পৌলোমী সেনগুপ্ত
যে-সব রাতজাগা পড়ুয়া অর্থাৎ গল্পপাঠক রহস্য-রোমাঞ্চের গল্প পড়ে উত্তেজনায় কাঁপতে অভ্যস্ত, তাদের মধ্যে কেউ ইন্দ্রপাঁচু রায়ের নাম জানেন না এমনটা দেখিনি, শুনিনিও। আধাবয়সি নাদুসনুদুস এই ভদ্রলোকটির মাথা-ভর্তি পাকা বেলের মতো টাকের আড়ালে যে এত সব গুরুতর রহস্য আর তার সমাধান কী করে লুকিয়ে থাকতে পারে, তা বাইরে থেকে বোঝা দুষ্কর। তবে নামটা? হ্যাঁ, ওটা যেন একটু কেমন-কেমন! তা ওতে ইন্দ্ৰপাঁচুবাবুর তো কোনও হাত নেই। সাধারণত নাম রাখেন বাবা-মা কিংবা দাদু-ঠাকুমা। ওঁর বেলাও তাই হয়েছিল। বাবা নামটাকে একটু ভারিক্কি করার জন্য ইন্দ্ৰ শব্দটির আমদানি করেছিলেন। কিন্তু শুধু ইন্দ্র শুনতে কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে, ইন্দ্রনাথ, ইন্দ্রনারায়ণ, ইন্দ্রসেন, ইন্দ্রদ্যুম্ন, এই ধরনের একটা কিছু হলে তবে মানায়। কিন্তু বেঁকে বসলেন ওঁর ঠাকুমা। ইন্দ্র দেবতাদের রাজা হলেও এমন কিছু আদর্শ-চরিত্রের পুরুষ নন। ঠাকুর-দেবতার নাম বলতে ও নামটা আমরা কেউ বলি না। অথচ ছোটদের নামের মধ্যে কোনও ঠাকুর-দেবতার নাম থাকলে তাকে ডাকাডাকি করার সময় ওই উপলক্ষে বারে বারে সেই ঠাকুরের নামই তো উচ্চারণ করা হয় এবং তাতে নিশ্চয়ই কিছুটা পরকালের কাজও হয়। শিব ঠাকুমার প্রিয় দেবতা, তাই তিনি জোর করতে লাগলেন নাম দেওয়া হোক পঞ্চানন। বাবা ছিলেন মাতৃভক্ত, মায়ের আদেশ একেবারে অগ্রাহ্য করতে পারলেন না, তাই ইন্দ্রের সঙ্গে ওই নামটি জুড়ে করা হল ইন্দ্রপঞ্চানন। কিন্তু ও নামটাও তো কানে লাগে। পঞ্চাননকে চলতি কথায় বলা হয় পাঁচু। তাই শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রপাঁচু নামটাই বহাল হয়ে গেল।
ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার সময়ও ওই নামটাই লিখিয়ে দিলেন বাবা। ফলে কলেজেও ওই নামটাই রয়ে গেল। বন্ধুবান্ধবরা নাম নিয়ে একটু ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত। ইন্দ্রপাঁচু ভাবতেন আদালতে একটা এফিডেবিট করে নামটা বদলে একটা আধুনিক নাম নিয়ে নেবেন—এই ধরো দেবদ্যুতি কিংবা সঞ্জয় কিংবা শুভায়ু; কিন্তু মুশকিল হল অল্প বয়স থেকেই তিনি গল্প লিখতে শুরু করে দিয়েছিলেন ওই স্বনামেই অর্থাৎ ইন্দ্রপাঁচু নামেই এবং তখন থেকেই তার একটু খ্যাতিও হয়েছিল রহস্য-গল্প-লিখিয়ে বলে। কাজেই এখন আর নাম বদলানো ঠিক হবে না , তাই পুরনো নামটাই বহাল রাখতে হল।
অবশ্য তাতে কিছু এসে যায় না। স্বয়ং শেক্সপিয়রই তো বলে গিয়েছেন, ‘নামে কী করে? গোলাপে যে নামে ডাকো মধু বিতরে।’ শেক্সপিয়রকে উড়িয়ে দেবে এমন বুকের পাটা কার?
প্রথম জীবনে ইন্দ্রপাঁচুবাবু একটা মার্চেন্ট অফিসে চাকরি নিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু দিন পরেই দেখা গেল, আপিসে কাজ করে গল্প লেখার সময় বড় একটা থাকে না, আর তত দিনে তার যে নাম হয়েছে, তাতে গল্প লিখেই চাকরির চেয়ে বেশি আয় হবে। তার লেখা ‘কামস্কটকার হত্যা-রহস্য, ‘এলোকেশীর বিবেকের দর্শন’ ‘কবরখানার রোজনামচা’, ‘মানুষখেকোর দ্বীপে’ প্রভৃতি বইগুলির ইতিমধ্যেই পাঁচ-সাতটা করে সংস্করণ হয়ে গেছে। আজকাল সম্পাদকদের উৎপাতে অনেক সময় তাঁকে বাড়িতে থেকেও ইন-আউট নেমপ্লেটে ‘আউট’ রাখতে হয়।
এত ভণিতা করবার কারণ আর কিছুই না, কারণ সেই ইন্দ্রপাঁচুবাবুকে নিয়েই আমার এই গল্প।
আগেই বলেছি, ইন্দ্রপাঁচুবাবু আধাবয়সি ভদ্রলোক। স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালই ছিল, কিন্তু রাত-দিন বসে থেকে থেকে সম্প্রতি তার একটা ছোট্ট ভুঁড়ি গজিয়েছে, আর সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে হাঁপানি। ভুঁড়ি কমাতে গেলে ব্যায়াম করতে হয়, অন্তত নিয়মিত বেশ খানিকটা হেঁটে বেড়াতে হয়, কিন্তু তাতে আবার হাঁপানি বেড়ে ওঠে। চিকিৎসা তো কম করলেন না! অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবরেজি, মায় নানা রকম টোটকা ওষুধে তার টেবিল ভর্তি হয়ে গেছে। কিন্তু না, কিস্সু হচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত তিনি ঠিক করলেন দিন কতক কলকাতার হইচই ছেড়ে কোনও নির্জন জায়গায় কাটিয়ে আসবেন। খোলা মুক্ত জায়গায়, যেখানে লোকজনের কোলাহল নেই, নেই কোনও ভক্ত পাঠকের অকারণ আনাগোনার আশঙ্কা। সমুদ্রের ধারে হলে তো কথাই নেই। ভোরবেলাকার সমুদ্রের হাওয়া নাকি হাঁপানি রোগীদের পক্ষে পরম হিতকারী ওষুধ।
আশ্চর্য, ঠিক সেই রকম জায়গাই একটা পাওয়া গেল।
সে দিন খবরকাগজে চোখ বোলাতে-বোলাতে ইন্দ্রপাঁচুবাবু দেখেন, ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। দিঘা থেকে মাইল-দশেক দূরে সমুদ্রের ধারে বনঝাউয়া গ্রামে একটা ছোট্ট বাড়ি ভাড়া কিংবা সস্তায় লম্বা লিজ দেওয়া হবে। উপযুক্ত দাম পেলে বিক্রি করতেও আপত্তি নেই মালিকের। জায়গাটা নির্জন হলেও পরিবেশ মনোরম। দিঘার মতো উটকো যাত্রীর ভিড় নেই। সামনেই সমুদ্র। তাতে ঢেউ আছে, মাঝে মাঝে ব্রেকারও দেখা যায়। স্নানে পরম তৃপ্তি। কাছেই সপ্তাহে দু’বার করে হাট বসে, তাই খাবার-দাবার জোগাড় করারও অসুবিধে নেই। প্রচুর মাছ। দামেও সস্তা। খোঁজ নিন, বক্স নং…।
এই রকমই তো চেয়েছিলেন ইন্দ্ৰপাঁচুবাবু। তাঁর পক্ষে একেবারে ‘আইডিয়াল জায়গা। মনে মনে ভাবলেন, আপাতত মাস খানেকের জন্য তো ভাড়া নেওয়া যাক। ভাল লাগলে কিনেই ফেলবেন বাড়িটা। কত আর দাম হবে? ঈশ্বরেচ্ছায় একখানা রগরগে উপন্যাস লিখেই টাকাটা তুলে নেওয়া যাবে। নিজের লেখার ওপর তার অগাধ বিশ্বাস আছে।
সঙ্গে সঙ্গে চিঠি গেল, জবাবও এল। সপ্তাহখানেক পরেই দেখা গেল ইন্দ্রপাঁচুবাবু সশরীরে বনঝাউয়ায় এসে হাজির হয়েছেন। দিঘা থেকে একটা ঝটকা ভাড়া পাওয়া গিয়েছিল, তাইতেই এসেছেন এই দশ মাইল।
ছোট্ট গ্রাম বনঝাউয়া। দূরে ঝাউবন ঘেঁষে একটা জেলে-পল্লি। ব্যস, আর কিছু না। সামনেই খানিকটা বালির ময়দান পেরোলেই ধু-ধু করছে সমুদ্র। অবিরাম ঢেউ ভেঙে পড়ার শব্দ ছাড়া ক্বচিৎ দু’-একটা নাম-না-জানা পাখির ডাক। তা ছাড়া সম্পূর্ণ নিরিবিলি জায়গাটা।
বাড়িখানা অবশ্য ছোট্ট। খান-দুয়েক মাত্র ঘর। চাঁচ-বেড়ার ওপর প্লাস্টার লাগানো দেওয়াল, ওপরে টালির ছাদ, তবে মেঝেটা পাকা, সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। সামনে একফালি বারান্দা। উঠোনের ওধারে ছোট্ট একটা রান্নাঘর। আশপাশে কিছু শৌখিন ফুলের গাছ টবে করে লাগানো হয়েছে। কিছু মনসা জাতীয় গাছও আছে বাড়ির সামনে। একটা টিউবওয়েলও আছে খাবার জলের জন্য, তবে জলটার স্বাদ একটু কষা। তা এ অঞ্চলে ওই রকম তো হবেই।
মোট কথা, বাড়িটা ভালই লাগল ইন্দ্ৰপাঁচুবাবুর। এখানে স্বাস্থ্য ভালই থাকবে মনে হয়। সারা দিন ঘরে কি খোলা বারান্দায় বসে বই লেখো, না-হয় সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়াও। ভাগ্যিস সাধারণ লোকে হট্টগোল ভালবাসে, নইলে দিঘার মতো এখানেও ভ্রমণার্থীদের উৎপাত শুরু হত। কিন্তু হয়নি।
ইন্দ্রপাঁচুবাবু অবশ্য একেবারে একা আসেননি। গিন্নি তাকে একা ছেড়ে দেননি, সঙ্গেই এসেছেন। আর এসেছে কাজের লোক হাবুল। লোক বললাম বটে, কিন্তু নেহাতই বাচ্চা। দশ-বারো বছরের বেশি বয়স হবে না। কিন্তু ভারী চালাক ছেলেটা। দোষের মধ্যে একটু বেশি কথা বলে। তা বলুক।
বনঝাউয়ায় দিন কয়েক কাটিয়েই ইন্দ্রপাঁচুবাবুর স্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি দেখা গেল। ভোরে সূর্য ওঠার আগেই তিনি একটা লাঠি হাতে পায়জামা পরে সমুদ্রের ধারে চলে যান। তারপর সমুদ্রের ধার ঘেঁষে হাঁটতে থাকেন আপনমনে, কখনওবা গল্পের প্লট ভাবতে ভাবতে। ফুরফুরে বাতাস। সে-বাতাসে একটুও ধোঁয়া নেই, একটুও ধুলো নেই, কিন্তু আছে যথেষ্ট ওজোন যা নাকি অক্সিজেনেরই একটা রূপভেদ। ইন্দ্রপাঁচুবাবু বিজ্ঞানী না হলেও এটুকু জানেন যে, সাধারণ অক্সিজেনে যেখানে একটা অণুর মধ্যে থাকে দুটো অক্সিজেন পরমাণু, ওজোনে তার জায়গায় থাকে তিনটে অক্সিজেন পরমাণু। ওই বাড়তি অক্সিজেন পরমাণুটুকু তার শ্বাস-প্রশ্বাসকে আরও সহজ, আরও সতেজ করে তোলে। গিন্নি অত ভোরে উঠতে পারেন না, চিরকালই তার একটু বেলায় ওঠা অভ্যাস। তা ছাড়া তিনি ইতিমধ্যেই এখানকার জেলে আর জেলে-গিন্নিদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছেন। একজন ভাল মুরুব্বির সন্ধান পেয়ে তারাও রোজ নানা রকম টাটকা মাছের ঝুড়ি নিয়ে এসে হাজির হয়। তিনি তা থেকে বেছে একটু বেশি করেই কিনে নেন। দরদপ্তর করেন না, এমনিই তো ওরা যা চায়, তা প্রায় জলের দাম। রকমারি রান্না করতে তার খুব ভাল লাগে। হাবুল অবশ্য ইন্দ্রপাঁচুবাবু বেরোলেই সঙ্গে সঙ্গে আসে। সেও নতুন জায়গাটা খুব উপভোগ করে। কখনও ঝিনুকের খোঁজে বালির মধ্যে হাতড়ে বেড়ায়, কখনও সমুদ্রের ধারে একেবারে জল ঘেঁষে দাঁড়ায়, তারপর একটা বড় ঢেউ এসে পা ধুইয়ে দিতেই দৌড়।
তবে হ্যাঁ, ইন্দ্রপাঁচুবাবুর বই লেখার কাজও চলছিল সমানে। খুনজখম, মারদাঙ্গা, ভূতের উৎপাত—এ সব নিয়ে তিনি অনেক ‘থ্রিলিং’ বই লিখেছেন, এখানে এসে এই পরিবেশে সে রকম বই লিখতে মন চাইছে না। তাই একটা নতুন ধরনের উপন্যাস শুরু করেছেন-বনঝাউয়ার রহস্য। রহস্য তো একটা থাকতেই হবে, নইলে উপন্যাস কাটবে ; তবে রহস্যটা যে কী হবে তা এখনও তিনি ঠিক করে উঠতে পারেননি। তবে একটা কিছু নিশ্চয়ই খুঁজে বার করবেন এবং তখন তরতর করে গড়িয়ে চলবে লেখা জলস্রোতের মতো।
সে দিনও ভোরবেলা বেরিয়েছেন। দূরে পেছন পেছন হাবলুও আসছে। অন্য দিনের মতোই ফুরফুরে হাওয়া বইছে। সূর্যদেব উঠি উঠি করছেন। ইন্দ্ৰপাঁচুবাবুর মনে হল সূর্যঠাকুরের চেহারায় কেমন যেন একটা ম্লান ভাব। নাকি ওটা তার মনের ভুল? হঠাৎ চিড়বিড় করে কী একটা খেলে গেল আকাশের গায়ে। পরিষ্কার নীল আকাশ, কোথাও এক ফোঁটা মেঘ নেই। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ঝলকাবে কী করে? এও কি তবে মনের ভুল! কিন্তু না, পরক্ষণেই আবার সেই বিদ্যুতের ঝলক। কোনও শব্দ নেই তাতে, শুধুই আলো; তাও ঠিক চোখ ঝলসানো নয়। কিন্তু সে বিদ্যুৎ ঝলক থামল না, ক্রমাগত দেখা দিতে লাগল আকাশে। ইন্দ্রপাঁচুবাবু অবাক হয়ে গেলেন। আকাশে মেঘের চিহ্ন নেই, তা ছাড়া এটা বৃষ্টির সময়ও নয়। এ কী অদ্ভুত ব্যাপার!
কিন্তু বিদ্যুৎ চমকালেও ইন্দ্রপাঁচুবাবুর ভালই লাগছে। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিচ্ছেন, কোনও কষ্ট হচ্ছে না। হাঁপানির নামগন্ধও নেই। হাবুল দূরে জলের ধারে কী যেন একটা খুঁজছে! ওর প্রাত্যহিক সংগ্রহ ইতিমধ্যে বেশ ভারী হয়ে উঠেছে। কলকাতায় ফিরবার সময় যদি আবদার ধরে সব সঙ্গে নিয়ে যাবে, তা হলে হয়তো তার জন্যই আবার একটা আলাদা ঝটকার খোঁজ করতে হবে। ইন্দ্রপাঁচুবাবু সমুদ্রের ধার দিয়ে সমানে হাঁটতে লাগলেন বিদ্যুতের চমক অগ্রাহ্য করে।
আশ্চর্য, সূর্য কি এখনও ওঠেনি! কিন্তু সূর্য একবার উঠে পড়লে তো বাতাসে আর তিন-পরমাণুর ওজোন থাকে না, সূর্যের তেজই আবার তাকে ভেঙে দু-পরমাণুর অক্সিজেনে পরিবর্তিত করে দেয়। কাজেই তখন আর সমুদ্রের ধারে ঘোরার কোনও মানে হয় না। বাতাসে ধুলো থাকলে তাও ওজোনকে ভেঙে দেয়, এ জন্য সমুদ্রের ধারে ছাড়া অন্যত্র ওজোন কমই পাওয়া যায়। সমুদ্রের ওপরকার বাতাসে তো আর ধুলো থাকে না।
ইন্দ্রপাঁচুবাবুর খেয়াল হল, সূর্য তো উঠে গেছে, বেশ খানিকটা ওপরেই উঠে গেছে; কিন্তু নিশ্বাস নিয়ে বুঝতে পারছেন বাতাসে অক্সিজেনের প্রাবল্য কমেনি, অর্থাৎ ওজোন তখনও ভেঙে যায়নি৷ ও দিকে মেঘশূন্য আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি চলছে তো চলছেই।
অবশেষে ইন্দ্রপাঁচুবাবু ফিরলেন। মনটা এবার চায়ের জন্য একটু আকুলতা বোধ করছিল। মনে হল অন্য দিনের চেয়ে আজ বেলাটা ইতিমধ্যে বেশ বেড়ে গেছে। আজ গল্পের জন্য একটা রহস্য খুঁজে বার করতেই হবে, নইলে গল্প আর এগোবে না।
আকাশে তখনও বিদ্যুতের ঝলকানি সমানে চলেছে। হঠাৎ হাবুল ছুটে এসে বলল, “বাবু, একটা মাছের আঁশটে গন্ধ পাচ্ছেন না? কিন্তু এ দিকে তো জেলেরা কেউ আসে না, মাছ জমিয়েও রাখে না। কেউ এ দিকে।”
সত্যি, কেমন একটা বিশ্রী গন্ধ ইন্দ্রপাঁচুবাবুও টের পাচ্ছিলেন, কীসের গন্ধ ধরতে পারছিলেন না। হাবুলের অভিজ্ঞ ঘ্রাণশক্তি কিন্তু তা ঠিক ধরে ফেলেছে। হ্যাঁ, মাছের আঁশটে গন্ধই তো! আশ্চর্য ব্যাপার!
একটু পরেই আর-এক কাণ্ড। সামনের বাতাসটা মনে হল আর তেমন স্বচ্ছ লাগছে না, কেমন ধোঁয়াটে ধোঁয়াটে মনে হচ্ছে। না, কালচে ধোঁয়া নয়, আর ঠিক অস্বচ্ছও নয়; ধোঁয়াটা যেন ঈষৎ নীলচে। যতই এগোচ্ছেন রংটা যেন স্পষ্ট চোখে লাগছে।
ইন্দ্রপাঁচুবাবু বাড়ির পথ ধরলেন।
নীলচে ধোয়াটা কিন্তু তখনও মিলিয়ে যায়নি, তারই সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। তবে সমুদ্রতীর থেকে সরে আসাতে একটু যেন ফিকে লাগছে।
বাড়ির সামনে এসে দেখেন, তার গিন্নি নাকে কাপড় গুঁজে একটা ঝাঁটা নিয়ে সারা ঘর, বারান্দা বালতি-বালতি জল ঢেলে ধোয়াচ্ছেন।
“কী ব্যাপার?
ইন্দ্রপাঁচুবাবুর প্রশ্ন শেষ হতে না-হতে গিন্নি ঝংকার দিয়ে উঠলেন, “দ্যাখো-না হাবলেটার কাণ্ড! কাল বিকেলে জেলেগুলো একরাশ মাছ নিয়ে হাজির হয়েছিল। বললাম, না, বিকেলে দরকার নেই, বাসি মাছে গন্ধ হবে। ওরা পীড়াপীড়ি করে কয়েকটা জোর করে গছিয়ে দিয়ে গেল। বলল, দাম পরে নেবে। হাবলেকে বললাম, মাছগুলো তুলে রাখ। কী করেছে কোথায় রেখেছে কে জানে! আঁশটে গন্ধে নাক গেল। কিন্তু মাছ তো দেখছি না; তাই আপাতত জল ঢেলে পরিষ্কার করছি। এ ভাবে তো থাকা যায় না!”
হাবুল বলল, “আমি তো ওগুলো রান্নাঘরে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছি, বেশ ভাল করে। গন্ধ আসতেই পারে না,” বলেই সে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটল, রান্নাঘরের দিকে। তারপরই চিৎকার, “ও মা, দেখুন, লোহার কড়াই, চাটু কাল ঝকঝকে করে মেজে রাখলুম, এরই মধ্যে কেমন মরচে ধরে গেছে!” সত্যিই তাই।
ও দিকে আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি সমানে চলছে। ইন্দ্রপাঁচুবাবু লক্ষ করলেন, সমুদ্রের ধারে বাতাসে যে নীলচে ধোঁয়া চোখে পড়েছিল, ক্রমে তা ঘরের দিকেও এগিয়ে আসছে। হ্যাঁ, উঠোন পেরিয়ে ঘরের মধ্যেও ঢুকে গেছে। আর সেই আঁশটে মাছের গন্ধ ঘরের মধ্যেও বেশ টের পাচ্ছেন তিনি। এ কী অদ্ভুত কাণ্ড!
কিন্তু ওরই মধ্যে একটু সুখেরও আভাস ছিল। ভোরবেলা সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গিয়ে যে সহজ নিশ্বাস নেবার আনন্দ পান, বাড়িতে আসার পর সেটা অন্য দিন ততটা থাকে না, যদিও এ ক’দিনে হাঁপানি তার প্রায় সেরে গেছে বললেই চলে। আজ কিন্তু ঘরের মধ্যেও সেই বুকভরা নিশ্বাসপ্রশ্বাসের আনন্দ অনুভব করছেন তিনি।
গিন্নি কিন্তু সমানে তারস্বরে চিৎকার শুরু করে দিয়েছেন। হাবুল এসেই উনুনে আগুন দিতে বসে গিয়েছিল। এখানে কাঠ ছাড়া আর কোনও জ্বালানি নেই। গিন্নির চিৎকারে উনুন থেকে একটা জ্বলন্ত চেলাকাঠ হাতে নিয়েই ঘরে ঢুকে পড়ল সে। কী হয়েছে মা?” ও দিকে তার হাতের কাঠ তখনও দাউদাউ করে জ্বলছে।
গিন্নি চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওরে হতভাগা, এমনি জ্বলছি ধোঁয়ায় আর বিটকেল গন্ধে, তার মধ্যে তুই আবার আগুন নিয়ে এলি ঘরে।” বললেন বটে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল ঘরের নীলচে ধোঁয়াটা যেন কমে আসছে। আঁশটে গন্ধটাও আর টের পাওয়া যাচ্ছে না। হাবুল জ্বলন্ত কাঠটা নিয়ে তখনও ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ তার কী খেয়াল হল, সে সেই জ্বলন্ত কাঠটা নিয়ে প্রথমে বারান্দায় ঘুরতে লাগল, সেখান থেকে লাফিয়ে পড়ল উঠোনে, তারপর সেই জ্বলন্ত চেলাকাঠ নিয়েই সারা উঠোন নেচে বেড়াতে লাগল।
এ দিকে হাবুলের নাচ দেখেই বোধহয় নীল ধোঁয়াটে জিনিসটা লজ্জা পেয়ে সেখান থেকেও আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যেতে লাগল আঁশটে গন্ধটাও। ইন্দ্ৰপাঁচুবাবু দূর আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। দেখলেন, আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানিটাও আর দেখা যাচ্ছে না।
এর পর আরও দু’দিন কেটে গেছে। ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর ঘটেনি। তা হলে রহস্যকাহিনীর একটা রহস্যের সন্ধান পেয়ে গেছেন ইন্দ্রপাঁচুবাবু! এই নিয়েই তো একটা চমৎকার গল্প ফাঁদা যায়। কিন্তু রহস্যের জটটা তো খুলতে হবে। সেটা উদ্ধার করতে না পারলে রহস্যের যে কোনও মানেই থাকে না।
এ দিকে ওই ঘটনার পরই গিন্নি কলকাতায় ফিরবার জন্য ক্রমাগত তাগাদা শুরু করেছেন। কিন্তু ইন্দ্রপাঁচুবাবু নারাজ। হঠাৎ একদিন কী একটা অলৌকিক কাণ্ড ঘটল বলেই এমন সুন্দর জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে? নেভার। তা ছাড়া এখানে এসে তো তার স্বাস্থ্যের দিব্যি উন্নতি হচ্ছে। হাঁপানিটা একদম টের পাচ্ছেন না। ভুঁড়িটাও তুবড়ে গেছে। হাঁটা-চলা তো কম হচ্ছে না। গিন্নির রান্নার বাতিক, তাই খাওয়া-দাওয়াটাও ভালই চলছে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই গায়ে, যাকে বলে গত্তি লাগা, তাই লেগেছে। এমনকী, হাবুলেরও। সে ছেলেটা তোফা ফুর্তিতে আছে। এখন এ-জায়গা ছেড়ে যাবার কোনও মানে হয়? তা ছাড়া সে-দিনকার সেই অলৌকিক ব্যাপারের একটা জুতসই কারণ ভাবতে না পারলে তার গল্পটাই যে মাঠে মারা যাবে। তিনি তো ভাবছিলেন বাড়িটা সস্তাগণ্ডায় পেলে একেবারে কিনেই ফেলবেন। তা হলে প্রায়ই মাঝে মাঝে আসা যাবে। পরের বারে আর দিঘায় নেমে ঝটকা চেপে আসবেন না, একেবারে খোদ কলকাতা থেকে মোটরেই চলে আসবেন সোজা। পাকা রাস্তা না থাকলেও সবটাই তো বালির ময়দান, বালির ওপর দিয়ে গাড়ি চালাতে অসুবিধে হবে না নিশ্চয়ই।
অগত্যা গিন্নি বললেন, “তুমি তো দিব্য আছ। নিজের তালে খুশিমতো বেড়াচ্ছ আর পাঁজা-পাঁজা লিখে চলেছ। আমার একা একা সময় কাটে কী করে? তা হলে বরঞ্চ বটকেষ্টকেও আসতে লিখে দি। নতুন বিয়ে করেছে, একেবারে বউ নিয়েই না-হয় কাটিয়ে যাক এখানে।”
বটকেষ্ট নামটা হেলাফেলার সঙ্গে উচ্চারণ করলেও ভদ্রলোক নেহাত হেলাফেলার লোক নন। তিনি ইন্দ্ৰপাঁচুবাবুর শ্যালক, গিন্নির ছোট ভাই। পুরো নাম ডক্টর বটকৃষ্ণ চ্যাটার্জি। বর্তমানে ইউনিভার্সিটিতে কেমিষ্ট্রি অর্থাৎ রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক। তুখোড় ছাত্র বলে এক সময়ে খুব নাম ছিল, তেমনই নাম ছিল আমুদে বলে। নামটা অবশ্য বড়ই সেকেলে, কিন্তু সেজন্য ভগ্নিপতির মতো তাঁর কোনও আক্ষেপ ছিল না। নাম? ও একটা হলেই হল। লোকে চিনতে পারলেই হল। তাদের কেমিস্ট্রিতে তো কত বিদঘুটে ল্যাটিন নাম সর্বদা ব্যবহার করতে হয়, তাতে কার কী ক্ষতিটা হচ্ছে? থ্যালিয়াম ট্রাইক্লোরোট্রাইঅ্যাসিটেট কিংবা অ্যালফাকিটোপ্রোগিওনিক অ্যাসিড শুনলে কি কারও কানে বাঁশি বাজে? কিন্তু শেষেরটা যে এক রকম প্রোটিন তৈরির কাজে লাগে, এ-খবর ক’জন রাখে?
বটকেষ্ট এসেই কিন্তু বাড়ি মাত করে তুলল। তার বউ মধুঋতাও বেশ হাসিখুশি। সেও একটা মেয়ে-কলেজে কেমিস্ট্রি পড়ায়। দুজনে মিলে বাড়ির আবহাওয়াই যেন বদলে দিল মুহূর্তে। মধুঋতা অবশ্য মাঝে মাঝে বেশি চেঁচামেচি হলে ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে বলত, “চুপ, পাঁচুদা বোধহয় রহস্য-গল্প লিখবার তোড়জোড় করছেন, আস্তে কথা বলো।” ইন্দ্রপাঁচু শব্দটা তার মুখে আসত না, আসত না বটকেষ্টরও। সে আগে বলত জামাইবাবু, এখন মধুঋতার দেখাদেখি সেও বলে পাঁচুদা।
ভোরবেলা এখন থেকে বটকেষ্টও সঙ্গী হল ইন্দ্রপাঁচুবাবুর প্রাতঃভ্রমণে। মধুঋতার তার ননদিনীর মতোই বেলায় ওঠা অভ্যাস। বিশেষত সকালে চা না খাওয়া পর্যন্ত সে এক পা-ও নড়তে চায় না। ওরা বাড়িতেই থাকত।
বেড়াতে বেড়াতে একদিন ইন্দ্রপাঁচুবাবু শ্যালককে সে দিনকার সেই অলৌকিক কাণ্ডের কথা শোনালেন। শুনে ভারী অবাক হয়ে গেল বটকেষ্ট। বলল, “একটু ভেবে দেখতে হবে। আর কোনও দিন অমন কাণ্ড হয়নি?”
“না তো?”
আর, আশ্চর্য, সেই দিনই হঠাৎ শুরু হল সেই আকাশে ছড়ানো বিদ্যুতের ঝলকানি। না, কোনও শব্দ নেই, গর্জন তো দূরের কথা, এমনকী চিড়বিড় আওয়াজটুকুও নয়। কিন্তু সমানে চলতে লাগল থেকে থেকে সেই আলোর ঝলকানি। তারপর সেই একই কাণ্ড। ইন্দ্রপাঁচুবাবু প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে লাগলেন আরামে, বটকেষ্টও। কিন্তু একটু পরেই নাকে আসতে লাগল সেই আঁশটে মাছের গন্ধ আর চোখে ভেসে আসতে লাগল সেই ঈষৎ নীলচে ধোয়া। ওঁরা আর দেরি না করে তখনই ছুটলেন বাড়ির দিকে।
বাড়িতেও সেই একই ব্যাপার। সেই নীলচে ধোঁয়াটে বাতাস ঘরে ঢুকে পড়েছে। সঙ্গে আঁশটে মাছের গন্ধ আসছে নাকে। কিন্তু কাল বিকেলে কিংবা আজ সকালে তো কোনও জেলে আসেনি মাছ বেচতে। তবে?
হাবুল কিন্তু সে দিনের কথা ভোলেনি। হঠাৎ সে রান্নাঘরে ঢুকে একটা মস্ত জ্বলন্ত চেলাকাঠ এনে ঘরে, বারান্দায়, উঠোনে নাচানাচি শুরু করে দিল। আর, আশ্চর্য কাণ্ড, সঙ্গে সঙ্গে নীল ধোঁয়া ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল, আঁশটে গন্ধটাও যেন মিলিয়ে গেল হাওয়ায়।
আকাশে তখন বিদ্যুতের ঝলকানি অনেকটা কমে এসেছে। একটু পরেই সেটাও নিবে গেল।
না, রহস্য ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।
বটকেষ্টর হাবভাব যেন কেমন কেমন লাগছে। সে কি কিছু সন্দেহ করছে! দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর দেখা গেল সে মধুঋতার সঙ্গে নিরালায় বসে কী আলোচনা করছে। তার পরই একটা ঝটকা জোগাড় করে দুজনেই বেরিয়ে পড়ল, কোথায় যাবে কাউকে না বলে।
ফিরে এল সন্ধ্যার একটু আগে। দু’জনের মুখেই তখন দিগ্বিজয়ের হাসি। অর্থাৎ রহস্যের সন্ধান ওরা পেয়ে গেছে।
সে দিন ছিল হাটবার। হাটের লোকদের কাছ থেকেই খবরটা পেয়েছিল ওরা। এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে একটা মিলিটারি ক্যাম্প বসানো হয়েছে কয়েক মাস আগে। তার ধারে কাছে কাউকে যেতে না দিলেও ওখানে যুদ্ধের নানা রকম মহড়া চলে। যুদ্ধ বাঁধবে বলে নয়, সম্ভবত নতুন যারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে তাদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য এই সামরিক ক্যাম্প। এইটুকু খবরই বটকেষ্টর কাছে যথেষ্ট এবং সেই জন্যই সে ঝটকা ভাড়া করে মধুঋতাকে নিয়ে সেই মিলিটারি ক্যাম্পের উদ্দেশে রওনা হয়। হাটের দিন বলে ঝটকাও একটা মিলে যায় সহজেই।
মিলিটারি ক্যাম্পের ভিতরে যাওয়া অবশ্য ওদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু ফটকে দাঁড়ানো সান্ত্রীর হাত দিয়ে নিজেদের পরিচয়পত্র দেওয়ার পর একজন মিলিটারি অফিসার ওদের সঙ্গে এসে দেখা করে। আর মজা, দেখা গেল ওই অফিসারটি বটকেষ্টরই একজন পুরনো বন্ধু, কলেজের সহপাঠী। গোপনীয়তা যতটা সম্ভব রক্ষা করে সে যা বলল, বটকেষ্টর কাছে রহস্য উদ্ধারের পক্ষে সেটুকুই যথেষ্ট।
কিছু দিন থেকে মাঝে মাঝে ওখানে একটা নতুন ধরনের মিসাইল ছোঁড়ার মহড়া চলছিল। ওই মিসাইল ছুঁড়বার সময় তা থেকে বিদ্যুতের ঝলক বেরিয়ে আসে কিন্তু তাতে কোনও শব্দ হয় না। অর্থাৎ তার উত্তাপ এত বেশি হয় না, যা থেকে শব্দ হতে পারে। শব্দ বন্ধ রাখার জন্যই উত্তাপ বাড়তে দেওয়া হয় না কি না সেটা অবশ্য বটকেষ্ট জানতে পারেনি, তবে এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, এই ধরনের বিদ্যুৎক্ষরণকেই বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, সাইলেন্ট ইলেকট্রিক ডিসচার্জ’, বাংলায় বলা যায় শব্দহীন বিদ্যুৎক্ষরণ। এ ক্ষেত্রে তাপ কখনও ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হতে দেওয়া হয় না। এইটুকু জানতে পেরেই সমস্ত রহস্যটা রসায়নের অধ্যাপক বটকেষ্টর কাছে ধরা পড়ে গেছে।
ল্যাবরেটরিতে ওজোন তৈরি করতে হলে তো এই পদ্ধতিরই সাহায্য নেওয়া হয়। অবশ্য ভোরের নির্মল আকাশে সমুদ্রতীরে যে ওজোন তৈরি হয় তার কারণটা অন্য। সূর্যোদয়ের সময় সূর্যের আলোর সঙ্গে বেরিয়ে আসে বেশ খানিকটা আলট্রাভায়োলেট রশ্মি। এই রশ্মি ধুলিহীন সমুদ্রতীরের বাতাসে পড়ে খানিকটা অক্সিজেনকে ওজোনে রূপান্তরিত করে, যা নাকি সাধারণ অক্সিজেনের মতো দুই-পরমাণুর অক্সিজেন নয় তিন-পরমাণুর অক্সিজেন। ওজোনের এই অতিরিক্ত অক্সিজেনের জন্যই হাঁপানি রোগীরা শ্বাস-প্রশ্বাসে আরাম পায়। একটু বেলা হলেই কিন্তু সূর্যের আলো থেকে এই আলট্রাভায়োলেট রশ্মি আর পাওয়া যায় , উপরন্তু ওজোনও তখন সূর্যের তেজে ভেঙে গিয়ে ফের দুই-পরমাণুর সাধারণ অক্সিজেন হয়ে যায়।
বিজ্ঞানীর ল্যাবরেটরিতে কিন্তু ওভাবে ওজোন তৈরি করা হয় না, সেখানে ওজোন তৈরি হয় অক্সিজেন গ্যাসের ভিতর দিয়ে সাইলেন্ট ইলেকট্রিক ডিসচার্জ চালনা করে। এ জন্য কয়েক রকম পদ্ধতি আছে। কিন্তু এখানকার এটা একেবারে অভিনব বলা যেতে পারে। যাঁরা তৈরি করছেন মিসাইল ছুঁড়ে, তারাও বোধহয় জানেন না এর ফলাফল কী হতে পারে। এটা একেবারেই প্রাকৃতিক ঘটনা বলা চলে, কিন্তু আসলে তো ব্যাপারটা একই। সেই বাতাসের অক্সিজেনকে ক্রমাগত সাইলেন্ট ইলেকট্রিক ডিসচার্জের সাহায্যে ওজোনে রূপান্তরিত করা।
মিলিটারি মহড়ার সময়ে এখানে সেই কাণ্ডটাই ঘটেছে। অক্সিজেন ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়েছে ওজোনে এবং যতক্ষণ মহড়া চলেছে ততক্ষণই চলেছে এই ব্যাপার। ফলে যে ওজোন তৈরি হয়েছে তার পরিমাণ হয়েছে বিরাট।
এখন, রাসায়নিকরা সবাই জানেন যে, ওজোনের মধ্যে তিনটি অক্সিজেন পরমাণু থাকায় ওজোন আর অক্সিজেনের ধর্ম এক নয়। অক্সিজেনের কোনও রং নেই, কিন্তু ওজোন গ্যাস হলেও, তার রং নীল। অক্সিজেনের কোনও গন্ধ নেই, কিন্তু ওজোনের আছে একটা বিশ্রী গন্ধ, যা নাকি অনেকটা মাছের আঁশটে গন্ধের মতো।
মিলিটারি মহড়ার ফলে খানিকক্ষণের জন্য ও-জায়গাটার অনেকটা অক্সিজেনই ওজোনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, আর তারই ফলে মনে হয়েছিল একটা অলৌকিক কাণ্ড ঘটে গেছে। রান্নাঘরে কড়াই আর চাটুতে হঠাৎ মরচে ধরার কারণও এই অতিরিক্ত অক্সিজেন।
অবশ্য এই ওজোন ভেঙে তাকে ফের অক্সিজেনে আনার ব্যাপারে হাবুলেরও মস্ত একটা ভূমিকা ছিল, যদিও সেটা ঘটেছিল তার সম্পূর্ণ অজান্তে। ওজোনকে একটু গরম করলে, বিশেষ করে সে তাপটা যদি ২০০ ডিগ্রির ওপরে হয়, তা হলে তা সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে ফের অক্সিজেনে রূপান্তরিত হয়, হাবুলের হাতের জ্বলন্ত চেলাকাঠ তার অজান্তেই এই অঘটনটা ঘটিয়েছিল।
বাড়ি ফিরে বটকেষ্ট আর মধুঋতা যখন হাসতে হাসতে রহস্যটা বুঝিয়ে দিল, তখন ইন্দ্রপাঁচুবাবুও হো হো করে হাসতে শুরু করে দিলেন। তবে তার গিন্নি এই সরল সমাধানের ওপর খুব গুরুত্ব দিলেন কি না বোঝা গেল না, কেননা তিনি তখন ভাই আর ভাই-বউয়ের আপ্যায়নের জন্য মাছের চপ ভাজতেই বেশি ব্যস্ত দেখা গেল।
৯ ডিসেম্বর ১৯৮৭
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন