সতীশচন্দ্র মিত্র
সুন্দরবনের সবই বিচিত্র। এখানকার বৃক্ষলতা, জীবজন্তু সবাই নূতন ধরণের এবং সবই এক বিচিত্রতার পরিচয় দেয়। এখানে পাতলা পলির কদমের উপরে অতি শক্ত কাঠের সুন্দরী, পশুরী প্রভৃতি বৃক্ষ জন্মে এবং আর্দ্র, জলসিক্ত ও লোণাদেশ গণ্ডার ও ব্র্যাঘ্রের মত ভীষণ জীবের আবাসভূমি হয়। হরিণগণ সুখসেবিত সুন্দর জীব, তাহারা কদম মোটেই ভালবাসে না, কিন্তু এই কদমাক্ত সুন্দরবনের জঙ্গলেই তাহারা পালে পালে থাকে। এখানে মাছে গাছ বাহিয়া উঠে, কুমীরে ডাঙ্গায় আসিয়া জীবজন্তু ধরে এবং ব্র্যাঘ্র কখনও বৃক্ষডালে বিশ্রাম করে, কখনও বা সাঁতার দিয়া সাগরের মত ভীষণ নদী পার হইয়া যায়। এখানে স্থানের অবস্থান গুণে একই খালে দুইদিকে বিভিন্ন প্রবাহ বহে এবং একই নদীতে অবস্থার গতিকে দুইস্থানে দুইপ্রকার ভীষণ মূর্ত্তি পরিগ্রহ করে। এখানে বিষাক্ত বাষ্পে বায়ুস্তর পরিপূর্ণ, তথাপি হাতীর মত প্রকাণ্ড গণ্ডার, মহিষের মত প্রকাণ্ড বাঘ, বাঘের মত প্রকাণ্ড শূকর, গরুর মত প্রকাণ্ড হরিণ এবং নৌকার মত প্রকাণ্ড কুমীর এই দেশে জন্মে।[১]
সুন্দরবন নিবিড় জঙ্গলাকীর্ণ। এই নিবিড় বনে যেমন অসংখ্য বৃক্ষলতা, তেমনই বহু জীবজন্তু বাস করে। কিন্তু এখানে সব বৃক্ষলতা জন্মে না, সব জীবজন্তু বাস করিতে পারে না। সুন্দরবনের স্বাভাবিক অবস্থান ও প্রকৃতির জন্য প্রত্যেক বিষয়ে ইহার বিশেষত্ব আছে। আমরা প্রথমে বৃক্ষলতা সম্বন্ধে বিবেচনা করিব।
সুন্দরবনে বহু বৃক্ষলতা পাওয়া যায়। তবে পার্ব্বত্য-প্রদেশে উদ্ভিদের যেরূপ সংখ্যাধিক্য, এখানে তত নহে; কারণ সকল গাছ সুন্দরবনে জন্মিতে পারে না। এখানে বাতাস, জল, মৃত্তিকা সকলই লবণাক্ত। এই লবণ যাহারা সহ্য করিতে পারে, জলীয় বাষ্প সম্বলিত সামুদ্রিক বাতাসে যাহাদের তৃপ্তি হয়, প্রবল বায়ুবেগে যাহারা আত্মরক্ষা করিতে সক্ষম এবং মূলদেশ জলপ্লাবিত হইলে যাহারা মরে না, সেই সকল বৃক্ষলতাই সুন্দরবনে জন্মে। এখানে বৃক্ষমাত্রেরই মূলদেশ অবিরত জোয়ারের জলে ধৌত হওয়ায় উন্মুক্ত হইয়া পড়ে; প্রবল বায়ুবেগে বৃক্ষকুল অবিরত আন্দোলিত হয় এবং নদীতীরে জলস্রোতে পাহাড় ভাঙ্গিয়া পড়িয়া বৃক্ষমূল উৎপাটিত করিয়া দেয়, এজন্য সুন্দরবনের প্রত্যেক গাছেরই শিকড় অত্যন্ত অধিক। ঐ সকল শিকড় চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে, এক বৃক্ষের শিকড় অন্য বৃক্ষের শিকড়গুলিকে জড়াইয়া ধরে; যে সকল বৃক্ষের উপরে পরস্পরকে আঙ্গিলন করিবার সুযোগ না হয়, তাহারা মৃত্তিকার নিম্নে পরস্পরকে গাঢ় আলিঙ্গন করে এবং সকলে জুটিয়া সম্মিলিত বলে আত্মরক্ষা করিয়া থাকে। সুন্দরবনে মাটির নিম্নে কিছুদূর পৰ্য্যন্ত শুধুই শিকড়ময়। যেখানে মূলদের্শ ধুইয়া যায়, তথায় দেখা যায়, শিকড়গুলি নানাদিক্ হইতে টানা দিয়া কেমন সুন্দরভাবে বৃক্ষগুলিকে সোজা করিয়া রাখে। গর্জ্জন প্রভৃতি বৃক্ষের অধিকাংশ শিকড় মাটির উপরই থাকে। বটগাছের বোয়ার মত এই সকল শিকড় বৃক্ষকাণ্ড হইতে চতুৰ্দ্দিকে টানা দিয়া বৃক্ষগুলিকে রক্ষা করে। সুন্দরবনের বৃক্ষসমূহের যেমন শিকড়ের পরিমাণ অধিক, তেমন সেই সকল শিকড়ের বায়ু সেবনের প্রয়োজনও অধিক। মূলদেশ জলে প্লাবিত থাকিলে, শিকড়গুলির বায়ু সেবনের সুবিধা হয় না; এজন্য শিকড় হইতে উর্দ্ধদিকে অসংখ্য শূলের মত ক্ষুদ্র সুচল শিকড় উত্থিত হয়, উহাদিগকে শূল বা শূলো (blind root-suckers) বলে। সুন্দরবনের প্রায় সকল বৃক্ষেরই শূলো হয়, কাহারও সরু, কাহারও মোটা, কাহারও দীর্ঘ, কাহারও ছোট; তবে সুন্দরী গাছের শূলগুলি সংখ্যায়ও অধিক এবং আকারেও বড়।[২] জোয়ারের জল যেখানে অধিক সঞ্চিত হয়, শূলোগুলিও সেখানে অধিক দীর্ঘ হয়।
সুন্দরবনের গাছগুলি প্রায়ই লম্বা হইয়া উঠে। বন্যবৃক্ষ মাত্রই দীর্ঘ হয়; তাহার একটি কারণ এই যে, সেখানে অনেক গাছ অযত্নসম্বৰ্দ্ধিত হইয়া একত্র জন্মে, তাহারা প্রত্যেকে ছাড়াইয়া থাকিবার অবসর পায় না। বীজ হইতে উৎপন্ন গাছমাত্রই দীর্ঘ হয় এবং কলম প্রভৃতি কৃত্রিম উপায়ে যত্নে প্রস্তুত বৃক্ষমাত্রই অনুন্নত এবং বিস্তৃত হয়। যে সকল বৃক্ষের কাষ্ঠ ব্যবহার করিতে হইবে, তাহা দীর্ঘ হওয়াই ভাল। শাখা প্রশাখা বাড়িতে গেলে গ্রন্থি বা গাঁইট বেশী হয় বলিয়া কাঠ ভাল হয় না। এজন্য স্বভাবতঃই পাহাড়ী শাল সেগুন এবং সুন্দরবনের সুন্দরী পশুর প্রভৃতি বৃক্ষ দীর্ঘ হইয়া উঠে।
এক্ষণে আমরা সুন্দরবনের বৃক্ষলতাদির মধ্যে প্রধান-প্রধানগুলির নাম ও তাহাদের বিশেষত্ব এবং প্রয়োজনীয়তার বিষয় ক্রমে ক্রমে নিম্নে আলোচনা করিতেছি।
সুন্দরী বা সুন্দর গাছ (Heritiera Minor, Roxburgh; Heritiera Fomes, Brandis ) ॥ ইহার পাতাগুলি ছোট, লবঙ্গের পাতার মত, উপরে মসৃণ এবং নিম্নে ধূসরবর্ণ, বাতাসে নিম্নভাগ সুন্দর দেখায়। ইহাতে ছোট ছোট হরিদ্রাবর্ণ ফুল হয়। গাছগুলি সাতিশয় দীর্ঘ হয়, এবং স্থুল হয় বটে কিন্তু বটগাছ প্রভৃতির মত স্থূল হয় না। ইহা আমগাছের মতও বড় হয় না। ইহার দীর্ঘোন্নত ভাব গ্রাম্য জামগাছের সহিত তুলনা করা যায়। অল্পবয়স্ক সুন্দরী গাছগুলিও বাঁশের মত দীর্ঘ ও সরল হইয়া উঠে। উহাদিগকে ‘ছিট’ বলে; সুন্দরীর ছিটে নৌকার লগি প্রস্তুত হয়। গাছের গায়ের উপরিভাগের পাতলা আবরণ উঠাইলে ভিতরে গাবগাছের মত লাল রঙ বাহির হয়।
ইহার কাঠও গাঢ় লালবর্ণ, যেমন শক্ত, তেমনি সুন্দর; এবং সুন্দর বলিয়াই ইহাকে সুন্দর বা সুন্দরী কাঠ বলে। এই কাঠে তক্তা হয় এবং ইহার কাষ্ঠ বিশেষ মূল্যবান্ এবং স্থায়ী এবং বহু প্রয়োজনে লাগে। দক্ষিণবঙ্গ নদীপ্রধান দেশ, নৌকা ভিন্ন যাতায়াতের উপায় নাই। এক সময়ে সুন্দরীকাঠ নৌকা নির্মাণের প্রধান এবং সহজলভ্য উপাদান ছিল;[৩] কিন্তু এক্ষণে আর তেমন সুন্দর কাঠ পাওয়া যায় না। ইহার কয়েকটি কারণ আছে; প্রথমতঃ শুধু লবণাক্ত জলে সুন্দরীগাছ ভাল জন্মে না। যেখানে নদীস্রোত দ্বারা উপর হইতে মিষ্ট জল আসে এবং জলে অধিক পরিমাণ পলি মিশ্রিত থাকে, সেই স্থানে সুন্দরীগাছ ভাল উৎপন্ন হয়। নিম্নবঙ্গের সমস্ত নদীগুলি পূর্ব্বে গঙ্গার শাখা প্রশাখা ছিল, সুতরাং সব নদী দিয়া পার্ব্বত্য জলস্রোত আসিত। পলিমিশ্রিত সেই মিষ্টজল লবণাক্ত সমুদ্রজলের সহিত মিশিয়া সুন্দরীগাছের জন্য উপযুক্ত উপকরণ প্রস্তুত করিয়া দিত। এজন্য সুন্দরবনের সকল অংশে পূর্ব্বে ভাল সুন্দরীগাছ জন্মিত। এক্ষণে পশ্চিম ভাগে যুমনা, ইচ্ছামতী, কপোতাক্ষ ও ভৈরব প্রভৃতি সমস্ত নদীগুলির সহিত গঙ্গার সংযোগ-স্রোত এক প্রকার বন্ধ হইয়া গিয়াছে এবং পদ্মার জল কেবলমাত্র মধুমতী প্রভৃতি নদী দিয়া পূৰ্ব্ববঙ্গে প্রবাহিত হয়। এজন্য পূর্ব্বভাগে যেরূপ সুন্দরীগাছের বৃদ্ধি ও সংখ্যাধিক্য আছে, পশ্চিমভাগে তাহা নাই। অতি নিরবচ্ছিন্ন লবণাক্ত স্থানে শুধু সুন্দরী কেন, অন্য ভাল কাষ্ঠের বৃক্ষও জন্মে না।[৪] সে অঞ্চলে কেবল গরাণ ঝোপ দেখিতে পাওয়া যায়। দ্বিতীয়তঃ পুরাতন সুন্দরীগাছ যাহা ছিল, তাহা কাঠুরিয়ার অস্ত্রমুখে পতিত হইয়া প্রায় নিঃশেষিত হইয়াছে। সুন্দরবনের অন্তর্গত বাদা বা জঙ্গল পরিষ্কৃত হইয়া যত আবাদ বা শস্যক্ষেত্রের সীমা বর্দ্ধিত হইতেছে, এবং বন্দুক প্রভৃতির সাহায্যে লোকের সাহসবৃদ্ধির সহিত হিংস্রজন্তুর বিনাশে কাঠ যতই অধিক কর্ত্তিত হইতেছে, সুন্দরীগাছ ততই নষ্ট হইয়া গিয়াছে। এজন্য গবর্ণমেণ্ট বর্ত্তমানে কঠোর শাসন দ্বারা সুন্দরবনের অনেক স্থান রিজার্ভ বা রক্ষিত বনে পরিণত করিয়া, সুন্দরী শিশুকে পূর্ণাবয়ব হইবার অবসর দিতেছেন। কিছুকাল পরে পুনরায় প্রচুর পরিমাণে সুন্দরীগাছ পাইবার আশা আছে।
পশুর (Meliaceae ভুক্ত) ॥ সুন্দরী ব্যতীত অন্য সমস্ত কাঠের মধ্যে ইহা প্রধান; এমন কি ঘরের খুঁটিরূপে ইহা সুন্দরী অপেক্ষাও ভাল কাজ করে। গাছ বড় হয়, পাতাগুলি একটু প্রশস্ত, কতকটা কাঁটালের পাতার মত। ইহাতে খুঁটি ও তক্তা হয়।
বাইন (Avicennia officinalis) ॥ কাঠের শক্তি ও স্থায়িত্বের হিসাবে ইহাকে সুন্দরবনের তৃতীয় বৃক্ষ ধরা যায়। গাছগুলি খুব বড় হয় এবং অনেককাল থাকে। ভীষণ জঙ্গলের মধ্যে পুরাতন বাইন গাছের গুঁড়ি দেখিলে বিস্মিত হইতে হয়। আমরা ইহার গুঁড়ির পরিধি ২০/২৫ ফুটও দেখিয়াছি। অধিকদিন হইলে গাছের গুঁড়ি শূন্যগর্ভ হয়। ইহাতে ভাল তক্তা হয়।
ধোন্দল (Carapa Moluccensis) বা গামুর ॥ অনেকটা পশুর গাছের মত। ইহাতে মিষ্ট বা বিলাতী কুমড়ার মত প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ফল হয়। ফলে কোন কাজ হয় বলিয়া জানি না। পরিপক্ক হইলে ফলগুলি ফাটিয়া যায়; তখন তাহার ভিতর হইতে তালের আঁটির মত কতকগুলি বীজ বাহির হয় এবং তালের গাছের মত অঙ্কুরিত হইয়া উহা হইতে গাছ গজাইয়া থাকে। এ গাছে কাঠ ও তক্তা হয়।
কেওড়া (Sonneratia opetala) ॥ প্রায়ই নদী বা খালের তীরে এবং চরভূমিতে জন্মে। গাছ খুব বড় হয়। সুন্দরবনের মধ্যে ইহাই সর্ব্বাপেক্ষা দীর্ঘ ও সর্ব্বাপেক্ষা সুন্দর গাছ। চরের উপরে প্রায়ই একস্থানে বহুসংখ্যক গাছ সারিবদ্ধ হইয়া নদীর বাঁকে মধুর শোভা বিস্তার করে। পাতাগুলি জিওলের পাতার মত সরু সরু; উহা বানর ও হরিণের খাদ্য। কেওড়ার ফল অম্লাস্বাদযুক্ত, উহা মানুষেরও আহার্য্যোপকরণরূপে সুন্দরবনে ব্যবহৃত হয় বটে, কিন্তু হরিণের নিকট এই ফল পরম উপাদেয় খাদ্য। কেওড়া তলাতেই হরিণ শিকার করিবার স্থান এবং এখানেই বহু হরিণ মারা পড়ে। ইহাতেও তক্তা এবং ব্যবহারোপযোগী অন্যপ্রকার কাঠ হয়।
গরাণ (Ceriops Candolleana) ॥ হরিদ্রাভ পুরু গোলাকার পাতাযুক্ত গাছ। গাছ খুব বড় হয় না এবং প্রায়ই ১০/১২ ফুটের অধিক উচ্চ হয় না। এক এক ঝাড়ে অনেকগুলি গাছ হয়। অত্যন্ত লোণাস্থানেও গরাণ জন্মে। এজন্য পশ্চিমের বাদায় গরাণের অত্যন্ত প্রাধান্য। ইহা ছোট কাঠের মধ্যে বেশ শক্ত কাঠ। ইহাতে ঘরের খুঁটি, চালের রুয়া, বেড়া ঘিরিবার খুঁটা বা পোষ্ট এবং নৌকার লগি (Log) প্রস্তুত হয়। ইহার দ্বারা হুকার নলচেও হইয়া থাকে। ইহার পাকা গাছের বেধ ৫/৬ ইঞ্চির অধিক প্রায়ই হয় না। কাঠের গাত্রের খোসায় একটা সুন্দর লাল রঙ আছে।[৫]
গেঁয়ো (Excoecaria Agalloch) ॥ এ গাছ সোজা হইয়া উঠে। গাছের গায়ে একপ্রকার বিষাক্ত দুগ্ধবর্ণ আঠা আছে। পশ্চিমের বাদায় কেওড়া না থাকিলে, গেঁয়ো গাছই সৰ্ব্বাপেক্ষা লম্বা হয়। ইহার কাঠ খুব পাতলা। সে কাঠে ভাল কয়লা ও তাহা হইতে টিকে প্রস্তুত হয়। বড় কাঠের গুঁড়ি হইতে ঢোলক, তবলা প্রভৃতির খোল হয়। সাধারণতঃ ইহা জ্বালানি কাঠের জন্য ব্যবহৃত হয়।
গৰ্জ্জন (Diptero Carpus Turbinatus) ॥ সুন্দরবনের সর্ব্বত্র, বিশেষতঃ পশ্চিমভাগে অধিক জন্মে। প্রায়শঃই নদী বা খালের কূলে গৰ্জ্জনগাছ দেখা যায়। বটগাছের বোয়ার মত চতুর্দ্দিকে ইহার শিকড় বিস্তৃত হইয়া গাছগুলিকে সোজা করিয়া রাখে। ইহার ছোট ফুল হয় ও তাহা হইতে বকফুল বা সজিনার মত লম্বা খাঁড়া নির্গত হয়। পাতাগুলি রবার গাছের পাতার মত পুরু। গর্জ্জনের তৈল হয়। প্রতিমা বা পুতুলের গায়ে রঙ্ ফলাইবার জন্য গর্জ্জন তৈল ব্যবহার করে। এই তৈল কুষ্ঠ প্রভৃতি মহারোগে মহোপকারী। ইহার কাঠ রক্তাভ ধূসরবর্ণ এবং স্থায়ী নহে।[৬]
হেন্তাল ॥ ছোট সরু খেজুর গাছের মত। বোধ হয় যেন আমাদের পাড়াগাঁয়ের খেজুর গাছ বনে আসিয়া লবণ খাইয়া হীনবীৰ্য্য হইয়াছে। একস্থানে অনেকগুলি একত্র ঝাড় বাঁধিয়া থাকে। গাছগুলি ৮/১০ ফুট হইতে ১৫/১৬ ফুট পৰ্য্যন্ত উচ্চ হয়। এ গাছ বাঁশ অপেক্ষা অধিক মোটা হয় না, সাধারণতঃ সরু বাঁশের মতই মোটা হয়। ইহার সরু গাছের লাঠি এবং ঘরের চালের রুয়া হয়। হেঁতালের নড়ি বা ছড়ির কথা ‘মনসার ভাসানে’ আছে। হেঁতালবন ব্যাঘ্রের একটি প্রধান আড্ডা, কারণ ইহার ভিতরে পরিষ্কৃত এবং উপরে ঢাকা থাকে।
সুন্দরবনে বাঘ প্রভৃতি হিংস্র জন্তুর লুকাইয়া থাকিবার উপযোগী, হেঁতাল ব্যতীত বলা, বলা সুন্দরী এবং হ’দো নামক আরও তিন প্রকার গাছ আছে। বলাগাছের গোল গোল পাতা ও হরিদ্রাবর্ণ পুষ্প হয়, গাছগুলি ঝোপসা বাঁধিয়া একস্থানে বহুদূর লইয়া নদী বা খালের ধারে জুড়িয়া থাকে। ব্যাঘ্র প্রভৃতি জলপিপাসু হিংস্ৰজন্তু ঐ ঝোপের মধ্যে সুন্দর ছায়ায় বসিয়া শিকার অন্বেষণ করে। হ’দোগাছ খড় প্রভৃতির ন্যায় একটু উচ্চ শুল্কস্থানে জন্মে। এই সকল গাছ ভিন্ন শিঙ্গড় বা সিঙ্গুড়, গ’ড়ে বা গড়িয়া, ওড়া, কাঁকড়া, খলসী ভাণ্ডার বা ভাঁড়ার, করঙ্গ এবং হিঙ্গে, এই আট প্রকার কাঠের গাছ বনস্থলী জঙ্গলাকীর্ণ করিয়া রাখে এবং সকলগুলিই জ্বালানি কাঠের জন্য ব্যবহৃত হয়। সিঙ্গুড় ও কাঁকড়া কিছু শক্ত, ওড়া প্রভৃতি কাঠ খুব নরম। হিঙ্গের কাঠ খুব পাতলা; ইহাদ্বারা পাল্কীর বাঁট হয় এবং দক্ষিণ দেশীয় লোকে পাঙ্গাসমাছ প্রভৃতি ধরিবার জালগুলি জলে ভাসাইয়া রাখিবার জন্য হিঙ্গে দ্বারা ‘ভাসান কাঠ’ প্রস্তুত করে। অল্প লোণাতেও ওড়াগাছ জন্মে; এমন কি ভৈরব, কপোতাক্ষ প্রভৃতি নদীতে পার্ব্বত্যস্রোতের সংযোগ বন্ধ হওয়ার পর যত লোণাজল উপরে উঠে, ততই সেই সকল স্থানে নদীর ধারে ওড়াগাছের আবির্ভাব দেখা যায়। ওড়ার পাতা পচিয়া সেইস্থান হইতে চিংড়িমাছ ও অন্যান্য পোকার উদ্ভব হয়। এইজন্য লোণাস্থানে অধিক পরিমাণ চিংড়ি প্রভৃতি মৎস্য জন্মে।
এতদ্ব্যতীত জলের কূলে হরগোজা নামক কাঁটা গাছ, বিস্তৃত চরে ওড়াধান, খোলা জায়গায় খড়জাতীয় কাশা ও তুলাটেপারী, বালুকার চরে বন ঝাউ এবং দৈবাৎ কোনস্থানে সাধারণ ঝাউ ও বনলেবু দেখা যায়। সুন্দরবনের মধ্যে যেখানে প্রাচীন বসতিচিহ্ন আছে, উচ্চভিটা বা ইষ্টকগৃহের ভগ্নাবশেষ যেখানে দেখা যায়, তাহার সন্নিকটে প্রচুর পরিমাণে গাবগাছ দেখিতে পাওয়া যায়। অন্য দুই একটি গ্রাম্য বৃক্ষের বন্য সংস্করণ যে না আছে, তাহা নহে, তবে প্রাচীন বসতির চিহ্নের সঙ্গে সঙ্গে গাবগাছ প্রায় সর্ব্বত্রই বিরাজ করিয়া বনস্থলীর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে। অশ্বত্থবট এক নূতন জাতীয় বৃক্ষ হইয়াছে, হরিদ্রার গাছ শটি হইয়া গিয়াছে, নানাপ্রকার লেবু বন্যপ্রকৃতি পাইয়াছে, কিন্তু গাবগাছ অবিকৃত আছে—সেই কৃষ্ণবর্ণ বৃক্ষগাত্র, সেই পত্রপ্রাচুর্য্যে ছায়াবাহুল্য, সেই নবকিশলয়োদ্গমে রক্তবর্ণের ছড়াছড়ি এবং গাছ ভরিয়া সেই একই গ্রাম্যাস্বাদযুক্ত ফলের ভার— বনে যাইয়া গাবগাছ শুধু বন্য হয় নাই, বরং ঐতিহাসিকের মত প্রাচীনত্বের নিদর্শনসমূহ রক্ষা করিয়া লোকের কাছে সাক্ষ্য দিতেছে। মানুষেও গাবগাছের কাছে অনেক শিক্ষালাভ করিতে পারে!
গোলগাছ ॥ ইহা নারিকেল জাতীয় গাছ (Palm); তবে অধিক উচ্চ হয় না। নদী বা খালের কূলে জলের মধ্যে বা ধারে জন্মে; গাছ যত বড় হয়, ততই নিম্নাংশ উচ্চ হইয়া না উঠিয়া গাছের মূলে সাপের মত জড়াইয়া থাকে এবং ক্রমশঃ নিম্ন দিক্ হইতে ক্ষয় পাইতে থাকে। নারিকেলের পাতার মত ইহার পাতাগুলি খুব বড় হয়, উহা নিম্নবঙ্গে খড়ের মত ঘর ছাইবার সুন্দর উপাদান রূপে ব্যবহৃত হয়। প্রতি সপ্তাহে সুন্দরবন হইতে অসংখ্য নৌকায় গোলপাতা বোঝাই করিয়া লইতেছে। সুতরাং গোলগাছ হইতে গবর্ণমেন্টের যথেষ্ট আয় হয়। গোলের ডাঁটা খুব শক্ত, শীষগুলি কাঠের মত। গোলগাছে তালের মত ফলের কান্দি হয় এবং তালশাঁসের মত গোলফল খাওয়া যায়। পাকিলে ফল অভক্ষ্য হয়।
গিলেলতা ও বেত। সুন্দরবনের ভীষণ জঙ্গলের মধ্যে স্থানে স্থানে বহুকাল হইতে লতা জন্মিয়া থাকে। ইহার মধ্যে গিলেলতা এরূপ দীর্ঘ ও সারবান হয় যে, দেখিলে বিস্ময়াবিষ্ট হইতে হয়। অনেক সময়ে বড় গাছের গুঁড়ির মত লতার দীর্ঘতনু দেখা যায়। বনের মধ্যে বেতও এইরূপ খুব বড় হয়। এই বেত গ্রাম্যজীবনের নানা কাজে লাগে।
পাদটীকা :
১. ‘We must still view it as a curious and anomalous tract, for here we see a surface soil composed of black liquid mud supporting the huge rhinoceros, the sharp-hoofed hog, the mud-hating tiger and the delicate and fastidiously clean spotted deer, and nourishing and upholding large timber trees; we see fishes climbing trees, tides running in two directions in the same creek and at the same moment.’-An article on the Gangetic Delta, Calcutta Review, 1859.
২. ‘The Sundri tree has the peculiarity of sending up from its roots small prongs or spits, a foot or more in height, which are sometimes as thickly placed as to leave little room for walking-F. E. Pargiter, Calcutta Review, 1889, P. 300. একথা ঠিক নহে। সুন্দরবনের অধিকাংশ বৃক্ষেরই শূলো আছে। তবে সুন্দরীর শূলোগুলি কিছু দীর্ঘ ও শক্ত।
৩. ‘The Sundri forests supply wood for boat-building to the 24 Pergannahs, to Jessore, to Backergunj, to Noakhali and other districts, and also furnish wood for many purposes of domestic architecture.’-Sir Richard Temple, Lieutenant – Governor of Bengal, who personally visited the Sundarbans in 1874.
৪. ‘… Which (Sundari) Deteriorate gradually towards the west and south as the water of the rivers becomes more and more saline . ‘ L. S. S. O’ Malley’s Khulna Gazetteer, PP. 82-88.
৫. বর্তমানে চর্ম্ম-শিল্পে রঙের কার্য্যে এই খোসা প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হইতেছে।—শি মি
৬. ‘Heart-wood reddish grey, not durable, yields wood-oil.’-Brandis. Indian Trees, P. 65.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন