১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা

সতীশচন্দ্র মিত্র

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা

আইট বা আ’ট—বনের মধ্যে পূৰ্ব্বর্তন বসতির চিহ্নযুক্ত উচ্চ জমি।

আদলদার—পূর্ব্বে লবণ প্রস্তুত হইয়া রাশীকৃত হইলে, তাহার উপর যাহারা ছাপ মারিয়া দিত।

আবাদ—জঙ্গলকে ‘বাদা’ বলে এবং জঙ্গল ‘উঠিত’ হইয়া যখন ধান্যক্ষেত্রে পরিণত হয়, তখন তাহার নাম আবাদ।

আফালি—আস্ফালন। মৎস্যের আফালি।

আশে*—নমস্কার; হাত বাড়াইয়া আশীৰ্ব্বাদ ভিক্ষা করা। সম্মানিত ব্যক্তিকে সুন্দরবনে এইভাবেই অভিবাদন জানান হয়।

উশকাড়া—মৎস্যে জলের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আবার ঢুকিয়া যায়, উহাকে উশকাড়া বলে।

ওঝা—যন্ত্রবিৎ ব্যক্তি। উপাধ্যায় শব্দের অপভ্রংশ।

ওত—শিকারের জন্য প্রস্তুত অবস্থা; বাঘে জঙ্গলের মধ্যে ‘ওত পাতিয়া’ বসিয়া থাকে।

কয়াল—দালাল (ধানের)।

কল—ভেড়ী বা বাঁধের মধ্য দিয়া জল নিষ্কাশনের কাষ্ঠ নির্মিত প্ৰণালী।

কল্লা—দুষ্ট, চতুর।

কাগজী—যাহারা পূর্ব্বে কাগজ প্রস্তুত করিত, তাহাদের কাগজী উপাধি হইত।

কাঁচা (বাদা)—নিবিড় জঙ্গলপূর্ণ।

কাঠিকাটা (অধিবাসী) – যাহারা সর্ব্বপ্রথমে বাদা কাটিয়া বসতি স্থাপন করে। ঐরূপ জমিতে তাহাদের বিশেষ স্বত্ব স্বামিত্ব থাকে, এই অর্থে কাঠিকাটা শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন ইহা অমুকের কাঠিকাটা মহল।

কাঠির আবাদ-প্রথমতঃ জঙ্গল কাটিয়া যে আবাদ হয়, তাহার নাম কাঠির আবাদ।

কাঠুরিয়া—যাহারা কাঠ কাটিতে বনে যায়।

কাড়াল—নৌকায় মাঝির বসিবার স্থান।

কাড়াল দেওয়া—কাণ্ডারীর কার্য্য করা বা হাল ধরা।

কাবলীওয়ালা—বাঘ। সম্ভবতঃ প্রকাণ্ড মূর্ত্তির জন্য কাবুলিয়াদিগের নামানুসারে নাম হইয়াছে।

কাবান— জঙ্গলে কাঠ কাটিয়া রাখিবার ও আনিবার জন্য পরিষ্কৃত প্রশস্ত স্থান।

কারিকর—গান রচয়িতা।

কালাবন*—নিবিড়বন।

কুমোর—নদী বা খালের মধ্যে কাঁচা ডাল পাতা দিয়া যে স্থানে মাছ আটকাইয়া রাখে।

কেরেচ্ বা কেরেচ্ ছিলা—ক্ষেতের মধ্যে এড়োভাবে (ডরম্র) ছোট বাঁধ বা ভেড়ী।

কোলা—নদী বা খালের কূলে প্রশস্ত স্থান।

খটি—সমুদ্র বা নদীতীরে মাছ ধরিয়া শুকাইবার আড্ডা।

খ’লেন—ধান মাড়াই করিবার স্থান।

খাদাড়ী বা খালাড়ী—লবণের কারখানা।

খাস জঙ্গল—গবর্ণমেন্টের তত্ত্বাবধানে রক্ষিত বন। Reserved forest.

খেঁড়ো—গাজীর গীতের মূল গাইন বা গাথক।

খোঁজ—চিহ্ন বা পদচিহ্ন। সন্ধান।

খোঁজ তোলা—কাদার মধ্যে চলিবার সময় চিহ্ন রাখিয়া পা তুলিয়া যাওয়া। যেমন ‘হরিণের খোঁজ তোলার শব্দ’।

গণ—অনুকূলনদীপ্রবাহ। Favourable current.

গরম—হিংস্রজন্তুর ভয়যুক্ত। যেমন ‘অমুক স্থান গরম’, অর্থাৎ যেখানে বাঘ আছে।

গলুই—নৌকার অগ্রভাগ।

গাইন—গাথক।

গাছাল—গাছে বসিয়া শিকার।

‘গাছাল দেওয়া’ অর্থাৎ শিকারের জন্য গাছে বসিয়া থাকা।

গাজি—ব্যাঘ্রের দেবতা। যাহারা ব্যাঘ্র শিকার করে বা মারিয়া বীরত্ব দেখায়, তাহাদের গাজি উপাধি হয়। গাজি শব্দের প্রকৃত অর্থ ধৰ্ম্মযোদ্ধা।[১]

গুন—যে দড়ি দ্বারা প্রতিকূল স্রোতে নৌকা টানিয়া লওয়া হয়।

গুনের রাস্তা—গুন টানিবার সময় মাল্যারা নদীকূল বাহিয়া যে পথে যায়।

গুঁরো—নৌকার দুই পার্শ্বের ‘ডালির’ সহিত সংযোগ রাখিয়া ২/১ হাত অন্তর যে শক্ত কাঠগুলি এড়োভাবে লাগান থাকে, তলদেশে পা না দিয়াও যে কাঠগুলির উপর পা দিয়া নৌকার সম্মুখ হইতে পশ্চাৎ পৰ্য্যন্ত পাওয়া যায়, তাহার নাম ‘গুঁরো’।

গোছা—নৌকার ভিতর তলদেশে ‘বাগ’ লাগান থাকে, সেইরূপ দুইপার্শ্বে ঐরূপ যে ছোট ছোট কাঠ মাঝে মাঝে লাগান থাকে, তাহাকে গোছা বলে।

গ্যাড়া—গণ্ডার।

ঘুঘু— ছোট ডিঙ্গি নৌকা। ইহাকে ঘুঘুডিঙ্গি বা শুধু ‘ঘুঘু’ বলে।

ঘের—বনের যে অংশে কাঠ কাটিবার হুকুম হয়। যেমন, অমুক বাদায় এবার ‘ঘের পড়িয়াছে’।

ঘোঘা*—ভেড়ীর যে সরু ছিদ্রপথে নদীর লোনা

জল ক্ষেতের মধ্যে প্রবেশ করে।

ঘোষড় (বন)—নিবিড় বা দুষ্প্রবেশ্য।

চ’ট বা চটই—চলাচল বা যাতায়াত। যেমন অমুক বনে খুব হরিণের চ’ট আছে, অর্থাৎ সে বনে অনেক হরিণ চলাফেরা করে।

চ’ড় বা চইড়—নৌকা ঠেলিয়া সরাইবার বা চালাইবার জন্য ব্যবহৃত সরু কাষ্ঠ বা বংশ দণ্ড।

চাড়া—উচ্চ অর্থাৎ যেখানে বাঘের অত্যাচার আছে। ‘গরম’ দেখ।

চাপান—নৌকা বাঁধিয়া থাকা।

চাপান সারা-রাত্রিতে নৌকারোহী দিগের নিদ্রার পূর্ব্বে মন্ত্র দ্বারা বাঘের অত্যাচার নিবারণ করা।

চেলা—শিষ্য।

চেরাক, চেরাগ—প্ৰদীপ।

চোট—বন্দুকের আঘাত। [চোট করা অর্থাৎ বন্দুকের গুলি করা।]  

ছই—নৌকার উপরিস্থ আবরণ।

ছড়া কাটা—কবি গানের দ্রুত কবিতা রচিয়া বলিয়া যাওয়া।

ছাওয়াল পীর—পাঁচ পীরের অন্যতম।

ছাপ্পর—ছই।

ছিট—ছোট গাছ, যেমন ‘সুন্দরের ছিট’; অর্থাৎ অল্পবয়স্ক সরু ও দীর্ঘ সুন্দরী গাছ।

ছিলা বা ছিলে—ভেড়ী—অপেক্ষাকৃত ছোট ভেড়ী।

জয়াল—নদী তীরবর্ত্তী প্রকাণ্ড ভূমিখণ্ড, যাহা সময় সময় নদীর মধ্যে ভাঙ্গিয়া পড়ে।

জায়গীর—বানর।

জারী – জাহিরা বা প্রচার; এক প্রকার ধর্মের গান।

জিগীর—উচ্চ কীৰ্ত্তন বা শব্দ।

জো* — জোয়ার। এক জো’ পথ, অর্থাৎ যাইতে এক’জোয়ার লাগে (প্রায় ছয় ঘণ্টা সময়)।

জোগা— অমাবস্যা-পূর্ণিমার নিকটবর্ত্তী অতিরিক্ত জলোচ্ছ্বাসের সময়।

জোয়ার—সমুদ্র হইতে উপরদিকে জলপ্রবাহ।

জোয়ারিয়া—উপর বা উত্তরের দিকে। যেমন অমুক স্থান অমুক স্থানের জোয়া’রে অর্থাৎ প্রথম স্থানে যাইতে হইলে দ্বিতীয় স্থান হইতে জোয়ার দিয়া নৌকায় যাইতে হয়।

ঝা’ল—শুকনা গাছের অগ্রভাগ।

টোপ—খোলা স্থানে গর্ত্ত করিয়া তন্মধ্যে বসিয়া শিকার করাকে টোপে শিকার বলে।

ডালি—নৌকায় তক্তা দ্বারা তলদেশ গড়িয়া আসিয়া সর্ব্বোপরি দুই পার্শ্বে যে অপেক্ষাকৃত পুরু দুইখানি তক্তা লম্বালম্বিভাবে লাগান থাকে, তাহাকে ‘ডালি’ বলে।

ডিঙ্গা—ব্যবসায়ীদের বড় নৌকা।

ডিঙ্গি—ছোট খোলা নৌকা।

তারকেল – গোসাপ (Iguana)। ইহারা সর্প-ভক্ষক। কোন কোন স্থানে ‘গো–হাড়কেল’ নামে পরিচিত।

দ’ড়েল—যাহারা দড়ি দিয়া পাঙ্গাস মাছ বা কাঁকড়া ধরে।

দোখালা—যেখানে দুই পার্শ্বে দুইটি সমান আকারে খাল গিয়াছে, তখন তাহাকে দোখালা বলে। কিন্তু যদি উহার একটি খাল ছোট হয়, তবে তাহাকে পাশখালি বলে।

দোয়ানী খাল*—যে খালের দুই মুখেই একই সময়ে জোয়ারের জল প্রবেশ করে এবং দুই মুখেই ভাটির জল নামিয়া যায়।

দোস্তি—বন্ধুত্ব।

ধে’ড়ো—শীর্ষ বা শীষ, যেমন গোলের ধে’ড়ো। বলে না। মৃত্যু হইলেও ‘ভাল হইয়াছে’ এইরূপ ধোঁয়াকল বা ধুমাকল— ষ্টীমার।

নদীর বাঁক—দিক্ পরিবর্তন করিয়া একমুখে নদী যতদূর যায়।

নল ছেয়া বা নলছ্যাও—কোণাকোণি নদী পার হওয়া।

নাও, না, লাও, লা—নৌকা।[২]

না’য়ে বা লা’য়ে—নাবিক, নৌকার মাঝি।

নেমক—লবণ।

পড়া—মরা, যেমন অমুক বনে মানুষ পড়িয়াছে, অর্থাৎ বাঘে মানুষ মারিয়াছে।

পলোয়ার—বড় ঢাকাই নৌকা।

পাটাতন— নৌকার উপরিভাগ যাহা তক্তাদ্বারা আচ্ছাদিত থাকে।[৩]

পাড়ি—উত্তরণ, পার হওয়া।

পাতারি—জলপ্লাবন নিবারণ জন্য ছোট বাঁধ।

পাশখালি—‘দোখালা’ দেখ।

পিঠেম বাতাস—পৃষ্ঠদিক্ হইতে প্রবাহিত অনুকূল বায়ু।

পিঠেল*—বনের পেট্রোল (petrol) পুলিশ।

পীর—দেবতা।

পেরেম (প্রেম) কাদা — পলিমাটির আঠাল কাঁদা, যাহা লাগিয়ে সহসা ছাড়িতে চাহে না।

ফুলি—আলোক।

বড় মিঞা—বাঘ।

বড় শিয়াল—বাঘ।

বড় হরিণ—বাঘ।

বনবিবি—বনদেবতা; ‘বনবিবির জহুরা নামা’ কেতাবে ইঁহার বর্ণনা আছে।

বয়াতি—বয়েৎ বা জারীগানের পদরচয়িতা।

বাইচ—ভাসান, নদীপথ, নৌকাবাহনের পাল্লা।

বাওন—বাহন, নদীবাহনে শিকার।

বাওয়ালী—বনওয়ালী, বনভ্রমণকারী মন্ত্রবিৎ ফকির।

বাগ—নৌকার মধ্যে তলায় যে ছোটছোট কাঠ এড়োভাবে থাকে।

বাটাল—গাছাল। ‘গাছাল’ শব্দ দেখ।

বাদা—জঙ্গল।

বাদাই—ভাল–মন্দ বা মরণ; বাদায় মরার কথা বলে না।

বালাম—এক প্রকার নৌকা; এবং ঐ নৌকায় যে সরু সিদ্ধ চাউল পূর্ব্বদেশ হইতে রপ্তানি হইত।

বালিয়াৎ—যে অনুচর অগ্রবর্ত্তী হইয়া শিকার দেখাইয়া দেয়।

বা’লেট—বাঘ।

বিশ—ধানের হিসাব, আনুমানিক ১৪ মণ ধান।[৪]

বে-গণ*— প্রতিকূল নদী প্রবাহ।

বেড়ো, বেরো বা বেরুয়া—গুন টানিবার জন্য ব্যবহৃত চোঙ্।

বেতনাই *—কাঠ বা গোলপাতা বোঝাই করিবার উপযোগী এক প্রকার বড় নৌকা।

বৈকিরী—বানর।

বৈঠক—কাষ্ঠ।

বৈঠা, বৈঠক—কাষ্ঠ নির্ম্মিত যে পাতালা দাঁড় না বাঁধিয়া হাতে তুলিয়া বাহিতে হয়।

ভাটি—বাঙ্গালা-বাঙ্গালার দক্ষিণাংশ।

ভাটিয়াল—দক্ষিণ দেশীয়, যেমন ভাটিয়াল চাউল, ভাটিয়াল সুর।

ভাটো—নিম্ন বা দক্ষিণ দিগবৰ্ত্তী। যেমন অমুক স্থান অমুক স্থানের ভাটো, অর্থাৎ প্রথম স্থানে যাইতে হইলে দ্বিতীয় স্থান হইতে নৌকা পথে ভাটিতে যাইতে হয়। এক ভাটো পথ, অর্থাৎ যেখানে যাইতে এক ভাটি লাগে (প্রায় ছয় ঘণ্টা সময়)।

ভূইঞা—ভূধ্যধিকারী।

ভেড়ী—জলপ্লাবন নিবারণ জন্য বড় এবং উচ্চ বাঁধ।

ভোঁতড়—বাঘ।

মড়াই—ধানের গোলা।

মাছি—ডাকাইত, শত্রু।

মাঝি—নৌকার কর্ণধার।

মাঠাল—পায়ে হাঁটিয়া শিকার।

মাদিয়া—দ্বীপ।

মানসেল—মনুষ্যালয়, মানুষের বসতি বিভাগ।

মায়া হরিণ*—হরিণী।

মাল-মহল, সুন্দরবনের ডাঙ্গা।

মাল্যা, মাল্লা—দাঁড়ী।

মাহিন্দর—লবণ প্রস্তুতকারী মজুর।

মুখোড় বাতাস—প্রতিকূল বাতাস।

মোটা ভাষা—অশ্লীল ভাষা।

মোলঙ্গা—লবণ প্রস্তুত করিবার জন্য ভাণ্ড বা ভাঁড়।

মোলঙ্গী—যাহারা ঐরূপ করিয়া লবণ প্রস্তুত করে।

মোহন, মোহড়া- মোহনা বা নদীর সঙ্গমস্থল।

রসাঙ্গী—যে ব্যক্তি লবণের রস লইয়া ভাঁড়ে সরবরাহ করিত।

লগি—‘চ’ড়’ দেখ।

লা, লাও—না, নাও; ‘নাও’ দেখ।

শাকরেত—শিষ্য।

শিয়াল—শৃগাল, বাঘ।

শিরা*—নদীবক্ষে স্রোতের প্রধান ধারা যে পথে যায়।

শিষে—অতি সরু খাল বা খাড়ি।

শূলো—সুন্দরী প্রভৃতি বৃক্ষের গোড়া হইতে উর্দ্ধমুখী হইয়া যে সূচল শিকড় উঠে (Air-roots)

সড়া—নদী তীরে নৌকা উঠাইয়া রাখিবার জন্য যে খাল কাটিয়া রাখা হয়।

সয়লা—জঙ্গলের মধ্যে শুঁড়ি পথ।

সাঁই—আড্ডা।

সারি বা সাড়ী গান—নদীপথে যাইতে যাইতে নাবিকেরা যে গান করে। তরঙ্গের মৃদু আন্দোলনে উহাতে এক প্রকার কেমন স্বরতরঙ্গ মাখান থাকে। নৌকায় সারিবদ্ধভাবে বসিয়া বা দাঁড়াইয়া গায় বলিয়া ইহার নাম সারি গান।

সিঙ্গেল বা শিঙেল*—পুরুষ হরিণ।

সির্নী, ছিন্নি—হিন্দুর দেবতা বা মুসলমান পীরের নামে উৎকৃষ্ট ভোগ বা খাদ্যদ্রব্য।

সোরা—গাছের কাঠের মধ্যে যে অংশ নষ্ট হইয়া খোল হইয়া যায়।

স্থল-পাহারী—যাহারা লবণের খোলা চৌকি দিত।

হা’নর—বানর।

হিসনে—যে দুইখানি কাঠের সন্ধিস্থলে দাঁড়ের মধ্যস্থান বাঁধিয়া দাঁড় বাহিয়া থাকে, উহাকে দাঁড়ের হিসনে বলে।

.

এতদ্দেশীয় লোকেরা সুন্দরবন ভ্রমণ করিবার অবসর পাইলে, তাহার নদী নালা সুন্দরভাবে মনে করিয়া রাখে এবং সময় সময় স্বভাবজাত কবিতার রসে উচ্ছ্বসিত হইয়া গীত রচনা দ্বারা পথের পরিচয় স্মরণ-পথে রাখে। তাহাদের সেই সকল সরল গান তাহাদের যেমন সরল প্রাণের প্রমাণ পাই, তেমুনি তদ্বারা অন্য অনেক নিরক্ষর ভ্রমণকারীর পথভ্রান্তির সম্ভাবনা কমাইয়া দেয়। এখানে এই জাতীয় একটি দেশীয় গান উদ্ধৃত করিয়া দিলাম। এই গীত-রচয়িতা রাডুলির পূৰ্ব্ববর্ত্তী চেঁচো গ্রামে বাস করিতেন, এবং তথা হইতে নৌকাপথে সুন্দরবনে যাইতেন। জঙ্গলা ভাষারও কতকটা দৃষ্টান্ত এই গানে পাওয়া যাইবে।

‘চেঁচোর গ্রামে বাস করি খোসনবীশের মাটি
পূৰ্ব্ব অংশে তুলে দিলাম, নিমাই খালির ভাটি।
হাড়ে বাসে ছোট নদী ত্রিমোহানা ভারী
সেখানেতে বা’য়ে দিলাম মনসুখের তরী।
বাঁকের মাথায় কোদার গাঙ্গ জানে সৰ্ব্বজনা
বায় থাকিল দেলুটির গাঙ্গ ডানি সোলাদানা।
মাদুর পাল্টা, হাড়ার গাঙ্গ, তা’তে বড় টান
পূর্ব্বের দিকে চেয়ে দেখ তিল ডাগার গাঙ্গ।
তিলডাঙ্গার পশ্চিমেরে ভাই আছে গড়খালি
সেইখানেতে চেয়ে দেখি কুচিয়া আর চাঁদখালি।
কুচিয়া আর চাঁদখালি গিয়া মনে হ’ল আশা
দক্ষিণের পারে চেয়ে দেখি আলমচাঁদের বাসা।[৫]
ঘোষখালি আর ঢাকির মুখ আছেরে সায় সায়
সাতুল্যার তুফান দেখে পরাণ কেঁপে যায়।
গাঙ্গরই, বুড়া হড্ডা, ন’লেন রইল বায়
সূতারখালির মুখে কত লাও মারা যায়।
আড় বাউনে, লক্ষ্মীপ্রসাদ, ছাচনাঙ্গলার মুখে।
কত না’য়ে চাপান থাকে অতি পরম সুখে।
আ’ড়ো শিপসার মুখে টান করেরে কল্ কল্
পূবের পার চেয়ে দেখ, কুকড়া কাটির খাল।
মার্গির চর, বুজবু’নে নজরেতে দেখি
নোঙ্গর ক’রলাম গিয়ারে ভাই হাতধাবড়ার মুখি।
কেউ বলে মরা ভদ্র কেউ বলে হাতধাবড়া—
রূপসার তুফান দেখে রে ভাই কাঁপে পাছার চামড়া।
আদা চাকি দিয়া কত ধুমাকল যায়,
আড়পাউড়ী দিয়া তারা আ’ড়ো শিবসায় ধায়।
সেই যে কল মহাবল বুঝে কার সাধ্যি
ডান হাতে তু’লে দিলাম চা’লোবগির মধ্যি।
বা’য় থাকলো টগিবগি দক্ষিণমুখো হ’লাম
তিন বাঁক বা’য়ে গিয়ে নলবু’নের খাল পালাম।
বনেতে মা বনবিবি করেছে কি খেলা
(দেখলে) রোগ শোক দূরে যায় আর সংসারের জ্বালা।
বনের মধ্যে বনবিবির কতই রে ভাই খেলা
দুই পার দিয়ে চেয়ে দেখি শুধু গোলের মেলা।
মা যদি করেন দয়া তবে ত আর আসিব
চা’লো বগির কয়খান বাঁক সেইবার গ’ণে যাব।[৬]

পাদটীকা :

* তারকা-চিহ্নিত শব্দগুলি সংযোজিত হইল। —শি মি

১. ‘Ghazi signifies a conqueror, one who makes war upon infidels.’ – Tabakat-i-Nasiri (Raverty), P. 70 Note 2.

২. যুদ্ধকালে সুন্দরবনে ব্যবহৃত নানারকম নৌকা বা জাহাজের নামের জন্য ২য় খণ্ড, মোগল আমল, ২০শ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

৩. বড় পাসী নৌকার পাটাতনকে সাত ভাগে বিভক্ত করা হয় : (১) গলুই, নৌকার অগ্রভাগ; (২) আগা নৌকা, যেখানে দাঁড়িরা বসিয়া দাঁড় টানে; (৩) মালখোপ, ছইএর নিম্নে যে অংশে সাধারণতঃ পাটাতনের নীচে জিনিষপত্র বোঝাই করা হয়; (৪) ডরা, অর্থাৎ নৌকার মধ্যস্থান, যেখান হইতে নৌকার জল সেঁচিয়া থাকে (৫) সোয়ারি খোপ, ডরার পশ্চাতে যেখানে আরোহিগণ শয়ন করে; (৬) উপরকোটা, যেখানে সাধারণতঃ মাঝি প্রভৃতি শয়ন করে; (৭) কাড়াল, যেখানে বসিয়া মাঝি হাল ধরে।

৪. ১৬ কোণে = ১ পালি
২০ পালি= ১ শলা বা ৮ পালি=১ আড়ি
৮ শলা=১ বিশ বা ২০ আড়ি = ১ বিশ
১৬ বিশ=১ কাহণ

৫. আলমচাঁদ নামক দক্ষিণদেশীয় একজন বিখ্যাত ফকির বা মুসলমান সাধু।

৬. এইরূপ অনেক নিরক্ষর কবিদিগের কত গান ও বাঙ্গালা শ্লোক, কত কবিতা ও পদাবলী যে এই দেশে এখনও প্রচলিত আছে, তাহা বলিবার নহে। যশোহর-খুলনার নিরক্ষর কবিদিগের কথা ২য় খণ্ডের দ্বিতীয় অংশে ১১শ পরিচ্ছেদে সংক্ষেপে বলা হইয়াছে। [এই গানে সুন্দরবনের এক ক্ষুদ্রাংশের ৩৬টি নদী ও খাল সমন্বিত মাকড়সার জালের মত জটিল জলপথের সন্ধান আছে। —শি মি

সকল অধ্যায়

১. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. ২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. ৩. নদী-সংস্থান
৪. ৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. ৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. ৬. সুন্দরবন
৭. ৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. ৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. ৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. ১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. ১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. ১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
১৩. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
১৪. ২. দ্বীপের প্রকৃতি
১৫. ৩. আদি হিন্দু-যুগ
১৬. ৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
১৭. ৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
১৮. ৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
১৯. ৭. মাৎস্য-ন্যায়
২০. ৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
২১. ৯. সেন-রাজত্ব
২২. ১০. সেন-রাজত্বের শেষ
২৩. ১১. আভিজাত্য
২৪. ১. তামস যুগ
২৫. ২. বসতি ও সমাজ
২৬. ৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
২৭. ৪. খাঁ জাহান আলি
২৮. ৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
২৯. ৬. পয়োগ্রাম কসবা
৩০. ৭. খালিফাতাবাদ
৩১. ৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৩২. ৯. হুসেন শাহ
৩৩. ১০. রূপ-সনাতন
৩৪. ১১. লোকনাথ
৩৫. ১২. হরিদাস
৩৬. ১৩. রামচন্দ্র খাঁ
৩৭. ১৪. গাজীর আবির্ভাব
৩৮. ১৫. মুকুট রায়
৩৯. ১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
৪০. ১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
৪১. পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
৪২. পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
৪৩. পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
৪৪. পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন