সতীশচন্দ্র মিত্র
হরিদাসের বেণাপোলত্যাগের পর রামচন্দ্র খাঁ বহুদিন পর্য্যন্ত জীবিত ছিলেন। রামচন্দ্র হুসেন শাহের নিকট হইতে যে যথেষ্ট অনুগ্রহ লাভ করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। তাঁহার রাজ্য সমুদ্র পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শুনা যায়, তিনি কঠোরভাবে শাসনদণ্ড চালনা করিতেন। এজন্য তাঁহার আয়ও যথেষ্ট ছিল। তিনি বঙ্গেশ্বরকে কর দিতেন না। এই সকল কারণ হইতে বোধ হয়, হুসেন শাহ শৈশবকালে যে তাঁহার পিতার আশ্রয়ে কিছুকাল প্রতিপালিত হইয়াছিলেন, তাহা অসত্য নহে। তিনি সাধারণতঃ রামচন্দ্র নামে পরিচিত হইলেও তাঁহার প্রকৃত নাম ইহা ছিল না। শান্তিধর নামক এক ব্রাহ্মণ হুসেন শাহের নিকট ‘রাম খাঁ’ উপাধি পান।[১] এই রাম খাঁ উপাধি, শেষে রামচন্দ্র খাঁ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। রামচন্দ্র বহু অর্থ বিলাসবাসনা-তৃপ্তির জন্য ব্যয় করিতেন বটে, কিন্তু তাঁহার পুণ্য কার্য্যের ব্যয়ও যথেষ্ট ছিল।
বেণাপোলের সন্নিকটে কাগজপুকুরিয়া গ্রামে তাঁহার বিস্তীর্ণ রাজবাটীর ভগ্নাবশেষ রহিয়াছে। প্রথমতঃ একটি বাহিরের পরিখা; উহা বৃত্তাকারে চারিদিক্ বেষ্টন করিয়াছিল। উহার মধ্যে একটি চতুষ্কোণ গভীর পরিখা ছিল, উহা এখনও বর্ত্তমান। কোন কোন স্থানে বেশ জল আছে; কুঞ্জেশচন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় এই রাজবাটীর অসংখ্য ভগ্নস্তূপের পার্শ্বে উত্তর-পূর্ব্বকোণে সপরিবারে বাস করিতেছেন। তাঁহার বাড়ীর পূর্ব্বদিকের প্রাচীন পরিখাটি একটু খনন করায় এক্ষণে বারমাস জল থাকে। নিৰ্জ্জনতা যদি গৃহ-বাসের পক্ষে সুখের কারণ হয়, তবে চট্টোপাধ্যায় মহাশয়দিগের মত সুখী কেহ নাই। নিকটে অন্য কোন লোকজনের বাড়ীঘর নাই। চারিদিকে রাজবাটীর ইষ্টকস্তূপসমূহ নিবিড় জঙ্গলে সমাকীর্ণ হইয়া বন্যশূকরাদির আশ্রয়স্থান হইয়া রহিয়াছে। তথাকার ঘনান্ধকার দিবালোকেও অভ্যাগতের রোমাঞ্চ সঞ্চার করিয়া থাকে। গড়ের বাহিরে পশ্চিমদিকে একস্থানে দুইটি মন্দিরের ভগ্নস্তূপ আছে এবং প্রান্তরের মধ্যেও সে স্থানে ঢিপি দেখিতে পাওয়া যায়। লোকে বলে, এ সকল স্থানে রামচন্দ্রের শিবমন্দির, হাতীশালা, অশ্বশালা প্রভৃতি ছিল।[২]
কিন্তু রামচন্দ্রের প্রধানকীর্তি তাঁহার জলদানপুণ্যের প্রবাদ এই, নিকটবর্ত্তী স্থানে তাঁহার খনিত ১০০ পুষ্করিণী আছে। আমরা তাহার কয়েকটি মাত্র দেখিয়াছি এবং নাম পাইয়াছি : (১) চা’লধোয়ানী পুকুর; (২) হাঁসপুকুর; (৩) দবদবে পুকুর, ইহাতে ২০ বিঘা জলাশয়; (৪) মিঠাপুকুর; (৫) ‘দীঘিরপাড়’–হয়তো পূর্ব্বে দীঘির অন্য নাম ছিল এবং উহার পাহাড় অত্যন্ত উচ্চ বলিয়া কিছু বিশেষত্ব ছিল; এখন দীঘিরই নাম ‘দীঘির পাড়’ হইয়া গিয়াছে—ইহাতে ৩০ বিঘা জলাশয়। (৬) কালুর পুকুর (৭) রামচন্দ্রের সর্ব্বাপেক্ষা প্রকাণ্ড দীঘি এখন ‘ভবার বেড়ের দীঘি’ নামে পরিচিত। ইহা এক্ষণে রেলের রাস্তার দক্ষিণে পড়িয়াছে, ইহার জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ৫০ বিঘা। খাঁ জাহান বা সীতারামের দীঘির সহিত রামচন্দ্রের দীঘিগুলির তুলনা না হইতে পারে কিন্তু খাঁ জাহান বা সীতারাম ত সব স্থানে যান নাই। জলকষ্ট ত স্থান বিশেষে সীমাবদ্ধ হয় না। যশোহর-খুলনার উত্তর দিকে সীতারাম, পূৰ্ব্বভাগে খাঁ জাহান, দক্ষিণে প্রতাপাদিত্য যেমন অসংখ্য জলাশয় দ্বারা দেশের জলকষ্ট নিবারণ করিয়াছিলেন, পশ্চিমভাগের একাংশেও তেমনি রামচন্দ্র জলাশয় প্রতিষ্ঠা দ্বারা হৃদয়ের পরিচয় দিয়াছিলেন।[৩] হরিদাসের প্রতি রামচন্দ্রের অত্যাচার সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিতে হইতে পারে নবমতের প্রবর্ত্তকদিগকে এমন কত শত্রুতাই সহ্য করিতে হয়। তথাপি রামচন্দ্রের বৈষ্ণব-বিদ্বেষ লোকসমাজে তাঁহাকে একান্ত নিন্দিত করিয়া রাখিয়াছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। কিন্তু সে নিন্দাভেদ করিয়াও তাঁহার জল-দানপুণ্যের কথা লোকসমাজে আত্মপ্রতিষ্ঠা করে।
পাঠান রাজগণ লোকহিতকর কার্য্যের উৎসাহদাতা ছিলেন। হুসেন শাহ যে এবিষয়ে সৰ্ব্বাগ্রণী, তাহা ঐতিহাসিক সত্য। ইতিহাস কখনও প্রবাদের ঋণ পরিশোধ করিতে পারিবে না। পাঠান শাসনের অত্যাচার কলঙ্কের মধ্যেও প্রবাদ একটি কথা প্রকাশ করে যে, তাহাদের মধ্যে অনেকে, অনুগত জমিদারগণ কোন লোক-হিতকর কার্য্য করিলে তাহাদের নিকট হইতে রাজস্ব দাবি করিতেন না। রাজনীতির এমন উচ্চ আদর্শ অতীব দুর্লভ। যাহা হউক, অন্য নৃপতি কি করিয়াছেন, তাহা জানিতে না পারিলেও, হুসেন শাহ যে রাম খাঁর রাজস্ব বহুদিন মাপ করিয়াছিলেন তাহা মানিয়া লইবার কারণ আছে।
সত্যনিষ্ঠ বৈষ্ণব কবি বলিয়াছিলেন হরিদাসের প্রতি অত্যাচারের নিমিত্ত রামচন্দ্র যে মহদপরাধের বীজ রোপণ করিয়াছিলেন, তাহা হইতে বিষবৃক্ষের সৃষ্টি হইয়াছিল। বৈষ্ণববিদ্বেষে এই পাপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছিল। শ্রীচৈতন্যদেবের সহিত যিনি অচ্ছেদ্য বন্ধনে সংবদ্ধ ছিলেন, সেই শ্রীনিত্যানন্দদেব এক সময়ে গৌড়ে আসিয়াছিলেন এবং দেশে দেশে ভ্রমণ করিতেছিলেন। এই ভ্রমণের দুইটি উদ্দেশ্য ছিল— নবধর্ম্মমত প্রচার এবং বৈষ্ণব-বিদ্বেষীদিগের শাস্তি বিধান :
‘প্রেম প্রচারণ আর পাষণ্ডদলন
দুই কার্য্যে অবধূত করেন ভ্রমণ॥’—চরিতামৃত
তিনি রামচন্দ্রের কথা জানেন, এজন্য একদিন শিষ্যদল সহ কাগজপুকুরিয়ায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রামচন্দ্র নিজে ভক্ত অতিথির সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া, ভৃত্য দ্বারা বলিয়া পাঠাইলেন যে, দুর্গামণ্ডপ তাঁহার থাকিবার উপযুক্ত স্থান নহে। নিকটবর্ত্তী গোয়ালার বাড়ীতে বিস্তীর্ণ গোশালায় তাঁহাকে স্থান দেওয়া যাইবে। শুনিয়া নিত্যানন্দ অভিসম্পাত করিয়া গেলেন যে, মণ্ডপগৃহ গোবধকারী ম্লেচ্ছের যোগ্য বাসভূমি হইবে। তাঁহার সে অভিসম্পাত অচিরে কাৰ্য্যে পরিণত হইয়াছিল। রামচন্দ্র রাজস্ব না দিলেও হুসেন শাহ তাঁহার উপর অত্যাচার করেন নাই। কিন্তু হুসেনের মৃত্যুর পর তৎপুত্র নসরৎ শাহের আমলে বঙ্গেশ্বরের সৈন্য সামন্ত কর আদায় করিবার জন্য উপস্থিত হইল; এবং নিত্যানন্দ উঠিয়া গেলে রামচন্দ্র যে মণ্ডপ ঘরে মাটি খুড়িয়া গোময়লেপন দ্বারা পরিশুদ্ধ করিয়া লইয়া ছিলেন, সেই ঘরেই মুসলমান-সৈন্য আসিয়া বাসা করিল, অবধ্য বধ করিয়া ঘরে মাংসাদি রন্ধন করিল এবং
‘স্ত্রী পুত্র সহিত রামচন্দ্ররে বাঁদিয়া
তার ঘর গ্রাম লুটে তিন দিন রহিয়া’—চরিতামৃত
এইভাবে রামচন্দ্রের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইল। সৈন্য সামন্তের অমানুষিক অত্যাচারে সে গ্রাম লোকশূন্য শ্মশানভূমি হইয়া গেল।
স্থানীয় প্রবাদে কিন্তু রামচন্দ্রের শোচনীয় পরিণাম সম্বন্ধে আর একটু ঔপন্যাসিকতা আছে। রামচন্দ্রের রাজবাটীতে রাজপরিবারের আত্মরক্ষার্থ ভূগর্ভে একটি ক্ষুদ্র দুর্গ ছিল; উহার মধ্যে প্রবেশের জন্য বাহির দিক্ হইতে একটিমাত্র দরজা ছিল। সে দরজাটিও এমন স্থানে ছিল যে, কেহ সহজে তাহার সন্ধান পাইত না। নবাব-সৈন্যের আগমনে রামচন্দ্র সমস্ত ধনরত্ন ও পরিবারবর্গ সহ এই গুপ্তদুর্গে প্রবেশ করিয়াছিলেন। উহার গুপ্ত দ্বারে তালা লাগাইয়া বিশ্বস্ত ভৃত্য কালু উহার চাবি লইয়া এক বৃক্ষোপরি লুকাইয়া রহিল। কালুর উপর আদেশ ছিল, নবাব-সৈন্য দেশ ত্যাগ করিলে সে গুপ্তদ্ধার উন্মোচন করিয়া দিবে। নবাবসৈন্য আসিয়া রামচন্দ্রকে না পাইয়া তাহার বাটী ও পার্শ্ববর্ত্তী গ্রামের উপর ভীষণ অত্যাচার করিল এবং অবশেষে চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছিল, এমন সময় একজনে দেখিল, একটি পুষ্করিণীর উপর বিলম্বিত ডালে পত্রগুচ্ছের আড়ালে কালু পলাইয়া আছে, তৎক্ষণাৎ দর্শকের হস্তস্থিত ধনুক হইতে তীর নিক্ষিপ্ত হইল এবং সে অব্যর্থ সন্ধানে আহত হইয়া কালু নিম্নস্থিত পুকুরে পড়িয়া পঞ্চত্ব পাইল। তদবধি পুকুরের নাম কালুর পুকুর আছে। এখনও প্রাচীন রাজবাটীর প্রধান ভগ্নস্তূপসমূহের উত্তরদিকে একটি খোলা স্থান দেখাইয়া স্থানীয় লোকে বলিয়া থাকে উহা ‘পাটনাচের জমি’ এবং উহারই নিম্নে রামচন্দ্র সপরিবারে প্রবেশ করিয়া আর উঠেন নাই। লোকে মনে করে, সে স্থান খনন করিলে অপরিমিত ধনরত্ন পাওয়া যায়; আমরা মনে করি, ধনরত্ন পাওয়া যাউক বা না যাউক, কিছু ঐতিহাসিক তথ্যের উদ্ধার হয়, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই গল্পটী কোন উপন্যাস-লেখকের সরস উপাদান হইতে পারে বটে, কিন্তু আমরা উহাতে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারি না। তাহার কারণ আছে।
চৈতন্যচরিতামৃতকারের বর্ণনায় অবিশ্বাস করিবার কিছু নাই। রামচন্দ্র সপরিবারে বন্দী হইয়া গৌড়ে নীত হইয়াছিলেন। হয়ত তিনি সেখানে হুসেনের সহিত সম্বন্ধসূত্রের পরিচয় দিয়া নিষ্কৃতিলাভ করেন। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্রগণ রাজসরকারে সম্মানিত হইয়াছিলেন।
নবাবিষ্কৃত দুইখানি হস্তলিখিত পুঁথি হইতে এ বিষয়ে কিছু নূতন তথ্য পাওয়া গিয়াছে। রামচন্দ্রের দুইটি পুত্র ছিলেন; জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণানন্দ এবং কনিষ্ঠ ভুবনানন্দ। ভুবনানন্দের উপাধি ছিল কবিকণ্ঠাভরণ। তিনি অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন এবং ‘বিশ্বপ্রদীপ’ নামে এক বিরাট আভিধানিক গ্রন্থ রচনা করেন। উহাতে অষ্টাদশ বিদ্যার যাবতীয় তত্ত্ব সংগৃহীত হইয়াছিল। বহু রশ্মি বা আলোকের সমবায়ে যেমন প্রদীপ হয়, বিশ্বপ্রদীপেরও বিভিন্ন ভাগে তেমনি আলোক, অংশু প্রভৃতি বিভিন্ন অধ্যায় ছিল। অধ্যায়ের শেষে যে সব ভণিতা ছিল, তাহার একটি এই :
‘যং কণ্ঠাভরণং কবীন্দ্রসদসাং শ্রীরাম-খানাপর
খ্যাতেঃ শান্তিধরাদসূত ভুবনানন্দং সুতং জীবনী।
বিদ্যাষ্টদশকেন তদ্বিরচিতে বিশ্বপ্রদীপে স্ফুটং
সংপ্রাপাঙ্গশিখান্তরে পরিণতিং শিক্ষাখ্যমালোকনম॥’[৫]
অর্থাৎ যে শান্তিধরের উপাধি ছিল শ্রীরামখান, তাঁহার ঔরসে ও জীবনী দেবীর গর্ভে কবীন্দ্রসমাজে বরণীয় ভুবনানন্দ কবিকণ্ঠাভরণ জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি অষ্টাদশ বিদ্যার বিশিষ্ট আলোচনা দ্বারা বিশ্বপ্রদীপ নামক গ্রন্থ রচনা করেন।
উক্ত বিরাট গ্রন্থের সামান্য দুইখণ্ড মাত্র পাওয়া যাইতেছে। এক খণ্ড জ্যোতিষ-শাস্ত্রবিষয়ক; উহা লণ্ডনে ইণ্ডিয়া আপিসের লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত হইয়াছে। অপর খণ্ড সঙ্গীতশাস্ত্রবিষয়ক, উহা মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয় কর্তৃক নেপাল হইতে সংগৃহীত হইয়াছিল। তিনি উহার সংক্ষিপ্ত বিবরণী তৎসম্পাদিত পুঁথির তালিকায় প্রকাশিত করিয়াছেন। অন্য ১৬ খণ্ড পুস্তকের এখনও কোন সন্ধান পাই। যদি উহাদের সন্ধান হয় এবং সমগ্র গ্রন্থখানি একত্র প্রকাশিত হইবার সুযোগ হয়, তাহা হইলে সেই বিরাট পুস্তক বিলাতী বিখ্যাত কোষগ্রন্থের (Encyclopaedia) মত ভারতবর্ষের এক অপূর্ব্ব গৌরবস্তম্ভরূপে প্রতিষ্ঠিত হইবে। এই পুস্তকে কৃষ্ণানন্দ ও ভুবনানন্দ সম্বন্ধে যে দুই একটি শ্লোক পাওয়া যায়, তাহা দ্বারা উহারা রাজসরকারে কিরূপ প্রতিপত্তি স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা সুন্দররূপে বুঝা যায়। কৃষ্ণানন্দ সম্পৰ্কীয় শ্লোকটি এই :
‘কৃষ্ণানন্দঃ সমজনি ততো মেধ্যবিত্তৈরযোধ্যা–
কাশীবাসিদ্বিজপরিষদাং কল্পিতানল্পবৃত্তিঃ।
গৌড়ক্ষৌণীপরিবৃঢ়দৃঢ়প্রেমসন্দর্ভপাত্রঃ
বিদ্যানদ্যামনুগুণনিকা স্নানপূতান্তরাত্মা।।’
ইহা হইতে দেখা যাইতেছে, গৌড়াধিপের প্রিয়পাত্র হইয়া সুপণ্ডিত ও পবিত্রাত্মা কৃষ্ণানন্দ অযোধ্যা-কাশীবাসী ব্রাহ্মণদিগকে সেই সেই দেশে বৃত্তিদান করাইয়াছিলেন। কাশী অযোধ্যাদি দেশে বৃত্তিদান করিতে পারেন, সের শাহ ব্যতীত এমন কোন গৌড়াধিপের কল্পনা করা যায় না। হুসেন শাহের মৃত্যুর কয়েক বৎসর পরে তৎপুত্র মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে সের শাহ বীরবিক্রমে বঙ্গাধিকার করেন (১৫৩৮)। সুতরাং রামচন্দ্র খাঁ গৌড়াধিপ হুসেন শাহের সমসাময়িক হইলে, তৎপুত্র কৃষ্ণানন্দ সের শাহের সমকালীন হইতে পারেন। অন্য একটি শ্লোকে ভুবনানন্দের কথা আছে :
মন্ত্রি-গৌড়বিড়ৌজসঃ কবিসম্ভাষণে কঞ্চন,
স্থেমানং দধদুদ্বভুব ভুবনানন্দোহনুজাতস্ততঃ।
গ্রন্থঃ সূক্ষ্মবিচারমন্থমথিতাদ্বিস্তীর্ণবিদ্যার্ণবাৎ,
সারঃ প্রীতিসমীভয়াসুমনসাং তেনায়মভ্যুদ্ধৃতঃ।’
ভুবনানন্দ গৌড়াধিপতির কবিসভা-সন্তাষণে মন্ত্রী ছিলেন। তিনি বিদ্যার্ণব মন্থন করিয়া সূক্ষ্মবিচারসম্পন্ন মহাগ্রন্থ সম্পাদন করেন। বাস্তবিকই ভুবনানন্দের সর্ব্বতোমুখী পাণ্ডিত্যে দেশের মুখোজ্জ্বল করিয়াছে। আমরা কিন্তু তরল গল্পে বিশ্বাস করিয়া সে পণ্ডিতপরিবারকে ভূপ্রোথিত করিয়া রাখিয়াছি। দেশে ইতিহাস-চর্চ্চার যে কত আবশ্যক, তাহা ইহা হইতে বুঝা যায়।
পাদটীকা :
১. এই বই-এর দ্বিতীয় অংশ : পাঠান রাজত্ব, নবম পরিচ্ছেদ, হুসেন শাহ, ৪-৬ নং স্তবক ও দ্বাদশ পরিচ্ছেদ, হরিদাস, ৯-১১ নং স্তবক দ্রষ্টব্য।
২. “রাজা রামচন্দ্র খাঁন তথা জমিদার।
অঞ্চল জুড়িয়া জলদান পুণ্য যার।।
শিবের মন্দির শোভে যার সিংহদ্বারে।
ব্রাহ্মণ পোষণ করে দিয়া ব্রহ্মোত্তর।।’— গোঁসাই গোরাচাঁদের শ্রীসঙ্কীৰ্ত্তন বন্দনা
৩. সম্ভবতঃ বহু পুকুরের অস্তিত্বের জন্যই রামখানের আবাসস্থানের নাম কাগজপুকুরিয়া হইয়াছিল
৪. ‘রামচন্দ্র খান অপরাধ বীজ রুইল
সেই বীজ বৃক্ষ হইয়া আগেতে ফলিল।’–শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত
৫. India Office Catalogue of Sanskrit manuscripts No. 1781, PP. 1082-3. সেখানে বিশ্বপ্রদীপ সম্বন্ধে এইরূপ বিবরণী আছে : ‘Vishyapradipa, a cyclopaedia of (chiefly astronomical) knowledge by Bhubanananda, son of Santidhar Rambala (or Ram khan) and jibani and younger brother of krish- nananda.’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন