পৌলোমী সেনগুপ্ত
বছর পঁচিশ পরে দেখা। চিনতেও পারিনি।
অশ্বিনীই আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘কী রে, চিনতে পারছিস? আমি অশ্বিনী।’
মানুষ যে কত বদলে যায়, অশ্বিনীকে না-দেখলে বোঝা মুশকিল। ছেলেবেলার চেহারা বয়েসে পালটে যায়। তবু একটা আদল ধরা পড়ে। অশ্বিনীর সবই পালটে গিয়েছে। অনেকক্ষণ নজর করে দেখলে হয়তো তার সামনের দাঁত আর কখনও-কখনও চোখের দৃষ্টিতে পুরনো অশ্বিনীকে একটু-আধটু ধরা যায়।
অশ্বিনী আমার হাত ধরে টানল। বলল, ‘আয়। দোকানে আয়। আমি ধুলুর মুখে শুনেছিলাম, তুই আসছিস।’
ধুলু আমার ভাই। নিজের নয়, দূর সম্পর্কের। বয়েসে অনেক ছোট। শ্রাদ্ধশান্তির ব্যাপারে ধুলুদের বাড়িতেই এসেছি। দিন-দুই থাকার কথা।
দরজির দোকান দিয়েছে অশ্বিনী। বাজারের মধ্যেই। দোকানের নাম রেখেছে ‘মনোরমা’। ছোট দোকান। সাধারণ ভাবে সাজানো-গোছানো। দোকানের পেছনের দেওয়ালে কাঠের তক্তা দিয়ে বাঙ্ক মতন করে নিয়েছে, সেখানে তার দরজি বসে সেলাইমেশিন নিয়ে।
অশ্বিনী আমাকে তার চেয়ারে বসাল। নিজে বসল একটা টুলের ওপর। বলল, ‘কত কাল পরে তোকে দেখলাম, বিজন। কেমন আছিস বল?’
বলার আর কীই বা ছিল। ‘চাকরি-বাকরি, ঘরসংসার, ছোটখাটো অসুখ-বিসুখ নিয়ে সাধারণ মানুষ যেমন করে বেঁচে থাকে সেইভাবেই দিন কাটছে।’ বললাম অশ্বিনীকে। শেষে বললাম, ‘তুই কেমন আছিস তাই বল?’
অশ্বিনী বলল, ‘আমার অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছিস। এই দোকান নিয়ে আছি। চলে যাচ্ছে কোনও রকমে।’ বলে অশ্বিনী উঠল। দাঁড়া, একটু চায়ের কথা বলে আসি। পাকৌড়া খাবি? সেই মতিয়ার দোকানের পাকৌড়া। মতিয়া অবশ্য নেই, তার ভাইপো দোকান চালায়।
অশ্বিনীকে খুশি করতেই আমি মাথা নাড়লাম। অশ্বিনী চলে গেল।
দোকান ফাঁকা। রাত হয়ে আসছে। যদিও মাসটা ফাল্গুন, তবু কলকাতার মতন গরম পড়ে যায়নি। একটু শীতের ভাব রয়েছে।
আমার বারবার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছিল। অশ্বিনী আমার ছেলেবেলার বন্ধু। একসঙ্গে প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে হাই স্কুল পর্যন্ত পড়েছি। খেলাধুলো করেছি একসঙ্গে। থাকতামও এক পাড়ায়।
স্কুল ছাড়বার পর থেকে আর তেমন দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। আমার বাবা চাকরি থেকে রিটায়ার করে ধানবাদ ছাড়লেন। আমিও ছাড়লাম। মাঝে এক-আধবার দু-এক দিনের জন্যে এসেছি। হয়তো ধুলুদের বাড়ি, অশ্বিনীকেও দেখেছি, কিন্তু এবার যেমন দেখলাম সেরকম নয়।
ছেলেবেলায় অশ্বিনী ছিল যেমন হুজুগে তেমনি বেপরোয়া। তার বাবা, আমাদের কামাখ্যাকাকা, ছিলেন রেলের ছোট ডাক্তার। দেখতে বড় সুন্দর ছিলেন। বড়দের সঙ্গে থিয়েটারও করতেন। অশ্বিনী অত সুন্দর ছিল না দেখতে, কিন্তু সুশ্রী ছিল। তার চোখ-নাক ছিল চমৎকার। চেহারাটা অবশ্য গণেশ-গণেশ ছিল। অশ্বিনী বেশ শৌখিন ছিল। ফিটফাট প্যান্ট-শার্ট পরে স্কুলে যেত। তার পকেটে পাট করা রুমাল থাকত। আমরা তখন বাচ্চাদের পকেটে রুমাল থাকার কথা ভাবতেই পারতাম না।
অশ্বিনীর ছেলেবেলা থেকেই শখ ছিল ম্যাজিশিয়ান হবে। ধানবাদের রেলবাবুরা পেল্লায় করে যে একজিবিশান করতেন সেখানে গণপতির ম্যাজিক দেখার পর থেকেই তার মাথায় এই শখ চাপে। অশ্বিনী বটতলার ম্যাজিকশিক্ষার বই আনিয়ে ম্যাজিক শিখত, আর আমাদের দেখাত।
ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে অশ্বিনী অনেকবার মরতে মরতে বেঁচে গেছে। একবার সে কলা খেয়ে মুখ থেকে ছুঁচ বার করতে গিয়ে মরো-মরো হয়েছিল। আর-একবার যা করেছিল, আরও মারাত্মক। কাচের টুকরো চিবিয়ে খেতে গিয়েছিল। বইয়ে পড়েছিল আদার রসে কাচের টুকরো ভিজিয়ে উনুনের পাশে রেখে গরম করে নিলে কাচ হজম করা যায়। সেই কায়দাটা দেখাতে গিয়ে গাল জিভ কেটে যায়-যায় অবস্থা হয়েছিল অশ্বিনীর। ছেলেবেলার এইসব বোকামি সে অবশ্য শুধরে নিয়েছিল, কিন্তু ম্যাজিকের নেশা তার মাথা থেকে যায়নি। আমরা যখন স্কুল ছেড়ে চলে আসি, তখন সে অনেক পাকা ম্যাজিশিয়ান; সরস্বতী-পুজোর দিন স্কুলে সে ম্যাজিক দেখাত।
ম্যাজিশিয়ান অশ্বিনী আজ সাদামাটা একটা দরজির দোকান দিয়ে বসে আছে—এ যেন ভাবাই যায় না। তা ছাড়া তার চেহারা? সেই সুশ্রী, শৌখিন অশ্বিনীর আজ কী বিশ্রী চেহারা হয়ে গিয়েছে। রোগা, হাড়-হাড় চেহারা, মুখ শুকিয়ে বুড়োদের মতন চিমসে হয়ে গিয়েছে, মুখের কথা জড়ানো, মাথার চুল পাতলা, পোশাক-আশাকও একেবারে মামুলি। ওকে দেখলে দুঃখই হয়।
অশ্বিনীর কথাই ভাবছিলাম, এমন সময় অশ্বিনী ফিরে এল। হাতে শালপাতার ঠোঙায় পাকৌড়া। বলল, ‘আমি খাব না, তুই খা। গরম ভাজিয়ে আনলাম। চা আসছে।’
পাকৌড়া খেতে-খেতে আমি বললাম, ‘তোর এই দরজির দোকান কত দিনের?
‘তা বছর ছয়েক হবে।’
মনোরমা নাম দিয়েছিস কেন?’
‘আমার মায়ের নাম মনোরমা।’
আমার খেয়াল ছিল না কাকিমা’র নাম। অপ্রস্তুত হলাম। তারপরই বললাম, ‘তুই আর-কিছু করতে পারলি না? চাকরি-বাকরি? অন্য কোনও ভাল ব্যবসা?’
‘চাকরি করেছি। ভাল লাগত না। ঝগড়াঝাঁটি হত। ছেড়ে দিয়েছি।’
‘কিন্তু এই দরজির দোকানে তোর চলে?’
‘চলে যাচ্ছে। আমার আর আছেটা কী। মা নেই, বাবা নেই। দিদি ছিল। সেও নেই। আমি একলা থাকি। নিজেই রান্নাবান্না করি, খাই।’
এমন সময় চা এল। দেখলাম, অশ্বিনীর জন্যে চা আসেনি। বললাম, ‘তুই চা খাবি না?’
‘না। তুই খা।’
চা খেতে খেতে আমি হেসে বললাম, ‘তোর সেই ম্যাজিক ম্যাজিক ছেড়ে দিয়েছিস?’
অশ্বিনী আমার দিকে তাকাল। পাতা পড়ল না চোখের। একবার যেন দৃষ্টিটা কঠিন ও রুক্ষ হল, তারপর ধীরে ধীরে সেই রুক্ষভাব মোলায়েম হয়ে এসে কেমন যেন মলিন হল।
অশ্বিনী বলল, ‘লোক-দেখানো ম্যাজিক ছেড়ে দিয়েছি।’
কথাটা কানে লাগল। বললাম, ‘তার মানে? ম্যাজিক তো লোকেই দেখে।’
‘ও ম্যাজিক আর আমি দেখাই না।’
‘অন্য ম্যাজিক দেখাস নাকি?’ আমি ঠাট্টা করে হাসলাম, ‘সেটা আবার কী?’
অশ্বিনী ম্লান করে হাসল; কোনও জবাব দিল না কথার।
চা খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এল। অশ্বিনী চুপচাপ। আমার কেমন ভাল লাগছিল না। অস্বস্তি হচ্ছিল। অশ্বিনীর হঠাৎ এমন বোবা হয়ে যাওয়া কেন? সে মাঝে মাঝেই আমায় কেমন করে যেন দেখছে। তা ছাড়া এসে পর্যন্ত লক্ষ করছি, অশ্বিনী কথা বলার সময় মুখের সামনে রুমাল ধরে রাখছে। কী খারাপ অভ্যেস।
অসহিষ্ণু হয়ে আমি বললাম, ‘তুই যেন কী ভাবছিস! আমায় অমন করে দেখছিস কেন?… রুমালটাই বা মুখের সামনে ধরে রেখেছিস কেন?’
অশ্বিনী রুমাল সরাল না। আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল; তারপর বলল, ‘তোকে একটা কথা বলতে পারি। বিশ্বাস করবি?’
‘কী কথা?’
‘শুনলে হাসবি। ভাববি, আমার মাথা খারাপ হয়েছে।’
আমি হেসে ফেলে বললাম, ‘তোর তো প্রথম থেকেই মাথার গোলমাল। ছেলেবেলায় কাচ চিবিয়ে খেতে গিয়ে মরতে বসেছিলি, মনে নেই!’
অশ্বিনী হাসির মুখ করল।
আমি বললাম, ‘তোকে কত বছর পরে দেখছি, অশ্বিনী। আমার ভাল লাগছে না। এই দরজির দোকান, তোর চেহারা, চোখমুখ সব যেন কেমন লাগছে। সত্যি করে বল তো, তোর কী হয়েছে? আমি হাসব না।’
অশ্বিনী বেশ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। নিশ্বাস ফেলল বড় করে। তারপর বলল, ‘তোকে যা বলছি সত্যি করেই বলছি। এক বর্ণও বাড়িয়ে বলছি না। মিথ্যে বলছি না।’
বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অশ্বিনী বলল, ‘বছর আষ্টেক আগের কথা। মা বেঁচে আছে। বাবা নেই। তখন আমি একটা চাকরি করতাম। তবে চাকরিতে আমার মন ছিল না। মন ছিল ম্যাজিকে। ম্যাজিকই ছিল আমার ধ্যান-জ্ঞান। কত টাকা-পয়সাই না খরচ করেছি ম্যাজিকের জিনিসপত্র তৈরি করতে, সাজপোশাক বানাতে। ছোটখাটো একটা দলই তৈরি করে ফেলেছিলাম আমি। এ-সব দিকে—মানে তোর কোলিয়ারিতে, মেলায়, রেলের ক্লাবে, চ্যারিটি শোয়ে আমার ডাক পড়ত। দলবল নিয়ে যেতাম। খেলা দেখাতাম। টাকা-পয়সাও পেতাম। একবার কাতরাসগড়ে আমাদের ডাক পড়ল। কালীপুজোর সময়। খেলা দেখাতে গেলাম দলবল নিয়ে। সঙ্গে একটা বাচ্চা মেয়ে ছিল, তুই চিনবি না, ভজনদার মেয়ে। তার নাম টুনি। দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি স্মার্ট। টুনিকে নিয়ে আমরা দু’-তিনটে খেলা দেখাতাম। তার মধ্যে একটা ছিল হাসি-হুল্লোড়ের, বড় বেতের টুকরির মধ্যে টুনিকে ঢুকিয়ে দেওয়া হত—আর চোখের পলকে ভ্যানিশ হয়ে যেত টুনি, তার বদলে টুকরি থেকে এক জোড়া খরগোশ বেরিয়ে আসত।
অশ্বিনী কথা বলতে বলতে থামল একবার। বাইরের দিকে তাকাল। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘অন্য দুটো খেলার মধ্যে একটা ছিল, টুনি ছুরি দিয়ে আমার জিব কেটে দেবে, রক্ত পড়বে গলগল করে, আবার কাটা জিব জোড়া হয়ে যাবে। সোজা খেলা। তুইও ছেলেবেলায় স্কুলে যাবার সময় রাস্তার ধারে এই খেলা দেখেছিস—মাদারিরা দেখাত। খেলাটাকে চটকদার করার জন্যে আমি টুনির মতন বাচ্চা মেয়েকে দিয়ে খেলাটা দেখাতাম। তাকে খুব ভাল করে খেলাটা শিখিয়েছিলাম।
…সেদিন কিন্তু কী যে হল কে জানে! সহজ খেলা। অজস্রবার দেখিয়েছি। অথচ ওই দিনটাতে সব গোলমাল হয়ে গেল, ভুল হয়ে গেল আমাদের। টুনি আমার আসল জিবে ছুরি চালিয়ে দিল।’
আমি চমকে উঠলাম। বলে কী অশ্বিনী! ওর জিব নেই নাকি? তা হলে কথা বলছে কেমন করে?
আমার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে অশ্বিনী বলল, ‘তুই ভাবছিস, আমার জিব কি কেটে ফেলেছিল টুনি? না। সবটা কাটেনি। জিবের একটা পাশ কেটে গিয়েছিল। তাতেই যা রক্ত পড়েছিল তুই কল্পনাও করতে পারবি না। হাসপাতালেও ছিলাম বেশ কিছু দিন।’
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললাম, ‘সেই থেকে ম্যাজিক ছেড়ে দিয়েছিস?’
মাথা হেলিয়ে অশ্বিনী বলল, হ্যাঁ, ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আসল ব্যাপারটা তো তোকে বলিনি এখনও। আমার জিব ধীরে ধীরে আবার আগের মতন হয়ে এল খানিকটা, ভাবলাম বেঁচে গেলাম। পরে দেখলাম, জিবটা আগের মতন আর হচ্ছে না। রংটা দিন দিন কালো হয়ে যাচ্ছে, আর ধারগুলো কেমন গুটিয়ে থাকে। কথা বলতে আগে বেশ কষ্ট হত। এখন অনেকটা সামলে নিয়েছি।’
কৌতূহল বোধ করে বললাম, ‘দেখি তোর জিব?’
অশ্বিনী মাথা নাড়ল।
আমি বললাম, ‘দেখা না, কী হয়েছে?’
অশ্বিনী আমার চোখে চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘না রে, দেখিস না।’
“কেন?’
‘আমার জিব কাউকেই আমি দেখাই না। মা আমার জিব দেখত, মারা গেল। বাজারের দাস ডাক্তার আমার জিব দেখেছিল—সেও মারা গেল। আমার জিব দেখলে খারাপ হয়। আমি কারুর সামনে জিব দেখাই না।’
আমার বিশ্বাস হল না।
তারপরই মনে পড়ল, অশ্বিনী আমার সঙ্গে কথা বলার সময় আগাগোড়া মুখের সামনে রুমাল আড়াল করে রেখেছিল। সে কোনও কিছুই খায়নি।
অশ্বিনীর কথা আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না, আবার কেমন ভয়ও করছিল। অশ্বিনী কার জিব নিয়ে বেঁচে আছে কে জানে! তার, না অভিশপ্ত কোনও জীবের, কে জানে।
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন