সতীশচন্দ্র মিত্র
যুক্ত-জেলা ॥ বঙ্গদেশে প্রেসিডেন্সী বিভাগের পূর্ব্বাংশই যশোহর-খুলনা জেলা। যশোহর অতি প্রাচীন রাজ্য। অতি অল্পদিন হইল (১৮৮২) খুলনা ইহা হইতে বিচ্যুত হইয়া পৃথক্ জেলারূপে পরিণত হইয়াছে। পৃথক্ হইলেও ইহাদের প্রাচীন ইতিবৃত্ত পৃথক্ করা যায় না; পৃথক্ হইলেও ইহাদের সামাজিক ও অন্য প্রকৃতি প্রায় একই আছে। সুতরাং এই দুইটি জেলা যুক্তরূপেই বিচার করা উচিত। এই যুক্ত-জেলা বঙ্গদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত। যশোহরের দক্ষিণে খুলনা; উভয় জেলা একত্র উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ এবং সমুদ্র পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত।
সীমা।। এই যুক্ত-জেলার পূর্ব্বে বাখরগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলা, উত্তরে-নদীয়া জেলা, পশ্চিমে নদীয়া ও চব্বিশ পরগণা জেলা এবং দক্ষিণে চব্বিশ পরগণা ও বঙ্গোপসাগর। পূর্ব্বদক্ষিণ কোণ হইতে আরম্ভ করিলে, যথাক্রমে মধুমতী, গৌরী (গোরাই), কুমার, ইচ্ছামতী, যমুনা ও কালিন্দী নদী এবং বঙ্গোপসাগর— এই প্রাকৃতিক পরিখা দ্বারা ইহা চতুর্দিকে বেষ্টিত; কেবলমাত্র পশ্চিমোত্তর কোণে তিন চারি স্থলে ইহার কোনও প্রাকৃতিক সীমা নাই। সেখানে নদীয়া এবং চব্বিশ-পরগণাই ইহার সীমা। মধুমতীর তীরস্থ মাণিকদহ হইতে সিদ্ধিপাশা, রাজঘাট, গৌরীঘোনা, সাগরদাঁড়ি ও ত্রিমোহানী দিয়া চাঁদুড়িয়া পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত আঁকাবাঁকা রেখা উভয় জেলাকে পৃথক্ করিতেছে।
অবস্থান ॥ এই যুক্ত-জেলা উত্তর নিরক্ষ ডিগ্রী ২২°৩৮ ́ কলা হইতে ডিগ্রী ২৩°৪৭′ কলার মধ্যে এবং পূর্ব্বদ্রাঘিমা ডিগ্রী ৮৮°৪০ কলা হইতে ডিগ্রী ৮৯°৫৮ কলার মধ্যে অবস্থিত। উভয় জেলার প্রধান নগরী যশোহর ও খুলনা একই ভৈরব নদের দক্ষিণ পারে প্রতিষ্ঠিত। যশোহর নগরী উত্তর নিরক্ষ ডিগ্রী ২৩°১০ ́ কলা এবং পূর্ব্বদ্রাঘিমা ডিগ্রী ৮৯°-১৩ ́ কলার সন্ধিস্থলে এবং খুলনা সহর উত্তর নিরক্ষ ডিগ্রী ২২°৪৯ ́ কলা এবং পূৰ্ব্বদ্রাঘিমা ডিগ্রী ৮৯°৩৪ ́ কলার সন্ধিতে অবস্থিত রহিয়াছে।
পরিমাণ ॥ উভয় জেলার পরিমাণ হল ৭.৬৩৪ বর্গমাইল। তন্মধ্যে সুন্দরবন ২,২৯৭ বর্গমাইল অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশের অধিক সুন্দরবন সমস্তই খুলনার অন্তর্ভুক্ত। সুন্দরবন বাদ দিলে খুলনার পরিমাণ ২,৪৩৩ বর্গমাইল। অর্থাৎ খুলনার প্রায় অর্দ্ধেক অংশ সুন্দরবন। যশোহরের পরিমাণ হল ২,৯০৪ বর্গমাইল অর্থাৎ খুলনার বসতি অংশের প্রায় সওয়া গুণ। খুলনা উত্তর- দক্ষিণে দীর্ঘ এবং যশোহর পূর্ব্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ। যশোহর ত্রিভুজাকৃতি এবং খুলনা মোটামুটি একটি আয়ত ক্ষেত্র।
লোকসংখ্যা।। গত ১৯২১ খৃষ্টাব্দের আদম-সুমারী বা লোকগণনা অনুসারে উভয় জেলার মোট লোকসংখ্যা ৩১,৭৫,২৫৩ জন; তন্মধ্যে যশোহরে ১৭,২২,২১৯ এবং খুলনায় ১৪,৫৩,০৩৪ জন। ১৮৮১ খৃঃ অব্দের পর খুলনা প্রথম পৃথক্ জেলা হওয়ার সময় হইতে গত চল্লিশ বৎসরে খুলনার জনসংখ্যা ৩,৭৬,৫২৩ বাড়িয়াছে এবং ঐ সময়মধ্যে যশোহরে ২,০০,৬৯৭ জন কমিয়াছে। ভৈরব প্রভৃতি[২] নদনদী মরিয়া যাওয়া এবং ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবই ইহার প্রধান কারণ। যশোহরে প্রতি বর্গমাইলে ৫৯৩ জন লোক বাস করে। সুন্দরবন সহিত খুলনার হিসাব করিলে, উহার প্রতি বর্গমাইলে মাত্র ৩০৭ জন লোক বাস করে কিন্তু সুন্দরবন বাদ দিলে বসতি অংশে প্রতি বর্গমাইলে লোকসংখ্যা উহার দ্বিগুণ হইবে।[৩] গত ১০ বৎসরে খুলনায় শতকরা ৭ জন লোক বাড়িয়াছে এবং যশোহরে শতকরা ১ জন কমিয়াছে।[৪]
হিন্দুর সংখ্যা যশোহরে ৬,৫৬,৩৪৩ জন এবং খুলনায় ৭,২৬,৮৬১ জন, মোট দুই জেলায় ১৩,৮৩,২০৪ জন। মুসলমানের সংখ্যা যশোহরে ১০,৬৩,৫৫ জন, খুলনায় ৭,২২,৮৮৭ জন, মোট ১৭,৮৬,৪৪২ জন। অর্থাৎ দুই জেলায় একত্রে মুসলমানের সংখ্যা শতকরা ৫৬.২৬ জন। যশোহরে শতকরা ৩৮.১১ জন হিন্দু, ৬১.৭৫ জন মুসলমান, অন্যধর্ম্মাবলম্বী প্রায় .১৪ জন; খুলনায় শতকরা ৫০.০২ জন হিন্দু; প্রায় ৪৯.৭৫ জন মুসলমান ও অন্যান্য প্রায় ২৩ জন। সুতরাং দেখা যাইতেছে, যশোহরে মুসলমানের সংখ্যা হিন্দু অধিবাসীর দেড়গুণের অধিক, খুলনায় হিন্দু ও মুসলমান প্রায় সমান। প্রতি জেলায় স্ত্রী অপেক্ষা পুরুষ ৬২ হাজারের বেশী।[৫]
আয়।। উভয় জেলায় গবর্ণমেন্টের আয় ৩৩ লক্ষ টাকা। তন্মধ্যে যশোহরে প্রায় ১৮ লক্ষ এবং খুলনায় ১৫ লক্ষের কিছু উপর। সুন্দরবন ক্রমশঃ আবাদ হওয়ার জন্য খুলনার আয় বৎসর বৎসর বৃদ্ধি পাইতেছে। যখন প্রথম জেলা হইয়াছিল, তখন খুলনার আয় মাত্র ৬ লক্ষ টাকা ছিল।
সব্ডিভিসন বা উপবিভাগ ॥ যশোহরে ৫টি উপবিভাগ (১) যশোহর সদর, (২) মাগুরা, (৩) ঝিনাইদহ, (৪) নড়াইল ও (৫) বনগ্রাম। ইহার মধ্যে সদর উপবিভাগে যশোহর, চৌগাছা, মণিরামপুর, কেশবপুর, ঝিকারগাছা, নওয়াপাড়া ও বাঘেরপাড়া এই ৭টি থানায় মোট ১০৭৪ খানি গ্রাম; মাগুরা উপবিভাগে মাগুরা, শ্রীপুর, শালিখা ও মহম্মদপুর এই ৪টি থানায় মোট ৫৪১ খানি গ্রাম; ঝিনাইদহে শোলকূপা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ, হরিণাকুণ্ড ও কোট চাঁদপুর থানায় ৮২৭ খানি গ্রাম; নড়াইলের মধ্যে কালিয়া, নরাগাঁতি, লোহাগড়া, আল্ফা ভাঙ্গা ও অভয়া নগর থানায় ৪৮৬ খানি গ্রাম এবং বনগ্রাম উপবিভাগে বনগ্রাম মহেশপুর, সারসা ও গাইঘাটা এই চারিটি থানায় ৬৮২ খানি গ্রাম। যশোহর জেলার মোট গ্রামসংখ্যা ৩৬১০।
খুলনা জেলায় তিনটিমাত্র উপবিভাগ : (১) খুলনা সদর (২) বাগেরহাট ও (৩) সাতক্ষীরা। ইহাদের মধ্যে সদরে খুলনা, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, তেরখাদা, দৌলতপুর, পালের হাট, ফুলতলা ও দাকোপ থানায় মোট ৫৭২ খানি গ্রাম; বাগেরহাট উপবিভাগে বাগেরহাট, মোল্লাহাট, রামপাল, মোরেলগঞ্জ, ফকিরহাট, কচুয়া ও স্বরণখোলা থানায় ৫৯৩ খানি গ্রাম এবং সাতক্ষীরার মধ্যে সাতক্ষীরা, আশাশুনি, কলারোয়া, কালীগঞ্জ,৬ তালা, শ্যামনগর ও দেবহাটা নামক ৭টি থানায় মোট ৮৪৩ খানি গ্রাম। খুলনার গ্রাম সমষ্টি ২০০৮; উভয় জেলায় ৮টি উপবিভাগে ৪৯টি থানায় মোট ৫৬১৮ খানি গ্রাম। গড়ে ১১৫ খানি গ্রাম লইয়া এক একটি থানা, প্রতি গ্রামে ৫৬৫ জন এবং প্রতি থানায় গড়ে প্রায় ৬৫ হাজার লোকের বাস।[৭]
এই উপবিভাগগুলির মধ্যে যশোহর, খুলনা ও বাগেরহাট সহর ভৈরব নদের উপর; মাগুরা ও ঝিনাইদহ নবগঙ্গার উপর; নড়াইল চিত্রানদীর উপর ও বনগ্রাম ইচ্ছামতীর উপর অবস্থিত। সাতক্ষীরা কোন নদীর উপর সংস্থিত নহে। পূর্ব্ববঙ্গ রেলওয়ের সেন্ট্রাল বা মধ্যবিভাগে বনগ্রাম, যশোহর ও খুলনা তিনটি প্রধান ষ্টেশন; খুল্না হইতে ষ্টীমারে নড়াইল, কালিয়া, বোয়ালমারি, তারপাশা, চুকনগর, মাগুরা ও সাতক্ষীরায় যাওয়া যায়; নূতন যশোহর-ঝিনাইদহ লাইট রেলওয়ের প্রান্ত ষ্টেশন ঝিনাইদহ। খুলনার অন্তর্গত আলাইপুরে আঠার বাঁকী ও ভৈরবের সঙ্গমস্থল হইতে বাগেরহাট পর্যন্ত ১৫/১৬ মাইল পথে যাতায়াত অত্যন্ত কষ্টকর হইয়াছে; জোয়ারের সময় অতি কষ্টে এ পথে নৌকা যায়, কিন্তু ভাটার সময় হাঁটিয়া যাওয়া ভিন্ন উপায় নাই। খুলনা হইতে বাগেরহাট পর্য্যন্ত রেলওয়ে খুলিয়াছে।
নামের উৎপত্তি ॥ যশোহর নামের উৎপত্তি লইয়া অনেক কথা আছে; এখন যে সহরকে যশোহর বলে, তাহা হইতে প্রাচীন যশোহর নগরী বহুদূরে অবস্থিত। প্রাচীন সেই প্রকৃত যশোহর এখন খুলনার মধ্যে। সে যশোর এক প্রাচীন স্থান এবং সেস্থান যে রাজ্যের মধ্যে সংস্থিত, তাহারও নাম যশোর। ইহার নাম যশোর হইল কেন, তাহা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। আরবী জসর বা যশোর শব্দে সেতু বুঝায়। যশোর জলবহুল দেশ বলিয়া এই অর্থে তাহার নামোৎপত্তি হইয়াছে, ইহাই সুপ্রসিদ্ধ কানিংহাম সাহেবের ধারণা।[৮] কিন্তু মুসলমান অধিকারের পূর্ব্ব হইতে যশোর নামের উল্লেখ দেখা যায়। যশোর একটি পীঠস্থান; পীঠস্থানের তালিকায় যশোরের নাম আছে।[৯] অন্যান্য প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে যেখানে যশোর রাজ্যের প্রসঙ্গ আছে, সেখানে ‘যশোর’ নামই দৃষ্ট হয়, ‘যশোহর’ নাম নাই।[১০] প্রতাপাদিত্য এই যশোর রাজ্যের রাজা হইয়াছিলেন। বর্ত্তমান খুলনা জেলার দক্ষিণাংশে অবস্থিত কালীগঞ্জ হইতে ১২ মাইল দক্ষিণে সুন্দরবন অঞ্চলে তাঁহার রাজধানী ছিল। সে রাজধানীর নামও যশোর।[১১] এই রাজধানীর অন্তর্গত ঈশ্বরীপুর নামক স্থানে এখন যশোরেশ্বরী দেবীর পীঠমন্দির ও মূৰ্ত্তি আছে।[১২] প্রতাপাদিত্যের পিতা বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে প্রথম ‘যশোহর’ নাম হয়। যশোরে বনস্থলী আবাদ করিয়া তথায় নগরী স্থাপনাকালে প্রতাপাদিত্যের খুল্লতাত সুকবি বসন্তরায় যশোরকে যশোহর করিয়াছিলেন, ইহাই বিশ্বাসযোগ্য এবং এইরূপ প্রবাদও প্রচলিত রহিয়াছে।
বঙ্গের শেষ পাঠান নৃপতি দায়ুদশাহ মোগল কর্তৃক পরাজিত হইয়া পলায়ন করিবার সময় রাজধানী গৌড় ও তাণ্ডার অধিকাংশ রাজকীয় ধনরত্ন বিক্রমাদিত্যের হস্তে সমর্পণ করেন। কেহ কেহ এইরূপ অনুমান করেন যে, নবপ্রতিষ্ঠিত যশোরনগরী এইরূপে গৌড়ের যশঃ হরণ করে বলিয়াই উহার নাম হইয়াছিল—যশোহর।[১৩] আবার কেহ বলেন যে, গৌড়ের সহিত তুলনা না করিয়াই কোন ব্যক্তি এ রাজ্য ‘অত্যধিক যশস্বী’-এই অর্থে ‘যশোহর’ নাম দিয়াছিলেন।[১৪] কিন্তু যশোহর নাম নূতন দেওয়া হয় নাই। পূর্ব্বে ইহার একটা নাম ছিল এবং সে নাম যশোর। রামরাম বসুর মতে ‘দক্ষিণ দেশে যশহর নামে এক স্থান’ ছিল। যাহা হউক, এই নাম যশোর বা ‘যশহর’ যাহাই থাকুক, উহাতে বিশেষ অর্থ হইত না। এজন্য বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে উহাকে বিশুদ্ধ ও অর্থসঙ্গত করিবার জন্যই উহার ‘যশোহর’ এইরূপ নামকরণ হইয়া থাকিবে। তখন হইতে পণ্ডিত ও কুলাচার্য্যগণের উক্তিতে যশোহর নাম দেখা যায়।[১৫] তবুও তদবধি যশোর ও যশোহর শব্দ একই অর্থে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে।
প্রতাপের পরাজয়ের পর বিজয়ী মানসিংহ বসন্তরায়ের পুত্র কচুরায় বা রাঘবকে ‘যশোরজিৎ’ উপাধি দেন। অল্পদিনে তাঁহার বংশীয়গণের রাজত্ব ফুরাইলে, যশোর রাজ্যশাসনের জন্য একজন ফৌজদার নিযুক্ত হন। উঁহাকে যশোরের ফৌজদার বলিত। তিনি স্বাস্থ্যহানির ভয়ে সুন্দরবন অঞ্চল ত্যাগ করিয়া, কপোতাক্ষ-কূলে ত্রিমোহনীতে বাস করেন। এই সময়ে চাঁচড়ার রাজা মনোহর রায় যখন ক্রমে নানাসূত্রে যশোর রাজ্যের অধিকাংশ পরগণার জমিদার হইলেন, তখন নবাব সায়েস্তা খাঁর আমলে যশোরের ফৌজদারের পদ উঠিয়া গেল। তবুও চাঁচড়ার রাজবাটীর সন্নিকটে বলিয়া মুড়লীতে যশোরের একটি ফৌজদারী কাছারী রহিল। কিন্তু মনোহর রায়ই তখন যশোরের প্রকৃত রাজা ছিলেন।
ইংরাজেরা রাজ্যাধিকার করিয়া যখন দেওয়ানী বিভাগ মুর্শিদাবাদ হইতে কলিকাতায় আনিলেন, তখন যশোহর রাজ্যেরও একজন রাজস্বসংগ্রাহক বা কালেক্টরকে এই মুড়লীতে পাঠাইয়া দিলেন (১৭৭২)। কিন্তু দুই বৎসর পরে এ ব্যবস্থা উঠিয়া গেলেও, ১৭৮১ খৃঃ অব্দে শান্তিরক্ষার জন্য পূর্ব্বকালীয় ফৌজদারের মত একজন শাসক বা ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হইয়া আসিলেন। তখন যে আফিস-আদালত হইল, তাহাকে লোকে মুড়লীর কাছারীও বলিত, যশোরের কাছারীও বলিত। ১৭৮৯ খৃঃ অব্দে এই সকল কাছারী পার্শ্ববর্ত্তী কসবা বা সাহেবগঞ্জে স্থানান্তরিত হইল, তখন হইতে ঐ স্থানের নাম হইল— যশোর বা Jessore।
বর্তমান যশোহর সহরের নামের ইহাই উৎপত্তি। এক্ষণে লোকে সাধারণ কথায় ইহাকে যশোর বলে এবং বাঙ্গালা ভাষায় বিশুদ্ধ করিয়া যশোহর লেখা হয়। ‘যশোর’ প্রাচীন কথা; ‘যশোহর’ বিশুদ্ধ বা অর্থসঙ্গত হইলেও আধুনিক কথা। আমরা এ পুস্তকে অনেক স্থানে বিশেষ কোন পার্থক্য না ধরিয়া উভয় নামই ব্যবহার করিব। প্রাচীন রাজ্যের প্রসঙ্গ হইলে তাহাকে সাধারণতঃ যশোরই বলিব, যশোহর বলিব না; আধুনিক জেলাকে যশোর বা যশোহর বলিব এবং আধুনিক সহরকে সাধারণতঃ যশোহরই বলিব, যশোর বলিব না।
খুলনা ॥ যশোহরের মত খুলনা নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে বিশেষ কোন বিশ্বাসযোগ্য কারণ পাওয়া যায় না। প্রবাদ কতই আছে বটে, কিন্তু কোনও প্রবাদেরই বিশেষ ভিত্তি আছে বলিয়া মনে হয় না। তবুও প্রবাদগুলির দুই একটি আলোচনা করা উচিত। পূর্ব্বকালে এখানে সুন্দরবনের ভীষণ জঙ্গল ছিল। ইংরাজ আমলেও খুলনাকে নয়াবাদ বা নূতন আবাদ বলিত; অথচ উত্তর পারে ‘সেনের বাজার’ প্রাচীন স্থান। সেই পূৰ্ব্বকালেও লোকে কাঠ কাটিতে সুন্দরবনে যাইত; তখন এদেশের ব্যবহারোপযোগী যাহা কিছু কাঠ সুন্দরবন হইতেই আসিত। পশ্চিমদেশে বা বিদেশে বাণিজ্যার্থ যাইতে হইলে, সুন্দরবনের মধ্য দিয়া যাইতে হইত। নয়াবাদেই বসতির শেষ এবং বনের আরম্ভ। দিবাশেষে নৌকার বহর নয়াবাদের নিম্নে আসিয়া রাত্রিবাস করিত, রাত্রিতে কেহ নৌকা খুলিতে সাহসী হইত না। লোকে বলে যে, রাত্রিতে কোন দুঃসাহসিক মাঝি নৌকা খুলিতে গেলে জঙ্গলের মধ্য হইতে বন-দেবতা তাহাকে বারণ করিয়া বলিতেন ‘খু’লো না, খু’লো না।’ যেস্থান হইতে এই ‘খু’লো না’ শব্দ হইত বা কোন একবার হইয়াছিল, তাহারই নাম হইয়া গেল—খুলনা। হয়ত খুলনা শব্দের অক্ষর-বিন্যাস হইতে কল্পনা-কৌশলেই এইরূপ ব্যুৎপত্তি বাহির হইয়াছে।
‘কবিকঙ্কণ’ কৃত চণ্ডীকাব্য হইতে জানি যে, পূর্ব্বে বৰ্দ্ধমান জেলায় অজয় নদের তটে উজানি (উজ্জয়িনী) নামে নগর ছিল। এইস্থানে এক সাধু বা সওদাগর বাস করিতেন; তাঁহার নাম ধনপতি। তিনি শুধু নামে ধনপতি নহেন; বঙ্গ ভরিয়া বাণিজ্য করিয়া, তিনি প্রকৃত কাযেও ধনপতি হইয়াছিলেন। ধনপতির দুই স্ত্রী— লহনা ও খুল্লনা। যেমন সর্ব্বত্র হয়, দুই স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ ও প্রকৃতির পার্থক্য যথেষ্ট ছিল; জ্যেষ্ঠা লহনা ক্রুরা ও হিংসাপরায়ণা, কনিষ্ঠা খুল্লনা সাধ্বী ভক্তিমতী আদর্শ স্ত্রী। একদা ধনপতির অনুপস্থিতিকালে লহনা তাহার সতা খুল্লনাকে যৎপরোনাস্তি কষ্ট দিয়াছিল। উহাতে খুল্লনার চরিত্র পরীক্ষিত হইল এবং স্বামী ফিরিয়া আসিলে, অচিরে তাহার সুখের দিনও ফিরিল। খুল্লনা তখন স্বামি-হৃদয়ের ষোল আনা অধিকার করিয়া আদরিণী হইয়া বসিল। প্রবাদ প্রচলিত যে, এই খুল্লনা নাম হইতেই ‘খুলনা’ নামের উৎপত্তি হইয়াছে।
পূর্ব্বে বণিকগণের বাণিজ্যতরী সর্ব্বদেশে ফিরিত। তাহারা স্বদেশী পণ্যে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ‘ডিঙ্গা’ সাজাইয়া দেশে বিদেশে সমুদ্রপারে বহুস্থানে বাণিজ্য করিতে যাইত এবং বিদেশের অর্থে দেশের ধনবৃদ্ধি করিত। এক সময়ে এই বণিকদিগের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান ও প্রতিপত্তিশালী ছিলেন চাঁদ বা চন্দ্রধর সওদাগর। ধনপতি পিতৃশ্রাদ্ধকালে তাঁহারই চরণে প্রথম অর্ঘ্য দিয়াছিলেন।[১৬] চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যতরী না যাইত, এমন স্থান নাই। বঙ্গের দক্ষিণকূলে প্রধান প্রধান সমস্ত বন্দর বা বাজারের সহিত তাঁহার কারবার চলিত। সেই সকল স্থানে নানাভাবে তাঁহার কীর্ত্তিচিহ্ন থাকিয়া যায়। উহারই পরিচয়ে আজ বহু জেলার লোকে বাড়ীর কাছে চাঁদ সওদাগরের বসতিস্থান ছিল বলিয়া দাবি করিতেছেন।[১৭] ধনপতিও এই একই প্রকার সওদাগর, ‘চাঁদ বেণের’ মত তাঁহারও বিস্তৃত কারবার ছিল। দক্ষিণদেশে যেখানে বসতির শেষ ও বনের আরম্ভ, সেইরূপ অনেক স্থানে ইঁহাদের কীৰ্ত্তি-চিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায়। খুলনা জেলায় কপিলমুনি এক অতি পুরাতন স্থান। সেখানে প্রাচীন কাল হইতে মুনির আশ্রম ও কপিলেশ্বরী দেবীর মন্দির ছিল। ধনপতি সেখানে বাণিজ্যার্থ আসিয়া উহার দক্ষিণে লহনা-খুল্লনার নাম প্রতিষ্ঠা করিয়া যান। এখনও কপিলমুনি হইতে দক্ষিণ মুখে কাটীপাড়া যাইবার পথে বর্ত্তমান ডিষ্ট্রীক্ট বোর্ডের রাস্তায় এক স্থানে ‘লহনা-খুল্লনার’ পুল বিল আছে।
সম্ভবতঃ ধনপতি সওদাগর কপিলেশ্বরী নামের অনুকরণে নয়াবাদের প্রান্তে ভৈরবকূলে তাঁহার প্রিয়তমা স্ত্রীর নামে খুল্লনেশ্বরী নামে চণ্ডীদেবীর এক মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। উহার ঠিক অপর পারে অর্থাৎ ভৈরবের উত্তর কূলে ধনপতির অপর স্ত্রী লহনার নামে তিনি লহনেশ্বরী দেবীমূৰ্ত্তি স্থাপিত করেন।[১৮] খুলনা দ্বারাই প্রথম বণিক সমাজে চণ্ডীদেবীর মাহাত্ম্য ব্যাখ্যাত হইয়াছিল। এই খুল্লনেশ্বরী হইতেই খুলনা নামের উৎপত্তি হইয়াছে বোধ হয়।
কোম্পানীর আমলে রেণী নামক[১৯] এক সৈনিক ঘটনাচক্রে বর্ত্তমান খুলনার পূর্ব্ব পারে তালিমপুর গ্রামে আসিয়া খুল্লনেশ্বরীর মন্দিরের সন্নিকটে নদীতীরে বসতি স্থাপন করেন এবং নীল, চিনি প্রভৃতি দ্রব্যের বিস্তৃত বাণিজ্য খুলেন।[২০] যথাস্থানে (২য় খণ্ডে) ইহার পৃথক বিবরণ প্রদত্ত হইবে। ক্রমে নিকটবর্ত্তী প্রবল জমিদার শিবনাথ ঘোষের সহিত তাঁহার ভীষণ বিবাদ হয়, শান্তিরক্ষার জন্য কোম্পানি কর্তৃক তখন রেণী ও শিবনাথের বাড়ীর মধ্যস্থানে ‘নয়াবাদের থানা’ স্থাপিত হয়।[২১]
অচিরে যখন ঐ বিবাদ রীতিমত যুদ্ধ-বিদ্রোহে পরিণত হয়, তখন খুলনা নামে এই স্থানে একটি সব্ডিভিসন্ স্থাপিত হয় (১৮৪২ খৃঃ)। বঙ্গদেশের মধ্যে খুলনাই প্রথম সব্ডিভিসন; তদবধি এই নাম চলিয়া আসিতেছে। পূর্ব্বে রূপসা একটি ক্ষুদ্র খাল ছিল; উহা এক্ষণে প্ৰকাণ্ড নদীর আকার ধারণ করিয়া নয়াবাদ ও প্রাচীন খুলনাকে বর্তমান খুলনা সহর হইতে পৃথক করিয়া ফেলিয়াছে।
পাদটীকা :
১. এই পরিচ্ছেদের সকল পরিসংখ্যান এবং জেলা, বিভাগ ও উপবিভাগের বিবরণ ১৯২১ খৃষ্টাব্দের আদম- সুমারী হইতে গৃহীত। ঐতিহাসিক তথ্য হিসাবে তাহাই রক্ষিত হইল।—শি মি
২. ‘Jessore like Nadia is a land of moribund rivers and obstructed drainage and declining popula- tion’ Census Report, 1911.
৩. সঠিক হিসাবে সুন্দরবন ও বড় নদী অংশ (৩২ বর্গমাইল) বাদ দিলে প্রতি বর্গমাইলে ৫৯৭ জন হইবে। Census Report, 1921, V, pp. 454-55-শি মি
৪. সঠিক হিসাবে খুলনায় ৬.৭ বাড়িয়াছে এবং যশোহরে কমিয়াছে ১.২. Ibid; See also R. K. Mukerjee— Charging Face of Bengal (1938). p. 77-শি মি
৫. দ্বিতীয় সংস্করণে মুদ্রাকর ভ্রমে কিছু ভুল সংখ্যা ছিল। ফলে আনুপাতিক হিসাবেও ভুল থাকিয়া যায়। ১৯২১ খৃষ্টাব্দের আদম-সুমারী পরীক্ষান্তে তাহা শুদ্ধ করিয়া দেওয়া হইল।-শি মি
৬. যশোহর ও খুলনা উভয় জেলায় পৃথক্ কালীগঞ্জ ও মাগুরা আছে। খুলনার কালীগঞ্জ দক্ষিণদেশে, উহার সন্নিকটে প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল। যশোহরের কালীগঞ্জ উত্তর ভাগে, ইহার সন্নিকটে নলডাঙ্গা রাজবাটী।
৭. পূর্ব্বে থানার সংখ্যা কম থাকায় প্রতি থানায় প্রায় লক্ষ লোকের বাস ছিল। এই পুস্তকের ১ম সংস্করণে সেইরূপই উল্লেখ ছিল। শি মি
৮. The name of Jasar, the bridge, shows the nature of the country which is completely intersected by deep water course’-Cunningham’s Ancient Geography, P. 502.
৯. ‘যশোরে পাণিপদ্মঞ্চ দেবতা যশোরেশ্বরী।
চণ্ডশ্চ ভৈরবো যত্র তত্র সিদ্ধিমবাপ্লুয়াৎ।।’-তন্ত্রচূড়ামণি
১০. ‘উপবঙ্গে যশোরাদিদেশাঃ কাননসংযুতাঃ। জ্ঞাতব্যা নৃপশাৰ্দ্দুল বহুলাসু নদীষু চ’- কবিরামকৃত ‘দিগ্বিজয়প্রকাশ’ পুঁথি
‘যশোরদেশবিষয়ে যমুনেচ্ছাপ্রসঙ্গমে।
ধুমঘট্টপত্তনে চ ভবিষ্যন্তি ন সংশয়ঃ’-ভবিষ্যপুরাণ
১১. ‘যশোর নগর ধাম, প্রতাপ আদিত্য নাম,
মহারাজা বঙ্গজ কায়স্থ।’-ভারতচন্দ্র কৃত অন্নদামঙ্গল
১২. যশোরেশ্বরীকে মানসিংহ লইয়া যান বলিয়া যে প্রবাদ আছে, তাহা মিথ্যা কথা। যথাস্থানে তাহার প্রমাণ দেওয়া হইয়াছে। যশোহর-খুলনার ইতিহাস, ২য় খণ্ড, মোগল আমল, ২৪শে পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
১৩. হরিশচন্দ্র তর্কালঙ্কার-কৃত ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত।’
১৪. “It was intended to express the idea ‘Supremely glorious.’ – Westland’s Report on the district of Jessore, 1871, p. 30.
১৫. পণ্ডিত-রচিত কবিতায়-’যশোহরপুরী কাশী দীর্ঘিকা মণিকর্ণিকা।
ঘটক কারিকায়—’সেনাপতিরূপা সা যশোহরসুরক্ষকা।’
অন্যত্র-‘রাজবিপ্লবেন গৌড়াৎ যশোহরং সমাগতঃ।’
১৬. ‘সবার অধিক বটে চাঁদ মহাতেজা’, তাই ধনপতি ‘আগে জল দিল চাঁদ বেণের চরণে’–কবিকঙ্কণ চণ্ডী, ইণ্ডিয়ান প্রেস সংস্করণ (১৯১১-শি মি), ১৮০ পৃ।
১৭. রায় বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন প্রণীত ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ (৮ম সংস্করণ), ১১৬ পৃ।
১৮. কালে সৰ্ব্বত্রই প্রায় চণ্ডীমূৰ্ত্তি কালীমূৰ্ত্তিতে পরিণত হন। ভৈরবের চড়ায় উলুবনের মধ্যে লহনেশ্বরীর স্থান আমরাও দেখিয়াছি। উহা উলুবনের কালীবাড়ী বলিয়া পরিচিত ছিল। এক্ষণে নদীর ভাঙ্গনের জন্য সে কালীবাড়ী নন্দনপুর গ্রামের মধ্যে স্থানান্তরিত হইয়াছে।
১৯. William Henry Sneyd Rainey of the 3rd Buffs.
২০. বর্তমান খুলনা সহরের পূর্ব্বপারে তালিমপুরে রেণীসাহেবের নূতন বাড়ীর উত্তর-পূর্ব্ব কোণে নদীকূলে আমরা বিখ্যাত খুল্লনেশ্বরীর মন্দির দেখিয়াছি। উহা আজ ৩০ বৎসর হইল নদীগর্ভস্থ হইয়াছে। এক্ষণে খুল্লনেশ্বরী কালিকা আরও কিছু পূর্ব্বদিকে গ্রামের কোণে পূর্ব্ববৎ পূজিত হইতেছেন।
২১. এখনও তালিমপুরে রেণীসাহেবের পুরাতন বাড়ী ও শ্রীরামপুর গ্রামের মাঝখানে একটি উচ্চভিট্টি ও ‘খানার পুকুর’ আছে। ঐস্থানে নয়াবাদের থানা ছিল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন