সতীশচন্দ্র মিত্র
সূর্য্যোদয়ের প্রাক্কালে যেমন প্রাচীদেশ রক্তিমবর্ণে রঞ্জিত হয়, শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্ব্বেও তেমনই সমগ্র বঙ্গদেশ তাঁহারই মতে, তাঁহারই প্রাণে অনুপ্রাণিত হইতেছিল। প্রভাত-পক্ষীর প্রথম কাকলীর মত কোন কোন দিক্ হইতে তাঁহার নবমত ঝঙ্কারিত হইতেছিল। নামের মাহাত্ম্য কীৰ্ত্তনই চৈতন্যমতের সার নীতি। কিন্তু অনন্যসাধনায় এ নীতি প্রথম প্রচার করিয়াছিলেন হরিদাস। কীৰ্ত্তনপ্রথা তিনিই প্রবর্তন করেন। স্তব্ধ রজনীর নির্জ্জনতা ভেদ করিয়া তিনি ভগবানের নামানুকীৰ্ত্তন দ্বারা পরলোকের বার্তা বিজ্ঞাপিত করিয়াছিলেন। যে দেশে তান্ত্রিকমতে অতি সঙ্গোপনে মনে মনে সংক্ষিপ্ত বীজমন্ত্র জপ করিবার প্রথা ছিল, সেই দেশে সৰ্ব্বজনশ্রুতিযোগ্য উচ্চকণ্ঠে ইষ্টদেবের পূর্ণ নাম উচ্চারিত করিবার পদ্ধতি তিনিই দেখাইয়াছিলেন। হিন্দুশাস্ত্রে অনেক যজ্ঞের কথা আছে, তন্মধ্যে জপ-যজ্ঞ একটি। প্রাচীন মনু-সংহিতায়ও এই যজ্ঞের কথা আছে। কিন্তু সে যজ্ঞে কিরূপে পূর্ণাহুতি দিতে হয়, আধুনিক যুগে হরিদাসের সাধন-জীবনই তাহার সজীব দৃষ্টান্ত রাখিয়াছে।
বৈষ্ণবযুগে কত হরিদাস আবির্ভূত হইয়াছিলেন! তন্মধ্যে দুইজন ছিলেন ‘কীর্তনিয়া’ হরিদাস; আমরা যাঁহার কথা বলিব, তিনি সাধারণতঃ যবন হরিদাস নামে পরিচিত। ইঁহাকে ব্রহ্ম হরিদাস ও বলে।১ ইনি পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বুঢ়নে অবতীর্ণ হন।
‘বূঢ়নে হইলা অবতীর্ণ হরিদাস।
সে ভাগ্যে সে সব দেশে কীৰ্ত্তন প্রকাশ।’
—শ্রীবৃন্দাবনদাস-কৃত চৈতন্যভাগবত
এই বুঢ়ন কোথায়? বুঢ়নের অবস্থান বিষয়ে অনেকেই ভ্রমে পতিত হইয়াছেন।২ অতি প্রাচীনকালে বুঢ়ন একটি দ্বীপ ছিল; আমরা এই বৃদ্ধদ্বীপ বা বুঢ়নের কথা পূর্ব্বে বিশেষভাবে আলোচনা করিয়াছি। পূৰ্ব্বে বুঢ়ন যত বড় দ্বীপ ছিল, এখন ইহার আকার তত বড় নহে। বৰ্ত্তমান খুলনা জেলার অন্তর্গত সাতক্ষীরা মহকুমার বুঢ়ন নামে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র পরগণা এখনও বৰ্ত্তমান আছে। জয়ানন্দের চৈতন্য-মঙ্গলে আছে :
‘স্বর্ণ নদীতীরে ভাটকলাগাছি গ্রামে।
হীনকুলে জন্ম হয় উপরি পূৰ্ব্ব নামে।।’
ভক্ত জয়ানন্দ চৈতন্যদেবের সমসাময়িক; তাঁহার কথা বড়ই প্রামাণিক। তিনি কেবলমাত্র পরগণার নাম বলিয়া ক্ষান্ত হন নাই। তিনি হরিদাসের জন্মপল্লীর নাম দিয়াছেন। ‘ভাটকলাগাছি’ একটি গ্রামের নাম নহে, উহা জোড়া গ্রাম। বুঢ়ন পরগণায় এখনও স্বর্ণনদী বা সোনাই নদী আছে; এবং উহার কূলে ভালা বা ভাটপাড়া এবং কলাগাছি বা কেরাগাছি নামে দুইটি পাশাপাশি গ্রাম এখনও আছে। যশোহর-খুলনায় অন্ততঃ ৭/৮ টি কলাগাছি আছে। যশোহর-খুলনায় অন্ততঃ এইরূপ থাকিলে একটি গ্রামকে বিশেষ করিবার জন্য অন্য পার্শ্ববর্তী গ্রামের সহিত উহার যোগ করিয়া দিয়া জোড়ানামে গ্রামের পরিচয় হয়; এ রীতি এদেশে চিরকাল চলিয়া আসিতেছে। চালার পার্শ্ববর্ত্তী কলাগাছি গ্রামে হরিদাসের জন্ম হইয়াছিল।’ এখনও সে প্রদেশে এ প্রবাদ মাছে; তবে এই দেবরূপী সাধুর জন্মপল্লীতে তাঁহার নামে কোন উৎসব নাই, ইহাই বিচিত্র কথা। রিদাসের জন্মপুণ্যে খুলনা জেলা ধন্য হইয়াছে।
হরিদাস মুসলমান বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, ইহাই প্রচলিত কথা। বহু-বৈষ্ণব গ্রন্থে দেখিতে পাই, তিনি ‘হীনকুলে জাত’; আবার মুসলমান নরপতি হুসেন শাহ তাঁহাকে ‘মহাবংশজাত’ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। ইহা হইতে বুঝা যায়, তিনি মুসলমান বংশে জন্মলাভ করেন। দেবত্ব কোন কুলগত নহে, ইহাই দেখাইতে গিয়া বৃন্দাবন দাস এ মতের সমর্থন করিয়াছেন। কেহবা ভাট-কলাগাছিতে জন্ম দেখিয়াই তিনি ভাট-বংশীয় ছিলেন এইরূপ অদ্ভুত অনুমান প্রকাশ করিতে কুণ্ঠিত হন নাই। কলাগাছি ভাট প্রধান স্থান বলিয়া ভাট-কলাগাছি নাম হইতে পারে, কিন্তু তাহা হইতে হরিদাসের ভাট-জাতিত্ব প্রতিপন্ন হয় না। যাহা হউক, আমরা দেশীয় প্রবাদাদি হইতে অনুসন্ধান দ্বারা যতদূর জানিতে পারিয়াছি, তাহাতে হরিদাস যে হিন্দুসন্তান ছিলেন, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। জয়ানন্দই তাঁহার পিতামাতার নাম দিয়াছেন :
‘উজ্জ্বলা মায়ের নাম, পিতা মনোহর।’
কেহ কেহ কতিপয় সংস্কৃত গ্রন্থ হইতে দেখাইয়াছেন যে, হরিদাসের মাতার নাম গৌরীদেবী এবং পিতার নাম সুমতি শর্ম্মা।[৫] কিন্তু আমরা জয়ানন্দের প্রামাণিক বর্ণনা উপেক্ষা করিবার কোন কারণ দেখিতে পাই না। এই মনোহর চক্রবর্ত্তী জপতপ-পরায়ণ সুব্রাহ্মণ ছিলেন। গোঁসাই গোরাচাঁদ কৃত ‘শ্রীশ্রীসঙ্কীৰ্ত্তনবন্দনা’ নামক হস্তলিখিত পুঁথিতে পাইয়াছি :
‘মনোহর চক্রবর্ত্তী সুমতি ব্ৰাহ্মণ।
জপাতপা যাহান ব্রাহ্মণের আচরণ॥’
মনোহর চক্রবর্ত্তী সুব্রাহ্মণ ও সুপণ্ডিত ছিলেন। তাঁহার রীতিমত চতুষ্পাঠী ছিল, বহু ছাত্র ছিল। তাঁহার শ্রীনন্দকিশোর ও বাসুদেব নামে দুইটি কুলবিগ্রহ ছিলেন, উঁহাদের নিয়মমত সেবা হইতে। এখন মনোহরের বাসুদেব বিগ্রহ নিকটবর্ত্তী বিথারি গ্রামে শীতলচন্দ্র চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের গৃহে অধিষ্ঠিত আছেন। কলাগাছি গ্রামে এখনও লোকে মনোহর চক্রবর্ত্তীর ভিট্টা দেখাইয়া দেয়, আমরা সে গ্রামে গিয়া সে ভিট্টা দেখিয়াছি। ঐ ভিট্টার বা হরিদাসের পৈতৃক সম্পত্তির যাঁহারা আধুনিক মালিক, তাঁহাদের গৃহরক্ষিত প্রাচীন দলিল হইতে বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায়। বিশেষতঃ, মনোহরের বংশের কেহ কেহ এখনও জীবিত আছেন এবং চক্রবর্ত্তী-বংশীয়েরা ১৭/১৮ পুরুষ কলাগাছিতে বাস করিতেছেন।[৬]
এক্ষণে প্রশ্ন এই হিন্দুসন্তান কেন যবন বলিয়া কীৰ্ত্তিত হইলেন। বৈষ্ণব গ্রন্থেই আমরা পাই, হরিদাস ১৩৭২ শকে বা ১৪৫০ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।[৭] আমরা দেখিয়াছি এ সময়ে খাঁ জাহান আলি পূর্ণ প্রতাপে খালিফাতাবাদে বা বাগেরহাটে শাসনদণ্ড পরিচালনা করিতেছেন। তাঁহার প্রধান কর্ম্মচারী মহম্মদ তাহের বা পীর আলি বহুসংখ্যক হিন্দুকে মুসলমান ধর্ম্মে প্রবর্তিত করিতেছিলেন। সেই ধর্ম্ম পরিবর্তনের তরঙ্গ পূর্ণভাবে সাতক্ষীরা অঞ্চলে আসিয়াছিল, তাহারও বিশেষ আভাস দিয়াছি।[৮] সম্ভবতঃ হরিদাসের জন্মের ২/৩ বৎসর পর তাঁহার পিতা দেহত্যাগ করেন এবং তাঁহার মাতা চিতারোহণে স্বামীর অনুগমন করেন। হরিদাস পিতামাতা হারাইয়া নিরাশ্রয় হইয়াছিলেন। এ সময়ে কলাগাছি প্রভৃতি স্থানের বহুসংখ্যক হিন্দুই মুসলমান হইয়া গিয়াছিলেন। এই নিরাশ্রয় অবস্থায় হরিদাস কলাগাছির অপর পারে অবস্থিত হাকিমপুরের জনৈক মুসলমান কর্তৃক অপহৃত হন, ইহাই সম্ভবপর। কলাগাছির বর্তমান ভূম্যধিকারী রায়চৌধুরীগণ পূর্ব্বে নিকটবর্ত্তী কুশখালিতে বাস করিতেন। শ্রীসঙ্কীর্ত্তন বন্দনার লেখক গোঁসাই গোরাচাঁদ কুশখালিতে আসিয়া চাঁদরায়ের আতিথ্য গ্রহণ করেন। সম্ভবতঃ এই চাঁদরায় বা তাঁহার পুত্র কৃষ্ণরাম সোনাই নদীর কূলে এবং তাঁহার ভ্রাতা গন্ধর্ব্বরায় সাতক্ষীরার নিকটবর্ত্তী আগরদাঁড়িতে বাস করেন। চাঁদরায় হইতে এক্ষণে ১০/১১ পুরুষ নামিয়াছে। হরিদাসের বাল্যকালে রায়চৌধুরীরা কলাগাছিতে ছিলেন না, কিন্তু ঐস্থান ও উহার নিকটবর্ত্তী গ্রামগুলি তাঁহাদের জমিদারীর অন্তর্গত ছিল। এই ভূসম্পত্তি লইয়া তাঁহাদের সহিত পরপারস্থ হাকিমপুরের পীরালি-বংশীয় মুসলমানদিগের সর্ব্বদা বিবাদ হইত। বহুবার চৌধুরীরা লুটপাট করিয়া মুসলমানদিগকে উদ্বাস্তু করেন এবং সুযোগ পাইবামাত্র মুসলমানেরাও চৌধুরীদিগের নিজের বা প্রজার বাড়ীতে পড়িয়া লুটপাট ও বিস্তর ক্ষতি করিতেন। এই বিবাদমূলে একটা লুটপাটের সময় অসহায় অবস্থায় শিশু হরিদাস অপহৃত হন এবং এক নিঃসন্তান বৃদ্ধ মুসলমান তাঁহাকে হাকিমপুরে লইয়া গিয়া পুত্রবৎ প্রতিপালন করেন। ইঁহার নাম হবিবুল্যা কাজি এবং এই জন্যই কথা হইয়াছিল :
‘হবুল্যা কাজির বেটা ব্রহ্ম হরিদাস।’
এই কাজির গৃহেই হরিদাস প্রতিপালিত হন এবং তজ্জন্যই তাঁহাকে লোকে মুসলমান বলিয়া ব্যাখ্যাত করে।[৯] শ্রীনিত্যানন্দ দাস-বিরচিত ‘প্রেম-বিলাস’ নামক প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব গ্রন্থে আছে :
‘বুড়নে হইল জন্ম ব্রাহ্মণের বংশে।
যবনত্ব প্রাপ্তি তার যবনান্ন দোষে॥’— ২৪শ বিলাস
পরবর্ত্তীকালে এইজন্য হরিদাস মুসলমান বলিয়া সর্ব্বত্র পরিচিত হন। এইজন্য বঙ্গাধিপ হুসেন শাহ তাঁহার বিচার করিবার সময়ে তাঁহাকে ‘মহাবংশজাত’ বলিয়া উল্লেখ করিয়া থাকিবেন।[১০]
পালক পিতা কাজি সাহেবের চেষ্টায় হরিদাস শৈশবে আরবী, পারসী ও বাঙ্গালা ভাষায় সময়োচিত সাধারণ শিক্ষালাভ করেন। তিনি শিশুকাল হইতে ধর্মগ্রন্থ পাঠ করিতেন। সম্ভবতঃ হাকিমপুরের কাজিরা এজন্য তাঁহার উপর বিরক্ত হইতেন। সে বিরক্তি হইতে অযত্ন ও অত্যাচার হওয়াও অসম্ভব নহে। হরিদাস শৈশব হইতেই সংসারে বিরক্ত ছিলেন। কিছুতেই সংসারে তাঁহার মন বসিত না, তিনি পালনকর্তার কথা শুনিতেন না। অবশেষে তাঁহার ১৮ বৎসর বয়সে যখন কাজি সাহেব বিবাহ দিবার উদ্যোগ করিলেন, সেই সময়ে একদিন তিনি রাত্রিকালে হরিনাম সম্বল করিয়া মুসলমানের গৃহত্যাগ করেন এবং বেণাপোল গ্রামের এক জঙ্গলে আসিয়া বাস করিতে থাকেন। তিনি নিজের জন্য সামান্য একখানি কুটীর রচনা করেন এবং কুটীরের সন্নিকটে একটি বেদীতে তুলসীবৃক্ষ রোপণ করিয়া তাহার সেবা করিতে থাকেন।[১১] এই সময়ে তাঁহার জীবনের প্রধান কাৰ্য্য জপ-যজ্ঞ আরম্ভ হয়। হরিদাস আনুমানিক ৮/১০ বৎসরকাল বেণাপোলে থাকিলেন। তিনি বালকের মত সরল; বালকেরা তাঁহাকে বড় ভালবাসিত। বালকের হাসিতে তিনি হাসি মিশাইয়া আনন্দে ভাসিতেন। তিনি করতালি দিয়া তাহাদিগকে হরিবুলি শিখাইতেন। সাধু বলিয়া তাঁহাকে দেখিতে আসিয়া যে যাহা খাইতে দিয়া যাইত, ফলমূল বা বাতাসা যাহা তিনি হাতের কাছে পাইতেন, হরিবোল বলিয়া তিনি তাহা বালকদিগকে ছড়াইয়া দিতেন। তদবধি বেণাপোলে হরিদাস কর্তৃক হরির লুঠের সৃষ্টি হইল। কিছুদির পরে সে স্থান তাঁহার আর ভাল লাগিল না। তিনি নবদ্বীপ শান্তিপুরের গল্প শুনিতেন, প্রভু অদ্বৈতাচার্য্য উভয়স্থলে ভক্তি শাস্ত্রের নূতন ব্যাখ্যা করিয়া সর্ব্বস্থান হইতে ভক্তদিগকে আকর্ষণ করিতেছিলেন। হরিদাস সেই ভাব-তরঙ্গে যোগ দিবার জন্য বেণাপোল ত্যাগ করিয়া প্রথম নবদ্বীপে ও পরে শান্তিপুরে আসিয়া শ্রীঅদ্বৈত-চরণে আশ্রয় লইলেন। এইস্থানে তাঁহার সংস্কৃত শিক্ষা আরব্ধ হইল।
‘তবে হরিদাস প্রভু অদ্বৈতের স্থানে।
ব্যাকরণ সাহিত্যাদি পড়িলা যতনে।।
ক্রমে দর্শনাদি পড়ি হইল ব্যুৎপত্তি।
শ্রীমদ্ভাগবত পড়ি পাইলা শুদ্ধাভক্তি।।
শ্রুতিধর হরিদাসের মহিমা অপার।
শ্লোক অর্থ কৈল তার কণ্ঠ মণিহার।।’
ইহা ‘অদ্বৈত-প্ৰকাশে’ আছে। অদ্বৈতাচার্য্য-শিষ্য ঈশান নাগর এই গ্রন্থের রচয়িতা। তিনি হরিদাসের বন্ধু। তাঁহার কথায় অবিশ্বাস করিবার কোন কারণ নাই। শিক্ষালাভের পর তিনি আচার্য্যের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিলেন। তখন হইতে তিনি তিন লক্ষ নাম জপ করিবার নিয়ম গ্রহণ করিলেন। গঙ্গার গর্ভে এক গোফায় বসিয়া এক তুলসীপিড়ির সন্নিকটে তিনি নিত্য নাম সঙ্কীর্ত্তন করিতেন। শান্তিপুরে থাকিতে যখন লোকে তাঁহার জাতিকুল উল্লেখ করিয়া নানা গণ্ডগোল উপস্থিত করিল, তখন তিনি ঘুরিয়া ফিরিয়া পুনরায় বেণাপোলে আসিয়া নিজ ভজনকুটীরে বসিয়া নামযজ্ঞ আরম্ভ করিলেন। তিনি প্রতিমাসে কোটিবার নাম জপ করিবেন এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া কার্য্যারম্ভ করেন এবং প্রত্যহ অন্ততঃ তিনলক্ষবার জপ না করিয়া জলগ্রহণ করিতেন না। হরিদাস সাধারণ তান্ত্রিকের মত মনে মনে অনুচ্চারিতস্বরে অস্পষ্টভাবে নাম জপ করিতেন না; তাঁহার জপ অন্যে শুনিতে পাইত; সে জপই একপ্রকার সঙ্গীত ছিল; তানপুরার দ্রুত ঝঙ্কারের মত সে জপ- ঝঙ্কারে শ্রোতা মাত্রেই বিমোহিত হইত। দেবর্ষি নারদের হরিনামঝঙ্কারে কিরূপে আকাশমার্গ মুখরিত হইত, তাহা পুরাণে দেখিতে পাই; ভূতলে হরিদাসের জপের মাধুর্য্যে বঙ্গদেশ আকুলিত হইয়াছিল। কলিতে হরিনাম জপের মত ধর্ম্ম নাই, এতদঞ্চলে হরিদাস তাহার প্রথম প্রবর্তক; পরে চৈতন্য সে ধর্ম্মদ্বারা দেশ মাতাইয়া জপের মাহাত্ম্য সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। যে অগ্নিকুণ্ডে বঙ্গ জ্বলিয়াছিল, হরিদাস তাহার শিখামাত্র। হরিদাসের জীবনে দেখিতে পারি, সে শিখা সেই অগ্নিকুণ্ডে মিশিয়া অস্তিত্ব হারাইয়া বসিয়াছিল। [১২]
হরিদাস বেণাপোলে যে তুলসী মঞ্চ রচনা করিয়াছিলেন, উহাই কালে অসংখ্য ভক্তসমাগমে মহাতীর্থে পরিণত হইয়াছিল। এক সময়ে ইহার ইষ্টকবেদী প্রস্তুত হয়, আবার কখন তাহা ভাঙ্গিয়া পড়িয়া ইষ্টকগুলি বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। ভক্তের কৃপায় তুলসীমঞ্চটি এখনও আছে। উহার সন্নিকটে সম্প্রতি একটি সুন্দর মন্দির নির্ম্মিত হইয়াছে। হরিদাসের উপলক্ষ্যে এখানে বার্ষিক উৎসবও হইয়া থাকে। বর্তমান বেণাপোল রেলওয়ে ষ্টেশন হইতে অর্দ্ধ মাইলমাত্র দূরে এই তুলসীমঞ্চ যে পুণ্যস্মৃতি বহন করিয়া এখনও বর্তমান রহিয়াছে, তাহা যশোহর জেলার একটি গৌরবের স্থান। স্কটের নভেলে বর্ণিত দস্যুর কার্য্যক্ষেত্র দেখিবার উদ্দেশ্যে স্বভাবসুন্দর স্কটল্যাণ্ডের দুর্গম গিরিপথসমূহ জনকোলাহলময় হইয়া গিয়াছে; হরিদাসের যজ্ঞ-ক্ষেত্র কি যশোহর ও খুলনার অধিবাসীদিগকে আকর্ষণ করিতে পারিবে না?
হরিদাসের কুটীরের প্রায় এক মাইল দূরে কাগজপুকুরিয়া গ্রাম। প্রাচীন কোন মানচিত্রে বেণাপোলের নাম নাই, কাগজপুকুরিয়ার নামই আছে। এই স্থানে রামচন্দ্র খাঁ নামক জনৈক প্রতাপান্বিত জমিদার বাস করিতেন। ইনি ব্রাহ্মণ, ইঁহার পূর্ব্বনাম ছিল শান্তিধর, ‘রাম খাঁ’ তাঁহার উপাধি। আমি পূৰ্ব্বে বলিয়াছি, যে ব্রাহ্মণের আশ্রয়ে সুলতান হুসেন শাহের বাল্যজীবন অতিবাহিত হইয়াছিল, তিনি এই শান্তিধরের পিতা হইতে পারেন। সম্ভবতঃ হুসেন শাহই তাঁহাকে রাম খাঁ উপাধি দিয়াছিলেন। মুসলমান-নরপতির অনুগ্রহপুষ্ট রাম খাঁ সদাচারী ছিলেন না; তিনি মুসলমানের ধর্ম্ম গ্রহণ না করিলেও মুসলমানের পক্ষপাতী ছিলেন এবং নিজে তান্ত্রিক শাক্ত বলিয়া নবপ্রচলিত বৈষ্ণব মতের বিরোধী ছিলেন। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতকার ভক্ত কৃষ্ণদাস কবিরাজের মত সংযমী লেখক আর নাই; তিনি কাহারও নিন্দা করিতেন না; কিন্তু তিনিও রামচন্দ্র খাঁ সম্বন্ধে সংযমের মাত্রা রক্ষা করিতে পারেন নাই।
ভক্ত হরিদাসকে সকল লোকে পূজা করে, সকল লোক তাঁহার নিকট যায়, তাঁহার গুণে মোহিত হয়, রামচন্দ্র খাঁ তাহা সহ্য করিতে পারিলেন না।
‘সেই দেশাধ্যক্ষ নাম রামচন্দ্র খান।
বৈষ্ণবদ্বেষী সেই পাষণ্ড প্ৰধান।।
হরিদাসে লোকে পূজে সহিতে না পারে।
তার অপমান করিতে নানা উপায় করে।।’—শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত,
কিন্তু সাধারণ চেষ্টায় হরিদাসের জপ ভঙ্গ হয় না। তিনি ব্রাহ্মণের বাড়ীতে ভিক্ষা করিয়া দিনান্তে একবার কিছু আহার গ্রহণ করেন; আর দিবারাত্রির অধিকাংশ সময় জপকাৰ্য্যে নিযুক্ত থাকেন। সাধারণ লোকের সহিত তাঁহার সম্বন্ধও বিশেষ কিছু ছিল না। যে জগৎ ছাড়িয়া উর্দ্ধগামী হয়, জগৎ তাঁহার কি করিতে পারে? নিন্দা, বিদ্রূপ বা অত্যাচারে হরিদাসের কিছুই হইল না। তখন রামচন্দ্র খাঁ এক ভীষণ পরীক্ষা করিতে অগ্রসর হইলেন।
হঠাৎ অর্থ-সামর্থ্য বৃদ্ধিতে সাধারণ লোকের যাহা হয়, রামচন্দ্রের তাহা হইয়াছিল। তিনি বেশ্যাসক্ত হীনচরিত্র ছিলেন। তাঁহার একটি বেশ্যার নাম হীরা। দুর্বৃত্ত জমিদারের বিপুল অর্থ আকর্ষণ করিয়া হীরা লক্ষমুদ্রা সঞ্চয় করিয়াছিল; তাই লোকে বলে, তার জন্য তাহার নাম হইয়াছিল লক্ষহীরা। হরিদাসের সর্ব্বনাশ সাধনজন্য রামচন্দ্র এই লক্ষহীরাকে নিযুক্ত করেন। হীরা পরমাসুন্দরী তীক্ষ্ণবুদ্ধিশালিনী ছিল। সে তিন দিনে হরিদাসের মতি হরণ করিবে বলিয়া রামচন্দ্রের নিকট গৰ্ব্বিত প্রতিজ্ঞা করিল। কাগজপুকুরিয়ার সন্নিকটে গয়ড়া-রাজাপুরে হীরার জন্য বাটী প্রস্তুত হইয়াছিল, রামচন্দ্র ময়ূরপঙ্খী তরণীতে চড়িয়া যে পথে হীরার বাটী যাতায়াত করিতেন, সে পথে খালের চিহ্ন এখনও আছে; রাজাপুর এক্ষণে লোকশূন্য প্রান্তর হইয়া গিয়াছে। সেখানে হীরার ভিটার ইষ্টকাদি ভগ্নাবশেষ এবং ‘হীরার পুকুরের’ খাত এখনও সেই প্রাচীন কালের সাক্ষ্য দিতেছে।
হাবভাবময়ী হীরা রত্নালঙ্কারে বিভূষিতা হইয়া হরিদাসের সন্নিকটবর্ত্তী হইল। কি দেখিল? দেখিল নির্জ্জন কুটীরে ভক্তসাধু বীণাবিনিন্দিত দিব্য মধুর ঝঙ্কারে হরিনাম জপ করিতেছেন। বেশ্যা বারংবার বিরক্ত করিতে লাগিল। হরিদাস বলিলেন, ‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি জপ শেষ করিয়াই আপনার কথা শুনিব।’ হীরা বসিয়া থাকিল, বসিয়া বসিয়া দিন গেল, রাত্রি গেল, ঝঙ্কার আর থামে না, জপ আর শেষ হয় না। তেমনই নিস্পন্দ তনু, নিশীথ-নিস্তব্ধতা ভেদ করিয়া তেমনই মধুর ঝঙ্কার। হীরারও চাঞ্চল্যের সমাধি হইতে চলিল। রাত্রির শেষযামে হরিদাস শৌচাদির জন্য গাত্রোত্থান করিয়া বলিলেন, ‘আজ আমার নির্দ্দিষ্ট জপ শেষ করিতে বড় বিলম্ব হইয়াছে, আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক কল্য আসিবেন, আমি আপনার সহিত বাক্যালাপ করিয়া তৃপ্তিলাভ করিব।’ দিবাশেষে হীরা পুনরায় আসিল; রাম খাঁ তাহাকে উদ্রিক্ত করিতে ছাড়েন নাই। সে দিনও হীরা আসিয়া দেখিল সেই জপনিরত সাধুর তেমনই মধুর মূর্ত্তি— সে মূর্ত্তি হইতে যেন কি দিব্য জ্যোতিঃ ক্ষরিয়া পড়িতেছে। হীরা বসিয়া রহিল, আজ সকাল সকাল জপ শেষ করিয়া সাধু হীরার ফাঁদে ধরা পড়িবেন। কিন্তু তাহা হইল না। রাত্রি আসিল, হীরা বসিয়া আছে। দূরাগত গ্ৰাম্য কোলাহল বিলুপ্ত হইল, কিন্তু জপের ঝঙ্কার চলিতেছে। কি মধুর নাম! নামের স্বভাবশক্তিতে কেমন যে হৃদয়ে আঘাত করে, মানুষকে কেমন উদাস করিয়া দেয়! হীরা ভাবিতে লাগিল, ‘অপার আনন্দ না হইলে লোকে কি এমন করিয়া নিস্পন্দভাবে বসিয়া থাকিতে পারে? সাধুর কি আনন্দ, আমার জীবনে কি করিলাম?’ পরমুহূর্তে কে যেন রশ্মি টানিয়া ধরিল, হীরা আবার দন্ত কটমট করিয়া সাধুর ভণ্ডামি ভাঙ্গিবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া রহিল। কিন্তু রাত্রি শেষে আবার সেই মধুর স্বর, আবার সেই দীনতা হীরাকে পরদিন আসিতে বলিল। হীরা সে সানুনয় ভাষায় দ্বিরুক্তি না করিয়া পুনরায় চলিয়া গেল।
তৃতীয় দিনে আবার হীরা আসিল। কিন্তু সে হীরা আর নাই; বিবেক তাহাকে সংশোধিত করিয়াছে; পূর্ব্বজন্মের কোন্ অজানিত পুণ্যফলে এক অপূৰ্ব্ব নির্ব্বেদ আসিয়া অলক্ষিতে তাহার হৃদয় অধিকার করিয়াছে। সেই হৃদয় লইয়া হীরা সামগায়ীর ঝঙ্কারধ্বনিবৎ আবার হরিনামের মধুর ঝঙ্কার শুনিল। সে একেবারে বিমুগ্ধ হইয়া গেল। আজ হরিদাস একটু সকালে জপ শেষ করিয়া উত্থান করিবামাত্র হীরা গিয়া তাঁহার পদপ্রান্তে বিলুণ্ঠিত হইয়া পড়িল। ভক্তসংস্পর্শে এক সঞ্জীবনী শক্তি সঞ্চারিত হইল। হীরা বারংবার আত্মকৃত পাপজীবনের কাহিনী বিবৃত করিয়া ক্ষমা ভিক্ষা করিতে লাগিল। রাগদ্বেষনির্মুক্ত সাধু তাহাকে অম্লানবদনে ক্ষমা করিলেন। তাহাকে ধর্মোপদেশ দিলেন, নামমহিমা কীৰ্ত্তন করিয়া নাম জপ শিখাইলেন। অবশেষে হীরাকে নিজের কুটীরে রাখিয়া স্বয়ং সে দেশ পরিত্যাগ করিলেন।
হীরা আর সে হীরা নাই; রামচন্দ্র ভাবিয়াছিলেন এক, হইল অন্য। পরকে ভুলাইতে হীরাকে পাঠাইলেন, হীরা নিজেই ভুলিয়া গেল। হীরা গুরু হরিদাসের আদেশে বিলাস-বিভ্রাট ত্যাগ করিল, সৌখীন বস্ত্রালঙ্কার পরিত্যাগ করিয়া মোটা কাপড় পরিল, মস্তক মুণ্ডন করিয়া সযত্নবর্দ্ধিত সুন্দর কেশরাশি জগন্নাথের চরণে সমর্পণ করিবার জন্য তুলিয়া রাখিল।
‘তবে সেই বেশ্যা গুরুর আজ্ঞা লইল।
গৃহবিত্ত যেবা ছিল ব্রাহ্মণেরে দিল।।
মাথা মুড়ি এক বস্ত্রে রহিলা সে ঘরে।
রাত্রি দিনে তিন লক্ষ নাম গ্রহণ করে।’— শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত
হীরা গৃহবিত্ত শুধু ব্রাহ্মণকে দিয়াছিল না; সে তাহার পাপার্জিত অর্থ লোকসেবায় নিয়োজিত করিয়া পরমার্থ লাভের পন্থা প্রস্তুত করিয়াছিল। হীরার উপর আদেশ ছিল, সে সমস্ত কাৰ্য্য শেষ করিয়া অচিরে জগন্নাথ যাইবে। তাহার একটা কারণ, রামচন্দ্র তাহার উপর রাগ করিয়া অত্যাচার করিতে পারেন। কিন্তু সে দেশে রামচন্দ্রকে ভয় করিত না একজন মাত্র, সে হীরা নিজে। সে নির্ভীকতা হীরার পূর্ব্বেও যেমন ছিল, এখনও সেইরূপ রহিল। হীরা নির্ভীকভাবে গুরুর আদেশ প্রতিপালন করিয়া কয়েক বৎসর পরে জগন্নাথ যাত্রা করিয়াছিল। জগন্নাথ তখনও বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র; অনেক লোক সে তীর্থে যাইত; কিন্তু তথ্যায় যাইবার পথ এত দুর্গম ছিল যে, লোকে বাড়ী হইতে বিদায় লইয়া যাইত। বিশেষতঃ বর্ষার প্রারম্ভে পুরীতীর্থের প্রকৃত সময় বলিয়া যাত্রীদিগের কষ্টের অন্ত ছিল না। এই কষ্ট নিবারণের জন্য হীরা বহু অর্থ ব্যয় করিয়া এক দীর্ঘ রাস্তা নির্ম্মাণ করিয়াছিল। উহা এখনও ‘হীরার জাঙ্গাল’ নামে খ্যাত আছে। যশোহরের উত্তরাংশে খাজুরা প্রভৃতি গ্রাম হইতে এই রাস্তার সূচনা দেখা যায়। সেখানে কোথায়ও হীরার পূৰ্ব্ববাস থাকিতে পারে। যশোহর হইতে যে বিখ্যাত ‘কালী পোদ্দারের রাস্তা’ বেণাপোল হইয়া বনগ্রাম দিয়া চলিয়া গিয়াছে, উহারও কতকাংশ এই রাস্তার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখনও খাজুরা প্রভৃতি স্থানের লোকে জলময় প্রান্তরের মধ্য দিয়া ‘হীরানটির জাঙ্গাল’ দেখাইয়া থাকে। এখনও বর্ষাগমে যখন বিস্তীর্ণ প্রান্তর জলরাশিতে ভাসিয়া যায়, তখন এই জাঙ্গালই স্থানীয় লোকের যাতায়াতের একমাত্র পথ হয়।[১৩]
হরিদাস বেণাপোল ত্যাগ করিয়া ২/৩ মাইল দূরে নাওভাঙ্গা নদীর তীরে একস্থানে কয়েকদিন অবস্থান করিয়াছিলেন। অল্পদিনে তাঁহার ভক্তির কথা দেশময় রাষ্ট্র হইয়াছিল, হরিদাস এইস্থানে আসিলে, নানাস্থান হইতে বহুলোক আসিয়া তাঁহার পাদবন্দনা করিয়া রামচন্দ্রকে অভিসম্পাত করিতেছিল। ভক্তের অনুরোধে তিনি যেস্থানে কয়েকদিন অবস্থিতি করিয়াছিলেন, উহার নাম হইয়াছিল, হরিদাসপুর। এখনও হরিদাসপুর আছে। যশোহর রোডের পাশে শৈবালময়ী নদীর বাঁকের মুখে একটি সুন্দর পুলের সন্নিকটে হরিদাস ঠাকুরের আস্তানাটি দেখিতে অতি সুন্দর। হিন্দুর মধ্যে যে সেস্থানের সন্ধান রাখে, সে কখনও প্রণাম না করিয়া সেস্থান অতিক্রম করে না। স্থানীয় লোকেরা চিহ্নিত করিবার জন্য সে স্থানটি ঘিরিয়া রাখিয়াছে। এই স্থান হইতে হরিদাস গঙ্গাতীর উদ্দেশ্যে পশ্চিমদিকে চলিয়া যান। এই সময়েই যশোহর-খুলনার সহিত তাঁহার সম্বন্ধ শেষ হয়। খুলনায় তাঁহার জন্মভূমি এবং যশোহরে তাঁহার বিকাশ ক্ষেত্র, তিনি ইহার কোন স্থানই দর্শন করিবার জন্য আর প্রত্যাগমন করেন নাই। কিন্তু তাঁহার জন্মলাভে এবং চরিত্রখ্যাতিতে যশোহর-খুলনা পবিত্র হইয়া রহিয়াছে। এক ভীষণ বিপ্লবের যুগে তিনি যে নূতন মত ও নূতন পথ দেখাইয়াছিলেন, চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের প্রাক্কালে তিনি যে নামের মাহাত্ম্য কীৰ্ত্তন করিয়া যুগ-ধৰ্ম্ম প্রচার করিয়াছিলেন, তাহার জন্য যশোহর-খুলনার যথেষ্ট গৌরব করিবার বিষয় আছে।
হরিদাসের পরবর্ত্তী জীবনের সহিত বর্ত্তমান ইতিহাসের বিশেষ সম্পর্ক নাই, তবুও সে জীবনকথা সম্পূর্ণ করিবার জন্য অতি সংক্ষেপে উহার প্রধান ঘটনাগুলির উল্লেখ করিতেছি। যশোহর ত্যাগ করিয়া হরিদাস কয়েক বৎসর নানাস্থান পরিভ্রমণ করতঃ অবশেষে সপ্তগ্রামের সন্নিকটে চাঁদপুরে আসিয়া উপনীত হন। তথায় এক ঋষিকল্প ব্রাহ্মণের পরিচর্য্যায় শান্তিলাভ করিয়া নির্জ্জন কুটীরে জপ-যজ্ঞ সম্পন্ন করিতে থাকেন। যে রঘুনাথ দাস পরিণত বয়সে বৃন্দাবনে গোস্বামী পদে বরিত হইয়াছিলেন, তিনি এসময়ে বালক। বালক রঘুনাথের সহিত প্রৌঢ় হরিদাসের এই সময়ে সাক্ষাৎ হয়। সেই সাক্ষাতের ফলে বালক রঘুনাথের উপর হরিদাস ঠাকুরের শক্তি সঞ্চারিত হইয়াছিল। সত্যনিষ্ঠ কবিরাজ গোস্বামী লিখিয়াছেন :
‘হরিদাস কৃপা করেন তাহার উপরে।
সেই কৃপা কারণ হৈল চৈতন্য পাইবারে।।’
হরিদাস চাঁদপুর হইতে পুনরায় শান্তিপুরে যান। পথে কুলীনগ্রামে তিনি কয়েক বৎসর ছিলেন, তথায় তাহার আসন-বেদী আছে। কিন্তু শান্তিপুরে গিয়া তাঁহার বেশী দিন থাকা হইল না। কারণ গুরুদেব অদ্বৈত আচাৰ্য্য তাঁহাকে অত্যধিক আদর করিতেন, সন্ন্যাসী কি তত আদর সহিতে পারেন? শান্তিপুর ছাড়িয়া হরিদাস ফুলিয়া গ্রামে আসিলেন। শান্তিপুরে অদ্বৈত ও ফুলিয়ায় হরিদাস; উভয়ের সম্মিলনে প্রেমতরঙ্গে সে দেশ ভাসিয়া গেল। নামানুকীৰ্ত্তনে দেশ প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। দেশাধ্যক্ষ মুসলমান কাজীর তাহা সহিল না। তখন দেশ শাসনজন্য দেশমধ্যে নানা বিভাগের মুসলমান কাজী বা বিচারক নিযুক্ত হইতেন। শান্তিপুর প্রভৃতি স্থানে অধ্যক্ষ ছিলেন গোরাই কাজী। হরিদাসের নামানুকীৰ্ত্তন তাঁহার সহিল না। তাঁহার জানা ছিল, হরিদাস যবনকুলে জাত; মুসলমান হইয়া হরিনাম, -এমন পাপ কি আছে! হরিদাসকে শাসন করিবার জন্য কাজী ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। শুধু হরিদাসকে শাসন নহে, তেমন শাসন কাজীও করিতে পারিতেন; কিন্তু হরিদাস যে হরিনাম শুনাইয়া দেশ মাতাইয়া তুলিয়াছে, মুসলমানে হরিনাম করিলে পাঠান শাসন যে অচিরে অস্তমিত হইবে! সুতরাং রোগের মূলোচ্ছেদ করিতে হইবে; হরিদাসের সর্ব্বনাশ সাধন সংকল্পে তাঁহার বিপক্ষে রাজদ্বারে নালিশ রুজু হইল। গৌড়াধিপ হুসেন শাহ তখন দেশের রাজা, বিচার তাঁহার নিকট হইবে। হরিদাস কারারুদ্ধ হইয়া গৌড়ে আনীত হইলেন।
তথায় হরিদাসের বিচার হইল। সে বিচারের সঙ্গে ধর্ম্মবিচারও চলিয়াছিল। হুসেন শাহ প্রকৃতভাবে হিন্দু-বিদ্বেষী ছিলেন না; কিন্তু যেখানে হিন্দু ধর্ম্মের সহিত ইসলাম ধর্ম্মের বিরোধ সেখানে হুসেন শাহ মুসলমানের পক্ষে, হিন্দুর কেহ নহেন। উচ্চ মুসলমান জন্মগ্রহণ করিয়া হরিদাস যেন হরিনাম না করেন, তাহাই হুসেনের প্রথম অনুরোধ হইল; তিনি হরিনাম ত্যাগ করিলে রাজকোপ হইতে নিষ্কৃতি পাইতে পারেন, তাহারও আভাস দেওয়া হইল। কিন্তু এখানে হরিদাস প্রহ্লাদের অবতার, বীর সন্ন্যাসী, তিনি সদর্পে বারংবার বলিলেন :
‘খণ্ড খণ্ড যদি হই, যায় দেহ প্রাণ।
তবুও আমি বদনে না ছাড়ি হরিণাম।।’
কত বুঝান হইল, কিন্তু সেই একই উত্তর। তখন ক্রোধভরে কাজীর ব্যবস্থায় হরিদাসের শাস্তির আদেশ হইল। গৌড় তখন প্রকাণ্ড সহর; উহাতে ২২টি বাজার ছিল। আদেশ হইল হরিদাসকে লইয়া এই ২২ বাজারে বেত মারা হইবে। তাহাই হইল। দুরন্ত ঘাতকের নিদারুণ প্রহারে হরিদাস ভীষণ কষ্ট পাইলেন, কিন্তু সে কষ্টের বোধ ছিল না। তিনি সমাধিগত সাধুর মত নির্ব্বাক্ হইয়া রহিলেন, আর মধ্যে মধ্যে শ্রীভগবানের অবতারের মত শত্রুর জন্য আশীৰ্ব্বাদ ভিক্ষা করিতেছিলেন :
‘এ সব জীবেরে প্রভু করহ প্রসাদ।
মোর দ্রোহে নহে এ সবার অপরাধ ॥’
এমন উক্তি আর কি ভারতে হইবে! দারুণ প্রহারে হরিদাস অজ্ঞান হইয়া পড়িলে, মৃতবোধে তাহার দেহ গঙ্গায় নিক্ষিপ্ত হইল। অচিরে তিনি পুনর্জীবন লাভ করিয়া তীরে উঠিয়া হরিনাম করিতে লাগিলেন। এই সময়ে চৈতন্যদেব প্রেমতরঙ্গে নবদ্বীপ অঞ্চল মাতাইয়া তুলিয়াছিলেন। হরিদাস আসিয়া তাঁহার সহিত যোগ দিলেন। পরে চৈতন্যদেব পুরীতে অবস্থিতি করিবার সময়ে হরিদাসও তথায় বাস করিয়াছিলেন। এই স্থানেই তিনি চৈতন্য-চরণে মস্তক রাখিয়া হরিনাম করিতে করিতে, জীবন-যজ্ঞের পরিসমাপ্তি করিয়াছিলেন। পুরীতে এখনও হরিদাসের মঠ আছে। সে মঠ দর্শন না করিলে হিন্দু-যাত্রীর পক্ষে পুরীপর্যটন বিফল হয়।
পাদটীকা :
১. হরিদাসের পূর্ব্বজীবন সম্বন্ধে অনেক প্রবাদ আছে। কেহ বলেন, ইনি প্রহলাদের অবতার, কেহ বলেন তিনি স্বয়ং ব্রহ্মার অবতার, কেহ বা তাঁহাকে ব্রহ্মা ও প্রহলাদের মিলিত অবতার বলিয়াছেন। ঈশান নাগর কৃত অদ্বৈত- প্রকাশে এইরূপ বর্ণিত হইয়াছে। কালীপ্রসন্ন ঘোষ প্রণীত ‘ভত্তির জয়’ ৭৯ পৃ; বিশ্বকোষ, ২২ খণ্ড, ৪৮৯ পৃ।
২. বিশ্বকোষ-সম্পাদক কোন অনুসন্ধান না করিয়াই বুঢ়ন গ্রামকে বনগ্রাম রেলওয়ে ষ্টেশনের নিকটবর্ত্তী বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। স্বর্গীয় কালীপ্রসন্ন ঘোষ এই মতেরই অনুবর্ত্তন করিয়াছেন। কিন্তু বনগ্রাম হইতে কলাগাছির দূরত্ব অন্ততঃ ২৫ মাইল হইবে। কেহ কেহ স্বর্ণ নদীকে সুরনদী করিয়া লইয়াছেন এবং সুরনদী বলিতে যমুনার শাখা পদ্মানদীকে বুঝিয়াছেন। কিন্তু সোনাই এখনও আছে।
৩. এই বই-এর দ্বিতীয় অংশ : প্রথম পরিচ্ছেদ, উপবঙ্গে দ্বীপমালা, ১৪-১৬ নং স্তবক দ্রষ্টব্য।
৪. বনগ্রাম স্কুলের সুযোগ্য হেডমাষ্টার সুপণ্ডিত চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় এ বিষয়ে প্রথম ভুল সংশোধন করিয়াছিলেন।— সাহিত্য পরিষৎ-পত্রিকা, ২৮শ ভাগ, ২য় সংখ্যা ১৩৩ পৃ।
৫. অচ্যুতচরণ চৌধুরী, ‘হরিদাস ঠাকুরের জীবন-চরিত।’
৬. মন্ত্রণীত ‘হরিদাস ঠাকুর গ্রন্থ’, ১৮ পৃ।
৭. ‘ত্রয়োদশ শত দ্বিসপ্ততি শকমিতে, প্রকট হইলা ব্রহ্মা বুঢ়ন গায়েতে।’-অদ্বৈত-প্ৰকাশ।
৮. এই বই-এর দ্বিতীয় অংশ : পাঠান রাজত্ব, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ, পয়োগ্রাম কসবা, ১৬-১৮ নং স্তবক দ্রষ্টব্য।
৯. মুসলমান হইয়া কিরূপে হরিভক্তি হয়, এই তথ্যের মীমাংসার জন্য হরিদাস সম্বন্ধে অনেক রচিত কল্পিত গল্প প্রচলিত আছে। তাহার একটি এই : হরিদাস ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার মাতা বালবিধবা ছিলেন এবং পিত্রালয়ে বাস করিতেন। একদা এক সন্ন্যাসী আসিয়া ঐ গৃহে কয়েকদিন অবস্থান করেন, সে সময়ে উক্ত বালবিধবা ভক্তিভাবে সন্ন্যাসীর সেবা করেন। বালবিধবা বালিকা বলিয়া পাড়যুক্ত বস্ত্র পরিধান করিতেন; সন্ন্যাসী ভ্রমক্রমে তাঁহাকে সধবা বলিয়াই স্থির করেন এবং যাইবার সময়ে তাঁহাকে পুত্রবতী হইতে আশীর্ব্বাদ করেন। সন্ন্যাসীর আশীর্ব্বাদ অব্যর্থ জানিয়া বালিকার পিতামাতার মস্তকে আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল; তাহাদের কোন অনুনয়ে সন্ন্যাসীর কথা ব্যর্থ হইল না। কিছুদিন পরে উক্ত বিধবা এক পুত্র প্রসব করিলেন প্রসবান্তে পুত্রটিকে একটি হাঁড়ির মধ্যে পুরিয়া সোনাই নদীতে ভাসাইয়া দেওয়া হয়। হাঁড়ি ভাসিতে ভাসিতে কলাগাছি গ্রামে লাগে এবং এক জোলার স্ত্রী উহা পাইয়া বাড়ী লইয়া গিয়া প্রতিপালন করেন। জোলারা এ সময়ে সকলে মুসলমান হইয়াছিলেন। সুতরাং হরিদাস সাধারণতঃ মুসলমান-কুলজাত বলিয়া পরিচিত ছিলেন। রোমের ইতিহাসে রমুলাসের জন্মবৃত্তান্তে এইরূপ গল্প আছে। এ গল্পগুলি কতদূর সত্য বলা যায় না।
১০. হুসেন শাহ বলিতেছেন :
‘কত ভাগ্যে দেখ তুমি হ’য়েছ যবন
তবে কেন হিন্দুর আচারে দেহ মন?
আমরা হিন্দুরে দেখি নাহি খাই ভাত,
তাহা ছোড়, হই তুমি মহাবংশজাত!’-বৃন্দাবনদাস-কৃত-শ্রীচৈতন্যমঙ্গল,
১১. ‘হরিদাস যবে গৃহত্যাগ কৈলা,
বেনাপোলের বন মধ্যে কতদিন রৈলা।
নির্জ্জনবনে কুটীর করি তুলসী সেবন।
রাত্রিদিনে তিনলক্ষ নাম সংকীর্ত্তন।’-শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, অন্ত্যলীলা, ৩য় পরিচ্ছেদ
১২. বাঙ্গালার সাহিত্যগুরু মনীষী কালীপ্রসন্ন ঘোষ তাঁহার ‘ভক্তির জয়’ গ্রন্থে যেস্থানে হরিদাসের সহিত চৈতন্যের মিলন হইল, সেই স্থানেই হরিদাসের জীবনলীলা শেষ করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন : ‘প্রবহমানা নদী সাগরসঙ্গমের অনির্ব্বচনীয় সুখে বিলয় পাইল।’-’ভক্তির জয়’, ২১১ পৃ।
১৩. হীরার কথা কল্পিত উপন্যাস নহে। হীরা জগন্নাথ গিয়াছিল। পথে বৈতরণী তীর্থও পর্য্যটন করিয়াছিল। তাহার যে কেশরাশি দ্বারা খোঁপা বাঁধিত, উহা মুণ্ডনের পর রাখিয়া দিয়াছিল এবং পুরীতে গিয়া জগন্নাথের মন্দিরে টাঙ্গাইয়া রাখিয়াছিল। এখনও পুরীর প্রাচীন লোকে ‘হীরার লোটনের’ গল্প করিয়া থাকে। দুর্লভ মল্লিককৃত গোবিন্দচন্দ্র গীতে এক হীরার কথা আছে। ঐ পুস্তকের অনসুন্ধিৎসু সম্পাদক শিবচন্দ্র শীল মহাশয় সেই হীরা এবং এই লক্ষহীরাকে অভিন্ন বলিয়া অনুমান করিয়াছেন। বৈতরণী পার হইয়া সমুদ্রের ধারে কোথায়ও ‘বেউশ্যা হীরাদারির’ বাসভূমি ছিল কিনা তাহা জানা যায় নাই। শেষ জীবনে তাহার এমন কোন স্থানে বাস করা অসম্ভব নহে।— ‘গোবিচন্দ্ৰ গীত’, ৯৬-৭, ১০১-৬ পৃ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন