গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক

পৌলোমী সেনগুপ্ত

স্কুলে যাওয়ার সময় রোজই আমার মেয়ে একটা-না-একটা বায়না ধরে। ওর বায়না শুনতে শুনতে ওর মায়ের কান এতই ঝালাপালা হয়ে গেছে যে, ওকে স্কুলের পোশাক পরাতে পরাতে এখন মেয়ের আগে মা-ই ধমকের সুরে বলে ওঠেন, “চুপচাপ স্কুলে যাবে। কোনও বায়না করবে না। ভাল মেয়েরা কখনও বায়না করে না।”

এর পরেই মেয়ের প্রশ্ন, “বায়না করলেই কি খারাপ হয়ে যায়?”

মেয়েকে বোঝাবার ভঙ্গি করে মা বলেন, “নিশ্চয়ই খারাপ হয়ে যায়। বইয়ে লেখা আছে পড়োনি। গোপাল অতি সুবোধ বালক। সে কখনও বায়না করে না। বড়রা যাহা বলে তাহাই করে। যা পায়…”

মাকে থামিয়ে দিয়ে মেয়ে বলে, “এটা তো ছেলেদের জন্যে। গোপাল তো মেয়ে নয়। মেয়েরা বায়না করলে খারাপ হয় না।”

মা-মেয়ের এমন সওয়াল-জবাব প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। আজ স্কুলে যাওয়ার আগে আমার কাছে এসে বলল, “বাবা, পঁচিশটা পয়সা দিতে হবে। দিদিমণি নিয়ে যেতে বলেছেন।”

আমি বললাম, “কেন?”

মেয়ের হয়ে মা উত্তর দিলেন, “ওদের স্কুলে কে নাকি কী সব খেলা দেখাবে। তার জন্যে চার আনা করে পয়সা নিয়ে যেতে বলেছেন।”

মেয়ে তার মাকে ভুল শুধরে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলে, “চার আনা পয়সা নয়, পঁচিশ পয়সা। চার আনা নিলে হবে না।”

আমারও অফিস বেরোবার তাড়া ছিল বলে ওকে চার আনা অর্থাৎ পঁচিশ পয়সা দিয়ে স্নানে গেলুম। অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি গোটা বাড়িতে আমার মেয়েই একমাত্র বক্তা আর সবাই শ্রোতা। এমনকী তার মা’ও নির্বাক। মেয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এল। শনিবার বলে পড়ার চাপ কম, অতএব, এখন বকবক করে বেড়ালেও তাকে বকবার লোক কেউ নেই। বাড়ির সকলেরই সম্ভবত একাধিকবার শোনা হয়ে গিয়েছিল, তাই মেয়ে এসে ধরল আমাকে।

স্কুলে পঁচিশ পয়সার বিনিময়ে যেসব কাণ্ডকারখানা সে দেখে এসেছে, সেই নবীন অভিজ্ঞতার কাহিনি আমাকে না শোনালে ওর স্বস্তি হচ্ছে না।

মেয়ে চোখ বড় বড় করে, দু’হাত নেড়ে বলতে লাগল, “একজন লোক আমাদের খাওয়ার খেলা দেখাল। প্রথমে বলল, আমি সব খেতে পারি। একজন একটা কাঁচা পেঁপে দিল, লোকটা দিব্যি খেয়ে নিল। তারপর খেল কলাগাছের টুকরো, তারপর কাঁচা বেগুন, এক খাবলা মাটি, মাটির ভাঁড়। যে যা দিচ্ছে সব খেয়ে নিচ্ছে। আমাদের অঙ্ক-দিদিমণির হাতে ছিল চকের বাক্স। এক বাক্স চকের অর্ধেকটা যখন খেয়ে নিয়েছে, তখন বড়দিদিমণি “স্টপ, স্টপ” বলে ছুটে এসে চকের বাক্সটা ওই খাইয়ে-লোকটার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বললেন, এগুলো স্কুলের প্রপার্টি। খেয়ে ফেললে জবাব দিতে পারব না।”

একনাগাড়ে কথা বলে মেয়ে হাঁফাচ্ছিল। আমি ওকে দম নেওয়ার অবকাশ দিলাম। একটু পরে জিজ্ঞেস করলাম, “কতক্ষণ খেলা দেখাল?”

মেয়ে খুব দুঃখের সঙ্গে বলল, “বেশিক্ষণ দেখাতে পারল না। বড়দিদিমণি থামিয়ে দিলেন।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”

মেয়ে উত্তর দিল, “বড়দিদিমণির ভয় হয়ে গেল যে! একে তো স্কুলের চোদ্দোখানা আস্ত চক খেয়ে নিয়েছে। এর পর একটা ডাস্টার কামড়ে ধরতেই বড়দিদিমণি ভয় পেয়ে বললেন, ‘ওকে দু’-পাঁচ টাকা বেশি দিয়ে বিদেয় করুন। মনে হচ্ছে, এর পর গোটা স্কুল বাড়িটাই খেতে আরম্ভ করবে।’ তারপর বড়দিদিমণি ইংরেজিতে অন্য দিদিমণিদের বললেন, ‘ইফ হি ট্রাই টু ইট আওয়ার স্কুল বিল্ডিং, আই থিঙ্ক হি ক্যান, বাট উই কান্ট অ্যালাউ হিম টু ইট সাচ এ ইম্পরট্যান্ট থিং, লাইক আওয়ার এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন।’ তখন জোর করে ওই খাওয়াখাওয়ির খেলা বন্ধ করতে হল।”

বাড়ি ফিরে আমার জলখাবারের বরাদ্দ হল এক পিস পাউরুটি, আর এককাপ চা। রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় মাখন খাওয়া বন্ধ করেছি মাস ছয়েক আগে। সেঁকা পাউরুটিতে যখন কামড় দিচ্ছি, তখন মেয়ে বলল, “বাবা, তুমি ওইরকম খেতে পারবে?”

আমি মাথা নেড়ে জানালাম, না।

মেয়ে বলল, “পারলে বেশ হত, তাই না।”

আমি বললাম, “তা হলে তো তোদের স্কুলে গিয়ে খেলা দেখাতে হত আর বড়দিদিমণি ভয় পেয়ে মাঝপথে বন্ধ করে দিতেন, তাই না?”

মেয়ে বলল, “তা কেন, তখন তো বাড়িতে তুমি সব কাঁচা-কাঁচাই খেতে পারতে। মাকে আর কষ্ট করে রাঁধতে হত না।”

আমার ওই এক পিস পাউরুটি খাওয়া দেখে মেয়ে তার দুর্বল বাবার দিকে যেন করুণার চোখে তাকাল। আজই সদ্য সদ্য খাওয়ার ব্যাপারে যে মেয়ে নররাক্ষস দেখে ফিরেছে, যে তার কাছে দারুণ একটা হি-ম্যান হিরো, সেই মেয়ে তার নিজের বাবাকে এক পিস পাউরুটি আর এক কাপ চা খেয়ে ঢেকুর তুলতে দেখে যদি খুবই দুর্বল ভাবতে আরম্ভ করে, তাতে আর তার দোষ দেব কেন। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেক রকম স্বপ্ন বাসা বাঁধে। বাইরে যা দেখে মুগ্ধ হয় নিজের ঘরে এসে তাই খোঁজবার চেষ্টা করে। আমার মেয়ে রিঙ্কি তাই হঠাৎ হঠাৎ তার মাকে বলে, “মা, তুমি স্টেফি গ্রাফের মতো টেনিস খেলতে শিখলে না কেন?”

আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে যেদিন এসে বলল, “কী বলব মা গো, বড় রাস্তায় এত গণ্ডগোল যে, দেড় মাইল পথ বাস না পেয়ে ছুটতে ছুটতে চলে এলুম। পাছে দেরি হয় তাই ছুটে এলুম। বাসও আমার আগে আসতে পারবে না।”

সঙ্গে সঙ্গে রিঙ্কি বলে উঠল, “ও মাসি তুমি তো তা হলে পি টি উষার রেকর্ড ভেঙে দেবে গো। তুমি এখন থেকে তাই করো।”

কাজের মেয়ে ময়না বলল, “আমি বাছা কারও সাতে-পাঁচে থাকি না। অ্যাদ্দিন তোমাদের কাছে কাজ করছি, তোমরা বলতে পারবে কখনও একটা চায়ের কাপ ভেঙেছে আমার হাত থেকে। তবে কেন আমি অন্যের বাড়ির রেকর্ড রেডিয়ো ভাঙতে যাব।”

রিঙ্কির এইরকম অভ্যেস আছে বলে আমি এবং আমরা খুব সতর্ক থাকি। আমাকে যে কতবার গাওস্কর, কপিলদেব, মারাদোনা আর বিয়র্ন বর্গ হতে অনুরোধ করেছিল তার ইয়ত্তা নেই। একটা বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের কাছে তার বাবাই হচ্ছেন হিরো। তাদের ধারণা তার বাবা সব পারেন। রিঙ্কি সেই বয়সটা না পেরোনো পর্যন্ত খুব সতর্ক থাকতে হয়।

রবিবার সকালে বাজারে যাওয়ার সময় মেয়ে বায়না ধরল তাকেও নিয়ে যেতে হবে। এটা অবশ্য এমন কিছু নতুন ব্যাপার নয়। অধিকাংশ রবিবারই এটা ঘটে। বাজার করে ফিরে আসার পথে রিঙ্কি আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কিছুটা ভয় আর অনেকখানি বিস্ময়-জড়ানো গলায় বলে উঠল, “বাবা, ওই যে, ওই যে লোকটা আসছে।”

আমি দেখলাম, একটা গলির মধ্য দিয়ে আধময়লা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরা রোগা চেহারার একটা লোক হেঁটে আসছে। লোকটা দেখতে এতই সাধারণ যে, ওর দিকে কারও নজর পড়ার কথা নয়; অথচ রিঙ্কি চোখ বড় বড় করে তাকেই দেখছে এবং আমাকে দেখাচ্ছে।

আমি বললাম, “কে ওই লোকটা? তুই চিনিস?”

রিঙ্কি যেন তার বাবাকে পৃথিবীর কোনও অষ্টম আশ্চর্য দেখাচ্ছে তেমন ভাবেই বলল, “এই তো সেই লোকটা, যে কালকে আমাদের স্কুলে খেলা দেখিয়েছিল। জ্যান্ত নররাক্ষস।”

এ বার লোকটার দিকে ভাল করে তাকাতেই হল। গত সন্ধ্যায় যার খাওয়াখাওয়ির এমন সব রোমহর্ষক বিবরণ শুনেছি এবং পাছে স্কুল বাড়িটাই খেয়ে ফেলার আশঙ্কায় বড় দিদিমণি ভয় পেয়ে যার খেলা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাকে দেখার লোভ আমারও হল।

আমি একটু এগিয়ে গেলাম। রিঙ্কি এবার দু’হাত দিয়ে আমাকে টেনে ধরে চাপা গলায় সাবধান করে দিয়ে বলল, “বাবা, বেশি এগিয়ো না। এখনও নির্ঘাত ওর ব্রেকফাস্ট হয়নি। পারলে ব্যাগ থেকে একটা বাঁধাকপি ছুড়ে দাও।”

আমি বললাম, “ও কি মানুষও খায় নাকি?”

রিঙ্কি বলল, “আমাদের রামু-দরোয়ান বলেছে, যে ডাস্টার খেতে পারে সে ইচ্ছে করলে মাস্টারও খেতে পারবে।”

লোকটা ততক্ষণে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমার এক হাত সামনে দাঁড়িয়ে লোকটা আমার দিকে তাকাল। চোখ পিট পিট করে আমায় দেখতে লাগল। আমিও লোকটাকে দেখছি। মাথায় খাটো-খাটো চুল, ছ’ফুটের মতো লম্বা, যেন পাকানো দড়ির মতো। আধময়লা পাজামা আর হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি, পায়ে হাওয়াই চপ্পল আর কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা-ব্যাগ। লোকটা আরও এক পা আমার দিকে এগিয়ে আসতেই রিঙ্কি প্রাণপণে আমার হাত ধরে টানতে লাগল।

লোকটা আমায় দেখতে দেখতে হাসল। তারপর বলল, “নিশ্চয়ই চিনতে পারছিস না। আমি কিন্তু পেরেছি।”

কথাটা বলেই লোকটা দু’হাতে তালি বাজিয়ে হাত দুটো মুখের কাছে তুলে এনে এমন ভাবে হাসল, যে হাসি জীবনে আমি একজনকেই হাসতে দেখেছি। আমি বললাম, “তুই কি তবে গাবু?”

ওই লোকটা, অর্থাৎ গাবু আরও জোরে হেসে উঠে বলল, “মার দিয়া কৈলাস! তুই চিনতে পেরেছিস। আমিই গাবু, গ্রেট গাবুলাল সাঁপুই।”

বাজারের ব্যাগটা ডান হাতে, বাঁ হাত ধরে টানছে রিঙ্কি, তাই ব্যাগটা রাস্তাটায় নামিয়ে ডান হাত বাড়িয়ে গাবুকে কাছে টানলাম। গাবু আমাকে জড়িয়ে ধরে হাসতে লাগল। গতকালের হি-ম্যান নররাক্ষস বাবাকে বুকে জড়িয়ে আদর করছে দেখে রিঙ্কি যেন মনে মনে ভরসা পেল।

গাবুকে বললাম, “এই হচ্ছে আমার মেয়ে। তুই ওদের স্কুলে গতকাল খেলা দেখিয়েছিলি। রিঙ্কিই তো তোকে দেখাল।”

গাবু হাত বাড়িয়ে রিঙ্কির গালটা আলতো করে টিপে দিল। রিঙ্কি সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের সঙ্গে আরও সেঁটে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে গাবু বলল, “ভাগ্যিস দেখাল তাই দেখা হল। নইলে তো দেখাই হত না। তা প্রায় তিরিশ বছর পর দেখা হল, তাই না?”

আমি মনে মনে হিসেব করে বললাম, “হ্যাঁ, তা প্রায় হবে।”

ছেলেবেলার বন্ধুর সঙ্গে এ ভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা উচিত নয় ভেবে বললাম, “চল, আমার বাড়িতে। কাছেই আমার বাড়ি।”

গাবু রাজি হয়ে গেল। রিঙ্কির ভয় কেটে গিয়ে এবার কৌতূহলটা বাড়তে লাগল। আমরা যখন হেঁটে আসছি তখন রিঙ্কির এক হাত আমার হাতে, অন্য হাত ধরেছে গাবু। ওকে মাঝখানে রেখে আমি আর গাবু দু’জন রিঙ্কির দু’পাশে হাঁটছি। রিঙ্কি তখন গাবুকে উদ্দেশ করে বলে যাচ্ছে, “তুমি কাঁচা বাঁধাকপি খেতে পারো? তুমি জলের কুঁজো খেতে পারো? তুমি নাকি ইটও খেতে পারো?”

গাবু সব প্রশ্নের জবাবেই খালি, “পারি, পারি” বলে মাথা নেড়ে যাচ্ছে। রিঙ্কি এ বার আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করল, “তোমার কে হয়? বন্ধু?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, বন্ধু। খুব ছোটবেলা থেকে।”

আমি লক্ষ করছিলাম গাবুর সঙ্গে হেঁটে যেতে যেতে রিঙ্কি বেশ গর্বিত চোখে চারপাশে তাকাচ্ছিল। ওর দুই বন্ধুকে ডেকে ডেকে গাবুকে দেখাল। গতকাল পঁচিশ পয়সার বিনিময়ে যার খেলা দেখেছে আজ তারই হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মধ্যে রিঙ্কি এক ধরনের গর্বমেশা আনন্দ পাচ্ছিল। আমার মনে পড়ল কৈশোরের দিনগুলিতে গাবুকে নিয়ে আমাদেরও গর্ব ছিল। গাবু আমাদের বন্ধু অথচ এই বয়সেই আমাদের পাড়ায় গাবু প্রায় ভি. আই. পি.’র সম্মান পেত।

না, গাবু যে খুব ভাল ছাত্র, দারুণ খেলোয়াড়, কিংবা গাইয়ে-বাজিয়ে ছিল তা নয়। গাবুর ছিল দুটি গুণ। বারো-চোদ্দো বছর বয়সেই গাবু দারুণ খেতে পারত। তার খাওয়া দেখবার জন্য এঁটো হাতেও সার দিয়ে নেমন্তন্ন বাড়িতে লোক দাঁড়িয়ে থাকত। আর ওই বয়সেই তার গায়ে ছিল অসুরের বল। গাবুর বাবার ছিল লোহাপেটার ছোট্ট একরত্তি দোকান। গাবু মাঝে মাঝে বাবার কাজে সাহায্য করত। গাবুর বাবাও নাকি আস্ত একটা কাঁঠাল খেতে পারত। কিন্তু তাঁর খাওয়া আমরা দেখিনি। আমরা দেখেছি গাবুকে। সত্যনারায়ণ পুজোর সিন্নি গাবুকে দেওয়া হত বালতিসুদ্ধু। লোকেরা যেভাবে চুমুক দিয়ে দুধ খায়, গাবুও তেমন করে দেড়-দু’বালতি সিন্নি সাবাড় করে দিত চোদ্দো বছর বয়সেই।

গোপেন মিত্তিরের মায়ের শ্রাদ্ধে গাবু যা খেল, তাতে গোটা পাড়ায় তার খ্যাতি ছড়িয়ে গেল। গাবু ছিল শ্মশানবন্ধু, অর্থাৎ শবযাত্রায় সেও গিয়েছিল। কিন্তু ওকে গোপেনবাবু বসালেন শেষের ব্যাচে। গাবু খেতে আরম্ভ করল। প্রথমে খান-বিশেক লুচি খেল। তারপর এটা-ওটা খাওয়ার পর এল দই আর মিহিদানা। গোপেনবাবু বললেন, “ওকে গোটা হাঁড়িটা দে।”

তাই দেওয়া হল। দইয়ের হাঁড়ি থেকে খানিকটা দই খেয়ে গাবু বলল, “এ বার মিহিদানা দাও।”

দইয়ের হাঁড়িতে মিহিদানা আর দই নিয়ে এমন ভাবে মাখল যেন খিচুড়ি খাচ্ছে। তিন হাঁড়ি দই আর দুই ডাবু-হাতা মিহিদানা শেষ হতেই মাতৃদায়গ্রস্ত গোপেন মিত্তিরের সদ্য ন্যাড়া মাথায় ঘাম জমতে শুরু করল। গোপেনবাবু কাতর গলায় বললেন, “বাবা গাবু, দই ছেড়ে রসগোল্লায় যা।”

গাবু কোনও উত্তর দিল না। ভাঁড়ারের দই শেষ হতে গাবু রসগোল্লার দিকে চোখ ফেরাল। গাবুর খাওয়ার গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা আর গুনে উঠতে পারছি না। একসময় গোপেনবাবুর বড় ছেলে হাততালি দিয়ে উঠে বললেন, “হাফ সেঞ্চুরি হয়ে গেল।”

আস্তে আস্তে গোটা গাঁয়ে গাবুর খাওয়ার ব্যাপারটা এমন চাউর হয়ে গেল যে, পাড়ার কোনও বাড়িতে গাবুর নিমন্ত্রণ না হওয়া মানে সেই বাড়ির অনুষ্ঠান খুবই ক্ষুদ্র এবং খাওয়াবার ব্যাপারে গৃহস্বামীর সামর্থ্য কম নতুবা গৃহস্বামী কৃপণ। ফলে লোকচক্ষে লজ্জা ঢাকতে সবাই আগেভাগে গাবুকে নিমন্ত্রণ করে আসত। ভদ্রলোকরা কে আর সবার কাছে গরিব বা কৃপণ হিসেবে পরিচিতি পেতে চায়।

আমরা মাঝেমধ্যে গাবুর পেটে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করতুম, “হ্যাঁ রে গাবু, তুই এত খাস কেমন করে?”

গাবু খুব সরল গলায় উত্তর দিত, “কে জানে কেমন করে হয়। যতক্ষণ খেতে থাকি ততক্ষণ কেবলই খেতে ইচ্ছে করে। চোখের সামনে খাবার দেখলে আরও খিদে বেড়ে যায়।”

একবার পুবপাড়ার কুঞ্জ সাহা তাঁর বাড়িতে অষ্টপ্রহর কীর্তন গানের ব্যবস্থা করলেন। তিন দিনের কীর্তনের পর দুপুর থেকে নারায়ণসেবা। তার মানে খিচুড়ি, নানা তরকারির ঘ্যাঁট আর বোঁদে। গাবু দুপুর বেলা খেতে গেল। সাহাবাবু ওকে দেখেই বললেন, “এসো গাবু, এসো। সবাই এসে অবধি তোমার খোঁজ করছে। দেখি আজ কত খিচুড়ি তুমি খেতে পারো।”

গাবু খুব লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “জ্যাঠাবাবু, আজ একদম পীড়াপীড়ি করবেন না। সন্ধেবেলা ডাক্তারবাবুর নাতির অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন। ওখানে কিছু একটু তো দাঁতে কাটতে হবে।”

সাহাবাবু বললেন, “সে সন্ধেবেলার কথা পরে ভাবা যাবে। কেষ্টনগর থেকে কেত্তনের দলের লোকেরা বসে আছে তোমার খাওয়া দেখবে বলে। আমার বেয়াইমশাই এয়েচেন উলটোডিঙি থেকে। ওঁকেও বসিয়ে রেখেছি তোমার জন্যে। এত কাণ্ডের পর তুমি আমায় হতাশ করবে?”

গাবু সাহাবাবুকে অবশ্য হতাশ করেনি। প্রথমে এক বালতি খিচুড়ি খেয়ে গাবু বলল, “খান তিনেক কাঁচালঙ্কা হবে?”

সঙ্গে সঙ্গে ছ’খানা কাঁচালঙ্কা চলে এল। গাবু দ্বিতীয় বালতি খিচুড়ি শেষ করার পর তরকারির দিকে হাত বাড়াল। এতক্ষণ তরকারির কোনও দরকারই সে বোধ করেনি। চার বালতি খিচুড়ি শেষ করার পর গাবু খুব বিনীতভাবে বলল, “আর একটু হবে?” ঠিক তখনই ভাঁড়ার ঘর থেকে সাহাবাবুর ডাক এল। সেখান থেকে ঘুরে এসে সাহাবাবু গাবুর কানের কাছে মুখ এনে বললেন, “ওবেলা তো ডাক্তারবাবুর ওখানে যেতে হবে। ওখানে মুখ এঁটো না করলে ডাক্তারবাবু খুব দুঃখ পাবেন। এদিকে সবাই তোমার খাওয়া দেখে খুশি। তাই বলছি বাবা, এবার থামলে হয় না?”

গাবু কলাপাতার ওপর থেকে খিচুড়ি কাচিয়ে নিয়ে মুখে দিতে দিতে বলল, “জ্যাঠাবাবু, চাট্টি বোঁদে বলুন।”

সেদিনই রাত আটটা নাগাদ গাবু খেতে বসল ডাক্তারবাবুর বাড়িতে। শুধু গাবুকে পরিবেশন করার জন্যই আলাদা চারটে লোক। তারা অন্যদের কিছুই দেবে না, শুধু গাবুকে পরিবেশন করবে। গাবুকে দিতে দিতে ছেলে চারটে ঘেমে গেল। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারবাবু এগিয়ে এসে বললেন, “গাবু, একটু ধীরে ধীরে হাত চালা, ছেলেগুলো তো পাশ ফিরতে পারছে না। তা মাছ খেলি ক’টা?”

গাবু উত্তর দিল, “খাওয়ার সময় আমি গুনি না। যারা দিয়েছে তারা বলতে পারবে।” কে একজন তখন বলে উঠল, “গাবুর জন্য তিরিশ পিস আলাদা রাখা ছিল। সেগুলো শেষ হতে আরও পনেরো পিস আনতে হয়েছে।”

ডাক্তারবাবু বললেন, “পাঁচের জন্য আর পঞ্চাশ অপূর্ণ থাকে কেন?”

গাবু বলল, “ও-বেলায় এটু খিচুড়ি খেয়েছি কিনা। তবে আপনি গুরুজন, আপনি হুকুম করলে অমান্যি করতে পারব না। দিন আর পাঁচ পিস।”

খাওয়ার জন্য গাবুকে তখন মাঝে মাঝে হায়ারও করা হত। অন্য পাড়া থেকে হয়তো কেউ এসে গাবুর বাবাকে অনুরোধ করত, “আজ্ঞে, আপনার ছেলে গাবুকে একটু চাই। আমাদের সঙ্গে চন্দননগরে বরযাত্রী যাবে আর খেয়ে ওদের পিলে চমকে দেবে। দয়া করে যদি গাবুকে যাওয়ার অনুমতি দেন।”

হায়ারে গেলে অবশ্য গাবু পাঁচটি টাকা আর একখানা ধুতি পেত। ডাক্তারবাবু অবশ্য বলতেন, কারও কারও পেটে জোড়া পাকস্থলী থাকে, গাবুর বোধহয় এক ডজন আছে। আর ওর লিভার, হজম করার যন্ত্রপাতি বোধহয় ফরেন থেকে তৈরি। ছেলেটা এত খায় অথচ একদিনও বদহজমের জন্য একটা ট্যাবলেট নিতে এল না। ওর হজমযন্ত্রটা ভেরি, ভেরি স্ট্রং—মিউজিয়ামে রাখবার মতো।

একবার অন্য পাড়ায় খেতে গিয়ে গাবু তো প্রায় দাঙ্গা বাধিয়ে ফেলেছিল। যদিও সেটা ভাড়াটে খাওয়া নয়, তবুও একরকম হায়ারই বলা চলে। উত্তরপাড়ার চক্রবর্তীবাবুর মেয়ের বিয়ে হল শ্যামনগরে। ছেলেটি বি এ পাস করে বেশ ভাল একটা চাকরি করে। গঙ্গার ধারে বিঘেখানেক জমির ওপর নিজেদের দোতলা বাড়ি। ছেলের বাবা জুট মিলের বড়বাবু। খুব রাশভারী লোক এবং বেজায় দেমাকি। এই বিয়েতে দাবি করে যা নেওয়ার তা তো নিয়েইছেন, সঙ্গে নিয়েছেন নগদ দশ হাজার টাকা। তখন দশ হাজার টাকা মানে আজকের দিনে অনেক, অনেক টাকা। অনেক অনুরোধে এক পয়সাও কম নেননি। উত্তরপাড়ার চক্রবর্তীরা অবশ্য পয়সাওলা লোক। সবই দিয়েছেন, কিন্তু মনে মনে চটেছেনও খুব। তাই বউভাতের দিন ছেলের বাবা কালীপ্রসাদ মুখার্জিকে একটু বেগ দেওয়ার জন্য গাবুকে নিয়ে যাওয়া হল। চক্রবর্তীমশাই গাবুর পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, “বাবা গাবু, পাড়ার মানটা রাখিস। তুই ফিরে এলে তবে আমি খাব। দেখিস, মুখুজ্যে যেন তোর কাছে হাতজোড় করে।”

চক্রবর্তীমশাই বাড়ি রইলেন। তাঁর ভাই আর অন্য আত্মীয়স্বজনরা ভাড়া করা বাসে গাবুকে নিয়ে চললেন শ্যামনগরে। গাবুর জন্য নতুন জামা, প্যান্ট, জুতোও কিনে দিয়েছেন চক্রবর্তীমশাই। গোটা বাসে যত কন্যযাত্রী ছিল সবাই ঘন ঘন গাবুর দিকে তাকাচ্ছিল আর বলছিল, “গাবু, পারবি তো? তোর ওপর চক্রবর্তীবাড়ির মান আর পাড়ার সম্মান।”

কে একজন হুংকার দিয়ে বলে উঠল, “গাবু, আজ তোকে জ্বলে উঠতে হবে। নিজের রেকর্ড নিজেকেই ভাঙতে হবে।”

ব্যাপারটা এমন মনে হচ্ছিল, যেন কোনও ফাইনাল খেলায় একজন দামি স্ট্রাইকারকে ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যার গোলেই টিম শিল্ড পাবে।

বাস থেকে নামবার আগে গাবু চক্রবর্তীমশায়ের ছোট ভাই জীবন চক্রবর্তীকে বলল, “কাকু, আমাদের সঙ্গে তো বাস রয়েছে, তাই আমরা কয়েকটা ব্যাচ পরে বসব। গোটা তিন-চার ব্যাচ হয়ে যাক। আপনারা বলবেন, আগে গাবু খেয়ে উঠুক পরে আমরা বসব।”

জীবন চক্রবর্তী ভেবে দেখলেন বুদ্ধিটা খারাপ বাতলায়নি গাবু। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “তাই হবে।”

তাই হল। যত বার বসতে বলা হয়, জীবন চক্রবর্তী হাতজোড় করে বলেন, “ঠিক আছে ঠিক আছে। আমরা একটু পরে বসছি। সঙ্গে তো বাস রয়েছে, ফেরার ভাবনা নেই।”

সবাই থেকে থেকে গাবুর খোঁজ করে। মন্টু এসে বলল, “ছোটকাকা, গাবু গঙ্গার ধারে ওয়ার্মআপ করছে। ও আজকে ফাটিয়ে দেবে।”

জীবন বলল, “দেখিস, উলটোটা যেন না হয়। এদের আয়োজন কিন্তু বেশ।”

মন্টু বলল, “গাবু যদি ওর আগের স্ট্যান্ডার্ডটাও বজায় রাখতে পারে, নিদেনপক্ষে ছোড়দির বিয়ের রাতের রেকর্ডটা, তাতেই ঢের।”

এই সময় গাবু এসে জীবন চক্রবর্তীকে বললেন, ‘কাকু, এবার সত্যিই খিদে পেয়ে গেছে। এখানকার গঙ্গার হাওয়াটা বেশ। কেবলই খিদে পায়।”

এই সময় খবর এল, সেকেন্ড ব্যাচ শেষ হয়ে থার্ড ব্যাচের পাতা পড়ছে। জীবন বললেন, “গাবু, এটা তো থার্ড! কী করবি?”

গাবু বলল, “ওতেই হবে। আপনারা আমার পরে বসবেন।”

যথারীতি মুখুজ্যেমশাই চুরুট টানতে টানতে এসে বললেন, “এবার আপনারা বসবেন তো?”

জীবন চক্রবর্তী হাতজোড় করে বললেন, “বাড়ির মেয়েরা এখনও জমিয়ে গল্প করছে। আপনি বরং বাচ্চাদের বসিয়ে দিন।”

গুটিসাতেক বাচ্চার সঙ্গে গাবুও বসল। তা বলতে গেলে গাবু তো বাচ্চাই। তখনও চোদ্দো পেরোয়নি।

পরিবেশনের শুরুতেই জীবন চক্রবর্তী মুখুজ্যেমশাইকে শুনিয়ে বললেন, “বাচ্চাদের একটু দেখেশুনে দেবেন।” মুখুজ্যেমশাই যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “জীবনবাবু, এটা কালী মুখুজ্যের বাড়ি। কেমন করে খাওয়াতে হয় সেটা ছেলেদের এক হপ্তা ধরে ট্রেনিং দিয়েছি। আমার অর্ডার দেওয়া আছে, ফেলা যায় ফেলা যাবে, কিন্তু কোনও পাত যেন শূন্য না থাকে।”

পাতে লুচি পড়তেই গাবু বলল, “শুরু করি।”

যে-লোকটা লুচি দিচ্ছিল সে বলল, “লজ্জা কী খোকা, শুরু করে দাও।” বেগুন ভাজা দিতে এসে দ্যাখে, লুচি নেই। লুচি এলে দ্যাখে, বেগুনভাজা নেই। এইরকম বারতিনেক হতেই গাবু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ও জীবনকাকা, এরা তো দিতেই পারছে না। খাব কী!”

কথাটা কানে গেল মুখুজ্যেমশাইয়ের। তিনি গাবুর সামনে এসে বললেন, “কী হয়েছে তোমার?”

গাবু বলল, “লুচি পাই তো বেগুনভাজা আসে না। আবার ভাজা আসতে আসতে লুচি ফুরিয়ে যায়।”

মুখুজ্যেমশাই হাঁক দিলেন। পাতে ছ’টা লুচি পড়ল। দু’খানা লুচি বেগুনভাজা দিয়ে জড়িয়ে মুহূর্তে শেষ করে ফেলল গাবু। মুখুজ্যেমশাই বললেন, “আরও চাই?”

গাবু খুব বিনীতভাবে বলল, “জেঠু, একটু হাত খুলে দিতে বলুন-না। এ যেন পরীক্ষা হলে ব্লটিং পেপার দিচ্ছে।”

মুখুজ্যেমশাই বললেন, “লুচির ঝুড়ি নিয়ে আয়।”

ঝুড়ি এল। মুখুজ্যেমশাই বললেন, “এতে চলবে?”

গাবু বলল, “পাতে ঢেলে দিন।”

গাবুর পাতে লুচির পাহাড় জমে গেল। গাবু বেগুনভাজার ওপর একটু নুন ছিটিয়ে দিয়ে লুচি খেতে লাগল। শেষ হওয়ার পর দেখল মুখুজ্যেমশাইয়ের চুরুট নিভে গেছে। তিনি বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে। গাবু বলল, “আর খানকয়েক হবে?”

মুখুজ্যেমশাই ঢোক গিলে বললেন, “হবে, নিশ্চয়ই হবে। তবে বাবা, এখানে আরও আইটেম আছে। পোলাও, মাছ, মাংস, আলুর দম, পটলের কোর্মা, মাংসের চপ, মানে…”

ঠিক এই সময় জীবন ইশারা করতেই গাবু বলল, “জেঠু, আর কয়েকখানা লুচি খাব।”

মুখুজ্যেমশাই ছুটলেন হেঁশেলের দিকে। তখন মন্টু মারফত একটা চিরকুট এল গাবুর হাতে। তাতে লেখা, “শাবাশ গাবু, তুই লুচি নিয়ে ড্রিবলিং করে যা। নতুন করে ময়দা মাখা হচ্ছে।”

আরও ডজনদুয়েক লুচি খাওয়ার পর পোলাও এল। আলুর দমটা গাবু নিলই না। নতুন চিরকুট পাঠালেন জীবন। “তাতে লেখা, মাংসের চপ শুধু কন্যাযাত্রীদের জন্য। স্টক বেশি নেই। চপকে অ্যাটাক কর।”

পোলাও আর চপ নিয়ে গাবু যখন ত্রাহি ত্রাহি রব তুলে দিয়েছে তখন মুখুজ্যেমশাই বললেন, “খোকা, তুমি মাছ খাবে না? মাংস? এবার না-হয় চপটা ছাড়ো, কচি পেটে এত ভাজা জিনিস কি ভাল?”

মন্টু ফিসফিস করে বলল, “গাবু, অপোনেন্ট ফাউল করলেও রাগ করবি না। তুই চপ সাবড়ে যা।”

গাবু বলল, “চপটা খেতে ভাল লাগছে। আর খান কয়েক হবে জেঠু?”

সঙ্গে সঙ্গে চিরকুট এল জীবনের। “জিতা রহো মেরা লাল! রান্নার ঠাকুরের সঙ্গে মুখুজ্যেমশায়ের ঝগড়া লেগে গেছে। তুই চপ ছাড়িস না। চপ শেষ হলেই ওদের ডিফেন্স ভেঙে যাবে।”

এ বার মুখুজ্যেমশাই নিজে হাতে করে খানপাঁচেক চপ এনে বললেন, “এই নাও।”

গাবু বলল, “জেঠু, আর নেই?”

মুখুজ্যেমশাই মাথা হেঁট করে বললেন, “না বাবা, নেই। ঠাকুররা হিসেবে ভুল করে ফেলেছে।”

কথাটা কানে যেতেই হাতা-খুন্তি নিয়ে ঠাকুর ধেয়ে এল মুখুজ্যেমশাইয়ের দিকে। বলল, “ঠাকুরের বদনাম করছেন কেন? বলেছিলেন তিরিশজন কন্যাযাত্রী। ষাটখানা চপ বানালেই হবে। আমি তো সত্তরখানা বানিয়েছি। তার মধ্যে থেকে সাতখানা আপনারা নিয়ে গেছেন।”

এই সময় জীবন এসে বললেন, “ঠিক আছে, এ নিয়ে গোল করার কী হল? এ তো আমাদের নিজেদের ব্যাপার। গাবু, আর চপ খেতে হবে না। দেখছিস না, চপ বাড়ন্ত। তুই মাছ খা।”

এর মধ্যে কে একজন বোধহয় গাবুকে কলির রাক্ষস বলে ফেলায় মন্টু চিৎকার করে বলে উঠল, “গাবু, উঠে আয়। তোকে রাক্ষস বলেছে।”

গাবু উঠে দাঁড়াল। ছুটে এলেন মুখুজ্যেমশাই। জীবন বলল, “ছিঃ ছিঃ মুখুজ্যেমশাই, এ কী শুনছি। একটা কচি ছেলে দু’-চার পিস চপ বেশি খেয়েছে বলে তাকে রাক্ষস-টাক্ষস বলে আপনার লোকেরা গাল দিচ্ছে? এই আপনার এক হপ্তার ট্রেনিং? এই আপনার আতিথেয়তা? এর পর তো এখানে জলগ্রহণ করা চলে না।”

মুখুজ্যেমশাই হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলেন। গাবুকে বললেন, “বাবা বোসো, মাছ খাও।”

জলসায় যেমন গায়কদের কাছে নানা গানের অনুরোধ জানিয়ে চিরকুট যায় তেমনই ঘন ঘন চিরকুট আসতে লাগল গাবুর কাছে। এই চিরকুটে লেখা, “গাবু, ওদের প্রেস্টিজের পেনাল্টি বক্সে ঢুকে পড়েছিস। মাছের ডিফেন্সটাকে নাড়িয়ে দিয়ে মাংসে ঝাঁপা। পরের ব্যাচে যাতে মাছ কম পড়ে। এত রাত্রে মাছ পাওয়া যাবে না। এখনও চার ব্যাচ বাকি!” মুখুজ্যেমশাই একবার গাবুকে দেখেন পরক্ষণেই হেঁশেলে ছোটেন। খাবার জায়গায় তখন হইচই ব্যাপার। বাজনা থামিয়ে সানাইওলারা পর্যন্ত ছুটে এসেছে। গাবুর খাওয়া আর মুখুজ্যেমশাইয়ের ছোটাছুটি দেখে বাজনদাররা বলল, “আমাদের এখনই খেতে দিন। পরের ব্যাচের আর ভরসা করতে পারছি না।”

গাবু যখন থামল তখন রাত্রি সাড়ে বারোটা। কলকাতার ঠাকুররা ঝগড়া করে সদলবলে চলে গিয়েছে এগারোটা নাগাদ। তখন কন্যযাত্রী-সহ শ’ দেড়েক লোক খেতে বাকি।

মুখুজ্যেমশাই দোতলায় গিয়ে ঘরে দরজা দিলেন। লজ্জায় তিনি আর কাউকে মুখ দেখাতে পারছেন না। কন্যাযাত্রীরা ঠান্ডা পোলাও আর কয়েক টুকরো মাংস, দু’-একটা মিষ্টি খেয়ে দেখা করতে এল মুখুজ্যেমশাইয়ের সঙ্গে। ঘরে তখন বাবা-ছেলেতে তুমুল ঝগড়া চলছে। এ বলে শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে আমার প্রেস্টিজ গেল, বাবা বলেন, পাড়ার লোকের কাছে আমার মান গেল।

মুখুজ্যেমশাই বললেন, “আপনাদের কিছুই খাওয়া হয়নি জানি। তাই আর-একদিন আসতে হবে। তা না হলে আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না। শুধু বড়রাই আসবেন। কচি-কাঁচাদের না আনলেও চলবে।”

গাবু তখন এগিয়ে গিয়ে মুখুজ্যেমশাইকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে বলল, “জেঠু, আমি আসব না?”

গাবুর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে মুখুজ্যেমশাই বললেন, “আসবে, নিশ্চয়ই আসবে। তুমি বাবা এত কিছু চেটেপুটে খেলে, শেষপাতে যদি চাটনির সঙ্গে আমার মাথাটা চিবিয়ে খেতে তা হলে মুখ দেখানোর লজ্জা থেকে বাঁচতাম।”

বাস যখন ছাড়তে যাবে তখন কোমরে গামছা বাঁধা কয়েকটা ছেলে হইহই করে এগিয়ে এল। এরাই এতক্ষণ পরিবেশন করছিল। ওদের হাতে এক গামলা লুচি। ওরা বলল, “খেয়ে যেতে হবে। না খেতে পারলে বাস যেতে দেব না। আমাদের অপমান!”

সবাই গাবুর দিকে তাকাল। ছেলেগুলো কোনও কথা শুনবে না। এ বার গাবু এগিয়ে এসে বলল, “ভালবেসে খাওয়াতে চাইছে, না বলি কেমন করে?”

খান বিশেক লুচি ছিল। মিনিট তিরিশ সময় নিল গাবু। শেষ লুচিটা মুখে পুরে গামলাটা উলটে দিয়ে বলল, “আর আছে?”

ছেলেগুলো কয়েক মুহূর্ত স্থির চোখে গাবুকে দেখল, তারপরেই উলটো দিকে দৌড় লাগাল।

নিজের বাড়িতে এসে এ-হেন গাবুকে বসালাম। জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় থাকিস?” গাবু বলল, “থাকার কোনও ঠিক নেই রে। এই খাওয়াখাওয়ির খেলা দেখিয়ে বেড়াই। গোবরডাঙার কাছে একটা কুঁড়ে আছে। সেখানে মা, বউ আর দুটো বাচ্চা।”

ইতিমধ্যে খবর পেয়ে রিঙ্কির দু’-চারজন বন্ধু আর অন্য ছেলেরাও এসে গেছে নররাক্ষস দেখবে বলে। রিঙ্কির ফরমায়েশ মতো গাবু কাঁচা বেগুন, বাঁধাকপি, শিম আর কলাগাছের টুকরো খেয়ে দেখাল। যখন মাটির ভাঁড় খেতে আরম্ভ করল তখন আমি বাধা দিয়ে বললাম, “ঢের হয়েছে, আর খেতে হবে না। এখন খেলা শেষ কর!”

ঘরের ভিড় পাতলা হতেই আমার বউ একটা কাঁসার থালায় খানবিশেক লুচি নিয়ে এল। সঙ্গে বেগুনভাজা আর আলুর ছেঁচকি।

গাবু অদ্ভুত চোখে লুচিগুলোর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “যদি কিছু মনে না করিস, একটা কথা বলব?”

আমি বললাম, “বল-না কী বলবি?”

গাবু বলল, “এখন আর এসব খেতে পাই না, ভালও লাগে না। তার চেয়ে বরং কাগজে মুড়ে দে, বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। ওরা খাবে।”

আমি বললাম, “ওরা মানে?”

গাবু উত্তর দিল, “আমার মা, বউ আর ছেলে দুটো ওরা তো আমার মতো নররাক্ষস হতে পারল না। ওরা মানুষের মতোই ভাত-রুটি এসব খায়। ওদের চারটে পেটের খিদে মেটাতেই আমাকে এসব খেতে হয়। মানুষ যা খায় সে-খাবার কেউ দেয় না রে! দু’খানা রুটি কেউ দেবেনা, কিন্তু আমাকে কাঁচা খাওয়ার জন্যে এক কিলো বেগুন দেবে। মানুষ যদি মানুষের মতো খাবার খায় তা হলে সেটা ক্ষুধা হয়, খেলা হয় না। পরিবারের অন্যদের ক্ষুধা মেটাবার জন্যই আমাকে খাওয়ার খেলা দেখাতে হয়। মানুষ যা খায় না, খেতে পারে না, আমাকে তাই খেয়ে দেখাতে হয়।”

আমার স্ত্রী বলল, “আপনি খান, আমি বাড়ির জন্য নতুন করে ভেজে দেব।”

গাবু বিষণ্ণ গলায় বলল, “খেতে পারব না। সহ্য হবে না। রাক্ষসের পেটে মানুষের খাবার সয় না বউদি। বড় ছেলেটা বিকেলে উলটোডাঙা স্টেশনে এসে দাঁড়াবে। ওর হাতে খাবারগুলো দিয়ে দেব।”

আমার বুকের মধ্যে কান্না আর বেদনা মিশে কেমন অদ্ভুত ধরনের একটা আক্রোশ তৈরি হচ্ছিল। এই আক্রোশটা কার ওপর সেটা বুঝতে পারছিলাম না। গাবু যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি ঘর থেকে টাকা এনে বললাম, “কিছু মনে করিস না। এটা রাখ।”

গাবু ছলছল চোখে তাকাল। চোখ সরিয়ে নিতে নিতে বলল, “খেলা দেখিয়ে রাস্তার লোকের কাছ থেকে দশ পয়সা, বিশ পয়সা হাত পেতে নিই। আজ বন্ধু হাতে গুঁজে দিলে সেটা নিতে আটকাবে কেন?”

গাবু আস্তে আস্তে চলে গেল। আমার স্মৃতিতে আমাদের পুরনো গ্রাম আর কৈশোরের সেই গাবু বারবার ফিরে আসতে লাগল। রিঙ্কি অবাক চোখে তার বাবাকে দেখছে। আমি জানি রিঙ্কি এখন আর তার বাবাকে বুঝতে পারছে না।

২৯ এপ্রিল ১৯৯২

সকল অধ্যায়

১. ভারত যুদ্ধে পিঁপড়ে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২. বিড়ালের চোখ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ – শিবরাম চক্রবর্তী
৪. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৫. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ‘তেনা-রা’ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. লালটেম – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৯. অশরীরী – লীলা মজুমদার
১০. রাজপুত্তুরের অসুখ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১১. ভূতেরা বড় মিথ্যুক – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১২. রুকু আর সুকু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৩. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
১৪. ম্যাজিশিয়ান – বিমল কর
১৫. ঘণ্টাকর্ণের কান গেল – মনোজ বসু
১৬. খুনি – সমরেশ মজুমদার
১৭. বনকুঠির রহস্য – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৮. একদম রূপকথা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. তারিণীখুড়ো ও ডুমনিগড়ের মানুষখেকো – সত্যজিৎ রায়
২০. অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য – সত্যজিৎ রায়
২১. দেবতার ভর – সুকুমার সেন
২২. মজারুমামা – আশাপূর্ণা দেবী
২৩. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
২৪. গঙ্গারামের কপাল – সত্যজিৎ রায়
২৫. গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুক – সমরেশ বসু
২৬. ভুনিকাকার চৌরশতম্‌ – বিমল কর
২৭. অনুকূল – সত্যজিৎ রায়
২৮. ক্যাপ্টেন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২৯. তুরুপের তাস চুরি – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩০. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩১. রুপোর গাছ – বাণী বসু
৩২. বনঝাউয়ার রহস্য – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৩. জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু
৩৪. একটি লাল লঙ্কা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. টিকটিকি অতীন্দ্রিয় শক্তি ও বেদান্ত বর্ধন -আশাপূর্ণা দেবী
৩৬. নদুস্কোপ – রূপক সাহা
৩৭. আতাপুরের দৈত্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৮. নিখোঁজ চারু – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৯. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪০. কপালের নাম গোপাল – আশাপূর্ণা দেবী
৪১. শিমুলতলার মাধবী লজ – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪২. কানকাটা বাঘ – শৈলেন ঘোষ
৪৩. হিংসুটে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৪. হরিণ-শিকারির বাড়ি – হর্ষ দত্ত
৪৫. অর্জুন হতভম্ব – সমরেশ মজুমদার
৪৬. কেউ কি এসেছিলেন – বিমল কর
৪৭. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৮. মজাদার এক ফুটবল ম্যাচ আর দানাপুরি – বিমল কর
৪৯. চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. বন্ধু – তিলোত্তমা মজুমদার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন