ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

পৌলোমী সেনগুপ্ত

ঝুনুমাসি একদম বেড়াল পছন্দ করতেন না। বেড়ালরা নাকি বড় নোংরা হয়। তারা যখন-তখন ছাদে যায়, ছাইগাদার ওপর ঘোরে, আবার সুযোগ পেলেই টুক করে বিছানার ওপর লাফিয়ে ওঠে। বেড়ালরা এমনই আদুরে যে, বিছানায় না শুলে তাদের ঘুমই আসে না। একদিন তো ঝুনুমাসি তাঁর বিছানার ওপর কোথাকার একটা উটকো বেড়ালকে দেখে একেবারে কেঁদেই ফেলেছিলেন।

সেই বেড়ালই একদিন ঝুনুমাসিকেই জব্দ করে দিল।

বাড়ির কাজের লোকদের ঝুনুমাসি হুকুম দিয়ে রেখেছিলেন, বাড়ির ত্রিসীমানায় যেন বেড়াল না আসে! বেড়াল দেখলেই তাড়াতে হবে। একটা গোঁফওয়ালা হুঁড়িমুখো বেড়াল প্রায়ই জানলা দিয়ে উকি মারে, আমরা হইহই করে সেটাকে তাড়া করে যাই!

এত পাহারা-টাহারা দিয়েও শেষ পর্যন্ত কিছু করা গেল না। এর মধ্যেই একদিন সকাল বেলা কী করে যেন একটা বাচ্চা-বেড়াল ঢুকে গেল। ফুটফুটে সাদা রং, টুলটুলে দুটি চোখ, ছোট্ট সেই বেড়ালটা প্রায় একটা উলের বলের মতন ঝুনুমাসিরই খাটের কাছে লাফালাফি করছে।

ঝুনুমাসি একেবারে আঁতকে উঠলেন। চ্যাঁচামেচি করে ডাকলেন সবাইকে। বললেন, “এক্ষুনি তাড়াও, এক্ষুনি বিদেয় করো হতভাগাকে!”

আমরা হ্যাট হ্যাট, হুশ হুশ করলাম। বেড়ালটা যাবার নামই করে না। আমাকে হাততালি দিতে দেখে সে ভাবল বুঝি সেটা একটা খেলা। অমনি হাততালির সঙ্গে সঙ্গে ডিগবাজি দিতে লাগল। তাই দেখে ঝুনুমাসির ছেলে পন্টু হেসে ফেলতেই ঝুনুমাসি তাঁর দিকে কটমট করে তাকালেন। তাঁরপর বললেন, “হাসছিস কী! তোর হাসি দেখলে ও লাই পেয়ে যাবে না? সুখন, বিলু, জটার মা, তোমরা বেড়ালটাকে তাড়াতে পারছ না?”

বেড়ালকে তো ভয় দেখালেই পালায়। কিন্তু এই বেড়ালছানাটা যে একটুও ভয় পাচ্ছে না। আমরা যতই তাড়া করি, ততই সে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে খেলা দেখায়। ও বোধহয় এখনও ভয় পেতেই শেখেনি। সুখনের হাতে মস্ত বড় একটা ডান্ডা, কিন্তু ওইটুকু বেড়ালকে তো আর মারা যায় না! সুখন লাঠিটা নিয়ে ওর পাশে ঠুকতে লাগল। তাতেও ভয় পায় না। ফুড়ুত ফুড়ুত করে তালে তালে লাফায়।

ছোটমাসি বললেন, “উসকো কান পাকাড়কে বাইরে ফেলে দাও।”

বেড়ালটাকে হাতে করে তুলে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কে তুলবে। সবাই তাই ভাবছে। এমন সময় বেড়ালটা ধপাস করে পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বুজে একেবারে স্থির হয়ে গেল।

ঝুনুমাসি ভয় পেয়ে গেলেন। চেঁচিয়ে বললেন, “ওমা, বেড়ালটা মরে গেল নাকি? বাড়িতে বেড়াল মরলে যে ভীষণ পাপ হয়! এই সুখন, তুই ওইটুকু প্রাণীটাকে লাঠি দিয়ে মারলি?”

সুখন জিভ কেটে বলল, “না মাইজি, মা কালীর দিব্যি, আমি একবারও ওকে মারিনি! শুধু ভয় দেখিয়েছি!”।

“তা হলে মরে গেল কী করে? অত বেশি ভয় দেখালি কেন, নিশ্চয়ই হার্ট ফেল করেছে।”

পন্টু বলল, “মরেনি মা, চোখ পিটপিট করছে।”

ঝুনুমাসি ধমক দিয়ে বললেন, “মরেনি, কিন্তু মরতে কতক্ষণ! কী অলুক্ষুনে কাণ্ড! বাড়িতে বেড়াল মরে যাবে? কত পাপ হবে!”

আমি বললাম, “মরবে কেন? এতক্ষণ খেলা করে হাঁপিয়ে গেছে, তাই জিরিয়ে নিচ্ছে।”

ছোটমাসি তক্ষুনি হুকুম দিলেন, “জটার মা, শিগগির এক বাটি দুধ নিয়ে এসো। দুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে নিক, তাঁরপর ওকে ভালয়-ভালয় বাড়ির বাইরে রেখে আসবে।”

জটার মা একটা এনামেলের বাটিতে খানিকটা দুধ নিয়ে এল। ঝুনুমাসি সেটা দেখেই আবার বকুনি দিয়ে উঠলেন, “ওইটুকু দুধে বেড়ালের পেট ভরে? বেড়াল কি তোমার-আমার মতন ভাত খায়? তোমাকে কিপ্টেমি করতে কে বলেছে?”

আবার বাটি ভরে আনা হল। দুধের গন্ধ পেয়েই বেড়ালছানাটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। তারপর দুধ খেতে লাগল চুকচুক চুকচুক শব্দ করে। আমরা গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।

সবটা দুধ শেষ করে সে খুব আরাম করে জিভ চাটল খানিকক্ষণ। পন্টু বলল, “মা, এবার আমি ওকে রাস্তায় ফেলে আসব?”

ঝুনুমাসি বললেন, “রাস্তায় নয়, ফুটপাথে। দেখিস খুব সাবধানে, যেন গাড়ি-টাড়ি চাপা না পড়ে।”

কিন্তু তার আগেই বেড়ালটা এক কাণ্ড করল। সে এক দৌড়ে গিয়ে ঝুনুমাসির পায়ে মাথা ঘষতে লাগল। এবং এই প্রথম সে খুব মিষ্টি করে আস্তে ডাকল, মিউ-উ!

তখনই আমরা বুঝে গেলাম। ওটা মোটেই বেড়ালছানা নয়। ছদ্মবেশী কোনও মহামানব। ও নিশ্চয়ই মানুষের ভাষা জানে। না হলে কী করে বুঝল যে, ঝুনুমাসিই ওকে তাড়াতে চাইছে।

ততক্ষণে ঝুনুমাসি একেবারে গলে জল হয়ে গেছেন। পা সরিয়ে নিলেন না। নরমভাবে বললেন, “আহা রে, মা ষষ্ঠীর জীব, বড় মায়া লাগে! রাস্তাঘাটে কোথায় গিয়ে মরবে! থাক, এখন থাক।”

সেই থেকে বেড়ালছানাটা থেকেই গেল। ঝুনুমাসির সব ঘেন্না চলে গেছে। এখন তিনি উল বুনতে বসলেই বেড়ালটা লাফিয়ে এসে তাঁর কোলে বসবে। পন্টুর চেয়েও তাঁর আদর অনেক বেশি।

প্রথম ক’দিন তাঁর অনেকগুলো নাম রাখা হয়েছিল। মিনি, পুষি, বিধুমুখী, পুঁচকি, গুলগুলি, ভুলভুল, দুষ্টু, মিষ্টি—এইসব। শেষ পর্যন্ত তার নাম হল ফ্লসি। ইংরিজি নামটা ঝুনুমাসিরই বেশি পছন্দ। লোকে কুকুর পুষলেই ইংরিজি নাম দেয়, বেড়ালেরই বা কেন ইংরেজি নাম হবে না? বেড়াল কি কুকুরের চেয়ে কম?

ফ্লসি সারা বাড়ি তুরতুর করে ঘুরে বেড়ায়। সে খুব শৌখিন, কক্ষনও ননাংরা থাকে না। সব সময় সেজে-গুজে ফুটফুটে। ঝুনুমাসি তাকে মাছের কাঁটা খাওয়াবার অভ্যেস করাননি। মাছের কাঁটা ওরা মুখে করে এখানে-সেখানে নিয়ে গিয়ে নোংরা করে। তাই ফ্লসিকে শুধু দুধ খাওয়া অভ্যেস করানো হল। কখনও-সখনও এক-আধ টুকরো মাছ তাকে দেওয়া হয় বটে, তাও কাঁটা বেছে, যাতে সেটা খাওয়ার টেবিলের নীচেই শেষ করে।

ফ্লসি সত্যিই মানুষের কথা বোঝে। বাড়িতে লোকজন এলে ঝুনুমাসি যেই বলেন, “ফ্লসি, একটু নাচ দেখাও তো!” অমনি সে দু হাত তুলে দাঁড়ায়। তাঁরপর টেবিলের একেবারে পাশে একটা বিস্কুট রেখে দিলে সে লাফিয়ে উঠে সেটাকে মুখে করে নেয়। সকলেই অবাক হয়ে যায়। ঝুনুমাসি গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘এত সুন্দর বেড়াল থাকতে কেন যে লোকে কুকুর পোষে, তাও তো বুঝি না!”

প্রথম-প্রথম সে যেখানে-সেখানে, এমনকী দরজার সামনে হিসি করে দিত। ঝুনুমাসি একদিন তার কান ধরে ছাদে নিয়ে গিয়ে একটা কোণ দেখিয়ে বলেছিলেন, “এইটা তোর বাথরুম, বুঝলি পোড়ারমুখী! ফের যদি অন্য জায়গা নোংরা করবি…”

কী আশ্চর্য, তাঁরপর থেকে ফ্লসি ঠিক ছাদেই বাথরুম করতে যায়!

এক বছরের মধ্যে ফ্লসি বেশ বড় হয়ে উঠল। দারুণ সুন্দর হয়েছে চেহারা। রাজকুমারীর মতন সে সগর্বে বারান্দার রেলিংয়ের ফুটোয় মুখ বাড়িয়ে রাস্তা দেখে। কক্ষনও সে রাস্তার বাজে বেড়ালদের সঙ্গে মেশে না। সবচেয়ে মজার হচ্ছে তার চোখ দুটো। তার দুটো চোখ দু’রকম—একটা নীল, আর একটা হলদে। তোমরা বিশ্বাস করছ না? সত্যি এরকম হয়। আমার নিজের চোখে দেখা।

সেবার পুজোর ছুটিতে বাইরে বেড়াতে যাবার সময়েও ঝুনুমাসি ফ্লসিকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। বাড়িতে একা-একা সে কার কাছে থাকবে? ঝি-চাকররা যদি যত্ন না করে? প্রথমে কথা ছিল দার্জিলিং যাবার। কিন্তু বেড়াল কি অত ঠান্ডা সহ্য করতে পারবে? বেশি শীতে যদি ফ্লসির লোম উঠে যায়? তাই মত বদলে ঝুনুমাসি দার্জিলিং না গিয়ে ঘুরে এলেন পুরী থেকে।

ঝুনুমাসিরও এক মাসি আছেন। তাঁর নাম টুনুমাসি। ইনিও কিন্তু খুব বড় নন। ঝুনুমাসিরই প্রায় সমান বয়েসি। এই টুনুমাসি অনেক দিন ধরে থাকেন দিল্লিতে, কয়েক দিনের জন্য এসেছেন কলকাতায়। একদিন বেড়াতে এলেন ঝুনুমাসির বাড়িতে। অনেক দিন পরে এসেছেন তো, তাই সকলেরই খুব আনন্দ। কথা বলতে বলতে তিনি বসবার ঘরের সোফার ওপর বসে পড়েই ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওরে বাবারে, একী?”

কেউ লক্ষ করেনি, ফ্লসি শুয়ে ছিল সোফার এক কোণে। এ বাড়ির সব জায়গায় তাঁর অবাধ অধিকার। টুনুমাসি না দেখে বসে পড়েছেন ফ্লসির গায়ের ওপর। ফ্লসিও ভয় পেয়ে ডেকে উঠছে মা-অ্যা-ও!

টুনুমাসি তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললেন, “এ ম্যাগো! একটা বেড়াল এলো কোখেকে! অ্যাঁঃ? দেখলেই ঘেন্না লাগে। এই যা, যাঃ!”

ফ্লসি যাবে কেন? তাঁর জ্ঞান হবার পর কেউ তো কখনও তাকে তাড়িয়ে দেয়নি। সে গ্যাঁট হয়ে বসে রইল। টুনুমাসি তখন ফ্লসির ঘাড় ধরে তুলে বেশ জোরে ছুঁড়ে দিলেন মাটিতে। বললেন, “যা, বেরোঃ! দূর হ!”।

আমরা সবাই আড়ষ্ট হয়ে রইলাম। ফ্লসির এরকম অপমান! কেউ কোনও দিন তাকে ছুঁড়ে ফেলেনি। ঝুনুমাসির মুখখানা থমথমে।

টুনুমাসি বললেন, “কলকাতাতে বড্ড বেশি বেড়াল। আমাদের দিল্লিতে এ-উৎপাত নেই! বেড়াল দেখলেই আমার এমন ঘেন্না করে।”

ঝুনুমাসি বললেন, “তুমি অত জোরে ছুঁড়ে দিলে? যদি পা-টা ভেঙে যায়!”

“ওদের আবার পা ভাঙবে! ছাদ থেকে ফেলে দিলেও মরে না! সারা বাড়ি নোংরা করে, অসুখ- বিসুখ ছড়ায়।”

এক বছর আগে ঝুনুমাসিরও ঠিক এই মতই ছিল। সেটা যে এর মধ্যে বদলে গেছে সেটা আর টুনুমাসি জানবেন কী করে! সুতরাং তিনি আরও কিছুক্ষণ বেড়ালের নিন্দে করে গেলেন। ঝুনুমাসি শুধু একবার বললেন, “সব বেড়াল এক রকম হয় না!”

যাই হোক, একটু বাদেই টুনুমাসি দিল্লির গল্প শুরু করতেই বেড়ালের কথা চাপা পড়ে গেল। আমরা সবাই রাত দশটা পর্যন্ত গল্পে মশগুল হয়ে রইলাম।

সে-রাত্রে আর ফ্লসিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। টুনুমাসি তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবার পর সে দৌড়ে ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। আর তাকে দেখা যায়নি। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা ফ্লসিকে খোজাখুঁজি করলাম। ঝুনুমাসি কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন।

পরের দিনও ক্লসি ফিরে এল না। তার পরের দিনও না। একেবারে উধাও হয়ে গেছে।

বেড়ালেরও কি অভিমান হয়? আমাদের সকলের সামনে, এমনকী ঝুনুমাসির সামনেই একজন তাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তক্ষুনি তো আমরা কেউ তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করিনি।! সেই অভিমানে ফ্লসি চিরদিনের মতন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল?

আমরা পাগলের মতন খোঁজাখুঁজি করলাম কয়েক দিন। ঝুনুমাসি সব সময় কান্নাকাটি করছেন। আমাদের মধ্যে একমাত্র পল্টুই তেমন ভালবাসত না ফ্লসিকে। এখন তার মায়ের অবস্থা দেখে দেখে সে নিজেও ফ্লসিকে ফিরিয়ে আনার সব রকম চেষ্টা করল। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতেই পাওয়া গেল না।

দিন সাতেক বাদে ঝুনুমাসি আমাদের কারুকে না জানিয়ে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিলেন।

ফ্লসি, ফিরে এসো!

তোমায় আর কেউ কোনও দিন মারবে না।

তুমি যা চাও তাই পাবে

তোমার জন্য আমি শয্যাশায়ী!

ইতি তোমার মা

ঝুনু

সেই বিজ্ঞাপন পড়ে সবচেয়ে বেশি হাসলেন ঝুনুমাসির বর। আমাদের ছোটমেসসা। তিনি ঝুনুমাসিকে বললেন, “তুমি তো তোমার বেড়ালকে অনেক কিছুই শিখিয়েছিলে জানি! তাকে কি খবরের কাগজ পড়তেও শিখিয়েছিলে নাকি? তার চেয়ে বলো, পুলিশের মধ্যে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, তাদের খবর দেব?”

এই সময় ঠাট্টা-ইয়ার্কি ঝুনুমাসির একদম ভাল লাগে না। তিনি কান্নায় ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললেন, “জানি, তুমি তো ফ্লসি মরে গেলেই খুশি হও! সে কি রাস্তায়-ঘাটে হাঁটতে শিখেছে কখনও। না জানি এত দিনে তাঁর কী হয়েছে!”

শেষ পর্যন্ত ছোটমেসোই লিখে দিলেন খবরের কাগজে আর একটা বিজ্ঞাপন:

হারাইয়াছে! হারাইয়াছে!

একটি ফুটফুটে সাদা রঙের বিড়াল

কপালে শুধু টিপের মতন একটি কালো দাগ

ল্যাজ ঠিক আড়াই ইঞ্চি মোটা

বয়েস এক বছর এক মাস

খুব শান্ত স্বভাব, মাছের কাঁটা খায় না

কেহ সন্ধান দিলে একশো টাকা পুরস্কার!

সেই বিজ্ঞাপন পড়ে দলে দলে লোক আসতে লাগল। প্রত্যেকেরই কোলে একটি বা দুটি বেড়াল, কেউ কেউ থলেতে ভরে অনেকগুলো বেড়ালছানাও আনে। গেটের কাছে আমি, পন্টু আর সুখন মিলে একটি কমিটি বসালাম। সব বেড়াল পরীক্ষা করে দেখি। ফ্লসির মতন সুন্দর একটাও নয়।

ঝুনুমাসিকে নিয়েই হল মুশকিল। উনিও আমাদের কমিটিতে থাকতে চান। তার ফল হল সাংঘাতিক।

দুপুরের দিকে তিনটে ছেলে এল, সঙ্গে একটা জাঁদরেল খয়েরি রঙের বেড়াল। মুখখানা দারুণ রাগী-রাগী। তাকে জোর করে ধরে রাখা হয়েছে।

একটি ছেলে ঝুনুমাসিকে দেখেই বলল, “মাসিমা, আপনার বেড়াল হারিয়েছে? এই নিন!”

ঝুনুমাসি তিন পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, “এটা তো আমার বেড়াল নয়।”

“তাতে কী হয়েছে। বেড়াল তো সবই এক!”

“না, না, আমি আমার সেই বেড়ালটাই শুধু চাই!”

“নিন না, সস্তা করে দিচ্ছি! আপনি একশো টাকা পুরস্কার দেবেন বলেছিলেন তো? পঞ্চাশ টাকা দিন, তা হলেই এটা ছেড়ে দেব!”

“না, অন্য বেড়াল আমার চাই না!”

“তা হলে পঁচিশ টাকা দিন। আচ্ছা, দশ টাকা?”

“বলছি তো, অন্য বেড়াল নেব না আমি!”

ছেলেটি এবার নিরাশ ভাবে বলল, “নেবেন না? ঠিক আছে, তা হলে এটাকে লেকের জলে ডুবিয়ে মারব!”

ঝুনুমাসি ভয় পেয়ে বললেন, “কী করবে?”

“জলে ডুবিয়ে মারব।”

“কেন, মেরে ফেলবে কেন?”

“এটা সাংঘাতিক বদমাস! যেখানেই ছেড়ে দিই, ঠিক বাড়ি ফিরে যাবে! একবার হাওড়ায় ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম। একবার ব্যারাকপুরে। তাও রাস্তা চিনে ফিরে এসেছে! উঃ! এ পর্যন্ত সাতাশখানা মাছ ভাজা চুরি করেছে। একে মারব না?”

ঝুনুমাসি ধমক দিয়ে বললেন, “না, মারবে না ভগবানের জীবকে কেউ কখনও এমনি-এমনি মারে?”

দশ টাকা দিয়ে সেই বিশ্রী বিড়ালটা রাখতে হল আমাদের।

এর পরে এল একজন বুড়ো-মতন লোক। সঙ্গে দুটো বেড়াল। তার মধ্যে একটাকে দেখতে প্রায় ফ্লসিরই মতন। আমরা খুব উৎসাহী হয়ে উঠলাম। কপালে সেই কালো রঙের দাগটা পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু পন্টু সেই জায়গাটায় আঙুল দিয়ে ঘষতেই দেখা গেল রং উঠে আসছে। ওটা এঁকে আনা হয়েছে। তা ছাড়া ফ্লসি কখনও আমাদের দেখে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে?

ধরা পড়ে যাওয়ায় বুড়ো লোকটি একটু দুঃখিত ভাবে বললেন, “যাঃ, তাও মিলল না। সারা শহর খুঁজে খুঁজে সাদা বেড়াল ধরে আনলাম!”

তারপর তিনি বেড়াল দুটোকে মাটিতে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “যাঃ, যা!”

আমরা বললাম, “এ কী! এখানে বেড়াল ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? এখানে ছাড়া চলবে না!”

লোকটি এবার রেগেমেগে বললেন, “তা হলে কি আমি ফেরত নিয়ে যাব নাকি? বেড়াল কি কেউ কখনও ফেরত নেয়? কোনও দিন শুনেছেন?”

সে বেড়াল দুটোও রয়ে গেল এ বাড়িতে। সন্ধের মধ্যে দশ-বারোটি বেড়াল জমে গেল। অনেকেই বেড়াল নিয়ে এসে আর ফেরত নিয়ে যায় না। একশো টাকার পুরস্কারের লোভে রাস্তার ছেলেরা এক-একটা বেড়াল ধরে আনছে রাস্তা থেকে। পুরস্কার না পেয়ে রাগের চোটে সে-বেড়াল ছেড়ে যাচ্ছে এ-বাড়িতেই। দু’-একটা অবশ্য এদিক-ওদিক পালিয়ে গেল। কিন্তু ঝুনুমাসি সব কটার জন্য দুধ বরাদ্দ করে দিলেন। তিনি নিজে থেকে কোনও বেড়ালই তাড়াবেন না!

সন্ধেবেলা দু’জন প্যান্ট-পরা লোক একটা টেম্পো ভর্তি করে নিয়ে এল একশো পঁচিশটা বেড়াল। শাড়ির দোকানে যেমন একটা শাড়ি পছন্দ না হলেই সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা শাড়ি বার করে দেখায়, ওরাও তেমনি এক-একটা বেড়ালের ঘাড় ধরে তুলে জিজ্ঞেস করে, “এটা আপনাদের? এটা নয়? তা হলে এটা?”

এক-এক করে একশো পঁচিশটা বেড়ালই দেখা হল। কোনওটাই ফ্লসি নয়! লোক দুটো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “তা হলে আর কী হবে! চলো হে গঙ্গাচরণ!”

ঝুনুমাসি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা এত বেড়াল পেলেন কোথা থেকে? এগুলো নিয়ে কী করবেন?”

একটা লোক বলল, “আমরা লেবরেটরিতে সাপ্লাই দিই!”

“লেবরেটরিতে? সেখানে কী হয়?”

“সেখানে বেড়ালের ওপর নানা রকম ওষুধ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। এদের কেটেকুটে দেখা হয়। আমরা পার পিস তিন টাকা করে বিক্রি করি।”

“পার পিস মানে?”

“এক-একটা তিন টাকা। ভাবলুম, আপনারটা যদি মিলে যায়, তা হলে একশো টাকা পাওয়া যাবে!”

“তাঁর মানে এতগুলো বেড়ালকে আপনারা মারতে পাঠাচ্ছেন! নামান! গাড়ি থেকে নামান সবগুলোকে!”

সে এক-প্রায় পাগলের কাণ্ড! সারা বাড়িতে প্রায় দেড়শো বেড়াল। কুনুমাসির ধারণা, তাঁর ফ্লসিকেও নিশ্চয়ই কেউ লেবরেটরিতে চালান দিয়েছে। তিনি আমাদের বলতে লাগলেন, “যা, সব লেবরেটরি দেখে আয়। যেখানে যত বিড়াল দেখবি কিনে নিয়ে আয়।”

ছোটমেসো বাত্তিরে বাড়ি ফিরে প্রায় নাচতে লাগলেন। কোথাও পা ফেলার উপায় নেই। সব জায়গায় বিড়াল। তিনি ঝুনুমাসিকে বললেন, “তুমি পাগল হয়েছ, না আমি চোখের ভুল দেখছি? এ কখনও হয়? এটা বাড়ি, না চিড়িয়াখানা? হাটাও, সব কটাকে হাটাও!”

ঝুনুমাসি বললেন, ‘আমি যদি থাকি, তা হলে বেড়ালও থাকবে!”

সারা বাড়িতে ম্যাও মিঁয়াও ক্যাঁও কিঁও চিঁউ ওয়াঁও এই রকম নানারকম ডাক। কত রকম সাইজের কত রকম রঙের বেড়াল। এর মধ্যে মানুষের থাকা সত্যি অসম্ভব। আমরা ভাবলুম, ঝুনুমাসির জন্য ডাক্তার ডাকব কি না!

রাত্তিরে খেতে বসারও উপায় নেই। খাবার টেবিলের চার পাশে দেড়শো বেড়াল। অনেকগুলোই লাফিয়ে টেবিলে উঠে আসছে। সুখন একটা লাঠি নিয়ে সেগুলো তাড়াতে গেলেও যায় না!

হঠাৎ ঝুনুমাসি চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওই তো! চুপ, ওই তো, শোন।”

সেই চিৎকারে সবাই চুপ করে গেল। এমনকী বেড়ালগুলো পর্যন্ত। আমরা শুনতে পেলাম, বন্ধ সদর দরজার বাইরে কে যেন মিষ্টি গলায় ডাকছে, মিঁউ!

ঝুনুমাসি ছুট্টে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। অমনি ফ্লসি ভেতরে এসে ঝুনুমাসির পায়ে মাথা ঘষতে লাগল! ঝুনুমাসি তাকে কোলে তুলে নিয়ে একেবারে কেঁদে ফেললেন। তাকে আদর করে বলতে লাগলেন, “ওরে সোনা, তুই কোথায় গিয়েছিলি, তুই মায়ের ওপর রাগ করেছিলি? আহা তোর বুঝি খুব লেগেছিল সেদিন?”

ঠিক মনে হচ্ছে মা মেয়ের অভিমান ভাঙাচ্ছে।

অন্য বেড়ালগুলো ফ্লসির এই আদর মোটেই ভাল চোখে দেখল না। কয়েকটা বিচ্ছিরি চেহারার হুলো বেড়াল রীতিমতন রাগী চোখে তাকিয়ে রইল।

ছোটমেসো বললেন, “যাক, পেয়েছ তো! তোমার আদরের বেড়ালকে পেয়েছ তো? এবার বাকিগুলো সব তাড়াও!”

কিন্তু বেড়াল তাড়ানো কি সহজ? যে-বাড়িতে বেড়ালকে একবার আদর করে খাবার দেওয়া হয়েছে, সে-বাড়ি ছেড়ে তারা কিছুতেই যাবে না। ঝুনুমাসির কোলে চেপে ক্লসি খুব ভয়ে-ভয়ে তাকিয়ে আছে। এত বেড়াল সেও সহ্য করতে পারবে না।

আমি সুখন আর পন্টু তিনটে লাঠি নিয়ে বেড়ালগুলোকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে বাড়ির বাইরে পাঠাই। একটু বাদেই তারা ঠিক ফিরে আসে। একসঙ্গে অত বেড়ালকে আটকানো অসম্ভব। জানলা দিয়ে, ছাদ দিয়ে ফিরে আসবেই!

আরও দুটো দিন এরকম অবস্থায় কাটাবার পর বোঝা গেল, একটা-কিছু ব্যবস্থা না করলে এ-বাড়িতে থাকাই অসম্ভব। রাস্তায় ঘাটে একসঙ্গে এত বেড়াল ছেড়ে আসা যায় না। লোকেরা আপত্তি করবে। শেষ পর্যন্ত একটা বুদ্ধি মেসোমশাই-ই বার করলেন। রং তুলি নিয়ে অনেকগুলো কাগজে পোস্টার লেখা হল:

প্রদর্শনী, বিরাট প্রদর্শনী

অভূতপূর্ব বিড়াল প্রদর্শনী

ধর্মতলা কার্জন পার্কে আজ সন্ধে ছটায়

আপনার গৃহপালিত বিড়াল আনুন

প্রথম পুরস্কার এক হাজার টাকা

আরও অন্যান্য অনেক পুরস্কার!

এই পোস্টারগুলো মেরে দেওয়া হল কার্জন পার্কের কাছাকাছি সব রাস্তায়। তাঁরপর এ-বাড়ির সবকটা বেড়ালকে ধরে তোলা হল একটা লরিতে। ভোরবেলা সেই লরিভর্তি বেড়াল এনে ছেড়ে দিলাম কার্জন পার্কে। আমরা আর কেউ লরি থেকে নামলাম না পর্যন্ত। যদি কোনও বেড়াল পায়ে এসে আবার লুটিয়ে পড়ে!

লরিটা ছাড়বার পর ছোটমেসো বললেন, “কার্জন পার্কে অনেক ইঁদুর আছে, বেড়ালগুলো ভাল থাকবে। তা ছাড়া প্রদর্শনীতে পুরস্কার পাওয়ার লোভে কেউ কেউ ওদের কটাকে পুষ্যিও নিতে পারে। মোট কথা, ব্যবস্থাটি বেশ ভালই হয়েছে, কী বলো?”

বাড়ি ফিরে ঝুনুমাসিকে সব শোনাতে হল। ফ্লসি তাঁর কোলের কাছে শুয়ে। অন্য বেড়ালগুলো তাড়াবার জন্য ঝুনুমাসি খুব খুশি নন। সব শুনে-টুনে তিনি ফ্লসির গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, “সত্যি-সত্যি একটা বেড়ালের প্রদর্শনী যদি হত, তাহলে আমার ফ্লসিই নিশ্চয়ই ফার্স্ট হত! তাই না?”

আমরা কেউ কোনও প্রতিবাদ করলাম না।

ডিসেম্বর ১৯৭৫

অলংকরণ: সুনীল শীল

সকল অধ্যায়

১. ভারত যুদ্ধে পিঁপড়ে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২. বিড়ালের চোখ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ – শিবরাম চক্রবর্তী
৪. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৫. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ‘তেনা-রা’ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. লালটেম – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৯. অশরীরী – লীলা মজুমদার
১০. রাজপুত্তুরের অসুখ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১১. ভূতেরা বড় মিথ্যুক – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১২. রুকু আর সুকু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৩. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
১৪. ম্যাজিশিয়ান – বিমল কর
১৫. ঘণ্টাকর্ণের কান গেল – মনোজ বসু
১৬. খুনি – সমরেশ মজুমদার
১৭. বনকুঠির রহস্য – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৮. একদম রূপকথা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. তারিণীখুড়ো ও ডুমনিগড়ের মানুষখেকো – সত্যজিৎ রায়
২০. অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য – সত্যজিৎ রায়
২১. দেবতার ভর – সুকুমার সেন
২২. মজারুমামা – আশাপূর্ণা দেবী
২৩. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
২৪. গঙ্গারামের কপাল – সত্যজিৎ রায়
২৫. গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুক – সমরেশ বসু
২৬. ভুনিকাকার চৌরশতম্‌ – বিমল কর
২৭. অনুকূল – সত্যজিৎ রায়
২৮. ক্যাপ্টেন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২৯. তুরুপের তাস চুরি – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩০. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩১. রুপোর গাছ – বাণী বসু
৩২. বনঝাউয়ার রহস্য – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৩. জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু
৩৪. একটি লাল লঙ্কা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. টিকটিকি অতীন্দ্রিয় শক্তি ও বেদান্ত বর্ধন -আশাপূর্ণা দেবী
৩৬. নদুস্কোপ – রূপক সাহা
৩৭. আতাপুরের দৈত্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৮. নিখোঁজ চারু – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৯. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪০. কপালের নাম গোপাল – আশাপূর্ণা দেবী
৪১. শিমুলতলার মাধবী লজ – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪২. কানকাটা বাঘ – শৈলেন ঘোষ
৪৩. হিংসুটে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৪. হরিণ-শিকারির বাড়ি – হর্ষ দত্ত
৪৫. অর্জুন হতভম্ব – সমরেশ মজুমদার
৪৬. কেউ কি এসেছিলেন – বিমল কর
৪৭. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৮. মজাদার এক ফুটবল ম্যাচ আর দানাপুরি – বিমল কর
৪৯. চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. বন্ধু – তিলোত্তমা মজুমদার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন