পৌলোমী সেনগুপ্ত
চিঠিটা পেয়ে রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গেলাম। বছর দশেক তো হবেই, মানে কলেজ ছাড়ার পর থেকে সুকুমারের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। শুনেছিলাম ওড়িশার এক জঙ্গলে কাঠ কেটে চালান দিচ্ছে। ব্যবসায় বেশ দু’পয়সা করেছে। কলকাতায় সে আসেই না।
চিঠিতে লেখা, ভাই আমার বড় বিপদ। তুই। আমাকে বাঁচা। যত তাড়াতাড়ি পারিস আয়। কটকে নেমে ট্যাক্সিতে সারানার জঙ্গলে চলে আসবি। আমার বাংলোর নাম বনকুঠি। যাকে জিজ্ঞাসা করবি, সেই দেখিয়ে দেবে। আসিস ভাই। তোর আশায় রইলাম। ইতি সুকুমার।
চিঠিটা পেয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী এমন বিপদ হতে পারে সুকুমারের? ব্যবসার জন্য যদি টাকার দরকার হয়ে থাকে তা হলে আমি আর কী সাহায্য করতে পারি। আমার সামান্য চাকরি। একলা মানুষ তাই কোনও রকমে চলে যায়।
তবে কি ওখানকার মজুরদের সঙ্গে কোনও রকম গোলমাল বাধল? তা হলেই বা আমি কী করতে পারি।
যাই হোক, বিপদ যখন লিখেছে তখন একবার যাওয়া দরকার।
অফিস থেকে দশ দিনের ছুটি নিয়ে বের হয়ে পড়লাম।
কটকে নামলাম সন্ধ্যা ছ’টায়। স্টেশনে অনেক ট্যাক্সি রয়েছে, কিন্তু সারানার জঙ্গলে যেতে কেউ রাজি নয়।
যাকে জিজ্ঞাসা করি, সেই বলে যেতে চার ঘণ্টা লেগে যাবে। ফেরার সময় অত রাতে বিপদ আছে। খুব চিতাবাঘের উপদ্রব।
দু-একজন বলল, রাতটা ওয়েটিংরুমে কাটিয়ে সকালেই যাবেন।
ভেবে দেখলাম সেটাই ঠিক হবে। নতুন জায়গায়, বিশেষ করে জঙ্গলে রাতে না যাওয়াই ঠিক।
ওয়েটিং রুমে রাতটা কাটিয়ে সকালে ট্যাক্সি ধরলাম। শহর ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা যাবার পর জঙ্গলের এলাকা শুরু হল। বড় বড় শাল আর কেঁদো গাছ। ঘন লতার ঝোপ। সূর্যের আলো বন্ধ। দিনের বেলাতেই আবছা অন্ধকার।
একটু এগিয়েই ট্যাক্সি থেমে গেল। আর পথ
“কী হল?”
“আর রাস্তা নেই। আপনাকে হেঁটে যেতে হবে।”
“সারানা জঙ্গল কত দূর?”
“এই তো শুরু হল,” ট্যাক্সি ড্রাইভার আঙুল দিয়ে একটা ফলকের দিকে দেখিয়ে দিল। তাতে লেখা, সারানা জঙ্গল।
জিজ্ঞাসা করলাম, “বনকুঠি কতটা দূর হবে?”
“তা বলতে পারব না। আপনি নেমে খোঁজ করুন।”
অগত্যা ভাড়া মিটিয়ে কাঁধে ঝোলা আর হাতে স্যুটকেস নিয়ে নেমে পড়লাম।
সরু পায়ে-চলা পথ। ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে এল। ঝিঝির একটানা শব্দ, নাম-না-জানা পাখির কর্কশ ডাক, বাতাসে পাতা কপার শিরশিরানি আওয়াজ। এই অজগর জঙ্গলে সুকুমার থাকে কী করে? অর্থের জন্য মানুষ বুঝি সব কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়।
বেশ কিছুটা যাবার পর জনাতিনেক কাঠুরিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সকলের হাতেই কুড়াল। ঝুড়িগুলো টুপির মতন মাথায় পরেছে।
তাদের প্রশ্ন করলাম, “বনকুঠি কোন দিকে?”
তারা নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করল, কয়েকবার আমার আপাদমস্তক দেখল, তারপর একজন বলল, “বনকুঠি সোজা ডানদিকে, পুকুরের পাশে।”
চলতে চলতে লক্ষ করলাম কাঠুরিয়ারা একটা গাছের নীচে দাড়িয়ে আমাকে দেখছে।
গভীর জঙ্গলে নতুন লোক দেখে তাদের কৌতুহল হওয়াই স্বাভাবিক।
একটু পরে ঝোপের আড়ালে আর তাদের দেখা গেল না।
সোজা হাঁটতে লাগলাম। ঘামে সমস্ত শরীর ভিজে গিয়েছে। শহরের লোেক, এতটা হাঁটা অভ্যাস নেই। পা-দুটো টনটন করছে।
একটু এগোতেই পুকুর দেখা গেল। পুকুর নয়, বিরাট বিল। জল দেখা গেল না। পদ্মপাতায় ভর্তি।
তার পাশেই একটা বাংলো। একতলা। চারপাশের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলোর রংও সবুজ। ছোট গেট। গেটের ওপর একটা লতা উঠেছে। তাতে বেগুনি রঙের থোকা থোকা ফুল।
চমৎকার বাংলো। পথের কষ্ট যেন নিমেষে মুছে গেল।
গেটের কাছ বরাবর গিয়ে নজরে পড়ল। একটা কাঠের ওপর সবুজ রং দিয়ে লেখা, বনকুঠি।
গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকেই দাড়িয়ে পড়তে হল। দরজায় তালা ঝুলছে।
তার মানে সুকুমার নেই। বেরিয়েছে। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে!
সুটকেস আর ঝোলা পাশে রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। বেশ ঝিরঝিরে বাতাস বইছে।
ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙল, ঘড়ি দেখে চমকে উঠলাম। দু’ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। তখনও দরজায় তালা ঝুলছে।
বুদ্ধি করে ঝোলার মধ্যে পাউরুটি আর কলা এনেছিলাম। কটক স্টেশন থেকে ফ্লাস্কে গরম চা ভরে নিয়েছিলাম। আপাতত তাই খেয়ে প্রাণ বাঁচালাম।
নেমে কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম। সব জানলা বন্ধ। সেটাই স্বাভাবিক। এই ঘন জঙ্গলে কেউ জানলা খুলে বাইরে যায় না। জানলা দিয়ে বাইরে থেকে সাপখোপের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ার যোলো-আনা সম্ভাবনা।
আরও দু’ঘণ্টা কাটল। সুকুমার ফিরল না।
চিন্তায় পড়লাম। এমন তো নয় সুকুমার কলকাতায় চলে গিয়েছে। আমি যে আসবই, সেটা তো তার জানবার কথা নয়। তবু চিঠি যখন আমাকে দিয়েছে, তখন তার দু’-একদিন অপেক্ষা করা উচিত ছিল।
দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। খুব কম দামি মরচে-পড়া তালা ঝুলছে। জোরে কয়েক বার। টানতেই তালাটা খুলে এল।
বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম। একটা খাট, বিছানা পাতা। এক পাশে আলমারি। বোধহয় কাপড়-জামা রাখার। একটা গোল টেবিল, একটা চেয়ার।
খিদেয় চোখে অন্ধকার দেখছি। ছুটে রান্নাঘরে গেলাম। একটা জালের মিটসেফ। খুলতেই দেখলাম, চাল, ডাল, আলু আর ডিম রয়েছে। নীচে একটা স্টোভ।
রান্না করার অভ্যাস আমার ছিল। একসঙ্গে চাল-ডাল চড়িয়ে দিলাম। তার মধ্যে আলুও ছেড়ে দিলাম। দুটো ডিমও ভাজলাম।
খাওয়া সেরে নিলাম। সুকুমারের জন্য খিচুড়ি আর ডিমভাজা আলাদা করে রেখে দিলাম।
তারপর সোজা শুয়ে পড়লাম বিছানায়।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না, খুটখাট শব্দ হতে উঠে বসলাম।
দরজার ওপারে বিশ্রী একটা মুখ দেখা গেল। খোচা খোচা কাচা-পাকা দাড়ি। খুদে লাল চোখ। পরনে ছেড়া শার্ট আর প্যান্ট।
চেঁচিয়ে উঠলাম, “কে?”
লোকটা ভিতরে এসে বলল, “আপনি কে? বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন কী করে?”
তার কথায় উত্তর না দিয়ে বললাম, “তুমি কে, আগে তাই বলো।”
“আজ্ঞে, আমি এবাড়ির দেখাশোনা করতাম। রান্না, বাসনমাজা, ঘর ঝাট দেওয়া সব।”
“আমি সুকুমারের বন্ধু। সুকুমার কখন আসবে? আমি ভোর থেকে অপেক্ষা করছি।”
লোকটার ভাঙাচোরা মুখে বিস্ময়ের রেখা ফুটে উঠল। দুটো চোখ বিস্ফারিত, আমার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, “কে আসবে? বাবু? মরা মানুষ কি ফিরে আসে?”
কথাটা কানে যেতেই লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালাম।
“কে মরা মানুষ? কী যা-তা বলছ?”
“আপনি শোনেননি কিছু? নিজের দোষে বাবু মরণ ডেকে আনল।”
মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে গেল। সুকুমার নেই! যে বিপদের ভয়ে সে আমাকে চিঠি লিখে আসতে বলেছিল, সেই বিপদই বুঝি তাকে গ্রাস করল!
আমার কি আসতে দেরি হয়েছে? কী লজ্জা, বন্ধুর প্রাণ বাঁচাতে পারলাম না।
লোকটাকে বললাম, “সব ব্যাপারটা খুলে বললো। তো। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
লোকটা মেঝের ওপর বসল। খুব নিচু গলায় বলতে শুরু করল। “বাবু তো কাঠের কারবার করতেন। জঙ্গলের একবারে কোণের দিকে একটা গাছ আছে। সেটাকে আমরা তোঙ্গা গাছ বলি। সে গাছ কেউ কাটে না। তাতে অপদেবতার বাস। কাঠুরেরা কেউ সে গাছ কাটতে রাজি হল না। সবাই চলে এল জঙ্গল থেকে, কিন্তু বাবু নাছোড়বান্দা। বললেন, ‘এ জঙ্গলের সব গাছ আমি ইজারা নিয়েছি, কোনও গাছ আমি ছাড়ব না।’ বাবু কুড়াল নিয়ে নিজেই তার ডাল কাটতে শুরু করলেন। গোটা তিনেক ডাল মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কাটা জায়গা দিয়ে রক্তের মতন আঠা ঝরতে লাগল। আমি জোর করে বাবুকে টেনে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। তারপর—”
“কী তারপর?”
“পরের দিন ভোরে এসে দেখি সদর দরজা খোলা। বাবু মেঝের ওপর পড়ে আছেন। দুটো চোখ যেন ঠিকরে বের হচ্ছে। বাবুকে কেউ গলা টিপে মেরে ফেলেছে। বাবুর হাতের মুঠোয় তোঙ্গাগাছের ছোট একটা ডাল।”
বললাম, “তার মানে সুকুমারকে ডাকাতে মেরে ফেলেছে।”
“না বাবু, এখানে চোরডাকাত নেই। এত গভীর জঙ্গলে কে আসবে ডাকাতি করতে। ডাকাত হলে বাবুর টাকাকড়ি জামাকাপড় নিয়ে যেত না? কিচ্ছু কেউ ছোঁয়নি। তা ছাড়া বাবুর আর-এক হাতের মুঠোয় একটা কাগজ ছিল। তাতে লেখা, তোঙ্গা বাবার কোপ থেকে আমাকে বাঁচাও। আমার বড় কষ্ট হচ্ছে। তোঙ্গাগাছের শক্ত ডাল আমার গলা চেপে ধরেছে। উঃ।”
‘কাগজটা কোথায়?”
“এই যে বাবু।” লোকটা উঠে রান্নাঘরে গিয়ে একটা হাঁড়ির মধ্যে থেকে ডায়েরির একটা ছেড়া পাতা নিয়ে আমার হাতে দিল।
লোকটা যা বলেছিল সেই সবই কাগজে লেখা রয়েছে। সুকুমারেরই হাতের লেখা।
জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি বাংলা পড়তে পার?”
“বলতে পারি বাবু, পড়তে পারি না।”
“তবে এ লেখা পড়লে কী করে?”
“আমি পড়িনি বাবু। পুলিশের লোক এসেছিল খবর পেয়ে। তাদের মধ্যে একজন বাংলা জানত, সেই পড়ে শুনিয়েছিল। কাগজটা আমার হাতে ফেরত দিয়ে বলেছিল, যত সব আজগুবি কাণ্ড।”
কথাটা হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল। সব। ব্যাপারটা কেমন সন্দেহজনক। অলৌকিক ব্যাপারে আমার মোটেই বিশ্বাস নেই।
“কত দিন আগে এটা ঘটেছে?”
লোকটা হিসাব করে বলল, “তা দিন পনেরো তো হবেই।”
“মিথ্যে কথা,” ধমক দিয়ে উঠলাম। “দিন পাঁচেক আগে সুকুমার আমাকে চিঠি দিয়েছিল। এই দেখো সেই চিঠি।”
পকেট থেকে পোস্টকার্ডটা লোকটার দিকে এগিয়ে দিতে গিয়েই চমকে উঠলাম। পোস্টকার্ডে একটি আঁচড়ও নেই। কেবল লাল লাল ছোপ।
সুকুমারের গলায় যে ধরনের লাল দাগের কথা লোকটা বলেছিল, অনেকটা বুঝি সেই ধরনের।
২ জুলাই ১৯৮০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন