পৌলোমী সেনগুপ্ত
“ধেত্তারি, ভাল লাগছে না।” ফোটন বেজার গলায় বলে উঠল, “আজ আর আসছে না মজারুমামা! ক্যারমবোর্ডটা সাজা বরং। পেটা যাক! তা-ই যাক! কী আর করা!”
ছোটন বোর্ডটা পেতে ঘুঁটি সাজিয়েছে, ফোটন স্ট্রাইকারটাকে মাথায় ঘষে নিয়ে বোর্ড ফাটাবার জন্যে তাক করছে, ব্যস। ফস করে আলোটা নিভে গেল! ঝুপ করে ঘরের মধ্যে নেমে এল গাঢ় অন্ধকার! আর এমনই আশ্চয্যি, ঠিক সেই মোমেন্টেই ঘটল এই অলৌকিক ঘটনাটি! একদম ঝপ করে। দরজায় মজারুমামা!
যে মজারুমামার জন্যে ফোটন ছোটন রিঙ্কি পিঙ্কি সেই কখন থেকে ছটফট করছে। রিঙ্কি তো তখন থেকেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায় চোখ ফেলে। পিঙ্কি একবার করে ছুটে যাচ্ছে আর আবার ঘরে ফিরে এসে হাত-পা ছুঁড়ছে, “আরে বাবা রে বাবা! কী হল মজারুমামার? আসছে না কেন?”
তা এরাও তো সেই কথাই বলে চলেছে মিনিটে মিনিটে, ফোটন আর ছোটন। সত্যি, কী হল মজারুমামার? এত দেরি করছে কেন?
“নাঃ, হোপলেস! কী যেন একখানা মজারুমামাটা!”
‘আচ্ছা হল কী বল তো? কী হতে পারে?”
হতে কত কী-ই পারে অবশ্য! আবার কিছু না হতেও পারে।
“ইশ! কী যে বিচ্ছিরি লাগছে! ছোটমাসি পষ্ট করে বলে গেল বিকেলে, ‘মজারুদা আসছে। আমি বাড়ি নেই বলে যেন কেটে পড়ে না, তোরা একটু জমিয়ে নিয়ে বসিয়ে রাখবি! “
“হু! বিকেল! বিকেল আবার কালকে হবে।”
“মজারুমামাটা এই রকমই। মনে নেই সেবার পিকনিকে যাবার দিন? লাস্ট মোমেন্টে আসতে পারবে না খবর দিয়ে সব গুবলেট করে দিল। ভীষণ অদ্ভুত!”
“এই এ রকম বলিস না! তেমনি আবার পিঙ্কির জন্মদিনে কেউ নেমন্তন্ন না করতেই নিজে থেকে এসে কী মজাটাই না করে গেল, ভাব!”
‘তা সত্যি রে। সেই কোথা থেকে যেন ছৌনাচের এক রাক্ষুসে মুখোশ নিয়ে এসে পরে, সবাইকে ভয় পাইয়ে-হি হি হি! নেমন্তন্ন না করার জন্যে রাগটাগ নেই।”
“হু রে, মনে পড়েছে। বলেছিল ‘পিঙ্কির জন্মদিন আর মনে রাখব না? কী দিনে জন্মেছিল তা বল? স্বয়ং কেষ্টঠাকুরের জন্মদিনে। মা বলল, ‘তোকে কে নেমন্তন্ন করবে বাবা। কখন যে কোথায় থাকিস তা তুইই জানিস! আর কেষ্টঠাকুরই জানে।”
ফোটন আর ছোটনের এই ক্ষোভ দুঃখ অস্থিরতা আর স্মৃতিচারণের মাঝখানে মাঝখানে রিঙ্কি ছুটে ছুটে এসে বলে যাচ্ছে, “ও রে বাবা রে, এত দেরি করছে কেন রে মজারুমামা! আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে! এই দাদা, রাস্তায় গিয়ে দেখনা!”
“রাস্তায় গিয়ে?”
ফোটন বলেছে, “তুই তো বারান্দা থেকে ঝুঁকে গলাটাকে প্রায় রাস্তায় ঠেকিয়েই দাঁড়িয়ে আছিস! আর কী দেখব?”
পিঙ্কি ডুকরে উঠছে মাঝে মাঝে, “ছোটমাসি যে কেন বলল, মজারুমামা আসবে! এত দেরি হয়ে গেল, আর এসেছে। ধেত্তারিকা!”
তা সত্যি, এদের এই আশাভঙ্গটি বড়ই দুঃখজনক!
মজারুমামা মানেই তো ভয়ংকর ভয়ংকর উৎকট উৎকট সব মজা।… মজারুমামা মানেই জমজমাটি মজলিশ, মিনিটে মিনিটে হাসির হুল্লোড়। …মজারুমামা মানেই গায়ে কাঁটা-দেওয়া ভৌতিক, আধাভৌতিক, দৈবিক, দুঃসাহসিক, অদ্ভুতুড়ে সব নতুন নতুন গল্প!… তা ছাড়া কখন কোন স্টাইলে যে হঠাৎ হঠাৎ একখানি মজা প্রেজেন্ট করবে মজারুমামা, তা বোধহয় মজারুমামারও অজানা!
ছোটকা তো বলে, “তোদের মজারুমামার কাছাকাছি এলে, পকেটে একটা উঁচু সুতো মজুত রাখা উচিত। কে জানে বাবা কখন না হাসতে হাসতে পেটটা ফেটে যায়!”
‘মনোজ’কে ‘মজারু করে ফেলা ওই ছোটকারই অবদান!
কিন্তু কতদিন যে আসেনি মজারুমামা!
আজ যখন বেরোবার সময় ছোটমাসি বলল, “এই, আজ বিকেলে মজারুদা আসবে, তোরা একটু বসিয়ে রাখিস, যেন পালায় না” শুনে তখন এরা, মানে ফোটন ছোটন রিঙ্কি পিঙ্কি আহ্লাদে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল।
“আঁ! মজারুমামা?”
“সত্যি?”
“ঠিক?”
“একদম ঠিক। ওখানে থাকতে চিঠিতে জানিয়ে রেখেছে আমায়! উঃ, কতদিন দেখা হয়নি!”।
রিঙ্কি অবশ্য একবার বলে ফেলেছিল, “তো তোমার সঙ্গেই দেখা করতে আসছে মজারুমামা, তুমি চলে যাচ্ছ? একদিন না হয় সিনেমাটা বাদ দিতে ছোটমাসি!”
শুনে দুঃখে ভেঙে পড়েছিল ছোটমাসি। বলেছিল, “সিনেমাটা বাদ? কোন প্রাণে বলতে পারলি রে এ কথা? দশ দিনের তো মেয়াদ, তার চার-চারটে দিন কেটেই গেল। একদিনই মাত্র দুটো হল-এ সিনেমা দেখেছি, আর ক’দিন তো মাত্র একটা করে। তবেই বল আর ক’টাই বা দেখে উঠতে পারব? কোথায় পড়ে থাকি জানিস? বাংলা সিনেমার মুখ দেখতে পাই? এসেই তো পড়ব বাবা। রাত্তিরে তো খাবে এখানে মজারুদা, তখন আড্ডা হবে।”
চলে গিয়েছিল ছোটমাসি ফোটন কোম্পানির মাকে কব্জা করে নিয়ে। দুটো হল-এ টিকিট কাটা আছে। তিনটে-ছ’টা, ছ’টা-ন’টা!
ছোটমাসি চলে যাবার পর, ছোটন অবশ্য রিঙ্কিকে বকেছিল, “বোকার মতো ও কথা বলতে গেলি কেন রে? বড়রা না থাকলেই তো আমাদের লাভ। মজারুমামাকে বেশি করে পেয়ে যাব! ওনারা এলে, আর আমরা পাত্তা পাব?”
রিঙ্কি স্বীকার করেছিল, সত্যিই তার ভুল হয়ে গিয়েছিল। আর তার পর থেকেই ‘লাভের আশায় ছটফটাচ্ছে একগণ্ডা ভাইবোন। মিনিট গুনছে, আর মিনিটে মিনিটে বলছে, ‘দুর ছাই, কী যে করছে মজারুমামা? …বিকেল ছেড়ে সন্ধে পার হয়ে গেল!
“নাঃ। নো হোপ। আজ আর চান্স নেই!”
“আমাদের কপালটাই খারাপ!”।
শেষমেশ রাগে দুঃখে ঘোষণা: “ধেত্তেরি, ভাল লাগছে না, ক্যারমটা পাড়া হোক। পেটা যাক!”
সেই ক্যারমে খুঁটিগুলি সাজানো হয়েছে মাত্তর, সঙ্গে সঙ্গে নোডশেডিং। আর সেই মুহূর্তে ঘরের দরজায় মজারুমামার আবির্ভাব!
একসঙ্গে চারটে গলা চেঁচিয়ে উঠল, “উঃ মজারুমামা? এতক্ষণে আসা হল? এই তোমার বিকেল? …ছোটমাসিরা সিনেমা গেছে, ভাবছিলাম আমরা একা একা তোমার গল্প শুনব। …ইশ! তুমি এলে, আর এক্ষুনি আলোটা নিভে গেল।.. এত দেরি করলে কেন?”
এতগুলো প্রশ্ন আর অভিযোগের উত্তরে একটি মাত্রই শব্দ উঠল, নাকি-নাকি সুরে, “হাঁউ মাউ খাঁউ! মনিষ্যির গন্ধ পাঁউ!”
কিন্তু ভয় পেতে বয়ে গেছে এদের। ছোট দুটোরও নয়। পিঙ্কিসুদ্ধু বলে ওঠে, “ও মজারুমামা, আমরা বুঝি এখনও আগের মতন ছোট আছি যে হাঁউমাউখাঁউ শুনে ভয় পাব? সে বারের মতো মুখোশ পরে এলেও এখন আর ভয় পাব না। এই ছোড়দা, একটা টর্চ জ্বাল না।”
ছোটন বলল, “টর্চ তো মা’র ঘরে। কে যাবে বাবা? মজারুমামা, তোমার লাইটারটা জ্বালোনা একটু।”
আবার নাকিসুর, “আমার বয়ে গেছে।”
“মজারুমামা, যতই তুমি নাকি সুর করো, আমরা ভয় পাচ্ছি না। জ্বালো না বাবা লাইটারটা। ও মজারুমামা, অন্ধকারে বিচ্ছিরি লাগছে; তোমায় দেখতে পাচ্ছি না।”
হঠাৎ নাকি সুরের বদলে ‘পাকি’ গলা: “কী। ফ্যাচফ্যাচ করছিস, আঁ! মজারুমামা আবার কী? মজারুমামা! সাত জন্মে এমন কিম্ভূত নাম শুনিনি। কস্মিনকালেও তোদের ওই সব মজারু শজারুকে চিনি না আমি।”
কিন্তু রিঙ্কি হল গিয়ে দুর্দান্ত মেয়ে, সে ওসব ধমক-টমকে ঘাবড়ায় না। সে হেসে ওঠে, ‘হি হি হি মজারু শজারু। সাত জন্মেও শোনেনি এমন নাম। তবে তোমার নাম কী শুনি?”
“আমার নামে তোদের কী কাজ, আঁ?”
“আহা! তোমায় তবে কী বলে ডাকব শুনি?”
ছায়ামূর্তি বলে, “আমায় ডাকবারই বা কী দরকার? আঁ!”
‘বা রে, না ডাকলে কী করে গল্প করব। মজারুমামা?”
“খবরদার, ওইসব মজারু-গজারু বলবি না, আমার নাম হচ্ছে, গোকুল গড়াই।”
“কী? কী নাম তোমার? হি হি হি! আবার বলোনা।”
“বললাম তো! আমার নাম হচ্ছে গোকুল গড়াই। তবে পাড়ার লোক আড়ালে বলে চোর-গোকলো। বলুক গে। আড়ালে লোকে কিনা বলে।”
“চোর গোকলো! হি হি হি! ছোড়দা রে, এবারে মজারুমামার কী মার্ভেলাস স্টান্ট। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, একবার নাকি তুমি ‘বকরাক্ষস হয়েছিলে মজারুমামা? মা বলে না ছোড়দা? যতই খাবার দেন সব সাবাড়। আর একবার হোয়োনা মজারুমামা। আমি বেশ দেখব।”
“বটে!” মজারুমামা বলে, “বকরাক্ষস দেখার সাধ? তা দেখিস। সব সাবড়ে দেব! এখন সর, আমায় আমার কাজ করতে দে!”।
“কাজ! তোমার আবার কাজ কী মজারুমামা?”
“এই মেয়েটা তো আচ্ছা ফ্যাচফ্যাচানি। চোরের আবার কী কাজ চুরি করা ছাড়া?”
ছোটন হেসে বলে ওঠে, “তা আলোটা জ্বলুক মজারুমামা। অন্ধকারে তো কিছু দেখতেই পাবে না। কোথাও একটা দেশলাইও খুঁজে পাচ্ছি না। মা না এমন! দেশলাই মোমবাতি টেবিলে রেখে দেবে তো? আমরা ক’জন ছোট একা রয়েছি।”
“হ্যাঁ, তাই তো!”
পিঙ্কি পিনপিনিয়ে বলে, “নিজেরা বেশ মজা করে রোজ রোজ সিনেমা দেখতে যাওয়া হবে, আর আমরা একা পড়ে থাকব। আবার লোডশেডিং পাজিটাও এসে হাজির হবে। ও মজারুমামা, একবারটি তোমার লাইটারটাই জ্বালোনা গো। তোমায় দেখি!”
‘লাইটারফাইটার নেই আমার।”
এবারে ফোটন হেসে ওঠে, “তুমি আছ আর তোমার লাইটার নেই, এ হয় মজারুমামা?… তা, তোমায় দরজা খুলে দিল কে?”
হেঁড়ে গলায় মজারুর উত্তর, “আমায় আবার দরজা খুলে দিতে লাগে নাকি? জন্মে কক্ষনও কেউ আমায় দরজা খুলে দেয়নি, দেয় না, দেবেও না। দরকারটা কী? ছাতের রেনওয়াটার পাইপগুলো তবে আছে কী করতে?”
“হো-হো-হো, হা-হা-হা, এমন মজার কথা বলো তুমি। আর কত রকম যে গলা করতে পারো। দুর ছাই; লোডশেডিংটা আর সময় পেল না। সেই কখন থেকে হাঁ করে বসে আছি তুমি আসবে-আসবে করে। মিনিট গুনছি। কেবল কেবল রাস্তা দেখছি। আর তুমি…”
“আহা রে, আজ আমার কী ভাগ্য! সাত জন্মে কেউ কক্ষনও আমার আসার আশায় পথ চেয়ে বসে থাকে না রে। তুই একটু জল খাওয়াতে পারিস?”
এখন গলার স্বর একটু কম বিকট।
“জল? এ মা, শুধু জল? ফ্রিজে কত কী রয়েছে। এই বিচ্ছিরি অন্ধকারটা হয়েই তো যত জ্বালা। সুশীল! এই সুশীল!”
মজারু বলে ওঠে, “এই, চোপ, চেঁচাবি না। রাখ তোর সুশীল। আমি নিজেই নিচ্ছি। ওই তো দালানের কোণে তোদের সাধের ফ্রিজ!”
“তা তো তুমি জানোই। কিন্তু ভীষণ অন্ধকার যে মজারুমামা!”
‘নিকুচি করেছে তোদের অন্ধকারের। অন্ধকারেই আমার চোখে মানিক জ্বলে।”
দরজার কাছের ছায়াটা নড়ল। অতঃপর এক ঝাপটে ফস করে ছায়াটা সরে গেল।
ফোটন চেঁচিয়ে উঠল, “ও মজারুমামা, দাঁড়াও, একটা টর্চ পেয়েছি”।
“অ্যাই খবরদার! টর্চ-ফর্চ জ্বালবি না।”
কিন্তু জ্বালবেই বা কী! এ তো সেই ব্যাটারি-ফুরনো টর্চটা। বাবা কাল বলেছিলেন, ফোটন, তোর বয়েসে আমি কত কাজ করেছি। আর তুই এইটুকুও পারিস না? বললাম না কাল, টর্চটায় একটু ব্যাটারি ভরে রাখ।
বলেছিলেন। যেমন সর্বদাই কত কী বলেন।
রাখেনি ফোটন। তাই জ্বলল না টর্চ। ও দিকে মজারুমামার বারণও। না জ্বলেছে এক রকম ভালই। জ্বললে মজারুমামা রাগ করে চলেই যাবে কি না কে জানে।
রিঙ্কি দরজা থেকে চেঁচায়, “ফ্রিজ খুলতে পেরেছ মজারুমামা?”
“ফ্রিজ। হা-হা-হা। ফ্রিজ খুলতে পারব না? বলে গডরেজের লকার খুলে খুলে হাত পাকা। খুলেছি, বেশ ভাল-ভাল সব খাবারদাবার সাঁটছি টপাটপ বকরাক্ষসের মতো।”
হি-হি-হি৷ রিঙ্কি হাসে, “মালাই চমচম তো? ভীম নাগের তস্য পৌত্রের জলভরা কড়াপাক?… ছোটমাসির তৈরি ডিমের পাটিসাপটা, আর মা’র তৈরি কাশ্মীরি গোকুলপিঠে? সবই বোধহয় তোমার জন্যেই ছিল মজারুমামা। তোমার যখন আসার কথা! …আহা অন্ধকারে খেতে পেরেছ কিছু?”
দালান থেকে হাসির আওয়াজ, “কিছু কী রে? এমন সব ভালমন্দ খাবার, কেউ কিছু খেয়ে ছেড়ে দেয়? সব সাঁটছি। …আঃ! তার সঙ্গে বোতলের এই ঠান্ডা জল! অমৃত! যাক, এ বার আমায় আমার কাজ করতে দে!”
ছায়াটা আবার ঘরে ঢুকে এল।
“মজারুমামা, অত সরে সরে যাচ্ছ কেন? ছুঁতে পারছি না, ধরতে পারছি না, কাছে এসোনা!”
পিঙ্কি প্রায় কাঁদো কাঁদো।
কিন্তু তার মজারুমামার মামাত্ব’ কই?
সে তো প্রায় ধমকে ওঠে, “ধরবি? ধরবি মানে কী? আজ পর্যন্ত কেউ আমায় ধরতে পেরেছে? তায় তুই ধরবি? সর। সব ক’টা এই দেয়াল সেঁটে দাঁড়িয়ে থাক। আমাকে একটু নিশ্চিন্দি হয়ে কাজ করতে দে। চটপট সারতে হবে, নাকি তোদের সঙ্গে বাকতালা করব?”
ফোটন এখন জোর গলায় বলে, “এবার তুমি বড্ড বেশি মজা করছ মজারুমামা! ভাল্লাগছে না! কী সব উলটো-পালটা কথা বলছ। জানি না বাবা। অন্ধকার দেখে খুব ঠকাতে ইচ্ছে করছে আমাদের, কেমন? কেবল বলা হচ্ছে কাজ করতে দে। কাজ আবার কী তোমার শুনি?”
“শুনবি? হে-হে-হে! কাজ হচ্ছে ঘর সাফ করা।”
রিঙ্কি ঝংকার দিয়ে ওঠে, “এ মা, তুমি আবার ঘর সাফ করবে কী? কেন, সুশীলদা কি, হি-হি-হি, বনবাসে গেছে?”
পিঙ্কি বলে ওঠে, বিকেলে তো সাফ করেছে সুশীলদা ন্যাতা নিয়ে বালতি নিয়ে।”
“সুশীল? সুশীলের সাফ করার কথা বাদ দে।”
বিজ্ঞের মতো বলে ছোটন, “ছোটমাসি তো বলে তোদের সুশীলবাবু ঘর সাফ করে যায়, বোঝাও যায় না , করেছে কি করেনি। পায়ে খুব ধুলোবালি কিচকিচ করছে বুঝি মজারুমামা?”
“ফের মজারু-শজারু? বলেছি না ওইসব বিটকেল নামে ডাকবি না আমায়।”
“বেশ বাবা, ডাকব না। তো, বাবার হাওয়াই চটিটা এনে দেব তোমায়? অন্ধকারেও খুঁজে পেতে পারি। দরজার কাছেই আছে।”
‘হাওয়াই চটি! ধ্যেত! দরকার নেই তোর বাবার চটিতে। তো, বাবা কোথায়?”
“বাবা তো অফিস থেকে বেরিয়ে সিনেমা হলে এসে জুটবে মা-ছোটমাসিদের কাছে। দুটো সিনেমা দেখছে তো? তিনটে-ছটা, ছ’টা-ন’টা। তা, শেষেরটায় বাবাকে যেতে হবে। নইলে অত রাত্তিরে ছোটমাসিরা প্রাচী থেকে এই যাদবপুরে ফিরবে কী করে?”
“হেঁহেঁহেঁ! ভালই তো। হেঁহেঁহেঁ!” অন্ধকারের মধ্যে নড়েচড়ে বেড়াতে-বেড়াতে মজারু কেমন একটা বিটকেল গলায় হেসে ওঠে।
“মজারুমামা! তুমি অমন বিচ্ছিরি গলায় হাসছ কেন?”… ছোটন সন্দেহ সন্দেহ গলায় বলে, “এবার বুঝি হরবোলা শিখে এসেছ।”
“কী? কী বললি? কী শিখে এসেছি?”
“হরবোলা গো, না হলে এত রকম গলা করছ কী করে? কত রকমই যে গলা শুনছি। শুধু তোমার মতনটা বাদে! বুঝেছি, সেবারে বহুরূপী হতে শিখে এসেছিলে, এবার হরবোলা!”
‘অ্যাই! কী বাজে বাজে কথা বলছিস?”
“আহা রে! বাজে বাজে বইকী!”
ছোটন বলে, “ছোটকার বিয়ের সময় এসে বহুরূপী হওনি তুমি? বাবা! ইয়া মোটকা এক ল্যাজওয়ালা বীর হনুমান সেজে নতুন করে কনের ঘরের মধ্যে ধুপ করে লাফিয়ে পড়ে কী কাণ্ড, কী কাণ্ড! পিঙ্কিদের হয়তো মনে নেই।”
কিন্তু রিঙ্কি সতেজে বলে, “আমার খুব মনে আছে! নতুন কাকি লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে আঁআঁ করছে… বড়পিসি নতুন বউয়ের চেঁচানো শুনে বকতে এসে নিজেই হাঁক-পাঁক করতে করতে দে-ছুট। মনে নেই আবার। তোমার মনে পড়ছে না মজারুমামা?”
“হাঁ! বোধহয় পড়ছে।”
“এ মা! মনে পড়ার আবার বোধহয় কী? এমন উৎকট মজার কথা বলো তুমি! তো তোমার সেই বহুরূপী সাজবার সব ছালচামড়া গোঁফ-দাড়ি ল্যাজ-ফ্যাজ কিছু আনোনি তো?”
“কী? ছালচামড়া, ল্যাজ-গোঁফ? ভাগ।”
“আহা, ছোটমাসি বেশ দেখত!”
এখন ছায়ামূর্তির গলা থেকে ঠিক ভোম্বলজ্যাঠার মতো গম্ভীর স্বর বেরোল, “এক জায়গায় একই খেলা দেখায় বোকারা, বুঝলি?”
“বাঃ, ছোটমাসি তো দেখেনি।”
“তোদের ছোটমাসি আরও অনেক খেলা দেখবে।
“বাবাঃ! মজারুমামা, তোমার গলাটা ঠিক ভোম্বলজ্যাঠার মতো লাগল। এবারে এই হরবোলাটাই শিখে এসেছ, তাই না? কী কী ডাক ডাকতে পারো?” রিঙ্কির গলায় আগ্রহ, উত্তেজনা। “মুরগির ডাক ডাকতে পারো? ঘোড়ার ডাক? কুকুরের কান্না? রেলগাড়ির ইঞ্জিনের ডাক? মিনিবাসের হর্নের ডাক? আমাদের স্কুলে প্রাইজের দিনে না, একজন হরবোলাবাবু এসে— মজারুমামা!”
হঠাৎ থেমে যায় রিঙ্কি। বলে ওঠে, “তুমি আলমারি খুলছ? কেন গো?”
“খুলছি, ভাল করে সাফ করে বন্ধ করে দেব বলে। আহা এ বাড়ির গিন্নি কী গুড গার্ল।”
মজারুর গলার স্বর এখন ভোম্বলজ্যাঠার মতো নয়, বরং ছোটকার মতো, মজা মজা হাসি-হাসি। “আহা! জগতে যে চুরিটুরি বলে একটা কথা আছে জানেনই না, চোর বলে একটা জিনিস আছে তাও না। বেশ বেশ!”
‘হাঁ, বেশ বইকী! দেখেছিস দাদা, ছোড়দা, মা’র নিজের বেলায় দোষ হয় না, যত দোষ নন্দ ঘোষ আমাদের বেলায়। আমরা যদি পেনটা কি স্কেলটা, কি মাইনের বইটা একটু এখানে-সেখানে ফেলে রাখি কী বকুনি! কী বকুনি। …ঠিক আছে মজারুমামা, তোমায় আর বন্ধ করতে হবে না, যেমন ঝুলছে ঝুলুক। এসে নিজের কীর্তিটা দেখুন।”
“তা দেখুন।” মজারুকণ্ঠ বলে ওঠে, “তবে ভেতরটা সাফ করে ফেলি।”
“অন্ধকারে আবার তুমি কী সাফ করবে। মজারুমামা! যা হ্যান্ডুল-মান্ডুল হয়ে আছে। হবে না? বলে ছোটমাসির মার্কেটিং! যখন ইচ্ছে, আর যত ইচ্ছে শাড়ি কিনে আনছে, আর আলমারিতে ঠুসছে। ছোটমাসিদের ওখানে নাকি বাংলা সিনেমাও নেই, বাংলা শাড়িও নেই। তাই কলকাতার সব শাড়িগুলো কিনে নিয়ে যাবার তাল। আচ্ছা, নিয়ে যাবে কী করে বল তো?”
“সেই তো!” মজারু বলে ওঠে, “সেটাই তো সমস্যা। ঢাউস একটা সুটকেস তো এনেছে মনে হচ্ছে, তা সেটাও তো বোঝাই! কীসে কী নিয়ে যাওয়া যাবে।”
“ও মা! ছোটমাসি যে একটা ঢাউস সুটকেস এনেছে, তুমি জানলে কী করে? সে তো ও-ঘরে।”
“কী করে জানলাম? হে-হে-হে, জানিস না অন্ধকারে আমার চোখে মানিক জ্বলে, আর হাত না দেখেও আমি গুনে বলতে পারি। সুটকেসটা চাকা লাগানো তো? ভারী খাসা জিনিস। যত ভারীই হোক গড়গড়িয়ে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।”
“ঠিক, ঠিক। কী দারুণ! ও মজারুমামা, তা হলে হাত গুনে বলে দাও না গো আমার রেজাল্টটা কী হবে!”
“দুর বাবা! এ তো আচ্ছা মেয়ে! যেমন একজামিন দিয়েছিস, তেমনই রেজাল্ট হবে। আবার কী?”
“অ, আ, আঁ! ও ছোড়দা দ্যাখ-না—”।
রিঙ্কির গলা আকাশে ওঠে, “মজারুমামা আমায় রাগাচ্ছে। আমি বুঝি খারাপ পরীক্ষা দিয়েছি?”
‘অন্ধকারে তির-ছোঁড়াছুঁড়ি।”
“অ্যাই! চোপ! আমি বলেছি খারাপ দিয়েছিস? বলেছি, যেমন দিয়েছিস! আমি বেটা চোর-গোকলো ওসব রেজাল্ট-ফেজাল্টের কী বুঝি?”
“চোর-গোকলো!” ছোটন বলে ওঠে, “ওঃ মার্ভেলাস! দারুণ একখানা নাম আবিষ্কার করেছ। বটে মজারুমামা! মাথায় এলও তো!”
ফোটন এতক্ষণ বিশেষ কথা বলছিল না। কেবল অন্ধকারেই এখানে-সেখানে, তাকে, জানলার ধারে, বইয়ের শেলফে হাতড়ে বেড়াচ্ছিল একটা দেশলাই আর মোমবাতির টুকরোফুকরো পায় কি না। কত সময়ই যে এ রকম পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু দরকারের সময়? নেভার! এখন হতাশ গলায় বলল, “এই, মজারুমামা অন্ধকারেও গল্প বলতে পারে। তাই না মজারুমামা?”
“হু! বলব। অপারেশানটা শেষ হোক! তারপর।”
“অপারেশন কী? আঁ! ও মামা! হঠাৎ অপারেশনের কথা কেন? কীসের অপারেশন? কার অপারেশন?”
“কেন, কীসের, কার? সেটা পরে বুঝবি!”
“জানি না বাবা! ও সব বুঝতে-টুঝতে চাই না। আমরা তোমায় ধরছি রোসো।”
কলকলিয়ে ওঠে সব ক’টা। বলে, “এই শোন, মজারুমামা আলমারির কাছে, আয় সবাই মিলে ধরে ফেলি!”
“এই যে এটা কার হাত! মজারুমামা তুমি শার্ট পরেছ না পাঞ্জাবি? এই যে ..এই যে…ধরেছি!”
“অ্যাই! অ্যাই! ফোঁড়া! ফোঁড়া!”
“ ফোঁ-ড়া!”
সব কটা হাত নিজের নিজের দু’পাশে ঝুলে পড়ল।
মজারু নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে বলে, “সর্বাঙ্গে ফোঁড়া। বুঝলে হে ভাগ্নে-ভাগ্নিরা! চেপে ধরলেই রক্ত-ফক্ত। দ্যাখো, কারুর হাতে-টাতে লেগে গেল কি না।”
ততক্ষণে চার-দু’গুনে আটখানা পা পিছু হাঁটতে হাঁটতে একেবারে ও দিকের দেয়ালে সেঁটে গেছে। আর দেখছে হাত ভিজে ভিজে কি না।
তবু কথা কয়ে উঠল ছোটন, “ওঃ, তাই তুমি অপারেশনের কথা বলছিলে?”
“হেঁহেঁ, ঠিক বুঝেছিস তো! যাক এবার তা হলে—”
এই সময় পিঙ্কি হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল, “আলো কি আজ আসবে না? মা কি আজ আসবে না?”
ফোটন বলে উঠল, “ধ্যেত, কাঁদছিস কেন?”
“আমার ভয় করছে। আমার কান্না পাচ্ছে। আমার মজারুমামাকে ভূত মনে হচ্ছে!”
“কী বললি? বাঃ, ঠিকই বলেছিস। এ ব্যাটা তো একটা ভূতই! গোর্ভূত। হাম্বা-হাম্বা খাম্বা-খাম্বা, হাউ-মাউ-খাউ!”
“আঁ আঁ আঁ।” পিঙ্কি কেঁদে ওঠে।
অন্ধকার ভেদ করে আবার সেই বিকট গলা, “অ্যাই, চোপ! এক চড়ে কান্নাকে বিন্দাবনে পাঠিয়ে দেব। মেয়ে না তো, সানাইবাঁশি! ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। দেখি কোথায় কী—”
ভয় খেয়ে পিঙ্কি কান্নাটা গিলে ফেলে। আর বাকি তিনজন হা-হা করে ওঠে, “ও মজারুমামা, না না, যেয়ো না গো, ছোটমাসি তা হলে আমাদের বড় ঘেন্না দেবে। বলবে, এইটুকু আর বসিয়ে রাখতে পারলি না? বলে গেলাম। মজারুমামা, তোমার পায়ে পড়ি!”
“ফের! ফের মজারু? ঠ্যাং ধরে আছাড় মারব এক-একটাকে! বলছি আমি হচ্ছি চোর-গোকলো, কোনও জন্মে কারুর মামা-ফামা নই।”
হঠাৎ সবাই চুপ করে যায়।
অন্ধকারের মধ্যে নেমে আসে একটা স্তব্ধতা।
আর একটু পরেই সেই অন্ধকার ভেদ করে বেশ দিলখোলা এক হা হা হাসি ওঠে।
“খুব ভয় পেয়ে গেছিস তো? নাঃ, তোরা বাবা খুব চালাক ছেলেমেয়ে, কিছুতেই ঠকানো গেল না। পরীক্ষায় ফার্স্ট তো! তা বোস, অন্ধকারে বসে গল্পই শোন একটা। তোদের ছোটমাসি তত সেই ছ’টা-ন’টা!”
ভারী মোলায়েম গলা এখন মজারুর।
ওঃ। বুকের পাহাড় নামল!
এতক্ষণ ধরে তবে এদের বুদ্ধির পরীক্ষা চলছিল। মজারুমামা যত পারে ঠকাবার চেষ্টা করছিল! “হু বাবা, আমাদের আর ঠকাতে হয় না।”
অতএব সমস্বরে “হা হা, গল্প গল্প। ততক্ষণে মা-ছোটমাসিরা এসে যাবে।”
“বেশ, কীসের গল্প শুনবি!”
“ভূতের, ভূতের!” ফোটন আর ছোটন বলে ওঠে।
কিন্তু পিঙ্কি আবার পুরনো রেকর্ড চাপায়। “না, নাআঁ। আমার ভয় করছে।”
“ধ্যেত, একটা ভিতুর ডিম।” রিঙ্কি বলে ওঠে, “ওটাকে নিয়ে পারা যায় না।”
“তা হলে? রাজা-রানির?”
“এ মা, রাজা-রানির কী? আমরা কি বাচ্চা?”
“তা হলে? চোরের?”
“হ্যাঁ-হ্যাঁ, চোরের, চোরের! কী রে পিঙ্কিখুকি, চোরের গল্পেও ভয় পাবি না তো?”
পিঙ্কি চোখ মুছে বলে, “না!”
“তবে শোন। এক গ্রামে এক চোর বাস করত। ভারী ভদ্দরসজ্জন লোক! ওই চুরিটি ছাড়া আর কোনও দোষ ছিল না তার।”
‘আহা, চোর আবার ভদ্দরসজ্জন কী গো?”
“কেন? হতে নেই? চুরিটা তার সাতপুরুষের পেশা। বাপ-ঠাকুরদার কাছে আর-কোনও বিদ্যে শেখেইনি। তা ভদ্দরসজ্জন হতে বাধা কী? তা যা করত নিয়মকানুন মেনেই। রাত বারোটা বাজলেই সিদকাঠিটি নিয়ে বেরিয়ে পড়া, আর ঠিক রাত চারটের মধ্যেই কাজকর্ম সেরে, ফিরে এসে পাতা-বিছানায় শুয়ে পড়া।
“চৌকিদারদের ডিউটির টাইম হচ্ছে রাত পৌনে বারোটা, আর ভোর সাড়ে চারটে।
“পৌনে বারোটায় চৌকিদার জানলার বাইরে হাঁক পাড়ত: ‘গণেশ দাস হো!’
“চোরমশাই সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিত, “আছি আজ্ঞে। তামাক খাচ্ছি।”
তামাক খাচ্ছিস তো ধোঁয়া কই?”
“চোরমশাই মুখে কালিঝুলির আঁক কাটতে কাটতে বলত, “আজ্ঞে টিকে ভিজে গেছে।
“ঠিক হ্যায়! ঘুমো ব্যাটা!
“আবার চৌকিদারটা ভোর সাড়ে চারটের সময় এসে বাইরে থেকে হাঁক পাড়ত, ‘গণেশ দাস হ্যায়!
“গণেশ দাস তেল-ন্যাকড়া দিয়ে মুখের কালিঝুলি মুছতে মুছতে বলত, “আজ্ঞে আছি বইকী। বিড়ি খাচ্ছি।
‘কেন? কেন? এত রাত্তিরে বিড়ি খাচ্ছিস কেন?’
“আজ্ঞে জেগে থাকতে!
“চৌকিদার বলত, “কেন? জেগে থাকার কী দরকার?’
এই আপনার ডাকে সাড়া দিতে। সাড়া না পেলেই তো কাল সকালে এসে চালান দিবেন।
হা-হা-হা! তা দিব। তবে দে, দুটা বিড়ি দে।’
“জানলা দিয়ে হাত বাড়াত।
“কিন্তু এত সাবধানেও কপালের ফেরে একদিন দুপুররাতে সিদকাঠি হাতে ধরা পড়ল গণেশ দাস। বাস, দশ বছর জেল।”
“দশ বছর!”
“ওই তো মজা, তল্লাটের যেখানে যত চুরির কাণ্ড ঘটেছে, সব কেস তার নামে। রেগেমেগে গণেশ দাস জেলে ঢোকার আগে তার ছেলেকে বলে গেল, ‘তুই আর রাতের কারবারে যাসনে! যা করবি দিনমানে!”
“এই বাবা! তার ছেলে চোর নাকি?”
“তা হবে না? চোরের ব্যাটা চোর না হয়ে কি পুলিশ হবে? বললুম না, সাতপুরুষের পেশা। চুরি না করে উপায় কী? ওই বিদ্যেটি ছাড়া আর তো কিছু শেখেনি। বাপ বলল, রাতের কারবারেই যত ফ্যাসাদ। দিনে-দুপুরে ভাল ভাল জামা-জুতো পরে পাঁচজনের মাঝখানে ঘুরতে ঘুরতে কাজ সাফাই করে বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় পাবলিকের ভিড়ে মিশে যাবি। বাপ-ঠাকুদ্দার মতন কুচিয়ে চুল ছাঁটতে হবে না। গায়ে প্যাচপেচিয়ে তেল মাখতে হবে না, মুখে কালিঝুলি মাখতে হবে না, তুই বা কে, রাজপুত্তুরই বা কে। শহরবাজারে এখন এই রেওয়াজ হয়েছে!
“তা বাপ জেলে ঢুকে যাবার পর ছেলে সেই রেওয়াজে কাজ চালায়। তোফাই চালায়। হাল ফিরে রাজার হাল! দিনমানে গটগটিয়ে ঢুকে আসে, দোকানে বাজারে লোকের বাড়িতে। চোখ রাঙিয়ে, মাল হাতিয়ে বেরিয়ে আসে। ট্যাক্সি ডেকে মালপত্তর চাপিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। বেশ চলছিল…”
মজারুমামা একটু থেমে বলে, “কপালের ফেরে একদিন হল এক বিপত্তি! বাঘা বাঘা পুলিশদাদারা যাকে জব্দ করতে পারে না, সেই লোক কিনা দুটো কুচোকাচা ছেলেপেলের কাছে জব্দ বনে বসল। সব গুবলেট।”
“কী মজা! কী মজা!”
চটপট হাততালি।
“ওরা বুঝি বুদ্ধি করে চোরটাকে ঘরে বন্ধ করে ফেলল?”
“ঘরে বন্ধ?” গল্প বলিয়ে মজারু জোর গলায় বলে, “নিকুচি করেছে তোদের! ঘরে বন্ধ আবার একটা ব্যাপার। কেন, জানলার গ্রিল ওপড়ানো যায় না? শিক ভাঙা যায় না? আর বুদ্ধি? বুদ্ধিই বটে! যেন সব ক’টা এইমাত্তর স্বর্গ থেকে খসে পড়েছে।… ও সব কিছু না। কপালের ফের! তা একদিন দিনের বদলে সন্ধে, আর মক্কেলের বাড়ি ঢোকামাত্তর লোডশেডিং।”
‘আঁ!”
“যাঃ!”
“ধ্যাত!”
“তুমি বুঝি বানাচ্ছ মজারুমামা?”
“বানাচ্ছি মানে? লোডশেডিং বলে কোনও জিনিস নেই? দেখিসনি কখনও?”
“না না, তা বলছি না!”
“বলছিস না তো চুপচাপ থাক! লোডশেডিং। তায় আবার আকাশে মেঘের ঘটা। সেকেলে চোরের মায়েদের ভিরকুট্টির অবস্থা! চোখ রাঙালেও দেখানো যাচ্ছে না। বাড়িতে গার্জেনরা সব হাওয়া। কিন্তু বাড়িতে রেখে গেছে ওই সর্বনেশে ডেঞ্জারাস কুচো ক’টাকে। …ব্যাস। সবক’টা একসঙ্গে ছিনেজোঁকের মতো লেগে থেকে চোরটাকে কিমা বানিয়ে ছাড়ল।”
“আঁ! কিমা!”
“স্যরি কিমা নয়, মামা, মামা! তো চোর বেটার কাছে দুইই সমান। তিন কুলে যার একটাও বোন নেই, তাকে যদি গণ্ডাখানেক ভাগ্নে-ভাগ্নি রসোমালাই, ডিমের পাটিসাপটা, কাশ্মীরি গোকুলপিঠে খাওয়াতে বসে, আর মামা-মামা করে জীবন মহানিশা করে ছাড়ে, সেটা কিমা বানানো ছাড়া আর কী? কাজেই চোরটা…”
“ও মজারুমামা, গল্পটা তুমি বানাচ্ছ নাকি?”
‘বানানো মানে? চোরটা যা করল, তাই বলছি। বিলকুল সত্যি!”
“কী করল গো?”
“কী করল? অনেক কষ্টে হাতানো মালপত্তরগুলো ছড়িয়ে ফেলে রেখে এমনি করে গটগট করে বেরিয়ে চলে গেল!”
“এ কী! এ কী! তা, তুমি চলে যাচ্ছ কেন? ও মজারুমামা, গল্পটার শেষ কী?”
আর শেষ! ছায়ামূর্তির টিকির ছায়াটিও নেই।
আর শুনলে বিশ্বাস করা যায় না। ঠিক সেই মুহূর্তে কারেন্ট এসে গেল! বাড়ি আলোয় ঝলমল!
“ফোটন!”
“ছোটন!”
“ছোড়দা রে!”
“রিঙ্কি রে!”
“বারান্দায় ঝুঁকেও দেখতে পেলাম না রে দাদা।”
“আচ্ছা, আমরা কী দোষ করলাম বল তো?”
“কী জানি বাবা!”
“এ বারে বোধহয় শরীর ভাল নেই মজারুমামার।”
“না রে। বোধহয় ছোটমাসিরা নেই বলে রাগ হয়েছে।”
“হতেই পারে।”
“কিন্তু এ কী?”
“এ সব কী?”
“দালানে এ সব কোখেকে এল?”
“এ সব কী? এ-সব কী?”
বাইরের দরজা থেকে চেঁচাতে-চেঁচাতে আসছেন ফোটন কোম্পানির মা বাবা-মাসিরা। এর মানে কী? রাস্তার দরজা হাটপাট!” “সুশীল নিজের দরজায় ছেকল তুলে দিয়ে হাপিস!” “কী, হাপিস নয়? ঘরের মধ্যে বন্দি তুই?” কী ব্যাপার? সিঁড়ি থেকে জিনিস ছড়ানো—এত দুষ্টুমিও মাথায় খেলে ওদের!”
চেঁচাতে চেঁচাতে উঠে আসেন ওঁরা। “এ কী! এ কী!”।
তবে ওঁদের চেঁচানোয় কর্ণপাত না করে একগণ্ডা গলা চেঁচিয়ে উঠল, “এতক্ষণে আসা হল তোমাদের? এই একটু আগে চলে গেল মজারুমামা!”
“চলে গেল!”
“তা যাবে না তো কী? তোমরা আসবে না, আলো আসবে না, ভাল্লাগে?”।
“কিন্তু এ সব কী?”
বড়-ছোট দুই বোন দালানে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকেন, “কিন্তু এ সব কী ব্যাপার! ওরে বাবা, আমার সুটকেসটা সিঁড়ির ধারে কেন? আলনার জামা কাপড়গুলো মাটিতে জড়ো করা কেন? টেপ-রেকর্ডারটা দেরাজ থেকে বেরিয়ে এখানে এল কী ভাবে? ফ্রিজটা হাঁ করে খোলা.. মানে কী? ওরে বাবা রে, মেজদি, আমার নতুন কেনা শাড়িগুলো বাজারের থলের মধ্যে ঠোসা। আমার যে মাথা ঝিমঝিম করছে গো।”।
বলতে বলতে ঘরে। এবং আর-একপ্রস্থ চিৎকার। “এ আবার কী? আলমারি ফাঁকা করে সর্বস্ব মাটিতে নামানো। ওরে সর্বনেশে ছেলেমেয়েরা, কী যে হচ্ছিল তোদের? রাম-রাবণের যুদ্ধ, না কুরুক্ষেত্তর কাণ্ড!”
বাবা গম্ভীর ভাবে বলেন, “দেখে মনে হচ্ছে তৃতীয় মহাযুদ্ধের পত্তন এইখান থেকেই হল! দস্যিপনার একটা সীমা থাকবে তো?”
মা’ও বলে ওঠেন, “সত্যি! হাঁ হয়ে যাচ্ছি।”
কিন্তু রিঙ্কি তো আর ছেড়ে কথা বলবার মেয়ে নয়। সে নিজস্ব স্টাইলে ঝংকার দিয়ে ওঠে, “আহা রে। আমরা এই সব করেছি! আমাদের ভারী সাহস! এ সবই তোমাদের মজারু-ভাইয়ের গজারু কাণ্ড! অন্ধকারের মধ্যে উনি ঘরবাড়ি আলমারি দেরাজ সব সাফ করছেন! হি-হি, আবার তিনি ‘চোর-গোকলো’ হয়ে মালপত্তর হাতাচ্ছেন! উঃ, কম কাণ্ড করেছে মজারুমামা আমাদের ঠকাতে? হরবোলা হয়ে দশ রকম গলা করেছে। কিন্তু পারল কি ঠকাতে? আমরা তেমন বোকা নাকি? শেষ অবধি তোমাদের দেরি-ফেরি দেখে হঠাৎ রেগে গটগট করে চলে গেল। তবে খুব ভাগ্যি, ফ্রিজের খাবারগুলো সেটে গেছে চেটেপুটে।”
১৭ অক্টোবর ১৯৮৪
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন