গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুক – সমরেশ বসু

পৌলোমী সেনগুপ্ত

গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুক – সমরেশ বসু

ভন্ডুল থেকেই ওর নামটা ভুন্ডুল হয়ে গেছে। ভন্ডুল বা ভুন্ডুল, যাই হোক, কথাটার একটা মানে আছে। আর ওই শব্দটা দিয়ে যদি কোনও ছেলের নাম রাখা হয়, তা হলে ব্যাপারটা কীরকম দাঁড়ায়? মনে তো একটা খটকা লাগেই। কাজ পণ্ড করাও যা, ভন্‌ডুল করাও তাই। কেউ কোনও কাজ নষ্ট করলেই, বা কোনও একটা আয়োজন এলোমেলো করে দিলে, আমরা বলি, সব ভন্ডুল করে দিলে।’ এর অর্থ একটাই। যে ছেলেবেলা থেকেই দুরন্ত আর কেবলই কাজ ভন্‌ডুল করে দেয়, তারই নাম রাখা হয় ভন্ডুল। আর ভন্ডুলই সকলের মুখে মুখে ভুন্ডুল।

কিন্তু আমি যে শ্রীমান ভুন্ডুলের কথা বলছি, ওর মতো নিরীহ শান্ত ভালমানুষ ছেলে, গোটা মফস্‌সল শহরে আর পাড়ায় একটিও আছে বলে মনে হয় না। ভুন্ডুলের ভাল নাম রজত ঘোষাল। শহরের হাইস্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। লেখাপড়ায়ও ও খুব ভাল না হলেও খারাপ বলা চলবে না কোনও মতেই। এক রকমের ছেলে আছে, সাতে-পাঁচে নেই, ভুন্ডুল হল সেই রকমের ছেলে। ও কোনও ক্লাবের মেম্বার নয়। খেলাধুলোয় ওর কোনও টান নেই, আর তা নিয়ে কোনও দলাদলির মধ্যেও নেই।

ভুন্ডুলের স্বাস্থ্যটা অবশ্য কোনও দিনই বিশেষ ভাল নয়। রুগ্‌ণ বললে যা বোঝায়, ঠিক তা না হলেও, ছেলেটা রোগাই। দৌড়ঝাঁপ করা তেমন পছন্দ করে না। তবে ওর রোগা আর মোটামুটি মাথাচাড়া দেওয়া লম্বা ধাঁচের চেহারাটা সুন্দর। চোখ দুটো বেশ ডাগর। নাকটি চোখা। গায়ের রং খুব ফরসা না হলেও, বেশ উজ্জ্বল। কোনও ক্লাবের মেম্বার না হলেও, ও লাইব্রেরির মেম্বার। বই পড়তে খুব ভালবাসে। আর চোখ দুটো ওর ডাগর বটে, কিন্তু সেই ডাগর চোখজোড়া সব সময়েই যেন নানান আশ্চর্য স্বপ্নের ঘোরে ঝকঝক করে। ওর বন্ধুবান্ধব প্রায় নেই বললেই চলে। শহরের মাত্র দু-তিনটি ছেলের সঙ্গে ওর ভাব আছে। আসলে ভুন্ডুল সব সময়ে ওর নিজের জগৎ নিয়েই আছে। আর সেই জগৎটা এমনই, অন্যান্য ছেলেরা যা দেখতে পায় না, ও তাই দেখতে পায়। কেউ যদি সেগুলোকে আজগুবি বলে উড়িয়ে দিতে চায়, দিতে পারে। তাতে ভুন্ডুলের কিছু যায় আসে না।

ভুন্ডুলের সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব বোধহয় এখনও ওর মায়ের সঙ্গেই। আর ওর মাই ওকে সবচেয়ে ভাল বোঝেন। তার সঙ্গে ওর কথাও হয় অনেক। মা মাঝে-মাঝে হেসে বলেন, “ভুন্ডুলের সবই ঠিক আছে। কেবল ওর ব্রহ্মতালুটা সব সময়েই একটু বেশি তেতে থাকে। আর মনটা রাজ্যের দুঃখী-গরিবের জন্য কাঁদে।”

মায়ের দুটো কথাই ঠিক। ভুন্ডুলের মাথার চাঁদি গরম থাকারই কথা। কারণ, চোখ মেলে ও যে কত রকমের আশ্চর্য ব্যাপার সব দেখতে পায়, আর কত রকমের উত্তেজিত স্বপ্নময় সব উদ্ভট চিন্তা মাথায় খেলা করে, ওর ব্রহ্মতালু তেতে থাকবেই। আর ওই কথাটাও সত্যি। যত রাজ্যের দুঃখী ছেলেদের অদ্ভুত সব দুঃখের আর কষ্টের ঘটনা ওরই চোখে পড়ে। আর সে সবের মধ্যে ও যেন কেমন সহজেই জড়িয়ে পড়ে।

ভুন্ডুল অঙ্কে কোনও কালেই ভাল ফল করতে পারে না। বলতে গেলে, ও অঙ্ক বিষয়টিকে ভয়ই পায়। এ-বিষয়ে অনেক ছেলের সঙ্গেই ওর মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু অঙ্কের চেয়েও, ও অনেক বেশি ভয় পায় অঙ্কের স্যার গোরক্ষনাথবাবুকে। এক-একজন মানুষকে দেখলে বা তার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই, কেমন যেন একটা অলৌকিক ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে, ভুন্ডুলের কাছে অঙ্কের স্যার গোরক্ষনাথবাবুও সেইরকম। অথচ, এমন নয় যে, গোরক্ষনাথবাবু ভুন্ডুলের ওপর রেগে থাকেন। আসলে তিনি এমনিতে কারও ওপরেই রেগে থাকেন না। তবে, অঙ্ক শেখাবার সময় কেউ গোলমাল করলে তিনি ভীষণ চটে যান। তখন তার মাথার ঠিক থাকে না। হাতের ডাস্টারও অনেক সময় ছুঁড়ে মারেন। আর অমনোযোগী ছেলেদেরও তিনি দু’চক্ষে দেখতে পারেন না।

ভুন্ডুলের সেদিক থেকে কোনও ভয় নেই। গোরক্ষনাথ নামটাই ওর কাছে কেমন অস্বস্তিকর লাগে। তা ছাড়া গোরক্ষনাথবাবুর চেহারাটা দোহারা চওড়া, আর কালো কুচকুচে। তাতেও ভুন্ডুলের কিছু যায়-আসে না। কুচকুচে কালো মানুষ তো কতই আছে। কিন্তু তারা কেউ গোরক্ষনাথবাবুর মতো রামগরুড়ের ছানা নয়। গোরক্ষনাথবাবু যে কেবল হাসেন না, তা নয়। মুখটা সব সময়েই যেন রাগে থমথম করছে। যখন খুব রেগে যান, তখন তার ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো যেন হিংস্রভাবে ঝকঝকিয়ে ওঠে। তার চোখ দুটোও যেন কেমন জ্বলজ্বলিয়ে জ্বলে। ভুন্ডুল কিছুতেই সেই চোখের দিকে তাকাতে পারে না। তার মাথার চুলগুলোও কুচকুচে কালো আর যেন ছোট-ছোট সাপের মতো ফণা তোলা।

ভুন্ডুল একলা নয়। অঙ্কের স্যার গোরক্ষনাথবাবুকে ভয় পায় না, এমন ছেলে বোধহয় একটিও নেই। কিন্তু ভুন্ডুলের ভয়টার সঙ্গে, আর সবার ভয়ের একটা তফাত আছে। কারণ ওর ভয়টা হল অলৌকিক। গোরক্ষনাথবাবুর পুরো হাতাওয়ালা সাদা শার্ট আর ধুতি পরা ওই চেহারাটা কি আসল, না নকল? উনি কি সত্যি …?

ভুন্ডুলের মনের জিজ্ঞাসা মনেই থেকে যায়। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়, গোরক্ষনাথবাবু আসলে মানুষের বেশ ধরে ঘুরে বেড়ান কি না। অথচ ও জানে গোরক্ষনাথবাবুর বাড়ি ওদের শহরেরই বেশ দূরের এক প্রান্তে। ভুন্ডুল সেদিকে যায় না। শুনেছে গোরক্ষনাথবাবুর ছেলেমেয়েও নাকি আছে। পাশাপাশি শহরের, অন্য শহরের স্কুলে তারা পড়ে। কিন্তু ভুন্ডুল দিব্যি গেলে বলতে পারে, গোরক্ষনাথবাবু আর দশজন স্যারের মতো নন তো বটেই, সাধারণ মানুষের মতোও নন।

ভুন্ডুলের এরকম ভাববার অনেক কারণ আছে। মজাটাও সেখানেই। যে-গোরক্ষনাথবাবুকে ওর সবচেয়ে বেশি ভয়, সেই ভয়ংকর লোকটির দিকেই ওর নজর থাকে বেশি। ও অনেক দিন দেখেছে, গোরক্ষনাথবাবু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে পড়েন। এমনিতেই রাস্তা চলবার সময় উনি কোনও দিকে তাকান না। যেন একটা ঘোরের মধ্যে হনহনিয়ে চলেন। চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ান। যেন রাস্তায় সামনে এমন কিছু দেখেছেন, না দাঁড়িয়ে উপায় নেই। কিন্তু রাস্তায় কিছুই থাকে না। ভুন্ডুল অবাক হয়ে দেখেছে, গোরক্ষনাথবাবু যেন কেমন একটা দোটানায় পড়ে যান। সামনে পা বাড়াতে গিয়েও বাড়াতে পারেন না। তারপর হঠাৎ কিছু যেন ভাবতে আরম্ভ করেন। এমনকী বা হাত তুলে কর গুনে কী যেন হিসেব করেন। তার পরে মুখ তুলে চারদিকে সাবধানে একবার তাকিয়ে, আস্তে আস্তে কয়েক পা পেছিয়ে যান। পকেট থেকে টেনে বার করেন ছোট্ট একটা নোটবুক। বুক পকেট থেকে কলম নিয়ে, নোটবুকের পাতা খুলে, খুব তাড়াতাড়ি কী যেন লেখেন। তার পরে কোনও কোনও দিন উল্টো দিকে ফিরে চলে যান। নয়তো বেশ খানিকটা ডাইনে অথবা বাঁয়ে গিয়ে, সামনের দিকেই হনহন করে চলতে থাকেন।

কোনও স্বাভাবিক মানুষ কি এ রকম করতে পারেন? ভুন্ডুলের চোখে, গোরক্ষনাথবাবু অলৌকিক ভীতিজনক মানুষ তো বটেই। তার সঙ্গে তাঁর চলাফেরার ওই ধরনের অদ্ভুত ব্যাপার দেখে,ভুন্ডুলের কৌতুহলও দারুণ দানা বেঁধে উঠেছে। আর এই কারণেই, গোরক্ষনাথবাবুকে ও যখনই রাস্তায় দেখতে পায়, প্রায় গোয়েন্দার মতোই লুকিয়ে তার পেছনে ধাওয়া করে। অথচ ধাওয়া করে কোনও ফল হয় না। গোরক্ষনাথবাবু দিশাহারার মতো, হঠাৎ-হঠাৎ রাস্তা বদলে, একটা ছোট শহরের বাইরে আর একটা ছোট শহরের কোথায় যে চলে যান, আর কেনই বা যান, ভুন্ডুলের মাথায় কিছু ঢোকে না। তবুও ভুন্ডুল সহজে তাঁর পেছন ছাড়ে না। কারণ ওর কৌতুহল কিছুতেই মেটে না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, গোরক্ষনাথবাবু কোনও বাড়িতেই যান না। কোনও দোকানপাটেও ঢোকেন না। কেবল পাগলের মতো হনহনিয়ে চলতে চলতে, আবার থমকে দাঁড়ান। যেন তার পায়ের সামনে খুব খারাপ কিছু পড়ে আছে। মাড়িয়ে ফেলার ভয়ে, একেবারে দাঁড়িয়ে পড়েন। অথচ রাস্তায় কিছুই থাকে না। আবার সেই আঙুলের কর গোনা, পেছিয়ে আসা, নোটবুকে চটপট কিছু টুকে নেওয়া এবং তার পরে অন্য দিক দিয়ে পাশ কাটিয়ে হনহনিয়ে চলে যাওয়া।।

ভুন্ডুল অবশ্য লক্ষ করেছে, ঘুরতে ঘুরতে বিশেষ কোনও একটা জায়গায় তিনি আস্তে-আস্তে হাঁটতে থাকেন। আশপাশে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখেন। তখন তিনি হঠাৎ থমকে কোথাও দাঁড়ান না। কিন্তু দাঁড়ান। যেন নিতান্তই চলতে চলতে কিছু একটা কথা মনে পড়ে গেছে। কাছের দু’-একটা বাড়ির দিকে এক-আধবার চোখ তুলে একটু দেখে নেন। তার পরে আবার চলতে আরম্ভ করেন। কেন এরকম ঘোরেন, কী জন্য, ভুন্ডুল আজ অবধি কিছুই বুঝতে পারেনি। মাঝে-মাঝে ওর সন্দেহ হয়, গোরক্ষনাথবাবুর মাথাখারাপ। অবশ্য, এ সন্দেহটা ওর একলার নয়। ছাত্রদের মধ্যে তো বটেই, মাস্টারমশাইদের মধ্যেও অনেকের ওই রকম একটা সন্দেহ আছে। সংস্কৃতের স্যার তো স্পষ্টতই বলেন, “পাগলা গোরক্ষনাথবাবা।”

তবে এটাও ভুন্ডুলের মনে হয়, যিনি ওইরকম চমৎকার অঙ্ক বোঝান, তার মাথা খারাপ কী করে হয়? শুধু যে ভাল বোঝান, তা নয়। ভুন্ডুলের মনে হয়, গোরক্ষনাথবাবু অঙ্ক বিষয়টিকে ভালবাসেন। সেজন্যই যেমন যত্ন করে অঙ্ক শেখান, তেমনি কেউ অবহেলা করলে, ভীষণ রেগে যান। আবার কোনও ছেলে যখন একটা কঠিন অঙ্ক ঠিক-ঠিক কষে দেয়, তার ওপর গোরক্ষনাথবাবু খুব খুশি। অবশ্য তিনি হাসেন না, ছেলেটিকে ডেকে আদরও করেন না। কেবল একটি কথাই বলেন, “হুঁ, তুই ঠিক আখের রস চিবিয়ে খেতে শিখেছিস।”

যিনি এ রকম কথা বলেন, তাঁকে মাথাখারাপ ভাবতেও মন পুরোপুরি সায় দেয় না। গোরক্ষনাথবাবু মাঝে-মাঝে আরও একটা কথা বলেন। কোনও একটা অঙ্ক, ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে বুঝিয়ে ছেলেদের দিকে ফিরে তাকান। ঘাড় ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “অলরাইট?”

সেকথার জবাব প্রায় কোনও ছেলেই দেয় না। সবাই এমন একটা ভাব দেখায়, সব অলরাইট। অর্থাৎ সবাই বুঝেছে। আর গোরক্ষনাথবাবু নিশ্চিত হয়ে চেয়ারে বসে একটি কথা বলেন, “অঙ্কই হল সব। অঙ্কের নাগাল যে পাবে, সে সব কিছুরই নাগাল পাবে। আর, এর থেকে সহজ সাবজেক্ট আর কিছু নেই।”

ভুন্ডুল কোনও দিনই শেষের কথাটা মেনে নিতে পারবে না। কারণ অঙ্ককে ও কখনও সহজে ধরতে পারে না। কিন্তু, গোরক্ষনাথবাবুর বাকি ব্যাপারগুলো কী? তিনি কি রাস্তায় চলতে চলতেও অঙ্ক ভাবেন? আর যেই ভাবা, অমনি থমকে দাঁড়ান? হিসেব কি সেইজন্যই কষতে আরম্ভ করেন? নোটবুক খুলে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে তৎক্ষণাৎ কি অঙ্কটাই কষে ফেলেন?

ভুন্ডুল মনে মনে মাথা নাড়ে। আর বলে, “অসম্ভব। ওঁর মধ্যে আছে একটা অলৌকিক ভৌতিক ব্যাপার।” … ভুন্ডুলের আরও বিশ্বাস গোরক্ষনাথবাবুর ছোট্ট নোংরা পুরনো নোটবইটার মধ্যেই সব অলৌকিক ভৌতিক ব্যাপারগুলো লুকিয়ে রাখা আছে। ওই নোটবইটা যদি একবার দেখা যায়, তা হলেই সব বোঝা যাবে। যদি অঙ্ক কষা থাকে, তা হলে অঙ্ক-পাগলা ছাড়া, গোরক্ষনাথবাবুকে আর কিছুই ভাবা যাবে না। কিন্তু ওঁর চেহারা, চলাফেরা, সাদা ঝকঝকে দাঁত, রহস্যময় ঘোরাঘুরি, ও-সবের মধ্যে অঙ্ক পাগলামোর থেকে অন্য কিছুই বেশি আছে বলে মনে হয়। যদিও ভুন্ডুল রোজই গোরক্ষনাথবাবুর পেছনে ঘুরে বেড়ায় না। সব দিন বাইরে তার দেখা পাওয়া সম্ভবও নয়। যেদিন পায়, সেদিন পেছন নেয়। ফল অবশ্য কিছুই পাওয়া যায় না।

ভুন্ডুল শেষ পর্যন্ত মনে মনে একটা মতলব ফেঁদে বসল। ভাবল, মতলবটা যেমন করেই হোক হাসিল করতে হবে। গোরক্ষনাথবাবুর নোটবইটা যেমন করে হোক, একবার দেখতে হবে। কথাটা ভেবেই, ভুন্ডুলের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। গোরক্ষনাথবাবুর নোটবই ও কী করে দেখবে? পকেট মারবে? সে কাজ তো ও জানে না। যার চোখের দিকে তাকাতেই ভয় হয়, তার নোটবই চুরি করে দেখা? সে তো গোখরো সাপের ফণার মুখে হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

দুটো দিন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই, ভুন্ডুলের হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। স্কুলের দোতলায়, পশ্চিম দিকে, মাস্টারমশাইদের ব্যবহারের বাথরুম আছে। তার পাশেও আছে একটা ছোট ঘর। সে-ঘরে একটা নড়বড়ে টেবিল ছাড়া আর কিছুই নেই। ভুন্ডুলের চোখের সামনে ভেসে উঠল কয়েক বারের দেখা একটা ঘটনা। গোরক্ষনাথবাবু রোজই প্রায় একটা সময়ে বাথরুমে যান। বাথরুমে যাবার সময়, তিনি গায়ের জামা আর হাতের ঘড়ি খুলে, টেবিলের ওপর রেখে দেন। পকেট থেকে যে কিছু চুরি যাবার ভয় নেই, সেটা সবাই জানে। স্কুলের দফতরি থাকে কাছেপিঠেই। ছাত্রদেরও ওদিকে যাবার বিশেষ দরকার হয় না। গেলেও, কেউ তেমন লক্ষ করে না।

ভুন্ডুল মনের কথা মনেই রাখল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল। মাস্টারমশাইয়ের পকেটে হাত দিয়ে, তার নোটবই দেখাটা অপরাধ ছাড়া কিছু নয়। অথচ মনের কৌতুহল যেন ভূতের মতোই ওর ঘাড়ে ভর করেছে। ন্যায়-অন্যায় বিচার হারিয়ে ফেলেছে। যেমন করেই হোক, গোরক্ষনাথবাবুর নোটবইটা ওকে একবার দেখতেই হবে। ও মন ঠিক করে ফেলল, আর একটা দিন বাদ দিয়েই, ও ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়ল। সময়টা গোরক্ষনাথবাবুর বাথরুম যাবার সময়। ও ক্লাস থেকে বেরিয়ে আগে গেল মাস্টারমশাইদের বসবার ঘরের দিকে।

সব স্যারদের একসঙ্গে ক্লাসে ক্লাসে যেতে হয় না। কারও কারও কোনও কোনও দিন একটা পিরিয়ড ছুটি থাকে। ভুন্ডুল মাস্টারমশাইদের ঘরের খোলা দরজা দিয়ে দেখল, মাত্র একজন স্যার বসে আছেন। টেবিলের ওপর ঝুঁকে কী একটা বই পড়ছেন। গোরক্ষনাথবাবু নেই। ভুন্ডুল আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে ডান দিকে ক্লাস নাইনের ‘বি’ সেকশনের পাশ দিয়ে পশ্চিমের করিডর দিয়ে চলে গেল বাথরুমের দিকে। ক্লাস নাইনের ‘বি’ সেকশনের শেষেই, একটা টুলের ওপর দফতরি কানাইলালের বসে থাকার কথা। টুল খালি। ভুন্ডুলের বুকের ধুকধুকুনি বেড়ে গেল। ও বাথরুমের সামনের ঘরের খোলা দরজা দিয়ে দেখল, টেবিলের ওপর গোরক্ষনাথবাবুর জামা আর হাতঘড়ি! এ-ঘরের পাশ দিয়েই সোজা পশ্চিমে গেলে, ক্লাস নাইনের ‘সি’ সেকশন।

ভুন্ডুল ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে। টেবিলের সামনে গিয়ে, গোরক্ষনাথবাবুর জামার নীচের দু’ পকেট হাতড়ে, বের করে আনল নোটবুকটা। ওর বুক এত ঢিপঢিপ করছে আর ঘামছে, মনে হল এক্ষুনি দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে। নোটবুকটা নিয়ে চলে যাবার আগে, একবার একটা জায়গার পাতা খুলে দেখে নিল। অঙ্ক কষা থাকলে, নোটবুক দেখে কোনও লাভ নেই। কিন্তু এ কী সাংঘাতিক ব্যাপার। ভুন্ডুল দেখল, ও যে পাতাটা খুলেছে, সে-পাতায় কয়েক লাইন লেখা। বাকি সব খাতা ফাঁকা। কিন্তু সামনের দিকে সব পাতা লেখা-ভর্তি। ও যে পাতাটা খুলেছিল, তার কয়েক লাইনে এই কথাগুলো লেখা রয়েছে, ছ’ মাস গেল না, যম তার দাঁত বের করে হাত বাড়িয়ে খেতে এল। তুতোলির মুখুজ্জেপাড়ার অবিনাশ মুখুজ্জেকে নির্ঘাত ১৭ই আষাঢ় যম রাত্রের মধ্যে মুখে করে নিয়ে যাবে। এ-সবে যে আমার কেন এত খিদে, তা জানি নে।’…

এ-সবের মানে? কিন্তু ভুন্ডুল আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে, নোটবুক আবার জামার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দফতরির টুল তখনও ফাঁকা। নাইন ‘বি: সেকশন থেকে কোনও মাস্টারমশাইয়ের গলা ভেসে আসছে। ও মাস্টারমশাইদের বসার ঘরের পাশ দিয়ে নিজের ক্লাসের বাইরে দরজার সামনে দাঁড়াল। বাংলার স্যার তখন পড়াচ্ছেন। তিনি ভুন্ডুলকে দেখতে পেয়ে ইংরেজিতে বললেন, “কাম ইন।”

ভুন্ডুল ঘামতে ঘামতে ক্লাসে ঢুকে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। বাংলা সাহিত্যের বইটার পাতা খুলে ধরল সামনে। বইয়ের লেখা কিছুই চোখে পড়ছে না। নোটবইয়ের খুদে-খুদে অক্ষরের সেই কথাগুলোই ওর চোখে ভাসছে, ‘ছ’ মাস গেল না, যম তার দাঁত বের করে হাত বাড়িয়ে খেতে এল। তুতোলির মুখুজ্জেপাড়ার অবিনাশ মুখুজ্জেকে নির্ঘাত ১৭ই আষাঢ় যম রাত্রের মধ্যে মুখে করে নিয়ে যাবে। এ সবে যে আমার কেন এত খিদে, তা জানি নে।’

তুতোলি ভুন্ডুলদের উত্তরের পাশের শহর। কিন্তু গোরক্ষনাথবাবুর এ-সব কথার মানে কী? ওর খেয়াল আছে, আজ হচ্ছে ১৬ আষাঢ়। আগামী কালই ১৭ আষাঢ়, তুতোলির মুখুজ্জেপাড়ার অবিনাশ মুখুজ্জেকে ও জানে না। কিন্তু লেখা পড়ে মনে হচ্ছে, আগামীকাল রাত্রের মধ্যেই অবিনাশ মুখুজ্জেকে যমে মুখে করে নিয়ে যাবে। যার একটাই অর্থ, অবিনাশ মুখুজ্জেকে কেউ মেরে ফেলবে। ছ’ মাস আগে কী ঘটেছিল, নোটবুকের লেখা পড়ে তো বোঝার উপায় নেই। কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক কথা হল, এ সবে যে আমার কেন এত খিদে, তা জানিনে। কথাটা পড়েই গোরক্ষনাথবাবুর সাদা ঝকঝকে দাঁতগুলো ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। তার কিসের খিদে? অবিনাশ মুখুজ্জেকে ১৭ আষাঢ় যে-যম নির্ঘাত রাত্রের মধ্যে মুখে করে নিয়ে যাবে, সে-যম কি স্বয়ং গোরক্ষনাথবাবু?

ভুন্ডুল পারতপক্ষে মিথ্যে কথা বলে না। এখন অবস্থাগতিকে, মিথ্যে না বলে পারল না। ও উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলল। বাংলার স্যার ওর দিকে তাকালেন। ও বলল, “স্যার, আমার পেটে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, আমি বাড়ি যাব।”

বাংলার স্যার ভুরু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, “ঠিক আছে। বেশি রোদ না লাগিয়ে বাড়ি যাও, গিয়ে ওষুধ খাও।”

ভুন্ডুল বইখাতা বগলে, ক্লাস থেকে বেরিয়ে, সোজা বাড়ি চলে গেল। ওকে অসময়ে বাড়ি ঢুকতে দেখে, রান্নাঘর থেকে মা বেরিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে ভুন্ডুল, এখনও তো তোর টিফিনের ছুটি হয়নি। বাড়ি চলে এলি যে?”

“আমার শরীর ভাল লাগছে না,” বলতে বলতে ভুন্ডুল ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।”

মা একটু গম্ভীর মুখে ভাবলেন। তার পরে হেসে নিজের মনেই বললেন, “নিশ্চয়ই ভুন্ডুলের বেহ্মতালু তেতেছে।” তিনি আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন।

ভুন্ডুল বাবার আলাদা ঘরটায় ঢুকে বই রেখে খাটের ওপর শুয়ে পড়ল। চোখের সামনে ভাসতে লাগল নোটবুকের সেই খুদে খুদে লেখাগুলো। আগামী কাল রাত্রিটা না গেলে, ও কিছুই ঠিক করতে পারছে না। অথচ মনে মনে এখনই অস্থির হয়ে উঠছে।

মা ভুন্ডুলকে সময়মতো ডেকে খেতে দিলেন। ভুন্ডুল ভাল করে খেতে পারল না। কেবল মাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি তুতোলির মুখুজ্জেপাড়ার অবিনাশ মুখুজ্জেকে চেনো?”

মা বললেন, “কেন চিনব না? তুতোলি তো পাশের গাঁ। অবিনাশ মুখুজ্জেরা বেশ বড়লোক। ওদের বাড়ি দুর্গাপুজো হয়। তুই কি তুতোলির মুখুজ্জেদের দুর্গাপ্রতিমা দেখতে যাসনি কোনও দিন?”

ভুন্ডুল সেকথা মনে করতে পারল না। কেবল মাথা নাড়ল। মা’কে আর কিছুই জিজ্ঞেস করল না। কেবল বলল, “মা, আমি কাল স্কুলে যাব না। হেডমাস্টারমশাইকে তুমি একটা চিঠি লিখে দিলেই হবে।”

মায়ের চোখে দুশ্চিন্তা ফুটে উঠল। তিনি ভুন্ডুলের গালে গলায় হাত বুলিয়ে বললেন, “কেন রে, তোর কি জ্বরটর এসেছে নাকি?”

“না না, সে-সব কিছু নয়,” ভুন্ডুল ঘাড় নেড়ে বলল, “মাথাটা কেমন টিপটিপ ব্যথা করছে, আর কেবলই শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।”

মা তবু উদ্‌বেগের সঙ্গে বললেন, “হয়তো ঠান্ডা লাগিয়েছিস! শুয়ে কি আর তুই সত্যি থাকবি? থাকলে তো ভালই। যাই হোক, সাবধানে থাক। আমি হেডমাস্টারমশাইকে কালকের ছুটির জন্য চিঠি লিখে দেব। কিন্তু তুতোলির অবিনাশ মুখুজ্জের কথা তুই জিজ্ঞেস করলি কেন?”

“এমনি,” ভুন্ডুল মুখ ফিরিয়ে কথা এড়িয়ে ঘরের মধ্যে চলে গেল।

তার পরে ভুন্ডুল শুয়ে বসে কাটালেও, ওর ব্রহ্মতালু যে তেতেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ওর চোখের সামনে কেবল গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুকের খুদে অক্ষরের কথাগুলো ভাসছে। সেইসঙ্গে গোরক্ষনাথবাবুর অলৌকিক চেহারাটা। আজকের দিনটা কেটে গেলেও, পরের দিন, অর্থাৎ ১৭ আষাঢ় যেন আর কাটতে চায় না। বিশেষ করে রাতটা। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, প্রায় শেষরাত্রি অবধি জেগে থেকে, ভুন্ডুলের যখন ঘুম ভাঙল, তখন রীতিমতো বেলা হয়ে গেছে। ও লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে আগেই কলতলায় ছুটে গিয়ে চোখে-মুখে জল দিল। ছোট স্নানের ঘরে ঢুকে দাঁত মেজে নিল তাড়াতাড়ি। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে, ঘরে ঢুকতেই, বাবার সামনেই মা বললেন, “হ্যাঁ রে ভুন্ডুল, তুতোলির মুখুজ্জেপাড়ার অবিনাশ মুখুজ্জের সম্পর্কে তুই কিছু শুনেছিলি?”

ভুন্ডুলকে বাধ্য হয়েই মিথ্যে মাথা নাড়তে হল। মা বললেন, “তুই পরশু লোকটার কথা বললি, আর আজই সকালে শুনলুম, অবিনাশ মুখুজ্জেকে কে নাকি গলায় রেশমি সুতোর ফাঁস জড়িয়ে মেরে ফেলেছে।”

‘অ্যাঁ!” ভুন্ডুল হাঁ করে, দু চোখ বড় করে তাকাল। কিন্তু তার বেশি আর কিছুই বলতে পারল না।

ভুন্ডুলের বাবা একজন সরকারি অফিসার। তিনি যেন একটু বিরক্ত আর সন্দিগ্ধ চোখে ভুন্ডুলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, “কিছুই জানো না তো, পরশু কেন হঠাৎ অবিনাশ মুখুজ্জের কথা বলেছিলে, তা বোঝা যাচ্ছে না। যাই হোক, যা ঘটে ঘটুক, বাইরে যদি কিছু পরশুদিন শুনেও থাকো, এখন থেকে আর একটি কথাও বলবে না। অবিনাশ মুখুজ্জের নামও মনে আনবে না।”

ভুন্ডুল নিরীহ ভঙ্গিতে ঘাড় ঝাঁকিয়ে, অন্য ঘরে চলে গেল। ওর ব্রহ্মতালু এখন দপদপ করে জ্বলছে। গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুকে তা হলে সত্যি কথাই লেখা ছিল। তিনি জানতেন? না কি তিনি নিজেই…ভুন্ডুলের চোখের সামনে নোটবুকের শেষের কথা ক’টি ভেসে উঠল, এ সবে যে আমার কেন এত খিদে, তা জানিনে।’ …খিদে। কীসের খিদে। তার চওড়া কালো মুখ আর ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলোর কথা মনে পড়লেও, অবিনাশ মুখুজ্জেকে তো কেউ চিবিয়ে খায়নি। গলায় রেশমি সুতোর ফাঁস দিয়ে মেরেছে। গোরক্ষনাথবাবু একথাটা নির্ঘাত জানলেন কেমন করে?

বাবা অফিসে যাবার জন্যে তৈরি হতে-হতেই, ভুন্ডুলও স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিল। বাবা বেরিয়ে যাবার পরে ও মাকে বলল, “মা, তুমি হেডমাস্টারমশাইকে চিঠিটা লিখে দিয়ো।”

“চিঠি আমি লিখে রেখেছি,” মা বললেন, “তুই খেতে বোস। আমি চিঠিতে লিখে দিয়েছি, তোর আজও যদি শরীর খারাপ লাগে, তা হলে যেন ছুটি দিয়ে দেন। যা রুগ্‌ণ ছেলে তুই, তোকে বিশ্বাস নেই।”

ভুন্ডুল কোনও রকমে খেয়ে ছুটতে ছুটতেই স্কুলে গিয়েও তুতোলির অবিনাশ মুখুজ্জের খুনের কথা শুনল। ওর তখন গোরক্ষনাথবাবুকে দেখবার দারুণ কৌতুহল জাগছিল। ও মাস্টারমশাইদের বসবার ঘরের সামনে গিয়ে দেখল, সবাই ক্লাসে যাবার আগে গল্প করছেন। কেবল গোরক্ষনাথবাবু টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে, তাঁর সেই নোটবুকে কী যেন লিখে চলেছেন। পাশেই হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘর। তার মায়ের চিঠি দিয়ে, ভুন্ডুল ক্লাসে ফিরে এল। কিন্তু আজ আবার নোটবুকটা দেখার জন্য ও প্রায় পাগলের মতো অস্থির হয়ে উঠল। দুটো ক্লাস যে কী ভাবে, কী পড়া নিয়ে কেটে গেল, ও জানতেই পারল না। ঠিক সময় বুঝে ও ক্লাস-টিচারের অনুমতি নিয়ে ক্লাসের বাইরে গেল।

এটাই সেই সময়, গোরক্ষনাথবাবু যখন বাথরুমে যান। ঠিক পথেই ও এগিয়ে গেল। আর ওর কপালটাও ভাল, দফতরি তার টুলে ছিল না। ও বাথরুমের পাশের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল। টেবিলের ওপর গোরক্ষনাথবাবুর জামা আর ঘড়ি রয়েছে।

ভুন্ডুল এদিকে-ওদিকে একবার দেখেই, ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। টেবিলের ওপরে রাখা গোরক্ষনাথবাবুর জামার পকেট থেকে নোটবুকটা বের করল। তখনই বাথরুমের মধ্যে জল পড়ার শব্দ শোনা গেল। ও ভয় পেয়ে, নোটবুক নিয়েই ছিটকে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নোটবুকটা ঢুকিয়ে দিল ওর হাফপ্যান্টের পকেটে। তার পরে ওর মনে হল, মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। অবশ্য ক্লাসে গিয়ে ওকে বসতেই হল, আর মিনিটখানেক পরেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, আমার শরীর খারাপ লাগছে। মা হেডমাস্টারমশাইকে লিখে দিয়েছেন, শরীর খারাপ লাগলে যেন আমাকে আজ ছুটি দিয়ে দেন।”

ক্লাস-টিচার বললেন, “তা হলে হেড মাস্টারমশাইকে বলে বাড়ি যাও।”

ভুন্ডুল বইখাতা নিয়ে হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘরের দিকে গেল। মাস্টারমশাইদের ঘরের সামনে গোরক্ষনাথবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। তার দু চোখ লাল, মুখ রাগে থমথম করছে। তার সামনে দফতরি জোড় হাতে দাঁড়িয়ে। বলছে, “বিশ্বাস করুন স্যার, আমি আমার টুল ছেড়ে নড়িনি। ঘরে কেউ ঢোকেনি। আর আপনার পকেটে হাত দেবার সাহস আমার নেই।”

“কিন্তু আমার নোটবুক তা হলে কোথায় গেল?” গোরক্ষনাথবাবু গর্জন করে উঠলেন, “আমার মানিব্যাগ চুরি গেলে কিছু ক্ষতি হত না। কিন্তু আমার নোটবুকের দাম তার চেয়ে অনেক বেশি। আমি এক্ষুনি হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে যাচ্ছি। তিনি যদি কোনও ব্যবস্থা করতে না পারেন, তা হলে আমাকে থানায় যেতে হবে।”

ভুন্ডুলের সাহস ছিল না, গোরক্ষনাথবাবুর মুখের দিকে তাকায়। মাঝখান থেকে ও এমন ঘাবড়ে গেল, হেডমাস্টারের ঘরেও আর যেতে পারল না। সেখান থেকেই ফিরে সোজা একেবারে বাড়ি। মা তো দেখে অবাক। জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে ভুন্ডুল, আবার শরীর খারাপ করেছিস নাকি?”

“হ্যাঁ, মা,” বলেই ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

মা’ও ভুন্ডুলের পেছনে পেছনে ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। ভুন্ডুলের গালে কপালে গলায় হাত বুলিয়ে বললেন, “না, জ্বর আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। তোর কী হচ্ছে বল দিকিনি?”

“সেটাই তো জানিনে মা,” ভুন্ডুল বইখাতা টেবিলের ওপর রেখে বলল, “তবে আমি এখন শোব না। ছাদে গিয়ে, ছায়ায় একটু বসে থাকব।”

মা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, “এ এক অদ্ভুত ছেলে, যার কোনও হাতমাথা খুঁজে পাইনে। ছাদে এখন রোদ। বসতে হয়, চিলেকোঠায় গিয়ে বোস।”

ভুন্ডুল এক মুহূর্ত দেরি না করে ছাদে উঠে গেল। চিলেকোঠার এক কোণে ঠাকুরের জায়গা। ও ঘরে দরজা বন্ধ করে, আগে হাফপ্যান্টের পকেট থেকে নোটবুকটা বের করল। তার পরে দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেয় বসে নোটবুকের পাতা ওলটাল। প্রথম দিন যে-পাতাটা খুলেছিল, আগে সে-পাতাটাই খুলল। দেখল, আগে যা লেখা ছিল, তার পরেও অনেকখানি লেখা রয়েছে। ভুন্ডুল পড়তে আরম্ভ করল, খবরটা আগেই কৌশল করে, বন্ধ খামে থানার বড়বাবুকে লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলুম, তবু অবিনাশ মুখুজ্জে রক্ষা পেলেন না। তার মানে, থানার বড়বাবু আমার বেনামি চিঠিটাকে বিশ্বাস করেনি। উড়ো খবর বলে উড়িয়ে দিয়েছে। এর আগেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। তবু যে কেন থানা আমার বেনামি চিঠির কোনও দাম দেয় না, বুঝিনে। আমি বেনামি চিঠিতে জানাই, কারণ, নিজেকে আড়ালে রাখতে চাই। মামলা-মোকদ্দমার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে চাইনে। শত হলেও, আমি একজন সামান্য স্কুলমাস্টার। ওসব ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে না পড়াই ভাল। কিন্তু আজ অবধি যতগুলো দুর্ঘটনার আন্দাজ আমি পেয়েছি, কোনওটাই মিথ্যে হয়নি। এই যেমন অবিনাশ মুখুজ্জের ব্যাপারটা। লোকটা ছিল খুবই খারাপ। নিজের এক ভাইকে পাগল সাজিয়ে আজ অবধি পাগলা গারদে আটকে রেখেছে। তার সেই ভাই রাসবিহারীকে আমি খুব ভাল করে চিনতুম। সে ছিল আমার বন্ধু। অনেক বছর পাগলা গারদে থেকে এখন সে বোধহয় এমনিতেই পাগল হয়ে গেছে। অবিনাশ খেয়াল করেনি, রাসবিহারীর বড় ছেলে বেশ বুদ্ধিমান। সে তার জ্যাঠার কাণ্ডকারখানা সবই বুঝতে পেরেছিল। সে অনেক দিনই চুপচাপ ছিল। গোলমাল বাধাল অবিনাশ, হঠাৎ সম্পত্তি ভাগ করতে গিয়ে। কথাটা যেদিন আমার কানে এল, সেদিনই আমার অঙ্কের ছকে ধরা পড়ে গেল, অবিনাশের দিন ঘনিয়ে এসেছে। রাসবিহারীর ছেলেকে সে যেভাবে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছে, তার পরিণামে তাকে শেষ হতেই হবে। আমি লক্ষ রেখেছিলুম। রাসবিহারীর ছেলে অবিনাশ-হত্যার জন্য যে-লোকটাকে বেছে নিয়েছিল, সে অতি ধূর্ত এক খুনি। আগেকার দিনের খুনিদের মতোই সে অনায়াসে রাস্তার অল্প ভিড়ের মধ্যেও রেশমি ফাঁস দিয়ে লোক মারতে পারে। অবিনাশকে সে সেইভাবেই বাড়ির বাইরে রাস্তায় মেরেছে। এসব কথাই আমি আগেই থানায় চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলুম। কিন্তু পুলিশ আমাদের কথা বিশ্বাসই করে না। এখন আর চেষ্টা করলেও, অবিনাশ মুখুজ্জের খুন প্রমাণ করতে পারবে না। আমার অঙ্ক তাই বলছে।”

নোটবুকে আর কিছু লেখা নেই। ভুন্ডুল নোটবুকটার দিকে তাকিয়ে, হতভম্ব হয়ে বসে রইল। ওর চোখের সামনে গোরক্ষনাথবাবুর মুখটা ভাসতে লাগল। এতকাল তা হলে অঙ্কের স্যার গোরক্ষনাথবাবুকে ও একেবারে ভুল বুঝে এসেছে! আশ্চর্য, মানুষ চেনা খুবই কঠিন। কিন্তু এখন নিজের কৃতকর্মের জন্য ভুন্ডুল আবার অস্থির হয়ে উঠল। গোরক্ষনাথবাবুকে যেমন করে হোক, ও-নোটবুক ফেরত দিতেই হবে। এ-নোটবুক ফেরত না পেলে, উনি হয়তো পাগলই হয়ে যাবেন। অথচ ভুন্ডুলের এমন সাহস নেই গোরক্ষনাথবাবুর কাছে গিয়ে সত্যি কথা বলে নোটবুক ফেরত দিয়ে আসবে। তার সামনে যাবার কথা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

ভুন্ডুল প্রায় ঘণ্টাখানেক ভাবল। ভেবে, একটা পন্থা ঠিক করল। চিলেকোঠা থেকে নেমে, ও সোজা গেল বাবার ঘরে। বাবার কাজের টেবিলের দেরাজ থেকে বের করল একটা বড় খাম। তার মধ্যে নোটবুকটা ঢুকিয়ে, গদের আঠা দিয়ে ভাল করে মুখ বন্ধ করল। তারপর কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় পড়েই প্রায় ছুট লাগাল গোরক্ষনাথবাবুর বাড়ির দিকে। পৌঁছে গেল দশ মিনিটেই। একতলা বাড়িটা নিঝুম, চুপচাপ। আশেপাশে কয়েকটা গাছপালার ছায়ায় ঢাকা। রাস্তার দিকে ঘরগুলোর তিনটে জানালা খোলা।

ভুন্ডুল সাবধানে চারদিকে দেখে, পকেট থেকে খামটা বের করে, একটা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর ফেলে দিল। দিয়ে পেছন ফিরে দৌড়তে যাবে তৎক্ষণাৎ গোরক্ষনাথবাবুর গলা শুনতে পেল, “এই যে রজত, পালাসনে, ভয় পাসনে। তুই বাড়ির ভেতর আয়। আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।”

ভুন্ডুলের মনে হল, ও তক্ষুনি দম বন্ধ হয়ে, রাস্তায় পড়ে মরে যাবে। তবে গোরক্ষনাথবাবুর গলার স্বরে এমন কিছু ছিল, তাতে যেন একটু ভরসার আভাস আছে। গোরক্ষনাথবাবু বাড়ির ভেতরে যাবার দরজা খুলে দেবে, আবার বললেন, “রজত, আয়। তোর ভয় পাবার কিছু নেই।”

ভুন্ডুল দরদর ঘামছে। ও গোরক্ষনাথবাবুর মুখের দিকে না তাকিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকল। গোরক্ষনাথবাবু দরজা বন্ধ করে ভুন্ডুলকে নিয়ে একটা ঘরে ঢুকলেন। ঘরে কেউ নেই। তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে, প্রথমেই বললেন, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইনে। যা বলার.তা তুই নিজের থেকেই বল।”

ভুন্ডুলের চোখে তখন জল এসে পড়েছে। তার পরে ও সব কথাই বলল। গোরক্ষনাথবাবুকে নিয়ে ওর কৌতূহল, নোটবুক দেখার ভীষণ ইচ্ছে, আর কীভাবে নোটবুক নিয়েছে, দেখেছে, আর কেনই বা নোটবুকটা নিয়ে ওকে পালাতে হয়েছিল, কিছু বলতেই বাকি রাখল না।

গোরক্ষনাথবাবু সব কথা শুনে বললেন, যাক, নোটবুকটা যে তুই ফেরত দিয়েছিস, তাতেই আমার ধড়ে প্রাণ এল। একটা কথা বলে দিই। নোটবুক পড়ে যা জেনেছিস তা ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলিসনে। বললে বিপদে পড়ে যাবি। নোটবুকটার কথাও কাউকে বলিসনে। আরও একটা কথা মনে রাখিস। অঙ্ক জিনিসটা ভারী মজার। সহজও খুবই। অঙ্কের মধ্যে সব পাবি, কেবল হিসেবে যেন গরমিল না হয়। যা, এবার বাড়ি গিয়ে খেয়েদেয়ে ঘুমোগে।”

ভুন্ডুল গোরক্ষনাথবাবুকে এই প্রথম হাসতে দেখল। তখনও ওর চোখে জল। ও গোরক্ষনাথবাবুকে প্রণাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

২৫ জুন ১৯৮৬

সকল অধ্যায়

১. ভারত যুদ্ধে পিঁপড়ে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২. বিড়ালের চোখ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ – শিবরাম চক্রবর্তী
৪. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৫. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ‘তেনা-রা’ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. লালটেম – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৯. অশরীরী – লীলা মজুমদার
১০. রাজপুত্তুরের অসুখ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১১. ভূতেরা বড় মিথ্যুক – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১২. রুকু আর সুকু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৩. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
১৪. ম্যাজিশিয়ান – বিমল কর
১৫. ঘণ্টাকর্ণের কান গেল – মনোজ বসু
১৬. খুনি – সমরেশ মজুমদার
১৭. বনকুঠির রহস্য – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৮. একদম রূপকথা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. তারিণীখুড়ো ও ডুমনিগড়ের মানুষখেকো – সত্যজিৎ রায়
২০. অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য – সত্যজিৎ রায়
২১. দেবতার ভর – সুকুমার সেন
২২. মজারুমামা – আশাপূর্ণা দেবী
২৩. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
২৪. গঙ্গারামের কপাল – সত্যজিৎ রায়
২৫. গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুক – সমরেশ বসু
২৬. ভুনিকাকার চৌরশতম্‌ – বিমল কর
২৭. অনুকূল – সত্যজিৎ রায়
২৮. ক্যাপ্টেন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২৯. তুরুপের তাস চুরি – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩০. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩১. রুপোর গাছ – বাণী বসু
৩২. বনঝাউয়ার রহস্য – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৩. জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু
৩৪. একটি লাল লঙ্কা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. টিকটিকি অতীন্দ্রিয় শক্তি ও বেদান্ত বর্ধন -আশাপূর্ণা দেবী
৩৬. নদুস্কোপ – রূপক সাহা
৩৭. আতাপুরের দৈত্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৮. নিখোঁজ চারু – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৯. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪০. কপালের নাম গোপাল – আশাপূর্ণা দেবী
৪১. শিমুলতলার মাধবী লজ – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪২. কানকাটা বাঘ – শৈলেন ঘোষ
৪৩. হিংসুটে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৪. হরিণ-শিকারির বাড়ি – হর্ষ দত্ত
৪৫. অর্জুন হতভম্ব – সমরেশ মজুমদার
৪৬. কেউ কি এসেছিলেন – বিমল কর
৪৭. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৮. মজাদার এক ফুটবল ম্যাচ আর দানাপুরি – বিমল কর
৪৯. চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. বন্ধু – তিলোত্তমা মজুমদার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন