গঙ্গারামের কপাল – সত্যজিৎ রায়

পৌলোমী সেনগুপ্ত

নদীর ধারে খোলামকুচি দিয়ে ব্যাঙবাজি খেলতে খেলতে হঠাৎ গঙ্গারামের চোখে পড়ল পাথরটা। এ নদীতে জল নেই বেশি; যেখানে সবচেয়ে গভীর সেখানেও হাঁটু ডোবে না। জলটা কাচের মতো স্বচ্ছ, তাই তার নীচে লাল নীল সবুজ হলদে খয়েরি অনেক রকম পাথর দেখা যায়। কিন্তু এমন পাথর গঙ্গারাম এর আগে কোনও দিন দেখেনি। যত রকম রং হয় রামধনুতে, সব রং আছে এই পাথরে। আকারে একটা পায়রার ডিমের মতো। গঙ্গারাম জল থেকে পাথরটা তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে সেটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। বাঃ, কী সুন্দর!’ আপনা থেকেই বেরিয়ে পড়ল তার মুখ থেকে। তারপর সেটাকে সে ট্যাঁকে গুঁজে নিয়ে বাড়িমুখো রওনা হল।

গঙ্গারাম থাকে বৈকুণ্ঠ গ্রামে। তার বাপ-মা মড়কে মারা গেছে যখন, তখন গঙ্গারামের বয়স সাড়ে চার। সে তার মামা গোপীনাথের ঘরে মানুষ হয়েছে। এখন তার বয়স আঠারো। তাকে গ্রামের সকলেই ভালবাসে, কারণ কারও কোনও উপকারে আসতে পারলে গঙ্গারাম সবচেয়ে বেশি খুশি হয়। তাই সকলেই বলে গঙ্গারামের মতো এমন সরল সদাশয় ছেলে আর দুটি হয় না। এ ছাড়া গঙ্গারামের চেহারাটিও ভাল, গ্রামে যাত্রা হলে সে তাতে রাজপুত্তুর সাজে আর অভিনয়ও করে দিব্যি। গঙ্গারামের অবস্থা যে ভাল নয় মোটেই। মামার চাষের জমি আছে কিছুটা, সেটা সে এখন নিজে চষতে পারে না বাতের জন্য, তাই খেতের কাজ গঙ্গারামকেই করতে হয়। যা ফসল হয় তাতে তাদের কোনও মতে চলে যায়। গঙ্গারামের একটা মামাতো ভাই আছে তার চেয়ে তিন বছরের বড়, নাম রঘুনাথ। রঘুনাথ কুসঙ্গে পড়ে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়, তাতে তার শাস্তি হয় তিন বছরের হাজতবাস। সেই তিন বছর কাটতে আর তিন মাস বাকি। বাবা গোপীনাথ বলেছে ছেলেকে আর বাড়িতে ফিরিয়ে নেবে না।

নদীর ঘাটে খেলা সেরে বাড়ি ফেরার পথে গঙ্গারাম একবার সুবলকাকার বাড়ি হয়ে গেল। সুবলকাকার ক’দিন থেকে সর্দিজ্বর। তার একটা পা খোঁড়া, তাই সে লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারে না। গঙ্গারাম তাকে এসে দেখার জন্য শশী কবিরাজকে খবর দেয়, শশী রুগি দেখে ঔষধ বলে দিয়ে যায় চাকুলে পাতার রস। সে পাতাও গঙ্গারাম বনবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে বিছুটির কামড় খেয়ে জোগাড় করে এনে দেয়।

আজ গঙ্গারাম দেখল সুবলকাকা অনেকটা ভাল। একবার মোক্ষদা বুড়ির বাড়িতেও যাবার ইচ্ছা ছিল, বুড়ি গ্রামের এক প্রান্তে একা থাকে সেই জন্য, কিন্তু সুবলকাকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখল আকাশে মেঘের ঘনঘটা।

গঙ্গারাম পা চালিয়ে বাড়িমুখো চললেও বৃষ্টি এড়াতে পারল না। অবিশ্যি বৃষ্টিতে ভিজতে তার ভালই লাগে, কিন্তু ও মা—আজ যে জলের সঙ্গে শিল পড়তে শুরু করল। আর এমন শিল গঙ্গারাম তার বাপের জন্মে দেখেনি। একেকটা শিল যেন একেকটা তাল। ফটাস ফটাস করে রাস্তায় পড়ছে আর ফেটে চৌচির হয়ে বরফ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। যদি একটা মাথায় পড়ে?

মাথায় পড়ল ঠিকই, তবে সেটা গঙ্গারামের নয়। শ্রীনিবাস ময়রার বুড়ো বাপ ভুজঙ্গ লাঠি হাতে ঠক্‌ ঠক্‌ করে যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে, সোজা তার মাথায় একটা শিল পড়ে গঙ্গারামের চোখের সামনে বুড়ো মাথা ফেটে অক্কা পেল। আর তারপর গাঁয়ের কেলো কুকুরটাও মরল মাথায় ওই রাবুনে শিল পড়ে। গঙ্গারাম ভেবেছিল তেলিপাড়ার বুড়ো অশ্বথ গাছটার তলায় আশ্রয় নেবে, কিন্তু সেইসঙ্গে শিল কুড়িয়ে নিয়ে তাতে কামড় দেবার লোভটাও সামলাতে পারল না। অথচ গাঁয়ের সব লোক হয় গাছতলায় না হয় বাড়ির দাওয়ায় আশ্রয় নিয়েছে। দু’ একজন গঙ্গারামকে রাস্তায় দেখে চেঁচিয়ে তাকে সাবধান করে দিল, কিন্তু গঙ্গারাম তাদের কথায় কান দিল না। আর এও ঠিক যে, তার চতুর্দিকে শিল পড়লেও তার গায়ে পড়েনি। গঙ্গারামের কপাল মন্দ বলেই সকলে জানত—যদিও গঙ্গারাম কোনও দিন নিজেকে দুঃখী বলে মনে করেনি—কিন্তু আজ যে ঘটনা ঘটল তাতে বলতেই হয় যে, তার কপাল খুলে গেছে।

এই ঘটনার তিন দিন পরে খেতে জমি চষতে গিয়ে গঙ্গারামের লাঙলে খটাং করে মাটির তলায় কী যেন একটা লাগল। গঙ্গারাম মাটি খুঁড়ে দেখল সেটা একটা পিতলের কলসি, তার মুখটা একটা পিতলের ঢাকনা দিয়ে বন্ধ, আর সেই ঢাকনা একটা লাল কাপড় জড়িয়ে তাকে গেরো দিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে সহজে না খোলে।

খেতে কাজ সেরে গঙ্গারাম কলসিটা বাড়িতে নিয়ে এল। বেশ ভারী কলসি; গঙ্গারামের গায়ে জোর আছে তাই সে বইতে পারল, না হলে দু’জন লোক লাগত।

বাড়িতে এসে কাপড়ের গেরো খুলে ঢাকনা তুলে গঙ্গারাম দেখল কলসিটার ভিতর অনেকগুলো গোল গোল হলদে চাকতি রয়েছে, যেগুলো দিনের আলোতে ঝলমল করছে। গঙ্গারাম চোখে কখনও মোহর দেখেনি, নইলে সে বুঝত যে, সেগুলো সবই মোহর। এই এক কলসির মধ্যে যত স্বর্ণমুদ্রা ছিল তাতে একটা প্রাসাদ বানানো যায়। কিন্তু গঙ্গারাম ভাবল—না জানি এগুলো কীসের চাকতি। যেই ভাবে ছিল সেই ভাবেই পড়ে থাক।

কলসির মুখে আবার ঢাকনা দিয়ে সেটাকে কাপড় দিয়ে বেঁধে গঙ্গারাম খাটের তলায় চালান দিল; মামাকেও বলল না সেটার বিষয়ে কিছু।

এর কদিন পরে আরেকটা ঘটনায় বোঝা গেল গঙ্গারামের কপাল ফিরেছে। মাঝরাত্তিরে গঙ্গারামের পাড়ায় অন্তা ঘোষের বাড়িতে আগুন ধরল। গঙ্গারামের সাতটা বাড়ি পরেই অন্তা ঘোষের বাড়ি। পাড়ার সকলের ঘুম ভেঙে গিয়ে চারিদিকে হইহই চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল, পুকুর থেকে বালতি বালতি জল এনে হাতে হাতে সে জল চালান হয়ে আগুনে ঢালা হল। কিন্তু সর্বগ্রাসী আগুন এক ‘ঘরের চাল থেকে আরেক চালে ছড়াতে লাগল। সাড়ে চার ঘণ্টা লাগল আগুন নেভাতে, কিন্তু আশ্চর্য এই যে, চারপাশের বাড়ি পুড়ে গেলেও গঙ্গারামের বাড়ি সে আগুন ছোঁয়নি। গঙ্গারাম নিশ্চিন্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যাক, বাঁচা গেল! আমাদের বাড়িতে আগুন ধরলে বাতের রুগি মামাটা হয়তো পুড়েই মরত।

এই ঘটনার পর গাঁয়ের লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল গঙ্গারামের সৌভাগ্যের কথা। কেউ কেউ এসে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ রে গঙ্গা, তোর ব্যাপার কী বল তো? তোকে তো চিরদুঃখী বলেই জানি, কিন্তু তোর এমন ভাগ্য ফিরল কী করে?

গঙ্গারাম একগাল হেসে বলে, কপালের কথা কেউ কি কিছু বলতে পারে? ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন বটে, কিন্তু কেন তা তো বলতে পারব না।

গঙ্গারামের একবারও মনে হল না যে, তার ট্যাঁকে যে পাথরটা গোঁজা থাকে সেই পাথরই তার কপাল ফিরিয়ে দিয়েছে।

॥ ২॥

গঙ্গারামের মামাতো ভাই রঘুনাথ হাজত থেকে ছাড়া পেয়ে তার বাড়িতে আসার পথেই হলধরের দোকান থেকে মুড়ি কিনে খেতে খেতে গঙ্গারামের আশ্চর্য কপালের কথা শুনল। শুনে তার মনে হল, এটা কেমন করে হয়? হঠাৎ একটা লোকের ভাগ্য ফিরে যায় কী করে? এ ব্যাপারে একটু খোঁজখবর করতে হবে তো!

খিদে মিটিয়ে বাড়ি ফিরে এসে প্রথমেই তার বাপের কাছে মুখ ঝামটা খেতে হল রঘুনাথের। এ বাড়িতে তোর ঠাঁই হবে না, সোজা বলে দিলেন বাপ, ‘তুই অন্য ব্যবস্থা দ্যাখ।

রঘুনাথ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে দেখল গঙ্গারাম মাঠ থেকে বাড়ি ফিরছে। কী দাদা, অ্যাদ্দিনে ছাড়া পেলে বুঝি?’ গঙ্গারাম জিজ্ঞেস করল রঘুনাথকে। ‘কিন্তু বাপ তোমার উপর খাপ্পা হয়ে আছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করেছ?’

করেছি, বলল রঘুনাথ। আমি এ বাড়িতে থাকার জন্যে আসিনি। আমার অন্য ডেরা আছে কেষ্টপুরে। আমি এসেছি একবার তোর সঙ্গে দেখা করে যাব বলে।

“সে তো ভাল কথা,’ বলল গঙ্গারাম।

‘তোর সঙ্গে একটা কথা ছিল।’

কী কথা?

‘তোর কপাল ফিরেছে বলে শুনলাম। ব্যাপারটা কী?

আমি আর কী বলব দাদা। যিনি মাথার উপর আছেন, তাঁর কখন কী মর্জি হয় তা কি আমরা বলতে পারি?

রঘুনাথ বুঝল যে গঙ্গারাম যা বলছে তা সরল মনেই বলছে। তার কাছ থেকে খুব বেশি কিছু জানা যাবে না। সে পোঁটলা কাঁধে আবার বেরিয়ে পড়ল। কেষ্টপুরে সত্যিই তার একটা ডেরা আছে। তার দলের যে পাণ্ডা, যাকে পেয়াদায় ধরতে পারেনি, সেই মহেশ থাকে কেষ্টপুরে। জেল খেটে রঘুনাথের এবার সৎ পথে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু দুষ্কর্ম তার মজ্জায় ঢুকে গেছে, তাই তার পুরনো দল সে ছাড়তে চায় না।

তবে কেষ্টপুর যাবার আগে সে গেল হরিতাল, অঘোর গনতকারের কাছে। অঘোর শুধু গুনতে জানে না, সে নানারকম মন্তর-তন্তর জানে। লম্বা, চিমড়ে মানুষটা, গায়ের রং একেবারে আলকাতরার মতো, বয়স কত তা কেউ জানে না।।

অঘোর রঘুনাথকে দেখেই বলল, কয়েদখানা থেকে ছাড়া পেলি? তবে তোর কিন্তু কপালে দুঃখু আছে, তোকে আবার হাজতে যেতে হবে। এই বেলা কুসঙ্গ পরিত্যাগ কর।’

‘সে সব কথা থাক, বলল রঘুনাথ। আমি আমার পিসতুতো ভাইয়ের কথা জানতে এসেছি।

‘কে, গঙ্গারাম?

‘তার কপাল ফিরল কী করে বলতে পারেন?’

দাঁড়া, একটু হিসেব করে দেখি।

অঘোর গনতকার তার তক্তপোশে বসে একটা খেরোর খাতায় খাগের কলম দিয়ে কয়েকটা নকশা এঁকে প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর বলল, “সে তো এখন বিস্তর ধনের মালিক।”

‘ধন? কই, ধনদৌলত তো কিছু দেখতে পেলাম না।’

‘কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি।

হঠাৎ তার কপাল ফিরল কেন? সে কি দেবতার বর পেল নাকি?

না। সে পেয়েছে একটা পাথর।

‘পাথর?’

হ্যাঁ, পাথর। তার জোরেই তার কপাল ফিরেছে। এই পাথরের নাম সাতশিরা। তার বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। তবে সে নিজে তা বোঝে না। সে অতি সরল মানুষ।’

তার ধন কোথায় আছে বলতে পারেন?

তার খাটের নীচে। তিন সহস্র স্বর্ণমুদ্রা।

রঘুনাথ গনতকারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সে সোজা গেল কেষ্টপুর। তার লক্ষ্য মহেশ চোরের বাড়ি।

মহেশের বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি, পাকানো শরীর, নাকের নীচে পুরু গোঁফ আর গালে গালপাট্টা।

‘দাদা!’ বলল রঘুনাথ মহেশের হাত ধরে, ‘তিন সহস্র স্বর্ণমুদ্রা!

কী ব্যাপার?

রঘুনাথ তাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল।

‘এই কথা?’ শুনে বলল মহেশ। খাটের তলায় আছে পেতলের ঘটি?

হাঁ, দাদা! তুমি আনতে পারলে তিনের দুই ভাগ তোমার। এক ভাগ আমার।’

তা বেশ, বলল মহেশ। পরশু অমাবস্যা। পরশু যাব।’

মহেশের মতো চতুর চোর এ-তল্লাটে আর কেউ ছিল না। সে যে কতবার পেয়াদার চোখে ধুলো দিয়েছে তার হিসেব নেই। অমাবস্যার রাতে সিঁদকাঠি নিয়ে বৈকুণ্ঠগ্রামে গঙ্গারামের বাড়িতে এসে সে কাজ শুরু করে দিল। নিশুতি রাত, ফাল্গুন মাস, কিন্তু শীত এখনও পুরোপুরি যায়নি। মহেশ এসে পৌঁছেছে রাত তিনটেয়, যখন লোকের ঘুম হয় সবচেয়ে গভীর। এসেই প্রায় শব্দ না করে সে সিঁদ কাটতে শুরু করে দিয়েছে।

কিন্তু তাকে বেশি দূর এগোতে হল না। দু’দিন হল বৃষ্টি হয়ে গেছে, শীতকালের লম্বা-ঘুম-ভাঙা এক কালসাপ ছিল কাছাকাছির মধ্যে, সেটা নিঃশব্দে এসে মহেশের গোড়ালিতে মারল একটা ছোবল। মহেশের হাত থেকে সিঁদকাঠি পড়ে গেল, আর দু’মিনিটের মধ্যে তার নিষ্প্রাণ দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

পরদিন সকালে গঙ্গারামই দেখল প্রথমে চোরের মৃতদেহ। সে বুঝল কী হয়েছে, কিন্তু তার বাড়িতে চোর সিঁদ কাটতে আসবে কেন সেটা সে বুঝল না।

এদিকে মহেশের কী দশা হয়েছে সেটা রঘুনাথ জানতে পেরেছে। সে বুঝল তার পিসতুতো ভাইয়ের কী আশ্চর্য কপাল। এইভাবে চুরি করে তো তার কাছ থেকে টাকা আদায় করা যাবে না। অন্য কী পন্থা নেওয়া যায় সেই নিয়ে সে ভাবতে বসল।

এদিকে গঙ্গারামের যে কপাল খুলেছে তার আরও প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার মামার বাত আপনা থেকেই অনেকটা ভাল হয়ে গেছে: মামার মেজাজটা ছিল খিটখিটে, আজকাল সেটাও বদলে গিয়ে অনেক নরম হয়ে গেছে। মামা বলছে গঙ্গারামের জন্য এবার একটা পাত্রী খুঁজতে হবে। গঙ্গারাম এটাকেও কপাল ফেরার লক্ষণ বলে মনে করে, কারণ বিয়েতে তার আপত্তি নেই। বেশ একজন সুখ-দুঃখের সাথি হবে, ঘরকন্নার কাজ করার লোক হবে, আর সে মেয়ে যদি ফুটফুটে হয় তা হলে তো কথাই নেই। ফুল যেমন সুন্দর, সকাল-সন্ধ্যার আকাশ যেমন সুন্দর, পাখির ডাক যেমন সুন্দর, তেমনই তার বউও সুন্দর হয় এটা গঙ্গারাম চায়।

এই সময় একদিন এক হাটবারে হাটে ঢ্যাঁড়া শোনা গেল। বৈকুণ্ঠগ্রাম থেকে সাত ক্রোশ দূরে কনকপুর শহর, সেই শহর থেকে ঢ্যাঁড়া দিতে এসেছে। ঘোষণাটা এই

কনকপুরের রাজকন্যার একটা সাতশিরা পাথর ছিল, সেটা একটা বাঁদর রাজবাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে নিয়ে যায়। সেই থেকে রাজবাড়িতে নানা দুর্ঘটনা ঘটেছে। রাজকন্যার মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে, তার শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে। এই সাতশিরা পাথরে রামধনুর সাতটা রংই শিরায় শিরায় ফুটে বেরোয়। সে পাথর যদি কারও কাছে থেকে থাকে তা হলে সেটা ফেরত দিলে রাজা সে লোককে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দেবে।

গঙ্গারাম শুনল ঘোষণাটা, তারপর একটা গাছের আড়ালে গিয়ে ট্যাঁক থেকে পাথরটা বার করে দেখল সেটার দিকে মন দিয়ে। হ্যাঁ, এতেও তো শিরায় শিরায় সাতটা রংই দেখা যায়। এই কি তা হলে সাতশিরা পাথর?

গঙ্গারাম মনে মনে ঠিক করল সে কনকপুর যাবে, আর গিয়ে রাজাকে জিজ্ঞেস করবে এই পাথরই সেই পাথর কি না। যদি তাই হয় তা হলে সে পাথরটা ফেরত দিয়ে দেবে। সেটা তার সাধের জিনিস সন্দেহ নেই, কিন্তু রাজকুমারীর অবস্থা শুনে তার মনে আঘাত লেগেছে। কারও দুঃখ গঙ্গারাম সইতে পারে না। সে দুঃখ দূর করার ক্ষমতা যদি তার থাকে তা হলে সে নিশ্চয়ই তা করবে।

এদিকে কেষ্টপুরেও এই একই ঢ্যাঁড়া পড়েছে, একই ঘোষণা হয়েছে, আর সেটা শুনেছে রঘুনাথ। তার মন বলল তার পিসতুতো ভাইটা যা বোকা, সে নিশ্চয়ই পাথর ফেরত দিতে কনকপুর যাবে। সে নিজে কনকপুরের রাস্তায় ঝোপের পিছনে লুকিয়ে থাকবে, আর ভাই এলেই তাকে ঘায়েল করে তার কাছ থেকে পাথরটা নিয়ে নেবে। নিয়ে সেটা সে নিজের কাছেই রাখবে, রাজাকে ফেরত দেবে না।

গঙ্গারাম পরদিন সক্কাল সক্কাল চাদরের খুঁটে মুড়ি বাতাসা বেঁধে নিয়ে দুগ্গা বলে কনকপুর রওনা দিল।

তিন ক্রোশ পথ যাবার কিছু পরে একটা বনের পাশ দিয়ে যাবার সময় একটা ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে রঘুনাথ হাতে বাঁশের লাঠি নিয়ে ধেয়ে এল গঙ্গারামের দিকে। গঙ্গারাম কিছুই টের পায়নি, কারণ তার পিছন দিক দিয়ে নিঃশব্দে এসেছিল রঘুনাথ। কিন্তু হলে কী হবে? গঙ্গারামের ট্যাঁকে সাতশিরা পাথর। সে লাঠি তার মাথায় পড়তেই সেটা শোলার মতো মট করে ভেঙে গেল। কাণ্ড দেখে রঘুনাথ দিল চম্পট, কারণ সে জানে গঙ্গারামের সঙ্গে খালি হাতে সে পেরে উঠবে না।

কনকপুর পৌঁছতে গঙ্গারামের দুপুর পেরিয়ে গেল। রাজবাড়িটা অনেক দূর থেকেই দেখা যায়। সে সটান চলে গেল ফটকের সামনে। সেখানে প্রহরী তাকে রুখতে সে বলল, “আমি রাজকন্যার জন্য সাতশিরা পাথর এনেছি।”

প্রহরী পাথরটা দেখতে চাইলে গঙ্গারাম ট্যাঁক থেকে বার করে দেখাল। তাতে প্রহরী শুধু তার পথই ছেড়ে দিল না, আরেকজন প্রহরীকে বলে রাজার সঙ্গে দেখা করতে পাঠিয়ে দিল।

রাজা রাজসভায় যাননি, মন্ত্রী রাজকার্য চালাচ্ছেন, রাজা মনের দুঃখে অন্দরমহলে শয্যা নিয়েছেন।

গঙ্গারাম রাজার কাছে গিয়ে তাঁকে গড় করে বলল, ‘মহারাজ, আমি একটা পাথর এনেছি, সেটা সাতশিরা কি না যদি আপনি দেখে নেন।’

রাজা উঠে বসলেন, তাঁর চোখে আশার ঝিলিক।

কই, দেখি তোমার পাথর।

গঙ্গারাম দেখাল।

রাজার দৃষ্টি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এই তো সেই পাথর!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।

তারপর রাজা গঙ্গারামের দিকে চেয়ে বললেন, তুমি দাঁড়াও। তোমার পাওনা পুরস্কারটা তোমাকে দিই; আর তোমার সঙ্গে লোক দিয়ে দিচ্ছি, সে তোমাকে ঘোড়ায় করে তোমার গ্রামে পৌঁছে দেবে। এ-টাকা সঙ্গে নিয়ে হেঁটে যাওয়া নিরাপদ নয়।

কোষাগার থেকে একজন কর্মচারী একটা মখমলের থলিতে এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা এনে গঙ্গারামকে দিল। গঙ্গারাম থলি খুলেই বলল, “আরে, এ জিনিস তো আমার অনেক আছে—এর চেয়ে বেশি আছে। খেতে চাষ করতে গিয়ে মাটির তলা থেকে পেয়েছি। এ জিনিস আর আমার লাগবে না, যথেষ্ট আছে।’

রাজা তো অবাক। এমন কথা তিনি কখনও শোনেননি। তিনি বললেন, এটা তোমার পুরস্কার, তোমার পাওনা। তোমায় নিতেই হবে।

তবে দিন। আপনি যখন এত করে বলছেন তখন বলব না। কিন্তু একটা কথা বলার ছিল, রাজামশাই।

কী কথা?

যাকে এনে দিলাম সাতশিরা পাথর, সেই রাজকন্যাকে বড় দেখতে ইচ্ছা করছে। আমি কোনও দিন রাজকন্যা দেখিনি।

রাজা চোখ কপালে তুলে বললেন, এ কেমন কথা বললে তুমি! রাজকন্যাকে দেখা কি মুখের কথা? সে থাকে তার নিজের ঘরে; তার বিয়ের কথা হচ্ছে। সে তো আর খুকি নয়!

“সে তো আমারও বিয়ের কথা হচ্ছে, রাজামশাই, বলল গঙ্গারাম। আমি বলি দেখতে দোষটা কী? একবার দেখেই আমি চলে যাব।’

এমন সময় সকলকে অবাক করে দিয়ে রাজার ঘরের পর্দা সরিয়ে এক পরমাসুন্দরী মেয়ে এসে ঘরে

‘এ কী, সুনয়না!’ রাজা অবাক হয়ে বলে উঠলেন।

‘যে আমার পাথর এনে দিয়েছে তাকে একবার দেখতে ইচ্ছা হল,বলল রাজকন্যা সুনয়না। এই পাথর যে হাতছাড়া করতে পারে সে তো যেমন-তেমন লোক নয়। এমন পয়া পাথর তো আর হয় না। এতে মানুষের ভাগ্য ফিরে যায়।

গঙ্গারাম অবাক হয়ে রাজকন্যার দিকে চেয়ে বলল, ‘এ কথা বোধহয় ঠিকই, কারণ এটা পাবার পর থেকেই আমার মতো গরিবের কপালও খুলে গিয়েছিল। এখন যখন পাথরটা চলে গেল—

তখন আবার যেই কে-সেই হয়ে যাবে তুমি,”বলল রাজকন্যা। আমি এ পাথর ফেরত চাইনি, বাবাই জোর করে ঘোষণা করেছিলেন। আমাদের সত্যি করে কোনও অভাব নেই, অভাব তো তোমারই।’

‘অভাবের মধ্যেই তো মানুষ হয়েছি,’ বলল গঙ্গারাম, তাই অভাবের অভাবটা যে কী তা জানিই না। তবে একটা কথা বলতে পারি—এই পাথর আমাকে অনেক স্বর্ণমুদ্রা এনে দিয়েছে। অ্যাদ্দিন বুঝতে পারিনি, আজ বুঝলাম। আমার মনে হয় বাকি জীবনটা তাতে স্বচ্ছন্দে চলে যাবে। আমার আর কোনও পাথরের দরকার নেই। ওটা তোমার জিনিস ছিল, তোমার কাছেই থাক।

‘কিন্তু একটা কথা বলি, এই পাথরের গুণে পাওয়া স্বর্ণমুদ্রা এই পাথর চলে গেলে আর নাও থাকতে পারে। তখন তুমি কী করবে?

‘পাথর পাওয়ার আগে যেমন ভাবে চলছিল তেমন ভাবেই চলবে।

তা কেন? পাথর তো দু’জনের কাছেই থাকতে পারে, সকলকে অবাক করে দিয়ে বলল রাজবন্যা।

‘এটা ঠিক বলেছ,’ বলল গঙ্গারাম, যদি তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয় তা হলেই তো দু’জনের কাছেই থাকবে পাথর।

রাজাকে এবার বাধ্য হয়ে কথা বলতে হল। তিনি গঙ্গারামের দিকে চেয়ে বললেন, সব তো বুঝলাম। কিন্তু আমি তো আর বেশি দিন নেই, আর আমার কোনও ছেলেও নেই। আমি না থাকলে তুমি রাজকার্য চালাতে পারবে?’

গঙ্গারাম বলল, ‘অ্যাদ্দিন খেতে লাঙল চালালাম, এখন না হয় রাজ্য চালাব। ফসল ফলানোও তো সহজ কাজ নয়! তাতে অনেক বুদ্ধি লাগে, অনেক পরিশ্রম লাগে। আর রাজকার্যের অর্ধেক কাজ তো করে মন্ত্রী, আপনি আর একা কত করেন রাজামশাই?

‘সেকথা ঠিকই,’ বললেন রাজামশাই।

তবে কোনও ভাবনা নেই,বলল গঙ্গারাম। তারপর বলল, তা হলে এবার চলি। আপনি এদিকে তোড়জোড় করুন, দিনক্ষণ দেখুন। আমার মামাকে আবার খবরটা দিতে হবে।…চলি রাজকন্যা, আবার পরে দেখা হবে। ভাল কথা—আমার নাম গঙ্গারাম।

দরজার পাশ থেকে রাজকন্যা একটা খুশির হাসি হেসে পর্দা ফেলে দিয়ে চলে গেল।

বাড়ি ফিরে এসেই চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে গঙ্গারাম পাথরের অভাবটা হাড়ে হাড়ে টের পেল। মামার বাতটাও শুনল বেড়েছে। আর সবচেয়ে যেটা অবাক কাণ্ড—খাটের তলা থেকে কলসি বার করে দেখল তার ভিতর রয়েছে শুধু মাটি।

কিন্তু এর কোনওটাই সে গ্রাহ্য করল না, কারণ যা হতে চলেছে, তাতে তার কপাল মন্দ এটা আর বলা চলে না।

১৪ মে ১৯৮৬

সকল অধ্যায়

১. ভারত যুদ্ধে পিঁপড়ে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২. বিড়ালের চোখ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ – শিবরাম চক্রবর্তী
৪. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৫. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ‘তেনা-রা’ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. লালটেম – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৯. অশরীরী – লীলা মজুমদার
১০. রাজপুত্তুরের অসুখ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১১. ভূতেরা বড় মিথ্যুক – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১২. রুকু আর সুকু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৩. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
১৪. ম্যাজিশিয়ান – বিমল কর
১৫. ঘণ্টাকর্ণের কান গেল – মনোজ বসু
১৬. খুনি – সমরেশ মজুমদার
১৭. বনকুঠির রহস্য – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৮. একদম রূপকথা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. তারিণীখুড়ো ও ডুমনিগড়ের মানুষখেকো – সত্যজিৎ রায়
২০. অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য – সত্যজিৎ রায়
২১. দেবতার ভর – সুকুমার সেন
২২. মজারুমামা – আশাপূর্ণা দেবী
২৩. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
২৪. গঙ্গারামের কপাল – সত্যজিৎ রায়
২৫. গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুক – সমরেশ বসু
২৬. ভুনিকাকার চৌরশতম্‌ – বিমল কর
২৭. অনুকূল – সত্যজিৎ রায়
২৮. ক্যাপ্টেন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২৯. তুরুপের তাস চুরি – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩০. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩১. রুপোর গাছ – বাণী বসু
৩২. বনঝাউয়ার রহস্য – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৩. জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু
৩৪. একটি লাল লঙ্কা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. টিকটিকি অতীন্দ্রিয় শক্তি ও বেদান্ত বর্ধন -আশাপূর্ণা দেবী
৩৬. নদুস্কোপ – রূপক সাহা
৩৭. আতাপুরের দৈত্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৮. নিখোঁজ চারু – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৯. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪০. কপালের নাম গোপাল – আশাপূর্ণা দেবী
৪১. শিমুলতলার মাধবী লজ – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪২. কানকাটা বাঘ – শৈলেন ঘোষ
৪৩. হিংসুটে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৪. হরিণ-শিকারির বাড়ি – হর্ষ দত্ত
৪৫. অর্জুন হতভম্ব – সমরেশ মজুমদার
৪৬. কেউ কি এসেছিলেন – বিমল কর
৪৭. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৮. মজাদার এক ফুটবল ম্যাচ আর দানাপুরি – বিমল কর
৪৯. চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. বন্ধু – তিলোত্তমা মজুমদার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন