২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ

সতীশচন্দ্র মিত্র

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ

সাগরাভিমুখিনী গঙ্গা যে স্থান হইতে বামে পদ্মা ও দক্ষিণে ভাগীরথী নামক দুই প্রধান শাখায় বিভক্ত হইয়াছে, সেই সন্ধিস্থান হইতে সমুদ্রকূল পর্য্যন্ত এই উভয় শাখার অন্তবর্তী ভূভাগ একটি ত্রিভুজাকৃতি ধারণ করিয়াছে। পৃথিবীর মধ্যে গঙ্গার একটা বিশেষত্ব আছে; হিমালয়ের মত বহুবিস্তৃত, উচ্চতম, চিরতুষারাবৃত পর্বতমালার সহিত গঙ্গার মত এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ অন্য কোন নদীর নাই। হিমালয়ের গাত্রধৌত জলরাশি শত শত নির্ঝরিণীপথে গঙ্গার দেহপুষ্টি করে এবং অপরিমিত পর্ব্বতরেণু লইয়া তাহাকে উপহার দেয়। পৃথিবীর মধ্যে এমন অধিক পর্ব্বতরেণুও অন্য কোন নদী বহন করে না; এবং এমন ভূমিগঠনের ক্ষমতাও অন্য নদীর নাই। এই রেণু-সমষ্টি জলসংযোগে পলিমাটী হয়; গঙ্গা ও তাহার শাখাসমূহ সেই পলিমাটী বহন করিয়া স্রোতের পথে দুই পার্শ্বে রাখিয়া রাখিয়া ভূমি বৃদ্ধি করিতে করিতে চলিয়া যায়। সেই পলি দিয়াই গঙ্গা স্বীয় বাহুদ্বয়ের মধ্যবর্তী ত্রিকোণ ভূভাগ গঠন করিয়াছে। উহাকে আমরা ইংরাজীর অনুকরণে ব’দ্বীপ বলি; এই ব’দ্বীপকে গাঙ্গোপদ্বীপ বলাই সঙ্গত। পদ্মার বাম ভাগে ঢাকা জেলার দক্ষিণাংশ, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের মোহানাস্থিত প্রদেশ এবং ভাগীরথীর পশ্চিমকূলে মেদিনীপুরের দক্ষিণভাগ এই একই প্রকার পলি দ্বারা গঠিত। এই সমগ্র ভূভাগের প্রাকৃতিক অবস্থা ও প্রকৃতি একই প্রকার ধরা যাইতে পারে।

উক্ত ব’দ্বীপ যে কেবলমাত্র পদ্মা ও ভাগীরথী বেষ্টিত, তাহা নহে। উহার মধ্যভাগেও অনেকগুলি নদী উক্ত উভয় শাখা হইতে আসিয়া দক্ষিণাভিমুখে সমুদ্রে পড়িয়াছে এবং তাহারা এই গাঙ্গোপদ্বীপকে পূৰ্ব্বপশ্চিমে কতকগুলি ভাগে বিভক্ত করিয়াছে। পূর্ব্বদিকে গৌরী-মধুমতী, মধ্যস্থানে ভৈরব-কপোতাক্ষ, পশ্চিম দিকে যমুনা-ইচ্ছামতী উক্ত পদ্মা বা ভাগীরথী হইতে নির্গত হইয়া সমুদ্র পর্য্যন্ত প্রবাহিত হইতেছে।[১] এক্ষণে মধুমতীর পূর্ব্ববর্ত্তী অংশ ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত এবং গৌরী-মধুমতী ও ভাগীরথীর মধ্যবর্তী অংশকে প্রেসিডেন্সী বিভাগ বলে। এই প্রেসিডেন্সী বিভাগের মধ্যে আবার যে অংশ প্রধানতঃ যমুনা-ইচ্ছামতী ও মধুমতীর মধ্যবর্ত্তী, তাহাই আমাদের আলোচ্য যশোহর-খুলনা।

এই যুক্ত জেলাকে নদীর প্রবাহ দ্বারা উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘভাবে তিনটি বিভাগ করা যায়। পূৰ্ব্বসীমা মধুমতী, তাহা হইতে কুমার-নবগঙ্গা-চিত্রা প্রভৃতি নদীশ্রেণী পর্য্যন্ত একভাগ, উক্ত নদীশ্রেণী হইতে কপোতাক্ষ পৰ্য্যন্ত দ্বিতীয় ভাগ এবং কপোতাক্ষ হইতে যমুনা-ইচ্ছামতী পৰ্য্যন্ত তৃতীয় ভাগ। প্রধানতঃ এই চারিটি নদীমালা দ্বারা উভয় জেলার জল-নিঃসরণ কার্য্য সম্পন্ন হয়। এই তিনটি বিভাগের প্রত্যেক ভাগে উত্তর হইতে আরম্ভ করিয়া দক্ষিণ দিকে ক্রমশঃ নিম্ন হইয়া গিয়াছে, এবং ক্রমশঃ লোকসংখ্যা কমিয়াছে।

আবার পূর্ব্ব-পশ্চিমে দীর্ঘভাবেও এই ভূভাগকে তিন অংশে বিভক্ত করা যায়। যশোহরের উত্তর সীমা হইতে প্রধানতঃ ভৈরব নদ পর্য্যন্ত উত্তর ভাগ; চব্বিশ পরগণা জেলার বসুরহাট হইতে খুলনার বাগেরহাট পর্যন্ত একটি কাল্পনিক রেখা টানিলে, ভৈরব নদ হইতে সেই রেখা পর্য্যন্ত মধ্যভাগ এবং সেই রেখা হইতে সমুদ্রকূল পর্য্যন্ত দক্ষিণ ভাগ। ইহার মধ্যে উত্তর ভাগ প্রায় সবই যশোহর জেলার মধ্যে পড়িয়াছে; মধ্যভাগ যশোহর ও খুলনা উভয় জেলার মধ্যে প্রায় তুল্যাংশে বিভক্ত হইয়াছে; এবং দক্ষিণ ভাগ অর্থাৎ সুন্দরবনাংশ সমস্তই খুলনা জেলার অন্তর্ভুক্ত।

এই তিন ভাগের প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। উত্তরভাগে জমি অত্যন্ত উচ্চ, লোকসংখ্যা অধিক, উদ্যান যথেষ্ট, আম কাঁঠাল খেজুর তাল প্রভৃতি ফলবৃক্ষ খুব বেশী এবং তাহাতে উপযুক্ত ও উৎকৃষ্ট ফল দেয়; কিন্তু এ অংশে শস্যক্ষেত্র, বা মৎস্যপূর্ণ বিল ঝিল অধিক নাই; শস্যক্ষেত্র যাহা আছে, তাহাতে ধান্য অপেক্ষা নানাবিধ কলাই ও সরিষা, ধনিয়া প্রভৃতি রবিশস্য অধিক জন্মে। মধ্যভাগে জমি অপেক্ষাকৃত নিম্ন ও লোকসংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম, উদ্যানভাগ অধিক নহে; তাল, খেজুর, সুপারি, নারিকেল বেশ জন্মে বটে, কিন্তু আম কাঁটাল ভাল ফলে না। বিশেষতঃ আমে পোকা ও অম্লাধিক্য জন্য উহা একপ্রকার অখাদ্য। এ অঞ্চলে ধান্যক্ষেত্র অধিক এবং যেখানে জমি বারমাস জলপ্লাবিত না থাকে, সেখানে স্বল্পায়াসে প্রচুর ধান্য হয়। কিন্তু কলাই প্রভৃতি ফসল এ অঞ্চলে একপ্রকার হয় না বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। এদিকে যেমন বিল ও জলা জমি বেশী, তেমনি মৎস্যাদিও প্রচুর পরিমাণে জন্মে। দক্ষিণভাগে জমি অত্যন্ত নিম্ন, বৎসরের অধিকাংশ সময় জলমগ্নই থাকে; লোকসংখ্যা অতি সামান্য, প্রবল নদীর দুই কূলে ব্যতীত অন্যত্র প্রায় লোক বাস করিতে পারে না এবং সেরূপ লোকের বসতিও বড় অধিক দূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত হয় নাই। এ ভাগের অধিকাংশ ভীষণ জঙ্গলে আবৃত। এই জঙ্গলকে সুন্দরবন বলে। সুন্দরবনের বৃক্ষের প্রকৃতি অন্যস্থান হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্। এ অঞ্চলে লোকালয়ের পরিচয় দিতে নারিকেল জাতীয় দুই চারিটি বৃক্ষ ব্যতীত অন্য উদ্যান-বৃক্ষ জন্মে না বলিলেও চলে। যাহা আছে, সকলই শক্ত এবং জ্বালানি কাঠের গাছ। তবে যেখানে স্থান একটু পলির বলে উচ্চ হয়, সেখানে মনুষ্যে বল ও কৌশলে শ্বাপদসঙ্কুল স্থানে আত্মরক্ষা করিয়া, ‘বাদা’ বা জঙ্গল কাটিয়া ‘আবাদ’ বা শস্যক্ষেত্র প্রস্তুত করিতেছে। এবং সেই বহুযুগের পতিত নবাবিষ্কৃত অকর্ষিত ক্ষেত্রে বীজমুষ্টি নিক্ষেপ করিলে, শস্যের স্বর্ণবৃষ্টি হয়। এইরূপে সোণা ফলাইবার লোভে লোকে সেই হিংস্ৰজন্তুপূর্ণ অঞ্চলে প্রাণ হাতে করিয়া বাস করে।

উত্তরভাগে নদী মরিতেছে, জমি ‘জলগণ্ড’ বা বদ্ধজলে দূষিত এবং দেশ ‘অজন্মা’ হইতেছে। নানাবিধ রোগে ও মহামারীতে স্থায়ীভাবে বসতি করিয়াছে; অধিবাসিগণ প্রাণের ভয়ে দূরে সহরে পলায়ন করিতেছে, ফলে লোকসংখ্যা কমিতেছে। বহুদিন হইতে যশোহর জেলার এই লোকক্ষয় দেখিয়া সকলেই শঙ্কাকুল হইয়াছেন। মধ্যভাগে পূর্ব্বাংশের কিছু উন্নতি ও পশ্চিমাংশের কতকটা অধঃপতন অলক্ষিত না থাকিলেও নোটের উপর বিশেষ কিছু হ্রাসবৃদ্ধি দেখা যায় না। দক্ষিণভাগে জমি ‘উঠিতেছে’; শস্যক্ষেত্র বিস্তার লাভ করিতেছে, উত্তর দিক হইতে আক্রান্ত হইয়া সুন্দরবন যেন ক্রমশঃ দক্ষিণে সরিয়া যাইতেছে। নূতন রোগপীড়া নাই, হিংসের উৎপাত দিন দিন কমিতেছে; শস্যের লোভে বসতির আয়তন ও লোকসংখ্যা প্রবল বেগে বাড়িয়া চলিতেছে।

সকল দেশের একটা প্রকৃতি এই দেখা যায়, যে স্থানে বহুদিন লোকের বাস ছিল, মানব- সমৃদ্ধি যেখানে বহুদিন লীলা করিয়াছে, সেস্থান কালে দূষিত হয়, জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া বসতির অযোগ্য হয়, মানুষ কতক ধ্বংস প্রাপ্ত হয় এবং অবশিষ্ট চলিয়া যায়। সমৃদ্ধ পল্লী বা সহর শ্বাপদ-সঙ্কুল হইয়া পড়ে। প্রকৃতিদেবী বড় পরিবর্তনপ্রিয়। আলোচ্য যুক্ত-জেলায় ইহা বেশ দেখা যায়। উত্তরভাগে যেখানে রাজপাট, প্রাচীন সহর বা সভ্যতার স্থান ছিল, হঠাৎ কোন দৈবদুর্যোগ বা মহামারী উপস্থিত হইয়া, প্রায়ই ভীষণ জঙ্গলে আবৃত হইয়াছে এবং ব্যাঘ্র ও বন্যশূকরের বাসভূমি হইয়াছে, আর দক্ষিণভাগে যেখানে জঙ্গল ছিল, মানুষ গিয়া সেখানে বন কাটিয়া, আবাদ করিয়া, বাসাবাটী প্রস্তুত করিতেছে। নদীগুলিও গতি পরিবর্ত্তন করিয়া এইরূপ নূতন নূতন স্থানকে প্রতিপত্তি দান করিতেছে। মহম্মদপুর, সেখহাটি, বেণাপোল, অভয়নগর, পয়গ্রাম, কসবা, হাবেলী-বাগেরহাট প্রভৃতি প্রাচীন স্থানের বর্তমান অবস্থা দেখিলে ভীত ও বিস্মিত হইতে হয়, আবার নড়াইল, কালিয়া, খুলনা, সেনহাটি, বনগ্রাম, মোরেলগঞ্জ প্রভৃতি স্থানের উন্নত অবস্থা দেখিলে আনন্দের উদয় হয়।

গঙ্গার সমস্ত উপদ্বীপ বিভাগই নদী-মাতৃক দেশ। বিশেষতঃ যশোহর ও খুলনা। এ অঞ্চলে নদীই সব। নদীই দেশকে বাসোপযোগী করিয়া সভ্যতা আনিয়াছে, বাণিজ্য বিস্তার করিয়া মনুষ্যাবাসকে সমৃদ্ধ করিয়াছে, উদ্যান ও শস্য-ক্ষেত্রের হরিৎ ছটায় সমৃদ্ধ পল্লীর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করিয়াছে। দেহে যেমন শিরা ও ধমনী, এ দেশে তেমন নদ-নদী। শিরা বিকল হইলে যেমন দেহ- যন্ত্র অচল হয়, নদীর গতি রুদ্ধ বা পরিবর্তিত হইলেও দেশে নানা বিকৃতি উপস্থিত হয়। তবে প্রভেদ এই, দেহের শিরা সহজে বিকল হয় না; কিন্তু এদেশের নদনদী অবিরত পরিবর্তনশীল। যে কোন নদী পর্যবেক্ষণ করিলে ইহা বুঝা যায়। নদী যেখানে স্থান বা গতি পরিবর্তন করিয়াছে, তাহার চিহ্ন সেখানে নানাভাবে বর্ত্তমান আছে। খাতের পর খাত, এমনভাবে ক্রমান্বয়ে ৬/৭টি খাতও কোন স্থানে দৃষ্ট হইবে। আজ নদী একস্থানে বহিতেছে, লোকেরা উভয় কূলে বসতি করিয়াছে; আবার নদী সরিয়া গেল, খাত রহিয়া গেল কিন্তু বসতি গেল না; নূতন স্থানে নদীর কূলে আর এক সারি বসতি হইল। এইরূপে একসারি বসতি, তৎপরে একটি খাত, তাহাতে বর্ষাকালে জল হয়, বর্ষান্তে ধান্য হয়; সে খাতের পর পুনরায় বসতি, পুনরায় খাত। পাড়ায় পাড়ায় এইরূপ খাত সকল উচ্চ নীচ জমিতে পরিণত হইয়া রহিয়াছে। যমুনা, ভৈরব, কপোতাক্ষ ও নবগঙ্গা এমন যে কত গতি পরিবর্তন করিয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। ইহার জন্য ঐতিহাসিককে মহাভ্রমে পতিত হইতে হয়। যেখানে একদিন যোজনবিস্তৃত নদী-প্রবাহ পণ্য-বীথিকার মালা পরিয়া দেশকে ঐশ্বর্য্য-মণ্ডিত করিয়াছিল, আজ হয়ত সেখানে এক ক্ষীণ বদ্ধ জলের খাল মানুষের যাতায়াতের পথ বন্ধ করিয়া, অতীতের স্মৃতি মুছিয়া ফেলিয়া সে দেশের লোককে কূপমণ্ডুক করিয়া রাখিয়াছে। যেখানে দুই তিনটি সমৃদ্ধ গণ্ডগ্রাম পাশাপাশি থাকিয়া কোন রাজা বা শক্তিশালী পুরুষের প্রাচীন আবাসের মহিমাঙ্কিত হইয়াছিল, আজ এক বিপুল নদী-স্রোত উহাদের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া, সে সকল গ্রামকে এমনভাবে পৃথক করিয়া দিয়াছে যে, তথাকার কোন পূর্ব্বতত্ত্ব স্থির করিবার উপায় নাই। অনেক স্থানের প্রাচীন কাহিনী উদঘাটন করিতে গিয়া এইরূপ অবস্থা আলোচনা করিতে হইবে।

নদীসমূহ আপনারা যেমন কালের গতিতে বাঁক ফিরিয়া নানা পরিবর্তন আনিয়াছে, মানুষের কৃত্রিম হস্তক্ষেপও তেমিন অনেক স্থানে অচিন্তিতপূর্ব্ব পরিবর্ত্তন সংসাধিত করিয়াছে। অনেক স্থলে এ বিষয়ে মানুষের বুদ্ধির অপরিপক্কতা পরীক্ষিত হইয়াছে। হয়ত এক স্থানে কেহ দেখিলেন, একটি নদী অনেকদূর ঘুরিয়া আসিয়াছে, কিন্তু কোন স্থানে তাহার দুই অংশ এমন নিকটবর্ত্তী হইয়া পড়িয়াছে, যে ঐ স্থানে সামান্য দূর পর্য্যন্ত একটা খাল কাটিয়া দিলে, মানুষের যাতায়াতের পথ সুগম ও সংক্ষিপ্ত হয়। অমনি রাজা বা জমিদার তাহাই করিলেন। কিন্তু অল্পদিন মধ্যে এক বিস্তৃত অঞ্চল যেন নদীশূন্য হইয়া পড়িল, অথবা বিপরীত দিক্ হইতে স্রোত আসিয়া প্রকৃত নদীকে অচিরে ভরাট করিয়া দিয়া দেশের এক বিষম অনর্থ সাধন করিল। বাগেরহাটের নিকটে খাল কাটিয়া এইরূপে ভৈরবের দুর্দ্দশা হইয়াছে। দক্ষিণভাগে কোন কোন স্থানে এইরূপে খাল কাটিয়া পথ সোজা করিতে গিয়া দেশে লোণাজল প্রবেশ করিবার পথ করিয়া দেওয়া হইয়াছে, তাহাতে শস্য ও পানীয়ের ক্ষতি হওয়াতে, ‘খাল কাটিয়া লোণাজল ঢুকান’ কথাটা দেশের লোকের একটা অব্যক্ত অনুতাপকে ভাষান্তরিত করিয়াছে।

গাঙ্গোপদ্বীপে নদ-নদীর কার্য্য দুইটি; প্রথমতঃ জলনিঃসরণ ও দ্বিতীয়তঃ জমির উচ্চতা এবং উর্ব্বরতা বৃদ্ধি করা। বিপরীত জলস্রোতে নদীর বেগ শ্লথ হইলে, স্থির জলে পলি পড়িয়া ভূমি নিৰ্ম্মাণ কাৰ্য্যটা অত্যন্ত সত্বরতার সহিত সম্পন্ন করে। অনেক নদী এইভাবে পার্শ্ববর্ত্তী স্থানের জমির উচ্চতা ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি করিতে করিতে আপনার খাতই পলি সঞ্চয় দ্বারা এত উচ্চ করিয়া ফেলে যে, অবশেষে নদীকে নিজের আনীত পলির বোঝায় নিজেই মজিয়া গিয়া আত্মঘাতী হইতে হয়; তখন প্রথম উদ্দেশ্য বা জল নিষ্কাশন কাৰ্য্য বন্ধ হওয়াতে, নদী দেশের মধ্যে অনিষ্টকারক হইয়া পড়ে। অনেক নদী এইরূপে মজিয়া মরিয়া গিয়া ‘মরাগাঙ্গ’ নামে খাত রহিয়া গিয়াছে। গঙ্গা নামটি বঙ্গদেশে লোকের নিকট এতই মধুর যে, তাহারা গঙ্গা বলিতে প্রধানতঃ ভাগীরথীকে বুঝিলেও সকল নদীকেই গঙ্গা বা ‘গাস্‌’ বলে। আর নদী যেখানে শীর্ণকায়া হইয়া পড়ে, সেখানে তাহার নাম হয় কালিন্দী বা কালীগঙ্গা। এমন কত শত কালীগঙ্গা যে যশোহর-খুলনার যেখানে সেখানে আছে, এবং প্রাচীন নদ-নদীর বিস্তৃতির স্মৃতি জাগাইয়া দিতেছে, তাহা বলিবার নহে।

ভূমি নির্ম্মাণ করাই গঙ্গা বা তাহার শাখাসমূহের প্রধান কার্য্য। সে কার্য্যের ক্ষেত্রও মাঝে মাঝে পরিবর্তিত হয়। কোন এক সময় স্থান বিশেষে কতকগুলি নদী মিলিয়া এই জমি নিৰ্ম্মাণকাৰ্য্য আরম্ভ করে। তখন কতকগুলি নদী প্রবলবেগে সেই দিকে বহে। বামে দক্ষিণে পলি রাখিয়া দেশের প্রকৃতি পরিবর্তন করিতে করিতে, নদীগুলি সরিয়া সরিয়া কর্ম্মক্ষেত্র বাছিয়া লয়। এইরূপে একস্থানের কার্য্য প্রায় সমাপ্ত হইলে সেদিকে নদী মজিয়া যায়, স্রোতের জল পায় না। অন্যদিকে পুনরায় কার্য্যারম্ভ হয়। এইভাবে দেখিলে যেন দেখা যায় যে, যশোহর জেলার পশ্চিমাংশে ও খুলনার উত্তরাংশের এই পলি সঞ্চয় কার্য্য শেষ হইয়াছে। এখন যশোহরের পূর্ব্বপ্রান্তে এবং খুলনার দক্ষিণ ও পূর্ব্ব সীমা পর্যন্ত প্রবল বেগে কাৰ্য্য চলিতেছে। এ যুগে মধুমতী ও নবগঙ্গা সর্ব্বাপেক্ষা কার্য্যকারিণী। মধুমতী খুলনার পূর্ব্ব-দক্ষিণ কোণে সুন্দরবন আবাদ করিতেছে।[২]

এই সকল অবস্থার একটা ধারণা করিতে হইলে, এই নদী-মাতৃক দেশের প্রধান সম্পত্তি নদীসমূহের গতিবিধির বিষয় জানা প্রয়োজনীয়। এজন্য উহার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী প্রদত্ত হইতেছে।

পাদটীকা :

১. গৌরীকে সাধারণতঃ গোরাই, গড়াই বা গড়ই বলে।

২. ‘Thus, then, the whole river system has been charged, the many rivers that used to flow from north-west to south-east have now their heads closed and the Modhumati sends its waters across their paths, Changing the cross streams into principal streams and determining a general south- westward flow of the river currents.’— Westland’s Report on Jessore, 1871. P. 13.

সকল অধ্যায়

১. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. ২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. ৩. নদী-সংস্থান
৪. ৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. ৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. ৬. সুন্দরবন
৭. ৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. ৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. ৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. ১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. ১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. ১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
১৩. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
১৪. ২. দ্বীপের প্রকৃতি
১৫. ৩. আদি হিন্দু-যুগ
১৬. ৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
১৭. ৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
১৮. ৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
১৯. ৭. মাৎস্য-ন্যায়
২০. ৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
২১. ৯. সেন-রাজত্ব
২২. ১০. সেন-রাজত্বের শেষ
২৩. ১১. আভিজাত্য
২৪. ১. তামস যুগ
২৫. ২. বসতি ও সমাজ
২৬. ৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
২৭. ৪. খাঁ জাহান আলি
২৮. ৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
২৯. ৬. পয়োগ্রাম কসবা
৩০. ৭. খালিফাতাবাদ
৩১. ৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৩২. ৯. হুসেন শাহ
৩৩. ১০. রূপ-সনাতন
৩৪. ১১. লোকনাথ
৩৫. ১২. হরিদাস
৩৬. ১৩. রামচন্দ্র খাঁ
৩৭. ১৪. গাজীর আবির্ভাব
৩৮. ১৫. মুকুট রায়
৩৯. ১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
৪০. ১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
৪১. পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
৪২. পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
৪৩. পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
৪৪. পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন