বিড়ালের চোখ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

পৌলোমী সেনগুপ্ত

বিড়ালের চোখ মানে সত্যি সত্যিই কোনও বিড়ালের চোখ নয়।।

দুটি ‘স্টোন’ বা পাথর, যাকে বলা হয় ‘ক্যাট্‌স আই’ বা বৈদূর্যমণি এবং দেখতে যা অবিকল বিড়ালের চোখের মতোই, এ-কাহিনি তাকেই কেন্দ্র করে।

বাইরে বৃষ্টি নেমেছে এবং বৃষ্টি যে শিগগির থামবে, তার কোনও লক্ষণই নেই। এক জায়গায় একবার যাবার ছিল, কিন্তু আপাতত যে সেটা সম্ভব হবে না, তা বুঝতে পেরেই বিরূপাক্ষ তার বসবার ঘরে তৃতীয় কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে সবে একটা চারমিনার ধরিয়েছে, সিঁড়িতে জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।

এক জোড়া নয়, দুই জোড়া জুতোর শব্দ।

এক জোড়া জুতোর শব্দ বিরূপাক্ষর চেনা, অন্যটি ওর পরিচিত নয়, এবং জুতোর শব্দ থেকেই বিরূপাক্ষ বুঝতে পারে শিশিরের সঙ্গে কেউ আসছে। অন্য জুতোর শব্দটা ভারী নয়, হালকা এবং একটু যেন থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে। মনে হয়, দ্বিতীয় জন শিশিরকেই অনুসরণ করছে।

বিরূপাক্ষ ঘরের দরজার দিকেই তাকিয়ে থাকে। একটু পরেই শিশিরের পিছনে পিছনে থলথলে ভারী চেহারার একজন ভদ্রলোক এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।

ওদের দিকে তাকাল বিরূপাক্ষ। “কী রে শিশির, এই বৃষ্টি মাথায় করে…”

“আলাপ করিয়ে দিই। রামদাস আগরওয়ালা, বিরাট অয়েল মার্চেন্ট, আমার যে-বইটার এখন শুটিং চলছে, তার প্রডিউসার। আর মি, আগরওয়ালা, এই আমার বন্ধু বিরূপাক্ষ সেন। বসুন।” কথাগুলো বলে শিশির একটা সোফায় বসল। আগরওয়ালাও বসল।

বিরূপাক্ষ একটাও কথা বলেনি এতক্ষণ। এবারে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বললে, “কিন্তু কেন এসেছিস এই বৃষ্টি মাথায় করে, তা তো কই বললি না।”

“ওঁর, মানে মিঃ আগরওয়ালার, দুটো অত্যন্ত দামি পাথর চুরি গিয়েছে, সেই ব্যাপারেই, মানে আমিই ওঁকে তোর কাছে নিয়ে এলাম বিরূ—”

“দামি পাথর? কী, হিরা?”

“না। হিরা নয়।”

“তবে?”

“এ পেয়ার অব ক্যাট্‌স আই…দুটো ক্যাট্‌স আই পাথর।”

“বৈদূর্যমণি!”

“কী বললি?”

“না বলছিলাম, ক্যাটস আই পাথরের এমন কী দাম?”

“সো বাত ঠিক বলিয়েসেন সেন সাব।” আগরওয়ালা এতক্ষণে কেমন যেন কর্কশ খ্যানখেনে গলায় প্রথম কথা বললে, “দাম হিরার মতো নয় ঠিকই, কিন্তু ওই পাথর দুটোর দাম আমার কাছে লাখ টাকার চাইতেও বেশি।”

আগরওয়ালার কথা শুনে বিরূপাক্ষ বুঝতে পারে, হারানো ক্যাট্‌স আই দুটো, দামের দিক দিয়ে ভয়ানক একটা কিছু মূল্যবান না হলেও, ওই পাথর দুটির পিছনে কোনও একটা ইতিহাস আছে, যে-কারণে তার মূল্যও অনেক বেশিই ওই মানুষটির কাছে।

বিরূপাক্ষ তার চারমিনারে একটা টান দিয়ে বললে, “ব্যাপারটা যদি খুলে বলেন, মানে ওই যে পাথর দুটোর দামের কথা বললেন- ”

“কাকু—”

একটি বালকের কণ্ঠ শোনা গেল ঠিক ওই সময় দরজার গোড়া থেকে।

বিরূপাক্ষ সঙ্গে সঙ্গে দরজার দিকে তাকিয়ে বললে, “আরে মিতুলবাবু যে, এসো, এসো।”

একমাথা ঝাঁকড়া চুল— বড় বড় দুটি দুষ্টুমি ভরা চোখ, বছর আষ্টেক বয়সের একটি ছেলে এসে ঘরে ঢুকল এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে।

গায়ে একটা কলার তোলা মিকি মাউস আঁকা গেঞ্জি, পরনে একটা হাফ প্যান্ট, পায়ে চপ্পল, হাতে একটা খেলনা পিস্তল। গলায় কারে ঝোলানো একটা বাঁশি।

“দেখি, এ-দিকে এসো তো মিতুলবাবু। নিশ্চয়ই ভিজেছ।” বিরূপাক্ষ সস্নেহে বলল।

মিতুল বললে, “একটু একটু বেশি নয়!”

“এই বৃষ্টির মধ্যে কেন বেরুলে?”

“বাঃ রে, সেই বেড়ালের চোখের গল্পটা যে শেষ করলে না কাল।”

“বেড়ালের চোখ— বোস, বোস, এই ভদ্রলোক একটা সত্যিকারের বেড়ালের চোখের গল্প আমাদের শোনাতে এসেছেন, বসে শোন,” আগরওয়ালাকে দেখিয়ে বিরূপাক্ষ বললে।

আগরওয়ালা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, “নেহি সেন সাব, গপ্পো নয়— সাচ হামার ক্যাট্‌স আই দুটো খোয়া গিয়েছে—”

“হ্যাঁ— হ্যাঁ, সে তো আপনি একটু আগেই বললেন। বলুন তো এবার কী করে আপনার ক্যাট্‌স আই দুটো খোয়া গেল।” বিরূপাক্ষ শুধাল।

“খোয়া গিয়েছে, লেকিন কী করে যে খোয়া গেল সে তো হামিও জানে না সেন সাব।”

“তা কোথায় ছিল ক্যাটস আই পাথর দুটো আপনার?”

“হামার ঘরে আয়রন সেফের মধ্যে একটা চন্দনের বাক্সোর মধ্যে। হামার দাদা মানে গ্র্যান্ডফাদার দৌলতরাম আগরওয়ালা জর্মনি থেকে একটা চমৎকার টয় এনেছিলেন, একটা ঠিক যেন জ্যান্ত বিল্লি, তার দু’চোখে বসানো ছিল আসলি অওর বহুত দামি দুটো ক্যাট্‌স আই পাথর। অন্ধকারে জ্বলত।”

“খেলনার চোখে আসল ক্যাট্‌স আই পাথর? আশ্চর্য তো!”

“তাজ্জব কি বাতই বটে। আসলে ওই দুটো যে আসলি ক্যাট্‌স আই পাথর ছিল, তাও আমার দাদা জানতেন না। একটা খেলনার দোকানে ওই খেলার বিল্লিটা দেখে তাঁর পসন্দ হওয়ায় পঞ্চাশ মার্ক দিয়ে খেলনাটা নিয়ে আসেন কিনে।”

“তারপর?”

“পাথর দুটো যে আসলি পাথর, ক্যাট্‌স আই, তা জানতে পারলেন এদেশে আসার পর। আমি তখন ছোট, বয়স ধরুন সাত-আট হবে। টয়টা এনে দাদা আমাকে দেন। একদিন ওই বিল্লিটা নিয়ে দাদার ঘরে বসে খেলছি, দাদার এক জানা জহুরি মৈনাক সরকার কী ব্যাপারে যেন দাদার কাছে আসেন। তিনিই আমার বিল্লিটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বললেন, দেখি-দেখি বিল্লিটা। হামি অত শত জানি না, দিলাম বিল্লিটা তাঁর হাতে, তিনি পাথর দুটো দেখে বললেন দাদাকে, দৌলতরামজি, এ তো বড় তাজ্জব কি বাত— এ দুটো দেখছি আসল এবং অনেক দামি ক্যাট্‌স আই পাথর।

“দাদা তো তাঁর কথা শুনে অবাক। বললেন, সাচ?

“জি হাঁ— ওই পাথর দুটো বেচবেন?

“কৌতুক করে দৌলতরামজি বললেন, তুমি কিনবে?

“হাঁ, যদি বেচেন।

“তা কত দাম দেবে?

“পাঁচ হাজার—

“বল কী মৈনাক?

“জি- বেচেন তো বলুন—

“তারপর?” বিরূপাক্ষ শুধাল।

“দাদা রাজি হলেন না। এবং ওই ঘটনার মাস পাঁচ-ছয় বাদে দাদা দৌলতরামজিকে কে বা কারা যেন হত্যা করল।”

“সে কী?” বিরূপাক্ষর কষ্ঠে বিস্ময়।

“জি হাঁ। তাকে মৃত অবস্থায় তাঁর শোবার ঘরে পাওয়া যায়, বুকে ছোরা বেঁধানো ছিল। পুলিশ এল, এনকোয়ারি হল, কিন্তু হত্যাকারী ধরা পড়ল না।”

“আর বিল্লিটা—”

“সেটা আমার পিতাজি— ঘনশ্যাম আগরওয়ালা আমার দাদাজির নির্দেশমতো আমার কাছ থেকে নিয়ে সিন্দুকের মধ্যে একটা চন্দন বাক্সে রেখে দিয়েছিলেন। বরাবর সেখানেই সেটা ছিল, পরশু হঠাৎ জানতে পারলাম—”

“কী?”

“বিল্লির দু’ চোখের কোটরে বসানো ক্যাট্‌স আই দুটো আসল ক্যাট্‌স আই নয়— নকল— দুটো ঝুটো পাথর। অথচ দিন পনেরো আগে মাত্র আসল ক্যাট্‌স আই দুটোই বিল্লির চোখে বসানো ছিল দেখেছি—”

“তা আপনি বুঝলেন কী করে যে ও-দুটো ঝুটা— নকল পাথর?”

কথা বললে ওই সময় বিরূপাক্ষের প্রশ্নের জবাবে শিশিরই। বললে, “উনি মানে এই রামদাস আগরওয়ালা অয়েল মার্চেন্ট হলেও জুয়েলস নিয়ে অনেক পড়াশুনা করেছেন, এবং ওঁর নিজস্ব সংগ্রহে অনেক দামি দামি রেয়ার জুয়েলস আছে। এটা ওঁর একটা হবি বিরূ।”

“আচ্ছা। তা—”

“তা ছাড়া জুয়েলস চিনবার ওঁর অসাধারণ ক্ষমতা থাকায়, বহু নামী এবং বড় বড় জুয়েলার অনেক সময় অনেক জুয়েলস নিয়ে সেটা আসল না নকল সেটা যাচাই করতে আসে।”

“আশ্চর্য হবি— বলতেই হবে।” বিরূপাক্ষ বললে।

“ওই দুটো ক্যাট্স আই যেমন করেই হোক সেন সাব… হামার… টাকার জন্য পরোয়া করবেন না— পাথর দুটো হামাকে আপনি খুঁজে দিন—”

বিরূপাক্ষ কোনও কথা বলে না, নিঃশব্দে সে ধূমপান করতে থাকে। চারমিনারের গন্ধ ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বাইরে প্রবল ধারায় বৃষ্টি নেমেছে তখন।

স্তব্ধতা ভঙ্গ করে আবার আগরওয়ালার মিনতিভরা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “সেন সাব, বলুন, কুছু বলুন!” মিতুল ওই সময় হঠাৎ বলে উঠল, “আগরওয়ালা সাহেব, কিছু ভাববেন না আপনি, ও কাকু ঠিক চোরকে ধরে দেবে! যাবে কোথায় চোর?”

বিরূপাক্ষ হেসে ফেলে, “কিন্তু মিতুলবাবু, ব্যাপারটা সত্যিই কঠিন।”

“কিছু কঠিন না কাকু!”

“কঠিন নয় বলছ মিতুলবাবু?”

“না।”

“তা এ কথা তুমি বলছ কেন মিতুলবাবু?”

“বলব, তোমাকে আমি পরে বলব।” গম্ভীরভাবে মিতুল বললে।

“তাই বোলো। আচ্ছা মিঃ আগরওয়ালা…”

“বোলিয়ে সেন সাব!”

“পরশু মানে বিশ তারিখ এ-মাসের— জুলাইয়ের যদি হয় তো আপনি এ-মাসের পাঁচ তারিখে শেষ দেখেছিলেন পাথর দুটো ঠিক আছে? তাই তো?”

“জি হাঁ।”

“আচ্ছা ওই পাঁচ তারিখ ও বিশ তারিখের মধ্যে সিন্দুক আর খোলেননি আপনি?”

“না।”

“আপনার ঠিক স্মরণ আছে তো?”

“হাঁ, ঠিক স্মরণ আছে। ওই সিন্দুক তো আমি বেশি একটা খুলি না, কারণ—”

“কী?”

“টাকা-পয়সা যা-কিছু হামার শোবার ঘরের একটা আয়রন-সেফেই থাকে, তাই দাদাজির ঘরের সিন্দুক আমার খোলবার বড় একটা দরকার হয় না।”

“তবে পাঁচ তারিখেই বা ওই সিন্দুক খুলেছিলেন কেন? তাঁরপর আবার বিশ তারিখেই বা কেন খুলেছিলেন সিন্দুকটা?”

“ওই সিন্দুকটার মধ্যে আমার বহুত সব দামি দামি জুয়েলসগুলো থাকে। পাঁচ তারিখে একজন জানাশোনা জুয়েলার এসেছিল কিছু রেয়ার ক্যাট্স আই পাথর নিয়ে, তখন তাকে রেয়ার দামি ক্যাট্স আই পাথর দেখাবার জন্যই সেফ থেকে বিল্লির চোখ দুটো খুলে আমি নীচে নিয়ে যাই তাঁরই বিশেষ অনুরোধে। তাঁরপর—”

“বলুন— থামলেন কেন?”

“দেখিয়ে এনে পাথর দুটো আবার বিল্লির চোখের কোটরে বসিয়ে দিই।”

“হুঁ। তাঁরপর বিশ তারিখে—”

“একটা রেয়ার দামি রক্তমুখী নীলা পাথর কিনেছিলাম, সেটা সেফে রাখতে এসেই হঠাৎ বিল্লির চোখের দিকে তাকিয়ে আমার কেমন মনটা খট করে ওঠায় পাথর দুটো হাতে নিয়ে এক পলক দেখেই চমকে উঠলাম— হায় রাম— এ তো আসলি ক্যাট্স আই নয়, ওরিজিন্যাল পাথর দুটো নয়, এ যে ঝুটা, নকলি! সেন সাব, হামার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল। আজ দু’দিন দু’রাত ভেবে আমি পাগল হয়ে যাব মনে হচ্ছে! এ কী করে সম্ভব হল? আসলি ক্যাট্স আই পাথর দুটোর বদলে ওই নকলি পাথর দুটো কোথা থেকে কেমন করে এল!”

“মিঃ আগরওয়ালা—”

“বোলিয়ে সেন সাব।” আগরওয়ালার দু’চোখের কোণে জল।

“পাঁচ তারিখে যিনি এসেছিলেন আপনার কাছে—”

“হ্যাঁ, ওই মৈনাক সরকারের ছেলে জুয়েলার লোটন সরকার— এসেছিলেন—”

“কেন এসেছিলেন তিনি?”

“ওদের দোকানে একজন জার্মান সাহেব খরিদ্দার এসেছিলেন দুটো ক্যাট্স আই পাথর কিনতে, কিন্তু লোটন সরকারের স্টকে যে-সব ক্যাট্স আই ছিল সেগুলো সাহেবের পছন্দ হয় না। বলে লোটনকে, সে ঠিক যে-রকম পাথর খুঁজছে সে-রকম পাথর সে ওইগুলোর মধ্যে পাচ্ছে না। ওগুলো নাকি সব ঝুটা পাথর। সে দশ বিশ যা লাগে দিতে রাজি, কিন্তু আসলি মাল চাই। লোটন তখন সাহেবকে বলে, পাথরগুলো কোনওটাই ঝুটা নয়, এবং সেটা সে আমাকে দিয়ে প্রমাণ করিয়ে দেবে, বলে সে আমার পরিচয় দেয় সাহেবকে।”

“তারপর?”

“সাহেব ইন্টারেস্টেড হয়ে ওঠে এবং তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে বলে। আমি যদি ঠিক আছে বলি তবে সে কিনবে। সেই মতো লোটন সরকার সাহেবকে আমার কাছে নিয়ে আসে, আমি লোটনের পাথর থেকে দুটো বাছাই করে দিয়ে বলি, ওই দুটো সাহেব কিনতে পারে—”

“সাহেবের খুঁতখুতুনি কিন্তু তবু যায় না। সেই সময় লোটনই আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে, আপনার কাছে তো সেই পাথর দুটো আছে— দিন-না বেচে—”

“আপনি কী বললেন?”

“বললাম, না। ও পাথর আমি বেচব না লক্ষ টাকার বিনিময়েও।”

“লোটন তখন বলে, সাহেবকে পাথর দুটোর কথা বলব ভাবছিলাম।”

“আমি বললাম, না।”

“তারপর?”

“কিন্তু লোটন সরকার তাঁর কথা রাখেনি, সাহেবকে পাথর দুটোর কথা বলে দিল। সাহেব তখন পাথর দুটো দেখতে চায়।”

“আর আপনি সিন্দুক থেকে এনে পাথর দুটো দেখান?” বললে বিরূপাক্ষ।

“হ্যাঁ।”

“এবং সাহেব কিনতে চায় পাথর দুটো দেখেই, তাই কি?”

“হ্যাঁ।”

“মিঃ আগরওয়ালা, ওই দিনই, আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, আপনার অজ্ঞাতে কোনও এক ফাঁকে আসল ক্যাট্স আই দুটো বদল হয়ে গিয়েছে।”

“সিয়ারাম, কী বলছেন আপনি সেন সাব?”

“তাই। আপনি টেরও পাননি। শুনুন, আপনি এক কাজ করুন…”

“কী?”

“কাল সকালের দিকে লোটন সরকারকে আপনার বাড়িতে আপনি ডেকে পাঠান।”

“ডেকে পাঠাব? কেন?”

“বলবেন, ক্যাট্স আই দুটো আপনি বিক্রি করবেন স্থির করেছেন। এবং বদলে দুটো ক্যাট্স আই আসলি কিনতে চান।”

“কিন্তু—”

“যা বলছি, তাই করুন। আমিও সেখানে উপস্থিত থাকব। অন্য এক জুয়েলারের ছদ্মবেশে।”

ওদের বিদায় দিয়ে বিরূপাক্ষ মিতুলকে বললে, “বেড়ালের চোখের গল্প শুনলে মিতুলবাবু?”

“ও তো সত্যি ঘটনা।” মিতুল বললে, “পাথর দুটো নিশ্চয়ই চুরি করেছে—”

“কে চুরি করেছে বলে তোমার মনে হয়?”

“ওই লোটন সরকার লোকটাই মনে হয়।”

“কেন?”

“জানি না, তবে আমার মনে হয় সে-ই ম্যাজিক করেছে।”

“তুমি ম্যাজিক করতে পারো তাঁর মতো?”

“কী রকম করে করব?”

“আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব— তুমিও কাল সকালে আমার সঙ্গে যাবে।”

“সত্যি!”

“হ্যাঁ, বৃষ্টি এখন ধরেছে, এবার বাড়ি যাও।”

মিতুল চলে যাবার পর জামাটা গায়ে দিয়ে বিরূপাক্ষ বাড়ি থেকে বের হল তাঁর— শিশিরের মতে— মান্ধাতা আমলের ঝরঝরে অস্টিন গাড়িটা নিয়ে।

প্রথমেই গেল জর্মন কনসুলেটে। সেখানকার কনসাল জেনারেলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল।

মিঃ রিবেনট্রপ বিরূপাক্ষকে দেখে বললেন, “গুড মর্নিং মিঃ সেন, কী ব্যাপার, এই বৃষ্টির মধ্যে?”

“আপনি কিছু দিন আগে একজোড়া মূল্যবান হিস্টোরিক ক্যাট্স আইয়ের কথা বলেছিলেন, মনে আছে? আপনাদের দেশের এক ধনীর প্রপার্টি ছিল সে-দুটো। আশ্চর্যজনক ভাবে বছর পঁচিশ আগে খোয়া যায়, অনেক চেষ্টা করেও তাঁর কোনও কিনারা করতে পারা যায়নি এখনও।”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা আপনি জানেন কী করে সে দুটো খোয়া গিয়েছিল?”

“সে এক বিচিত্র এবং রহস্যজনক ব্যাপার মিঃ সেন। ব্যাপারটা ঘটেছিল ঠিক প্রথম মহাযুদ্ধের বছর চারেক পরে। এক খেয়ালি ধনীর জুয়েলস সংগ্রহের বাতিক ছিল। ওই রেয়ার ক্যাট্স আই দুটো তিনি এক পারস্যের জুয়েলারের কাছ থেকে কিনে একটা টয় বেড়ালের চোখে পাথর দুটো বসিয়ে তাঁর সেফে রেখেছিলেন, হঠাৎ একদিন তিনি দেখতে পেলেন—”

“পাথর দুটো চুরি গিয়েছে!”

“হ্যাঁ, কিন্তু কী করে যে বাড়ির মধ্যে থেকে চুরি গেল সেটাও আশ্চর্য! তাঁরা অনেক চেষ্টা করলেন পুলিশ ও ডিটেকটিভ দিয়ে, কিন্তু সে-দুটো আর পাওয়া গেল না, এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এদিকে এত বছর পরে একটা মজার ব্যাপার ঘটেছে মিঃ সেন—”

“মজার ব্যাপার?”

“হ্যাঁ, সেই পরিবারেরই একটি ছেলে হঠাৎ যেন কী করে সংবাদ পায় যে, সে-দুটো ইন্ডিয়াতে আছে, সে এখানে চলে আসে—”

“কবেকার কথা এটা?”

“এই তো মাস দুই হল তিনি এখানে এসেছেন পাথর দুটোর খোঁজে।”

“খোঁজ পেয়েছেন তিনি কিছু?”

“হ্যাঁ, কিন্তু যাঁর কাছে ক্যাট্স আই দুটো ছিল, তিনি বলে দিয়েছেন, পাথর দুটো বিক্রি করবেন না লক্ষ টাকা দিলেও—”

“পাননি তিনি পাথর দুটো তা হলে আজও?”

“না, তবে যে বাঙালি জুয়েলার তাঁকে সেই ভদ্রলোকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি বলেছেন, কিছু দিন অপেক্ষা করতে, যে-ভাবেই হোক ক্যাট্স আই দুটো যাতে পাওয়া যায়, তাঁর ব্যবস্থা তিনি করবেন, ছেলেটি তাই এখনও কলকাতাতেই আছেন।”

“কোন হোটেলে?”

একটা হোটেলের নাম করলেন কনসাল।

ধন্যবাদ জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল বিরূপাক্ষ।

কনসুলেট থেকে বের হয়ে বিরূপাক্ষ হোটেলে গেল।

নিজের ঘরেই ছিলেন জর্মন ভদ্রলোক। কিছুক্ষণ তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে বিরূপাক্ষ এক সময় ঘর থেকে বের হয়ে এল।

বাড়িতে ফিরে আসার ঘণ্টা দুই বাদে রামদাস ফোন করলেন বিরূপাক্ষকে। বললেন, লোটন সরকারকে তিনি ফোন করেছিলেন, কিন্তু লোটন সরকার জানিয়েছে—

“কী?”

“সাহেব নাকি আর কেনার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড নয়, এবং সে চলে গিয়েছে।”

“হুঁ। ঠিক আছে।” বিরূপাক্ষ বললেন, “কাল আপনি ঠিক সকাল সাড়ে এগারোটায় এলিট হোটেলের তিনতলায় ১৪৫ নং ঘরে আসুন—”

“কিন্তু—”

“যা বলছি তাই করবেন, মনে রাখবেন যেন আসতে ভুল না হয়।” বিরূপাক্ষ ফোন রেখে দিল।

পরের দিন সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ বিরূপাক্ষ মিতুলকে নিয়ে হোটেলে এল সেই জর্মন সাহেবের ঘরে। এক প্রৌঢ় মুসলমান জহুরির ছদ্মবেশে। একমুখ দাড়ি, জোব্বা ও পায়জামা পরনে, মাথায় জালি ফেজ, চোখে চশমা। কী করতে হবে, জর্মন সাহেবকে সব বলে বিরূপাক্ষ মিতুলের দিকে তাকিয়ে ডাকল, “মিতুল…”

“কাকু—”

“তুমি ওই জর্মন সাহেবের ঘরে বসে শুধু দেখে যাবে, একটা কথাও বলবে না। বুঝেছ? আর যা বলেছি, তাই করবে।”

“হ্যাঁ।”

ঠিক পূর্ব অ্যাপয়েন্টমেন্ট মতো লোটন সরকার এলেন না, এলেন অন্য-এক ভদ্রলোক। মুখে কাঁচা- পাকা চাপ দাড়ি, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, পরনে দামি সুট।

জর্মন সাহেব বললেন, “আপনি? মিঃ সরকার এলেন না যে?”

ভাঙা ভাঙা গলায় আগন্তুক বললেন, “হ্যাঁ তিনি আসেননি, কারণ আমিই ক্যাট্স আই দুটো বেচব, তিনি নন।”

“আপনি বেচবেন?” জর্মন সাহেব বললেন।

“হ্যাঁ, পাথর দুটো আমার কাছেই আছে। কিন্তু দাম দিতে হবে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ক্যাশ।”

“সে তো কালই মিঃ সরকারকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি রাজি আছি।”

“তবে টাকা বের করুন।”

“কিন্তু পাথর দুটো আমি একটু যাচাই করে নিতে চাই।”

“ভয় নেই, ঠিক পাথরই পাবেন।”

“সেটাই আমি এই জুয়েলারটিকে দিয়ে যাচাই করে নিতে চাই।”

“বেশ, দেখুন।” আগন্তুক জামার বুক-পকেট থেকে পাথর দুটো বের করলেন।

বিরূপাক্ষ পাথর দুটো হাতে নিয়ে পকেট থেকে একটা লেন্স বের করে, ঝুঁকে পড়ে পরীক্ষা করবার জন্য— হঠাৎ ওই সময় একটা বিড়াল ডেকে উঠল— মিঁয়াও।

“আরে, হোটেলের মধ্যে বিল্লি এল কোথা থেকে?”

আবার ,মিঁয়াও।

সামনের ঘর থেকেই আসছে বিড়ালের ডাকটা। সবাই ওই দিকে তাকায়।

সেই মুহূর্তেই বিরূপাক্ষ আসল ক্যাট্স আই দুটোর সঙ্গে নকল দুটো ক্যাট্স আই বদল করে বলে, “এটা তো ঝুটা পাথর।”

“ঝুটা? কী যা-তা বলছেন!” আগন্তুক চিৎকার করে উঠলেন।

ঠিক সেই মুহুর্তে আগরওয়ালা এসে ঘরে ঢুকলেন।

বিরূপাক্ষ বললে, “আসুন আসুন মিঃ আগরওয়াল! আপনার আসল ক্যাট্স আই দুটো পাওয়া গিয়েছে।”

“গিয়েছে পাওয়া?”

“হ্যাঁ, সে দুটো সেদিন এই লোটন সরকার আপনার বাড়িতে হাত-সাফাই করেছিল।” বলে বিরূপাক্ষ এক হেঁচকা টানে আগন্তুকের মুখ থেকে দাড়ি খসিয়ে আনল।

মিতুল খিল খিল করে হেসে ওঠে, তাঁরপরই ডেকে ওঠে— মিঁয়াও।

লোটন সরকার অধোবদন।

“মিঃ সরকার, আপনাদের বনেদি ফ্যামিলির একটা প্রেস্টিজ আছে, তাই আপনাকে এবারে ছেড়ে দিলাম।”

লোটন সরকার মাথা নিচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল নিঃশব্দে যেন চোরের মতোই।

বিরূপাক্ষ পকেট থেকে তখন ক্যাট্স আই দুটো বের করে মিঃ আগরওয়ালার হাতে দিতে দিতে বললে, “মিঃ আগরওয়াল, একটা অনুরোধ করব, যদি সম্ভব হয় এই জর্মন ভদ্রলোককে ক্যাট্স আই দুটো বিক্রি করে দিন। নচেৎ কে জানে আবার হয়তো আপনাকে বিপদে পড়তে হবে ওই চোখ দুটোর জন্য, হয়তো তাতে প্রাণহানিও ঘটতে পারে।”

পথে এসে গাড়ি চালাতে চালাতে পাশে উপবিষ্ট মিতুলের দিকে তাকিয়ে বিরূপাক্ষ বললে, “চমৎকার ‘মিমিক্রি’ হয়েছিল আজ মিতুলবাবু তোমার। লোটন সরকার একা নয়, সবাই আমরা তোমার বিড়ালের ডাক শুনে চমকে উঠেছিলাম, এবং লোকটা ওইভাবে চমকে না উঠলে আমি অত সহজে বোধহয় হাত সাফাই করতে পারতামনা।”

বাঁ হাত দিয়ে মিতুলের পিঠটা চাপড়ে দিল বিরূপাক্ষ।

অক্টোবর ১৯৭৫

অলংকরণ: সুধীর মৈত্র

সকল অধ্যায়

১. ভারত যুদ্ধে পিঁপড়ে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২. বিড়ালের চোখ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ – শিবরাম চক্রবর্তী
৪. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৫. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ‘তেনা-রা’ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. লালটেম – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৯. অশরীরী – লীলা মজুমদার
১০. রাজপুত্তুরের অসুখ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১১. ভূতেরা বড় মিথ্যুক – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১২. রুকু আর সুকু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৩. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
১৪. ম্যাজিশিয়ান – বিমল কর
১৫. ঘণ্টাকর্ণের কান গেল – মনোজ বসু
১৬. খুনি – সমরেশ মজুমদার
১৭. বনকুঠির রহস্য – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৮. একদম রূপকথা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. তারিণীখুড়ো ও ডুমনিগড়ের মানুষখেকো – সত্যজিৎ রায়
২০. অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য – সত্যজিৎ রায়
২১. দেবতার ভর – সুকুমার সেন
২২. মজারুমামা – আশাপূর্ণা দেবী
২৩. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
২৪. গঙ্গারামের কপাল – সত্যজিৎ রায়
২৫. গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুক – সমরেশ বসু
২৬. ভুনিকাকার চৌরশতম্‌ – বিমল কর
২৭. অনুকূল – সত্যজিৎ রায়
২৮. ক্যাপ্টেন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২৯. তুরুপের তাস চুরি – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩০. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩১. রুপোর গাছ – বাণী বসু
৩২. বনঝাউয়ার রহস্য – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৩. জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু
৩৪. একটি লাল লঙ্কা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. টিকটিকি অতীন্দ্রিয় শক্তি ও বেদান্ত বর্ধন -আশাপূর্ণা দেবী
৩৬. নদুস্কোপ – রূপক সাহা
৩৭. আতাপুরের দৈত্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৮. নিখোঁজ চারু – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৯. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪০. কপালের নাম গোপাল – আশাপূর্ণা দেবী
৪১. শিমুলতলার মাধবী লজ – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪২. কানকাটা বাঘ – শৈলেন ঘোষ
৪৩. হিংসুটে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৪. হরিণ-শিকারির বাড়ি – হর্ষ দত্ত
৪৫. অর্জুন হতভম্ব – সমরেশ মজুমদার
৪৬. কেউ কি এসেছিলেন – বিমল কর
৪৭. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৮. মজাদার এক ফুটবল ম্যাচ আর দানাপুরি – বিমল কর
৪৯. চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. বন্ধু – তিলোত্তমা মজুমদার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন