সতীশচন্দ্র মিত্র
প্রাদেশিক কাহিনী এবং প্রচলিত প্রবাদ হইতে আমরা কয়েকজন মুকুট রায়ের পরিচয় পাই।
১॥ রায় মুকুট নামে নবদ্বীপ অঞ্চলে একজন পণ্ডিত ছিলেন, ইনি অমরকোষের এক টীকা প্রণয়ন করেন। রায় মুকুটপদ্ধতি নামে একখানি স্মৃতিগ্রন্থও তাঁহার নাম রক্ষা করিয়াছে। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জন্য ইহার এক উপাধি ছিল, ‘বৃহস্পতি’। ইনি ব্রাহ্মণ এবং গৌণ কুলীন।
২॥ জমিদার মুকুট রায়, তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতার নাম বিনোদ রায়। ইঁহারা কাশ্যপ গোত্রীয় চাটুতি গাঞি। স্বনামখ্যাত ঐতিহাসিক ‘রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় তাঁহার ‘রাজবালা’ নামক উপন্যাসে লিখিয়াছেন যে, মুকুট রায়ের কন্যা দুর্গাবতীর সহিত নদীয়া জেলার অন্তর্গত গোসাঞি- দুর্গাপুরনিবাসী কুলীনাগ্রগণ্য কমলাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়; এবং তজ্জন্য জয়দিয়ার রায় চৌধুরী বংশের সহিত সম্বন্ধের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। যশোহরের অন্তর্গত জয়দিয়ার রায়চৌধুরীগণ যে উক্ত বিনোদ রায়ের বংশসম্ভূত, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু সে বংশের সহিত দুর্গাপুরের বন্দ্যবংশের সম্বন্ধ ছিল কিনা সন্দেহ। বৰ্ত্তমান সময়ে উক্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বংশীয়গণ ‘অধিকারী’ উপাধিযুক্ত। অধিকারীরা প্রধান কুলীন এবং স্বভাবে আছেন। কাশ্যপ-গোত্রীয় বিনোদ রায় বংশজ ছিলেন, তদ্বংশীয়ের সহিত বিবাহ হইলে কুল থাকে না। সুতরাং জয়দিয়ার সহিত দুর্গাপুরের বিবাহসম্বন্ধ ছিল বলিয়া বোধ হয় না। জয়দিয়ার সম্পর্কিত মুকুট একজন সাধারণ জমিদার ছিলেন; নলডাঙ্গার রাজবংশ প্রবল হইলে, সে বংশের জমিদারীর লোপ হয়।
৩॥ ঝিনাইদহ অঞ্চলে একজন প্রবল প্রতাপান্বিত জমিদার ছিলেন, তাঁহার নাম রাজা মুকুট রায়। ইনি শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ, শাণ্ডিল্য গোত্র, পারিহাল গাঞি। ইহার এক ভ্রাতা ছিলেন, তাঁহার নাম গন্ধর্ব্ব রায়; মুকুট রায়ের পতনের পর তিনি বঙ্গেশ্বর কর্তৃক খাঁ উপাধিভূষিত হন। এই গন্ধৰ্ব্ব খাঁ জোর করিয়া খড়দহমেলের অবসথী বংশীয় রাঘব চট্টোপাধ্যায়ের সহিত স্বীয় কন্যার বিবাহ দেন; তদবধি ঐ বংশে পারিহালভাবাপন্ন দোষ স্পর্শিয়াছিল। এখনও রাঘবের বংশীয়গণের পারি-মেল রহিয়াছে। শ্রোত্রিয়ের কন্যা বিবাহ করিলে কুলীনের কুল ভঙ্গ হয় না, শুধু দোষস্পর্শ হয়। সম্ভবতঃ দুর্গাবতী এই প্রতাপশালী রাজা মুকুট রায়ের কন্যা; রাজকন্যার নামানুসারে দুর্গাপুরের নাম হইয়াছিল এবং দুর্গাবতীর পুত্রবংশেও পারিহাল দোষ প্রবেশ করিয়াছিল। এখনও অধিকারী মহাশয়দিগের সে দোষ আছে। এই রাজা রায় মুকুটের অনেক সৈন্য সামন্ত ছিল; কথিত আছে তিনি ১৬ হল্কা হাতী, ২০ হল্কা অশ্ব ও ২২০০ কোড়াদার না লইয়া বাহির হইতেন না।[১] খাঁ জাহান প্রভৃতির মত তিনিও জলাশয় প্রতিষ্ঠায় পুণ্যবান্ ছিলেন; রাস্তা নির্ম্মাণ ও জলাশয় খনন করিতে করিতে তিনি অগ্রসর হইতেন। এখনও ঝিনাইদহের সন্নিকটে এরূপ অনেক রাস্তার ভগ্নাবশেষ ও জলাশয় রহিয়াছে। জলাশয়ের মধ্যে ঢোলসমুদ্র সর্ব্বপ্রধান, উহা ৫২ বিঘা জমি অধিকার করিয়া রহিয়াছে। ইহা ব্যতীত মিঠাপুকুর, নটিপুকুর নামে আরও কতকগুলি পুকুর এখনও বৰ্ত্তমান আছে। ঝিনাইদহের পূর্ব্ব ধারে ‘বিজয়পুরে’ এই রাজার রাজধানী ছিল;২ উহার দক্ষিণে পশ্চিমে ‘বাড়ীবাথান’ নামক স্থানে তাহার প্রকাণ্ড গো-শালা ছিল। তাহার খুব অধিকসংখ্যক গাভী ছিল বলিয়া লোকে তাহাকে ‘বৃন্দাবনের’ নন্দ মহারাজ বলিত। ‘বেড়বাড়ী’ নামক স্থানে তাহার উদ্যান ছিল। যেখানে তাহার কোড়াদার সৈন্যেরা বাস করিত, তাহার নাম কোড়াপাড়া। এ সবগুলি স্থান এখনও বর্তমান আছে। রায় মুকুটের রাজবাটীর কিছু নাই, তবে ঢোলসমুদ্রের দক্ষিণে দুই চারিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইষ্টকস্তূপ প্রবাদের সাহায্য কিছু নিদর্শন রক্ষা করিয়াছে। রায় মুকুট নিজে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, এবং গো-ব্রাহ্মণে ভক্তিমান ছিলেন। কথিত আছে, গয়েশকাজি নামক এক ব্যক্তি তাঁহার একটা গরু হত্যা করেন বলিয়া, তিনি উক্ত কাজিকে নিহত করেন। সেই কথা বঙ্গেশ্বরের নিকট পৌঁছিলে, তাঁহাকে বাঁধিয়া লইবার জন্য অসংখ্য সৈন্য প্রেরিত হয়। শৈলকূপার সন্নিকটবর্ত্তী বাঘুটিয়ানিবাসী কায়স্থবংশীয় রঘুপতি ঘোষ রায় মুকুটের প্রধান সেনাপতি ছিলেন; তাঁহার অধীনে আর দুইজন অসীম বলশালী বীর ছিলেন, তাঁহাদের নাম চণ্ডী ও কেশব। ইহারা চণ্ডী সর্দ্দার ও কেশব সর্দ্দার নামে পরিচিত ছিলেন বলিয়া লোকে মনে করিত। ইঁহারা চণ্ডালবংশীয়। কিন্তু চণ্ডীসম্বন্ধে এরূপও শুনা যায় যে তাঁহার সহিত রঘুপতির অত্যন্ত প্রণয় ছিল, রঘুপতি চণ্ডীকে বৈবাহিক সম্বোধন করিতেন; সম্ভবতঃ চণ্ডীও কায়স্থ ছিলেন। প্রবাদ আছে, রায় মুকুটের আর এক দল পাঠান সৈন্য ছিল, তাহার অধ্যক্ষ ছিলেন গয়েশ উদ্দীন। বাড়ীবাথানের সন্নিকটে গয়েশপুর নামক একটি স্থান আছে। উহার উৎপত্তি গয়েশকাজি হইতে হইয়াছিল, কিংবা, লোকের মুখে যেমন শুনিতে পাওয়া যায়, ঐ স্থানে সেনাপতি গয়েশউদ্দীনের শিবির ছিল, তাহা নিঃসন্দেহরূপে বলিবার উপায় নাই। যাহা হউক, নবাব সৈন্যের আগমন সংবাদে রায় মুকুট স্বীয় পরিবারবর্গ একটি গুপ্ত দুর্গে লুক্কায়িত রাখিয়া স্বয়ং যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইলেন। পর পর দুই দিন যুদ্ধে নবাব-সৈন্য পরাজিত হইল। চণ্ডী ও কেশব জয়োল্লাসে মত্ত হইয়া রাজার জনৈক পাঠান-সৈন্যকে নবাব-সৈন্য ভাবিয়া কালী মন্দিরে বলি দেয়; তাহার ফলে সমস্ত পাঠান- সৈন্য বিদ্রোহী হইয়া উঠে। নবাব পক্ষ হইতে রাজার পাঠান-সৈন্যগণকে হস্তগত করিবার কোন ব্যবস্থা হইয়াছিল কিনা জানি না। মোট কথা, বাড়ীবাথানের সন্নিকটে উভয় পক্ষে যে তৃতীয় যুদ্ধ হয়, তাহাতে মীরজাফরের মত গয়েশউদ্দীন যুদ্ধে বিরত ছিলেন বলিয়া রায় মুকুট সম্পূর্ণ পরাজিত ও বন্দী হন। বন্দীকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া রাজধানীতে লইয়া যাওয়া হয়। সেখানে তাঁহার বীরত্বের খ্যাতি পূৰ্ব্বেই পৌঁছিয়াছিল। বঙ্গেশ্বর তাঁহাকে বাধ্যতা স্বীকার করাইয়া তাঁহার রাজ্য প্রত্যর্পণ করেন।
কোন রাজবংশের পতন বিবৃত করিতে হইলে, এ দেশের একটা চিরপ্রচলিত প্রথা আছে। যেখানে প্রকৃত ইতিহাস নিৰ্ব্বাক্, সেখানে একটা মামুলী গল্পের অবতারণা করিয়া পাদপূরণ করা হয়। পাঠান ও মোগল আমলে হিন্দুরাজগণ একটু বিদ্রোহী হইলেই তাহার বিরুদ্ধে নবাব-সৈন্য আসিত; ফলে হিন্দুরাজা পরাজিত ও বন্দী হইতেন। বন্দীকে লইয়া যাইবার সময়ে, তাহার সঙ্গে প্রায়ই দুইটি কপোত কপোতী যাইত। ইহা হইতে বুঝা যায়, তখন এই সংবাদবাহী কপোতের বিশেষ ব্যবহার ছিল। বিংশ শতাব্দীর সভ্য ইয়োরোপে সংবাদবাহী কপোত যেমন দুঃসাধ্য সাধন করিতেছে, ৫/৬ শত বৎসর পূর্ব্বে বঙ্গেও কপোতের সে গুণের সদ্ব্যবহার করা হইত। কিন্তু প্রভেদ এই,—বঙ্গীয় কপোতেরা পরিণামে উপকার না করিয়া সর্ব্বনাশই সাধন করিত। হিন্দুর নিকট যুদ্ধে পরাজয় অপেক্ষা বিধর্মীর হস্তে জাতিকুল নাশই অধিকতর অসহনীয় ছিল। কারণ সে যুগে মুসলমানের সহিত যুদ্ধে পরাজয়ের অর্থই জাতিধর্ম নাশ। এ জন্য বন্দী রাজা সঙ্গে দুইটি পারাবত লইয়া রাজধানীতে যাইতেন, যদি তিনি নিষ্কৃতি লাভ করিতেন, পারাবত সঙ্গেই থাকিত। আর যদি নিতান্তই তাঁহার দেহান্ত হইত, তাহা হইলে তিনি পারাবত দুইটি ছাড়িয়া দিয়া মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতেন। পারাবত উড়িয়া বাড়ী ফিরিয়া আসামাত্র জানা যাইত যে রাজার দেহান্ত ঘটিয়াছে; সুতরাং তাঁহার পরিবারবর্গ সকলে আত্মহত্যা করিয়া ইতিহাসের পৃষ্ঠা হইতে বংশচিহ্ন মুছিয়া ফেলিতেন। কিন্তু বঙ্গের পারাবতগুলি উড়িয়া আসা ছাড়া অন্য কোন বিশেষ শিক্ষা পাইত না এবং তাহারা উড়িয়া আসিবার জন্য পাগল হইত; ইহার ফল হইত যে, অনেক সময়ে রাজার নিষ্কৃতির আজ্ঞা হইলেও দৈবক্রমে পারাবত উড়িয়া আসিয়া বংশ নিলোপ করিত; তখন রাজা ফিরিয়া আসিয়া নিজেও আত্মহত্যা করিতেন। এমন যে কত ঘটনা হতভাগিনী বঙ্গজননীর ভাগ্যে ঘটিয়াছে, তাহা কে বলিবে? মহারাজ বল্লাল সেন হইতে আরম্ভ করিয়া কত জনের সম্বন্ধে যে এই কপোতকাহিনীর সংযোজনা হইয়াছে, তাহার অবধি নাই। এ অঞ্চলেও কপোতের ভুল দ্বারা বহু রাজবংশ নির্ব্বংশ হইবার গল্প আছে; তন্মধ্যে দেবগ্রামের দেবপাল রাজা, দেউলিয়ার চন্দ্রকেতু, মহম্মদপুরের সীতারাম, হরিণাকুণ্ডুর শালিবাহন এবং বাড়ীবাখানের এই রায় মুকুটের কথা উল্লেখযোগ্য। রায় মুকুটের কপোত ফিরিয়া আসিবামাত্র তাঁহার পরিবারবর্গ গুপ্তদুর্গের পার্শ্ববর্ত্তী পরিখাতে নিমজ্জিত হইয়া আত্মহত্যা করেন; যেখানে তাঁহার কন্যারা মরেন তাহা ‘কন্যাদহ’, যেখানে তাঁহার দুই স্ত্রী নিমজ্জিত হন, তাহা ‘দুইসতীনে’ এবং যেখানে রাজদৈবজ্ঞ নিমজ্জিত হন, তাহা ‘দৈবজ্ঞদহ’ বলিয়া খ্যাত হইয়াছিল। এখনও ঐ সকল স্থান আছে, কিন্তু তাহা আর সে পরিখা নাই; পরিখা বিলে পরিণত হইয়া দুর্গচিহ্নও বিলুপ্ত করিয়াছে
৪॥ চতুর্থ মুকুট রায়ের বাড়ী ছিল, ব্রাহ্মণনগর।৩ যশোহর জেলায় যেখানে বর্তমান ঝিঁকারগাছা রেলওয়ে-ষ্টেশন অবস্থিত, তাহার কিঞ্চিৎ পূর্ব্বোত্তর কোণে লাউজানি বলিয়া গ্রাম আছে। ঐ লাউজানিই ছিল এক সময় ব্রাহ্মণনগর। উহা কপোতাক্ষের কূলে অবস্থিত। কিন্তু পূৰ্ব্বে যেরূপ উহার অবস্থান ছিল, এখন আর তেমন নাই। তখন ব্রাহ্মণনগরের পশ্চিম ভাগে সুবিস্তীর্ণ কপোতাক্ষ এবং দক্ষিণসীমা দিয়া হরিহর নদ প্রবাহিত হইত; উত্তর-পূর্ব্বদিকে বিল ছিল। ইহার মধ্যে পরিখাবেষ্টিত দুর্গে রাজা মুকুট রায় বাস করিতেন। তিনি গুড়গাঞিভুক্ত শ্রোত্রিয় ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। পাঠান আক্রমণের পূর্ব্ব হইতে গুড়গাঞিভুক্ত ব্রাহ্মণেরা যশোহর-খুলনার নানা স্থানে নদীতীরে বাস করিতেন। তাঁহারাই এক সময়ে চেঙ্গুটিয়া পরগণার রাজা ছিলেন। আমরা পূর্ব্বে দেখাইয়াছি, দক্ষিণডিহি প্রভৃতি স্থানের রায়চৌধুরী উপাধিভূষিত গুড়ব্রাহ্মণেরা কিরূপে খাঁ জাহানের অভিযানের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন এবং পরে কিরূপে এই বংশীয় কামদেব ও জয়দেব মহম্মদ তাহেরের কৌশলে পীরালি মুসলমান হইয়া যান। স্বধর্ম্মনিষ্ঠ মুকুট রায় প্রবল প্রতাপে শাসনকার্য্য করিতেন। তাঁহার রাজ উত্তরে মহেশপুর হইতে দক্ষিণ সমুদ্র পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পশ্চিম দিকে এ রাজ্য গঙ্গা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করিয়াছিল।[৪] এই শাসনকার্য্যে তাঁহার দক্ষিণহস্তস্বরূপ ছিলেন তাঁহার আত্মীয় ও সেনাপতি দক্ষিণ রায়।[৫] দক্ষিণ রায়ও ব্রাহ্মণ এবং দেবভক্তিপরায়ণ। রাজধানী ব্রাহ্মণনগরে মুকুটেশ্বর শিবমন্দির ছিল, দক্ষিণ রায় মন্দিরে গিয়া শিবপূজা না করিয়া জলগ্রহণ করিতেন না। অধিবাসীর সংখ্যা অধিকাংশ ব্রাহ্মণ ছিল বলিয়া নগরের নাম ব্রাহ্মণ নগর হইয়াছিল। মুকুট রায় অতিরিক্ত মুসলমানদ্বেষী ছিলেন; তখন সম্যক্ শাসন বিস্তৃত না হইলেও দেশ ইস্লামাধিকারভুক্ত ছিল। কিন্তু তবুও মুকুট রায় মুসলমানের আধিপত্য স্বীকার করিতেন না, তাহাদের মুখ দর্শন করিতেন না, কোনও কারণে মুসলমান দৰ্শন করিলে তজ্জন্য প্রায়শ্চিত্ত করিতেন। শাসনের সুব্যবস্থার জন্য মুকুট রায়ের রাজ্য দুইভাগে বিভক্ত ছিল; তন্মধ্যে উত্তর ভাগ তিনি নিজে শাসন করিতেন; তজ্জন্য তাঁহার অধীনে যথেষ্ট পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য ছিল; দক্ষিণ দেশ বা ভাটি মুল্লুকের শাসনভার দক্ষিণ রায়ের হস্তে সমর্পণ করিয়াছিলেন। এ জন্য তাঁহাকে লোকে ভাটীশ্বর, এমন কি আঠার ভাটির রাজ্যেশ্বর বলিত।[৬] এজন্য তাঁহার রীতিমত নৌ-বাহিনী ও নৌ-সৈন্য ছিল। এই ভাটি দেশে কাঠ, মধু, মোম প্রভৃতি হইতে আয়ও কম হইত না। সুন্দরবন তখন উত্তর দিকে অনেক দূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং ভীষণ ব্যাঘ্র প্রভৃতির উৎপাত ছিল। দক্ষিণরায় তেমনি বলবান্ পুরুষ ছিলেন; তিনি তীর ধনুক ও অস্ত্র সাহায্যে বহু ব্যাঘ্র ও কুমীর শিকার করিতেন এবং প্রয়োজন হইলে মল্লযুদ্ধেও সুন্দরবনের বাঘের মুণ্ডাত করিতে পারিতেন। অতিরঞ্জিত হইলে এই সকল গল্প কতদূর প্রসার লাভ করিতে পারে, তাহা সহজেই অনুমেয়। বস্তুতঃ দক্ষিণ রায় এই বলবীর্য্যের পুরস্কারস্বরূপ সুন্দরবনের ব্যাঘ্রভীতিনিবারক দেবতারূপে পূজিত হইয়া আসিতেছেন।
এই ব্যাঘ্রের দেবতার পূজাপদ্ধতি প্রচার জন্য অনেকেই লেখনী ধারণ করিয়াছেন; তন্মধ্যে মাধবাচার্য্য এবং নিম্তা গ্রামনিবাসী ‘রায়মঙ্গল’ প্রণেতা কৃষ্ণরাম দাসই প্রধান। রায় মঙ্গল হইতে জানা যায়, প্রভাকর নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি চব্বিশ-পরগণার দক্ষিণাংশে বন কাটাইয়া রাজ্য স্থাপন করেন। তিনি শিবের বরে দক্ষিণ রায় নামক পুত্র লাভ করেন। দক্ষিণ রায়ের আর এক ভ্রাতা বা বন্ধু ছিলেন কালু রায়। এই কালু রায়ের সহিত গাজীর সহচর কালুর কোন প্রকার সম্পর্ক নাই।[৭]
সম্ভবতঃ প্রভাকরের পুত্র দক্ষিণ রায় হাতিয়াগড় প্রদেশে আজন্ম ব্যাঘ্র শিকার প্রভৃতি কার্য্যে রত থাকিয়া, সুন্দরবনে শাসন বিস্তার কার্য্যে পিতার সহায়তা করিয়া বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তাঁহার বীরত্বের খ্যাতি মুকুট রায়ের নিকট পৌঁছিয়াছিল; তিনি সেই বীর যুবককে স্বীয় কার্য্যের সহায়ক রূপে গ্রহণ করেন। রাজার ধনবল ও জনবল দ্বারা পৃষ্ঠপোষিত হইয়া, বিস্তীর্ণ নদীবক্ষে বা জঙ্গলাকীর্ণ সুন্দরবনে শত্রু শাসন করিতে করিতে এমন রণপাণ্ডিত্য লাভ করেন যে, তাঁহার ভয়ে কেহ সুন্দরবনে প্রবেশ করিতে সাহসী হইত না। দক্ষিণ রায়ও মুকুট রায়ের মত মুসলমানদ্বেষী ছিলেন। এই জাতিবিদ্বেষই তাঁহাদের কালস্বরূপ হইয়াছিল। এই জন্যই গাজী তাঁহাদের উপর অত্যাচার করিতে অগ্রসর হন।
এই স্থানে আমরা ধীর ভাবে কয়েকটি কথা বিচার করিব। আমরা চারি জন মুকুট রায়ের উল্লেখ করিয়াছি। তন্মধ্যে প্রথম দুই জনের সহিত প্রস্তাবিত ইতিহাসের বিশেষ কিছু সম্বন্ধ নাই। তৃতীয় জনকে আমরা রায় মুকুট বলিয়াছি; চতুর্থ জনকে বলিয়াছি মুকুট রায়। এই দুই জনকে এক ব্যক্তি বলিয়া অনেকে সন্দেহ করিয়াছেন। যিনি ঝিনাইদহের মুকুটের কথা বলিতে গিয়াছেন, তিনি জনশ্রুতির উপর নির্ভর করিয়া বলিয়াছেন যে, তাঁহার একটি রাজধানী দক্ষিণ দিকে ছিল; কিন্তু সে মুকুটের সহিত গাজীর যুদ্ধ বা চম্পাবতী নামক তাঁহার কোন কন্যার কথা উল্লিখিত হয় নাই।[৮] অপর পক্ষে যিনি ব্রাহ্মণনগরের মুকুটের কথা বলিয়াছেন, তিনি অনুমান করিয়াছেন যে, তাঁহার রাজ্য উত্তর দিকে অনেক দূর বিস্তৃত ছিল; কিন্তু তিনি নবাব সৈন্যের সহিত যুদ্ধের কথা বিশেষ কিছু বলেন নাই। আমরা মনে করি, এই দুই জন স্বতন্ত্র ব্যক্তি। তাহার কয়েকটি কারণ সংক্ষেপতঃ এই :
১॥ রায় মুকুট পরিশ্রোত্রিয় এবং মুকুট রায় গুড়-শ্রোত্রিয়, যদিও শেষোক্ত জনের সামাজিক নিদর্শন সম্বন্ধে জনশ্রুতি ভিন্ন বিশেষ প্রমাণ নাই।
২॥ রায় মুকুটের চম্পাবতী নামে কোন কন্যার কথা পাওয়া যায় না।
৩॥ রায় মুকুটের সহিত গাজীর যুদ্ধ হয় নাই বা দক্ষিণ রায়ের সহিত তাঁহার সম্বন্ধের উল্লেখ নাই।
৪॥ রায় মুকুট যুদ্ধে বন্দী হইয়া রাজধানীতে নীত হইয়াছিলেন; মুকুট রায় বন্দী হইবার পূৰ্ব্বেই কূপে পড়িয়া আত্মঘাতী হইয়াছিলেন।
৫॥ রায় মুকুট নবাব সৈন্যের সহিত যুদ্ধকালে পরিবারবর্গ শৈলকূপার সন্নিকটে কোন দুর্গে রাখিয়াছিলেন, সেখানে তাঁহার স্ত্রী-কন্যার মৃত্যু হয়। অথচ প্রবাদ অনুসারে মুকুট রায়ের পরিবারবর্গ ব্রাহ্মণনগরে কূপে পড়িয়া আত্মহত্যা করেন। সুতরাং রায় মুকুট ও মুকুট রায় এক ব্যক্তি নহেন এবং তাঁহারা এক সময়ে প্রাদুর্ভূত হন নাই। সম্ভবতঃ ব্রাহ্মণনগরের মুকুট রায় হুসেন শাহ ও তৎপুত্র নসরৎ শাহের রাজত্ব কালে অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে আবির্ভূত হন এবং ঝিনাইদহের রায় মুকুট তাঁহার অনেক পরে অর্থাৎ মোগলআমলের প্রথম ভাগে আত্ম-প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এইরূপ অনুমান করিবার কি কারণ আছে, তাহা পরে বলিব। আমরা এখানে রাজা মুকুট রায়ের কথাই বলিতেছি।
মুকুট রায়ের স্ত্রীর নাম লীলাবতী ও তাঁহার সাত পুত্র এবং একটি মাত্র কন্যা। সাত ভ্রাতার ভগিনী বলিয়া ভগিনীটি সকলেরই বিশেষ আদরের ছিল; এরূপ আদরের ভগিনীর প্রসঙ্গ উঠিলে আমাদের দেশে এখনও ‘সাত ভাই চম্পার’ কথা অনেকে বলিয়া থাকে। চম্পাবতী অপূৰ্ব্ব রূপ- লাবণ্যবতী ছিল; এমন কি তাহার রূপের কথা নানা স্থানে ব্যাপ্ত হইয়াছিল। গাজী সেই রূপের খ্যাতি শুনিয়াই মুগ্ধ হইয়াছিলেন। তিনি মুকুট রায়ের মুসলমান বিদ্বেষের কথা জানিতেন। সেই ধর্মবিদ্বেষের জন্য প্রতিহিংসা লইবার কল্পনাই হউক বা প্রকৃত রূপমোহেই হউক, গাজী চম্পাবতীর সহিত বিবাহের প্রস্তাব করিবার জন্য কালুকে পাঠাইলেন। মুকুট রায় তাহার দুঃসাহসিক প্রস্তাবে ক্রোধে অগ্নিশৰ্ম্মা হইয়া কালুকে কারাবদ্ধ করিলেন। সুলতান হুসেন শাহ মুকুট রায়ের মুসলমান বিদ্বেষের কথা পূর্ব্ব হইতে জানিতেন এবং পরে গাজীর বর্ণনা হইতে তাহা বুঝিয়া লইয়া উহার প্রতিশোধ লওয়া জাতিগত কর্তব্য বলিয়া ধরিয়াছিলেন। গাজী সোণারপুর প্রভৃতি স্থান হইতে নৌকাপথে অনেক সৈন্য লইয়া আসিয়াছিলেন, হুসেন শাহের সৈন্যদলও আসিতেছিল। যেন সকল আয়োজন ও অভিযান কালুর কারামোচনের জন্য হইতেছিল।
দক্ষিণ রায় এ যুদ্ধের জন্য অপ্রস্তুত ছিলেন না। দক্ষিণ দিক হইতে যখন গাজীর সৈন্য আসিবার উপক্রম হইতেছিল, তখন তিনি ত্বরিত গতিতে নৌ-বাহিনী সাজাইয়া লইয়া অতর্কিত ভাবে গাজীর সৈন্যের উপর পড়িলেন, এবার গাজীকে পরাজিত হইয়া পলায়ন করিতে হইয়াছিল। শুনা গিয়াছে, ইছামতী-তীরে তারাগুণিয়া গ্রামে সৈয়দ সাদাউল্লার বাটীতে গাজী সাহেব আশ্রয় লইয়াছিলেন।[১০] পরে গাজী সমস্ত সংবাদ সুলতান হুসেন শাহের নিকট গিয়া অতিরঞ্জিত ভাষায় বর্ণনা করিলেন। গাজীর পরাজয়, কালুর কারাবাস, মুসলমানের অপমান, হিন্দুরাজন্যের অবাধ্যতা— সকল একত্র করিয়া এক ধর্ম্মযুদ্ধের কারণ উপস্থিত করিল। গৌড়েশ্বরের সৈন্যসমূহ জাতীয় মর্য্যাদার জন্য মুকুট রায়ের বিরুদ্ধে প্রেরিত হইল। হিজলী ও হাতিয়াগড় প্রদেশ হইতেও গাজী সাহেব অনেক সৈন্য সংগ্রহ করিয়া লইয়া আসিলেন। দক্ষিণ রায়ও নদীতীরসমূহ উৎসন্ন ও বাসশূন্য করিয়া, খাদ্যদ্রব্য দূরীভূত বা ভূপ্রোথিত করিয়া, যেখানে সেখানে গুপ্ত সৈন্য সংস্থাপন করিয়া শত্রুর আগমন-পথ কণ্টকময় করিয়া তুলিয়াছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না।
গাজী কালুর পুঁথিতে আছে, গাজী কতকগুলি ব্যাঘ্র লইয়া ব্রাহ্মণনগরের নিকট উপনীত হইলেন এবং ব্যাঘ্রদিগকে মেষ করিয়া লইয়া গুপ্তভাবে নগরে প্রবেশ করিলেন। এ ব্যাঘ্র সুন্দরবনের চতুষ্পদ ব্যাঘ্র বলিয়া বিশ্বাস করি না, তবে ইঁহারা সুন্দরবনের অসভ্য মল্লজাতীয় বলশালী সৈন্য হইতে পারেন। মোট কথা, গাজী গুপ্ত ভাবে নগরীতে প্রবেশ করিলেন। অন্য দিক্ হইতে গৌড়েশ্বরের সেনা আসিল। কয়েক দিন ধরিয়া ভীষণ যুদ্ধ চলিল। মুসলমানেরা পুরীর মধ্যবর্তী কূপের জলে গো-রক্ত প্রভৃতি নিক্ষেপ করিয়া বিষাক্ত করিয়া দিলেন।[১১] অবশেষে মুকুট রায় পরাজিত হইলেন। তখন দক্ষিণ রায় অন্য সৈন্য লইয়া দক্ষিণ দিকে ছিলেন। মুকুটের পরিবারবর্গ অধিকাংশই কূপে পড়িয়া আত্মহত্যা করিলেন। কেবলমাত্র মুকুটের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র কামদেব ও কন্যা সুভদ্রা বা চম্পাবতী বন্দী হইলেন। শত্রুপক্ষ ইঁহাদের উভয়কেই অখাদ্য খাওয়াইয়া মুসলমান করিয়া দিয়াছিলেন। কেহ বলেন, গাজী সাহেব চম্পাবতীকে বিবাহ করিবার কিছু দিন পরে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, আবার কেহ বলেন, গাজী সাহেব চম্পাবতীকে বিবাহ করেন নাই, বিবাহ করিবার প্রস্তাবনা ছল মাত্র; ইসলামদ্বেষী মুকুট রায়কে শাসন করাই উদ্দেশ্য ছিল। গাজীরা হিন্দুর সহিত বিবাদ করিতেন, বা হিন্দু জাতির উপর অত্যাচার করিতেন, সে শুধু ধর্ম্মের জন্য। অন্যান্য গাজীদিগের চরিত্র আলোচনা করিলে বিশ্বাস হয় না যে, গাজীসাহেব নরপিশাচদিগের মত ইন্দ্রিয়সেবী ছিলেন। এ বিষয়ে মুসলমানী পুঁথিতে গাজী সাহেবের কামুকতার যে বিস্তৃত কাহিনী আছে, তাহা সম্পূর্ণ অলীক বলিয়া বোধ হয়। উক্ত পুঁথিতেই আছে যে, কালু গাজী-সাহেবের চরিত্র-পতন দেখিয়া বারংবার ভর্ৎসনা করিতেছেন।[১২] যাহা হউক, গাজীর সহিত চম্পাবতীর বিবাহান্তে বা বিবাহের পূর্ব্বে, সেই রাজকুমারী কোন আত্মীয়ের সাহায্যে পলায়ন করিয়া সাতক্ষীরার গণরাজার আশ্রয় লন এবং অবশিষ্ট জীবন মনস্তাপে, স্বজন-শোকে, আত্মচিন্তায় ও ধর্ম্মসাধনায় অতিবাহিত করেন। তাঁহার যাহা কিছু ধনরত্ন ছিল, তাহা সৎকার্য্যে ব্যয়িত করিয়া পরসেবায় এমনভাবে তাঁহার আদর্শ জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন যে, জাতিধৰ্ম্ম-নির্ব্বিশেষে সৰ্ব্বলোকে তাঁহাকে ‘মা’ বলিয়া ডাকিত, মায়ের মত ভক্তি করিত, – তাঁহার নাম হইয়াছিল ‘মাইচম্পা বিবি।’ তাঁহার মৃত্যুর পর এই মাতৃদেবীর ভক্তবৃন্দ তাঁহার স্মৃতিরক্ষার জন্য তাঁহার সমাধির উপর একটি সুন্দর ও বৃহৎ এক-গুম্বজ মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দেন। সাতক্ষীরার সন্নিকটে লাসা গ্রামে এই বিখ্যাত ‘মাইচাম্পার দরগা’ এখনও আছে।[১৩] মাইচাম্পার পূর্ব্বজীবন নানা অদ্ভুত কাহিনীর অন্তরালে অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে।[১৪]
মুকুট রায়ের শিশুপুত্র কামদেব নানাস্থান ঘুরিয়া অবশেষে বর্তমান গোবর-ডাঙ্গার দক্ষিণে চারঘাটে আশ্রয় লন। তাঁহার নাম পরিবর্তিত হইয়া ঠাকুরবর হইয়াছিল। তিনি মুসলমান ফকিরের মত চারঘাটে বাস করিতেন। তিনি মুসলমান হইয়াছিলেন বলিয়া ক্রমে সে ধর্ম্মের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্ত্তী কালে তিনি হিন্দুদিগকে মুসলমান করিতে চেষ্টা করিতেন। ঠাকুরবর প্রায় ১০০ বৎসর কাল জীবিত ছিলেন। প্রতাপাদিত্যের উত্থানপতন এবং এমন কি প্রতাপের মৃত্যুর পরে ঠাকুরবর দেহত্যাগ করেন। হরি শৌণ্ডিক বা হ’রে শুঁড়ি নামক একজন প্রসিদ্ধ সমৃদ্ধিসম্পন্ন বণিক্ চারঘাটে বাস করিতেন। তাঁহাকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করাইবার জন্য ঠাকুরবর অনেক চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু হরি তাহাতে সম্মত হন নাই। তাহার ফলে ঠাকুরবর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। প্রতাপাদিত্যের সহিত হরি শৌণ্ডিকের বিবাদ ও তাঁহার পতনের মূলে যে ঠাকুরবরের প্ররোচনা ছিল, এরূপ শুনিতে পাওয়া যায়। আমরা দ্বিতীয় খণ্ডে তাহার আলোচনা করিব।[১৫] হ’রে শুঁড়ি মৃত্যুও শ্রেয়ঃ বোধ করিতেন, কিন্তু ঠাকুরবরের কথায় ধর্ম্মান্তর গ্রহণ করিতে স্বীকৃত হন নাই; তজ্জন্য সে অঞ্চলে একটা কথা আছে : ‘ম’রলো, তবুও হ’রে শুঁড়ি ঠাকুরবর বলল না’, অর্থাৎ ঠাকুরবরের বশ্যতা স্বীকার করিলেন না।
পাদটীকা :
১. Sen. Ram Sanker, Report on the Agricultural Statistics of Jessore (Jhenidah and Magurah). 1872-3. Appendix. xlii.
২. কেহ কেহ বলেন বিজয়পুরে রাজার আত্মীয় স্বজন থাকিতেন, বাড়ীবাথানেই তাঁহার দুর্গাদি ছিল। বাস্তবিক এই বাড়ীবাথানের সন্নিকটেই তাঁহার অন্যান্য কীৰ্ত্তিচিহ্নগুলি দেখিতে পাওয়া যায়।
৩. আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি যে, বারবাজারের মুসলমানদিগের মুখে কুনিয়া নগরের কথা শুনিয়াছি। গাজী কুনিয়া নগরে মুকুটরায়কে পরাজিত করেন। রায়মঙ্গল পুস্তকে আছে : ‘বড় খাঁ গাজীর সাথে, মহাযুদ্ধ খনিয়াতে’। রামশঙ্কর সেন মহাশয় লিখিয়া গিয়াছেন যে, মুকুট রায়ের রাজধানী খড়িয়া নগরে ছিল,-Sen, Ram Sankar Report, P. xliii.
৪. কেহ কেহ বলেন মুকুট রায়ের জমিদারী পাবনা হইতে সমুদ্র এবং ফরিদপুর হইতে বর্দ্ধমান পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি তৎকালীন দিল্লীর পাঠান বাদশাহের নিকট হইতে পাঞ্জা লাভ করিয়াছিলেন।—‘প্ৰদীপ’, আশ্বিন; গৌড়ের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, ৬১ পৃ।
‘দক্ষিণা নামেতে রায় রাজার গোসাঞি
তার সমতুল বীর ত্রিভুবনে নাই।’
৬. যতক্ষণ একবার ভাঁটা থাকে, অর্থাৎ ৬ ঘণ্টায় যতদূর নৌকাপথে পাওয়া যায় তাহাকে এক ভাঁটি পথ বলে। সুন্দরবনে এইভাবে দূরত্ব পরিমিত হইয়া থাকে। নৌকাপথে ঘণ্টায় ৩/৪ মাইল গেলেও এক ভাঁটায় অন্ততঃ ২০ মাইল পথ অতিক্রম করা যায়। তাহা হইলে আঠার ভাঁটায় অন্ততঃ ৩০০ মাইল যাওয়া যায়, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু সুন্দরবন রাজ্য পূর্ব্বকালে উত্তর দিকে যতদূরই বিস্তৃত থাকুক, তাহা ৮০ মাইলের অধিক প্রশস্ত ছিল না। সুতরাং মহামহোপাধ্যায় মরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বঙ্গীয় সাহিত্যসম্মিলনের অভিভাষণে যাহা বলিয়াছেন তাহার সহিত আমরা একমত হইতে পারি না। তিনি বলিয়াছেন, ‘দক্ষিণ রায় আঠার ভাটির অধিকার পাইলেন অর্থাৎ আঠারটি ভাঁটায় যতদূর যাওয়া যায় ততদূর অধিকার পাইলেন। এবং ‘রায়মঙ্গলে’ও আছে, দক্ষিণ রায়ের আমল আঠার ভাটি। দক্ষিণরায় দেবতা কবি কৃষ্ণরামকে স্বপ্ন দেখাইয়া বলিতেছেন :
‘পাঁচালী প্রবন্ধে কর মঙ্গল আমার–
আঠার ভাটির মধ্যে হইবে প্রচার।’
—সাহিত্যপরিষৎ পত্রিকা, ৩য় ভাগ, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য ৯৭ পৃ
আমাদের মনে হয় যেমন সুন্দরবনে নদীবিশেষের নাম আঠার-বাঁকী অথচ তাহাতে ঠিক আঠারটি বাঁক আছে কি না সন্দেহ, সেইরূপ আঠারটি নদীর গতিপথ দ্বারা সমস্ত সুন্দরবন বুঝাইয়া দেওয়া হইতেছে।
৭. কেহ বলিয়াছেন দক্ষিণরায় ও কালুরায় অভিন্ন ব্যক্তি। Dacca Review. Vol. 3, No. 3, P. 148; Wise’s Notes on Races. PP. 13-14 ‘রায়মঙ্গলে’ কিন্তু অন্যরূপ আছে। দক্ষিণ রায় নিজেই বলিতেছেন যে তিনি কালু রায় কর্তৃক হিজলী প্রেরিত হইয়াছিলেন।—বিশ্বকোষ, ৮ম খণ্ড, ২৮৯ পৃ।
৮. রামশঙ্কর সেন মহাশয় রায় মুকুটের কথা লিখিয়াছেন। চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় ব্রাহ্মনগরের মুকুটরায়ের কতক বিবরণ দিয়াছিলেন। কুশদহ, ৩য় বর্ষ, ৬৬, ১১১ ও ১৩৮ পৃ।
৯. ‘রায়মঙ্গলে’ কিন্তু দক্ষিণ রায়ের স্ত্রীর নাম নীলাবতী বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে।
১০. কুশদহ’, ৩য় বর্ষ, ১১৩ পৃ।
১১. প্রবাদ এই, মুকুট রায়ের পুরী মধ্যে একটি কূপ ছিল, তাহার নাম মৃত্যুজীব কূপ। ঐ কূপের জল ছিটাইয়া দিলে মৃত ব্যক্তি বাঁচিয়া উঠিত। শত্রু কর্তৃক গোমাংস নিক্ষিপ্ত হওয়াতে কূপের সে শক্তি নষ্ট হয়। এখনও লাউজানিতে যশোহর রাস্তার সন্নিকটে এই মৃত্যুজীব ককূ বা জীয়ৎ-কুঁড়ির স্থান প্রদর্শিত হইয়া থাকে। পরম শ্রদ্ধেয় নিখিলনাথ রায় স্বপ্রণীত মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে জঙ্গীপুরের মধ্যে এক স্থানে জীবৎ-কুণ্ড আছে, উল্লেখ করিয়াছেন। সেও হুসেন শাহের আমলের ঘটনা। এক তিওর রাজার সহিত যুদ্ধকালে হুসেন শাহের সৈন্যগণ গোমাংস দ্বারা সেখানেও উক্ত কুণ্ডের শক্তি নষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন। মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, ১ম খণ্ড, ১৮০ পৃ।
১২. কালু বলিতেছেন : ‘কহে তুমি হও ভাই আল্লার ফকির; হিন্দু মোছলমান তুঝে সবে মানে পীর। হেন কথা বল তুমি বড়ই তকছির। জগত মাঝারে কত হৈল পীর আলি, বিধির দোয়াতে বুঝি নাহি ছিল কালী। তাদের অদৃষ্টে নাহি লিখিল এমন। তারা না কান্দিল কেহ নারীর কারণ।’—ইত্যাদি
১৩. বারাসতের সন্নিকটে ঘোলা গ্রামে কাছারীর দক্ষিণ দিকে মাইচাম্পার একটি আস্তানা আছে।
১৪. কেহ বলেন চাম্পা বিবি বোগদাদের খালিফা বংশের অনূঢ়া কন্যা। তিনি ধর্ম্ম প্রচারার্থ এদেশে আসেন। Khulna Gazetteer, P. 182.
১৫. পরবর্ত্তী খণ্ড, মোগল আমল, ২৮শ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন