে পারে যে ইহা বৌদ্ধযুগেরও পূর্ব্ববর্ত্তী সময়ে রচিত। ইহা দূরে বসিয়া তর্ক করিবার বিষয় নহে, যশোরেশ্বরী দেবীর ভীষণা মূর্ত্তির সম্মুখবর্তী হইলে কেহই তাহার প্রাচীনতায় সন্দেহ করেন না। যে যুগে প্রস্তরে হাস্যলহরী বা নয়নভঙ্গী সজীববৎ প্রতিভাত হইত, এ মূর্ত্তি সে যুগের না হইলেও ইহাতে যে অপূর্ব্ব দৈবভাব তাহার ভয়ঙ্করী ছায়ার অন্তরালে লুক্কায়িত রহিয়াছে, তাহা সহজেই বুঝিয়া লওয়া যায়। এই সকল প্রাচীন মূর্তিতে আকারানুকরণ ভাল হয় নাই বলিয়া কেহ কেহ ভারত-শিল্পীর প্রতি কটাক্ষপাত করিয়াছেন। কিন্তু ভারতের শিল্প নিরাকারকে আকার দিতে গিয়া প্রকৃতভাবে আকারসর্ব্বস্ব হইয়া পড়ে নাই, পরন্তু কঠিন প্রস্তর-ফলকে অনাড়ম্বর ভাবে যে দেবভাব ফলাইয়াছে, তাহা অনিৰ্ব্বচনীয়। এ সম্বন্ধে এক কৃতী লেখক অভিমত প্ৰকাশ করিয়াছেন,– ‘মৃত্যুর মধ্যে অমৃত কি কৌশলে সৃষ্টিপ্রবাহ রক্ষা করিয়া থাকে, তাহা অন্য দেশের শিল্পকার অভিব্যক্ত করেন নাই। যাহা বাহ্যদৃষ্টিতে মৃত্যুমূর্তি, তাহাও বিশ্বমাতার শ্রীমূর্ত্তি মাত্র; ইহা কেবল ভারতশিল্পেই অভিব্যক্ত।’[২৭] মাতা যশোরেশ্বরীর মূর্তি এইরূপ একটি মৃত্যু-মূর্তি বটে, তাঁহার অতি বিস্তারবদনা জিহ্বাললনভীষণা মূৰ্ত্তি দর্শকমাত্রেরই প্রাণে ভয়ের সঞ্চার করিয়া দেয় বটে, কিন্তু তবুও সেই জ্বালাময়ী মূর্ত্তির বদনমন্ডলে কি জানি কি এক অপূৰ্ব্ব দেবভাব, কেমন সুন্দররূপে ফুটিয়া রহিয়াছে! উহা সেই প্রাচীন যুগেরই সম্পত্তি, এ যুগের নহে। তুমি এক্ষণে তিল তিল করিয়া আকারানুগত বিধিবিহিত সুষমাময়ী তিলোত্তমা গড়িতে পার, কিন্তু সেই প্ৰকাণ্ড কৃষ্ণপ্রস্তরপিণ্ডে, সেই অপ্রাকৃত চোখে মুখে, তেমন স্বর্গীয় ছায়াকে কায়াপরিগ্রহ করাইতে পার না। ইয়োরোপ দেবতাকে মানুষের আদর্শে, মানুষের প্রতি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আকারে গঠন করিতে গিয়া তাহার দেবভাব হারাইয়া ফেলিয়াছিল, ভারতবর্ষে মানুষের মূর্তিতে মানুষের কাঠামে, স্থূল গঠনে দেবতা গড়িয়াছিল। পাশ্চাত্য শিল্পীও একথা স্বীকার করিয়াছেন।[২৮]

বাস্তবিকই যশোরেশ্বরীর মূর্ত্তি ভীষণ হইলেও ইহা যে ভাস্কর্য্যের একটি চরম আদর্শ তাহাতে সন্দেহ নাই। কেহ কেহ বলেন সম্বলপুরে সম্বলেশ্বরীর মন্দিরে শনির মূর্ত্তি ব্যতীত মানুষের মূর্ত্তিতে এমন ভীষণ ভাব আর কোথাও ফলান হয় নাই।[২৯] উড়িষ্যার অন্তর্গত যাজপুরে বৈতরণী-তীরে সপ্ত-মাতৃকার মূর্তিমধ্যে চামুণ্ডা মাতার মূর্ত্তিও এইরূপ ভয়ঙ্করী। তাহাও এ জাতীয় মূর্তিশিল্পের পরাকাষ্ঠারূপে বর্ণিত হইয়াছে।[৩০] যশোরেশ্বরী মূর্তির গঠনশক্তি কেবল মাত্র মুখমণ্ডলেই প্রদর্শিত হইয়াছে। এ মূর্ত্তির কণ্ঠের নিম্নে হস্তপদ বা নিম্নাঙ্গ কিছুই নাই। উহা একখানি প্রস্তরপিণ্ড মাত্র। ইহার কষ্টিপাথরের কৃষ্ণতনু যে কত বৃহৎ বা ভারী, তাহা বুঝা যায় না। প্রথমতঃ একটী সমচতুষ্কোণ প্রস্তরময় বেদী প্রায় ১ হাত উচ্চ। তাহা হইতে কৃষ্ণ প্রস্তরের একটা আবরণ ক্রমশঃ সরু হইয়া কণ্ঠ পর্য্যন্ত আসিয়া মুখমণ্ডলের সহিত সুন্দরভাবে মিলিয়াছে। মূৰ্ত্তিদেহ নিম্নে অনেকটা প্রোথিত আছে, মুখের নিম্নাংশ কয়েক পরদা বস্ত্রে সমাবৃত থাকে। উহার উপরিভাগের রক্ত বস্ত্রখানি বৎসর অন্তর পরিবর্তিত হয়। কিন্তু নিম্নের বস্ত্রের নিম্নে প্রস্তরের গঠনাদি পুরোহিতগণ ও দেখিতে পারেন না। পুস্তকের প্রারম্ভপত্রে যে ত্রিবর্ণ চিত্র দেওয়া হইল, তাহা হইতে দেবীমূর্ত্তির আভাস পাওয়া যাইবে।[৩১] বিশ্বকোষে যশোরেশ্বরীর যে ছবি (woodcut) প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহাতে দেবী অষ্টভুজা মহিষ-মৰ্দ্দিনী বলিয়া অঙ্কিত হইয়াছেন। সে ছবি কোথা হইতে কিরূপ ভাবে সংগৃহীত হইল তাহা বলিতে পারি না।[৩২]

যশোহর-খুলনার মধ্যে আর কোনও পীঠমূর্তি নাই বটে, কিন্তু এই প্রাচীন যুগে এ প্রদেশে অন্যান্য দেবদেবীর নানামূৰ্ত্তি স্থাপিত হইয়াছিল। আর্য্যসভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে এই সকল মূর্ত্তির পূজাপদ্ধতি ক্রমশঃ বিস্তৃত হইয়া পড়ে। কিন্তু যশোর রাজ্যের উত্থান পতনে, নানা বিপ্লবে, বিভিন্ন শাসনফলে এই সকল দেব-বিগ্রহ অনেক নষ্ট হইয়া যায়। তবুও এক্ষণে ২/১টির দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে। খুলনার অন্তর্গত আমাদি গ্রামের পরীমালা বা পরিমলা দেবী এবং পাণিঘাটের অষ্টাদশভুজ মহালক্ষ্মীমূর্ত্তি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাইতে পারে। যশোহর-খুলনায় কালীবাড়ী নাই এমন কোন প্রধান স্থানই নাই, এরূপ বলা যাইতে পারে, কিন্তু তাহার অধিকাংশ দেবীস্থান পরবর্ত্তী যুগে প্রতিষ্ঠিত বলিয়াই আমাদের বিশ্বাস।

আমাদি গ্রাম এক্ষণে সুন্দরবনের উত্তর সীমায় কপোতাক্ষকূলে অবস্থিত। প্রাচীন যুগে ইহা একটী প্রধান স্থান ছিল বলিয়া বোধ হয়। পরবর্ত্তী হিন্দু ও মুসলমান যুগের অনেক কীৰ্ত্তিচিহ্ন এখনও এখানে বৰ্ত্তমান আছে। তাহার বিষয় যথাস্থানে বর্ণনা করা যাইবে। আমাদি নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। অতি পূৰ্ব্বকালে ইহা আমদ্বীপ (আম্রদ্বীপ) বা আমাদ অর্থাৎ পিশাচগণের বাসভূমি ছিল বলিয়া এরূপ নাম হইয়াছে কিনা বলা যায় না। যাহা হউক এই গ্রামে বা ইহার সন্নিকটে কোথাও পরীমালা দেবী পূজিত হইতেন। পরে কোনও বার সুন্দরবনের নিমজ্জনে উহার মন্দিরাদি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এবং দেবীমূর্ত্তি ভূমিগর্ভে প্রোথিত হইয়া পড়ে। সম্ভবতঃ উহা প্রথম বিপ্লবে হয়। পরে উহার উপর দিয়া বহু শতাব্দী চলিয়া যায়। অপেক্ষাকৃত আধুনিক যুগে ভূগর্ভ হইতে পরীমালা দেবীর উদ্ধার সাধিত হইয়াছে।

প্রবাদ এই যে, টাকীর জমীদারগণ যখন জামিরা পরগণার মালিক হন, তখন তাঁহাদের মধ্যে গোবিন্দদেব রায় চৌধুরী স্বপ্নাদিষ্ট হন। তদনুসারে তাঁহার লোকে কয়ড়া নদীর কূলে নারায়ণপুর গ্রামে ভূমি খনন করিয়া একটী প্রস্তরময়ী মূর্ত্তি পান। বহুকাল পৰ্য্যন্ত লবণাক্ত কৰ্দ্দমে কঠিন প্রস্তরেরও বহু পরিবর্তন হইয়া গিয়াছিল। তবুও মূৰ্ত্তিটী যে নরমুণ্ডমালিনী দেবী, তাহা বুঝা যায়। উক্ত রায় চৌধুরী মহোদয় এই প্রতিমা আনিয়া আমাদি গ্রামে উহার স্থাপনা করেন। দেবীমূর্তির জন্য একটী ছাদওয়ালা মন্দির প্রস্তুত হয়, উহার চতুর্দিকে প্রাচীর বেষ্টিত করিয়া পুষ্পোদ্যান রচিত হয়; নহবৎখানা প্রস্তুত হয় এবং সেবার সর্ব্ববিধ ব্যাপারের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বৃত্তির ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া হয়। বাঁকার নিকটবর্ত্তী রামনগর গ্রামনিবাসী কালীনাথ চক্রবর্ত্তী নামক একজন বিশেষ নিষ্ঠাবান্ পণ্ডিতের উপর স্বপ্নাদেশ অনুসারে যথাবিধি পূজার ভার অর্পিত হয়।[৩৩] তিনি মূর্ত্তির দেবতা নির্ণয় করিয়া উহার পূজা আরম্ভ করেন।

যাঁহাকে সাধারণ লোকে পরীমালা বলিয়া জানে, তিনি চামুণ্ডা দেবী। চণ্ডমুণ্ডা অসুরের নিপাত জন্য মহাদেবী এই করালবদনা চামুণ্ডা মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়াছিলেন। আমাদিতেও দেবীমূর্ত্তির নিম্নলিখিত ‘চামুণ্ডা’ ধ্যানে পূজা হয় :

ওঁ কালী করালবদনা বিনিষ্ক্রান্তাসিপাশিনী
বিচিত্রখট্টাঙ্গধরা নরমালাবিভূষণা।
দ্বীপিচৰ্ম্মপরীধানা শুষ্কমাংসাতি ভৈরবা
অতি বিস্তারবদনা জিহ্বাললনভীষণ।
নিমগ্নারক্তনয়না নাদাপূরিতাদি খা।
ওঁ ক্রীং হ্রীং চামুণ্ডারূপায়ৈ দুৰ্গায়ৈ নমঃ॥[৩৪]

এই মূৰ্ত্তিটি একখানি ২ ́-৩ ́X১ ́-১০ ́ প্রস্তরের উপর উৎকীর্ণ ছিল। মূর্ত্তির চারিখানি হস্ত। নরমুণ্ডমালার একটু একটু চিহ্ন আছে। নিম্নে অসুরাদি অঙ্কিত ছিল বুঝা যায়। বক্ষের উপর দুইটি শূন্যগর্ভ প্রস্তরপিণ্ড আছে, উহা স্তনযুগল ব্যতীত অন্য কিছু হইতে পারে না। কিন্তু দেহের অনুপাতে উহার অস্বাভাবিক আকার ও মধ্যে ফাঁপা দেখিয়া কেমন সন্দেহ হয়। মস্তকে প্রস্তরের মুকুট ছিল, সমগ্র প্রস্তরখানি প্রায় দুই মণ ভারী হইবে। অতিকষ্টে প্রস্তরখানিকে দরজার বাহিরে আনিয়া ফটো লওয়া হইয়াছিল। কিন্তু উহা এত অস্পষ্ট এবং অতিরিক্ত মসী ও তৈল-সঞ্চয়ে বিকৃত যে ইহার ভাল ফটো হয় নাই। কিন্তু তাহা হইলেও যে ছবি প্রদত্ত হইল, উহা হইতে দেবীমূর্তির কিছু আভাস পাওয়া যাইবে এবং উহার ভাস্কর্য্য যে অতি প্রাচীন যুগের, তাহাও অনুমিত হইতে পারিবে। যাজপুরে বৈতরণী-তটে যে চামুণ্ডা দেবীর ভীষণ মূর্ত্তি দেখিয়াছি, বঙ্কিমচন্দ্রের অমর লেখনীর মুখে যে ‘বিশুষ্কাস্থিচর্ম্মমাত্রাবশেষা, পলিতকেশা, নগ্নবেশা, খণ্ডমুণ্ডধারিণী ভীষণা চামুণ্ডার’ ধ্যানমূর্ত্তি[৩৫] ফুটিয়া উঠিয়াছে, এখানেও সেই একই দেবীবিগ্রহ সুন্দরবনের মৃত্তিকার দোষে বিকৃত হইয়াছেন।

খুলনা জেলার বাগেরহাট উপবিভাগে বাগেরহাট সহর হইতে ৫/৬ মাইল দূরে পাণিঘাটে এক অষ্টাদশভুজা দেবীমূৰ্ত্তি আছেন। পাণিঘাট অতি প্রাচীন স্থান এবং এই ক্ষুদ্রকায় দেবমূৰ্ত্তিও আদিযুগের বলিয়া অনুমান করা যায়। এই মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে প্রধানতঃ দুইটী মত আছে। আমরা প্রথমতঃ সেই দুই গল্প বিকৃত করিয়া তৎসম্বন্ধে আমাদের মতামত প্রকাশ করিব। পাণিঘাট এক্ষণে গোবরডাঙ্গার জমিদার বাবুদের চিরুলিয়া পরগণার অধীন। এখানে মায়ের মন্দির ভৈরব নদের কূলে অবস্থিত। মন্দিরের পুরোহিত ও স্থানীয় লোকে বলেন যে, পুরোহিত বংশের ৮/১০ পুরুষ পূর্ব্ববর্ত্তী রাজীবলোচন চক্রবর্ত্তী এই মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান কালীবাড়ীর দক্ষিণ- পশ্চিম কোণে নদীকূলে ভীষণ জঙ্গল ছিল। প্রবাদ এই-তখন এখানে সুন্দরী, পশুর প্রভৃতি বৃক্ষও ছিল। রাজীবের স্ত্রী প্রসববেদনায় অত্যন্ত কষ্ট পাইতেছিলেন বলিয়া রাজীব একটি ঔষধের অনুসন্ধানে এই বনের মধ্যে প্রবেশ করেন। তিনি বৃক্ষতলে এক সন্ন্যাসীকে দেখিতে পান ও তাঁহার পা ধরিয়া কাঁদিয়া পড়েন। সন্ন্যাসী সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ একটা অব্যর্থ ঔষধ দেন ও বলিয়া দেন যে, তাঁহার একটী কন্যাসন্তান হইবে এবং সন্ন্যাসী যে সেখানে আছেন, তাহা অন্যের নিকট প্রকাশ করিতে নিষেধ করেন। সন্ন্যাসী যেমন বলিয়াছিলেন, রাজীবের একটি কন্যাসন্তান হইল। তখন সন্ন্যাসীর প্রতি রাজীবের ভক্তি বাড়িয়া গেল। তিনি প্রত্যহ গোপনে সন্ন্যাসীর নিকট যাইতে লাগিলেন এবং তাঁহার কৃপা লাভে দীক্ষিত হইয়া প্রায় ছয়মাস কাল তন্ত্রাদি শাস্ত্রীয় উপদেশ সন্ন্যাসীর নিকট লাভ করেন। এমন সময় বাৎসরিক শ্যামাপূজার দিনও নিকটবর্ত্তী হইল। সন্ন্যাসী বলিলেন, ‘রাজীব! তোমাকে এই স্থানে একখানি কালীমূৰ্ত্তি গড়িয়া পূজা করিতে হইবে।’ রাজীব দরিদ্র ব্রাহ্মণ বলিয়া পূজার আয়োজন করিতে ভয় পাইলেন দেখিয়া সন্ন্যাসী বলিলেন, ‘তুমি মৃত্তিকা আনিয়া দাও, আমি মূৰ্ত্তি গড়িয়া দিব, তুমি পুষ্পপত্রে পূজা করিবে মাত্র।’ তাহাই হইল। সন্ন্যাসী স্বহস্তে কালীমূর্তি গড়িয়া দিলেন, রাজীব উপদেশ মত পূজা করিলেন। কিন্তু পূজান্তে সন্ন্যাসীর আদেশমত প্রতিমা বিসর্জ্জন করা হইল না। রাজীব বলিলেন, ‘কোন অনাদি মূৰ্ত্তি ব্যতীত কি পীঠস্থান হয়?’ তদুত্তরে সন্ন্যাসী তাঁহাকে নদীগর্ভে একটা স্থানে ডুব দিয়া যাহা পাওয়া যাইবে, তাহা তুলিয়া আনিতে বলিলেন। রাজীব নির্দ্দিষ্ট স্থানে ডুব দিয়া এক অষ্টাদশভুজা মহিষমৰ্দ্দিনী কালীমূর্ত্তি পাইলেন। পরে উহাই তন্ত্রোক্ত আসনে সংস্থাপন পূৰ্ব্বক পূজাপদ্ধতি প্রচলন করিলেন। তদনন্তর সন্ন্যাসী অন্তর্হিত হইলেন।

রাজীবের একটী কন্যা ও একটী পুত্র ছিল। পুত্রটি পূর্ণবয়স্ক হইয়া যোগ শিক্ষাকালে হঠাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কন্যা হইতে রাজীবের দৌহিত্রবংশ ছিল। সে বংশের শেষ বংশধর রামানন্দ চক্রবর্ত্তী ১৫/১৬ বৎসর হইল লোকান্তরিত হইয়াছেন। রাজীবের জ্যেষ্ঠভ্রাতা শ্রীরামের বংশ আছে। শ্রীরামের দুই পুত্র,-রামদেব ও রামকান্ত। রামদেবের বংশের অধস্তন তারাপদ চক্রবর্ত্তী এবং রামকান্তের বংশের ১০২ বৎসর বয়স্ক রামবিষ্ণু চক্রবর্ত্তী। দুঃখের বিষয় ইঁহারা পূর্ব্বপুরুষের কোন বিশেষ বৃত্তান্ত জানেন না।

অষ্টাদশভুজার প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে দ্বিতীয় বিবরণ কমলাকান্ত সাৰ্ব্বভৌম-প্রণীত ‘দ্বিগঙ্গা- রাজবংশম্’ নামক সংস্কৃত পুঁথি এবং মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়-প্রণীত ‘বাসুকী-কুলগাথা’ নামক বাঙ্গালা পুঁথি হইতে জানা যায়।[৩৬] উভয় পুঁথিতে বিশেষ সামঞ্জস্য আছে। বিশেষতঃ বাসুকীকুলগাথায় বহুস্থানে তারিখ দেওয়া হইয়াছে এবং তারিখগুলি ঐতিহাসিক তারিখের সহিত সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য রক্ষা করে। এই পুঁথি অনুসারে দ্বিগঙ্গা-সেনবংশীয়[৩৭] রুদ্রনারায়ণ বরিশালের অন্তর্গত রায়েরকাঠিতে এক রাজ্য স্থাপন করেন এবং রাজা উপাধি পান।[৩৮] রুদ্রনারায়ণের চারি পুত্র ছিল, তন্মধ্যে গন্ধর্ব্বনারায়ণ সর্ব্বকনিষ্ঠ, তিনি অংশমত চিরুলিয়া পরগণা প্রাপ্ত হইয়া তথায় আসিয়া প্রাসাদ নিৰ্ম্মাণ করিয়া বাস করেন। তাঁহার পুত্র রাজচন্দ্র অল্পবয়সে সান্নিপাত জ্বরে অজ্ঞান হন এবং রাজবৈদ্যেরা তাঁহার জীবনসঞ্চার করিতে পারেন না। এমন সময় হঠাৎ এক সন্ন্যাসী আসিয়া সেই মৃত কুমারকে ডাকিবামাত্র তাঁহার চৈতন্যোদয় হয় এবং সন্ন্যাসী তাঁহাকে ডাকিয়া নদীর কূলে জঙ্গলের মধ্যে লইয়া যান। রাজা রাণী সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়াছিলেন। সন্ন্যাসী রাজচন্দ্রকে দীক্ষিত করিবার জন্য তাঁহাদিগকে ‘পাণি আন’ বলিয়াছিলেন। দীক্ষান্তে সন্ন্যাসী পুনরায় পঞ্চম বৎসরে মহাষ্টমীদিনে সেই স্থানে সাক্ষাৎ হইবে বলিয়া অন্তর্ধান হন। ক্রমে গল্প যত রটিল, এই স্থান বিখ্যাত হইয়া উঠিল।

‘বহু লোক সমাগমে তথা হইল হাট।
তদবধি সে স্থানের নাম পাণিঘাট।।’

অল্পদিন পরে ১৭৩৭ খৃষ্টাব্দে গন্ধর্ব্বের লোকান্তর হইল৩৯ এবং রাজচন্দ্র পরে পঞ্চম বর্ষে মহাষ্টমীর দিনে সেই স্থানে সন্ন্যাসীর দর্শনলাভ করিলেন। সন্ন্যাসী তাঁহাকে গোপাল, বাসুদেব, শ্যামরায়, লক্ষ্মীনারায়ণ প্রভৃতি কতকগুলি দেববিগ্রহ দিয়াছিলেন; এবং সৰ্ব্ব শেষ—

‘পরে গুরু অন্য এক মূর্তি দিল ফিরি।
বাহির করিল মূর্ত্তি জটাজাল চিরি।।
অষ্টাদশভুজা আদ্যাশক্তির প্রতিমা।
তাঁহার রূপের কথা দিতে নারি সীমা।।’

এবং সে মূর্ত্তি পঞ্চমুণ্ডী আসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়া নিত্য-পূজার ব্যবস্থা করিতে বলিয়া দেন। সন্ন্যাসীর নাম ব্রহ্মাণ্ডগিরি।

রাজচন্দ্র তখন রামকান্ত বিদ্যাবাগীশ ও কমলাকান্ত সাৰ্ব্বভৌম নামক তাঁহার কুল-পুরোহিত ভ্রাতৃদ্বয়কে ডাকিয়া পাণিঘাটে বটমূলে মূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়া মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দেন।

উপরি লিখিত বিবরণ হইতে দেখা গেল যে, পাণিঘাটে মূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠা ১৭৩৭ খৃষ্টাব্দের পর হইয়াছে। পুরোহিতদিগের বিবরণ হইতে দেখা যায়, রাজীবের পর তাঁহারা ৮/১০ পুরুষ বাস করিতেছেন। এই পুরোহিত-বংশ যেরূপ দীর্ঘায়ু তাহাতে অনুমান করা যায় যে ১০ পুরুষে ৪০০ বৎসর অতিবাহিত হইয়াছে। অর্থাৎ রাজীব পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বা ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমে দেবীমূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু পাণিঘাটের নাম ইহা অপেক্ষাও প্রাচীন বলিয়া বোধ হয়। যখন রাঙ্গদিয়া, মধুদিয়া প্রভৃতি দ্বীপের সৃষ্টি হইতেছিল, সে সকল স্থানে কোন বসতি হয় নাই, উহার দক্ষিণ দিয়া পশর পর্য্যন্ত বিস্তৃত স্থান জলমগ্ন ছিল, তখনও পাণিঘাটের নাম শুনা যায়। পাণিঘাট হইতে পশর নদীর পার্শ্ববর্ত্তী কুড়লতলা পর্যন্ত একটি খেয়া পড়িত, ইহার এক খেয়া দিতে এক দিন লাগিত। তখন এই দিকে ভৈরবের দক্ষিণে ও পশরের পূর্ব্বে কোন বসতিস্থান ছিল না। খুলনা জেলায় এ কথা অনেকস্থানে সাধারণ প্রবাদবাক্যে পরিণত হইয়া রহিয়াছে। দেশের প্রকৃতি দেখিলেও তাহা অনুমান করা যায়। ইহাতে ভূতের গল্প কিছু নাই। লোকপরস্পরাগত এই সকল প্রবাদ উড়াইয়া দেওয়া চলে না। সুতরাং অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাণিঘাটের নামোৎপত্তি হইয়াছে, একথা স্বীকার করা যায় না, অথচ পুঁথিগত তথ্যেরও একটা ভিত্তি থাকা সম্ভব।

সকল অবস্থা পৰ্য্যালোচনা করিয়া আমাদের মনে হয়, পাণিঘাট অতি পুরাতন স্থান। সেন রাজগণের রাজত্বকালেও এখানে দেবীপীঠ ছিল। পরে পাঠান আমলের প্রাক্কালে এ অঞ্চলে যে বিপ্লব হয়, তাহাতে এ প্রদেশ বসিয়া গিয়া ভীষণ জঙ্গলাবৃত হইয়া পড়ে। পাঠান আমলের মধ্যভাগে পুনরায় এ দেশ আবাদ হইয়া লোকের বসতি হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন খাঁ জাহানালি বাগেরহাটে এক শাসন-কেন্দ্র খুলিয়াছিলেন, তাহার কিছু পূৰ্ব্ব হইতে বৰ্ত্তমান খুলনার পূর্ব্ব হইতে ভৈরব-কূল দিয়া বসতি স্থাপিত হইয়া ক্রমশঃ পূৰ্ব্বমুখে অগ্রসর হইতেছিল। এই অংশে ভৈরবের কূলবর্তী গ্রামসমূহের আদিম অধিবাসীদিগের বংশ-বিবরণ হইতে এই একই কথা সপ্রমাণ হয়; যথাস্থানে আমরা তাহার আলোচনা করিব। এই সকল আদিম ‘বাসিন্দাদিগের’ সময়ে পাণিঘাটে দেবীমূৰ্ত্তি পুনঃ প্রতিষ্ঠা হয় বলিয়া বিশ্বাস। পূৰ্ব্বকাল হইতে দেবীমূর্ত্তি এই স্থানেই জঙ্গলের মধ্যে নদীর কূলে বা গর্ভে ছিল। এক সন্ন্যাসী আসিয়া সে মূর্ত্তি আবিষ্কার করেন। পুরোহিতগণের বিবরণেও তাহাই আছে; সন্ন্যাসী জঙ্গলের মধ্যে এক পশুর বৃক্ষের তলে বসিয়া ছিলেন, তিনি রাজীবকে নদীতে নামিয়া দেবীমূৰ্ত্তি উঠাইবার স্থান নির্দ্দেশ করিয়া দেন। সন্ন্যাসী জটাজাল চিরিয়া দেবীমূর্তি বাহির করিলেন, একথা বিশেষ বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া বোধ হয় না। প্রায় ৬/৭ ইঞ্চি দীর্ঘ ও ৫ ইঞ্চি প্রস্থ বিশিষ্ট প্রস্তরময়ী ভারী দেবীমূর্ত্তি জটাজালের মধ্যে লুকাইয়া রাখা যায়, এবং জটাজাল চিরিয়া তথা হইতে বহুদিনের স্থাপিত মূর্তি বাহির করিতে হয়, ইহা সম্ভবপর বলিয়া মনে হয় না। পুঁথিতে আছে শুধু এমূৰ্ত্তি নহে, সন্ন্যাসী আরও অনেক মূৰ্ত্তি দিয়া যান। দ্বাদশ গোপাল, বাসুদেব, শ্যামরায়, কালাচাঁদ ঠাকুর, লক্ষ্মীনারায়ণ প্রভৃতি প্রস্তরনির্ম্মিত বিগ্রহগুলিও ব্রহ্মাণ্ডগিরি সন্ন্যাসী রাজচন্দ্রকে দেন।[৪০] হয়ত জঙ্গলের মধ্যে কোন প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষ নদীর জল পর্যন্ত ছিল, উহার মধ্যে সন্ন্যাসী এই সকল মূৰ্ত্তি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ভৈরবের গর্ভ খাতে নানাস্থানে এরূপ মূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। পাণিঘাটের নিকটবর্ত্তী লাউপালা গ্রামের পার্শ্বস্থ মরা ভৈরবের প্রাচীন খাতে জালিয়াদিগের জালে একটি চতুর্ভুজ বাসুদেব মূর্ত্তি উঠে। ঐ সুন্দর মূর্ত্তিটির মধ্যস্থানে কতকটা ভাঙ্গিয়া যাওয়ায় মূর্তিটি সখিচরণ দাস মহান্ত কর্তৃক লাউপালার গোপাল মন্দিরের বহির্দ্বারে দেওয়ালের ভিতর গাঁথিয়া রাখা হয়। উক্ত গোপাল বিগ্রহও এক সন্ন্যাসীর নিকট হইতে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল। সেও আজ দেড় শত বৎসরের কথা।

অষ্টাদশভুজার মূর্ত্তি দেখিলেও তাহা অতি প্রাচীন যুগের ভাস্কর্য্যের পরিচয় দেয়। অতি প্রাচীন কঠিন কষ্টি পাথরের প্রস্তুত হইলেও বহুযুগের কালধর্ম্মে ইহা অনেকটা ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছে।

তান্ত্রিকগণ বলেন শতভুজা বা অষ্টাদশভুজা প্রভৃতি অধিক সংখ্যক ভুজবিশিষ্টা মূৰ্ত্তি হিমালয়ের উপরই নির্ম্মিত ও প্রতিষ্ঠিত হইত, ক্রমে হিমাচল হইতে যত দূরে যাওয়া যায়, তত হস্তসংখ্যা কমিয়া মায়ের মূর্ত্তি অষ্টভুজা বা চতুর্ভুজা ও অবশেষে দ্বিভুজা হইতে থাকে। কোন্ অনাদিযুগে এই সকল মূৰ্ত্তি প্রস্তুত হইয়া ক্রমে বঙ্গদেশের বহু পীঠস্থানে নীত ও স্থাপিত হইয়াছিলেন, তাহা জানিবার উপায় নাই। মোট কথা কপিলেশ্বরী কালীমূর্তি, যশোরেশ্বরী কালীমূর্তি, আমাদির চামুণ্ডামূর্ত্তি এবং পাণিঘাটের অষ্টাদশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্ত্তি যশোহর-খুলনার প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য দিতেছেন।

পাদটীকা :

১. ‘ইমাঃ প্রজাস্তিস্রো অত্যায়মায়ং স্তানীমানি বয়াংসি
বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদান্যন্যা অকমভিতো বিবিএ ইতি’–ঐতরেয় আরণ্যক, ২/১/১

২. পণ্ডিতপ্রবর সত্যব্রত সামাশ্রমী প্রণীত ত্রয়ী-টীকা, ১৩৬ পৃ। বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণ কাণ্ড, ৫৬ পৃ। ‘বেদে যে নিষাদের উল্লেখ আছে…ভাগবত-পুরাণ যাহাদের বর্ণনা করিয়াছেন কাককৃষ্ণ, অতি খর্বকায় খর্ববাহু, প্রশস্তনাসিকা, রক্তচক্ষু ও তাম্রকেশ বলিয়া, সেই নিষাদরাও আদি-অস্ট্রেলীয়দেরই বংশধর বলিয়া অনুমান করিলে অন্যায় হয় না।’-বাঙ্গালীর ইতিহাস, ৪১ পৃ।—শি মি

৩. ‘শনৈকস্তু ক্রিয়ালোপাৎ ইমাঃ ক্ষত্রিয়জাতয়ঃ।
বৃষলত্বগতা লোকে ব্রাহ্মণাদর্শনেন চট্ট’—মনুসংহিতা, ১০/৫৩

৪. ‘অঙ্গবঙ্গকলিঙ্গেষু সৌরাষ্ট্র-মগধেষু চ।
তীর্থযাত্রাং বিনা গচ্ছন্ পুনঃ সংস্কারমহতি।’

এই শ্লোকটি মনু হইতে উদ্ধৃত বলিয়া উল্লিখিত হইয়া আসিতেছে, কিন্তু প্রচলিত কোন মনুসংহিতায় এ শ্লোকটি পরিদৃষ্ট হয় নাই। বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণকাণ্ড, ৫৭ ও ৭৮ পৃ, এবং বাঙ্গালার পুরাবৃত্ত, ১১৮ পৃ। [ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই বক্তব্যকেই স্বীকৃতি দিয়াছেন।—বাঙ্গালার ইতিহাস, ১ম ভাগ, ৩য় সংস্করণ, ২৪ পৃ–শি মি]

৫. বৌধায়ন, ১/১/২

৬. ‘দ্রাবিড়াঃ সিন্ধুসৌবীরাঃ সৌরাষ্ট্রা দক্ষিণাপথাঃ।
বঙ্গাঙ্গমগধামৎস্যাঃ সমৃদ্ধাঃ কাশীকোশলাঃ॥’ ইত্যাদি— রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, ১০ম।

৭. ‘বঙ্গান্ উৎখায় তরসা নেতা নৌসাধনোদ্যতান্।
নিচখান জয়স্তম্ভান্ গঙ্গাস্রোতোহস্তরেষু সঃ’—রঘুবংশ, ৪র্থ সর্গ, ৩৬ শ্লোক।

৮. সগরের পুত্র অসমঞ্জা, তৎপুত্র অংশুমান, তৎপুত্র দিলীপ এবং দিলীপের পুত্রই ভগীরথ।

৯. কবিকঙ্কণ চণ্ডী, শ্রীমন্তের সিংহল যাত্রা, এলাহাবাদ সংস্করণ, ২৪০ পৃ।

১০. হরিশ্চন্দ্র তর্কালঙ্কার প্রণীত ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্রের’ মুখপত্রেই এই পংক্তিটি উদ্ধৃত আছে : “The last king of Saugar Island’; কোথা হইতে উদ্ধৃত তাহা স্পষ্ট জানিতে পারি নাই। See Calcutta Edition, 1856.

১১. প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় প্রাচীন ম্যাপ হইতে প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে সগরদ্বীপই চ্যাণ্ডিকান। এ সম্বন্ধে তিনি দীর্ঘ আলোচনা করিয়াছেন। ‘প্রতাপাদিত্য’, উপক্রমণিকা, ১৩৬ ও ১৪৫ পৃ। এ বিষয়ে আমাদের যাহা বক্তব্য, প্রতাপাদিত্য প্রসঙ্গে বলিব। (২য় খণ্ড, মোগল আমল, ১৬শ পরিচ্ছেদ)

১২. ‘Two years befores the foundation of Calcutta, it (Sagar Island) contained a population of 200,000 souls, which in one night in 1688 was swept away by an inundation.’-Calcutta in the olden time, Calcutta Review, No. XXXVI.

১৩. ‘As early as 1811 one Mr. Beaumont applied for lease &c., and attempt went on up to 1820 and failed completely. It is now almost uninhabited.’ – Hunter, Sir W. Statistical Accounts, Vol. 1, P. 106.

১৪. মহাভারত, কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ, সভাপৰ্ব্ব, ২৯ অধ্যায়।

‘সমুদ্রসেনং নিজ্জিত্য চন্দ্রসেনঞ্চ পার্থিবম্।
তাম্রলিপ্তঞ্চ রাজানং কৰ্ব্বটাধিপতিং তথা।’

[প্রফেসর হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী কবট মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত হইবে বলিয়া অনুমান করিতে চান। History of Bengal, Dacca Univ, vol. 1, p-9, 1943. —শি মি]

১৫. দ্রোণপর্ব্ব, ১১৯/১৫, এখানে শক, কিরাত, দরদ, বর্ঝর ও তাম্রলিপ্তক প্রভৃতি ম্লেচ্ছ বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে।

১৬. সভাপর্ব্ব, ৬১/১৬-১৯

১৭. উদ্যোগপর্ব্ব, ১৬৯ অধ্যায়।

১৮. পৌণ্ড্রকের নানা অদ্ভুত অভিযানের বিষয় হরিবংশের ভবিষ্যপর্ব্বে বর্ণিত হইয়াছে। এই ভবিষ্যপর্ব্বের কতকাংশ হস্তলিখিত পুঁথিতে নাই এবং টীকাকার নীলকণ্ঠ ইহার টীকাও করেন নাই। এজন্য কেহ কেহ অনুমান করেন, এ অংশ প্রক্ষিপ্ত। কিন্তু এসিয়াটিক সোসাইটির মুদ্রিত পুস্তকে সেরূপ ধরা হয় নাই। যাহা হউক, পৌণ্ড্রকের নাম মহাভারতে কয়েক স্থানে আছে; বিষ্ণুপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ প্রভৃতি পুরাণেও পৌণ্ড্রক বাসুদেবের কথা আছে। তিনি যে ঐতিহাসিক ব্যক্তি, তৎপক্ষে সন্দেহ নাই। বঙ্গবাসী সংস্করণের হরিবংশে উদ্ধৃত ভবিষ্য পূৰ্ব্ব দ্রষ্টব্য।

১৯. ‘গন্ধর্ব্বাণাং চিত্ররথঃ সিন্ধানাং কপিলো মুনিঃ।’ গীতা ১০/২৬

ভাগবতের মতে সাংখ্যকার কপিল ভগবানের পঞ্চম অবতার; তাঁহার পিতার নাম কর্দ্দম, মাতার নাম দেবহুতি।

২০. ইঁহারা বোধখানার চৌধুরী-বংশীয়। কমলাকান্তের ভ্রাতা রঘুনন্দনের বংশে আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্রের জন্ম। বিশেষ বিবরণ ২য় খণ্ডে মোগল আমল, ৪৪শ পরিচ্ছেদে আছে।

২১. Westland’s Report [1871],. p. 53.

২২. সম্ভবতঃ এইস্থানে যে অতীব সুন্দর গঙ্গামূর্তির পূজা হইত, মহারাজ প্রতাপাদিত্য সগরদ্বীপ অধিকার করিবার পর উহা স্বীয় রাজধানী যশোহর-ধূমঘাটে লইয়া গিয়া প্রতিষ্ঠিত করেন। সে কথা পরে বলিতেছি।

২৩. বিনোদবিহারী তৈলিকজাতীয় একজন সঙ্গতিসম্পন্ন ভাগ্যবান পুরুষ। কলিকাতায় তাঁহার বড় দুইটি তৈলের কল আছে, তাঁহার নামীয় ‘বিনোদ মার্কা খাঁটি সরিসার তৈল’ এক্ষণে বঙ্গদেশের সর্ব্বত্র ব্যবহৃত হইতেছে। খুলনা জেলায় ব্যবসায়ী জাতির মধ্যে সঙ্গতিসম্পন্ন লোক অনেক আছেন, কিন্তু অল্পবয়স্ক বিনোদবিহারীর মত পরহিতব্রত কর্ম্মবীর অতীব বিরল। তিনি স্বজাতিকুলতিলক, বঙ্গীয় তেলিজাতি- সম্মিলনীর সভাপতি এবং খুলনা তেলী জাতীয়-ভাণ্ডারের প্রতিষ্ঠাতা হইয়া তিনি স্বীয় সমাজের অশেষ উন্নতি বিধান করিতেছেন। তাঁহার মত পিতৃভক্ত ও স্বদেশভক্ত অধিবাসী অধিক থাকিলে খুলনার সৌভাগ্যের সীমা ছিল না। বিনোদবিহারী প্রায় লক্ষ টাকা ব্যয়ে কপিলমুনি গ্রামে স্বীয় পিতার নামে ‘যাদবচন্দ্র দাতব্য চিকিৎসালয় ও হাসপাতাল’ স্থাপন করিয়াছেন এবং মাতার নামে তাঁহার সেই নিজগ্রামে ‘কপিলমুনি সহচরী বিদ্যালয়’ নামক উচ্চ ইংরাজী স্কুল প্রতিষ্ঠা করিয়া তজ্জন্য সুন্দর অট্টালিকা নির্ম্মাণ করিয়া দিয়াছেন। গত বৎসর (১৯২৭) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর স্বয়ং গিয়া এই বিদ্যামন্দিরের দ্বারোদঘাটন করেন। গত ১৩২৭ সালে যখন খুলনায় ভীষণ দুর্ভিক্ষ হয়, তখন বিনোদবিহারী স্বীয় বাটীতে পিতামহের নামে ‘ভরতচন্দ্র দুর্ভিক্ষ ভাণ্ডার খুলিয়া কয়েকমাস যাবৎ বাটীর নিকটবর্ত্তী ৪/৫ মাইলের অধিবাসী নিরন্ন প্রতিবেশীকে অজস্র অন্ন, অর্থ ও বস্ত্র দিয়া রক্ষা করেন। এই সকল অবদানের সামান্যমা গুণগ্রাহিতার নিদর্শন স্বরূপ সদাশয় গবর্ণমেণ্ট বিনোদবিহারীকে ‘রায় সাহেব’ উপাধি ভূষিত করিয়াছেন। তাঁহার নিকট হইতে তাঁহার স্বদেশবাসীর যেমন আরও প্রত্যাশা আছে, তিনিও তেমনি আরও উচ্চ সম্মানের অধিকারী হইবেন।

২৪. কণ্ঠহারের বীর্য্যে নীচ যোনিজ পুত্রগণ জঙ্গল বাধা ও চালিথা বেষ্টক (চাল্লাবাড়িয়া) গ্রামে বাস করিত। চাল্লাবাড়িয়া বৈদিক ব্রাহ্মণবংশীয় রায়দিগের অধীন ছিল। জঙ্গল বাধা বা জঙ্গল বাধাল যশোহরে সিঙ্গিয়া ষ্টেশনের সন্নিকটে এবং চাল্লাবাড়িয়া কপোতাক্ষের সন্নিকটে সারসা থানার অন্তর্গত।

২৫. Quoted from the translation of judgment of Special Court of Calcutta and Murshidabad, 4-5-1842. Kali kinkar Adhikori of Iswaripur, Pergunnah Dhuliapur VS. Government.

এই মোকদ্দমার রায় ও তাহার অনুবাদের সহিমোহর নকল ঈশ্বরীপুর নিবাসী মায়ের ভক্ত সেবায়েৎ শ্রীশচন্দ্র অধিকারী মহাশয়ের বাটীতে রক্ষিত হইয়াছে।

২৬. এই মূৰ্ত্তিটি দেবী অন্নপূর্ণা কিনা তাহা পরে আলোচনা করা যাইবে।

২৭. অক্ষয়কুমার মৈত্রের—’শ্রীমূৰ্ত্তি-বিবৃতি’ প্রবন্ধ, বঙ্গদর্শন, নবপৰ্য্যায় মাঘ, ১৩১৬।

২৮. ‘Greek and Italian art would bring the gods to earth, and make them the most beautiful of men, Indian art raises men up to heaven and makes them even as the gods’. Havell’s Indian Sculpture and Painting, p. 83.

২৯. “A people, superstitious like the Hindus, were no less influenced by on of the best specimens of Hindoo Sculpture in the frightful image of Jashareswari. For a better conception of the terrific  realised in human countenance by the aid of art, is scarcely to be met with in India except perhaps in the figure of Shani to be seen in the temple of Sambaleswari at Sambulpur.’-Mookerjee’s Magazine, July, 1872; Antiquities of Jessore’ – Iswaripur, by Rashbehari Bose.

৩০. “The Sculpture has certainly succeeded in producing a more disagreeable image of death than any other artist has imagined; there is nothing in Holbeins’ Dance of Death quite so horrible.’

এই প্রসঙ্গে বঙ্গদর্শন নবপৰ্য্যায়, ১০ম সংখ্যা, ৪৫৯ পৃ দ্রষ্টব্য।

৩১. বহুজনে যশোরেশ্বরীর মূর্ত্তির ফটো লইতে গিয়া অকৃতকাৰ্য্য হইয়াছেন। মন্দিরের ভিতরে তৈলাক্ত কৃষ্ণপ্রস্তরের মূর্ত্তির ফটো তোলা কঠিন ব্যাপার। আমরাও ২/৩ বার চেষ্টা করিয়া ভাল ছবি করিতে পারি নাই। একবার একখানি আয়না হইতে মায়ের মুখের উপর সূর্য্যলোক প্রতিফলিত করিয়া মুখমণ্ডলের ছবি লইয়াছিলাম বটে, কিন্তু নিম্নাংশের কোন ছায়া ধরিতে পারি নাই। অবশেষে মদীয় বন্ধু যশোহর শিবানন্দকাঠী নিবাসী সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় ফটোগ্রাফে খুব ভাল ছবি তুলিতে না পারিয়া, মাসাধিক কাল মন্দিরে থাকিয়া মায়ের এক বর্ণচিত্র প্রস্তুত করেন। উহা হইতে এক ব্লক প্রস্তুত করিয়া তিনি বৃহদাকারে ছবি প্রস্তুত করত প্রকাশিত করিয়াছেন। তাঁহারই সাগ্রহ সম্মতিতে সে ছবি হইতে আমি এই বর্ণচিত্র প্রকাশ করিলাম; বিশেষভাবে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি যে, এ ছবি সম্পূর্ণ মূলানুগত হইয়াছে।

৩২. বিশ্বকোষে যশোরেশ্বরীকে শিলাদেবী বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। তাহার মতে এই শিলাদেবীকে মানসিংহ অম্বরে লইয়া যান এবং তৎপরে কচুরায় ঈশ্বরীপুরে এক নূতন প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত করেন। এ কথা ঠিক নহে। এই পুস্তকের দ্বিতীয় খণ্ডে (মোগল আমল, ৩১শ পরিচ্ছেদে) প্রতাপাদিত্যের সময়ে যশোরেশ্বরীর আবির্ভাব প্রসঙ্গে তাহার আলোচনা করা হইবে। মূর্তির প্রকৃতি দেখিয়া যাঁহারা উহার সময়ের একটা অনুমান করিতে পারেন তাঁহারা নিঃসন্দেহে বলিবেন যে, যশোরেশ্বরীর মূর্ত্তি কচুরায়ের সময়ের হইতে পারে না। সে মূৰ্ত্তিতে যে হস্তপদ নাই, তাহাও প্রকৃত সত্য। সকলেই দূরে বসিয়া প্রবন্ধ রচনা করেন। স্বচক্ষে দেখিয়া ধীরভাবে ভাবিয়া লিখিবার প্রথা এখনও বিশেষভাবে বঙ্গদেশে আসে নাই। বঙ্গেতিহাস উদ্ধারের ইহাই প্রধান অন্তরায়। বিশ্বকোষ, প্রথম খণ্ড, ৪৯৭ পৃ দ্রষ্টব্য।

৩৩. কিছু দিন পরে কালীনাথ চক্রবর্ত্তী আমাদি গ্রাম নিবাসী শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়কে পৌরোহিত্যে প্রতিনিধি রাখিয়া যান। এই গাঙ্গুলী বংশের দৌহিত্র-কুলোদ্ভব সীতানাথ চক্রবর্ত্তী মহাশয় এক্ষণে পুরোহিত আছেন। পূর্ব্বোক্ত জমিদার মহাশয়গণ মায়ের পূজার জন্য যে বৃত্তির ব্যবস্থা করেন, তাহা বৰ্ত্তমান সময়ে সদাশয় গবর্ণমেন্টের অনুগ্রহে ৫৬ টাকা ছয় আনা রাজস্বের একটা নির্দ্দিষ্ট তালুকে পরিণত হইয়াছে এবং উহাতে ১৫০ টাকার অধিক আয় আছে। এক সময়ে রাজস্বের অনাদায় জন্য এই তালুক বিক্রীত হইবার উপক্রম হইলে, আমাদি নিবাসী সারদাচরণ সিংহ ও মহেন্দ্ৰনাথ সিংহ টাকা আমানত করিয়া দিয়া বিষয় রক্ষা করেন; তাহার ফলে তাঁহারা তালুকের অর্দ্ধাংশ ভোগ করিতেছেন। সুতরাং এখনও বৃত্তির বন্দোবস্ত আছে, কিন্তু মায়ের পূজার অবস্থা তেমন নাই। এখনও বহু দূরবর্তী স্থানের লোক এখানে পূজা দিতে আসে, কিন্তু দেবায়তনের তেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, পুরোহিতের তেমন পূজার ব্যবস্থা এখন আর নাই।

৩৪. মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে চণ্ডমুণ্ডবধাধ্যায়ে এই চামুণ্ডাদেবীর আবির্ভাব বর্ণিত হইয়াছে। সেই স্থানেই দেবীর এই ধ্যান আছে। আমাদিতে যে ধ্যানে পূজা হয় তাহাতে যে বীজমন্ত্র আছে, তাহা ঠিক কিনা বলিতে পারি না। অন্যত্র চামুণ্ডাবীজ এঁ, হ্রী, ক্লী,—এইরূপ উক্ত হইয়াছে। [বিশ্বকোষ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২৪৮ পৃ. দ্রষ্টব্য।—শি মি

৩৫. সীতারাম, ১ম খণ্ড, একাদশ পরিচ্ছেদ।

৩৬. এই দুইখানি পুঁথিই (খুলনা) মঘিয়ার রাজবংশীয় বাসুকীকুলপ্রদীপ সুকবি হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী মহোদয় মুদ্রিত ও প্রকাশিত করেন। তিনি আমাদের জন্য উভয় পুঁথির প্রতিলিপি প্রস্তুত করিয়া পাঠাইয়াছিলেন। কিন্তু পুঁথিতে কোন কোন অংশ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া কেহ কেহ সন্দেহ করেন।

৩৭. এই গ্রাম সৰ্ব্বপ্রথমে এই সেনবংশের কুলপুরুষ রমানাথ মহারাজ আদিশূরের নিকট হইতে প্রাপ্ত হন। পুঁথিতে আছে :

‘ভাগীরথী নদীতীরে দীর্ঘ গঙ্গা গ্রাম,
সৰ্ব্বস্থানে দ্বিগঙ্গা বলিয়া ঘুষে নাম।
সুন্দর সে গ্রামখানি কি শোভা তাহাতে,
সেই গ্রাম আদিশূর দিল রমানাথ।’

সম্ভবতঃ ২৪-পরগণা জেলায় বারাসত উপবিভাগে এই দ্বিগঙ্গা গ্রাম; তাহা প্রাচীন স্থান। সেখানে প্রকাণ্ড দীঘি ও ইষ্টকালয়ের ভগ্নাবশেষ বৰ্ত্তমান। কিন্তু উহা গঙ্গা নদীর উপর নহে, ২৪-পরগণা জেলার মধ্য দিয়া প্রবাহিত যমুনার পদ্মা নামক শাখার উপর অবস্থিত। এই দ্বিগঙ্গা একসময়ে বঙ্গের একটি প্রধান স্থান ছিল। অন্য প্রসঙ্গে ইহার সমালোচনা করা যাইবে। বিভারিজ সাহেব দ্বিগঙ্গাকে কলিকাতার নিকটবর্ত্তী বলিয়াছেন। [পরিশিষ্ট-গ দ্রষ্টব্য। —শি মি]

৩৮. রমানাথ সেনকে প্রথম পুরুষ ধরিলে ১৯ পর্যায়ে রুদ্রনারায়ণ। ইনি ‘বাণঋতু বাণশশি শকের বৈশাখে’ রায়েরকাঠিতে সিদ্ধেশ্বরী কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত কালীমন্দিরের শিলালিপি হইতেও তাহাই প্রমাণিত হয়। See Beveridge History of Bakargunj, p. 121

৩৯. ‘গ্রহবাণ ঋতু শশধর শক পৌষে
রাজা রাণী স্বর্গে যান অত্যন্ত হরষে।’

গ্রহ=৯, বাণ=৫, শশধর=১, ইহাকে উল্টাইয়া লইলে ১৬৫৯ শক বা ১৭৩৭ খৃষ্টাব্দ হয়।

৪০. খ্রীষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যে সন্ন্যাসী (ব্রহ্মাণ্ডগিরি) নলডাঙ্গা রাজবাটীতে সিদ্ধেশ্বরী দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন, তিনি ও এই ব্রহ্মাণ্ডগিরি অভিন্ন ব্যক্তি কিনা বলা যায় না। পরবর্ত্তী খণ্ড, মোগল আমল, ৩৬শ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. ২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. ৩. নদী-সংস্থান
৪. ৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. ৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. ৬. সুন্দরবন
৭. ৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. ৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. ৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. ১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. ১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. ১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
১৩. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
১৪. ২. দ্বীপের প্রকৃতি
১৫. ৩. আদি হিন্দু-যুগ
১৬. ৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
১৭. ৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
১৮. ৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
১৯. ৭. মাৎস্য-ন্যায়
২০. ৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
২১. ৯. সেন-রাজত্ব
২২. ১০. সেন-রাজত্বের শেষ
২৩. ১১. আভিজাত্য
২৪. ১. তামস যুগ
২৫. ২. বসতি ও সমাজ
২৬. ৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
২৭. ৪. খাঁ জাহান আলি
২৮. ৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
২৯. ৬. পয়োগ্রাম কসবা
৩০. ৭. খালিফাতাবাদ
৩১. ৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৩২. ৯. হুসেন শাহ
৩৩. ১০. রূপ-সনাতন
৩৪. ১১. লোকনাথ
৩৫. ১২. হরিদাস
৩৬. ১৩. রামচন্দ্র খাঁ
৩৭. ১৪. গাজীর আবির্ভাব
৩৮. ১৫. মুকুট রায়
৩৯. ১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
৪০. ১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
৪১. পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
৪২. পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
৪৩. পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
৪৪. পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন