৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি

সতীশচন্দ্র মিত্র

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ব’দ্বীপের প্রকৃতি

বিল, বাঁওড়, খাল, দিয়াড়া

গাঙ্গেয় ব’দ্বীপের প্রধান প্রকৃতি এই, ‘উহা জলকে স্থল করে, স্থলকে উন্নত ও উর্ব্বর করিয়া চলিয়া যায়।’ প্রথমে নদী নালা থাকে না; থাকে কেবল দিগন্তবিস্তৃত অসীম সাগর। তাহাতে গঙ্গা প্রভৃতি নদীস্রোত পড়ে, পলি সঞ্চিত হয়, অবশেষে জল ছাড়িয়া ভূমি উত্থিত হয়। মাঝে মাঝে নদী নালা থাকিয়া যায়। কিছুদিন মধ্যে নদী বেশ উচ্চ, বনাকীর্ণ বা মনুষ্যাকীর্ণ হয়, তখন নদী খালের বিস্তৃতি কমিতে থাকে। ক্রমে জলধারাসমূহ নানাভাবে গতি পরিবর্তন করে, মধ্যে চড়া বা চর রাখিয়া যায়; উহাকে দিয়াড়া, দিয়া, দহ, মাদিয়া বা দ্বীপ বলে। শেষে এই নবোত্থিত দ্বীপ ও প্রাচীন ভূখণ্ডের মধ্যবর্ত্তী জলখাত বেগহীন হইয়া মজিয়া মরিয়া যায়; এবং খাত ভরাট হইয়া জমিভুক্ত হয়, দ্বীপ শুধু নামে মাত্র থাকে। ব’দ্বীপের কার্য্য আরও দূরে সরিয়া চলিতে থাকে। কিছুদিন পর্য্যন্ত বিল, ঝিল, বাঁওড় প্রভৃতি নামে নিম্ন ভূমিতে জল সঞ্চিত থাকে। আবাদ হইতে লাগিলে কালে তাহাও থাকে না। এইরূপে গঙ্গার মোহানা ক্রমশঃ দক্ষিণ-পূর্ব্ব দিকে সরিতেছে। বঙ্গের আয়তন বাড়িতেছে, বঙ্গোপসাগরের আয়তন কমিতেছে। খরবেগে কাজ চলিলে, এতদিন বঙ্গভূমি আরও অগ্রসর হইত। কিন্তু তাহা বোধ হয় বিধাতার অভিপ্রেত নহে। সাগরবেলান্ত বনভাগ মধ্যে মধ্যে বসিয়া গিয়া কাৰ্য্যে বিলম্ব করিয়া দিতেছে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার মোহনার নিকট প্রায় ৪০০ ফুট পলি ও বালি জমিয়াছে, কিন্তু তবুও উহা পার্শ্ববর্ত্তী সিন্ধুবারি হইতে কয়েক ইঞ্চির অধিক উচ্চও নহে।[১]

পার্বত্যতরঙ্গিণী গঙ্গা আর্য্যাবর্তের সমতলে পড়িয়া ক্রমশঃ মন্দগতি হইয়াছে। ইহার ১৬০০ মাইল দীর্ঘ গতিপথের মধ্যে শেষ ৩৩০ মাইল নিম্নবঙ্গে প্রবেশ করিয়াছে। সেখানে ইহার গতি মৃদু বলিয়া সমুদ্রে পড়িবার পূর্ব্বে গঙ্গা পলির বোঝা নামাইয়া যায়।[২] উহা হইতে জমি উদ্ভূত হইলে মধ্যবর্তী জলভাগ পার্ব্বত্য স্রোতের সংযোগ সাধন করিবার জন্য নদী হইয়াছিল। সে সব আঁকাবাঁকা নদীপথে পলি বাহিত হয়। উহাদ্বারা তীরভূমি ক্রমশঃ উচ্চ হইতে থাকে। নদী হইতে দূরবর্তী অংশ সে ভাবে উচ্চ হয় না; নদীতীর উচ্চ ও তাহার পরবর্তী স্থান নিম্ন থাকে। বৃষ্টির জলধারা ভূমিপৃষ্ঠ ধৌত করিয়া নদীতে প্রবাহিত হওয়াই সঙ্গত ও স্বাভাবিক। কিন্তু তাহা হয় না, কারণ বোধ হয় তাহা হইলে নিম্নভূমি উচ্চ হইবার আর উপায় থাকে না। বৃষ্টিজল সেই নিম্নভূমিতে সঞ্চিত হইতে থাকে। ইহাতে ভূমিভাগ ধুইয়া লইয়া গেলেও সেখানে যথেষ্ট জল জমে। এই জল নদীতে আনিবার জন্য স্বাভাবিক বা কৃত্রিম প্রণালীর প্রয়োজন হয়। ইহাই খাল বা নালা। যেখানে স্বাভাবিক খাল থাকে না, সেখানে মনুষ্যে খাল কাটিয়া জল নিঃসরণের ব্যবস্থা করে। যেখানে মনুষ্য-হস্ত তত সবল নহে, সেখানে মধ্যভাগে জল জমিয়া জলাভূমি হয়। উহার নাম বিল। এক নদীর উচ্চ পাহাড় হইতে অন্য নদীর উচ্চ পাহাড় পর্যন্ত এই সব বিল বিস্তৃত থাকে। যেখানে দুই নদীর দূরত্ব অধিক, সেখানে বিলও খুব প্রকাণ্ড।

পলি দ্বারা জমি জমাইয়া উচ্চ করিতে পারিলেই নদীর কর্ত্তব্য শেষ হয়। তখন নদী ক্ৰমশঃ শীর্ণকায় হইয়া গত হয় বা গতি পরিবর্ত্তন করিয়া অন্য স্থানে কার্য্য করিতে থাকে। যেখানে নদী মরিয়া যায়, বা সরিয়া যায়, উভয় স্থানেই খাত থাকে। সে খাতে জল জমে। এইরূপে জলপূর্ণ প্রাচীন খাতকে বানোড় বা বাঁওড় বলে; কোন কোন স্থানের লোক ইহাকে ‘গোগ’ বা ‘ঘোগ’ বলে। শুধু বিল বাঁওড় নহে, নিম্ন জলাভূমিকে অনেক স্থানে লোকে ‘ঝিল’, ‘দোহা’ প্রভৃতি নামেও আখ্যাত করে। এইরূপ বিল, ঝিল, খাল, বাঁওড় গাঙ্গেয় উপদ্বীপের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম। যশোহর-খুলনা জেলায় এই বিল বাঁওড়ের অভাব নাই। যেখানে নদী আছে, তাহারই পার্শ্বে বিল, বাঁওড় বা গোগ আছে। আর এ নদীমাতৃক দেশে নদী নাই এমন স্থান নাই। যশোহর জেলায় মরা নদীই হউক, আর খুলনার বেগবতী নদীসমূহই হউক, নদী সৰ্ব্বত্র আছে। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে গ্রামে পল্লীতে পল্লীতে বিল বাঁওড়ের অপূর্ব্ব সমাবেশ রহিয়াছে। বিল যেখানে উচ্চ হইয়া শস্যক্ষেত্রের উপযোগী হয়, সেখানে তাহা প্রান্তরে পরিণত হয়। প্রান্তরকে এদেশীয় লোকে ‘ডহর’ বা ডর বলে।

যশোহর-খুলনায় কোন হ্রদ নাই। অনেক স্থানে এই বিল, ঝিল ও বাঁওড়গুলি হ্রদের মত বারমাস জলপূর্ণ থাকে। নদী হইতে বিল বাঁওড় পর্যন্ত বিস্তৃত স্থানে বাস করাই এদেশের সাধারণ বসতির পদ্ধতি। লোকের অবস্থার সঙ্গে এই বসতির স্থানভেদেরও একটা রীতি আছে। পাড়াগাঁয়ে সে রীতি অধিকাংশ স্থলে এখনও প্রায় একভাবে পরিলক্ষিত হইয়া আসিতেছে। এ অঞ্চলে নদীর পাহাড়গুলিই সৰ্ব্বাপেক্ষা উচ্চ। যে নদী যত প্রবল, যাহার মাটী যত পলিময়, তাহার পাহাড় তত অধিক উচ্চ। মধুমতীর মত উচ্চ পাহাড় কোন নদীর নাই। মনে করা যাউক, উত্তরে ও দক্ষিণে দুইটি নদী আছে। উভয়ই পূৰ্ব্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। উত্তরবর্তী নদীর দক্ষিণ পাহাড় অত্যন্ত উচ্চ, উহা হইতে ক্রমশঃ দক্ষিণ দিক্ নিম্ন হইয়া গিয়া একটি বিল হইয়াছে। বিলের ভিতর কতকটা এবং অব্যবহিত উপরে কিছুদূর পর্য্যন্ত বর্ষার পরেও বেশ জল পায়, এজন্য সেখানে বেশ ভাল আমন বা হৈমন্তিক ধান্য হয়। তাহারই উপর উত্তরদিকে, শুধু বর্ষাকালে যেখানে জল পায়, সেখানে আউস ধান এবং কার্ত্তিক অগ্রহায়ণ মাসে কলাই সরিষা প্রভৃতি রবিশস্য জন্মে, তরকারীর ক্ষেত হয়, গরুতে ঘাস খায়। ইহার উপরই কৃষকদিগের বাড়ী। কৃষকেরা বাড়ীর ধারে চাষ করে, গরু চরায়। নিকটে বিল, উহা দামদল শৈবালাদিতে সমাকীর্ণ। তবুও তাহা গভীর হইলে কৃষকেরা তাহারই জল খায়; সেখানে প্রচুর পরিমাণে মৎস্য ধরে; গরুর জন্য ঘাস কাটে। তালের ডোঙ্গায় সেখানকার যাতায়াত চলে। এই সকল নিম্নশ্রেণীর লোকের ঘরে ধান থাকে, জমিতে কলাই হয়, সরিষা বা তিল ভাঙ্গাইয়া তৈল করে, বিল হইতে প্রচুর মাছ ধরিয়া খায়, হাটের দিন বস্ত্র-লবণাদির জন্য কিছু ধান্য বা তরকারী মাথায় করিয়া হাটে যায় এবং মাছের গল্প, ভূতের গল্প ও জমির গল্প দ্বারা যে উদর পূর্ণ ছিল, তাহা খালাস করিয়া আসে। আর তাহাদের পশ্চাতে বড় নদীর কূলে সভ্য শিক্ষিত, ধনী, বিষয়ী, উচ্চশ্রেণীর লোক উদ্যানশোভিত বাটীতে দালান কোঠায় বা ভাল ঘরে বাস করে, নৌকায় পাল্কীতে দূরবর্ত্তী স্থানের সহিত সম্বন্ধ রাখে, পোষ্টাফিসে বসিয়া খবরের কাগজ পড়িয়া চীন তুরস্কের ভাগ্যগণনা করে, আর সর্ব্বদা বাজার বা ডাক্তারের সহিত সম্বন্ধ রাখিয়া যাহা আয় করে, তাহাই খরচ করিয়া ঋণগ্রস্ত হয়। নদীকূলে নিত্যনূতন মুক্ত সভ্যতার স্রোত, আর বদ্ধ বিলের পার্শ্বে সেই অনাড়ম্বর অপরিবর্তনীয় প্রাচীন পদ্ধতি। নদীতে ও বিল বাঁওড়ে এইটুকু প্রভেদ। তবে দেশের যেমন গতি, তাহাতে সকল নদীই বাঁওড় হইবে; তখন আর কিছুর জন্য না হউক, অন্ততঃ প্রাণের জন্যও হয়ত সেই প্রাচীন পদ্ধতি অবলম্বনীয় হইবে।

এইরূপে বিলের এপারেও যেমন, ওপারেও তেমনি। বিলের পরে শস্যক্ষেত্র, ক্ষেত্রের পাশে কৃষকের বসতি, তাহার পরে বাগান, ধনীর বসতি ও সর্ব্বশেষে নদী। হয়ত নদীর অপর পার হইতে আরম্ভ করিয়া পুনরায় এইভাবে লোকের বাস। যেখানে নদী হইতে বিল বহুদূরে সরিয়া গিয়াছে, সেখানেও ২/৩ মাইলের অধিক দূরে যায় নাই। নদীতে পারাপারের সুবিধা থাকে, সুতরাং এপারের সহিত ওপারের সম্বন্ধ যায় না। কিন্তু বিল যদি খুব বড় হয়, তাহা হইলে এপারে ওপারে সম্বন্ধ পর্য্যন্ত থাকে না, চলাচলের পথ থাকে না। প্রয়োজন হইলে বহুদূর ঘুরিয়া নদীপথে আসিয়া বিলের উভয় পারে সম্বন্ধ স্থাপন করিতে হয়।

যশোহর-খুলনায় প্রায় প্রত্যেক দুইটি করিয়া বড় নদীর মধ্যে বিল দেখা যায়। তবে স্থান বহুদিনের পুরাতন হইলে, বিলের অস্তিত্ব লোপ পায়। বিল ক্রমশঃ শস্যক্ষেত্র হয়, শস্যক্ষেত বসতিস্থান হয়। পুরাতন যশোহরে বিলের সংখ্যা খুব কম। যশোহরের লোকেরা যে পৰ্যাপ্ত মৎস্য পায় না এবং তজ্জন্য খুলনার মুখাপেক্ষী হয়, তাহার কারণ এই। খুলনায় বিল অত্যন্ত অধিক; এজন্য যশোহর অপেক্ষা খুলনায় অধিবাসীর সংখ্যা কম। খুলনার অর্দ্ধেক প্রায় সুন্দরবন। তাহার কথা এখানে ধরিব না। সুন্দরবনের প্রকৃতি সম্পূর্ণ বিভিন্ন। তাহা পৃথক্ ভাবেই আলোচিত হইবে। কিন্তু সে সুন্দরবন ছাড়িয়া দিলেও খুলনার উত্তরার্দ্ধও অসংখ্য বিলে পরিপূর্ণ। আবার যশোহরের বিলগুলি ছোট এবং ক্রমশঃ সংকীর্ণ হইয়া আসিতেছে। কিন্তু খুলনার বিলগুলি যত দক্ষিণে অগ্রসর হওয়া যাইবে, ততই বিস্তৃত, ততই প্রকাণ্ড। অবশেষে সমস্ত সুন্দরবনই একটি প্রকাণ্ড বহুবিস্তৃত বিল। পূৰ্ব্বেই বলা হইয়াছে যে, দুই নদীর মাঝখানে গ্রামমালার পশ্চাতে সৰ্ব্বত্রই বিল আছে। দৃষ্টান্তক্রমে মাত্র উহার কয়েকটি প্রধান বিলের নামোল্লেখ করা যাইতেছে।

প্রথমতঃ গোরাই মধুমতী ও নবগঙ্গার মধ্যে মাগুরার উত্তর যোগিনী বিল এবং নলদীর পূর্ব্বে ইচ্ছামতী বিল। নবগঙ্গা ও চিত্রার মধ্যে কালিয়ার উত্তরে আগরহাটি বিল, চিত্রা ও ভৈরবের মধ্যে যশোহরের উত্তরে জলেশ্বর বিল। বড় বড় বিল সমস্তই খুলনার মধ্যে। মধুমতী ও ভৈরবের মধ্যে পূর্ব্বদিকে গজালিয়া, নরনিয়া, কাতলি; আতাই, ভৈরব ও আঠারবাঁকীর মধ্যে বিলকোলা ও বাসুখালি; ভৈরব ও ভদ্রের মধ্যে বিল পাবলা ও ডাকাতিয়ার বিল বিশেষ বিখ্যাত। ভদ্রের দক্ষিণে যে সমস্ত বিল তাহা সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত। ইহাদের মধ্যে সাতক্ষীরার পশ্চিমে দাঁতভাঙ্গা বিল ও দক্ষিণে বয়রার বিল সৰ্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ।

প্রায় সকল নদীর পার্শ্বেই বাঁওড় আছে। কারণ সকল নদীই কোন না কোন কালে পথ পরিবর্তন করিয়া খাত রাখিয়া গিয়াছে। কোন নদী মরিয়াছে, কোন নদী এখনও সজীব আছে। সকলেরই খাতের চিহ্ন আছে। তন্মধ্যে যে খাত ভরাট হইয়া এখনও শস্যক্ষেত্রে পরিণত হয় নাই, যাহাতে এখনও জল থাকে তাহাকে বাঁওড় বলে। নদীর গভীরতা সর্ব্বত্র সমান থাকে না। দুই দিক্ মরিয়া গেলে মধ্যবর্ত্তী এক গভীর স্থানে প্রচুর জল থাকে। সে বাঁওড়ে মৎস্য জন্মে, সময় সময় নৌকা চলাচল করে। অনেক বাঁওড়ের জল অতি সুন্দর, উহা পার্শ্ববর্তী লোকে পানীয়রূপে ব্যবহার করে। যশোহরে অধিকাংশ নদী মরিয়া অসংখ্য বাঁওড়ের সৃষ্টি করিয়াছে, খুলনার বাঁওড় তত অধিক নহে। বাঁওড় ও ঝিল একই কথা। যে বাঁওড়ে যথেষ্ট জল থাকে, কতকটা পরিষ্কৃত থাকে, তাহাই সাধারণতঃ ঝিল নামে কথিত হয়।

কোটচাঁদপুর হইতে যশোহর পর্য্যন্ত ভৈরব নদ, নলডাঙ্গার নিকট বেঙনদী, বেণাপোলের পার্শ্বে নাওভাঙ্গা নদী এক প্রকার বাঁওড়েই পরিণত হইয়াছে। চৌগাছার দক্ষিণে বেড়গোবিন্দপুরের চারিধারে, চৌবেড়িয়ার চতুর্দ্দিকে যমুনার খাতে, ঝিকারগাছার দক্ষিণে ঝাপাগ্রামের তিন দিকে, তাহিরপুর ও বারবাজারের মধ্যে ভৈরবের উত্তরে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বাঁওড় রহিয়াছে। খুলনা জেলায় সেনহাটী গ্রামের উত্তর-পশ্চিম কোণে ৬/৭টি খাতে, বসুন্দিয়ার দক্ষিণ-পারে জগন্নাথপুরের মাঝে, ফকিরহাটের পূর্ব্বে ব্রাহ্মণ-রাদিয়ার নিম্ন দিয়া, মরানদীতে জলপূর্ণ বাঁওড় দেখা যাইবে।

নদী মরিয়া এইরূপে নানাস্থানে ঝিল বা বাঁওড় হওয়ায় দেশের স্বাস্থ্য নষ্ট হইতেছে, বাণিজ্য বন্ধ হইয়াছে এবং জমির উর্ব্বরতা শক্তি বর্দ্ধিত বা নবীভূত হইতেছে না। ভৈরব, কপোতাক্ষ ও যমুনা মরিয়া যাওয়ায় যশোহর জেলা উৎসন্ন যাইতে বসিয়াছে। ১৮৮১ অব্দ হইতে ইহার লোকসংখ্যা প্রতি বৎসর কমিতেছে। ১৯১১ অব্দের লোকগণনার বিবরণী হইতে দেখা গিয়াছে যে, যশোহর জেলায় গত ত্রিশ বৎসরে মোট প্রায় ৫৫০০০ জন লোক কমিয়াছে, অর্থাৎ শতকরা ৩ জনেরও অধিক লোক কমিতেছে। অনুসন্ধানে দেখা যাইতেছে যে, যশোহরের সকল উপবিভাগে লোকসংখ্যা কমিয়াছে, কেবল নড়াইলে কমে নাই, বরং বাড়িতেছে। এবং এই একমাত্র নড়াইলে চিত্রার মত বেগবতী মিষ্টসলিলা নদী আছে, অন্য সব উপবিভাগেই অধিকাংশ স্থলে নদী মরিয়া গিয়াছে। ঝিনাইদহে যেখানে সব নদীগুলিই শুষ্কপ্রায়, সেই স্থানেই সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক লোক মরিয়াছে। এই মৃত্যুর কারণ ম্যালেরিয়া এবং ম্যালেরিয়ার প্রধান উৎপত্তিস্থল মৃতনদীগুলির বদ্ধজলপূর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ ও পূতিগন্ধময় প্রাচীন খাত। সুতরাং লোকক্ষয় নিবারণ করিতে হইলে, নদীগুলির পুনরুদ্ধার একান্ত প্রয়োজনীয়। কোথায়ও খাত কাটিয়া, কোথায়ও গতি ফিরাইয়া কোন কোন নদীকে প্রবহমান করিতে হইবে। কিন্তু নদীর গতি আপনি না ফিরিলে ফিরান কঠিন। তবে মানুষের বৈজ্ঞানিক চেষ্টায় যে কতক না হয়, তাহা নহে। তাহা না হইলে পশ্চিমাঞ্চলে বা উড়িষ্যায় নদীর মুখে কপাট এবং আনিকট (anicut) বা বাঁধের ব্যবস্থা করিয়া শুষ্ক নদী জলপূর্ণ করত ষ্টীমার চালান বা বিস্তীর্ণ ভূভাগে ক্ষেত্রের জন্য জল সঞ্চারের উপায় হইত না। এইজন্য যশোহরবাসী প্রজাবৃন্দ সহৃদয় এবং শক্তিসমৃদ্ধিসম্পন্ন গবর্নমেন্টের নিকট কিছু প্রার্থনা করে।

সকলেই ভাবিতেছে নদীসংস্কার ব্যতীত এ বিপদ্ হইতে উদ্ধারের অন্য উপায় নাই। যমুনার সংস্কার বা ভৈরবের পুনরুদ্ধার জন্য উভয় নদীর শোচনীয় অবস্থার বিষয় কয়েকবার রীতিমত ভাবে গবর্ণমেন্টের গোচরীভূত করা হইয়াছে। খুলনার জনসাধারণ-সভাও গবর্ণমেণ্ট বাহাদুরের নিকট এ বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা করিয়াছিলেন। গবর্ণমেণ্ট এক্ষণে সাড়ার সন্নিকটে পদ্মার উপর বিরাট্ লৌহসেতু নির্ম্মাণ করিয়া উহার উপর দিয়া পূর্ব্ববঙ্গ রেলওয়ে চালাইবার জন্য বহুকোটী মুদ্রা ব্যয় করিতেছেন। এজন্য পদ্মার বেগ কমাইয়া সেতুকে সুদৃঢ় করিবার জন্য উভয় পারে বার মাইল করিয়া তীরভাগ প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড প্রস্তরখণ্ড দ্বারা ঢাকিয়া দেওয়া হইতেছে। কিন্তু তাহাতেও কীর্তিনাশা পদ্মার বেগ কমিবে কি না বলা যায় না। তবে এক প্রকারে বোধ হয় এ বেগ কমান যাইতে পারে। যেখানে সেতু নির্ম্মিত হইয়াছে, তাহার অনেক উপরে পশ্চিমদিকে পদ্মা হইতে মাথাভাঙ্গা, জলঙ্গী ও ভৈরব বাহির হইয়াছে। এই সব নদীর মোহানাই অল্প বিস্তর মজিয়া গিয়াছে, ভৈরব একবারেই মজিয়াছে; কারণ ইহার মোহানা হইতে পদ্মাই অনেক দূরে সরিয়া গিয়াছে। সেই মোহানার নিকট কিছুদূর পর্য্যন্ত ক্ষুদ্র একটি খাত খনন করিয়া দিলে ভৈরব পুনরায় ভীম বিক্রমে বহিতে পারে। ভৈরব বহিলে, কপোতাক্ষও বেগবান হইবে। তখন যশোহরবাসী ভগ- স্বাস্থ্য ও রোগাপহৃত মস্তিষ্ক ফিরাইয়া পাইবে, দেশের গতি ফিরিবে, আবার যশোহর পরের যশঃ হরণ করিয়া আত্মপ্রতিষ্ঠা করিবে। ভৈরব-কপোতাক্ষ উদ্ধারপ্রাপ্ত হইলে আর একটি ফল হইবে। এই দুই নদী দিয়া মিষ্টজল সুন্দরবনে যায় না বলিয়া বৃক্ষাদির অবস্থা খারাপ হইয়াছে। লবণাক্ত জলের সহিত মিষ্টজল না মিলে সুন্দরবনে সুন্দরী, পশুর প্রভৃতি ভাল বৃক্ষ জন্মে না। মধুমতী দিয়া মিষ্টজল যায়, এজন্য হরিণঘাটা অঞ্চলে উৎকৃষ্ট সুন্দরীগাছ জন্মে। সেখান হইতে যত পশ্চিম দিকে যাওয়া যায়, জল ততই নিরবচ্ছিন্ন লবণাক্ত, এজন্য বৃক্ষের অবস্থা খারাপ; চব্বিশপরগণার দক্ষিণ-পূর্ব্বাংশে শুধু গরাণবনই হইতেছে, ভাল কাষ্ঠ হয় না।[৩]

সুন্দরবনে উৎকৃষ্ট কাঠ উৎপন্ন হইলে, তদ্বারা গবর্ণমেন্টের প্রভূত লাভ হইবে; হয়ত বহুকাল পরে ব্যয়িত অর্থের পুনরুদ্ধারও হইতে পারে। না হইলেও, অসংখ্য প্রজার জীবন রক্ষার মত রাজার মহৎ কার্য্য আর থাকিতে পারে না।

পাদটীকা :

১. ‘Four hundred feet of delta deposit now covers this island built up by the three rivers of Bengal and yet its surface is often but a few inches above the sea.’ Imperial Gazetter of India, Vol. 1, P. 25 (See also Ibid, 2nd ed., Vol. II, P. 272-fat fat)

২. ‘When the Ganges reaches its delta in Lower Bengal, the fall of the river is so slight. that the cur- rent is seldom sufficient to enable it to carry its burden and deposit its silt.’ Ibid.
(প্রতি মাইলে ৫ ইঞ্চি নিম্নগামী হইলে নদী পলি বহন করিয়া লইয়া যাইতে পারে। গাঙ্গোপদ্বীপে নদীর নিম্নগামিতা ইহারও কম। See Wood—A Short Geography of Bengal, 1895. P. 10 – শি মি

৩. ‘…Owing to its saline character this tract (Sunderbans) siturated in the 24 pargannahs District does not produce a large quantity of the best timber and fuel trees.’ Khulna Gazetteer, P. 87; (See also p. 82 শি মি)

সকল অধ্যায়

১. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. ২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. ৩. নদী-সংস্থান
৪. ৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. ৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. ৬. সুন্দরবন
৭. ৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. ৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. ৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. ১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. ১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. ১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
১৩. ১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
১৪. ২. দ্বীপের প্রকৃতি
১৫. ৩. আদি হিন্দু-যুগ
১৬. ৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
১৭. ৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
১৮. ৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
১৯. ৭. মাৎস্য-ন্যায়
২০. ৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
২১. ৯. সেন-রাজত্ব
২২. ১০. সেন-রাজত্বের শেষ
২৩. ১১. আভিজাত্য
২৪. ১. তামস যুগ
২৫. ২. বসতি ও সমাজ
২৬. ৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
২৭. ৪. খাঁ জাহান আলি
২৮. ৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
২৯. ৬. পয়োগ্রাম কসবা
৩০. ৭. খালিফাতাবাদ
৩১. ৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৩২. ৯. হুসেন শাহ
৩৩. ১০. রূপ-সনাতন
৩৪. ১১. লোকনাথ
৩৫. ১২. হরিদাস
৩৬. ১৩. রামচন্দ্র খাঁ
৩৭. ১৪. গাজীর আবির্ভাব
৩৮. ১৫. মুকুট রায়
৩৯. ১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
৪০. ১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
৪১. পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
৪২. পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
৪৩. পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
৪৪. পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন